ইসলামী সৈন্য তাবুকে অবতরণ করে শিবির স্থাপন করলেন। রোমকগণের সঙ্গে দুই দুই হাত করার জন্য তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সৈন্যদের উদ্দেশ্য করে জাওয়ামেউল কালাম দ্বারা (এক সারগর্ভ) ভাষণ প্রদান করেন। এ ভাষণে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ নির্দেশাবলী প্রদান করেন, দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের প্রতি উৎসাহিত করেন, আল্লাহর শাস্তির ভয় প্রদর্শন এবং তাঁর রহমতের শুভ সংবাদ প্রদান করেন। নাবী কারীম (ﷺ)-এর এ ভাষণ সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধি করে। তাঁদের খাদ্য সম্ভার ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ঘাটতি জনিত যে অসুবিধা ছিল এ ভাবে মনস্তাত্মিক স্বস্তিবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে বহুলাংশে তা পূরণ করা সম্ভব হল।
অন্য দিকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও মুসলিম বাহিনীর আগমনের সংবাদ অবগত হয়ে রুমী এবং তাদের মিত্র গোত্রসমূহের মধ্যে এমন ভয় ভীতির সঞ্চার করে যে, সামনে অগ্রসর হয়ে তাঁদের মোকাবেলা করার সাহস তারা হারিয়ে ফেলল এবং বিক্ষিপ্ত হয়ে দেশের অভ্যন্তরভাগে বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ল। রুমীদের এ ভয় ভীতিজনক নিষ্ক্রিয়তা আরব উপদ্বীপের ভিতরে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করল এবং মুসলিম বাহিনীর জন্য তা এমন সব রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা লাভের ক্ষেত্র তৈরি করে দিল যুদ্ধের মাধ্যমে যা অর্জন করা মোটেই সহজ সাধ্য ছিল না। এ সবের বিস্তারিত বিবরণ হচ্ছে যথাক্রমে নিম্নরূপ :
আয়লার প্রশাসক ইয়াহনাহ্ বিন রুবা নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে কর দানের স্বীকৃতি জ্ঞাপন করে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করল। জারবা এবং আজরুহর অধিবাসীগণও খিদমতে নাবাবীতে হাজির হয়ে কর দানের প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের লিখিত প্রমাণ প্রত্র প্রদান করেন যা তাদের নিকট সংরক্ষিত ছিল। তিনি আয়লার প্রশাসকের নিকটও লিখিত একটি প্রমাণ পত্র প্রেরণ করেন যার বিষয়বস্তু হচ্ছে নিম্নরূপ:
(بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ، هٰذِهِ أَمَنَةٌ مِّنْ اللهِ وَمُحَمَّدِ النَّبِيِّ رَسُوْلِ اللهِ لِيَحْنَةَ بْنِ رُؤْبَةَ وَأَهْلِ أَيْلَةِ، سفنِهِمْ وَسِيَارَاتِهِمْ فيِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ لَهُمْ ذِمَّةُ اللهِ وَذِمَّةُ مُحَمَّدِ النَّبِيِّ، وَمَنْ كَانَ مَعَهُ مِنْ أَهْلِ الشَّامِ وَأَهْلِ الْبَحْرِ، فَمَنْ أَحْدَثَ مِنْهُمْ حَدَثاً، فَإِنَّهُ لَا يَحُوْلُ مَالهُ دُوْنَ نَفْسِهِ، وَإِنَّهُ طِيْبٌ لِمَنْ أَخَذَهُ مِنْ النَّاسِ، وَأَنَّهُ لَا يَحِلُّ أَنْ يَّمْنَعُوْا مَاءً يُرَدُّوْنَهُ، وَلَا طَرِيْقاً يُرِيْدُوْنَهُ مِنْ بَرٍّ أَوْ بَحْرٍ)
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম : এ হচ্ছে শান্তির আদেশ পত্র আল্লাহর এবং নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পক্ষ হতে ইয়াহনাহ বিন রুবা এবং আয়লার অধিবাসীদের জন্য স্থল এবং সমুদ্র পথে তাদের নৌকা এবং ব্যবসায়ী দলের জিম্মা আল্লাহর এবং নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর রইল। তাছাড়া, এ দায়িত্ব সিরিয়া এবং ঐ সকল সমুদ্র তীরবর্তী অধিবাসীদের জন্য রইল যারা ইয়াহনার সঙ্গে থাকে। হ্যাঁ, যদি তাদের কোন ব্যক্তি কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তবে তার অর্থ তার জীবন রক্ষা করবে না এবং যে ব্যক্তি তার অর্থ নিয়ে নেবে তার জন্য তা বৈধ হবে। তাদেরকে কোন ঝর্ণার নিকট অবতরণ করতে এবং স্থল কিংবা জলভাগের কোন পথ অতিক্রম করতে বাধা দেয়া যাবে না।
এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চারশ’ বিশ জন সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত এক বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ)-কে দুমাতুল জান্দালের শাসক উকায়দেরের নিকট প্রেরণ করেন। যাত্রাকালে তিনি তাঁকে বলেন, (إِنَّكَ سَتَجِدُهُ يَصِيْدُ الْبَقَرَ) ‘তোমরা তাকে নীল গাভী শিকার করার সময় দেখতে পাবে।’
রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ মোতাবেক খালিদ (রাঃ) তথায় গমন করলেন। মুসলিম বাহিনী যখন এতটুকু দূরত্বে অবস্থান করছিলেন যে দূর্গটি পরিস্কার চোখে পড়ছিল তখন হঠাৎ একটি নীল গাভী বেরিয়ে এসে দূর্গের দরজার উপর শিং দ্বারা গুঁতো দিতে থাকল। উকায়দের তাকে শিকার করার জন্য বাহির হলে খালিদ (রাঃ) এবং তাঁর ঘোড়সওয়ার দল তাকে বন্দী করে ফেললেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে প্রেরণ করলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে ক্ষমা করলেন এবং দুই হাজার উট, আটশ’ দাস, যুদ্ধের চারশ’ লৌহ বর্ম এবং চারশ’ বর্শা দেয়ার শর্ত সাপেক্ষে একটি সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করেন। এ সন্ধি চুক্তিতে কর প্রদানের শর্তও সংযোজিত হল। সুতরাং তিনি তার সাথে ইয়াহনাহ্সহ দুমাহ, তাবুক, আয়লাহ এবং তাইমার শর্তানুযায়ী চুক্তিতে আবদ্ধ হলেন।
যে সকল গোত্র তখনো রোমকগণের পক্ষে কাজ করছিল, পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যখন তারা অনুধাবন করল যে, পুরাতন ব্যবস্থাধীনে থাকার দিন শেষ হয়েছে তখন তারা নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে মুসলিমগণের সঙ্গে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল। এভাবে ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমা বিস্তৃতি লাভ করে রোমক সাম্রাজ্যের প্রান্ত সীমা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। ফলে যে সকল গোত্র রোমকদের শক্তি জোগাত তারা একদম নিঃশেষ হয়ে গেল।