নাবী (ﷺ)-এর শিক্ষা-দীক্ষার বিষয়াদির বিকৃত করে দেখানো, নবী (ﷺ)-এর শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে জনমনে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি করা এবং মিথ্যা ও অপপ্রচার করা, নাবী (ﷺ)-এর শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি সব কিছুকে অর্থহীন ও আজেবাজে প্রশ্নের সম্মুখীন করা, এ সবগুলো অনবরত এত অধিক পরিমানে করা যাতে জনসাধারণ তার দ্বীন প্রচারের দিকে ধীর স্থিরভাবে মনযোগ দেয়া কিংবা চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ না পায়। মুশরিকগণ যেমন কুরআন সম্পর্কে বলেছেন: (أَضْغَاثُ أَحْلَامٍ) ‘এসব অলীক স্বপ্ন’ রাত্রে তৈরি করে আর দিনে সে তিলাওয়াত করে (بَلِ افْتَرَاهُ) সে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে অর্থাৎ সে নিজের পক্ষ থেকে বানিয়েছে এবং তারা এও বলে যে, (إِنَّمَا يُعَلِّمُهُ بَشَرٌ) ‘এক মানুষ তাকে (মুহাম্মাদ (সা)-কে) শিখিয়ে দেয়’ (আন-নাহল : ১০৩) তারা বলে, إِنْ هَٰذَا إِلَّا إِفْكٌ افْتَرَاهُ وَأَعَانَهُ عَلَيْهِ قَوْمٌ آخَرُونَ
‘কাফিররা বলে- ‘এটা মিথ্যে ছাড়া আর কিছুই নয়, সে তা (অর্থ্যাৎ কুরআন) উদ্ভাবন করেছে এবং ভিন্ন জাতির লোক এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছে’। (আল-ফুরক্বান ২৫ : ৪)
وَقَالُوا أَسَاطِيرُ الْأَوَّلِينَ اكْتَتَبَهَا فَهِيَ تُمْلَىٰ عَلَيْهِ بُكْرَةً وَأَصِيلًا
“তারা বলে, এগুলো পূর্ব যুগের কাহিনী যা সে [অর্থাৎ মুহাম্মাদ (ﷺ)] লিখিয়ে নিয়েছে আর এগুলোই তার কাছে সকাল-সন্ধ্যা শোনানো হয়। (আল-ফুরকান ২৫ : ৫)
কখনো তারা বলত যে, কাহিনদের উপর যেমন জিন ও শয়তান নাযিল তেমনি তার উপরও একজন জিন ও শয়তান নাযিল হয়। একথার প্রতিবাদে আল্লাহ বলেন,
هَلْ أُنَبِّئُكُمْ عَلَىٰ مَن تَنَزَّلُ الشَّيَاطِينُ تَنَزَّلُ عَلَىٰ كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٍ
“তোমাদেরকে কি জানাবো কার নিকট শয়তানরা অবতীর্ণ হয়? তারা তো অবতীর্ণ হয় প্রত্যেকটি ঘোর মিথ্যাবাদী ও পাপীর নিকট”। (আশ্ শুআরা ২৬ : ২২১-২২২)
ওটা তো মিথ্যাবাদী পাপীষ্টের উপর নাযিল হয়। তোমরা আমার মধ্যে কোন মিথ্যাচার ও ফাসেকী পাও না। সুতরাং কুরআনকে কিভাবে তোমরা শয়তানের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বল?
কখনো তারা নাবী (ﷺ) সম্পর্কে বলত, তাকে একপ্রকার পাগলামীতে পেয়েছে, সে কিছু খেয়াল করে সে অনুযায়ী প্রজ্ঞাপূর্ণ শব্দ তৈরি করে যেমন কবিরা করে থাকে। তাদের কথার উত্তরে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِي كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ وَأَنَّهُمْ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ
“তুমি কি দেখো না তারা বিভ্রান্ত হয়ে (কল্পনার জগতে) প্রত্যেক উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়? আর তারা বলে যা তারা করে না।” (আশ শুআরা ২৬ : ২২৫-২২৬)
আয়াতে কথিত গুণ তিনটি কবিদের মধ্যে পাওয়া যায়, কিন্তু নাবী (ﷺ)-এর মধ্যে এগুলো অনুপস্থিত। অধিকন্তু তার অনুসারীগণ হলেন, হিদায়াতপ্রাপ্ত, আল্লাহ ভীরু, সৎকর্মশীল তাদের চরিত্রে, কাজে কর্মে সবক্ষেত্রে। তাদেরকে কোন প্রকার বিভ্রান্ত স্পর্শ করে নি। নাবী (ﷺ) কবিদের মতো উদ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ান না বরং তিনি এক-অদ্বিতীয় প্রতিপালক, এক দীন, এক পথের দিকে আহবান করেন। তিনি যা বলেন তা পালন করেন, যা বলেন না তা করেন না। তবে তিনি কিভাবে কবিদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, আর কবিদের সাথে তার তুলনা-ই বা কিভাবে দেয়া যায়। মুশরিকদের পক্ষে থেকে ইসলাম, কুরআন ও নাবী (ﷺ)-এর উপর আরোপিত প্রত্যেক সন্দেহের ক্ষেত্রে এভাবে সন্তোষজনক উত্তর দান করা হয়।
মুশরিকরা সবচেয়ে বেশি সন্দেহে ছিল প্রথমত তাওহীদ বিষয়ে, দ্বিতীয়ত মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নবুওয়াত-রেসালাতে, তৃতীয়ত মৃতদের পুনরুজীবিত হওয়া ও কিয়ামত দিবসে হাশরের ময়দানে একত্রিত হওয়া নিয়ে। কুরআন তাওহীদ বিষয়ে তাদের সকল প্রকার সন্দেহের যথোপযুক্ত জবাব তো দিয়েছেই, বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশি ও বিস্তারিত আকারে আলোচনা করেছে যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ না থাকে। শুধু তা-ই নয় তাদের বাতিল মা’বুদের অসারতা সম্পর্কে এত বেশি সমালোচনা করেছে যে, এ বিষয়ে আর কোন আলোচনার অবকাশ নেই। সম্ভবত দীন ইসলাম বিষয়ে তাদের ক্রোধ-আক্রোষের পরিমাণ এত বেশি।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আল্লাহ ভীতি, তাঁর মহৎ উদ্দেশ্য, আমানতদারীতা এবং তাঁর নবুওয়াত সত্য বলে জানা সত্ত্বেও কাফিরদের সন্দেহের কারণ এই যে, তারা বিশ্বাস করতো নবুওয়াত-রিসালত এমনই বড় ও মর্যাদাপূর্ণ পদ যে তা কোন মানুষের হাতে অৰ্পন করার মতো নয়। সুতরাং তাদের আক্বীদা-বিশ্বাস মতে যেমন কোন মানুষ রাসূল হতে পারেন না, তেমনি কোন রাসূল কক্ষনো মানুষ হতে পারেন না। ফলে রাসূলল্লাহ (রঃ) যখন তাঁর নবুওয়াতের ঘোষণা দিলেন আর মানুষদেরকে আহবান জানালেন সব উপাস্যকে পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করতে তাদের বিবেক পেরেশান ও হতবাক হলো এবং তারা বলে উঠলো :
مَالِ هَٰذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ ۙ لَوْلَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيرًا
‘ এ কেমন রসূল যে খাবার খায়, আবার হাট-বাজারে চলাফেরা করে ? তার কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় না কেন যে তার সঙ্গে থাকত সতর্ককারী হয়ে?’ (আল-ফুরক্বান ২৫ : ৭)
তার বলে মুহাম্মাদ (ﷺ) তো মানুষ- مَا أَنزَلَ اللَّهُ عَلَىٰ بَشَرٍ مِّن شَيْءٍ
“আল্লাহ কোন মানুষের কাছে কোন কিছুই অবতীর্ণ করেননি।” (আল-আন’আম ৬ ৯১)
তাদের এ দাবী খণ্ডন করে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
قُلْ مَنْ أَنزَلَ الْكِتَابَ الَّذِي جَاءَ بِهِ مُوسَىٰ نُورًا وَهُدًى لِّلنَّاسِ
“বল, তাহলে ঐ কিতাব কে অবতীর্ণ করেছিলেন যা নিয়ে এসেছিলেন মূসা, যা ছিল মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা ও সঠিক পথের দিকদিশারী।” (আল-আন’আম ৬ :৯১)
অথচ তারা জানে যে আল্লাহর নাবী মূসা (আঃ)ও মানুষ ছিলেন। তাছাড়া পূর্ববতী নাবী-রাসূলকেই তার জাতি অস্বীকার করে বলতো-
إِنْ أَنتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِّثْلُنَا [ابراهيم ١٠] قَالَتْ لَهُمْ رُسُلُهُمْ إِن نَّحْنُ إِلَّا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَمُنُّ عَلَىٰ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ [ابراهيم ١١]
“তুমি আমাদেরই মত মানুষ বৈ তো নও,” “তাদের রসূলগণ তাদেরকে বলেছিল, যদিও আমরা তোমাদের মতই মানুষ ব্যতীত নই, কিন্তু আল্লাহ তার বান্দাহদের মধ্যে যার উপর ইচ্ছে অনুগ্রহ করেন।” (ইবরাহীম ১৪ : ১০-১১)
সুতরাং নাবী-রাসূল তো মানুষই হয়ে থাকে; আর রেসালাত ও মানবত্ব- এ উভয়ের কোন তফাৎ নেই।
অধিকন্তু তাদের জানা রয়েছে যে, ইবরাহীম, ইসমাঈল, মূসা (আলাইহিমুস সালাম)- তারা সকলেই মানুষ ও নাবী ছিলেন যে ব্যাপারে তাদের সন্দেহের কোন সুযোগ নেই। কাজে কাজেই তারা বলে, আল্লাহ এই দরিদ্র-ইয়াতিম ব্যতীত আর রিসালাতের দায়িত্ব দেয়ার মতো আর কাউকে পেলেন না যে তাকেই রাসূল করে পাঠাতে হবে? আল্লাহ তা’আলা মক্কার বড় বড় জাদরেল নেতাদের না বানিয়ে এই ইয়াতিমকেই রাসূল মনোনীত করলেন?
وَقَالُوا لَوْلَا نُزِّلَ هَٰذَا الْقُرْآنُ عَلَىٰ رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ
“আর তারা বলে, এই কুরআন কেন অবতীর্ণ করা হলো না দু জনপদের কোন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির উপর?” (আয-যুখরুফ ৪৩ : ৩১)
আল্লাহ তা’আলা তাদের যুক্তি খণ্ডন করে বলেন, (أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَتَ رَبِّكَ)
“তারা কি তোমার প্রতিপালকের রহমত বণ্টন করে?” (আয-যুখরুফ ৪৩ : ৩২)
অর্থাৎ নিশ্চয়ই ওহী আল্লাহ তা’আলার এক বিশেষ রহমত।
اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ
“নবুওয়াতের দায়িত্ব কার উপর অর্পণ করবেন তা আল্লাহ ভালভাবেই অবগত।” (আল-আন’আম ৬ : ১২৪)
আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে তাদের অমূলক সন্দেহের দাঁতভাঙ্গা পেয়ে উপায়ান্তর না দেখে তারা আরেকটি বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করলো তা হলো। তারা বলল, রাসূলগণ হবেন দুনিয়ার রাজা-বাদশা তারা থাকবেন শত শত গোলাম ও পরিচারকবৃন্দ দ্বারা পরিবেষ্টিত, তাদের জীবন হবে অত্যন্ত জাকজমকপূর্ণ ও শান-শওকতপূর্ণ; তাদেরকে দেয়া হবে জীবন-জীবিকার প্রাচুর্যতা। আর মুহাম্মাদ (সঃ)-এর কী রয়েছে? সে জীবন ধানণের সামান্য বস্তুর জন্যও বাজারে যায় আবার সে দাবি করে যে, সে কিনা আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত রাসূল?
وَقَالُوا مَالِ هَٰذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ لَوْلَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيرًا أَوْ يُلْقَىٰ إِلَيْهِ كَنزٌ أَوْ تَكُونُ لَهُ جَنَّةٌ يَأْكُلُ مِنْهَا وَقَالَ الظَّالِمُونَ إِن تَتَّبِعُونَ إِلَّا رَجُلًا مَّسْحُورًا
“তারা বলে- “এ কেমন রসূল যে খাবার খায়, আর হাট-বাজারে চলাফেরা করে? তার কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় না কেন যে তার সঙ্গে থাকত সতর্ককারী হয়ে? কিংবা তাকে ধন-ভাণ্ডার দেয়া হয় না কেন, অথবা তার জন্য একটা বাগান হয় না কেন যা থেকে সে আহার করত? যালিমরা বলে- “তোমরা তো এক যাদুগ্ৰস্ত লোকেরই অনুসরণ করছ।” (আল-ফুরকান ২৫ : ৭-৮)
তাদের এ ভিত্তিহীন ও অমূলক সন্দেহের উপযুক্ত জবাব দেয়া হয়েছে- অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ নবী-রাসূল প্রেরণের মহা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সুমহান বাণীকে ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, সবল-দুর্বল, ইতর-ভদ্র, স্বাধীন বা দাস নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়া। আর যদি ঐসব নাবী রাসূল খুব শান-শওকতপূর্ণ জীবন-যাপন করেন, পরিবেষ্টিত থাকেন অসংখ্য খাদেম ও পরিচারক দ্বারা যে রমক রাজা বাদশাদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে তবে তো দুর্বল ও দরিদ্রশ্রেণীর জনগণ তার ধারে-কাছে পৌছতেও পারবে না এবং তার নবুওয়াত-রিসালত থেকে কোন উপকারও লাভ করতে পারবে না। অথচ এরাই হচ্ছে পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। ফলে রিসালতের মহৎ উদ্দেশ্য ব্যহত তো হবেই, উপরন্তু উপযুক্ত উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।
আর তারা যে মৃত্যুর পর পুনথানের বিষয় অস্বীকার করে তা তাদের এ বিষয়ে আশ্চর্যতাবোধ, বেমানান মনে হওয়া ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই তারা বলে,
(أَإِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًا وَعِظَامًا أَإِنَّا لَمَبْعُوثُونَ أَوَآبَاؤُنَا الْأَوَّلُونَ)
(ذَٰلِكَ رَجْعٌ بَعِيدٌ) وكانوا يقولون
আর আমাদের পূর্বপুরুষদেরকেও (উঠানো হবে)? আমরা যখন মরব এবং মাটি ও হাড়ে পরিণত হব, তখনো কি আমাদেরকে আবার জীবিত করে উঠানো হবে?” ( আস-স-ফফাত ৩৭ : ১৬-১৭) তারা এও বলে যে, “এ ফিরে যাওয়াটা তো বহু দূরের ব্যাপার।” (ক্ব-ফ ৫০ : ৩)
তারা নিতান্ত একটা অদ্ভুত বিষয় সাব্যস্ত করে বলে,
هَلْ نَدُلُّكُمْ عَلَىٰ رَجُلٍ يُنَبِّئُكُمْ إِذَا مُزِّقْتُمْ كُلَّ مُمَزَّقٍ إِنَّكُمْ لَفِي خَلْقٍ جَدِيدٍ أَفْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَم بِهِ جِنَّةٌ
“কাফিরগণ বলে- তোমাদেরকে কি আমরা এমন একজন লোকের সন্ধান দেব যে তোমাদেরকে খবর দেয় যে, তোমরা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেলেও তোমাদেরকে নতুনভাবে সৃষ্টি করা হবে? সে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যে বলে, না হয় সে পাগল। বস্তুতঃ যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তারাই শাস্তি এবং সুদূর গুমরাহীতে পড়ে আছে।” (সাবা ৩৪ : ৭-৮) তাদের কেউ এ কবিতা চরণ আবৃত্তি করে-
أمؤيك ثم بغك ثم حَشرُ ** حديث لخرافة يا أم عمرو
“মৃত্যু বরণ, অতঃপর পুনঃজীবন লাভ, আবার একত্রিতকরণ! হে উম্মু আমরা এটা তো কল্পকাহিনী ব্যতিত আর কিছুই নয়”।
তাদের এ দাবীকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে খণ্ডন করা হয়েছে। বাস্তব অবস্থা এমন দেখা যায় যে, যালিম তার যুলুমের প্রতিফল না ভোগ করেই মারা যায়, অত্যাচারিত ব্যক্তি তার অত্যাচারের বদলা না পেয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, সৎকর্মশীল ব্যক্তি তার সৎকর্মের প্রতিদানপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বেই দুনিয়া ছেড়ে পরপারে চলে যায়, নিকৃষ্ট পাপী তার পাপের প্রতিফল আস্বাদন করার পূর্বেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এমতাবস্থায় যদি পুনরায় জীবন লাভ এবং মৃত্যুর পর উভয় দলের মধ্যে কোন সমতা বিধান করা না হয় বরং সৎকর্মশীল ব্যক্তির চেয়ে নিকৃষ্ট পাপী, অত্যাচারী বিনা শাস্তিতে মৃত্যুবরণ করার সৌভাগ্যলাভে ধন্য হয় তবে তো এমন দাঁড়ায় যে, তা সুস্থ বিবেক তা কক্ষনোই সমর্থন করে না করতে পারে না। আর আল্লাহ তা’আলাও তার এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডতে শুধু ফিতনা ফাসাদের আখড়ায় পরিণত করার নিমিত্তে পরিচালিত করছেন না। তাই আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,
أَفَنَجْعَلُ الْمُسْلِمِينَ كَالْمُجْرِمِينَ مَا لَكُمْ كَيْفَ تَحْكُمُونَ
“আমি কি আত্মসমর্পণকারীদেরকে অপরাধীদের মত গণ্য করব? তোমাদের কী হয়েছে, তোমরা কেমনভাবে বিচার করে সিদ্ধান্ত দিচ্ছ?” (আল-কালাম ৬৮ : ৩৫,৩৬)
أَمْ نَجْعَلُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ كَالْمُفْسِدِينَ فِي الْأَرْضِ أَمْ نَجْعَلُ الْمُتَّقِينَ كَالْفُجَّارِ
“যারা ঈমান আনে আর সৎ কাজ করে তাদেরকে কি আমি ওদের মত করব যারা দুনিয়াতে ফাসাদ সৃষ্টি করে? মুত্তাকীদের কি আমি অপরাধীদের মত গণ্য করব?” (স্ব-দ ৩৮: ২৮)
أَمْ حَسِبَ الَّذِينَ اجْتَرَحُوا السَّيِّئَاتِ أَن نَّجْعَلَهُمْ كَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَوَاءً مَّحْيَاهُمْ وَمَمَاتُهُمْ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ
“যার অন্যায় কাজ করে তারা কি এ কথা ভেবে নিয়েছে যে, আমি তাদেরকে আর ঈমান গ্রহণকারী সৎকর্মশীলদেরকে সমান গণ্য করব যার ফলে তাদের উভয় দলের জীবন ও মৃত্যু সমান হয়ে যাবে? কতই না মন্দ তাদের ফায়সালা!” (আল-জাসিয়াহ ৪৫ : ২১)
তাদের মস্তিষ্ক-বিবেক মৃত্যুর পুনরায় জীবন লাভ করারে অসম্ভব মনে করে এর প্রতিবাদে আল্লাহ বলেন,
أَأَنتُمْ أَشَدُّ خَلْقًا أَمِ السَّمَاءُ بَنَاهَا
“তোমাদের সৃষ্টি বেশি কঠিন না আকাশের? তিনি তো সেটা সৃষ্টি করেছেন।” (আন-নাযিআত ৭৯ - ২৭)
أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَلَمْ يَعْيَ بِخَلْقِهِنَّ بِقَادِرٍ عَلَىٰ أَن يُحْيِيَ الْمَوْتَىٰ بَلَىٰ إِنَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
“তারা কি দেখে না যে আল্লাহ, যিনি আকাশ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন আর ওগুলোর সৃষ্টিতে তিনি ক্লান্ত হননি, তিনি মৃতদেরকে জীবন দিতে সক্ষম? নিঃসন্দেহে তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান।” (আল-আহকাফ ৪৬ : ৩৩)
وَلَقَدْ عَلِمْتُمُ النَّشْأَةَ الْأُولَىٰ فَلَوْلَا تَذَكَّرُونَ
“তোমরা তোমাদের প্রথম সৃষ্টি সম্বন্ধে অবশ্যই জান তাহলে (আল্লাহ যে তোমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম এ কথা) তোমরা অনুধাবন কর না কেন?” (আল-ওয়াকিয়াহ ৫৬ : ৬২)
বিবেক-বিবেচনা ও প্রচলিত কথা হলো, মৃত্যুর পর পুনঃজীবন দান, (أَهْوَنُ عَلَيْهِ) “এটা তার জন্য অতি সহজ।” (আর-রূম ৩০ : ২৭)
তিনি আরো বলেন,كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِيدُهُ “যেভাবে আমি সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম, সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করবো।” (আল-আম্বিয়া ২১ : ১০৪)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, (أَفَعَيِينَا بِالْخَلْقِ الْأَوَّلِ) “আমি কি প্রথমবার সৃষ্টি করেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।” (ক্ব-ফ ৫০ : ১৫)
এভাবে একের পর এক তাদের সন্দেহের জবাব দেয়া হয়েছে এমন প্রজ্ঞাপূর্ণভাবে ও গভীর দৃষ্টিকোণ থেকে যা প্রত্যেক চিন্তাশীল ও প্রশস্ত জ্ঞানের অধিকারীদের তৃপ্তিদান করেছে। কিন্তু মুশরিকদের উদ্দেশ্য তো কেবল অহংকার-বড়ত্ব প্রকাশ করা এবং আল্লাহর জমীনে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে তাদের মতামতকে বিশ্ববাসীর উপর চাপিয়ে দেয়া। ফলে তারা তাদের অবাধ্যতার উপরই অটল থাকলো।