প্রকাশ্য দাওয়াতের প্রথম আদেশ (أَوَّلُ أَمْـرٍ بِإِظْهَارِ الدَّعْـوَةِ):

ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ ও পরস্পর সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে মুমিনদের যখন একটি দল সৃষ্টি হলো এবং রিসালাতের বোঝা বহনের মতো যোগ্যতা অর্জিত হলো ও ইসলাম তার নিজ অবস্থানকে কিছুটা শক্তিশালী করতে সক্ষম হলো তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রকাশ্যভাবে ইসলামের দাওয়াত দেয়া ও বাতিল দীন, উপাস্যদেরকে উত্তম পন্থায় প্রতিহত করতে আদিষ্ট হলেন।

এ বিষয়ে সর্ব প্রথম আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী অবতীর্ণ হয়:

‏(‏وَأَنذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْنَ‏)‏ ‏[‏الشعراء‏:‏214‏]‏،

‘‘আর তুমি সতর্ক কর তোমার নিকটাত্মীয় স্বজনদের।’ (আশ-শু‘আরা ২৬ : ২১৪)

এটি হচ্ছে সূরাহ শু‘আরার আয়াত এবং এ সূরাহয় সর্ব প্রথমে মূসা (আঃ)-এর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। এতে মূসা (আঃ)-এর নবুওয়তের প্রারম্ভিক কাল কিভাবে অতিবাহিত হয়েছিল, বনি ইসরাঈলসহ কিভাবে তিনি হিজরত করে ফেরাউনের কবল থেকে পরিত্রাণ লাভ করলেন এবং পরিশেষে কিভাবে স্বদলবলে ফেরাউনকে নিমজ্জিত করা হল সেব কথা বলা হয়েছে। অন্য কথায়, ফেরাউন এবং তাঁর কওমকে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত প্রদান করতে গিয়ে মূসা (আঃ)-কে যে সকল পর্যায় অতিক্রম করতে হয়েছিল এ ছিল সেই কর্মকান্ডের একটি সমন্বিত আলোচনা।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে যখন তাঁর আত্মীয়-পরিজন এবং স্বগোত্রীয় লোকজনদের নিকট দ্বীনের প্রকাশ্য দাওয়াত পেশ করার নির্দেশ দেয়া হল সেই প্রসঙ্গে মূসা (আঃ)-এর ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণাদি এ কারণেই তুলে ধরা হল, যাতে প্রকাশ্য দাওয়াতের পর কিভাবে মিথ্যা এবং বাতিলের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয়ে যায় এবং হক পন্থীদের কিভাবে অন্যায়-অত্যাচারে সম্মুখীন হতে হয় তার একটি চিত্র নাবী কারীম (ﷺ) এবং সাহাবীগণের (রাঃ) সম্মুখে বিদ্যমান থাকে।

দ্বিতীয়তঃ এ সূরাহর মধ্যে নাবী-রাসূলদের মিথ্যা প্রতিপন্নকারী জাতিসমূহ, যথাঃ ফেরাউন ও তার দল ব্যতীত নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়, আদ, সামুদ, ইবরাহীম (আঃ)-এর সম্প্রদায়, লুত (আঃ)-এর সম্প্রদায় এবং আসহাবুল আইকার পরিণতির কথাও উল্লে­খিত হয়েছে। সম্ভবতঃ এর উদ্দেশ্য হচ্ছে যে সকল কওম নাবী-রাসূলদের মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, তাঁদের উপর তাদের হঠকারিতার পরিণতি, কী কৌশলে আল্লাহ তাঁদের ধ্বংস করে দিতে পারেন, তাদের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে এবং ঈমানদারগণ অজস্র বিপদাপদ পরিবেষ্টিত থেকেও আল্লাহর রহমতে কিভাবে পরিত্রাণ লাভ করে থাকেন তা তুলে ধরাই হচ্ছে এর নিগূঢ় উদ্দেশ্য।

আত্মীয়-স্বজনদের নিকট প্রচারের নির্দেশ (الدَّعْـوَةُ فِي الْأَقْرَبِيْنَ):

প্রথম সম্মেলন : যাহোক, এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর নাবী কারীম (ﷺ) বনু হাশিম গোত্রকে একত্রিত করে এক সম্মেলনের আয়োজন করেণ। সেই সম্মেলনে বনু মুত্তালিব বিন আবদে মানাফেরও এক দল লোক উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে উপস্থিত লোকদের সংখ্য ছিল পঁয়তালি­শ জন। সম্মেলনের শুরুতেই আবূ লাহাব আকস্মিকভাবে বলে উঠলেন, ‘দেখ এঁরা সকলেই তোমার নিকট আত্মীয়- চাচা, চাচাত ভাই ইত্যাদি। বাচালতা বাদ দিয়ে এদের সঙ্গে ভালভাবে কথাবার্তা বলার চেষ্টা করবে। তোমার জানা উচিত যে তোমার জন্য সকল আরববাসীদের সঙ্গে শত্রুতা করার শক্তি আমাদের নেই। তোমার আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষে তোমাকে ধরে কারারুদ্ধ করে রাখাই কর্তব্য। সুতরাং তোমার জন্য তোমার পিতৃ-পরিবারই যথেষ্ট। তুমি যদি তোমার ধ্যান-ধারণা এবং কথাবার্তায় অটল থাক তবে এটা অনেক সহজ এবং স্বাভাবিক যে সমগ্র কুরাইশ গোত্র তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে এবং অন্যান্য আরব গোত্র এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবে। তারপর এটা আমার জানার বিষয় নয় যে, স্বীয় পিতৃপরিবারের আর অন্য কেউ তোমার চাইতে বড় সর্বনাশা হতে পারে। আবূ লাহাবের এ জাতীয় অর্থহীন আস্ফালনের প্রেক্ষাপটে নাবী কারীম (ﷺ) সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করলেন এবং ঐ নীরবতার মধ্য দিয়েই সম্মেলন শেষ হয়ে গেল।

দ্বিতীয় সম্মেলনঃ

এরপর নাবী কারীম (ﷺ) স্বগোত্রীয় লোকজনদের একত্রিত করে দ্বিতীয় সম্মেলনের ব্যবস্থা করেন। সম্মেলনে উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন,

‏‏الحَمْدُ لِلهِ، أَحْمَدُهُ وَأَسْتَعِيْنُهُ، وَأُوْمِنُ بِهِ، وَأَتَوَكَّلُ عَلَيْهِ‏.‏ وَأَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ‏

‘‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, আমি তাঁর প্রশস্তি বর্ণনা করছি এবং তাঁরই সাহায্য প্রার্থনা করছি। তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করছি, তাঁর উপরেই নির্ভর করছি এবং সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউই উপাসনার যোগ্য নয়। তিনি একক এবং অদ্বিতীয়, তাঁর কোন অংশীদার নেই।

তারপর তিনি বলেনঃ

‏(‏إِنَّ الرَّائِدَ لَا يَكْذِبُ أَهْلَهُ، وَاللهِ الَّذِيْ لاَ إِلٰهَ إِلاَّ هُوَ، إِنِّىْ رَسُوْلُ اللهِ إِلَيْكُمْ خَاصَّةً وَإِلَى النَّاسِ عَامَّةً، وَاللهِ لَتَمُوْتُنَّ كَمَا تَنَامُوْنَ، وَلَتَبْعَثُنَّ كَمَا تَسْتَيْقِظُوْنَ، وَلَتَحَاسَبْنَ بِمَا تَعْمَلُوْنَ، وَإِنَّهَا الْجَنَّةُ أَبَدًا أَوِ النَّارِ أَبَدًا‏)‏‏

‘‘কল্যাণকামী পথ-প্রদর্শক স্বীয় আত্মীয়-পরিজনগণের নিকট কখনই মিথ্যা বলতে পারেন না, সেই আল্লাহর শপথ যিনি ব্যতীত অন্য কোনই উপাস্য নেই। বিশেষভাবে তোমাদের জন্য এবং সাধারণভাবে বিশ্বের সকল মানুষের জন্য আমি আল্লাহর রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। আল্লাহ জানেন, তোমরা সকলেই সেভাবেই মৃত্যুর সম্মুখীন হবে যেমনটি বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ো এবং সেভাবেই পুনরায় উত্থিত হবে যেমনটি তোমরা ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জাগ্রত হও। পুনরুত্থান দিবসে তোমাদের সফলতা সম্পর্কে হিসাব গ্রহণ করা হবে এবং পুণ্যের ফলশ্রুতি হিসেবে চিরস্থায়ী সুখ-শান্তির আবাস স্থল জন্নাতে ও পাপাচারের ফলশ্রুতি হিসেবে কঠিন আযাব ও দুঃখ কষ্টের আবাসস্থল জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে।

এ কথা শুনে আবূ ত্বালিব বললেন, (জিজ্ঞেস করো না) আমরা কতটুকু তোমার সাহায্য করতে পারব, তোমার উপদেশ আমাদের জন্য কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে এবং তোমার কথাবার্তা কতটুকু সত্য বলে আমরা জানব। এখানে সমবেত লোকজন তোমার পিতৃ-পরিবারের সদস্য এবং আমিও অনুরূপ একজন সদস্য। পার্থক্য শুধু এ টুকুই যে, তোমার সহযোগিতার জন্য তাঁদের তুলনায় আমি অগ্রগামী আছি। অতএব, তোমার নিকট যে নির্দেশাবলী অবতীর্ণ হয়েছে তদনুযায়ী কাজ সম্পাদন করতে থাক। আল্লাহ ভরসা, আমি অবিরামভাবে তোমার কাজকর্ম দেখাশোনা ও তোমাকে সহানুভূতি করতে থাকব। তবে আব্দুল মুত্তালিবের দ্বীন ত্যাগ করতে আমি প্রস্তুত নই।

আবূ লাহাব বললেনঃ ‘আল্লাহর শপথ, এ হচ্ছে অন্যায় এবং দুষ্টামি-নষ্টামি। এর হাত অন্যদের আগে তোমরাই ধরে নাও।’

আবূ লাহাবের মুখ থেকে এ কথা শ্রবণের পর আবূ ত্বালিব বললেন, ‘আল্লাহর শপথ করে বলছি, যতক্ষণ আমার দেহে প্রাণ থাকবে আমি তাঁর হেফাযত বা রক্ষণাবেক্ষণ করতে থাকব।[1]

[1] ইবনুল আসিরঃ ফিকহুস সীরাহ পৃঃ ৭৭ ও ৮৮।

যখন নাবী কারীম (ﷺ) খুব ভালভাবে নিশ্চিত হলেন যে, আল্লাহর দ্বীন প্রচারের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আবূ ত্বালিব তাঁকে সাহায্য করবেন তখন এক দিবস তিনি সাফা পর্বত শিখরে আরোহণ করে জন সাধারণকে আহবান করলেন, (يَا صَبَاحَاه) হায় প্রাতঃকাল[1] ব’লে তা শ্রবণ করে কুরাইশ গোত্রের লোকেরা সেখানে যখন সমবেত হলেন তখন তিনি সকলকে লক্ষ্য করে আল্লাহর একত্ববাদ, স্বীয় নবুওয়ত এবং পরকালীন জীবনের উপর বিশ্বাস স্থাপনের জন্য অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় সকলকে আহবান জানালেন। এ ঘটনার এক অংশ সহীহুল বুখারীতে ইবনে আব্বাস কর্তৃক এইভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ

যখন (وَأَنْذِرْ عَشِيْرَتَكَ الْأَقْرَبِيْ) আয়াত অবতীর্ণ হল তখন নাবী কারীম (ﷺ) সাফা পর্বত শিখরে আরোহন করে কুরাইশ গোত্রের সকলকে লক্ষ্য করে বিশেষ কিছু শব্দ উচ্চারণ করে চিৎকার করতে থাকলেনঃ

‏‏يَا بَنِيْ فِهْرٍ، يَا بِنْيِ عَدِىٍّ، (يَا بَنِيْ فُلَانٍ، يَا بَنِيْ فُلَانٍ، يَا بَنِيْ عَبْدِ مَنَافٍ، يَا بَنِيْ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ‏)

‘‘ওহে বনু ফিহর! ওহে বনু আদী! (ওহে বনু অমুক, ওহে বনু ওমুক, ওহে বনু আবদে মানাফ, ওহে বনু আবদুল মুত্তালিব)

এ আহবান শ্রবণ করে সকলেই সেখানে সমবেত হয়ে গেলেন। এমনকি কোন ব্যক্তির পক্ষে তাঁর উপস্থিতি সম্ভব না হলে ব্যাপারটি সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য তিনি প্রতিনিধি প্রেরণ করলেন। ফলকথা হচ্ছে কুরাইশ গোত্রের সকলকেই সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। আবূ লাহাবও উপস্থিত ছিলেন।

তারপর নাবী কারীম (ﷺ) বললেন,

‏(‏أَرَأَيْتُكُمْ لَوْ أَخْبَرْتُكُمْ أَنَّ خَيْلًا بِالْوَادِىِّ بِسَفْح هٰذَا الْجَبَلِ تُرِيْدُ أَنْ تَغَيَّرَ عَلَيْكُمْ أَكُنْتُمْ مُصَدِّقِىَّ‏؟‏‏)

‘‘হে কুরাইশ বংশীয়গণ! তোমরা বল, আজ (এ পর্বত শিখরে দাঁড়িয়ে) যদি আমি তোমাদিগকে বলি যে, পর্বতের অন্য দিকে এক প্রবল শত্রু সৈন্য বাহিনী তোমাদের যথা- সর্বস্ব লুণ্ঠনের জন্য অপেক্ষা করছে তাহলে তোমরা আমার এ কথার উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে কি?

সকলে সমস্বরে উত্তর করল হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, বিশ্বাস না করার কোনই কারণ নেই। আমরা কখনো আপনাকে মিথ্যার সংস্পর্শে আসতে দেখি নি।

তখন গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলতে লাগলেন ,

‏(‏إِنِّىْ نَذِيْرٌ لَّكُمْ بَيْنَ يَدْى عَذَابٍ شَدِيْدٍ، إِنَّمَا مَثَلِىْ وَمَثَلُكُمْ كَمَثَلِ رَجُلٍ رَأَي الْعَدُوَّ فَانْطَلَقَ يَرْبَأ أَهْلَهُ‏) ‏‏(‏ أَيْ يَتَطَلِّعُ وَيُنْظَرُ لَهُمْ مِنْ مَكَانٍ مُّرْتَفِعٍ لِئَلاَّ يُدْهِمُهُمْ الْعَدُوُّ‏)‏ ‏(‏خَشِىَ أَنْ يَسْبِقُوْهُ فَجَعَلَ يُنَادِىْ‏:‏ يَا صَبَاحَاه‏)

‘‘যদি তাহাই হয়, তবে শ্রবণ করুন। আমি আপনাদেরকে (পাপ ও আল্লাহ দ্রোহিতার ভীষণ পরিণাম ও তজ্জনিত) অবশ্যম্ভাবী কঠোর দন্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি ....।

অতঃপর সাধারণ ও বিশেষভাবে সকলকে সত্যের পথে আহ্বান জানালেন এবং তাদেরকে আল্লাহর কঠিন শাস্তির ভয় প্রদর্শন করে বললেন

“হে কুরাইশগণ, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর এবং তোমাদের নিজেদেরকে আল্লাহর নিকট সঁপে দিয়ে তার সন্তুষ্টি অর্জন করো।”

“হে বনু কা’ব বিন লুহাই, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর। কেননা আমি তোমাদের কোন উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখি না।”

“হে বনু কা’ব বিন মুররাহ, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর।”

“হে বনু কুসাই সম্প্রদায়, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর। কেননা আমি তোমাদের কোন উপকার বা ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখি না।”

“হে বনু আবদে মানাফ সম্প্রদায়, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা কর। কারণ, আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের উপকার বা অপকার কিছুরই মালিক নই। আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য কোন উপকারে আসবো না ।”

“হে বনু আবদে শামস, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচাও।”

“হে বনু হাশিম, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচাও।”

“হে বনু আব্দুল মুত্তালিব সম্প্রদায়, তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুণ থেকে বাঁচাও। কারণ, আমি তোমাদের উপকার বা অপকার কিছুরই মালিক নই। আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য কোন উপকারে আসবো না। আমার নিকট থেকে তোমরা ইচ্ছমতো কোন সম্পদ চেয়ে পার কিন্তু আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য কোন উপকারে আসবো না।”

“হে বনু আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব, আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের জন্য কোন উপকারে আসবো না।”

“হে সাফিয়্যাহ বিনতে আব্দুল মুত্তালিব (রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ফুফু), আমি আপনার জন্য আল্লাহর নিকট কোন উপকারে আসবো না।”

“হে বনু হে ফাত্বিমাহ বিনতে মুহাম্মাদ! তুমি নিজেকে দোযখ থেকে বাঁচাও। কারণ, আমি আল্লাহর নিকট তোমাদের (উপকার-অপকার) কিছুরই মালিক নই। আমি তোমার জন্য আল্লাহর নিকট কিছুই করতে পারবো না। তবে তোমাদের সাথে (আমার) যে আত্মীয়তা রয়েছে তা আমি (দুনিয়াতে) অবশ্যই আর্দ্র রাখব। অর্থাৎ যথাযথভাবে আতীয়তা বজায় রাখবো।”

যখন এ ভীতিপ্রদর্শনমূলক বক্তব্য শেষ হলো সম্মেলন ভেঙ্গে গেল ও লোকজন যার যার মতো চলে গেল, কেউ কোন প্রতিবাদ করল না। কিন্তু আবূ লাহাব মন্দ উদ্দেশ্য নিয়ে নাবী (র)-এর নিকটে এসে বলে উঠলেন, ‘তোর সর্বনাশ হোক! এ জন্য কি তুই এখানে আমাদেরকে সমবেত করেছিস? এর ফলশ্রুতিতে আয়াতে কারীমা অবতীর্ণ হলো :[2]

‏(‏تَبَّتْ يَدَا أَبِيْ لَهَبٍ وَتَبَّ‏)‏ ‏[‏سورة المسد‏:‏1‏]

‘‘আবূ লাহাবের হাত ধ্বংস হোক।’ (আল-মাসাদ ১১১ : ১)

এভাবে উচ্চকণ্ঠে আহানের উদ্দেশ্য ছিল দীনের দাওয়াতের বাণী পৌছে দেয়া। এর মাধ্যমে রাসূল (ﷺ) তার নিকটস্ত লোকেদের মাঝে এটা পরিস্কার করলেন যে, তাঁর রেসালাতকে সত্যায়ন করার অর্থই হলো, রাসূল (ﷺ) এবং তাদের মধ্যে একটা সৌহাদ্যপূর্ণ জীবনের সূত্রপাত করণ। আর আরবে যে আত্মীয় সম্বন্ধের যে মজবুত ভিত্তি রয়েছে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সতর্কবাণীর তুলনায় নিতান্তই নগণ্য।

এর প্রতিধ্বনি মক্কার অলি-গলিতে পৌছেই নি এমন সময় নাযিল হলো

فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ وَأَعْرِضْ عَنِ الْمُشْرِكِينَ

“কাজেই তোমাকে যে বিষয়ের হুকুম দেয়া হয়েছে তা জোরে শোরে প্রকাশ্যে প্রচার কর, আর মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও।” (আল-হিজর : ৯৪)

এ আয়াত অবতীর্ণের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুশরিক সমাজে ও অলি-গলি ঘুরে ঘুরে প্রকাশ্যভাবে দাওয়াত দেয়া শুরু করলেন। তাদের নিকট আল্লাহর কিতাব পড়ে শুনাতে থাকলেন, অন্যান্য রাসূলগণ যা দাওয়াত দিতেন তাই প্রচার করতে থাকলেন অর্থ্যাৎ [يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ] “হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নেই।” এবং দৃষ্টির সামনেই আল্লাহর ইবাদত করতে লাগলেন। অতঃপর তিনি প্রকাশ্য দিবালোকে কুরাইশ নেতাদের সম্মুখে কাবাহ প্রাঙ্গণে সালাত আদায় করতেন। তাঁর দীনের দাওয়াত দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে লাগল এবং একের পর এক লোকজন শান্তির ধর্ম ইসলামে দীক্ষিত হতে থাকলেন। ফলশ্রুতিতে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং যারা ইসলাম গ্রহণ করেন নি

এ উভয় দলের বাড়িতে বাড়িতে হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা-বিরোধীতা ক্রমে বেড়েই চললো এবং কুরাইশগণ সর্বদিক থেকে মুমিনদের ঘৃণা করতে থাকলেন এবং তাদের সাধ্যমত ইসলামের সাথে মন্দ আচরণ করতে লাগলো।

[1] তৎকালীন সময়ে আরবের নিয়ম ছিল ভয়ঙ্কর কোন বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলে কিংবা কেউ দেশবাসীর নিকট কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিচার কিংবা প্রতিকার প্রার্থী হলে পর্বত শীর্ষে আরোহণ করে (ইয়াসাবাহাহ) হায় প্রাতঃকাল বলে চিৎকার করতে থাকত। এতে লোকজন সেখানে সমবেত হতো।

[2] সহীহুল বুখারী ২য় খণ্ড ৭০২ ও ৭৪৩ পৃঃ, সহীহুল মুসলিম ১ম খণ্ড ১১৪ পৃঃ।
হজ্জ যাত্রীগণকে বাধা দেয়ার বৈঠক (المَجْلِسُ الْاِسْتِشَارِيْ لِكَفِّ الْحِجَاجِ عَنْ اِسْتِمَاعِ الدَّعْوَةِ):

যে সময়ের কথা ইতোপূর্বে বলা হল সেই সময়ে কুরাইশগণের সামনে আরও একটি সমস্যা দেখা দিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রকাশ্য প্রচার অভিযানের কয়েক মাস অতিবাহিত হতে না হতেই হজ্জের মৌসুম এসে উপস্থিত হল। যেহেতু এ মৌসুমে আরব ভূমির দূর দূরান্ত থেকে বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধি দলের আগমন আরম্ভ হয়ে যাবে এবং সেহেতু মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁদের নিকটে প্রচারাভিযান শুরু করবেন সেহেতু তাঁর সম্পর্কে সমাগত সকলের নিকট এমন এক কথা বলার প্রয়োজনবোধ করলেন যার ফলে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর ক্রিয়ার সৃষ্টি করবে না। এ প্রেক্ষিতে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা ও সলাপরামর্শের জন্য তাঁরা অলীদ বিন মুগীরার গৃহে সমবেত হলেন। অলীদ বললেন ‘এ ব্যাপারে তোমাদের মতামত ঠিক, কারো যাতে এ নিয়ে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে মতবিরোধ কিংবা মত পার্থক্যের সৃষ্টি না হয় এবং তোমাদের একজনের কথাকে অন্যজন যেন মিথ্যা প্রতিপন্ন না করে।’

অন্যেরা বললেন, ‘আপনি একটা মোক্ষম মন্তব্য ঠিক করে দিন তাহলেই তা আমাদের সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য হবে।’

তিনি বললেন, ‘না তা হবে না বরং তোমরা বলবে এবং আমি তা শুনব।’

ওলীদের এ কথার পর কয়েকজন সমস্বরে উঠলেন ‘আমরা মন্তব্য করব যে, তিনি কাহিন।’

অলীদ বললেন, ‘না আল্লাহর শপথ তিনি কাহিন (গণক) নয়।

আমরা অনেক কাহিন দেখেছি। ইনি তো কাহিনদের মতো গুনগুন করে গান গান না। ছন্দাকারে কবিতা আবৃত্তি করেন না কিংবা কবিতা রচনাও করেন না।’

অন্যরা বললেন, ‘তাহলে আমরা তাঁকে একজন পাগল বলব।’

অলীদ বললেন, ‘না তিনি তো পাগল নন, আমরা পাগল দেখেছি এবং তাঁর রকম সকম সম্পর্কে জানি। এ লোকের মধ্যে পাগলাদের মতো দম বন্ধ করে থাকা, অস্বাভাবিক কোন কাজকর্ম করা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা কিংবা অনুরূপ কোন কিছুই তো দেখি না।’

অন্যেরা বললেন, ‘তাহলে আমরা বলব যে, তিনি একজন কবি।’

অলীদ বললেন, ‘তাঁর মধ্যে কবির কোন বৈশিষ্ট্য নেই যে, তাঁকে কবি বলা হবে। রযয, হাজয, কারীয, মাকবুয, মাবসুত ইত্যাদি সর্বপ্রকার কাব্যরীতি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। যাহোক তাঁর কথাবার্তাকে কিছুতেই কাব্য বলা যেতে পারে না।’

অন্যেরা বললেন, ‘তাহলে আমরা তাঁকে যাদুকর বলব।’

অলীদ বললেন, ‘এ ব্যক্তিকে যাদুকরও বলা যেতে পারে না। আমরা যাদুকর এবং যাদু সংক্রান্ত নানা ফন্দি-ফিকির দেখেছি, তারা সত্যমিথ্যা কত কথা বলে, কত অঙ্গ-ভঙ্গি করে কত যে, ঝাড়-ফুঁক করে এবং গিরা দেয় তার ইয়ত্তা থাকেনা। কিন্তু এ ব্যক্তি তো যাদুকরদের মতো সত্য-মিথ্যা কথা বলা, ঝাড়-ফুঁক কিংবা গিরা দেয়া কোন কিছুই করে না।’

অন্যেরা তখন বললেন, ‘আমরা তাহলে আর কী বলব।’

অলীদ বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, তাঁর কথাবার্তা বড়ই মিষ্টি মধুর, তাঁর ভিত শিকড় বড়ই শক্ত এবং শাখা-প্রশাখা বড়ই মনোমুগ্ধকর। তোমরা তাঁর সম্পর্কে যাই বল না কেন, যাঁরা তাঁর সংস্পর্শে কিছুক্ষণ থাকবেন তাঁরা তোমাদের কথাবার্তাকে অবশ্যই মিথ্যা মনে করবেন। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে পুনরায় তিনি বললেন, ‘তাঁর সম্পর্কে যদি কিছু বলতেই হয় তাহলে খুব জোর যাদুকর বলতে পারো। তাঁর এটা কিছুটা উপযোগী বলে মনে হতে পারে। তিনি এমন সব কথা উত্থাপন করেছেন যা যাদু বলেই মনে হয়। তিনি পিতাপুত্রের মধ্যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, ভাই-ভাইয়ের মধ্যে গোত্রে গোত্রে, আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’

শেষ পর্যন্ত তাঁরা তাঁকে যাদুকর বলার সিদ্ধান্তে একমত হয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।[1]

কোন কোন বর্ণানায় এ কথাও বলা হয়েছে যে, অলীদ যখন তাঁদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিলেন তখন তাঁরা বললেন, ‘আপনি তাহলে আপনার গ্রহণযোগ্য অভিমত ব্যক্ত করুন।’ প্রত্যুত্তরে অলীদ বললেন, ‘আমাকে তবে কিছু চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ দাও।’ এরপর তিনি বহুক্ষণ ধরে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন এবং উল্লে­খিত অভিমত ব্যক্ত করেন।[2]

এ ব্যাপারে অলীদ সম্পর্কে সূরাহ মুদ্দাসসিরের ১৬ টি আয়াত (১১-২৬) অবতীর্ণ হয়েছে :

‏(‏ذَرْنِيْ وَمَنْ خَلَقْتُ وَحِيْدًا وَجَعَلْتُ لَهُ مَالًا مَّمْدُوْدًا وَبَنِيْنَ شُهُوْدًا وَمَهَّدتُّ لَهُ تَمْهِيْدًا ثُمَّ يَطْمَعُ أَنْ أَزِيْدَ كَلَّا إِنَّهُ كَانَ لِآيَاتِنَا عَنِيْدًا سَأُرْهِقُهُ صَعُوْدًا إِنَّهُ فَكَّرَ وَقَدَّرَ فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ ثُمَّ نَظَرَ ثُمَّ عَبَسَ وَبَسَرَ ثُمَّ أَدْبَرَ وَاسْتَكْبَرَفَقَالَ إِنْ هٰذَا إِلَّا سِحْرٌ يُؤْثَرُ إِنْ هٰذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِسَأُصْلِيْهِ سَقَرَ‏)‏ ‏[‏من 11 إلى 26‏]‏

‘১১. ছেড়ে দাও আমাকে (তার সঙ্গে বুঝাপড়া করার জন্য) যাকে আমি এককভাবে সৃষ্টি করেছি। ১২. আর তাকে (ওয়ালীদ বিন মুগীরাহ্কে) দিয়েছি অঢেল ধন-সম্পদ, ১৩. আর অনেক ছেলে যারা সব সময় তার কাছেই থাকে। ১৪. এবং তার জীবনকে করেছি সচ্ছল ও সুগম। ১৫. এর পরও সে লোভ করে যে, আমি তাকে আরো দেই। ১৬. কক্ষনো না, সে ছিল আমার নিদর্শনের বিরুদ্ধাচারী। ১৭. শীঘ্রই আমি তাকে উঠাব শাস্তির পাহাড়ে (অর্থাৎ তাকে দিব বিপদের উপর বিপদ)। ১৮. সে চিন্তা ভাবনা করল এবং সিদ্ধান্ত নিল, ১৯. ধ্বংস হোক সে, কিভাবে সে (কুরআনের অলৌকিকতা স্বীকার করার পরও কেবল অহমিকার বশবর্তী হয়ে নবুওয়াতকে অস্বীকার করার) সিদ্ধান্ত নিল! ২০. আবারো ধ্বংস হোক সে, সে সিদ্ধান্ত নিল কিভাবে! ২১. তারপর সে তাকালো। ২২. তারপর ভ্রু কুঁচকালো আর মুখ বাঁকালো। ২৩. তারপর সে পিছনে ফিরল আর অহংকার করল। ২৪. তারপর বলল- ‘এ তো যাদু ছাড়া আর কিছু নয়, এ তো পূর্বে থেকেই চলে আসছে। ২৫. এটা তো মানুষের কথা মাত্র।’ ২৬. শীঘ্রই আমি তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করব।’ (আল-মুদ্দাসসির ৭৪ : ১১-২৬)

যার মধ্যে কয়েকটি আয়াতে তাঁর চিন্তার ধরণ সম্পর্কিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছেঃ

‏(‏إِنَّهُ فَكَّرَ وَقَدَّرَ فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ ثُمَّ نَظَرَ ثُمَّ عَبَسَ وَبَسَرَ ثُمَّ أَدْبَرَ وَاسْتَكْبَرَ فَقَالَ إِنْ هٰذَا إِلَّا سِحْرٌ يُؤْثَرُ إِنْ هٰذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِ‏) ‏[‏المدثر‏:‏18‏:‏ 25‏]‏

‘‘১৮. সে চিন্তা ভাবনা করল এবং সিদ্ধান্ত নিল, ১৯. ধ্বংস হোক সে, কিভাবে সে (কুরআনের অলৌকিকতা স্বীকার করার পরও কেবল অহমিকার বশবর্তী হয়ে নবুওয়াতকে অস্বীকার করার) সিদ্ধান্ত নিল! ২০. আবারো ধ্বংস হোক সে, সে সিদ্ধান্ত নিল কিভাবে! ২১. তারপর সে তাকালো। ২২. তারপর ভ্রু কুঁচকালো আর মুখ বাঁকালো। ২৩. তারপর সে পিছনে ফিরল আর অহংকার করল। ২৪. তারপর বলল- ‘এ তো যাদু ছাড়া আর কিছু নয়, এ তো পূর্বে থেকেই চলে আসছে। ২৫. এটা তো মানুষের কথা মাত্র।’ (আল-মুদ্দাসসির ৭৪ : ১৮-২৬)

যা হোক, তাঁরা যে সিদ্ধান্ত করলেন তা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে এখন থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকলেন। কিছু সংখ্যক কাফির মক্কায় আগমনকারী হজ্জযাত্রীগণের পথের পাশে কিংবা পথের মোড়ে মোড়ে জটলা করে নাবী কারীম (ﷺ)-এর প্রচার এবং তাবলীগের ব্যাপারে যা ইচ্ছে তাই বলে হজ্জযাত্রীগণকে বিভ্রান্ত করতে শুরু করলেন। নাবী কারীম (ﷺ) সম্পর্কে তাঁদের সতর্ক করে দিয়ে তাঁর সম্পর্কে বহু কিছু বলতে থাকলেন।[3] এ সব ব্যাপারে আবূ ল­াহাব অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

হজ্বের মৌসুমে হজ্ব যাত্রীগণের শিবিরে এবং উকায, মাজিন্নাহ ও যুলমাজায বাজারে নাবী কারীম (ﷺ) যখন আল্লাহর একত্ব এবং দ্বীনের তাবলীগ করতেন তখন আবূ লাহাব তাঁর পিছন পিছন গিয়ে বলতেন, ‘এর কথায় তোমরা কান দিয়ো না। সে মিথ্যুক এবং বেদ্বীন হয়ে গিয়েছে।[4]

এভাবে দৌড় ঝাপের ফল হল যে, হজ্ব পালনের পর হাজীগণ যখন নিজ নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন তখন তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে ভালভাবে অবগত হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। তাছাড়া তাঁরা এ কথাও অবগত হয়ে গেলেন যে মুহাম্মাদ (ﷺ) নবুওয়ত দাবী করেছেন। এভাবে হজ্ব যাত্রীগণের মাধ্যমেই নাবী কারীম (ﷺ)-এর নবুওয়ত এবং ইসলামের প্রাথমিক কথাবার্তা সমগ্র আরব জাহানে বিস্তার লাভ করল।

[1] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৭১ পৃঃ।

[2] ফী যিলালিল কুরআন: পারা ২৯, পৃষ্ঠা ১৮৮।

[3] ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ২৭১ পৃঃ।

[4] তিরমিযী মসনাদে আহমাদ ৩য় খন্ড ৪৯২ পৃঃ ও ৪র্থ ৩৪১ পৃঃ।
বিরুদ্ধাচরণের বিভিন্ন পন্থা (أَسَالِيْبٌ شَتّٰى لِمُجَابَهَةِ الدَّعْوَةِ):

কুরাইশগণ যখন দেখলেন যে, মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে তাঁর দ্বীনের দাওয়াত এবং তাবলীগ থেকে নিবৃত্ত করার কোন কৌশল কার্যকর হচ্ছে না তখন তাঁরা পুনরায় চিন্তাভাবনা করে তাঁর তাবলীগী কর্মকান্ডকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য নানামুখী পন্থা-প্রক্রিয়া অবলম্বন শুরু করলেন। যে সকল পন্থা তাঁরা অবলম্বন করলেন তা হচ্ছে যথাক্রমেঃ

প্রথম পন্থা : উপহাস, ঠাট্টা-তামাশা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, মিথ্যাপ্রতিপন্ন, অকারণ হাসাহাসি (السُّخْرِيَّةُ وَالتَّحْقِيْرُ وَالْاِسْتِهْزَاءُ وَالتَّكْذِيْبُ وَالتَّضْحِيْكُ):

বিভিন্ন অবমাননাকর উক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে নাবী কারীম (ﷺ)-কে তাঁরা জর্জরিত এবং অতীষ্ঠ করে তুলতে চাইলেন। এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমগণকে সন্দেহপরায়ণ, বিপন্ন ও ব্যতিব্যস্ত করে তাঁদের উদ্যম ও কাজের স্পৃহাকে নষ্ট করে দেয়া। এ উদ্দেশ্যে মুশরিকগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে অশালীন অপবাদ এবং গালিগালাজ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। তাঁরা কখনো তাঁকে পাগল বলেও সম্বোধন করতেন। যেমনটি ইরশাদ হয়েছেঃ

‏(‏وَقَالُوْا يَا أَيُّهَا الَّذِيْ نُزِّلَ عَلَيْهِ الذِّكْرُ إِنَّكَ لَمَجْنُوْنٌ‏)‏ ‏[‏الحجر‏:‏6‏]

‘‘তারা বলে, ‘ওহে ঐ ব্যক্তি যার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে! তুমি তো অবশ্যই পাগল।’ (আল-হিজর ১৫ : ৬)

কখনো কখনো নাবী (ﷺ)-কে যাদুকর বলত এবং মিথ্যার অপবাদও দিত। যেমনটি ইরশাদ হয়েছেঃ

‏‏(‏وَعَجِبُوْا أَن جَاءهُم مُّنذِرٌ مِّنْهُمْ وَقَالَ الْكَافِرُوْنَ هٰذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ‏)‏ ‏[‏ص‏:‏4]

‘‘আর তারা (এ ব্যাপারে) বিস্ময়বোধ করল যে, তাদের কাছে তাদেরই মধ্য হতে একজন সতর্ককারী এসেছে। কাফিরগণ বলল- ’এটা একটা যাদুকর, মিথ্যুক।’ (স্ব-দ ৩৮ : ৪)

এ কাফিরগণ নাবী (ﷺ)-এর অগ্রভাগে ও পিছনে ক্রোধান্বিত এবং প্রতি হিংসাপরায়ণ দৃষ্টিভঙ্গী ও মন-মানসিকতা নিয়ে ঘোরাফিরা করত। এ প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ

‏(‏وَإِن يَكَادُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَيُزْلِقُوْنَكَ بِأَبْصَارِهِمْ لَمَّا سَمِعُوْا الذِّكْرَ وَيَقُوْلُوْنَ إِنَّهُ لَمَجْنُوْنٌ‏)‏ ‏[‏القلم‏:‏51]

‘‘কাফিররা যখন কুরআন শুনে তখন তারা যেন তাদের দৃষ্টি দিয়ে তোমাকে আছড়ে ফেলবে। আর তারা বলে, ‘সে তো অবশ্যই পাগল।’ (আল-ক্বালাম ৬৮ : ৫১)

অধিকন্তু, নাবী কারীম (ﷺ) যখন কোথাও গমন করতেন এবং তাঁর দুর্বল ও মজলুম সাহাবীগণ (রাঃ) তাঁর নিকট উপস্থিত থাকতেন তখন এদের লক্ষ্য করে মুশরিকগণ উপহাস করে বলতঃ

‏(‏مَنَّ اللهُ عَلَيْهِم مِّن بَيْنِنَا ‏أَلَيْسَ اللهُ بِأَعْلَمَ بِالشَّاكِرِيْنَ‏)‏ ‏[‏الأنعام‏:‏53]‏

‘‘এরা কি সেই লোক আমাদের মধ্যে যাদেরকে আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন, আল্লাহ কি তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দাহদের সম্পর্কে অধিক অবগত নন?’ (আল-আন‘আম ৬ : ৫৩)

সাধারণতঃ মুশরিকগণের অবস্থা তাই ছিল যার চিত্র নীচের আয়াত সমূহে তুলে ধরা হয়েছেঃ

‏(‏إِنَّ الَّذِيْنَ أَجْرَمُوْا كَانُوْا مِنَ الَّذِيْنَ آمَنُوْا يَضْحَكُوْنَ وَإِذَا مَرُّوْا بِهِمْ يَتَغَامَزُوْنَ وَإِذَا انقَلَبُوْا إِلىٰ أَهْلِهِمُ انقَلَبُوْا فَكِهِيْنَ وَإِذَا رَأَوْهُمْ قَالُوْا إِنَّ هَؤُلَاء لَضَالُّوْنَ وَمَا أُرْسِلُوْا عَلَيْهِمْ حَافِظِيْنَ‏)‏ ‏[‏المطففين‏:‏ 29‏:‏ 33]

‘‘পাপাচারী লোকেরা (দুনিয়ায়) মু’মিনদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত। ৩০. আর তারা যখন তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করত তখন পরস্পরে চোখ টিপে ইশারা করত। ৩১. আর তারা যখন তাদের আপন জনদের কাছে ফিরে আসত, তখন (মু’মিনদেরকে ঠাট্টা ক’রে আসার কারণে) ফিরত উৎফুল্ল হয়ে। ৩২. আর তারা যখন মু’মিনদেরকে দেখত তখন বলত, ‘এরা তো এক্কেবারে গুমরাহ্।’ ৩৩. তাদেরকে তো মু’মিনদের হিফাযাতকারী হিসেবে পাঠানো হয়নি।’ (আল-মুত্বাফফিফীন ৮৩ : ২৯-৩৩)

মুশরিকদের উপহাস, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, হাসাহাসি ও বিভিন্নভাবে আঘাতের মাত্রা এর বাড়িয়ে দিল যে তা নাবী (ﷺ)-কে মর্মাহত করে তুলল। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন,

قَالَ فَمَا خَطْبُكُمْ أَيُّهَا الْمُرْسَلُونَ

“আমি জানি, তারা যে সব কথা-বার্তা বলে তাতে তোমার মন সংকুচিত হয়। (আল-হিজর ১৫ : ৯৭)

অতঃপর আল্লাহ তা’আলা তার অন্তরকে দৃঢ় করলেন এবং এমন বিষয়ের নির্দেশ প্রদান করলেন, যাতে করে তার অন্তর থেকে ব্যথা-বেদনা দূরীভূত হয়। এ মর্মে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,

فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَكُنْ مِنَ السَّاجِدِينَ وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتَّىٰ يَأْتِيَكَ الْيَقِينُ

“কাজেই প্রশংসা সহকারে তুমি তোমার প্রতিপালকের পবিত্রতা ঘোষণা কর, আর সাজদাহকারীদের দলভুক্ত হও। আর তোমার রবের ইবাদত করতে থাক সুনিশ্চিত ক্ষণের (অর্থাৎ মৃত্যুর) আগমন পর্যন্ত। (আল-হিজর ১৫ : ৯৮-৯৯)

অধিকন্তু আল্লাহ তা’আলা ইতোপূর্বেই তাঁর প্রিয় হাবীবকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, এ সব ঠাট্টা-বিদ্রুপকারীদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহ বলেন,

إِنَّا كَفَيْنَاكَ الْمُسْتَهْزِئِينَ الَّذِينَ يَجْعَلُونَ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ ۚ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ

“(সেই) ঠাট্টা-বিদ্রুপকারীদের বিরুদ্ধে তোমার জন্য আমিই যথেষ্ট। যারা আল্লাহর সাথে অন্যকেও ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে, (কাজেই শিরকের পরিণতি কী শীঘ্রই তার জানতে পারবে।” (আল-হিজর ১৫ : ৯৫-৯৬)

আল্লাহ তা’আলা আরো জানিয়ে দিলেন যে, এ অবস্থার শীঘ্রই উন্নতি হবে এবং এ ঠাট্টা-বিদ্রুপ তাদের ক্ষতির কারণ হবে।

وَلَقَدِ اسْتُهْزِئَ بِرُسُلٍ مِنْ قَبْلِكَ فَحَاقَ بِالَّذِينَ سَخِرُوا مِنْهُمْ مَا كَانُوا بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ

“তোমার পূর্বেও রাসূলদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা হয়েছে, অতঃপর যা নিয়ে তারা ঠাট্ট-বিদ্রুপ করত তাই তাদেরকে পরিবেষ্টন করে ফেলল।” (আল-আনআম ৬ : ১০)

দ্বিতীয় পন্থা : সংশয় সন্দেহের উসকানি ও মিথ্যা দাওয়াতের মুখোশ উন্মোচন (إِثَارَةُ الشُّبُهَاتِ وَتَكْثِيْفِ الدِّعَايَاتِ الْكَاذِبَةِ):

নাবী (ﷺ)-এর শিক্ষা-দীক্ষার বিষয়াদির বিকৃত করে দেখানো, নবী (ﷺ)-এর শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে জনমনে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি করা এবং মিথ্যা ও অপপ্রচার করা, নাবী (ﷺ)-এর শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি সব কিছুকে অর্থহীন ও আজেবাজে প্রশ্নের সম্মুখীন করা, এ সবগুলো অনবরত এত অধিক পরিমানে করা যাতে জনসাধারণ তার দ্বীন প্রচারের দিকে ধীর স্থিরভাবে মনযোগ দেয়া কিংবা চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ না পায়। মুশরিকগণ যেমন কুরআন সম্পর্কে বলেছেন: (أَضْغَاثُ أَحْلَامٍ) ‘এসব অলীক স্বপ্ন’ রাত্রে তৈরি করে আর দিনে সে তিলাওয়াত করে (بَلِ افْتَرَاهُ) সে মিথ্যা উদ্ভাবন করেছে অর্থাৎ সে নিজের পক্ষ থেকে বানিয়েছে এবং তারা এও বলে যে, (إِنَّمَا يُعَلِّمُهُ بَشَرٌ) ‘এক মানুষ তাকে (মুহাম্মাদ (সা)-কে) শিখিয়ে দেয়’ (আন-নাহল : ১০৩) তারা বলে, إِنْ هَٰذَا إِلَّا إِفْكٌ افْتَرَاهُ وَأَعَانَهُ عَلَيْهِ قَوْمٌ آخَرُونَ

‘কাফিররা বলে- ‘এটা মিথ্যে ছাড়া আর কিছুই নয়, সে তা (অর্থ্যাৎ কুরআন) উদ্ভাবন করেছে এবং ভিন্ন জাতির লোক এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছে’। (আল-ফুরক্বান ২৫ : ৪)

وَقَالُوا أَسَاطِيرُ الْأَوَّلِينَ اكْتَتَبَهَا فَهِيَ تُمْلَىٰ عَلَيْهِ بُكْرَةً وَأَصِيلًا

“তারা বলে, এগুলো পূর্ব যুগের কাহিনী যা সে [অর্থাৎ মুহাম্মাদ (ﷺ)] লিখিয়ে নিয়েছে আর এগুলোই তার কাছে সকাল-সন্ধ্যা শোনানো হয়। (আল-ফুরকান ২৫ : ৫)

কখনো তারা বলত যে, কাহিনদের উপর যেমন জিন ও শয়তান নাযিল তেমনি তার উপরও একজন জিন ও শয়তান নাযিল হয়। একথার প্রতিবাদে আল্লাহ বলেন,

هَلْ أُنَبِّئُكُمْ عَلَىٰ مَن تَنَزَّلُ الشَّيَاطِينُ تَنَزَّلُ عَلَىٰ كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٍ

“তোমাদেরকে কি জানাবো কার নিকট শয়তানরা অবতীর্ণ হয়? তারা তো অবতীর্ণ হয় প্রত্যেকটি ঘোর মিথ্যাবাদী ও পাপীর নিকট”। (আশ্‌ শুআরা ২৬ : ২২১-২২২)

ওটা তো মিথ্যাবাদী পাপীষ্টের উপর নাযিল হয়। তোমরা আমার মধ্যে কোন মিথ্যাচার ও ফাসেকী পাও না। সুতরাং কুরআনকে কিভাবে তোমরা শয়তানের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বল?

কখনো তারা নাবী (ﷺ) সম্পর্কে বলত, তাকে একপ্রকার পাগলামীতে পেয়েছে, সে কিছু খেয়াল করে সে অনুযায়ী প্রজ্ঞাপূর্ণ শব্দ তৈরি করে যেমন কবিরা করে থাকে। তাদের কথার উত্তরে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِي كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ وَأَنَّهُمْ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ

“তুমি কি দেখো না তারা বিভ্রান্ত হয়ে (কল্পনার জগতে) প্রত্যেক উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়? আর তারা বলে যা তারা করে না।” (আশ শুআরা ২৬ : ২২৫-২২৬)

আয়াতে কথিত গুণ তিনটি কবিদের মধ্যে পাওয়া যায়, কিন্তু নাবী (ﷺ)-এর মধ্যে এগুলো অনুপস্থিত। অধিকন্তু তার অনুসারীগণ হলেন, হিদায়াতপ্রাপ্ত, আল্লাহ ভীরু, সৎকর্মশীল তাদের চরিত্রে, কাজে কর্মে সবক্ষেত্রে। তাদেরকে কোন প্রকার বিভ্রান্ত স্পর্শ করে নি। নাবী (ﷺ) কবিদের মতো উদ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ান না বরং তিনি এক-অদ্বিতীয় প্রতিপালক, এক দীন, এক পথের দিকে আহবান করেন। তিনি যা বলেন তা পালন করেন, যা বলেন না তা করেন না। তবে তিনি কিভাবে কবিদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন, আর কবিদের সাথে তার তুলনা-ই বা কিভাবে দেয়া যায়। মুশরিকদের পক্ষে থেকে ইসলাম, কুরআন ও নাবী (ﷺ)-এর উপর আরোপিত প্রত্যেক সন্দেহের ক্ষেত্রে এভাবে সন্তোষজনক উত্তর দান করা হয়।

মুশরিকরা সবচেয়ে বেশি সন্দেহে ছিল প্রথমত তাওহীদ বিষয়ে, দ্বিতীয়ত মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নবুওয়াত-রেসালাতে, তৃতীয়ত মৃতদের পুনরুজীবিত হওয়া ও কিয়ামত দিবসে হাশরের ময়দানে একত্রিত হওয়া নিয়ে। কুরআন তাওহীদ বিষয়ে তাদের সকল প্রকার সন্দেহের যথোপযুক্ত জবাব তো দিয়েছেই, বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশি ও বিস্তারিত আকারে আলোচনা করেছে যাতে কোন সন্দেহের অবকাশ না থাকে। শুধু তা-ই নয় তাদের বাতিল মা’বুদের অসারতা সম্পর্কে এত বেশি সমালোচনা করেছে যে, এ বিষয়ে আর কোন আলোচনার অবকাশ নেই। সম্ভবত দীন ইসলাম বিষয়ে তাদের ক্রোধ-আক্রোষের পরিমাণ এত বেশি।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আল্লাহ ভীতি, তাঁর মহৎ উদ্দেশ্য, আমানতদারীতা এবং তাঁর নবুওয়াত সত্য বলে জানা সত্ত্বেও কাফিরদের সন্দেহের কারণ এই যে, তারা বিশ্বাস করতো নবুওয়াত-রিসালত এমনই বড় ও মর্যাদাপূর্ণ পদ যে তা কোন মানুষের হাতে অৰ্পন করার মতো নয়। সুতরাং তাদের আক্বীদা-বিশ্বাস মতে যেমন কোন মানুষ রাসূল হতে পারেন না, তেমনি কোন রাসূল কক্ষনো মানুষ হতে পারেন না। ফলে রাসূলল্লাহ (রঃ) যখন তাঁর নবুওয়াতের ঘোষণা দিলেন আর মানুষদেরকে আহবান জানালেন সব উপাস্যকে পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করতে তাদের বিবেক পেরেশান ও হতবাক হলো এবং তারা বলে উঠলো :

مَالِ هَٰذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ ۙ لَوْلَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيرًا

‘ এ কেমন রসূল যে খাবার খায়, আবার হাট-বাজারে চলাফেরা করে ? তার কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় না কেন যে তার সঙ্গে থাকত সতর্ককারী হয়ে?’ (আল-ফুরক্বান ২৫ : ৭)

তার বলে মুহাম্মাদ (ﷺ) তো মানুষ- مَا أَنزَلَ اللَّهُ عَلَىٰ بَشَرٍ مِّن شَيْءٍ

“আল্লাহ কোন মানুষের কাছে কোন কিছুই অবতীর্ণ করেননি।” (আল-আন’আম ৬ ৯১)

তাদের এ দাবী খণ্ডন করে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,

قُلْ مَنْ أَنزَلَ الْكِتَابَ الَّذِي جَاءَ بِهِ مُوسَىٰ نُورًا وَهُدًى لِّلنَّاسِ

“বল, তাহলে ঐ কিতাব কে অবতীর্ণ করেছিলেন যা নিয়ে এসেছিলেন মূসা, যা ছিল মানুষের জন্য আলোকবর্তিকা ও সঠিক পথের দিকদিশারী।” (আল-আন’আম ৬ :৯১)

অথচ তারা জানে যে আল্লাহর নাবী মূসা (আঃ)ও মানুষ ছিলেন। তাছাড়া পূর্ববতী নাবী-রাসূলকেই তার জাতি অস্বীকার করে বলতো-

إِنْ أَنتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِّثْلُنَا [ابراهيم ١٠] قَالَتْ لَهُمْ رُسُلُهُمْ إِن نَّحْنُ إِلَّا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَمُنُّ عَلَىٰ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ [ابراهيم ١١]

“তুমি আমাদেরই মত মানুষ বৈ তো নও,” “তাদের রসূলগণ তাদেরকে বলেছিল, যদিও আমরা তোমাদের মতই মানুষ ব্যতীত নই, কিন্তু আল্লাহ তার বান্দাহদের মধ্যে যার উপর ইচ্ছে অনুগ্রহ করেন।” (ইবরাহীম ১৪ : ১০-১১)

সুতরাং নাবী-রাসূল তো মানুষই হয়ে থাকে; আর রেসালাত ও মানবত্ব- এ উভয়ের কোন তফাৎ নেই।

অধিকন্তু তাদের জানা রয়েছে যে, ইবরাহীম, ইসমাঈল, মূসা (আলাইহিমুস সালাম)- তারা সকলেই মানুষ ও নাবী ছিলেন যে ব্যাপারে তাদের সন্দেহের কোন সুযোগ নেই। কাজে কাজেই তারা বলে, আল্লাহ এই দরিদ্র-ইয়াতিম ব্যতীত আর রিসালাতের দায়িত্ব দেয়ার মতো আর কাউকে পেলেন না যে তাকেই রাসূল করে পাঠাতে হবে? আল্লাহ তা’আলা মক্কার বড় বড় জাদরেল নেতাদের না বানিয়ে এই ইয়াতিমকেই রাসূল মনোনীত করলেন?

وَقَالُوا لَوْلَا نُزِّلَ هَٰذَا الْقُرْآنُ عَلَىٰ رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ

“আর তারা বলে, এই কুরআন কেন অবতীর্ণ করা হলো না দু জনপদের কোন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির উপর?” (আয-যুখরুফ ৪৩ : ৩১)

আল্লাহ তা’আলা তাদের যুক্তি খণ্ডন করে বলেন, (أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَتَ رَبِّكَ)

“তারা কি তোমার প্রতিপালকের রহমত বণ্টন করে?” (আয-যুখরুফ ৪৩ : ৩২)

অর্থাৎ নিশ্চয়ই ওহী আল্লাহ তা’আলার এক বিশেষ রহমত।

اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ

“নবুওয়াতের দায়িত্ব কার উপর অর্পণ করবেন তা আল্লাহ ভালভাবেই অবগত।” (আল-আন’আম ৬ : ১২৪)

আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে তাদের অমূলক সন্দেহের দাঁতভাঙ্গা পেয়ে উপায়ান্তর না দেখে তারা আরেকটি বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করলো তা হলো। তারা বলল, রাসূলগণ হবেন দুনিয়ার রাজা-বাদশা তারা থাকবেন শত শত গোলাম ও পরিচারকবৃন্দ দ্বারা পরিবেষ্টিত, তাদের জীবন হবে অত্যন্ত জাকজমকপূর্ণ ও শান-শওকতপূর্ণ; তাদেরকে দেয়া হবে জীবন-জীবিকার প্রাচুর্যতা। আর মুহাম্মাদ (সঃ)-এর কী রয়েছে? সে জীবন ধানণের সামান্য বস্তুর জন্যও বাজারে যায় আবার সে দাবি করে যে, সে কিনা আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত রাসূল?

وَقَالُوا مَالِ هَٰذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ لَوْلَا أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيرًا أَوْ يُلْقَىٰ إِلَيْهِ كَنزٌ أَوْ تَكُونُ لَهُ جَنَّةٌ يَأْكُلُ مِنْهَا وَقَالَ الظَّالِمُونَ إِن تَتَّبِعُونَ إِلَّا رَجُلًا مَّسْحُورًا

“তারা বলে- “এ কেমন রসূল যে খাবার খায়, আর হাট-বাজারে চলাফেরা করে? তার কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় না কেন যে তার সঙ্গে থাকত সতর্ককারী হয়ে? কিংবা তাকে ধন-ভাণ্ডার দেয়া হয় না কেন, অথবা তার জন্য একটা বাগান হয় না কেন যা থেকে সে আহার করত? যালিমরা বলে- “তোমরা তো এক যাদুগ্ৰস্ত লোকেরই অনুসরণ করছ।” (আল-ফুরকান ২৫ : ৭-৮)

তাদের এ ভিত্তিহীন ও অমূলক সন্দেহের উপযুক্ত জবাব দেয়া হয়েছে- অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ নবী-রাসূল প্রেরণের মহা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সুমহান বাণীকে ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, সবল-দুর্বল, ইতর-ভদ্র, স্বাধীন বা দাস নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়া। আর যদি ঐসব নাবী রাসূল খুব শান-শওকতপূর্ণ জীবন-যাপন করেন, পরিবেষ্টিত থাকেন অসংখ্য খাদেম ও পরিচারক দ্বারা যে রমক রাজা বাদশাদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে তবে তো দুর্বল ও দরিদ্রশ্রেণীর জনগণ তার ধারে-কাছে পৌছতেও পারবে না এবং তার নবুওয়াত-রিসালত থেকে কোন উপকারও লাভ করতে পারবে না। অথচ এরাই হচ্ছে পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। ফলে রিসালতের মহৎ উদ্দেশ্য ব্যহত তো হবেই, উপরন্তু উপযুক্ত উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।

আর তারা যে মৃত্যুর পর পুনথানের বিষয় অস্বীকার করে তা তাদের এ বিষয়ে আশ্চর্যতাবোধ, বেমানান মনে হওয়া ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই তারা বলে,

(أَإِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًا وَعِظَامًا أَإِنَّا لَمَبْعُوثُونَ أَوَآبَاؤُنَا الْأَوَّلُونَ)

(ذَٰلِكَ رَجْعٌ بَعِيدٌ) وكانوا يقولون

আর আমাদের পূর্বপুরুষদেরকেও (উঠানো হবে)? আমরা যখন মরব এবং মাটি ও হাড়ে পরিণত হব, তখনো কি আমাদেরকে আবার জীবিত করে উঠানো হবে?” ( আস-স-ফফাত ৩৭ : ১৬-১৭) তারা এও বলে যে, “এ ফিরে যাওয়াটা তো বহু দূরের ব্যাপার।” (ক্ব-ফ ৫০ : ৩)

তারা নিতান্ত একটা অদ্ভুত বিষয় সাব্যস্ত করে বলে,

هَلْ نَدُلُّكُمْ عَلَىٰ رَجُلٍ يُنَبِّئُكُمْ إِذَا مُزِّقْتُمْ كُلَّ مُمَزَّقٍ إِنَّكُمْ لَفِي خَلْقٍ جَدِيدٍ أَفْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَم بِهِ جِنَّةٌ

“কাফিরগণ বলে- তোমাদেরকে কি আমরা এমন একজন লোকের সন্ধান দেব যে তোমাদেরকে খবর দেয় যে, তোমরা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেলেও তোমাদেরকে নতুনভাবে সৃষ্টি করা হবে? সে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যে বলে, না হয় সে পাগল। বস্তুতঃ যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তারাই শাস্তি এবং সুদূর গুমরাহীতে পড়ে আছে।” (সাবা ৩৪ : ৭-৮) তাদের কেউ এ কবিতা চরণ আবৃত্তি করে-

أمؤيك ثم بغك ثم حَشرُ ** حديث لخرافة يا أم عمرو

“মৃত্যু বরণ, অতঃপর পুনঃজীবন লাভ, আবার একত্রিতকরণ! হে উম্মু আমরা এটা তো কল্পকাহিনী ব্যতিত আর কিছুই নয়”।

তাদের এ দাবীকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে খণ্ডন করা হয়েছে। বাস্তব অবস্থা এমন দেখা যায় যে, যালিম তার যুলুমের প্রতিফল না ভোগ করেই মারা যায়, অত্যাচারিত ব্যক্তি তার অত্যাচারের বদলা না পেয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে, সৎকর্মশীল ব্যক্তি তার সৎকর্মের প্রতিদানপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বেই দুনিয়া ছেড়ে পরপারে চলে যায়, নিকৃষ্ট পাপী তার পাপের প্রতিফল আস্বাদন করার পূর্বেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এমতাবস্থায় যদি পুনরায় জীবন লাভ এবং মৃত্যুর পর উভয় দলের মধ্যে কোন সমতা বিধান করা না হয় বরং সৎকর্মশীল ব্যক্তির চেয়ে নিকৃষ্ট পাপী, অত্যাচারী বিনা শাস্তিতে মৃত্যুবরণ করার সৌভাগ্যলাভে ধন্য হয় তবে তো এমন দাঁড়ায় যে, তা সুস্থ বিবেক তা কক্ষনোই সমর্থন করে না করতে পারে না। আর আল্লাহ তা’আলাও তার এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডতে শুধু ফিতনা ফাসাদের আখড়ায় পরিণত করার নিমিত্তে পরিচালিত করছেন না। তাই আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন,

أَفَنَجْعَلُ الْمُسْلِمِينَ كَالْمُجْرِمِينَ مَا لَكُمْ كَيْفَ تَحْكُمُونَ

“আমি কি আত্মসমর্পণকারীদেরকে অপরাধীদের মত গণ্য করব? তোমাদের কী হয়েছে, তোমরা কেমনভাবে বিচার করে সিদ্ধান্ত দিচ্ছ?” (আল-কালাম ৬৮ : ৩৫,৩৬)

أَمْ نَجْعَلُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ كَالْمُفْسِدِينَ فِي الْأَرْضِ أَمْ نَجْعَلُ الْمُتَّقِينَ كَالْفُجَّارِ

“যারা ঈমান আনে আর সৎ কাজ করে তাদেরকে কি আমি ওদের মত করব যারা দুনিয়াতে ফাসাদ সৃষ্টি করে? মুত্তাকীদের কি আমি অপরাধীদের মত গণ্য করব?” (স্ব-দ ৩৮: ২৮)

أَمْ حَسِبَ الَّذِينَ اجْتَرَحُوا السَّيِّئَاتِ أَن نَّجْعَلَهُمْ كَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَوَاءً مَّحْيَاهُمْ وَمَمَاتُهُمْ سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ

“যার অন্যায় কাজ করে তারা কি এ কথা ভেবে নিয়েছে যে, আমি তাদেরকে আর ঈমান গ্রহণকারী সৎকর্মশীলদেরকে সমান গণ্য করব যার ফলে তাদের উভয় দলের জীবন ও মৃত্যু সমান হয়ে যাবে? কতই না মন্দ তাদের ফায়সালা!” (আল-জাসিয়াহ ৪৫ : ২১)

তাদের মস্তিষ্ক-বিবেক মৃত্যুর পুনরায় জীবন লাভ করারে অসম্ভব মনে করে এর প্রতিবাদে আল্লাহ বলেন,

أَأَنتُمْ أَشَدُّ خَلْقًا أَمِ السَّمَاءُ بَنَاهَا

“তোমাদের সৃষ্টি বেশি কঠিন না আকাশের? তিনি তো সেটা সৃষ্টি করেছেন।” (আন-নাযিআত ৭৯ - ২৭)

أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَلَمْ يَعْيَ بِخَلْقِهِنَّ بِقَادِرٍ عَلَىٰ أَن يُحْيِيَ الْمَوْتَىٰ بَلَىٰ إِنَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

“তারা কি দেখে না যে আল্লাহ, যিনি আকাশ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন আর ওগুলোর সৃষ্টিতে তিনি ক্লান্ত হননি, তিনি মৃতদেরকে জীবন দিতে সক্ষম? নিঃসন্দেহে তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান।” (আল-আহকাফ ৪৬ : ৩৩)

وَلَقَدْ عَلِمْتُمُ النَّشْأَةَ الْأُولَىٰ فَلَوْلَا تَذَكَّرُونَ

“তোমরা তোমাদের প্রথম সৃষ্টি সম্বন্ধে অবশ্যই জান তাহলে (আল্লাহ যে তোমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম এ কথা) তোমরা অনুধাবন কর না কেন?” (আল-ওয়াকিয়াহ ৫৬ : ৬২)

বিবেক-বিবেচনা ও প্রচলিত কথা হলো, মৃত্যুর পর পুনঃজীবন দান, (أَهْوَنُ عَلَيْهِ) “এটা তার জন্য অতি সহজ।” (আর-রূম ৩০ : ২৭)

তিনি আরো বলেন,كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِيدُهُ “যেভাবে আমি সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম, সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করবো।” (আল-আম্বিয়া ২১ : ১০৪)

আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, (أَفَعَيِينَا بِالْخَلْقِ الْأَوَّلِ) “আমি কি প্রথমবার সৃষ্টি করেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।” (ক্ব-ফ ৫০ : ১৫)

এভাবে একের পর এক তাদের সন্দেহের জবাব দেয়া হয়েছে এমন প্রজ্ঞাপূর্ণভাবে ও গভীর দৃষ্টিকোণ থেকে যা প্রত্যেক চিন্তাশীল ও প্রশস্ত জ্ঞানের অধিকারীদের তৃপ্তিদান করেছে। কিন্তু মুশরিকদের উদ্দেশ্য তো কেবল অহংকার-বড়ত্ব প্রকাশ করা এবং আল্লাহর জমীনে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে তাদের মতামতকে বিশ্ববাসীর উপর চাপিয়ে দেয়া। ফলে তারা তাদের অবাধ্যতার উপরই অটল থাকলো।

তৃতীয় পন্থা : অতীতকালের ঘটনাবলী এবং উপাখ্যান সমূহ এবং কুরআন কারীমে বর্ণিত বিষয়াদির মধ্যে অর্থহীন বাগড়া বা প্রতিদ্বন্দ্বীতার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে জনমনে ধাঁধার সৃষ্টি করা এবং মুক্ত চিন্তা-ভাবনার সুযোগ না দেয়া (الْحِيْلُوْلَةُ بَيْنَ النَّاسِ وَبَيْنَ سِمَاعِهِمْ الْقُرْآن, وَمُعَارَضَتُهُ بِأَسَاطِيْرِ الْأَوَّلِيْنَ):

উপযুক্ত সন্দেহের বশবর্তী হয়ে মুশরিকগণ মানুষদেরকে তাদের সাধ্যমত কুরআন ও ইসলামের দাওয়াতের কথা শ্রবণ করতে বাধা প্রদান করতো। তারা যখন দেখতে যে, নাবী (ﷺ) লোকেদেরকে দীনের পথে আহবান করছে বা সালাত আদায় করছে, কুরআন তেলাওয়াত করছে তখন তারা মানুষদেরকে সেখান হতে তাড়িয়ে দিত, হৈচৈ-হৈ-হুল্লোড়, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, হট্টগোল পাকিয়ে দিত, গান গাইতো এবং নানা খেল-তামাশায় মেতে উঠত। এ বিষয়ে কুরআনের বাণী,

وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَسْمَعُوا لِهَٰذَا الْقُرْآنِ وَالْغَوْا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَغْلِبُونَ

“কাফিররা বলে- এ কুরআন শুনো না, আর তা পড়ার কালে শোরগোল কর যাতে তোমরা বিজয়ী হতে পার।” (হা-মীম সাজদাহ ৪১ : ২৬)

অবস্থা এমন করে ফেলতো যে, নবী (ﷺ) সেখানে আর লোকেদের কুরআন তেলাওয়াত শোনাতে পারতেন না। এ অবস্থা পঞ্চম নবুওয়াতী বর্ষের শেষ অবধি চলে। অনেক সময় রাস্তাঘাটে তাঁর তেলাওয়াত করার উদ্দেশ্য না থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে মুশরিকরা এরকম হট্টগোল বাধাত।

প্রসঙ্গক্রমে এখানে নাযর বিন হারিসের ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। সে ছিল কুরাইশদের মধ্যে অন্যতম শয়তান। নযর বিন হারিস একদা হীরাহ চলে গেলেন। সেখানে রাজা-বাদশাহদের ঘটনাবলী, ইরানের বিখ্যাত বীর রুস্তম ও প্রাচীন গ্ৰীক সম্রাট আলেকজান্ডারের কাহিনী শিখলেন। এ সব শেখার পর তিনি মক্কায় প্রত্যাবর্তন করলেন। ঘটনাক্রমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন কোন জায়গায় আল্লাহর নির্দেশাবলী নিয়ে আলোচনা করতেন এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করলে জাহান্নামের ভয়াবহ আযাব সম্পর্কে ভয় প্রদর্শন করতেন তখন সেই ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত হয়ে বলতেন, ‘আল্লাহর শপথ হে কুরাইশগণ! আমার কথা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর কথার চেয়ে উত্তম। এরপর তিনি পারস্য সম্রাটদের, রুস্তম এবং সেকান্দার বাদশাহর (আলেকজান্ডার) কাহিনী শোনাতে আরম্ভ করতেন এবং বলতেন, বল, কোনদিক দিয়ে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর কথা আমার কথার চেয়ে উত্তম।[1]

ইবনে আব্বাসের বর্ণনা সূত্রে এটাও জানা যায় যে, ইসলাম বৈরিতার চরম পর্যায়ের ব্যবস্থা হিসেবে নাযর একাধিক ক্রীতদাসী রেখেছিলেন। যখন তিনি জানতে পারতেন যে, কোন লোক ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছে করছে তখন সেই লোকের প্রতি এক ক্রীতদাসীকে নিয়োজিত করে দিতেন। ক্রীতদাসীকে বলতো তুমি তাকে খাওয়া দাওয়া করাও এবং তার মনোরঞ্জনের জন্য গীত গাও, বাদ্য বাজাও। মুহাম্মাদ যে বিষয়ের প্রতি আহবান করছে এটা তার চেয়ে উত্তম।[2] এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে :

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ

‘কিছু মানুষ আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার উদ্দেশে অজ্ঞতাবশত অবান্তর কথাবার্তা ক্রয় করে আর আল্লাহর পথকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে।’ (লুক্বমান ৩১ :৬)

[1] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ২৯৯-৩০০ পৃঃ, ৩৫৮ পূঃ । শাইখ আবদুল্লাহ মুখতাসারুস সীরাহ পৃঃ ১১৭-১১৮।

[2] ফাতহুল কাদীর, ইমাম শাওকানী, ৪র্থ খণ্ড ২৩৬ পৃঃ ও অন্যান্য তাফসীর গ্রন্থসমূহ।

নবুওয়তের চতুর্থ বছরে যখন প্রথমবার সর্ব সাধারণের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হল, তখন মুশরিকগণ তা প্রতিহত করার কৌশল হিসেবে ঐ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যা ইতোপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। এ কৌশল কার্যকর করার ব্যাপারে তাঁরা ধীরে চলার নীতি অবলম্বন করে অল্প অল্প করে অগ্রসর হতে থাকেন এবং এভাবে এক মাসের বেশী সময় অতিবাহিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁরা কোন প্রকার অন্যায় অত্যাচার আরম্ভ করেন নি। কিন্তু তাঁরা যখন এটা বুঝতে পারলেন যে, তাঁদের ঐ কৌশল ও ব্যবস্থাপনা ইসলামী আন্দোলনের ব্যাপ্তিলাভের পথে তেমন কার্যকর হচ্ছে না, তখন তাঁরা সকলে পুনরায় এক আলোচনা চক্রে মিলিত হন এবং মুসলমানদের শাস্তি প্রদান ও তাদেরকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যেক গোত্রপতি তার গোত্রের ইসলাম গ্রহণকারীদের শাস্তি প্রদান করা শুরু করে দিল। অধিকন্তু ঈমান আনয়নকারী দাস-দাসীদের উপর তারা অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দিল।

স্বাভাবিকভাবেই আরবের নেতা ও গোত্রপতিদের অধীনে অনেক ইতর ও নিম্নশ্রেণীর লোকজন থাকতো। এসব লোকেদের তারা তাদের ইচ্ছেমত পরিচালনা করতো। এদের মধ্যে যারা মুসলামান হতো তাদের উপর তারা চড়াও হতো। বিশেষ করে তাদের মধ্যে যারা দরিদ্র তাদের উপর অত্যাচারের স্টীমরোলার চালাতো। তারা তাদের শরীর থেকে চামড়া ছিলে ফেলাসহ এমন সব পাশবিক আচরণ করতে যা পাষাণ হৃদয় ব্যক্তিটিও প্রত্যক্ষ করে অস্থির কিংবা বিচলিত না হয়ে পারতেন না।

আবূ জাহল যখন কোন সম্ভ্রান্ত বা শক্তিধর ব্যক্তির মুসলিম হওয়ার কথা শুনত তখন সে তাকে ন্যায়-অন্যায় বলে গালি গালাজ করত, অপমান-অপদস্থ করত এবং ধন-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি করবে বলে ভয় দেখাত। জ্ঞাতি গোষ্ঠীর যদি কোন দুর্বল ব্যক্তি মুসলিম হতো তাহলে তাকে সে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে মারধোর করত এবং মারধোর করার জন্য অন্যদের প্ররোচিত করত।[1]

‘উসমান বিন আফফানের চাচা তাকে খেজুর পাতার চাটাইয়ের মধ্যে জড়িয়ে রেখে নীচ থেকে আগুন লাগিয়ে ধোঁয়া দিত’।[2]

মুসআব বিন উমায়ের (রা.)-এর মা যখন তার ইসলাম গ্রহণের খবর পেল তখন সে তার খানা পানি (আহারাদি) বন্ধ করে দিল এবং তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল। প্রথম জীবনে তিনি আরাম আয়েশ ও সুখস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর তিনি এতই কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন যে সর্পের গাত্র থেকে খুলে পড়া খোলসের মতো তার শরীরের চামড়া খুলে খুলে পড়ত।[3]

বিলাল, উমাইয়া বিন খালাফ জুমাহীর ক্রীতদাস ছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় উমাইয়া তার গলায় দড়ি বেঁধে ছোকরাদের হাতে ধরিয়ে দিত। তারা সেই দড়ি ধরে তাঁকে পথে প্রান্তরে টেনে হিচড়ে নিয়ে বেড়াত। এমনকি টানাটানির ফলে তার গলায় দড়ির দাগ বসে যেত। উমাইয়া স্বয়ং হাত পা বেঁধে তাকে প্রহার করত এবং প্রখর রোদে বসিয়ে রাখত। তাকে খানা পানি না দিয়ে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত রাখত। এ সবের চেয়েও অনেক বেশী কঠিন ও কষ্টকর হতো তখন যখন দুপুর বেলা প্রখর রৌদ্রের সময় কংকর ও বালি আগুনের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠত এবং তাকে উত্তপ্ত বালির উপর শুইয়ে দিয়ে তার বুকের উপর পাথর চাপা দেয়া হতো। তারপর বলত আল্লাহর শপথ তুই এভাবেই শুয়ে থাকবি। তারপর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বি। অথবা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সঙ্গে কুফরী করবি। বিলাল(রাঃ) ঐ অবস্থাতেই বলতেন, ‘আহাদ, আহাদ”। (অর্থ আল্লাহ এক, আল্লাহ এক)। একদিন বিলাল (রা.) এমনভাবে এক দুঃসহ অবস্থার মধ্যে নিপতিত ছিলেন তখন আবূ বাকর সিদিক (রা.) সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বিলাল (রা.)-কে এক কালোদাসের বিনিময়ে এবং বলা হয়েছে যে, দু’শত দেহরাম (৭৩৫ গ্রাম রুপা) অথবা দু’শ আশি দিরহামের (১ কেজিরও বেশী রুপা) বিনিময়ে ক্রয় করে মুক্ত করে দেন।[4]

আম্মার বিন ইয়াসির বনু মাখযুমের ক্রীতদাস ছিলেন। তাঁর পিতার নাম ইয়াসির এবং মাতার নাম সুমাইয়া। তিনি এবং তাঁর পিতামাতা সকলে একই সঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের কারণে তাদের উপর কেয়ামতের আযাব ভেঙ্গে পড়ে। দুপুর বেলা প্রখর রোদ্র তাপে মরুভূমির বালুকণারাশি এবং কংকর রাশি যখন আগুণের মতো উত্তপ্ত থাকত তখন আবূ জাহলের নেতৃত্বে মুশরিকগণ তাদেরকে নিয়ে গিয়ে সেই উত্তপ্ত বালি এবং কংকরের উপর শুইয়ে দিয়ে শাস্তি দিত। এক দিবস তাদেরকে যখন সেভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদেরকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, “হে ইয়াসিরের বংশধর ধৈর্য্য ধারণ করো, তোমাদের স্থান জান্নাতে’। অতঃপর শাস্তি চলা অবস্থায় ইয়াসির মৃত্যুবরণ করেন।

পাষণ্ড আবূ জাহল আম্মারের মা সুমাইয়ার নারী অঙ্গে বর্শ বিদ্ধ করে। অতঃপর তিনি মারা যান। মুসলিম মহিলাদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম শহীদ। সুমাইয়া বিনতে খাইয়াত ছিলেন আবূ হুজাইফাহ বিন আব্দুল্লাহ বিন উমার বিন মাখযুমের ক্রীতদাসী। সুমাইয়া ছিলেন অতি বৃদ্ধা এবং দুর্বল।

‘আম্মারের উপর নির্যাতন চলতে থাকে। কখনো তাকে প্রখর রোদে শুইয়ে দিয়ে তার বুকে লাল পাথর চাপা দেয়া হতো, কখনো বা পানিতে ডুবিয়ে শাস্তি দেয়া হতো। মুশরিকগণ তাকে বলত, যতক্ষণ না তুমি মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে গালমন্দ দেবে এবং আমাদের উপাস্য লাত এবং উযযা সম্পর্কে উত্তম কথা না বলবে ততক্ষণ তোমাকে অব্যাহতি দেয়া হবে না। নেহাৎ নিরূপায় হয়ে ‘আম্মার (রা.) তাদের কথা মেনে নিলেন।[5] তারপর নাবী করীমের দরবারে উপস্থিত হয়ে কান্না বিজড়িত কণ্ঠে সবিস্তারে ঘটনা বর্ণনা করে আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এ প্রেক্ষিতে এ আয়াত কারমা অবতীর্ণ হল :

مَن كَفَرَ بِاللَّهِ مِن بَعْدِ إِيمَانِهِ إِلَّا مَنْ أُكْرِهَ وَقَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْإِيمَانِ

‘কোন ব্যক্তি তার ঈমান গ্রহণের পর আল্লাহকে অবিশ্বাস করলে এবং কুফরীর জন্য তার হৃদয় খুলে দিলে তার উপর আল্লাহর গযব পতিত হবে আর তার জন্য আছে মহা শাস্তি, তবে তার জন্য নয় যাকে (কুফরীর জন্য) বাধ্য করা হয় অথচ তার দিল ঈমানের উপর অবিচল থাকে। (আন-নাহল ১৬ : ১০৬)

আবূ ফুকাইহাহ (রা.) বনু আব্বাস গোত্রের দাস ছিলেন। সে ছিল আযদীদের অন্তর্ভুক্ত। তাঁর অপর নাম ছিল আফলাহ। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার কারণে তাঁর মালিক পায়ে লোহার শিকল বেঁধে, শরীর হতে কাপড় খুলে নিয়ে তাকে কংকরময় পথ ও প্রান্তরে টেনে নিয়ে বেড়াতেন।[6] অতঃপর তার পিঠের উপর ভারী পাথর চাপা দিত ফলে তিনি নড়াচড়া করতে পারতেন না। এভাবে শাস্তি দেয়ার এক পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এমন শাস্তি চলছিল নিয়মিতভাবে। অতঃপর তিনি হাবশায় হিজরতকারী দ্বিতীয় কাফেলার সাথে তিনি হিজরত করেন। একদা তারা তার পায়ে রশি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে উত্তপ্ত ময়দানে নিয়ে তার গলায় ফাঁস লাগালো। এতে কাফিররা ধারণা করলো যে, আবূ ফুকাইহাহ মারা গেছে। ইত্যবসরে আবূ বকর (রা.) সে পথ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে ক্রয় করে আল্লাহর ওয়াস্তে আযাদ করে দিলেন।

খাব্বাব বিন আরাত খুযা’আহ গোত্রের উম্মু আনমার সিবা’ নাম্নী এক মহিলার দাস ছিলেন। খাব্বাব বিন আরাত ছিলেন কর্মকার। ইসলাম গ্রহণের পর উম্মু আনমার তাকে আগুন দিয়ে শাস্তি দিত। উত্তপ্ত লোহা দিয়ে তার পিঠ ও মাথায় সেঁক দিত যাতে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর দীনকে অস্বীকার করে। কিন্তু এতে তার ঈমান ও ইসলামে টিকে থাকার সংকল্প আরো বৃদ্ধি পায়। আর মুশরিকগণ তার উপর নানাধরণের নির্যাতন চালাতেন। কখনো বা খুব শক্ত হাতে চুল টানাটানি করে নিষ্পেষণ চালাতেন। কখনো বা আবার খুব শক্ত হাতে তার গ্রীবা ধরে মুচড়ে দিতেন। এক সময় তাকে কাঠের জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর শুইয়ে দিয়ে তার বুকের উপর পাথর চাপা দেয়া হয়েছিল যাতে তিনি উঠতে না পারেন। এতে তার পৃষ্ঠদেশ পুড়ে গিয়ে ধবল কুষ্ঠের মতো সাদা হয়ে গিয়েছিল।[7]

রুমী কৃতদাসী যিন্নীরাহ[8] ইসলাম গ্রহণ করলে এবং আল্লাহর উপর আনার কারণে তাকে শাস্তি দেয়া হয়। তাকে চোখে আঘাত করা হয় ফলে তিনি অন্ধ হয়ে যান। অন্ধ হওয়ার পরে তাকে বলা হলো তোমাকে লেগেছে। উত্তরে যিন্নীরাহ বললেন, আল্লাহর কসম! আমাকে লাত ও উযযার আসর লাগে নি। বরং এটা আল্লাহর একটা অনুগ্রহ এবং আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছায় তা ভাল হয়ে যাবে। অতঃপর একদিন সকালে দেখা গেল যে, আল্লাহ তা’আলা তার চক্ষু ভাল করে দিয়েছেন। তার এ অবস্থা দর্শন করে কুরাইশরা বলল, এটা মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর একটা যাদু।

বনু যুহরার কৃতদাসী উম্মু ‘উবায়েস ইসলাম গ্রহণ করার কারণে মুশরিকগণ তাকে শাস্তি দিত; বিশেষ করে তার মনীব আসওয়াদ বিন ‘আবদে ইয়াগুস খুব শাস্তি দিত। সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ঘোরতর শক্র এবং ঠাট্টা বিদ্রুপকারীদের অন্যতম ছিল।

বনু আদী গোত্রের এক পরিবার বনু মুয়াম্মিলের এক দাসীর মুসলিম হওয়ার সংবাদে ‘উমার বিন খাত্তাব তাকে এতই প্রহার করেছিলেন যে, তিনি নিজেই ক্লান্ত হয়ে গিয়ে এ বলে ক্ষান্ত হয়েছিলেন, ‘মানবত্বের কোন কারণে নয় বরং খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি বলে শাস্তি দেয়া থেকে আপাততঃ তোমাকে রেহাই দিলাম। অতঃপর বলতেন, তোমার সাথে তোমার মনিব এমন আচরণই করবে।[9] ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল উমার (রা.) ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পূর্বে।

নাহদিয়া এবং তার কন্যা উম্মু উবায়েস সকলেই দাসী ছিলেন। এঁরা উভয়েই বনু আব্দুদ্দার গোত্রের। ইসলাম গ্রহণের পর এরা সকলেই মুশরিকদের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হওয়ার ফলে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ও জ্বালা-যন্ত্রণার সম্মুখীন হন।

ইসলাম গ্রহণ করার কারণে যে সব দাসকে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের সম্মখীন হতে হয় তাদের মধ্যে আমির বিন ফুরায়রাও একজন। তাকে এতই শাস্তি দেয়া হয় যে, তার অনুভূতি শক্তি লোপ পায় এবং তিনি কি বলতেন নিজেই তা বুঝতে পারতেন না।

অবশেষে আবূ বাকর (রা.) দাস-দাসীগুলোকেও ক্রয় করে নেয়ার পর মুক্ত করে দেন।[10] এতে তাঁর পিতা আবূ কুহাফাহ তাঁকে ভর্ত্সনা করে বললেন, আমি দেখছি যে, তুমি দুর্বল দাস-দাসীদের মুক্ত করে দিচ্ছ। এর পর যদি তুমি কোন প্রহৃত ব্যক্তিকে মুক্ত কর তবে আমি তোমাকে বাধা প্রদান করবো। পিতার এ কথা শ্রবণ করত আবূ বাকর (রা.) বললেন, আমি তো কেবল তাদেরকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্যই মুক্ত করি। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা আবূ বাকর (রা.)-এর প্রশংসা এবং তাঁর শক্রদের নিন্দা জ্ঞাপন করে আয়াত নাযিল করেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, فَأَنذَرْتُكُمْ نَارًا تَلَظَّىٰ لَا يَصْلَاهَا إِلَّا الْأَشْقَى الَّذِي كَذَّبَ وَتَوَلَّىٰ

“কাজেই আমি তোমাদেরকে দাউ দাউ ক’রে জ্বলা আগুন সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছি। - চরম হতভাগা ছাড়া কেউ তাতে প্রবেশ করবে না। - যে অস্বীকার করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়”। (সূরাহ আল-লাইল ৯২ : ১৪-১৬)

উপর্যুক্ত আয়াতে ধমকী উমাইয়া বিন খালাফ ও তার মতো আচরণকারীদের উদ্দেশ্য করে দেয়া হয়েছে।

وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى الَّذِي يُؤْتِي مَالَهُ يَتَزَكَّىٰ وَمَا لِأَحَدٍ عِندَهُ مِن نِّعْمَةٍ تُجْزَىٰ إِلَّا ابْتِغَاءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَىٰ وَلَسَوْفَ يَرْضَىٰ

“তাথেকে দূরে রাখা হবে এমন ব্যক্তিকে যে আল্লাহকে খুব বেশি ভয় করে, - যে পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্যে নিজের ধন-সম্পদ দান করে, - (সে দান করে) তার প্রতি কারো অনুগ্রহের প্রতিদান হিসেবে নয়, - একমাত্র তার মহান প্রতিপালকের চেহারা (সন্তোষ) লাভের আশায়। - সে অবশ্যই অতি শীঘ্র (আল্লাহর নিমাত পেয়ে) সন্তুষ্ট হয়ে যাবে।” (সূরাহ আল-লাইল ৯২ : ১৭-২১)

উপর্যুক্ত আয়াতের উদ্দিষ্ট ব্যক্তি হলেন, আবূ বাকর সিদীক (রা.)।

ইসলাম গ্রহণ করার কারণে আবূ বকর (রা.)-কেও শাস্তি পেতে হয়েছে। তাঁকে এবং তাঁর সাথে ত্বালহাহ বিন উবাইদুল্লাহকে সালাত থেকে বিরত রাখতে এবং দীন থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য নওফেল বিন খুওয়াইলিদ একই রশিতে শক্ত করে বোঁধে রাখতো। কিন্তু তাঁরা কেউই তাঁর কথায় কর্ণপাত করেন নি। তাঁরা উভয়ে সর্বদা এক সাথে সালাত আদায় করতেন। এজন্য তাঁদেরকে ‘কারীনাইন’ (দু’ সঙ্গী) বলা হয়। আবার এও বলা হয় যে, তাদের সাথে এরকম করার কারণ, ‘উসমান বিন উবাইদুল্লাহ- ত্বালহা বিন উবাইদুল্লাহর ভাই।

প্রকৃত অবস্থা ছিল মুশরিকগণ যখন কারো মুসলিম হওয়ার সংবাদ পেতেন তখন তাদের কষ্ট দেয়ার ব্যাপারে তারা উদ্বাহু এবং বদ্ধ পরিকর হয়ে যেতেন। ইসলাম গ্রহণ করার কারণে দরিদ্র মুসলমানদেরকে শাস্তি দেয়া ছিল তাদের নিকট একটি মামুলি ব্যাপার। বিশেষ করে দাস-দাসীদের শাস্তি দিতে কোন পরওয়াই করতো না। কেননা তাদের শাস্তি দেয়া কারণে কেউ ক্রুদ্ধও হতো না আর তাদের শাস্তি লাঘবের জন্য কেউ এগিয়েও আসতো না। বরং তাদের মনিবেরাই স্বয়ং শাস্তি প্রদান করতো। তবে কোন বড় ও সম্ভান্ত ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের শাস্তি দেয়া ছিল কঠিন ব্যাপার। বিশেষ করে তারা যখন তাদের গোত্রের সম্মানী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হতেন। এসব সম্ভ্রান্ত লোকের উপর মুশরিকরা সামান্যই চড়াও হতো যদিও এদেরকেই তারা দীনের ক্ষেত্রে বেশি ভয় করতো।

[1] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩২০ পৃঃ।

[2] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৭৫ পৃঃ।

[3] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৫৮ পূঃ ও তালকীহু ফুহুমি আহলিল আসার।

[4] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৫৭ পৃঃ এবং তালকীহুল ফোহুম ৬১ পৃঃ ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩১৭-৩১৮ পৃ:।

[5] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩১৯-৩২০ পূঃ এবং মুহাম্মাদ গাজ্জালী রচিত ফিকহুস সীরাহ ৮২ পৃঃ আওফী ইবনে আব্বাস হতে কিছু কিছু অংশ বর্ণনা করেছেন। ইবনে কাসীর, উপরোক্ত আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য।

[6] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৫৭ পৃঃ, এ জাযুত তানখীল ৫৩ পৃঃ হতে।

[7] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৫৭ পৃঃ, তালকীহুল ফোহুম ৬০ পৃঃ।

[8] যিন্নীরাহ মিসকীনার ওযনে অর্থাৎ ‘যে’ কে যের এবং নুনকে যের এবং তাশদীদ।

[9] রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খণ্ড ৫৭ পৃঃ, ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩১৯ পৃঃ।

[10] ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড ৩১৮-৩১৯ পৃঃ।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ব্যাপারে মুশরিকদের অবস্থান (موقف المشتكين من رسول الله):

তাদের প্রকৃত সমস্যা ছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে নিয়ে। কেননা ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন। বংশ মর্যাদার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন বৈশিষ্ট্যময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। শত্রু-মিত্র পক্ষের কেউ তার নিকট আগমন করলে তাকে মান-মর্যাদা বা ইজ্জতের ভূষণে ভূষিত হয়েই সেখানে আগমন করতে হতো। কোন দুষ্টদুরাচার কিংবা অনাচারীর পক্ষে তার সম্মুখে কোন অশ্লীল বা জঘন্য কাজ করার মতো ধৃষ্টতা প্রদর্শন কখনই সম্ভব হতো না ।

নাবী কারীম (ﷺ)-এর উপর্যুক্ত গুণাবলী এবং ব্যক্তি বৈশিষ্ট্য প্রসূত প্রভাব প্রতিপত্তির সঙ্গে সংযুক্ত হল চাচা আবূ ত্বালিবের সাহায্য সহযোগিতা ও সমর্থন। ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত উভয় ক্ষেত্রেই আবূ ত্বালিব এত মর্যাদাসম্পন্ন এবং প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ছিলেন যে, তার কথা অমান্য করা কিংবা তার গৃহীত সিদ্ধান্তের উপর হস্তক্ষেপ করার মতো দুঃসাহসিকতা কারোরই ছিল না। এমন এক অবস্থার প্রেক্ষাপটে অন্যান্য কুরাইশগণকে কঠিন দুশ্চিন্তা, এবং টানা পোড়নের মধ্যে নিপতিত হতে হল। সাত-পাঁচ এ জাতীয় নানা কথা নানা প্রশ্ন এবং নানা যুক্তিতর্কের পসরা নিয়ে তারা আবূ ত্বালিবের নিকট যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তবে তা খুব হিকমত ও নম্রতার সাথে এবং মনে মনে চ্যালেঞ্জ ও ভীতিপ্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা গোপন করে যাতে করে তাদের বক্তব্য আবূ ত্বালিব খুব সহজেই মেনে নেয়।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২০ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 পরের পাতা »