ইসলামী জীবন ব্যবস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ পরিবার। পরিবার গঠন, পরিবারের সদস্যগণের পারস্পরিক দায়িত্ব, কর্তব্য, সহমর্মিতা, স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক দায়িত্ব, দাম্পত্য জীবনের আনন্দ ও তৃপ্তির ফযীলত ইত্যাদি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনেক নির্দেশনা বিভিন্ন সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সেগুলোর পাশাপাশি অগণিত বানোয়াট, ভিত্তিহীন, জাল বা যয়ীফ কথা হাদীস নামে সমাজে প্রচলিত। সবচেয়ে বেশি অবাক হতে হয় যে, প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থগুলোর সহীহ হাদীস বাদ দিয়ে অগণিত সূত্র বিহীন বানোয়াট কথা আমরা বিভিন্ন গ্রন্থে লিখছি বা মুখে বলছি।
বইয়ের কলেবর বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বিভিন্ন বিষয়ে সহীহ হাদীসের উল্লেখ করা সম্ভব হচ্ছে না। শুধু সংক্ষেপে কিছু বানোয়াট কথা উল্লেখ করছি।
১. বিবাহিতের ২ রাক‘আত অবিবাহিতের ৭০ রাক‘আত
প্রচলিত একটি জাল হাদীস:
رَكْعَتَانِ مِنَ الْمُتَزَوِّجِ أَفْضَلُ مِنْ سَبْعِيْنَ رَكْعَةً مِنَ الأَعْزَبِ
‘‘অবিবাহিতের ৭০ রাক‘আত অপেক্ষা বিবাহিতের দু রাক‘আত উত্তম।’’
আরেকটি প্রচলিত জাল হাদীস:
رَكْعَتَانِ مِنَ الْمُتَأَهِّلِ خَيْرٌ مِنِ اثْنَتَيْنِ وَثَمَانِيْنَ رَكْعَةً مِنَ الأَعْزَبِ
‘‘অবিবাহিতের ৮২ রাক‘আত অপেক্ষা বিবাহিতের দু রাক‘আত উত্তম।’’
কুরআন ও হাদীসে বিবাহের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং বিবাহের ফযীলতও বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্ত এ হাদীস দুটি জাল ও বানোয়াট।[1]
এ বিষয়ে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে কোনো সহীহ হাদীস নেই। হাদীসগুলোর সনদ অত্যন্ত যয়ীফ এবং সনদে মিথ্যাবাদী রাবী রয়েছে। এজন্য মুহাদ্দিসগণ সেগুলোকে জাল বলে গণ্য করেছেন।[1]
ইসলাম যেমন বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক কঠিনভাবে নিষেধ করে, তেমনি বিবাহিত দম্পতিকে তাদের জীবন ও যৌবনের আনন্দ উপভোগ করতে উৎসাহ দেয়। পায়ুপথে মিলন এবং রক্তস্রাব অবস্থায় মিলন নিষিদ্ধ। এছাড়া দম্পতির মিলন ও আনন্দলাভের কোনো দিন, তারিখ, বার, তিথি, সময়, উপকরণ, আসন বা পদ্ধতি ইসলাম নিষিদ্ধ করে নি। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে কোনোরূপ পর্দা নেই বা কোনো কিছু দর্শন, স্পর্শ, চুম্বন বা উপভোগে নিষেধাজ্ঞা নেই।
প্রচলিত অনেক জাল ও ভিত্তিহীন হাদীসে দাম্পত্য মিলন বিষয়ক বিভিন্ন মিথ্যা কথা বলা হয়েছে। অমুক সময়ে, অমুক দিনে, অমুক বারে, অমুক রাতে, অমুক তিথিতে দাম্পত্য সম্পর্ক করবে না, তাতে অমুক প্রকারের ক্ষতি হবে, অথবা সন্তানের অমুক রোগ হবে.... ইত্যাদি। অথবা অমুক পদ্ধতিতে বা আসনে দাম্পত্য মিলন করবে না, তাহলে অমুক ক্ষতি হবে, বা সন্তানের অমুক খুত হবে... ইত্যাদি। অথবা দাম্পত্য মিলনের সময় কথা বলবে না, দৃষ্টিপাত করবে না...স্পর্শ করবে না...তাহলে অমুক রোগ হবে, বা অমুক ক্ষতি হবে... ইত্যাদি। অথবা অমুক সময়ে, বারে, তিথিতে দাম্পত্য মিলনে সন্তান সৌভাগ্যবান বা দুর্ভাগ্যবান হয়..। এগুলো সবই মিথ্যা, বানোয়াট ও জাল কথা।
সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, মদীনার ইহূদীগণের মধ্যে এরূপ কিছু কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। তখন মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে সূরা বাকারার ২২৩ নং আয়াত নাযিল করে সে সকল কুসংস্কার খন্ডন করেন।[1]
বহুল প্রচলিত একটি পুস্তকে রয়েছে: ‘‘হযরত (ﷺ) বলিয়াছেন, স্ত্রীগণের বেহেশত স্বামীর পায়ের নিচে।’’[1] এ কথাটি একটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ সনদেও এ কথাটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয়েছে বলে জানা যায় না। কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা থেকে বুঝা যায় যে, স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জান্নাত উভয়ের হাতে। উভয়ের প্রতি উভয়ের দায়িত্ব পালন ও অধিকার আদায়ের মাধ্যমেই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব।
কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে মাতৃগণের মর্যাদার জন্য বিশেষভাবে সন্তানধারণ, দুগ্ধপান ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীস শরীফে সাধারণভাবে সংসার-পালন, সন্তান প্রতিপালন ইত্যাদির সাধারণ সাওয়াবের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জালিয়াতগণ তাদের অভ্যাস মত প্রত্যেক কর্ম বা অবস্থার জন্য পৃথক পৃথক আজগুবি ফযীলত ও সাওয়াবের বর্ণনা দিয়ে অনেক হাদীস বানিয়েছে। আমাদের সমাজে এগুলো প্রচলিত। এমনকি এ সকল ভিত্তিহীন কথা দিয়ে বিভিন্ন ছাপানো পোস্টার, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি ছাপা হয়।
প্রচলিত একটি পুস্তকে রয়েছে: ‘‘হুজুর (ﷺ) একদিন স্ত্রীলোকদের লক্ষ্য করিয়া বলিয়াছিলেন, যখন কোন স্ত্রীলোক তাহার স্বামী কর্তৃক হামেলা (গর্ভবর্তী) হইয়া থাকে, তখন হইতে প্রসব বেদনা উপস্থিত হওয়ার পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত সর্বদা সে স্ত্রীলোকটি দিনে রোযা রাখার ও রাত্রি বেলা নফল নামায পড়ার ছওয়াব পাইবে। আর যখন প্রসব বেদনা উপস্থিত হয় তখন খোদা তায়ালা তাহার জন্য বেহেশতের মধ্যে এমন বস্ত্তসমূহ গচ্ছিত রাখিয়া দেন যে, তাহার সন্ধান পৃথিবী, আকাশ, বেহেশত, দোজখবাসী কেহই অবগত নহেন। আর যখন সন্তান প্রসব করে তখন হইতে দুগ্ধ ছাড়ান পর্যন্ত প্রতি ঢোক দুগ্ধের পরিবর্তে আল্লাহ তাআলা তাহাকে একটি করিয়া নেকী দান করিয়া থাকেন। এবং সেই সময়ের মধ্যে তাহার মৃত্যু হইলে শহীদের দরওয়াজা প্রাপ্ত হইবে। আর যদি তাহাকে তাহার সন্তানের জন্য কোন রাত্রি জাগিয়া থাকিতে হয় তবে আল্লাহ তায়ালা তাহাকে ঐ রাত্রি জাগরণের পরিবর্তে ৭০টি গোলাম আজাদ করার ছওয়াব দিয়া থাকেন। তৎপর তিনি ইহাও বলিয়া ছিলেন যে, এই ছওয়াব সমূহ কেবল মাত্র ঐ সমস্ত স্ত্রী লোকদেরকে দেওয়া হইবে যাহারা সর্বদাই খোদার হুকুম ও আপন স্বামীর হুকুম পালন করিয়া আওরাতে হাছীনার অন্তর্ভূক্ত হইতে পারিয়াছে। আল্লাহ ও স্বামীর নাফরমান স্ত্রীলোকদিগকে কখনও ঐ সমস্ত ছওয়াব দেওয়া হইবে না।’’[1]
এ ‘কথাগুলো’ একটি জাল হাদীসের ‘ইচ্ছামাফিক’ অনুবাদ।[2] এছাড়া আরো অনেক আজগুবি, মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা হাদীসের নামে লিখে এ সকল পুস্তকের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মসীলিপ্ত করা হয়েছে। এ সকল পুস্তকে ‘হাদীস’ নামে লেখা অধিকাংশ কথাই বানোয়াট ও জাল।
[2] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/১৭৮; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১৭৪-১৭৫; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/২০৩-২০৪, ২১১।