শুভাশুভ ও উন্নতি-অবনতি বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা
বিভিন্ন প্রচলিত ইসলামী গ্রন্থে এবং আমাদের সমাজের সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস আছে যে, অমুক দিন, বার, তিথি, সময় বা মাস অশুভ, অযাত্রা ইত্যাদি। অনুরূপভাবে মনে করা হয়, বিভিন্ন কাজের অশুভ ফল রয়েছে এবং এ সকল কাজের কারণে মানুষ দরিদ্র হয় বা মানুষের ক্ষতি হয়। এ বিশ্বাস বা ধারণা শুধু ইসলাম বিরোধী কুসংস্কারই নয়; উপরন্তু এরূপ বিশ্বাসের ফলে ঈমান নষ্ট হয় বলে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অশুভ, অযাত্রা, অমঙ্গল ইত্যাদি বিশ্বাস করতে এবং যে কোনো বিষয়ে আগাম হতাশা এবং নৈরাশ্যবাদ (pessimism) অত্যন্ত অপছন্দ করতেন। পক্ষান্তরে তিনি সকল কাজে সকল অবস্থাতে শুভ চিন্তা, মঙ্গল-ধারণা ও ভাল আশা করা পছন্দ করতেন।[1] শুভ চিন্তা ও ভাল আশার অর্থ হলো আল্লাহর রহমতের আশা অব্যাহত রাখা। আর অশুভ ও অমঙ্গল চিন্তার অর্থ হলো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
الطِّيَرَة شِرْكٌ، الطِّيَرَةُ شِرْكٌ، الطِّيَرَةُ شِرْكٌ
‘‘অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস করা বা নির্ণয়ের চেষ্টা করা শির্ক, অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস করা বা নির্ণয়ের চেষ্টা করা শির্ক, অশুভ বা অযাত্রা বিশ্বাস করা বা নির্ণয়ের চেষ্টা করা শির্ক।[2]
এ বিষয়ে আরো অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
আল্লাহ যা কিছু নিষিদ্ধ করেছেন তাই অমঙ্গলের কারণ। বান্দার জন্য অমঙ্গল বলেই তো আল্লাহ বান্দার জন্য তা নিষিদ্ধ করেছেন। এ সকল কর্মে লিপ্ত হলে মানুষ আল্লাহর রহমত ও বরকত থেকে বঞ্চিত হয়। আল্লাহর নিষিদ্ধ হারাম দুই প্রকারের: (১) হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক্ক সম্পর্কিত হারাম ও (২) হক্কুল ইবাদ বা সৃষ্টির অধিকার সম্পর্কিত হারাম। দ্বিতীয় প্রকারের হারামের জন্য মানুষকে আখেরাতের শাস্তি ছাড়াও দুনিয়াতে পার্থিব ক্ষতির মাধ্যমে শাস্তি পেতে হবে বলে বিভিন্ন হাদীসের আলোকে জানা যায়। জুলুম করা, কারো সম্পদ তার ইচ্ছার বাইরে চাঁদাবাজি, যৌতুক বা অন্য কোনো মাধ্যমে গ্রহণ করা, ওজন, পরিমাপ বা মাপে কম দেওয়া, পিতামাতা, স্ত্রী, প্রতিবেশী, দরিদ্র, অনাথ, আত্মীয়-স্বজন বা অন্য কোনো মানুষের অধিকার নষ্ট করা, কাউকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা, আল্লাহর কোনো সৃষ্টির বা মানুষের ক্ষতি করা বা সাধারণ ভাবে ‘হক্কুল ইবাদ’ নষ্ট করা পার্থিব অবনতির কারণ।
কিন্তু আল্লাহর কোনো সৃষ্টির মধ্যে, কোনো বার, তারিখ, তিথি, দিক ইত্যাদির মধ্যে অথবা কোনো মোবাহ কর্মের মধ্যে কোনো অশুভ প্রভাব আছে বলে বিশ্বাস করা কঠিন অন্যায় ও ঈমান বিরোধী। আমাদের সমাজে এ জাতীয় অনেক কথা প্রচলিত আছে। এগুলোকে সবসময় হাদীস বলে বলা হয় না। কিন্তু পাঠক সাধারণভাবে মনে করেন যে, এগুলো নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ﷺ কথা। তা না হলে কিভাবে আমরা জানলাম যে, এতে মঙ্গল হয় এবং এতে অমঙ্গল হয়? এগুলো বিশ্বাস করা ঈমান বিরোধী। আর এগুলোকে আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের ﷺ বাণী মনে করা অতিরিক্ত আরেকটি কঠিন অন্যায়।
শুভ, অশুভ. উন্নতি, অবনতি ইত্যাদি বিষয়ক ভিত্তিহীন কথাবার্তা
১. শনি, মঙ্গল, অমাবস্যা, পূর্ণিমা ইত্যাদি
শনিবার, মঙ্গলবার, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, কোনো তিথি, স্থান বা সময়কে অমঙ্গল অযাত্রা বা অশুভ বলে বিশ্বাস করা জঘন্য মিথ্যা ও ঘোরতর ইসলাম বিরোধী বিশ্বাস। অমুক দিনে বাঁশ কাঁটা যাবে না, চুল কাটা যাবে না, অমুক দিনে অমুক কাজ করতে নেই...ইত্যাদি সবই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কুসংস্কার। এগুলো বিশ্বাস করলে শির্কের গোনাহ হবে।
২. চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, রংধনু, ধুমকেতু ইত্যাদি
চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণ, রংধনু, ধুমকেতু ইত্যাদি প্রাকৃতিক নিদর্শনাবলি বিশেষ কোনো ভাল বা খারাপ প্রভাব রেখে যায় বলে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট ও মিথ্যা কথা। অমুক চাঁদে গ্রহণ হলে অমুক হয়, বা অমুক সময়ে রঙধনু দেখা দিলে অমুক ফল হয়, এ ধরনের কথাগুলো বানোয়াট।[3]
৩. বুধবার বা মাসের শেষ বুধবার
বুধবারকে বা মাসের শেষ বুধবারকে অমঙ্গল, অশুভ, অযাত্রা বা খারাপ বলে বা বুধবারের নিন্দায় কয়েকটি বানোয়াট হাদীস প্রচলিত আছে। এগুলো সবই মিথ্যা। আল্লাহর সৃষ্টি দিন, মাস, তিথি সবই ভাল। এর মধ্যে কোন কোন দিন বা সময় বেশি ভাল। যেমন শুক্রবার, সোমবার ও বৃহস্পতিবার বেশি বরকতময়। তবে অমঙ্গল, অশুভ বা অযাত্রা বলে কিছু নেই।[4]
৪. অবনতির কারণ বিষয়ক ভিত্তিহীন কথাবার্তা
বিভিন্ন প্রচলিত পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নিম্নের কাজগুলোকে অশুভ, খারাপ ফলদায়ক বা দারিদ্র আনয়নকারী:
- হাঁটতে হাঁটতে ও অযু ব্যতীত দরুদ শরীফ পাঠ করা।
- বিনা ওযুতে কুরআন কিংবা কুরআনের কোনো আয়াত পাঠ করা।
এ কথা দুটি একদিকে যেমন বানোয়াট কথা, অপরদিকে এ কথা দ্বারা মুমিনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত থেকে বিরত রাখা হয়। গোসল ফরয থাকলে কুরআন পাঠ করা যায় না। ওযু ছাড়া কুরআন তিলাওয়াত জায়েয। রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবীগণ ওযু ছাড়াও মুখস্থ কুরআন তিলাওয়াত করতেন। ওযু অবস্থায় যিক্র, দোয়া, দরুদ-সালাম ইত্যাদি পাঠ করা ভাল। তবে আল্লাহর যিক্র, দোয়া ও দরুদ-সালাম পাঠের জন্য ওযু বা গোসল জরুরী নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের সুন্নাত হলো, হাঁটতে, চলতে, বসে, শুয়ে ওযুসহ ও ওযু ছাড়া পাক-নাপাক সর্বাবস্থায় নিজের মুখ ও মনকে আল্লাহর যিক্র, দোয়া ও দরুদ পাঠে রত রাখা।
- বসে মাথায় পাগড়ি পরিধান করা।
- দাঁড়িয়ে পায়জামা পরিধান করা।
- কাপড়ের আস্তিন ও আঁচল দ্বারা মুখ পরিষ্কার করা।
- ভাঙ্গা বাসনে বা গ্লাসে পানাহার করা।
- রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে খাওয়া।
- খালি মাথায় পায়খানায় যাওয়া বা খালি মাথায় আহার করা।
- পরিধানে কাপড় রেখে সেলাই করা।
- লুঙ্গি-গামছা চেপার সময় পায়ে পানি ফেলা
- ফুঁক দিয়ে প্রদীপ নেভানো।
- ভাঙ্গা চিরুনী ব্যবহার করা বা ভাঙ্গা কলম ব্যবহার করা।
- দাঁত দ্বারা নখ কাটা।
- রাত্রিকালে ঘর ঝাড়ু দেওয়া।
- কাপড় দ্বারা ঘর ঝাড়ু দেওয়া।
- ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখা বা রাত্রে আয়নায় মুখ দেখা।
- হাঁটতে হাঁটতে দাত খেলাল করা।
- কাপড় দ্বারা দাঁত পরিষ্কার করা।
- ঘরের ঝুলকালি বা মাকড়াসার বাসা পরিষ্কার না করা.......।
এরূপ আরো অনেক কথা প্রচলিত। সবই বানোয়াট কথা। কোনো জায়েয কাজের জন্য কোনোরূপ ক্ষতি বা কুপ্রভাব হতে পারে বলে বিশ্বাস করা কঠিন অন্যায়। আর এগুলোকে হাদীস বলে মনে করা কঠিনতর অন্যায়।
৫. উন্নতির কারণ বিষয়ক ভিত্তিহীন কথাবার্তা
মহান আল্লাহ বান্দাকে যে সকল কর্মের নির্দেশ দিয়েছেন সবই তার জন্য পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণ, উন্নতি ও মঙ্গল বয়ে আনে। সকল প্রকার ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, নফল-মুস্তাহাব কর্ম মানুষের জন্য আখিরাতের সাওয়াবের পাশাপাশি জাগতিক বরকত বয়ে আনে। আল্লাহ বলেন:
وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آَمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ
‘‘যদি জনপদবাসিগণ ঈমান এবং তাকওয়া অর্জন করতো (আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ বর্জন করতো ও নির্দেশিত কাজ পালন করতো) তবে তাদের জন্য আমি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর বরকত-কল্যাণসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম।’’[5]
এভাবে আমরা দেখছি যে, ঈমান ও তাকওয়ার কর্মই বরকত আনয়ন করে। তবে সৃষ্টির সেবা ও মানবকল্যাণমূলক কর্মে আল্লাহ সবচেয়ে বেশি খুশি হন এবং এরূপ কাজের জন্য মানুষকে আখিরাতের সাওয়াব ছাড়াও পৃথিবীতে বিশেষ বরকত প্রদান করেন বলে বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে অনেক বানোয়াট কথাও বলা হয়। যেমন বলা হয় যে, নিম্নের কাজগুলি করলে মানুষ ধনী ও সৌভাগ্যশালী হতে পারে:
- আকীক পাথরের আংটি পরিধান করা।
- বৃহস্পতিবারে নখ কাটা।
- সর্বদা জুতা বা খড়ম ব্যবহার করা।
- ঘরে সিরকা রাখা।
- হলদে রঙের জুতা পরা।
- যে ব্যক্তি জমরুদ পাথরের বা আকীক পাথরের আংটি পরবে বা সাথে রাখবে সে কখনো দরিদ্র হবে না এবং সর্বদা প্রফুল্ল থাকবে।
অনুরূপভাবে অমুক কাজে মানুষ স্বাস্থ্যবান ও সবল হয়, স্মরণশক্তি বৃদ্ধি পায়, অমুক কাজে স্বাস্থ্য নষ্ট হয় বা স্মরণশক্তি নষ্ট হয়, অমুক কাজে দৃষ্টি শক্তি বাড়ে, অমুক কাজে দৃষ্টিশক্তি কমে, অমুক কাজে বার্ধক্য আনে, অমুক কাজে শরীর মোটা হয়, অমুক কাজে শরীর দুর্বল হয় ইত্যাদি সকল কথাই বানোয়াট।
[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/১৬০; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ১৩/৪৯১; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৬৪; আবূ দাঊদ, আস-সুনান ৪/১৭; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১১৭০। তিরমিযী, ইবনু হিববান, হাকিম প্রমুখ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[3] তাহির পাটনী, তাযকিরা, পৃ. ২২১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/১৭৮, ১৭৯, ১৯১; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ২/৫৬৮।
[4] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/৩৭৪-৩৭৬; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/৪৮১-৪৮৬; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৩৬৪; মুল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ: ১৯৯-২০০, ২৭৫; আল-মাসনূ‘য় ১২৫; মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১৬৬, ২০৮।
[5] সূরা (৭) আ‘রাফ: ৯৬ আয়াত।
‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পোশাক’ ও ‘পোশাক-পর্দা ও দেহসজ্জা’ নামক গ্রন্থদ্বয়ে পোশাক বিষয়ক সহীহ, যয়ীফ ও মাউদূ হাদীসগুলি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে এ বিষয়ক কিছু মাউযূ বা জাল হাদীস উল্লেখ করছি। এছাড়া পানাহার বিষয়ক কিছু জাল হাদীসও এ পরিচ্ছেদে উল্লেখ করছি।
আবু দারদা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে:
لم يكن لرسول الله ﷺ إلا قميص واحد
‘‘রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর একটিমাত্র কামিস ছাড়া অন্য কোনো কামিস ছিল না।’’[1]
হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী সাঈদ ইবনু মাইসারাহ মিথ্যা হাদীস বানিয়ে বলতেন বলে ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন।[2]
বিভিন্ন হাদীসের আলোকে মনে হয়, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিভিন্ন প্রকারের জামা পরিধান করতেন। কোনোটির ঝুল ছিল টাখনু পর্যন্ত। কোনোটি কিছুটা খাট হাটুর নিম্ন পর্যন্ত ছিল। কোনোটির হাতা ছিল হাতের আঙ্গুলগুলোর মাথা পর্যন্ত। কোনোটির হাতা কিছুটা ছোট এবং কব্জি পর্যন্ত ছিল।
[2] যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৩/২৩৩।
বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আমরা জানতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জামার বোতাম ছিল, তবে তিনি সাধারণত বোতাম লাগাতেন না। বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে যে, ‘তাঁর জামার বোতামগুলো’ খোলা ছিল। এ থেকে মনে হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জামার তিন বা ততোধিক বোতাম ছিল। তিনি সাধারণত এ সকল বোতামের কোনো বোতামই লাগাতেন না।
কেউ কেউ বলেছেন যে, তাঁর জামার বোতাম ছিল না বা বোতামের স্থলে কাপড়ের তৈরি ঘুন্টি ছিল। এ বিষয়ক কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ইমাম গাযালী (৫০৫হি) লিখেছেন:
وَكَانَ قَمِيْصُهُ مَشْدُوْدَ الأَزْرَارِ، وَرُبَّمَا حَلَّ الأَزْرَارَ فِيْ الصَّلاَةِ وَغَيْرِهَا
‘‘তাঁর কামিস বা জামার বোতামগুলো লাগানো থাকত। কখনো কখনো তিনি সালাতে ও সালাতের বাইরে বোতামগুলো খুলে রাখতেন।’’[1]
কোনো কোনো গ্রন্থে ‘বসে পাজামা পরিধান করা’ সুন্নাত বা আদব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস আমার নজরে পড়ে নি। বিষয়টি পরবর্তী যুগের আলিমদের মতামত বলেই মনে হয়।[1]
আবু দাউদ ও তিরমিযী উভয়ে তাঁদের উস্তাদ কুতাইবা ইবনু সাঈদের সুত্রে একটি হাদীস সংকলিত করেছেন। তাঁরা উভয়েই বলেন: কুতাইবা আমাদেরকে বলেছেন, তাকে মুহাম্মাদ ইবনু রাবীয়াহ হাদীসটি আবুল হাসান আসকালানী নামক এক ব্যক্তি থেকে, তিনি আবু জা’ফর ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু রুকানাহ নামাক এক ব্যক্তি থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে বলেছেন, রুকানার সাথে রাসূলুল্লাহ ﷺ কুস্তি লড়েন এবং তিনি রুকানাকে পরাস্ত করেন। রুকানা আরো বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি:
إِنَّ فَـرْقَ مَا بَـيْـنَـنَا وَبَيْنَ الْمُشْرِكِينَ الْعَمَـائِمُ عَلَى الْقَلانِسِ
‘‘আমাদের এবং মুশরিকদের মধ্যে পার্থক্য টুপির উপরে পাগড়ী।’’[1]
তিরমিযী হাদীসটি উল্লেখ করে এর সনদটি যে মোটেও নির্ভরযোগ্য নয় তা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী আবুল হাসান আসকালানী। এ ব্যক্তিটির পরিচয় কেউ জানে না। শুধু তাই নয়। তিনি দাবী করেছেন যে, তিনি রুকানার পুত্র থেকে হাদীসটি শুনেছেন। রুকানার কোনো পুত্র ছিল কিনা, তিনি কে ছিলেন, কিরূপ মানুষ ছিলেন তা কিছুই জানা যায় না। এজন্য হাদীসটির সনদ মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
ইমাম তিরমিযীর উস্তাদ, ইমামুল মুহাদ্দিসীন ইমাম বুখারীও তাঁর ‘‘আত-তারীখুল কাবীর’’ গ্রন্থে এ হাদীসটির দুর্বলতা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: হাদীসটির সনদ অজ্ঞাত অপরিচিত মানুষদের সমন্বয়। এছাড়া এদের কেউ কারো থেকে কোন হাদীস শুনেছে বলেও জানা যায় না।[2] ইমাম যাহাবী, আজলূনী প্রমুখ একে মাউযূ বা বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন।[3]
এছাড়া আব্দুর রাঊফ মুনাবী, মোল্লা আলী কারী, আব্দুর রাহমান মুবারাকপুরী, শামছুল হক আযীমাবাদী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস আলোচনা করেছেন যে, এ হাদীসের অর্থ বাস্তবতার বিপরীত।[4] হাদীসটির দুইটি অর্থ হতে পারে: এক- মুশরিকগণ শুধু টুপি পরিধান করে আর আমরা পাগড়ী সহ টুপি পরিধান করি। দুই- মুশরিকগণ শুধু পাগড়ী পরিধান করে আর আমরা টুপির উপরে পাগড়ী পরিধান করি। উভয় অর্থই রাসূলুল্লাহ ﷺ ও তাঁর সাহাবীগণের কর্মের বিপরীত। কারণ বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, তাঁরা কখনো শুধু টুপি পরতেন এবং কখনো শুধু পাগড়ী পরতেন।
ইমাম গাযালী (৫০৫হি) বলেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনো পাগড়ীর নিচে টুপি পরিধান করতেন। কখনো পাগড়ী ছাড়া শুধু টুপি পরতেন। কখনো কখনো তিনি মাথা থেকে টুপি খুলে নিজের সামনে টুপিটিকে সুতরা বা আড়াল হিসাবে রেখে সেদিকে মুখ করে নামায আদায় করেছেন।’’[5]
শামসুদ্দীন ইবনুল কাইয়িম (৭৫১হি:) বলেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ ﷺ পাগড়ী পরিধান করতেন এবং তার নিচে টুপি পরতেন। তিনি পাগড়ী ছাড়া শুধু টুপিও পরতেন। আবার টুপি ছাড়া শুধু পাগড়ীও পরতেন।’’[6]
[2] বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর ১/৮২।
[3] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৩/৫১১; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর ৫/৭১; বাইহাকী, শুআবুল ঈমান ৫/১৭৫; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ৬/১৪৫; ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ৪/১৬২; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৯৫।
[4] মুবারাকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী ৫/৩৯৩; আযীমাবাদী, আউনুল মা’বুদ ১১/৮৮।
[5] গাযালী, এহইয়াউ উলূমিদ্দীন ২/৪০৬।
[6] ইবনুল কাইয়িম, যাদুল মা‘আদ ১/১৩০।
আবু হুরাইরা (রা)-এর নামে বর্ণিত:
رَأَيْتُ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ ﷺ قَلَنْسُوَةً خُمَاسِيَّةً طَوِيْلَةً
‘‘আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মাথায় একটি লম্বা পাঁচভাগে বিভক্ত টুপি দেখেছি।’’
হাদীসটি আল্লামা আবু নুআইম ইসপাহানী তাঁর সংকলন ‘মুসনাদুল ইমাম আবী হানীফা’ গ্রন্থে সংকলন করেছেন। তিনি বলেন: আমাকে আব্দুল্লাহ ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু জা‘ফর ও আবু আহমাদ জুরজানী বলেছেন, আমাদেরকে আহমাদ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসূফ বলেছেন, আমাদেরকে আবু উসামাহ বলেছেন, আমাদেরকে দাহহাক ইবনু হাজার বলেছেন, আমাদেরকে আবু কাতাদাহ হাররানী বলেছেন যে, আমাদেরকে আবু হানীফা বলেছেন, তাঁকে আতা’ আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি এ হাদীস বলেছেন।[1]
এ হাদীসটি জাল। ইমাম আবু হানীফা থেকে শুধুমাত্র আবু কাতাদাহ হাররানী (মৃ: ২০৭হি:) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাররানী ছাড়া অন্য কেউ এ শব্দ বলেন নি। ইমাম আবু হানীফার (রাহ) অগণিত ছাত্রের কেউ এ হাদীসটি এ শব্দে বলেন নি। বরং তাঁরা এর বিপরীত শব্দ বলছেন। অন্যান্য ছাত্রদের বর্ণনা অনুসারে ইমাম আবু হানীফা বলেছেন, তাঁকে আতা’ আবু হুরাইরা থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাদা শামি টুপি ছিল।[2]
তাহলে আমরা দেখছি যে, অন্যান্যদের বর্ণনা মতে হাদীসটি (قلنسوة شامية) বা ‘শামী টুপি’ এবং আবু কাতাদার বর্ণনায় (قلنسوة خماسية) বা ‘খুমাসী টুপি’। এথেকে আমরা বুঝতে পরি যে, আবু হানীফা বলেছিলেন শামী টুপি, যা তাঁর সকল ছাত্র বলেছেন, আবু কাতাদাহ ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ভুল বলেছে। অথবা সে (شامية) শব্দটিকে বিকৃতভাবে (خماسية) রূপে পড়েছে।
সর্বোপরি আবূ কাতাদা পরিত্যক্ত রাবী। ইমাম বুখারী বলেছেন, আবু কাতাদাহ হাররানী ‘মুনকারুল হাদীস’। ইমাম বুখারী কাউকে ‘‘মুনকারুল হাদীস’’ বা ‘‘আপত্তিকর বর্ণনাকারী’’ বলার অর্থ সে লোকটি মিথ্যাবাদী বলে তিনি জেনেছেন। তবে তিনি কাউকে সরাসরি মিথ্যাবাদী না বলে তাকে ‘‘মুনকারুল হাদীস’’ বা অনুরূপ শব্দাবলি ব্যবহার করতেন।
এছাড়া হাদীসটি আবু কাতাদাহ হাররানীর থেকে শুধুমাত্র দাহহাক ইবনু হুজর বর্ণনা করেছেন। দাহহাক ইবনু হুজরের কুনিয়াত আবু আব্দুল্লাহ মানবিজী। তিনিও অত্যন্ত দুর্বল বর্ণনাকারী ছিলেন। তিনি মিথ্যা হাদীস বানাতেন বলে ইমাম দারাকুতনী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন।[3]
এজন্য আল্লামা আবু নু‘আইম ইসপাহানী হাদীসটি উল্লেখ করে বলেন ‘‘এ হাদীসটি শুধুমাত্র দাহহাক আবু কাতাদা থেকে বর্ণনা করেছেন। আর কেউই আবু হানীফা থেকে বা আবু কাতাদাহ থেকে তা বর্ণনা করেন নি।’’[4]
[2] মোল্লা আলী কারী, শারহু মুসনাদি আবী হানীফাহ, পৃ: ১৪২।
[3] ইমাম বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর ৫/২১৯; ইবনু আবী হাতিম, আল-জারহু ওয়াত তাদীল ৫/১৯১; যাহাবী, মুগনী ফী আল-দুআফা’ ১/৪৯৩, ৫৭৬; মীযানুল ই‘তিদাল ৪/৩১৯, ইবনু হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান ৭/৭২।
[4] আবু নু‘আইম, মুসনাদুল ইমাম আবু হানীফা, পৃ: ১৩৭।
পাগড়ী কত হাত লম্বা হবে বা পাগড়ীর দৈর্ঘ্যের বিষয়ে সুন্নাত কী? এ বিষয়ে অনেক কথা প্রচলিত আছে। সবই ভিত্তিহীন বা আন্দায কথা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পাগড়ীর দৈর্ঘ্য কত ছিল তা কোনো হাদীসে বর্ণিত হয় নি।[1]
কোনো কোনো গ্রন্থে ‘দাঁড়িয়ে পাগড়ী পরিধান করা’ সুন্নাত বা আদব বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস আমার নযরে পড়ে নি। বিষয়টি পরবর্তী যুগের আলিমদের মতামত বলেই মনে হয়।[1]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিকাংশ সময় কাল রঙের পাগড়ী পরেছেন। হাদীস থেকে আমরা দেখতে পাই যে, তিনি মদীনায়, সফরে, যুদ্ধে সর্বত্র কাল পাগড়ী ব্যবহার করতেন।
৮/৯ম হিজরী শতকের কোনো কোনো আলিম উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় থাকা অবস্থায় কাল পাগড়ী পরতেন এবং সফর অবস্থায় সাদা পাগড়ী ব্যবহার করতেন। এ দাবীর পক্ষে কোনো প্রমাণ বা হাদীস তারা পেশ করেন নি। এজন্য হিজরী ৯ম শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম সাখাবী (৯০২ হি) এ কথাকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন।[1]
আমরা জানি ‘পাগড়ী’ পোশাক বা জাগতিক বিষয়। এ জন্য সাধারণ ভাবে হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ব্যতিরেকে কোনো রঙকে আমরা নাজায়েয বলতে পারব না। তবে কোনো রঙ সুন্নাত কিনা তা বলতে প্রমাণের প্রয়োজন। বিভিন্ন হাদীসে সাধারণ ভাবে সবুজ পোশাক পরিধানে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনো পাগড়ীর ক্ষেত্রে সবুজ রঙ ব্যবহার করেছেন বলে জানতে পারি নি। ফিরিশতাগণের পাগড়ীর বিষয়েও তাঁরা কখনো সবুজ পাগড়ী পরিধান করেছেন বলে কোনো সহীহ বা যয়ীফ হাদীস আমি দেখতে পাই নি। অনুরূপভাবে তিনি কখনো সাদা রঙের পাগড়ী পরিধান করেছেন বলেও জানতে পারি নি। কোন কোন সনদহীন ইসরাঈলীয় বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, তাবিয়ী কা’ব আহবার বলেছেন: ঈসা (আ:) যখন পৃথীবিতে নেমে আসবেন তখন তাঁর মাথায় সবুজ পাগড়ী থাকবে।[2]
[2] মুনাবী, ফযযুল কাদীর ২/৫৩৮।