আল্লাহর ওলীগণের পরিচয়, কর্ম ও মর্যাদার বিষয়ে কুরআন-হাদীসে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। এহইয়াউস সুনান ও রাহে বেলায়াত পু্স্তকদ্বয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এ বিষয়ে অনেক মিথ্যা কথা মুসলিম সমাজে প্রচার করেছে জালিয়াতগণ। অনেক সরলপ্রাণ নেককার বুযুর্গ সরল মনে এগুলো বিশ্বাস করেছেন। এখানে এ বিষয়ক কিছু কথা উল্লেখ করছি।
১. ওলীদের কারামত বা অলৌকিক ক্ষমতা সত্য
প্রচলিত একটি গ্রন্থে লেখা হয়েছে: ‘‘আল্লাহ তায়ালার বন্ধুদের শানে কোরান শরীফ ও হাদীস শরীফের কয়েকটি বাণী:.... কারামাতুল আউলিয়া হাক্কুন- আল-হাদীস। অর্থ আউলিয়া-এর অলৌকিক ক্ষমতা সত্য।’’[1]
এখানে এ বাক্যটি ‘আল-হাদীস’ বলে বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী বলে উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে জালিয়াতি করা হয়েছে। এছাড়াও বাক্যটির বিকৃত ও ভুল অনুবাদ করা হয়েছে। এখানে আমরা দুটি বিষয় আলোচনা করব: (১) এ বাক্যটির উৎস ও (২) এ বাক্যটির অর্থ।
প্রথমত: বাক্যটির উৎস
كَرَامَاتُ الأَوْلِيَاءِ حَقٌّ
‘‘ওলীগণের কারামত সত্য’’ এ বাক্যটি আলিমগণের কথা। এটি কোনো হাদীস নয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনোই এ কথা বলেন নি বা তাঁর থেকে কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে তা বর্ণিত হয় নি। উপরন্তু ‘কারামত’ শব্দটিই কুরআন বা হাদীসের শব্দ নয়। নবী ও ওলীগণের অলৌকিক কর্মকে কুরআন ও হাদীসে ‘আয়াত’ বা চিহ্ন বলা হয়েছে। দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দী থেকে নবী-রাসূলগণের ‘আয়াত’কে ‘মুজিযা’ এবং ওলীগণের ‘আয়াত’কে ‘কারামাত’ বলা শুরু হয়।
দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে মু’তাযিলা ও অন্যান্য কিছু সম্প্রদায়ের মানুষেরা ওলীগণের দ্বারা অলৌকিক কর্ম সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা অস্বীকার করেন। তাদের এ মতটি কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী। কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াত ও বিভিন্ন হাদীস প্রমাণ করে যে, নবীগণ ছাড়াও আল্লাহ নেককার মানুষদেরকে কখনো কখনো অলৌকিক চিহ্ন বা ‘আয়াত’ প্রদান করেন। এজন্য সুন্নাত-পন্থী আলিমগণ বলেন: ‘‘কারামাতুল আউলিয়া হাক্ক।’’
দ্বিতীয়ত: বাক্যটির অর্থ
এভাবে আমরা দেখছি যে, এ বাক্যটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী নয়; বরং আলিমগণের বক্তব্য। কাজেই বাক্যটিকে ‘হাদীস’ বলে জালিয়াতি করা হয়েছে। এছাড়া উপরের উদ্ধৃতিতে বাক্যটির ভুল অনুবাদ করা হয়েছে। ফলে অনুবাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জালিয়াতি ঘটেছে।
ক. ‘কারামত’ বনাম ‘অলৌকিক ক্ষমতা’
এ বাক্যে তিনটি শব্দ রয়েছে: কারামত, আউলিয়া, হক্ক। উপরের উদ্ধৃতিতে প্রথম শব্দ ‘কারামত’-এর অনুবাদ করা হয়েছে ‘অলৌকিক ক্ষমতা’। এ অনুবাদটি শুধু ভুলই নয়, বরং ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। কারামত অর্থ অলৌকিক কর্ম বা চিহ্ন, অলৌকিক ক্ষমতা নয়। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কোনোরূপ ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ আছে বলে বিশ্বাস করা শির্ক।
‘কারামত’ শব্দটির মূল অর্থ ‘সম্মাননা’। ইসলামী পরিভাষায় ‘কারামত’ অর্থ ‘নবী-রাসূলগণ ব্যতীত অন্যান্য নেককার মানুষের দ্বারা সংঘটিত অলৌকিক কর্ম।’ ‘অলৌকিক চিহ্ন’কে ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ মনে করা শির্কের অন্যতম কারণ। খৃস্টানগণ দাবি করেন, ‘মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতা ঈশ্বর ছাড়া কারো নেই, যীশু মৃতকে জীবিত করেছেন, এতে প্রমাণিত হয় যে, যীশু ঈশ্বর বা তাঁর মধ্যে ঈশ্বরত্ব বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল।
কুরআন কারীমে বারংবার বলা হয়েছে যে, কোনো অলৌকিক কর্ম বা চিহ্ন কোনো নবী-রাসূল বা কেউ নিজের ইচ্ছায় ঘটাতে বা দেখাতে পারেন না; শুধুমাত্র আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটতে পারে। কোনো ওলী বা নেককার ব্যক্তি কর্তৃক কোনো অলৌকিক কর্ম সংঘটিত হওয়ার অর্থ এ নয় যে, এ কর্মটি সম্পাদন করা সে ব্যক্তির ইচ্ছাধীন বা তার নিজের ক্ষমতা। এর অর্থ হলো একটি বিশেষ ঘটনায় আল্লাহ তাকে সম্মান করে একটি অলৌকিক চিহ্ন প্রদান করেছেন। অন্য কোনো সময়ে তা নাও দিতে পারেন।
একটি উদাহরণ দেখুন। নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত, ২৩ হিজরীর প্রথম দিকে উমার (রা) মসজিদে নাবাবীতে জুমুআর খুতবা প্রদান কালে উচ্চস্বরে বলে উঠেন: (يا سارية، الجبلَ) ‘‘হে সারিয়া, পাহাড়।’’ সে সময়ে মুসলিম সেনাপতি সারিয়া ইবনু যুনাইম পারস্যের এক যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করছিলেন। তিনি যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার উপক্রম করছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি উমারের এ বাক্যটি শুনতে পান এবং পাহাড়ের আশ্রয়ে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেন।[2]
এ ঘটনায় আমরা উমার (রা)-এর একটি মহান কারামত দেখতে পাই। তিনি হাজার মাইল দূরের যুদ্ধ ক্ষেত্রের অবস্থা ‘অবলোকন’ করেছেন, মুখে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং সে নির্দেশনা সারিয়া শুনতে পেয়েছেন।
এ কারামতের অর্থ হলো, মহান আল্লাহ তাঁর এ মহান ওলীকে এ দিনের এ মুহূর্তে এ বিশেষ ‘সম্মাননা’ প্রদান করেন, তিনি দূরের দৃশ্যটি হৃদয়ে অনুভব করেন, নির্দেশনা দেন এবং তাঁর নির্দেশনা আল্লাহ সারিয়ার কাছে পৌঁছে দেন। এর অর্থ এ নয় যে, উমার (রা)-এর হাজার মাইল দূরের সব কিছু অবলোকন করার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, অথবা তিনি ইচছা করলেই এভাবে দূরের কিছু দেখতে পেতেন বা নিজের কথা দূরে প্রেরণ করতে পারতেন।
এ বছরেরই শেষে ২৩ হিজরীর যুলহাজ্জ মাসের ২৭ তারিখে ফজরের সালাত আদায়ের জন্য যখন উমার (রা) তাকবীরে তাহরীমা বলেন, তখন তাঁরই পিছেন চাদর গায়ে মুসল্লীরূপে দাঁড়ানো আল্লাহর শত্রু আবূ লু’লু লুকানো ছুরি দিয়ে তাঁকে বারংবার আঘাত করে। তিনি অচেতন হয়ে পড়ে যান। চেতনা ফিরে পেলে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আমাকে কে আঘাত করল? তাঁকে বলা হয়, আবূ ল’লু। তিনি বলেন, আল-হামদু লিল্লাহ, আমাকে কোনো মুসলিমের হাতে শহীদ হতে হলো না। এর কয়েকদিন পর তিনি ইন্তিকাল করেন।[3]
এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মহান আল্লাহ প্রথম ঘটনায় হাজার মাইল দূরের অবস্থা উমারকে দেখিয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনায় পাশে দাঁড়ানো শত্রুর বিষয়ে তাঁকে জানতে দেন নি। কারণ ‘কারামত’ কখনোই ক্ষমতা নয়, কারমাত আললাহর পক্ষ থেকে দেয়া সম্মাননা মাত্র।
খ. ওলী ও আউলিয়া
ওলী ও বেলায়াতের অর্থ, পরিচয় ও বেলায়াত অর্জনের সুন্নাত পদ্ধতি জানতে পাঠককে আমরা লেখা ‘রাহে বেলায়াত’ বইটি পাঠ করতে অনুরোধ করছি। মূলত ‘বেলায়াত’ (الولاية) শব্দের অর্থ বন্ধুত্ব, নৈকট্য, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি। ‘‘বেলায়েত’’ অর্জনকারীকে ‘‘ওলী’’ (الولي), অর্থাৎ বন্ধু, নিকটবর্তী বা অভিভাবক বলা হয়। ওলীদের পরিচয় প্রদান করে মহান আল্লাহ বলেন:
أَلا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلا هُمْ يَحْزَنُونَ الَّذِينَ آَمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ
‘‘জেনে রাখ! নিশ্চয় আল্লাহর ওলীগণের কোনো ভয় নেই এবং তাঁরা চিন্তাগ্রস্তও হবেন না- যারা ঈমান এনেছেন এবং তাকওয়া অবলম্বন করেন।’’[4]
‘‘ঈমান’’ অর্থ তাওহীদ ও রিসালাতের প্রতি বিশুদ্ধ বিশ্বাস- যে বিশ্বাস শিরক, কুফর ও বিদআত থেকে মুক্ত। ‘‘তাকওয়া’’ শব্দের অর্থ আত্মরক্ষা করা। ফরয-ওয়াজিব পালন ও হারাম-পাপ বর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে আত্মরক্ষার নাম-ই তাকওয়া। এ আয়াতের মাধ্যমে আমরা জানছি যে, দুটি গুণের মধ্যে ওলীর পরিচয় সীমাবদ্ধ। ঈমান ও তাকওয়া। এ দু’টি গুণ যার মধ্যে যত বেশি ও যত পরিপূর্ণ হবে তিনি বেলায়াতের পথে তত বেশি অগ্রসর ও আল্লাহর তত বেশি ওলী বা প্রিয় বলে বিবেচিত হবেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওলীর বা বেলায়াতের পথের কর্মকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন: ফরয ও নফল। সকল ফরয পালনের পরে অনবরত বেশি বেশি নফল ইবাদত পালনের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্যের পথে বেশি বেশি অগ্রসর হতে থাকে।
এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, প্রত্যেক মুসলিমই আল্লাহর ওলী। ঈমান ও তাকওয়া যার মধ্যে যত বেশি থাকবে তিনি তত বেশি ওলী। ইমাম আবু জা’ফর তাহাবী (৩২১হি) ইমাম আবু হানীফা, মুহাম্মাদ, আবু ইউসূফ (রাহ) ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা বর্ণনা করে বলেন:
اَلْمُؤْمِنُوْنَ كُلُّهُمْ أَوْلِيَاءُ الرَّحْمَنِ، وَأَكْرَمُهُمْ عِنْدَ اللهِ أَطْوَعُهُمْ وَأَتْبَعُهُمْ لِلْقُرْآنِ
‘‘সকল মুমিন করুণাময় আল্লাহর ওলী। তাঁদের মধ্য থেকে যে যত বেশি আল্লাহর অনুগত ও কুরআনের অনুসরণকারী সে ততবেশি আল্লাহর কাছে কারামত-প্রাপ্ত (ততবেশি ওলী বা ততবেশি সম্মানিত)।[5]
তাহলে ওলী ও বেলায়েতের মানদন্ড হচ্ছে: ঈমান ও তাকওয়া: সকল ফরয কাজ আদায় এবং বেশি বেশি নফল ইবাদত করা। যদি কোনো মুসলিম পরিপূর্ণ সুন্নাত অনুসারে সঠিক ঈমান সংরক্ষণ করেন, সকল প্রকারের হারাম ও নিষেধ বর্জনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করেন, তাঁর উপর ফরয যাবতীয় দায়িত্ব তিনি আদায় করেন এবং সর্বশেষে যথাসম্ভব বেশি বেশি নফল ইবাদত আদায় করেন তিনিই আল্লাহর ওলী বা প্রিয় মানুষ। এ সকল বিষয়ে যিনি যতুটুকু অগ্রসর হবেন তিনি ততটুকু আল্লাহর নৈকট্য বা বেলায়াত অর্জন করবেন। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ‘বেলায়াত’ কোনো পদ-পদবী নয় এবং ইসলামের ‘ওলী’ বলে কোনো বিশেষ পদ বা পর্যায় নেই। প্রত্যেক মুমিনই ওলী। যে যত বেশি ঈমান ও তাকওয়া অর্জন করবেন তিনি তত বেশি ওলী।
গ. হক্ক
‘কারমাতুল আউলিয়া হক্ক’ বা ‘ওলীগণের অলৌকিক কর্ম সত্য’ অর্থ ওলীগণ থেকে অলৌকিক কর্ম প্রকাশ পাওয়া সম্ভব। যদি কোনো বাহ্যত মুমিন মুত্তাকী মানুষ থেকে কোনো অলৌকিক কার্য প্রকাশ পায় বা এরূপ ঈমানদার-মুত্তাকী মানুষ থেকে অলৌকিক কর্ম প্রকাশিত হয়েছে বলে সহীহ সনদে জানা যায় তবে তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত সম্মাননা বলে বুঝতে হবে। তা অস্বীকার করা বা অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেয়া মু‘তাযিলীদের আকীদা।
‘ওলীদের কারামত সত্য’ বলতে দু প্রকারে ভুল অর্থ করা হয়:
(১) কেউ মনে করেন, ওলীদের নামে যা কিছু কারামত বা অলৌকিক কথা বলা হবে সবই সত্য মনে করতে হবে। কথাটি জঘন্য ভুল। আমরা দেখেছি, যাচাই ছাড়া কোনো সংবাদ গ্রহণ করতে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ﷺ নিষেধ করেছেন। কথিত, লিখিত বা বর্ণিত কথাগুলি যাচাই ছাড়া গ্রহণ ও বর্ণনা করা হাদীসে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে এবং এরূপ ব্যক্তিকে মিথ্যাবাদী বলে গণ্য করা হয়েছে। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে যা কিছু কথিত বা বর্ণিত হয় তা যাচাই ছাড়া বিশ্বাস বা গ্রহণ করা যেমন হারাম, তেমনি ওলীগণের নামে কথিত, লিখিত বা বর্ণিত কোনো তথ্য সনদ যাচাই ছাড়া গ্রহণ, বর্ণনা বা বিশ্বাস করাও হারাম। প্রকৃত সত্য যে, জাল হাদীসের মত অগণিত ‘জাল’ কারামত ওলীদের নামে সমাজে ছড়ানো হয়েছে।
(২) কেউ মনে করেন যে, ‘ওলীগণের কারামত সত্য’ অর্থ ওলীগণের কারামত থাকতেই হবে বা কারামতই ওলীগণের আলামত বা চিহ্ন। এ ধারণাটি কঠিন ভুল। ঈমান ও তাকওয়া ছাড়া ওলীর আর কোনো পরিচয় নেই। ঈমান ও আমালের বাহ্যিক প্রকাশ ছাড়া ‘ওলী’-র পরিচয়ের জন্য কেনো চিহ্ন, মার্কা বা সার্টিফিকেট নেই। কোনো ‘কারামত’ কখনোই বেলায়াতের মাপকাঠি নয়। আল্লাহর প্রিয়তম ওলীর কোনো প্রকার কারামত নাও থাকতে পারে। আমরা জানি আল্লাহর প্রিয়তম ওলী সাহাবায়ে কেরামের অধিকাংশেরই কোনো কারামত বর্ণিত হয় নি। আবার পাপী বা কাফির মুশরিক থেকেও অলৌকিক কার্য প্রকাশিত হতে পারে। সর্বোপরি কারামতের অধিকারী ওলীও কোনো বিশেষ পদমর্যাদার ব্যক্তি নন বা পদস্খলন থেকে সংরক্ষিত নন। কর্মে ত্রুটি হলে তিনি শাস্তিভোগ করবেন। কুরআন উল্লেখ করেছে যে, কারামতের অধিকারী ওলীও গোমরাহ ও বিভ্রান্ত হয়েছেন।[6]
[2] তাবারী, তারীখ ২/৫৫৩-৫৫৪; বাইহাকী, আল-ই’তিকাদ,পৃ. ৩১৪; ইবনু হাজার, আল-ইসাবা ৩/৫-৬; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪৬৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৫১৪-৫১৫।
[3] ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ৭/১৩০-১৩৮।
[4] সূরা (১০) ইউনূস: ৬২-৬৩ আয়াত।
[5] ইমাম তাহাবী, আল-আকীদাহ (শারহ সহ), পৃ: ৩৫৭-৩৬২।
[6] সূরা (৭) আ’রাফ: ১৭৫-১৭৭ আয়াত। দেখুন: তাবারী, তাফসীর ৯/১১৯-১৩০, ইবনু কাসির, তাফসীর ২/২৬৫-২৬৮।
আমাদের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি বাক্য:
إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لاَ يَمُوْتُوْنَ، بَلْ يَنْتَقِلُوْنَ مِنْ دَارِ الْفَنَاءِ إِلَى دَارِ الْبَقَاءِ
প্রচলিত একটি পুস্তকে এ বাক্যটির অনুবাদ লেখা হয়েছে: ‘‘নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুদের কোন মৃত্যু নেই বরং তাঁরা স্থানান্তরিত হয় ধ্বংসশীল ইহ জগৎ হতে স্থায়ী পরজগতে’’-আল হাদীস।[1]
এখানে উল্লেখ্য যে, আব্দুল কাদির জীলানীর (রাহ) নামে প্রচলিত ‘সিররুল আসরার’ পুস্তকে এ হাদীসটি অন্যভাবে উল্লেখ করা হয়েছে:
اَلْمُؤْمِنُوْنَ لاَ يَمُوْتُوْنَ، بَلْ يَنْتَقِلُوْنَ مِنْ دَارِ الْفَنَاءِ إِلَى دَارِ الْبَقَاءِ
‘‘মুমিনগণের কোন মৃত্যু নেই বরং তাঁরা স্থানান্তরিত হয় ধ্বংসশীল ইহজগৎ হতে স্থায়ী পরজগতে।’’
দুটি কথাই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে জঘন্য মিথ্যা, বানোয়াট ও জাল কথা। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা বানোয়াট সনদেও তা বর্ণিত হয় নি।
আমরা জানি যে, মুমিন-কাফির প্রতিটি মানুষই মৃত্যুর মাধ্যমে ‘‘ধ্বংসশীল ইহ জগৎ থেকে স্থায়ী পরজগতে স্থানান্তরিত হয়।’’ এখানে কারো কোনো বিশেষত্ব নেই। কুরআন ও হাদীস দ্বারা শহীদগণের পারলৌকিক বিশেষ জীবন প্রমাণিত। সহীহ হাদীসের আলোকে নবীগণের পারলৌকিক বিশেষ জীবন প্রমাণিত। এছাড়া অন্য কোনো নেককার মানুষের পারলৌকিক বিশেষ কোনো জীবন প্রমাণিত নয়। আলিমগণ, ওলীগণ, মুআযযিনগণ... ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার নেককার মানুষের মৃত্যু পরবর্তী ‘হায়াত’ বা জীবন সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় সবই সনদ বিহীন, ভিত্তিহীন কথা।[2]
[2] দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৯৫-২৯৬; দাইলামী, আল-ফিরদাউস ৩/৩৫।
ওলীগণের পারলৌকিক জীবন বিষয়ক আরেকটি জাল কথা
اَلأَنْبِيَاءُ وَالأَوْلِيَاءُ يُصَلُّوْنَ فِيْ قُبُوْرِهِمْ كَمَا يُصَلُّوْنَ فِيْ بُيُوْتِهِمْ
‘‘নবীগণ ও ওলীগণ তাঁদের কবরের মধ্যে সালাত আদায় করেন, যেমন তাঁরা তাঁদের বাড়িতে সালাত আদায় করেন।’’ [1]
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, নবীগণের ক্ষেত্রে হাদীসটি সহীহ। তবে এখানে ‘ওলীগণ’ শব্দটির সংযোগ বানোয়াট।
প্রচলিত একটি পুস্তকে লিখিত হয়েছে: ‘‘আল-আউলিয়াও রায়হানুল্লাহ- আল হাদীস। অর্থ আউলিয়া আল্লাহর সুবাস।’’[1]
কথাটি কোনো কোনো বুজুর্গ বলেছেন, হাদীস হিসেবে এটি জাল। ওলীগণকে আল্লাহর সুবাস বলায় কোনো অসুবিধা নেই। আল্লাহর রিযককে আল্লাহর সুবাস বলা হয়েছে, সন্তানকেও আল্লাহর সুবাস বলা হয়েছে।[2] কিন্তু এ কথাটিকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে বলতে হলে সহীহ সনদে তা বর্ণিত হতে হবে। কিন্তু এ কথাটির কোনো জাল সনদও নেই।
[2] তাবারী, তাফসীর ২৭/১২৩; হাকীম তিরমিযী, নাওয়াদিরুল উসূল ২/৫৯; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/৬২১।
প্রচলিত একটি পুস্তকে লিখিত হয়েছে: ‘‘ইন্না আউলিয়াই তাহ্তা কাবাই লা ইয়ারিফুহুম গাইরী ইল্লা আউলিয়াই।- হাদীসে কুদসী। অর্থ: নিশ্চয়ই আমার বন্ধুগণ আমার জুববার অন্তরালে অবস্থান করেন, আমি ভিন্ন তাঁদের পরিচিতি সম্বন্ধে কেহই অবগত নহে, আমার আউলিয়াগণ ব্যতীত।’’[1]
এটিও একটি ভিত্তিহীন ও জাল কথা। সহীহ, যয়ীফ বা জাল কোনো সনদে এ কথাটি বর্ণিত হয়েছে বলে জানা যায় নি। সনদবিহীন অন্যান্য জাল হাদীসের মত এ কথাটিও সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। আর নবম-দশম হিজরী শতকের কোনো কোনো আলিম ভিত্তিহীন জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে সনদ বিহীন ভাবে এ কথাটি তাদের পুস্তকে উল্লেখ করেছেন।[2]
[2] জুরজানী, আলী ইবনু মুহাম্মাদ (৮১৬হি), তা’রীফাত, পৃ. ২৯৫; মুনাবী, মুহাম্মাদ আব্দুর রাঊফ (১০৩১হি); তা’আরীফ, পৃ. ৬৭৬; মোল্লা আলী কারী, মিরকাত (শামিলা) ১৫/২৫৬।
আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে যে, আল্লাহর খাস ওলীগণ জান্নাতের নেয়ামতের জন্য ইবাদত করেন না, বরং শুধুই ‘মহববত’ বা ‘দীদারের’ জন্য। এ অবস্থাকে ‘সর্বোচ্চ’ অবস্থা বলে মনে করা হয়। এ মর্মে একটি জাল হাদীস:
إِنَّ للهِ جَنَّةً لاَ فِيْهَا حُوْرٌ وَلاَ قَصْرٌ وَلاَ عَسَلٌ وَلاَ لَبَنٌ
‘‘আল্লাহর এমন একটি জান্নাত আছে যেখানে হুর, অট্টালিকা, মধু এবং দুগ্ধ নেই। (বরং শুধু দীদারে ইলাহী-মাওলার দর্শন)।’’ কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, সনদবিহীন একটি জাল কথা।[1]
উপরের অর্থেই আরেকটি বানোয়াট কথা:
اَلدُّنْيَا حَرَامٌ عَلَى أَهْلِ الآخِرَةِ، وَالآخِرَةُ حَرَامٌ عَلَى أَهْلِ الدُّنْيَا، وَالدُّنْيَا وَالآخِرَةُ حَرَامٌ عَلَى أَهْلِ اللهِ
‘‘আখিরাত-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া হারাম আর দুনিয়া-ওয়ালাদের জন্য আখিরাত হারাম। আর আল্লাহ-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই হারাম।’’ (অর্থাৎ উভয়কে হারাম না করে আল্লাহওয়ালা হওয়া যায় না)
দাইলামী (৫০৯ হি) ‘ফিরদাউস’-এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। তাঁর পুত্র আবূ মানসূর দাইলামী (৫৫৮হি) তার ‘মুসনাদুল ফিরদাউস’ গ্রন্থে এর একটি সনদ উল্লেখ করেছেন। সনদের অধিকাংশ রাবীই একেবারে অজ্ঞাত পরিচয়। অন্যরা দুর্বল। এজন্য হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করা হয়েছে।[1]
এ হাদীসে বলা হয়েছে যে, (১) আখিরাত-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া হারাম এবং (২) আল্লাহ-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া আখিরাত উভয়ই হারাম। এ কথা দুটি কুরআন কারীম ও অগণিত সহীহ হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। মহান আল্লাহ ঠিক এর বিপরীত কথা বলেছেন। তিনি তাঁর প্রিয়তম রাসূল ﷺ ও শ্রেষ্ঠতম আল্লাহ-ওয়ালা সাহাবীগণসহ সকল আল্লাহওয়ালা ও আখিরাত-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সৌন্দর্য ও আনন্দ হারাম করেন নি বলে ঘোষণা করেছেন: ‘‘আপনি বলুন: আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যে সৌন্দর্য ও পবিত্র আনন্দ ও মজার বস্তগুলো বের (উদ্ভাবন) করেছেন তা হারাম বা নিষিদ্ধ করলো কে? আপনি বলুন: সেগুলো মুমিনদের জন্য পার্থিব জীবনে এবং কিয়ামতে শুধুমাত্র তাদের জন্যই।’’[2]
এরূপ একটি জাল কথা: ‘‘ঐ ব্যক্তি আমার প্রিয়তম যে আমাকেই চায় শাস্তির ভয়ে কিংবা পুরস্কারের আশায় নহে।... তাহা অপেক্ষা অপরাধী কে, যে দোজখের ভয়ে কিংবা বেহেশতের আশায় আমাকে অর্চ্চনা করে..।’’[3]
কুরআনে ‘আল্লাহওয়ালা’ ও ‘আখেরাতওয়ালা’দিগকে দুনিয়া ও আখিরাতের নেয়ামত প্রার্থনা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ﷺ সর্বদা এভাবে দোয়া করতেন। আর আখিরাতের নেয়ামত তো আল্লাহওয়ালা ও আখেরাতওয়ালাদের মূল কাম্য। আল্লাহওয়ালা হতে হলে, জান্নাতের নিয়ামতের আশা আকাঙ্খা বর্জন করতে হবে, এ ধারণাটি কুরআন ও হাদীসের সুষ্পষ্ট বিরোধী। কোনো কোনো নেককার মানুষের মনে এরূপ ধারণা আসতে পারে। তবে রাসূলুল্লাহ ﷺ ও সাহাবীগণ সর্বদা জান্নাতের নিয়ামত চেয়েছেন, সাহাবীগণকে বিভিন্ন নিয়ামতের সুসংবাদ দিয়েছেন। সর্বোপরি মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে সর্বোচ্চ মর্যাদার নবী-ওলীগণ এবং সাধারণ ওলীগণ সকলের জন্য জান্নাতের নিয়ামতের বর্ণনা দিয়েছেন।
[2] সূরা (৭) আ’রাফ: ৩১-৩২ আয়াত।
[3] আলহাজ্জ খান বাহাদুর আহছানউল্লা (ই. ফা. বা. ২য় সংস্করণ ২০১১) পৃষ্ঠা ৬৯।
এগুলো সমাজে প্রচলিত অতি পরিচিত চারটি পরিভাষা। কুরআন-হাদীসে ‘‘শরীয়ত’’ শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছে। ইসলামের চারটি পর্যায় বা স্তর অর্থে তরীকত, মারেফত ও হাকীকত পরিভাষাগুলো কুরআন বা হাদীসে কোথাও ব্যবহৃত হয় নি। কখনোই কোনো সাহাবী, তাবিয়ী, প্রসিদ্ধ চার ইমাম বা অন্য কেউ ইসলামের চারটি স্তর বা পর্যায় হিসেবে এ পরিভাষাগুলি ব্যবহার করেন নি। প্রথমে শীয়াগণ এগুলি উদ্ভাবন ও ব্যবহার করেন। পরে সুন্নী সরল সূফীগণের মধ্যে পরিভাষাগুলি প্রসার লাভ করে। বিশেষত, ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীর পর মিসর, ইয়ামান, ইরান, ইরাক, বাগদাদ ও মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র শীয়াগণের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়ে শীয়া আকীদার অনেক কিছুই সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আর এ সুযোগে জালিয়াতগণ রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে হাদীস বানিয়ে বলেছে:
اَلشَّرِيْعَةُ شَجَرَةٌ وَالطَّرِيْقَةُ أَغْصَانُهَا وَالْمَعْرِفَةُ أَوْرَاقُهَا وَالْحَقِيْقَةُ ثَمَرُهَا
‘‘শরীয়ত একটি বৃক্ষ, তরীকত তার শাখা-প্রশাখা, মারিফত তার পাতা এবং হাকীকত তার ফল।’’[1]
মিথ্যাচারিদের আল্লাহ লাঞ্চিত করুন। তাদের বানানো আরেকটি কথা:
اَلشَّرِيْعَةُ أَقْوَالِيْ وَالطَّرِيْقَةُ أَفْعَالِيْ وَالْحَقِيْقَةُ حَالِيْ وَالْمَعْرِفَةُ رَأْسُ مَالِيْ
‘‘শরীয়ত আমার কথাবার্তা, তরীকত আমার কাজকর্ম, হাকীকত আমার অবস্থা এবং মারিফাত আমার মূলধন।’’[2]
আরবী মা’রিফাত (المعرفة) শব্দটি আরাফা (عرف) ক্রিয়াপদ থেকে গৃহীত। এর অর্থ (إدارك الشيء بحاسة من حواسه) কোনো ইন্দ্রিয় দিয়ে কোনো কিছু অবগত হওয়া বা পরিচয় লাভ করা। এভাবে মূলত ইন্দ্রিয়-লব্ধ জ্ঞান বা পরিচয়কে ‘‘মারিফাত’’ বলা হয়। তবে সাধারণত ‘মারিফাত’ বলতে ‘‘জ্ঞান’’, ‘‘পরিচয়’’ বা শিক্ষা (knowledge, education) বুঝানো হয়।
‘‘শরীয়ত, তরীকত, হাকীকাত ও মারিফাত’’ এ পর্যায়ক্রমিক ধারায় ‘‘মারিফাত’’-কে শরীয়তের উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে কুরআন-সুন্নাহ সুস্পষ্টভাবেই মারিফাতকে শরীয়তের নিম্নের স্থান দিয়েছে। ‘জ্ঞান’ অর্থে ‘মারিফাত’ ঈমান অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আল্লাহর মারিফাত বা আল্লাহর পরিচয় লাভ মানুষকে তাঁর প্রতি ঈমান বা বিশ্বাসের দিকে ধাবিত করে। তবে কুরআন-হাদীসে মূলত ‘‘ইলম’’ এবং ‘‘ফিকহ’’-এর প্রশংসা করা হয়েছে, ‘‘মারিফাত’’-এর কোনো বিশেষ প্রশংসা করা হয় নি। ‘‘মারিফাত’’ ঈমানের পথে পরিচালিত করলে তা প্রশংসনীয়। উপরন্তু কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘‘মারিফাত’’ অর্জনের পরেও মানুষ কুফর বা অবিশ্বাসে লিপ্ত হয়। কুরআনে একাধিক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইহূদী-খৃস্টানদের অনেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর দীন সম্পর্কে পরিপূর্ণ ‘‘মারিফাত’’ অর্জনের পরেও কুফরী করত।[3] অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
فَلَمَّا جَاءَهُمْ مَا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ
‘‘অতঃপর যখন তাদের নিকট তা (কুরআন) আগমন করল, তারা তার মারিফাত অর্জনের (প্রকৃত পরিচয় জানার) পরেও কুফরী করল।’’[4]
يَعْرِفُونَ نِعْمَةَ اللَّهِ ثُمَّ يُنْكِرُونَهَا وَأَكْثَرُهُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘আল্লাহর নিয়ামতের মারিফাত (প্রকৃত পরিচয়) তারা লাভ করে- অতঃপর তারা তা অস্বীকার করে এবং তাদের অধিকাংশই কাফির।’’[5]
কুরআন-সুন্নাহ মুমিনদেরকে ‘‘মারিফাত’’ অর্জনের নির্দেশ দেয় নি, বরং ইলম অর্জনের নির্দেশ দিয়েছে; কারণ ‘‘মারিফাত’’ তো ঈমান অর্জনের পূর্বের অবস্থা। কিন্তু শীয়াগণ মারিফাতকে ঈমান, ইসলাম ও শরীয়ত থেকে পৃথক উচ্চপর্যায়ের বিষয় বলে প্রচার করেন এবং মারিফাতকে ‘‘তত্ত্বজ্ঞান’’ বা গোপন বা পৃথক কোনো জ্ঞান বলে প্রচার করেন। এ সকল বিভ্রান্তির অপনোদনে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর নিম্নের বক্তব্য প্রণিধানযোগ:
نَعْرِفُ اللهَ تَعَالَي حَقَّ مَعْرِفَتِهِ كَمَا وَصَفَ اللهُ نَفْسَهُ فِيْ كِتَابِهِ بِجَمِيْعِ صِفَاتِهِ .. وَيَسْتَوِيْ الْمُؤْمِنُوْنَ كُلُّهُمْ فِيْ الْمَعْرِفَةِ وَالْيَقِيْنِ وَالتَّوَكُّلِ وَالْمَحَبَّةِ وَالرِّضَا وَالْخَوْفِ وَالرَّجَاءِ وَالإِيْمَانِ فِيْ ذَلِكَ، وَيَتَفَاوَتُوْنَ فِيْمَا دُوْنَ الإِيْمَانِ فِيْ ذَلِكَ كُلِّهِ.
‘‘মহান আল্লাহর প্রকৃত মা’রিফাত আমরা লাভ করেছি, তিনি যেভাবে তাঁর কিতাবে তাঁর নিজের বর্ণনা দিয়েছেন সেভাবে তাঁর সকল বিশেষণ সহকারে। ... মুমিনগণ সকলেই সমান মারিফাতের বিষয়ে, এবং ইয়াকীন, তাওয়াক্কুল, মাহাববাত, রিযা (সন্তুষ্টি), খাওফ (ভয়), রাজা (আশা) এবং এ সকল বিষয়ের ঈমান-এর ক্ষেত্রে। তাদের মর্যাদার কমবেশি হয় মূল ঈমান বা বিশ্বাসের অতিরিক্ত যা কিছু আছে তার সবকিছুতে।’’[6]
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর বক্তব্য থেকে দুটি বিষয় সুস্পষ্ট: (১) মারিফাত ঈমানেরই সহযাত্রী। আল্লাহর সত্যিকার মারিফাত লাভই ঈমানের পথে পরিচালিত করে; এজন্য সকল মুমিনই আল্লাহর হক্ক বা প্রকৃত মারিফাত লাভ করেছেন এবং এ বিষয়ে তাঁরা সকলেই সমমর্যাদার। (২) আল্লাহর মারিফাত গোপন কোনো তত্ত্বজ্ঞান নয় বা তা অর্জনের জন্য গোপন কোনো পথ নেই। মহান আল্লাহ তাঁর নিজের বিষয়ে ওহীর মাধ্যমে যা জানিয়েছেন তা অবগত হওয়াই তাঁর প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মারিফাত।
[2] আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৬।
[3] সূরা (২) বাকারা: ১৪৬; সূরা (৬) আনআম: ২০ আয়াত।
[4] সূরা (২) বাকারা: ৮৯ আয়াত।
[5] সূরা (১৬) নাহল: ৮৩ আয়াত।
[6] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আকবার (মোল্লা আলী কারীর ব্যাখ্যা-সহ), পৃ. ১৫১-১৫৭।
কথিত আছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করে বলেন:
رَجَعْنَا مِنَ الْجِهَادِ الأَصْغَرِ إِلَى الْجِهَادِ الأَكْبَرِ... جِهَادُ الْقَلْبِ/ مُجَاهَدَةُ الْعَبْدِ هَوَاهُ
‘‘আমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে প্রত্যাবর্তন করলাম। ... বড় জিহাদ হলো মনের সাথে জিহাদ বা নিজের প্রবৃত্তির সাথে সংগ্রাম।’’
ইবনু তাইমিয়া হাদীসটি ভিত্তিহীন ও বাতিল বলে গণ্য করেছেন। ইরাকী, সুয়ূতী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসটি দুর্বল সনদে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। পক্ষান্তরে সহীহ সনদে কথাটি ইবরাহীম ইবনু আবী আবলা (১৫২ হি) নামক প্রসিদ্ধ তাবিয়ী থেকে তাঁর নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। এজন্য ইবনু হাজার আসকালানী বলেছেন যে, হাদীসটি মূলত এ তাবিয়ীর বক্তব্য। অনেক সময় দুর্বল রাবীগণ সাহাবী বা তাবিয়ীর কথাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা হিসেবে বর্ণনা করেন।[1]
আমাদের সমাজে এ অর্থে আরেকটি ‘হাদীস’ প্রচলিত:
أَشَدُّ الْجِهَادِ جِهَادُ الْهَوَى
‘‘সবচেয়ে কঠিন জিহাদ প্রবৃত্তির সাথে জিহাদ।’’
কথাটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা নয়। তাঁর কথা হিসেবে কোনো সনদেই তা বর্ণিত হয় নি। প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী ইবরাহীম ইবনু আদহাম (১৬১হি) থেকে তাঁর নিজের বক্তব্য হিসেবে বর্ণিত।[1]
উল্লেখ্য যে, এ অর্থের কাছাকাছি সহীহ হাদীস রয়েছে। ফুদালাহ ইবনু উবাইদ (রা) বলেন, বিদায় হজ্জের ওয়াযের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
الْمُجَاهِدُ مَنْ جَاهَدَ نَفْسَهُ للَّهِ (وفي رواية: فِي طَاعَةِ اللَّهِ)
‘‘আর মুজাহিদ তো সে ব্যক্তি যে আল্লাহর জন্য/ আল্লাহর আনুগত্যের জন্য নিজের প্রবৃত্তির সাথে জিহাদ করে।’’[2]
দুঃখজনক যে, বিভিন্ন প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থে সংকলিত সহীহ হাদীস বাদ দিয়ে ভিত্তিহীন বানোয়াট কথাগুলো আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বলি।
[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/১৬৫; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ১১/২০৪; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৫৪; হাইসামী, মাওয়ারিদ ১/১২৭-১২৮; মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/২৬৮।