লগইন করুন
এগুলো সমাজে প্রচলিত অতি পরিচিত চারটি পরিভাষা। কুরআন-হাদীসে ‘‘শরীয়ত’’ শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছে। ইসলামের চারটি পর্যায় বা স্তর অর্থে তরীকত, মারেফত ও হাকীকত পরিভাষাগুলো কুরআন বা হাদীসে কোথাও ব্যবহৃত হয় নি। কখনোই কোনো সাহাবী, তাবিয়ী, প্রসিদ্ধ চার ইমাম বা অন্য কেউ ইসলামের চারটি স্তর বা পর্যায় হিসেবে এ পরিভাষাগুলি ব্যবহার করেন নি। প্রথমে শীয়াগণ এগুলি উদ্ভাবন ও ব্যবহার করেন। পরে সুন্নী সরল সূফীগণের মধ্যে পরিভাষাগুলি প্রসার লাভ করে। বিশেষত, ইসলামের প্রথম তিন শতাব্দীর পর মিসর, ইয়ামান, ইরান, ইরাক, বাগদাদ ও মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র শীয়াগণের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময়ে শীয়া আকীদার অনেক কিছুই সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আর এ সুযোগে জালিয়াতগণ রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে হাদীস বানিয়ে বলেছে:
اَلشَّرِيْعَةُ شَجَرَةٌ وَالطَّرِيْقَةُ أَغْصَانُهَا وَالْمَعْرِفَةُ أَوْرَاقُهَا وَالْحَقِيْقَةُ ثَمَرُهَا
‘‘শরীয়ত একটি বৃক্ষ, তরীকত তার শাখা-প্রশাখা, মারিফত তার পাতা এবং হাকীকত তার ফল।’’[1]
মিথ্যাচারিদের আল্লাহ লাঞ্চিত করুন। তাদের বানানো আরেকটি কথা:
اَلشَّرِيْعَةُ أَقْوَالِيْ وَالطَّرِيْقَةُ أَفْعَالِيْ وَالْحَقِيْقَةُ حَالِيْ وَالْمَعْرِفَةُ رَأْسُ مَالِيْ
‘‘শরীয়ত আমার কথাবার্তা, তরীকত আমার কাজকর্ম, হাকীকত আমার অবস্থা এবং মারিফাত আমার মূলধন।’’[2]
আরবী মা’রিফাত (المعرفة) শব্দটি আরাফা (عرف) ক্রিয়াপদ থেকে গৃহীত। এর অর্থ (إدارك الشيء بحاسة من حواسه) কোনো ইন্দ্রিয় দিয়ে কোনো কিছু অবগত হওয়া বা পরিচয় লাভ করা। এভাবে মূলত ইন্দ্রিয়-লব্ধ জ্ঞান বা পরিচয়কে ‘‘মারিফাত’’ বলা হয়। তবে সাধারণত ‘মারিফাত’ বলতে ‘‘জ্ঞান’’, ‘‘পরিচয়’’ বা শিক্ষা (knowledge, education) বুঝানো হয়।
‘‘শরীয়ত, তরীকত, হাকীকাত ও মারিফাত’’ এ পর্যায়ক্রমিক ধারায় ‘‘মারিফাত’’-কে শরীয়তের উপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে কুরআন-সুন্নাহ সুস্পষ্টভাবেই মারিফাতকে শরীয়তের নিম্নের স্থান দিয়েছে। ‘জ্ঞান’ অর্থে ‘মারিফাত’ ঈমান অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আল্লাহর মারিফাত বা আল্লাহর পরিচয় লাভ মানুষকে তাঁর প্রতি ঈমান বা বিশ্বাসের দিকে ধাবিত করে। তবে কুরআন-হাদীসে মূলত ‘‘ইলম’’ এবং ‘‘ফিকহ’’-এর প্রশংসা করা হয়েছে, ‘‘মারিফাত’’-এর কোনো বিশেষ প্রশংসা করা হয় নি। ‘‘মারিফাত’’ ঈমানের পথে পরিচালিত করলে তা প্রশংসনীয়। উপরন্তু কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘‘মারিফাত’’ অর্জনের পরেও মানুষ কুফর বা অবিশ্বাসে লিপ্ত হয়। কুরআনে একাধিক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইহূদী-খৃস্টানদের অনেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর দীন সম্পর্কে পরিপূর্ণ ‘‘মারিফাত’’ অর্জনের পরেও কুফরী করত।[3] অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
فَلَمَّا جَاءَهُمْ مَا عَرَفُوا كَفَرُوا بِهِ
‘‘অতঃপর যখন তাদের নিকট তা (কুরআন) আগমন করল, তারা তার মারিফাত অর্জনের (প্রকৃত পরিচয় জানার) পরেও কুফরী করল।’’[4]
يَعْرِفُونَ نِعْمَةَ اللَّهِ ثُمَّ يُنْكِرُونَهَا وَأَكْثَرُهُمُ الْكَافِرُونَ
‘‘আল্লাহর নিয়ামতের মারিফাত (প্রকৃত পরিচয়) তারা লাভ করে- অতঃপর তারা তা অস্বীকার করে এবং তাদের অধিকাংশই কাফির।’’[5]
কুরআন-সুন্নাহ মুমিনদেরকে ‘‘মারিফাত’’ অর্জনের নির্দেশ দেয় নি, বরং ইলম অর্জনের নির্দেশ দিয়েছে; কারণ ‘‘মারিফাত’’ তো ঈমান অর্জনের পূর্বের অবস্থা। কিন্তু শীয়াগণ মারিফাতকে ঈমান, ইসলাম ও শরীয়ত থেকে পৃথক উচ্চপর্যায়ের বিষয় বলে প্রচার করেন এবং মারিফাতকে ‘‘তত্ত্বজ্ঞান’’ বা গোপন বা পৃথক কোনো জ্ঞান বলে প্রচার করেন। এ সকল বিভ্রান্তির অপনোদনে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর নিম্নের বক্তব্য প্রণিধানযোগ:
نَعْرِفُ اللهَ تَعَالَي حَقَّ مَعْرِفَتِهِ كَمَا وَصَفَ اللهُ نَفْسَهُ فِيْ كِتَابِهِ بِجَمِيْعِ صِفَاتِهِ .. وَيَسْتَوِيْ الْمُؤْمِنُوْنَ كُلُّهُمْ فِيْ الْمَعْرِفَةِ وَالْيَقِيْنِ وَالتَّوَكُّلِ وَالْمَحَبَّةِ وَالرِّضَا وَالْخَوْفِ وَالرَّجَاءِ وَالإِيْمَانِ فِيْ ذَلِكَ، وَيَتَفَاوَتُوْنَ فِيْمَا دُوْنَ الإِيْمَانِ فِيْ ذَلِكَ كُلِّهِ.
‘‘মহান আল্লাহর প্রকৃত মা’রিফাত আমরা লাভ করেছি, তিনি যেভাবে তাঁর কিতাবে তাঁর নিজের বর্ণনা দিয়েছেন সেভাবে তাঁর সকল বিশেষণ সহকারে। ... মুমিনগণ সকলেই সমান মারিফাতের বিষয়ে, এবং ইয়াকীন, তাওয়াক্কুল, মাহাববাত, রিযা (সন্তুষ্টি), খাওফ (ভয়), রাজা (আশা) এবং এ সকল বিষয়ের ঈমান-এর ক্ষেত্রে। তাদের মর্যাদার কমবেশি হয় মূল ঈমান বা বিশ্বাসের অতিরিক্ত যা কিছু আছে তার সবকিছুতে।’’[6]
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর বক্তব্য থেকে দুটি বিষয় সুস্পষ্ট: (১) মারিফাত ঈমানেরই সহযাত্রী। আল্লাহর সত্যিকার মারিফাত লাভই ঈমানের পথে পরিচালিত করে; এজন্য সকল মুমিনই আল্লাহর হক্ক বা প্রকৃত মারিফাত লাভ করেছেন এবং এ বিষয়ে তাঁরা সকলেই সমমর্যাদার। (২) আল্লাহর মারিফাত গোপন কোনো তত্ত্বজ্ঞান নয় বা তা অর্জনের জন্য গোপন কোনো পথ নেই। মহান আল্লাহ তাঁর নিজের বিষয়ে ওহীর মাধ্যমে যা জানিয়েছেন তা অবগত হওয়াই তাঁর প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মারিফাত।
[2] আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৬।
[3] সূরা (২) বাকারা: ১৪৬; সূরা (৬) আনআম: ২০ আয়াত।
[4] সূরা (২) বাকারা: ৮৯ আয়াত।
[5] সূরা (১৬) নাহল: ৮৩ আয়াত।
[6] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আকবার (মোল্লা আলী কারীর ব্যাখ্যা-সহ), পৃ. ১৫১-১৫৭।