রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সুমহান মর্যাদার স্বাভাবিক দাবী যে, তাঁর পরিবার পরিজন এবং সাথী-সহচরগণের মর্যাদা ও সম্মান হবে নবীগণের পরে বিশ্বের সকল যুগের সকল মানুষের ঊর্ধ্বে। কুরআন ও হাদীসে যদি তাঁদের বিষয়ে কোন প্রকার উল্লেখ নাও থাকত, তবুও তাঁদের মহোত্তম মর্যাদার বিষয় যে কোন বিবেকবান ও জ্ঞানী মানুষ খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারতেন।
এ স্বাভাবিক মর্যাদার নিশ্চয়তা প্রদান করেছে এবং তাঁদের মহিমা, মর্যাদা ও সম্মান বর্ণনা করেছে কুরআন কারীমের অনেক আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর অগণিত বাণী। এ সকল আয়াত ও হাদীসের বিস্তারিত আলোচনার জন্য পৃথক পুস্তকের প্রয়োজন। এসবের সার কথা হলো রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর পরিজনগণকে এবং সাহাবীগণকে ভালবাসা ও সম্মান করা তাঁকে ভালবাসা ও সম্মান করার এবং ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কুরআন ও হাদীসের এসকল মহান বাণী, সহজ ও হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা অনেক মুর্খ ভক্তের হৃদয়কে তৃপ্ত করতে পারে নি। তৃপ্ত করতে পারে নি অতিভক্তির ভন্ডামীতে লিপ্ত অগণিত মানুষকে। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আজগুবি ও অবাস্তব কথা বানিয়েছে তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে। এভাবে তারা তাঁর নামে মিথ্যা বলার জঘন্যতম পাপ করার সাথে সাথে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক আবেদনকে কলুষিত করেছে। মুমিনের ঈমান ও জ্ঞানীর অনুভবকে অপবিত্র করেছে। নিচে এ জাতীয় বানোয়াট ও অনির্ভযোগ্য কিছু কথা উল্লেখ করছি।
আহল বাইতের মধ্য থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন (রা)-কে একত্রিত করে পাঁচজনের একত্রিত বিশেষ মর্যাদা জ্ঞাপক অনেক বানোয়াট ও মিথ্যা কথা ‘‘পাক-পাঞ্জাতন’’ নামে প্রচলিত আছে। ‘‘পাক-পাঞ্জাতন’’ বিষয়ক সকল কথা বানোয়াট ও জঘন্য মিথ্যা কথা।
আলী ও ফাতিমা- রদিয়াল্লাহু আনহুমা-কে কেন্দ্র করে মুর্খরা অনেক বানোয়াট, আজগুবি ও মিথ্যা কথা রটনা করেছে। যেমন: ফাতিমা (রা) একদিন একটি পাখির মাংস খেতে চান। আলী (রা) অনেক চেষ্টা করেও পাখিটি ধরতে পারেন না।.... জঘন্য মিথ্যা কথা।
বিষাদ সিন্ধু বইয়ের ৯৫% কথা মিথ্যা। বিষাদ সিন্ধু উপন্যাস। কোনো ইতিহাস বা ধর্মীয় পুস্তক নয়। উপন্যাস হিসাবে এর মূল্যায়ন হবে। কিন্তু দুঃখজনক কথা যে, সমাজের সাধারণ মানুষেরা এ ধরনের বইয়ের কথাগুলোকে সত্য বলে বিশ্বাস করে। বিশেষত রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জড়িয়ে যে সকল মিথ্যা কথা বলা হয়েছে সে বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকা দরকার। মু‘আবিয়াকে ইয়াযীদ বিষয়ক (রা) ভবিষ্যদ্বাণী, মুহাম্মদ হানুফার বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী, হুসাইন (রা)-এর গলায় বারংবার ছুরির আঘাতে ক্ষত না হওয়া... তাঁর হত্যাকারীর বেহেশতে নেওয়া ইত্যাদি সকল কথা বানোয়াট। মুহাম্মাদ হানুফা (মুহাম্মাদ ইবনু আলী, ইবনুল হানাফিয়্যাহ) বিষয়ক, ইয়াযিদের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধ, তাঁর পাহাড়ের মধ্যে আবদ্ধ থাকা ইত্যাদি কথা সবই মিথ্যা।
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, ‘বিষাদ সিন্ধু’ জাতীয় পুস্তকাদি, পুঁথি সাহিত্য ও ‘খাইরুল হাশর’ জাতীয় পুস্তকগুলোই আমাদের সমাজে মিথ্যা ও জাল হাদীস প্রচারের অন্যতম কারণ। এর পাশাপাশি রয়েছে ‘বার চাঁদের ফযীলত’, ‘নেক আমল’, ‘মকছুদুল মুমিনীন’, ‘নেয়ামুল কোরান’, ‘নাফেউল খালায়েক’ জাতীয় পুস্তক। সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠির মধ্যে প্রয়োজনীয় ইসলামী শিক্ষা প্রসারে এ সকল পুঁথি-পুস্তকের অবদান অনস্বীকার্য। এ সকল পুস্তকের সম্মানিত লেখকগণ তাঁদের যুগের ও সময়ের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে সাধ্যমত দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এরূপ কল্যাণময় খিদমতের পাশাপাশি জাল হাদীস, ভিত্তিহীন কথাবার্তা, বিভিন্ন প্রকারের কুসংস্কার ও ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণার প্রসারেও এগুলো অবদান রেখেছে। মহান আল্লাহ তাদের খিদমাত কবুল করুন এবং ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করুন।
এক সময় বাংলার ‘যোগ্য’ আলিমগণ বাংলাভাষায় পুস্তকাদি রচনা ‘দূষণীয়’ বলে গণ্য করতেন। এ ধ্বংসাত্মক বিভ্রান্তিই সমাজে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য আলিমদের রচিত ভুলভ্রান্তিপূর্ণ পুস্তক প্রচলনের সুযোগ করে দেয়।
এখানে অনুবাদের বিকৃতি ও মিথ্যার একটি নমুনা উল্লেখ করছি। প্রচলিত একটি পুস্তকে লিখিত হয়েছে: ‘‘হাদীস শরীফে বর্ণিত আছেঃ- একদিন বিবি ফাতেমা (রা) হযরত মোহাম্মদ ﷺ-এর কাছে আসিয়া আরজ করিলেন হে পিতঃ! আমাকে সমস্ত দিনই আটা পিষায় ও গৃহ কার্যে নিযুক্ত থাকিতে হয় তাই আমার শরীরটা বেদনা ও দরদযুক্ত হইয়া যায়। অতএব আমাকে একটি বাঁদী ক্রয় করিয়া দিন যাতে সে আমার শরীরটা টিপিয়ে দিতে ও গৃহ কার্যে আমাকে সাহায্য করিতে পারে। তদুত্তরে হুজুর (ﷺ) বলিলেন, হে মাতঃ! স্ত্রী লোকের পক্ষে আপন স্বামীর ও পরিজন পোষনের জন্য আটা পিষা গৃহ কার্যে আঞ্জাম করার ন্যায় পুণ্য কাজ আর কিছুই নাই। কিন্তু বাদী বা চাকরানীর সাহায্য লইলে ততদূর ছোওয়াবের ভাগী হইতে পারিবে না। অতএব আমার উপদেশ মানিয়া সর্বদা নিম্নলিখিত দোয়া পাঠ করিতে থাক, নিশ্চয়ই তোমার শরীরের বেদনা দুর হইয়া যাইবে এবং শরীর সর্বদা সুস্থ ও সবল থাকিবে। আর অতিরিক্ত ছওয়াবও পাইবে। তখন হইতে বিবি ফাতেমা তাহাই করিতেন। দোওয়া:
سُبْحَانَ اللهِ وَالْحَمْدُ للهِ وَلاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ‘‘.[1]
একটি সহীহ হাদীসের মনগড়া অনুবাদ করে এখানে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে অনেকে মিথ্যা ও মনগড়া কথা বলা হয়েছে। উপরন্তু ফাতিমা (রা) এর জন্য অবমাননাকর কথাবার্তা বলা হয়েছে। মূল হাদীসটি বুখারী, মুসলিম ও অন্য সকল মুহাদ্দিস কাছাকাছি শব্দে সংকলন করেছেন: হাদীসটি নিম্নরূপ:
আলী (রা) বলেন, যাঁতা চালানোর কারণে তাঁর হাতে কী কষ্ট হয় তা জানাতে ফাতিমা (রা) নবীজী ﷺ-এর কাছে গমন করেন। ফাতিমা শুনেছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে কিছু যুদ্ধবন্দী দাস-দাসী এসেছে। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাড়িতে যেয়ে তাঁকে পান নি। তখন তিনি আয়েশা (রা)-কে বিষয়টি জানান। যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘরে আসেন তখন আয়েশা বিষয়টি তাঁকে জানান। আলী বলেন, আমরা রাতে বিছানায় শুয়ে পড়ার পরে তিনি আমাদের কাছে আগমন করলেন। তখন আমরা উঠতে গেলাম। তিনি বললেন, তোমরা তোমাদের জায়গাতেই থাক। তিনি এসে আমার ও ফাতিমার মধ্যখানে বসলেন। এমনকি আমি আমার পেটের উপর তাঁর পদযুগলের শীতলতা অনুভব করলাম। তিনি আমাদেরকে বললেন, তোমার যা চাচ্ছ তার চেয়েও উত্তম বিষয় কি তোমাদের শিখিয়ে দেব না? তোমরা যখন তোমাদের বিছানায় শুয়ে পড়বে তখন ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদু লিল্লাহ ও ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করবে। এ আমলটি তোমাদের জন্য দাসীর চেয়েও উত্তম। আলী বলেন, এরপর আমি কখনোই এ আমলটি ত্যাগ করি নি।
এ হলো মূল ঘটনা, যা বুখারী ও মুসলিম সহ সকল মুহাদ্দিস বিভিন্ন সহীহ সনদে সংকলিত করেছেন। অথচ উপরের অনুবাদে সব কিছু বিকৃত করা হয়েছে এবং অনেক মিথ্যা কথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বলা হয়েছে।[2]
[2] সহীহ বুখারী ৩/১১৩৩, ৩/১৩৫৮, ৫/২০৫১, ৫/২৩২৯, নং ২৯৪৫, ৩৫০২, ৫০৪৬, ৫৯৫৯, সহীহ মুসলিম ৪/২০৯১, নং ২৭২৭, ফাতহুল বারী ১১/১২০।
প্রচলিত একটি পুস্তক থেকে একটি ভিত্তিহীন কাহিনী উদ্ধৃত করছি: ‘‘ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিবার পূর্বে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) একজন বড় ধনাঢ্য লোক ছিলেন। যেদিন হযরত (ﷺ)-এর খেদমতে আসিয়া ইসলামে দিক্ষীত হইলেন সেইদিন হইতেই তাঁহার যাবতীয় ধন সম্পত্তি আল্লাহর রাস্তায় খরচ করিতে লাগিলেন। ... একদিন পরনের কাপড়ের অভাবে মসজিদে নামায পড়িতে যাইতে কিঞ্চিত দেরী হইয়াছিল। দেখিয়া হযরত (ﷺ) বলিলেন, হে আবু বকর (রা), আমি জীবিত থাকিতেই ইসলামের প্রতি আপনাদের এত অবহেলা হইতেছে, আমি অভাবে আরও কত কি হয় বলা যায় না। ...তিনি বলিলেন হুজুর আমার অবহেলার কিছুই নহে। বাস্তবিক আমার পরনে কাপড় ছিলনা, সেই হেতু আমি ছোট এক খানা কাপড়ের সহিত বালিশের কাপড় ছিঁড়িয়া খেজুর পাতা ও কাঁটা দ্বারা সেলাই করতঃ ধুইয়া ও শুকাইয়া পরিয়া আসিতে এত গৌণ হইয়াছে...। ইহার কিছুক্ষণ পরে জীব্রাইল সম্পুর্ণ খেজুর পাতার পোষাক পরিয়া হযরতের সম্মুখে হাজির হইলেন...। হযরত (ﷺ) তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ... আজকে খেজুর পাতার পোশাক দেখিতেছি কেন? তদুত্তরে জিব্রাইল (ﷺ) বলিলেন হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রা) খেজুর পত্রের সেলাই করা কাপড়ে নামায পড়িতে আসিয়াছিলেন। তখন আল্লাহ তায়ালা সমস্ত ফেরেশতাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘দেখ হে ফেরেশ্তাগণ, আবুবকর আমার সন্তোষ লাভের জন্য কতইনা কষ্ট স্বীকার করিতেছেন। অতএব তোমরা যদি আজ আমার সন্তোষ চাও তবে এখনই আবুবকরের সম্মানার্থে সকলেই খেজুর পত্রের পোশাক পরিধান কর। নচেৎ আজই আমার দপ্তর থেকে সমস্ত ফেরেশ্তার নাম কাটিয়া দিব।’ এই কঠোর বাক্য শুনিয়া আমরা সকলেই তাঁহার সম্মানার্থে খেজুর পত্রের পোশাক পরিধান করিতে বাধ্য হইয়াছি।’’[1]
জালিয়াতদের বানানো একটি কথা: উমার (রা) বলেছেন,
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ إِذَا تَكَلَّمَ مَعَ أَبِيْ بَكْرٍ كُنْتُ بَيْنَهُمَا كَالزَّنْجِيِّ الَّذِيْ لاَ يَفْهَمُ
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন আবূ বাকরের (রা) সাথে কথা বলতেন, তখন আমি তাঁদের মাঝে অনারব হাবশীর মত হয়ে যেতাম, যে কিছুই বুঝে না।’’
জালিয়াত দাজ্জালরা বলতে চায়, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ বাক্র (রা)-এর সাথে এমন মারেফতী ভাষায় (!) কথা বলতেন যে, উমারও (রা) তাঁদের কথা বুঝতে পারতেন না। মুহাদ্দিসগণ একমত যে এ কথাটি সনদ বিহীন ভিত্তিহীন একটি মিথ্যা কথা।[1]
প্রচলিত আছে যে, উমার (রা) তাঁর নিজ পুত্র আবূ শাহমাকে ব্যভিচারের অপরাধে ১০০ বেত্রাঘাত করেন। এতে পুত্রের মৃত্যু হয়। এ ব্যভিচার উদঘাটন, স্বীকারোক্তি, শাস্তি, পিতা-পুত্রের কথাবার্তা ইত্যাদি নিয়ে লম্বা চওড়া কাহিনী বলা হয়, যা শুনলে সাধারণ শ্রোতাগণের চোখে পানি আসে। মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এগুলো ভিত্তিহীন মিথ্যা গল্প। ইবনুল জাওযী বলেন, ‘‘সাধারণ শ্রোতাদেরকে কাঁদানোর জন্য জাহিল ওয়ায়িযগণ এগুলো বানিয়েছে।’’[1]
ইতিহাসে পাওয়া যায়, উমারের পুত্র আব্দুর রাহমান আবূ শাহমা মিশরের সেনাবাহিনীতে যুদ্ধরত ছিলেন। একদিন তিনি নাবীয বা খেজুর ভিজিয়ে তৈরি করা ‘শরবত’ পান করেন। কিন্তু এ খেজুরের শরবতে মাদকতা এসে গিয়েছিল, ফলে আবূ শাহমার মধ্যে মাতলামি আসে। তিনি মিশরের প্রশাসক আমর ইবনুল আস (রা)-এর কাছে আগমন করে বলেন, আমি মাদক দ্রব্য পান করেছি, কাজেই আমাকে আপনি মাদক পানের শারীয়হ নির্ধারিত শাস্তি (বেত্রাঘাত) প্রদান করুন। আমর (রা) তাকে গৃহাভ্যন্তরে বেত্রাঘাত করেন। উমার (রা) তা জানতে পেরে আমরকে (রা) তিরস্কার করেন এবং বলেন সাধারণ মুসলিম নাগরিককে যেভাবে জনসমক্ষে শাস্তি প্রদান করা হয়, আমার পুত্রকেও সেভাবে শাস্তি প্রদান করা উচিত ছিল। আবূ শাহমা মদীনা ফিরে গেলে তিনি নিজে পুনরায় তাকে শাস্তি প্রদান করেন। এর কিছুদিন পরে আবূ শাহমা ইন্তেকাল করেন।[2]
[2] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/৪৩৮-৪৪৩; ইবনু হাজার, আল-ইসাবা ৪/৩৩৯, ৫/৪৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১৯৪-১৯৮; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/২২০।
প্রচলিত আছে যে, উমার (রা) যেদিন ইসলাম গ্রহণ করেন, সে দিন থেকে কাবাঘরে প্রথম আযান শুরু হয়। কথাটি ভুল। উমার (রা) হিজরতের ৫ বৎসর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন। আর আযানের প্রচলন হয় হিজরতের পরে মদীনায়। উমারের (রা) ইসলাম গ্রহণের সময় এবং পরবর্তী প্রায় ৬ বছর যাবৎ আযানের কোনো প্রচলন ছিল না। তবে উমারের (রা) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মক্কায় মুসলিমগণ কাবা ঘরের পাশে নামায আদায় করতে পারতেন না। মক্কার কাফিরগণ তাতে বাধা দিত। উমারের (রা) ইসলাম গ্রহণের পরে তিনি কাফিরদের বাধা প্রতিহত করে নিজে কাবার পাশে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করেন এবং তাঁর সাথে অন্যান্য মুসলিমও সেখানে নামায আদায় করেন।[1]
এ তথ্যটি কিভাবে ক্রমান্বয়ে বিকৃত হয়েছে তার একটি নমুনা দেখুন। খাজা নিজামউদ্দীন আউলিয়ার (রাহ) নামে প্রচলিত ‘রাহাতিল কুলূব’ গ্রন্থে রয়েছে তাঁর মুর্শিদ ফরীদ উদ্দীন গঞ্জে শক্কর (রহ) বলেন: ‘‘যতদিন পর্যন্ত হযরত আমিরুল মো'মেনীন ওমর এবনে খাত্তাব (রা) ইসলামে ঈমান আনেন নি ততদিন পর্যন্ত নামাজের আযান গুহায় গহবরে দেয়া হতো। কিন্তু যে দিন আমিরুল মো'মেনীন হযরত ওমর ফারুক (রা) ঈমান আনলেন সে দিন তিনি তলোয়ার মুক্ত করে দাঁড়িয়ে হযরত বেলাল (রা)-কে বললেন, কা’বা ঘরের মেম্বারে উঠে আজান দাও। হযরত বেলাল তার নির্দেশ মতো কাজ করলেন।’’[2]
আমরা জানি যে, এ কথাগুলো সঠিক নয়। উমার (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের আগে বা পরে কখনোই মক্কায় গুহায়, গহবরে বা কাবাঘরে কোথাও আযান দেয়া হয় নি। এ ছাড়া কাবা ঘরের কোনো মিম্বার ছিল না। আমরা দেখেছি যে, এ পুস্তকটি সম্ভবত খাজা নিযামউদ্দীনের নামে জাল করে লেখা। অথবা সরলতার কারণে তাঁরা যা শুনেছেন সহজেই বিশ্বাস করে নিয়েছিলেন।
[2] হযরত খাজা নিজামউদ্দীন আউলিয়া, রাহাতিল কুলূব, পৃ. ৭১ (১২ মজলিস)।
আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত হাদীস:
أَنَا مَدِيْنَةُ الْعِلْمِ وَعَلِيٌّ بَابُهَـا
‘‘আমি জ্ঞানের শহর এবং আলী তার দরজা।’’
এ হাদীসটিকে অভিজ্ঞ মুহাদ্দিসগণ বানোয়াট বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ হাদীসটিকে মিথ্যা না বলে যয়ীফ বলে উল্লেখ করেছেন। ইমাম তিরমিযী এ অর্থে একটি হাদীস বর্ণনা করে নিজেই হাদীসটি দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন।[1] ইমাম বুখারী, আবু হাতিম, ইয়াহইয়া বিন সায়ীদ, যাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসটিকে ভিত্তিহীন মিথ্যা বলে উল্লেখ করেছেন।[2]
[2] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/২৬১-২৬৫; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/৩২৮-৩৩৬; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, ৭১-৭২ পৃ, নং ২৫১, সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ১১৪-১১৬, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ পৃ: ৬৯।
প্রচলিত একটি গল্পে বলা হয়েছে: ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মি’রাজ থেকে ফিরে আসার পরে নিজের সাহাবা (রা)-দেরকে ডেকে এরশাদ করলেন যে, আমার দরবেশী খিরকা ঐ ব্যক্তিকে প্রদান করবো যে আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবে... আবূ বাকর (রা)-কে বললেন, যদি আমি তোমাকেই এ দরবেশী খিরকা দান করি তাহলে তুমি এর হক কিভাবে আদায় করবে? ... এভাবে উমার (রা) কে জিজ্ঞাসা করলেন ... উসমান (রা)-কে জিজ্ঞাসা করলেন...। এরপর আলী (রা)-কে প্রশ্ন করলেন। আলী (রা) উত্তরে বলেন, আমি আল্লাহর বান্দাদের গোপনীয়তা রক্ষা করব। তখন তিনি আলীকেই খিরকা প্রদান করেন...’’ ইত্যাদি। পুরো কাহিনীটিই ভিত্তিহীন বানোয়াট।[1]