১৩শ শতকের মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়িদ দরবেশ হূত বলেন,
مَا يُذْكَرُ فِيْ السِّيَرِ مِنْ نَبَاتِ شَجَرَةٍ عِنْدَ فَمِ الْغَارِ وَقْتَ هِجْرَتِهِ ﷺ وَأَنَّهُ فُتِحَ بَابٌ فِيْ ظَهْرِ الْغَارِ وَظَهَرَ عِنْدَهُ نَهْرٌ وَأَنَّ الْحَيَّةَ لَدَغَتْ أَبَا بَكْرٍ فِيْ الْغَارِ- بَاطِلٌ لاَ أَصْلَ لَهُ
‘‘সীরাতুন্নবী লেখকগণ বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হিজরতের সময়ে গুহার মুখে গাছ জন্মেছিল, গুহার পিছনে দরজা প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেখানে একটি নদী দেখা গিয়েছিল, এবং গুহার মধ্যে আবূ বাকরকে (রা) সাপে কামড় দিয়েছিল- এগুলো সবই বাতিল কথা, যার কোনো ভিত্তি নেই।’’[1]
বস্ত্তত গুহার পিছনে দরজা প্রকাশ হওয়া, নদী দেখতে পাওয়া ইত্যাদি বিষয় একেবারেই ভিত্তিহীন ও সনদবিহীন গল্প বলে প্রতীয়মান। আর গুহার মুখে গাছ জন্মানো, মাকড়াসার জাল বোনা, কবুতরের বাসা বানানো এবং আবূ বাকর (রা)-কে সাপে কামড়ানো বিষয়ে কিছু হাদীস সনদ-সহ বর্ণিত।
(ক) আবূ বাকরকে সাপে কামড়ানোর কাহিনীটি ইমাম বাইহাকী দালাইলুন নুবুওয়াত গ্রন্থে সংকলন করেছেন। এ হাদীসের সারমর্ম যে, আবূ বাকর (রা) সাওর গুহায় প্রবেশের পর আবূ বাকর (রা) দেখেন যে সেখানে ফাটল বা গর্ত রয়েছে। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিরাপত্তার জন্য ফাটলটির মুখে নিজের পা রাখেন। তখন ফাটলের মধ্যে অবস্থানরত সাপ তাঁকে দংশন করে এবং বেদনায় তাঁর চক্ষু দিয়ে অশ্রু পড়তে থাকে। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁকে বলেন: তুমি ব্যথিত হয়ো না; আল্লাহ তো আমাদের সাথে। এ কথার পর আল্লাহ আবূ বাকর (রা)-এর উপর প্রশান্তি নাযিল করেন।
বাইহাকী বর্ণিত হাদীসে এতটুকুই বলা হয়েছে, যদিও আমাদের সমাজে এ গল্পের সাথে অনেক কিছু সংযুক্ত হয়েছে। ইমাম যাহাবী ও ইমাম ইবন হাজার আসকালানী হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করেছেন। হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী আব্দুর রাহমান ইবনু ইবরাহীম রাসিবী জালিয়াত বলে গণ্য। তাঁর উস্তাদ ফুরাত ইবনুস সায়িবও অত্যন্ত দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবী।[2]
(খ) গুহার মুখের গাছ, মাকড়াসার জাল ও কবুতরের বাসা বিষয়ে মুসনাদ আহমাদ, তাবাকাত ইবন সা’দ, বাইহাকীর দালাইলুন নুবুওয়াত ও অন্যান্য গ্রন্থে অত্যন্ত দুর্বল সনদে কয়েকটি হাদীস সংকলিত। অনেক মুহাদ্দিস পুরো বিষয়টিকেই ভিত্তিহীন বলে গণ্য করেছেন। মাকড়াসার জাল বিষয়ক একটি হাদীসকে ইবন কাসীর ও ইবন হাজার হাসান বলে গণ্য করেছেন।[3]
[2] বাইহাকী, দালাইলুন নুবুওয়াত ২/৪৭৬-৪৭৭; যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ২/৪৫৪, ৪/৫০৩-৫০৪; ইবন হাজার, লিসানুল মীযান ৪/৩৯৭, ৬/৯-১০।
[3] ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/১৮১, ২২২-২২৩; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৭/২৭; ইবন হাজার, ফাতহুল বারী ৭/২৭৮; আলবানী, যায়ীফাহ ৩/২৫৯-২৬৪; ৩৩৭-৩৩৯।
সমাজে অতি প্রসিদ্ধ কথা যে, মি’রাজের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জুতা পায়ে আরশে আরোহণ করেছিলেন। কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট একটি কথা। মি’রাজের ঘটনা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসিদ্ধ ৬টি হাদীস গ্রন্থ সহ সকল হাদীস গ্রন্থে প্রায় অর্ধ শত সাহাবী থেকে বিভিন্নভাবে মি’রাজের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সিহাহ সিত্তার এ বিষয়ক হাদীসগুলো আমি ভালভাবে পড়ার চেষ্টা করেছি। এছাড়া মুসনাদ আহমাদসহ প্রচলিত আরো ১৫/১৬টি হাদীস গ্রন্থে এ বিষয়ক হাদীসগুলো পাঠ করার চেষ্টা করেছি। কুরআনে এবং এ সকল হাদীসে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত গমনের কথা বারংবার বলা হয়েছে। তিনি সিদরাতুল মুনতাহার ঊর্ধ্বে বা আরশে গমন করেছেন বলে কোথাও উল্লেখ করা হয় নি। রাসূলুল্লাহ ﷺ জাগ্রত অবস্থায় স্বশরীরে মি’রাজে গমন করেন এবং সিদরাতুল মুনতাহার সর্বোচ্চ মাকামে আল্লাহর সান্নিধ্য বা ‘দীদার’ লাভ করেন বলে এ সকল হাদীস প্রমাণ করে।
রাফরাফে চড়া, আরশে গমন করা ইত্যাদি কথা সিহাহ সিত্তা, মুসনাদে আহমাদ ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীস-গ্রন্থে সংকলিত কোনো হাদীসে নেই। ৫/৬ শতাব্দী পর্যন্ত সংকলিত ইতিহাস ও সীরাত বিষয়ক গ্রন্থগুলোতেও এ বিয়য়ে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। দশম হিজরী শতাব্দী ও পরবর্তী যুগে সংকলিত সীরাতুন্নবী বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থে মি’রাজের বিষয়ে রাফরাফ-এ আরোহণ, আরশে গমন ইত্যাদি ঘটনা বলা হয়েছে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবীর আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি, যে সকল হাদীস কোনো প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থে পাওয়া যায় না, বরং ৫ম হিজরী শতকে বা তার পরে কোনো কোনো মুহাদ্দিস বা বিষয়ভিত্তিক লেখক তা সংকলন করেছেন, সেগুলো সাধারণত বাতিল বা অত্যন্ত দুর্বল সনদের হাদীস। বিশেষত ১১শ-১২শ শতাব্দীর গ্রন্থাদিতে সহীহ, যয়ীফ ও মাউযূ সবকিছু একত্রে মিশ্রিত করে সংকলন করা হয়েছে।
আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল বাকী যারকানী (১১২২ হি) ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা ‘শারহুল মাওয়াহিব’ গ্রন্থে আল্লামা রাযী কাযবীনীর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন:
لَمْ يَرِدْ فِيْ حَدِيْثٍ صَحِيْحٍ وَلاَ حَسَنٍ وَلاَ ضَعِيْفٍ أَنَّهُ جَاوَزَ سِدْرَةَ الْمُنْتَهَى، بَلْ ذُكِرَ فِيْهَا أَنَّهُ انْتَهَى إِلَى مُسْتَوًى سَمِعَ فِيْهِ صَرِيْفَ الأَقْلاَمِ فَقَطْ. وَمَنْ ذَكَرَ أَنَّهُ جَاوَزَ ذَلِكَ فَعَلَيْهِ الْبَيَانُ، وَأَنَّى لَهُ بِهِ! وَلَمْ يَرِدْ فِيْ خَبَرٍ ثَابِتٍ وَلاَ ضَعِيْفٍ أَنَّهُ رَقِىَ الْعَرْشَ. وَافْتِرَاءُ بَعْضِهِمْ لاَ يُلْتَفَتُ إِلَيْهِ.
‘‘কোনো একটি সহীহ, হাসান অথবা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেছিলেন। বরং বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তথায় এমন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন যে, কলমের খসখস শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। যিনি দাবি করবেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেছিলেন তাকে তার দাবীর পক্ষে প্রমাণ পেশ করতে হবে। আর কিভাবে তিনি তা করবেন! একটি সহীহ অথবা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, তিনি আরশে আরোহণ করেছিলেন। কারো কারো মিথ্যাচারের প্রতি দৃকপাত নিষ্প্রয়োজন।’’[1]
সর্বাবস্থায় আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত একটি জাল হাদীস:
لَمَّا أُسْرِيَ بِهِ ﷺ لَيْلَةَ الْمِعْرَاجِ إِلَى السَّمَوَاتِ الْعُلَى وَوَصَلَ إِلَى الْعَرْشِ الْمُعَلَّى أَرَادَ خَلْعَ نَعْلَيْهِ أَخْذاً مِنْ قَوْلِهِ تَعَالَى لِسَيِّدِنَا مُوْسَى حِيْنَ كَلَّمَهُ: فَاخْلَعْ نَعْلَيْكَ إِنَّكَ بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوًى. فَنُوْدِيَ مِنَ الْعَلِيِّ الأَعْلَى: يَا مُحَمَّدُ! لاَ تَخْلَعْ نَعْلَيْكَ فَإِنَّ الْعَرْشَ يَتَشَرَّفُ بِقُدُوْمِكَ مُتْنَعِلاً وَيَفْتَخِرُ عَلَى غَيْرِهِ مُتَبَرِّكاً، فَصَعِدَ النَّبِيُّ ﷺ إِلَى الْعَرْشِ وَفِيْ قَدَمَيْهِ النَّعْلاَنِ...
‘‘মি’রাজের রাত্রিতে যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে উচ্চতম আকাশমন্ডলিতে নিয়ে যাওয়া হলো এবং আরশে মু‘আল্লায় পৌঁছালেন, তখন তিনি তাঁর পাদুকাদ্বয় খুলার ইচ্ছা করেন। কারণ আল্লাহ তা‘আলা মূসাকে (আঃ) বলেছিলেন: ‘‘তুমি তোমার পাদুকা খোল; তুমি পবিত্র ‘তুয়া’ প্রান্তরে রয়েছ।’’[2] তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আহবান করে বলা হয়, হে মুহাম্মাদ, আপনি আপনার পাদুকাদ্বয় খুলবেন না। কারণ আপনার পাদুকাসহ আগমনে আরশ সৌভাগ্যমন্ডিত হবে এবং অন্যদের উপরে বরকতের অহংকার করবে। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পাদুকাদ্বয় পায়ে রেখেই আরশে আরোহণ করেন।’’
এ কাহিনীর আগাগোড়া সবটুকুই বানোয়াট। এ কাহিনীর উৎপত্তি ও প্রচারের পর থেকে মুহাদ্দিসগণ বলছেন যে, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিসও এ সকল মিথ্যা কথা নির্বিচারে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে বলেন। এ সকল কথা তাঁরা কোন্ হাদীস গ্রন্থে পেয়েছেন তাও বলেন না, খুঁজেও দেখেন না, আবার যারা খুঁজে দেখে এগুলোর জালিয়াতির কথা বলেছেন তাঁদের কথাও পড়েন না বা শুনতে চান না। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করুন।[3]
আল্লামা রাযিউদ্দীন কাযবীনী, আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-মাক্কারী, যারকানী, আব্দুল হাই লাখনবী, দরবেশ হূত প্রমুখ মুহাদ্দিস এ কাহিনীর জালিয়াতি ও মিথ্যাচার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী এ প্রসঙ্গে বলেন: ‘‘এ ঘটনা যে জালিয়াত বানিয়েছে আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করুন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মি’রাজের ঘটনায় বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অনেক বেশি। এত হাদীসের একটি হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মি’রাজের সময় পাদুকা পরে ছিলেন। এমনকি একথাও প্রমাণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরশে আরোহণ করেছিলেন।’’[4]
[2] সূরা (২০) তাহা: আয়াত ১২।
[3] যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ৮/২২৩; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৩৭; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ৫৩০।
[4] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৩৭।
আমাদের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি কথা হলো, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মি’রাজের রাত্রিতে ‘আত-তাহিয়্যাতু’ লাভ করেন। এ বিষয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। গল্পটির সার-সংক্ষেপ হলো, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মি’রাজের রাত্রিতে যখন সর্বোচ্চ নৈকট্যে পৌছান তখন মহান আল্লাহকে সম্ভাষণ করে বলেন: (আত-তাহিয়্যাতু লিল্লাহি...)। তখন মহান আল্লাহ বলেন, (আস-সালামু আলাইকা...)। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চান যে তাঁর উম্মতের জন্যও সালামের অংশ থাক। এজন্য তিনি বলেন (আস-সালামু আলাইনা ওয়া...)। তখন জিবারাঈল ও সকল আকাশবাসী বলেন: (আশহাদু...)। কোনো কোনো গল্পকার বলেন: (আস-সালামু আলাইনা...) বাক্যটি ফিরিশতাগণ বলেন...।
এ গল্পটির কোনো ভিত্তি আছে বলে জানা যায় না। কোথাও কোনো গ্রন্থে সনদসহ এ কাহিনীটি বর্ণিত হয়েছে বলে জানা যায় নি। মি’রাজের ঘটনা বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে ও সীরাত গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও কোনো সনদ-সহ বর্ণনায় মি’রাজের ঘটনায় এ কাহিনীটি বলা হয়েছে বলে আমি দেখতে পাই নি। সনদ বিহীনভাবে কেউ কেউ তা উল্লেখ করেছেন।[1]
বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে, সাহাবীগণ সালাতের শেষে বৈঠকে সালাম পাঠ করতেন। আল্লাহকে সালাম, নবীকে সালাম, জিবরাঈলকে সালাম...। তখন তিনি তাঁদেরকে বলেন, এভাবে না বলে তোমরা ‘আত-তাহিয়্যাতু...’’ বলবে।[2] সকল হাদীসেই এইরূপ বলা হয়েছে। কোনো হাদীসেই বলা হয় নি যে, ‘আত-তাহিয়্যাতু’ মি’রাজ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে
[2] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৮৭; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩০১।
প্রচলিত একটি কথা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মি’রাজের সকল ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে সংঘটিত হয়ে যায়। তিনি সকল ঘটনার পর ফিরে এসে দেখেন পানি গড়ছে, শিকল নড়ছে, বিছানা তখনো গরম রয়েছে... মি’রাজে ২৭ বৎসর অতিবাহিত হয় ... ইত্যাদি। এ সকল কথা ভিত্তিহীন বলে প্রতীয়মান।
আমি ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, সিহাহ সিত্তাহ-সহ প্রায় ২০ খানা হাদীস গ্রন্থের মি’রাজ বিষয়ক হাদীসগুলো আমি অধ্যয়ন করার চেষ্টা করেছি। অধিকাংশ হাদীসে মি’রাজে ভ্রমণ, দর্শন ইত্যাদি সবকিছু সমাপ্ত হতে কত সময় লেগেছিল সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু উল্লেখ করা হয় নি। তাবারানী সংকলিত একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,
ثُمَّ أَتَيْتُ أَصْحَابِيْ قَبْلَ الصُّبْحِ بِمَكَّةَ فَأَتَانِيْ أَبُوْ بَكْرٍ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَيْنَ كُنْتَ اللَّيْلَةَ فَقَدِ الْتَمَسْتُكَ فِيْ مَكَانِكَ فَلَمْ أَجِدْكَ
‘‘অতঃপর প্রভাতের পূর্বে আমি মক্কায় আমার সাহাবীদের কাছে ফিরে আসলাম। তখন আবূ বাক্র আমার কাছে এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি গত রাতে কোথায় ছিলেন? আমি আপনার স্থানে আপনাকে খুঁজেছিলাম, কিন্তু আপনাকে পাই নি।... তখন তিনি মি’রাজের ঘটনা বলেন।’’[1]
এ হাদীস থেকে বুঝা যায় যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রথম রাতে মি’রাজে গমন করনে এবং শেষ রাতে ফিরে আসেন। সারা রাত তিনি মক্কায় অনুপস্থিত ছিলেন। এরূপ আরো দু একটি হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, মি’রাজের ঘটনায় রাসুলুল্লাহ (ﷺ) রাতের কয়েক ঘণ্টা কাটিয়েছিলেন। [2]
মি’রাজের ঘটনায় কত সময় লেগেছিল তা কোনো গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় নয়। এ মহান অলৌকিক ঘটনা আল্লাহ সময় ছাড়া বা অল্প সময়ে যে কোনো ভাবে তাঁর মহান নবীর (ﷺ) জন্য সম্পাদন করতে পারেন। কিন্তু আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো, হাদীসে যা বর্ণিত হয় নি তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে না বলা। তিনি ফিরে এসে দেখেন পানি গড়াচ্ছে, শিকল নড়ছে, বিছানা তখনো গরম রয়েছে ইত্যাদি কথা কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয়েছে বলে জানা যায় না। মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়িদ দরবেশ হূত (১২৭৬ হি) বলেন:
ذَهَابُهُ وَرُجُوْعُهُ لَيْلَةَ الإِسْرَاءِ وَلَمْ يَبْرُدْ فِرَاشُهُ، لَمْ يَثْبُتْ ذَلِكَ.
‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিরাজের রাত্রিতে গমন করেন এবং ফিরে আসেন কিন্তু তখনো তার বিছান ঠান্ডা হয় নি, এ কথাটি প্রমাণিত নয়।’’[3]
[2] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/৭৫-৭৬; ইবনু হাজার, আল-মাতালিব ৪/৩৮৯-৩৮১।
[3] দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ১১২।
আমাদের দেশে প্রচলিত একটি বানোয়াট কাহিনীতে বলা হয়েছে যে, মি’রাজের রাত্রিতে মুহূর্তের মধ্যে এত ঘটনা ঘটেছিল বলে মানতে পারে নি এক ব্যক্তি। ঐ ব্যক্তি একটি মাছ ক্রয় করে তার স্ত্রীকে প্রদান করে নদীতে গোসল করতে যায়। পানিতে ডুব দেয়ার পরে সে মহিলায় রূপান্তরিত হয়। একজন সওদাগর তাকে নৌকায় তুলে নিয়ে বিবাহ করেন.... অনেক বছর পরে আবার ঐ মহিলা পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে দেখেন যে, তার স্ত্রী তখন মাছটি কাটছেন...। এগুলো সবই মিথ্যা কাহিনী।
প্রচলিত গল্পে বলা হয়: একটি হরিণী রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে সালাম দেয়, তাঁর সাথে কথা বলে, অথবা শিকারীর কাছ থেকে তার নাম বলে ছুটি নেয় .... ইত্যাদি। এসকল কথার কোনো নির্ভরযোগ্য ভিত্তি পাওয়া যায় না।[1]
হাসান-হুসাইনের অভুক্ত থেকে ক্রন্দন, ফাতেমা (রা) ও আলীর কষ্ট, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক ইহূদীর বাড়িতে কাজ করা, ইহূদী কতৃক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে আঘাত করা ....ইত্যাদি আমাদের দেশের অতি প্রচলিত ওয়ায ও গল্প। এ সকল কাহিনী সবই বানোয়াট। এগুলোর কোনো ভিত্তি আছে বলে আমার জানা নেই। মদীনার রাষ্ট্রপতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কারো বাড়িতে শ্রম বিক্রয় করতে গিয়েছেন বলে বর্ণিত হয় নি। এছাড়া হাসান ও হুসাইন (রা) ৩ ও ৪ হি. সালে জন্মগ্রহণ করেন। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ৪ হি. সালে বনূ নযীর ও ৫ হি. সালে বনূ কুরাইযার ইহূদীদেরকে বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের কারণে মদীনা থেকে বিতাড়িত করেন। কাজেই ইমামদ্বয়ের কথা বলার বয়স হওয়ার অনেক আগেই মদীনা ইহূদী মুক্ত হয়েছিল।
প্রচলিত একটি গল্পে বলা হয়, জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দাওয়াত দেন। ইত্যবসরে জাবিরের এক পুত্র আরেক পুত্রকে জবাই করে। এরপর সে ভয়ে পালাতে যেয়ে চুলার মধ্যে পড়ে পুড়ে মারা যায়। জাবির (রা)-এর স্ত্রী এ সকল বিষয় গোপন রেখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর মেহমানদারী করেন। ... এরপর মৃত পুত্রদ্বয়কে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত করেন। ... রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দোয়ায় তারা জীবিত হয়ে ওঠে।... পুরো কাহিনীটি আগাগোড়াই বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।[1]
প্রচলিত বিলালের জারির সকল কথাই বানোয়াট।
এ বিষয়ক প্রচলিত জারিতে যা কিছু বলা হয় সবই বানোয়াট কথা।