সমাজে অতি প্রসিদ্ধ কথা যে, মি’রাজের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জুতা পায়ে আরশে আরোহণ করেছিলেন। কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট একটি কথা। মি’রাজের ঘটনা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসিদ্ধ ৬টি হাদীস গ্রন্থ সহ সকল হাদীস গ্রন্থে প্রায় অর্ধ শত সাহাবী থেকে বিভিন্নভাবে মি’রাজের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সিহাহ সিত্তার এ বিষয়ক হাদীসগুলো আমি ভালভাবে পড়ার চেষ্টা করেছি। এছাড়া মুসনাদ আহমাদসহ প্রচলিত আরো ১৫/১৬টি হাদীস গ্রন্থে এ বিষয়ক হাদীসগুলো পাঠ করার চেষ্টা করেছি। কুরআনে এবং এ সকল হাদীসে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত গমনের কথা বারংবার বলা হয়েছে। তিনি সিদরাতুল মুনতাহার ঊর্ধ্বে বা আরশে গমন করেছেন বলে কোথাও উল্লেখ করা হয় নি। রাসূলুল্লাহ ﷺ জাগ্রত অবস্থায় স্বশরীরে মি’রাজে গমন করেন এবং সিদরাতুল মুনতাহার সর্বোচ্চ মাকামে আল্লাহর সান্নিধ্য বা ‘দীদার’ লাভ করেন বলে এ সকল হাদীস প্রমাণ করে।
রাফরাফে চড়া, আরশে গমন করা ইত্যাদি কথা সিহাহ সিত্তা, মুসনাদে আহমাদ ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীস-গ্রন্থে সংকলিত কোনো হাদীসে নেই। ৫/৬ শতাব্দী পর্যন্ত সংকলিত ইতিহাস ও সীরাত বিষয়ক গ্রন্থগুলোতেও এ বিয়য়ে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। দশম হিজরী শতাব্দী ও পরবর্তী যুগে সংকলিত সীরাতুন্নবী বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থে মি’রাজের বিষয়ে রাফরাফ-এ আরোহণ, আরশে গমন ইত্যাদি ঘটনা বলা হয়েছে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবীর আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি, যে সকল হাদীস কোনো প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থে পাওয়া যায় না, বরং ৫ম হিজরী শতকে বা তার পরে কোনো কোনো মুহাদ্দিস বা বিষয়ভিত্তিক লেখক তা সংকলন করেছেন, সেগুলো সাধারণত বাতিল বা অত্যন্ত দুর্বল সনদের হাদীস। বিশেষত ১১শ-১২শ শতাব্দীর গ্রন্থাদিতে সহীহ, যয়ীফ ও মাউযূ সবকিছু একত্রে মিশ্রিত করে সংকলন করা হয়েছে।
আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল বাকী যারকানী (১১২২ হি) ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা ‘শারহুল মাওয়াহিব’ গ্রন্থে আল্লামা রাযী কাযবীনীর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন:
لَمْ يَرِدْ فِيْ حَدِيْثٍ صَحِيْحٍ وَلاَ حَسَنٍ وَلاَ ضَعِيْفٍ أَنَّهُ جَاوَزَ سِدْرَةَ الْمُنْتَهَى، بَلْ ذُكِرَ فِيْهَا أَنَّهُ انْتَهَى إِلَى مُسْتَوًى سَمِعَ فِيْهِ صَرِيْفَ الأَقْلاَمِ فَقَطْ. وَمَنْ ذَكَرَ أَنَّهُ جَاوَزَ ذَلِكَ فَعَلَيْهِ الْبَيَانُ، وَأَنَّى لَهُ بِهِ! وَلَمْ يَرِدْ فِيْ خَبَرٍ ثَابِتٍ وَلاَ ضَعِيْفٍ أَنَّهُ رَقِىَ الْعَرْشَ. وَافْتِرَاءُ بَعْضِهِمْ لاَ يُلْتَفَتُ إِلَيْهِ.
‘‘কোনো একটি সহীহ, হাসান অথবা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেছিলেন। বরং বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তথায় এমন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন যে, কলমের খসখস শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। যিনি দাবি করবেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেছিলেন তাকে তার দাবীর পক্ষে প্রমাণ পেশ করতে হবে। আর কিভাবে তিনি তা করবেন! একটি সহীহ অথবা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, তিনি আরশে আরোহণ করেছিলেন। কারো কারো মিথ্যাচারের প্রতি দৃকপাত নিষ্প্রয়োজন।’’[1]
সর্বাবস্থায় আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত একটি জাল হাদীস:
لَمَّا أُسْرِيَ بِهِ ﷺ لَيْلَةَ الْمِعْرَاجِ إِلَى السَّمَوَاتِ الْعُلَى وَوَصَلَ إِلَى الْعَرْشِ الْمُعَلَّى أَرَادَ خَلْعَ نَعْلَيْهِ أَخْذاً مِنْ قَوْلِهِ تَعَالَى لِسَيِّدِنَا مُوْسَى حِيْنَ كَلَّمَهُ: فَاخْلَعْ نَعْلَيْكَ إِنَّكَ بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوًى. فَنُوْدِيَ مِنَ الْعَلِيِّ الأَعْلَى: يَا مُحَمَّدُ! لاَ تَخْلَعْ نَعْلَيْكَ فَإِنَّ الْعَرْشَ يَتَشَرَّفُ بِقُدُوْمِكَ مُتْنَعِلاً وَيَفْتَخِرُ عَلَى غَيْرِهِ مُتَبَرِّكاً، فَصَعِدَ النَّبِيُّ ﷺ إِلَى الْعَرْشِ وَفِيْ قَدَمَيْهِ النَّعْلاَنِ...
‘‘মি’রাজের রাত্রিতে যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে উচ্চতম আকাশমন্ডলিতে নিয়ে যাওয়া হলো এবং আরশে মু‘আল্লায় পৌঁছালেন, তখন তিনি তাঁর পাদুকাদ্বয় খুলার ইচ্ছা করেন। কারণ আল্লাহ তা‘আলা মূসাকে (আঃ) বলেছিলেন: ‘‘তুমি তোমার পাদুকা খোল; তুমি পবিত্র ‘তুয়া’ প্রান্তরে রয়েছ।’’[2] তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আহবান করে বলা হয়, হে মুহাম্মাদ, আপনি আপনার পাদুকাদ্বয় খুলবেন না। কারণ আপনার পাদুকাসহ আগমনে আরশ সৌভাগ্যমন্ডিত হবে এবং অন্যদের উপরে বরকতের অহংকার করবে। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পাদুকাদ্বয় পায়ে রেখেই আরশে আরোহণ করেন।’’
এ কাহিনীর আগাগোড়া সবটুকুই বানোয়াট। এ কাহিনীর উৎপত্তি ও প্রচারের পর থেকে মুহাদ্দিসগণ বলছেন যে, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিসও এ সকল মিথ্যা কথা নির্বিচারে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে বলেন। এ সকল কথা তাঁরা কোন্ হাদীস গ্রন্থে পেয়েছেন তাও বলেন না, খুঁজেও দেখেন না, আবার যারা খুঁজে দেখে এগুলোর জালিয়াতির কথা বলেছেন তাঁদের কথাও পড়েন না বা শুনতে চান না। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করুন।[3]
আল্লামা রাযিউদ্দীন কাযবীনী, আহমাদ ইবনু মুহাম্মাদ আল-মাক্কারী, যারকানী, আব্দুল হাই লাখনবী, দরবেশ হূত প্রমুখ মুহাদ্দিস এ কাহিনীর জালিয়াতি ও মিথ্যাচার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী এ প্রসঙ্গে বলেন: ‘‘এ ঘটনা যে জালিয়াত বানিয়েছে আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করুন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মি’রাজের ঘটনায় বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অনেক বেশি। এত হাদীসের একটি হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মি’রাজের সময় পাদুকা পরে ছিলেন। এমনকি একথাও প্রমাণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরশে আরোহণ করেছিলেন।’’[4]
[2] সূরা (২০) তাহা: আয়াত ১২।
[3] যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ৮/২২৩; আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৩৭; দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ৫৩০।
[4] আব্দুল হাই লাখনবী, আল-আসার, পৃ. ৩৭।