জাল ও অনির্ভরযেগা্য হাদীস সংকলনের একটি বিশেষ পদ্ধতি: যে সকল বিষয়ে সকল হাদীস বা অধিকাংশ হাদীস বানোয়াট বা অনির্ভরযোগ্য সে সকল বিষয়কে একত্রিত করে সংকলিত করা। বানোয়াট হাদীস চিহ্নিত করণের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে আগ্রহী মুসলিম বিভিন্ন গ্রন্থের সহায়তা ছাড়াই অতি সহজে বুঝতে পারেন যে, এ হাদীসটি বানোয়াট; কারণ হাদীসটি যে বিষয়ে বর্ণিত সে বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস নেই। এ পদ্ধতিতে রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে অন্যতম গ্রন্থ ৭ম হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস ও হানাফী ফকীহ উমার ইবনু বাদর আল-মাউসিলী (৫৫৭-৬২২ হি) রচিত ‘আল-মুগনী’ গ্রন্থ। এছাড়া হিজরী একাদশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হানাফী ফকীহ ও মুহাদ্দিস মোল্লা আলী কারী (১০১৪ হি), ত্রয়োদশ হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ, মুহাদ্দিস ও সূফী সাধক মুহাম্মাদ ইবনুস সাইয়িদ দরবেশ হূত (১২৭৬ হি) এবং অন্যান্য মুহাদ্দিস এ বিষয়ক কিছু মূলনীতি উল্লেখ করেছেন।
(ক) উমার ইবনু বাদর মাউসিলী হানাফী
আল্লামা উমার ইবনু বাদর ইবনু সাঈদ আল-মাউসিলী হাদীস, তাফসীর, ফিক্হ ইত্যাদি বিষয়ে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘‘আল-মুগনী আনিল হিফযি ওয়াল কিতাব বি-কাউলিহিম লাম ইয়াসিহ্ শাইউন ফী হাযাল বাব’’ নামক গ্রন্থটি। এ দীর্ঘ নামের প্রতিপাদ্য হলো: ‘মুহাদ্দিসগণ সে সকল বিষয়ে বলেছেন যে, এ বিষয়ে কোনো হাদীসই সহীহ নয় সে বিষয়গুলোর বিবরণ। এগুলোর জন্য অন্য কোনো গ্রন্থ পাঠ ও মুখস্থ করার আর কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।’ এ গ্রন্থে সংক্ষিপ্ত পরিসরে তিনি ১০১ টি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন, যে সকল বিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীসই অশুদ্ধ বলে মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন। কোনো বিষয়ে কিছু হাদীস বিশুদ্ধ হলে তা উল্লেখ করে বাকি সকল হাদীস অশুদ্ধ বলে জানিয়েছেন। তাঁর গবেষণায় নিম্নলিখিত বিষয়গুলোতে বর্ণিত সকল হাদীসই জাল অথবা অতি দুর্বল:
কুরআনে একাধিক স্থানে আল্লাহ বলেছেন যে, মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি পায় (সূরা আনফাল ২ ও সূরা ফাতহ ৪ আয়াত)। তবে ঈমান বাড়ে এবং কমে অথবা বাড়ে না ও কমে না এবং কথা ও কর্ম ঈমানের অন্তর্ভুক্ত বা অন্তর্ভুক্ত নয়- এ অর্থে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীস বানোয়াট বা অত্যন্ত দুর্বল। কুরআন ও হাদীসের প্রাসঙ্গিক নির্দেশনার আলোকে মুসলিম উম্মাহর ইমামগণ মতভেদ করেছেন।
এ সকল সম্প্রদায় সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী মূলক কোনো সহীহ হাদীস রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণিত হয় নি। এদের বিষয়ে বর্ণিত হাদীসগুলি বানোয়াট অথবা অত্যন্ত দুর্বল। সাহাবীগণ, তাবিয়ীগণ ও ইমামগণ কুরআন ও সুন্নাহের নির্দেশনার আলোকে এ সকল সম্প্রদায়ের বিষয়ে কথা বলেছেন।
এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে কোনো সহীহ হাদীস বর্ণিত হয় নি। এ বিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীস বানোয়াট। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত, বিভিন্ন হাদীসের প্রাসঙ্গিক নির্দেশনা ও সাহাবীগণের মতামতের আলোকে তাবিয়ীগণ ও পরবর্তী ইমামগণ একমত যে, কুরআন আল্লাহর বাণী, তা তাঁর মহান গুণাবলির অংশ এবং সৃষ্ট নয়। বিভ্রান্ত মু’তাযিলা সম্প্রদায় কুরআনকে সৃষ্টবস্ত্ত বলে বিশ্বাস করতো। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতকে এ বিষয়টি মুসলিম সমাজের অন্যতম বিতর্ক-বিষয় ছিল। এজন্য অনেক জালিয়াত এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে হাদীস বানিয়ে প্রসিদ্ধি লাভের চেষ্টা করেছে। মুহাদ্দিসগণ একমত পোষণ করেছেন যে, কুরআন সৃষ্ট নয়। তবে এ মত প্রমাণের জন্য হাদীস জালিয়াতির সকল প্রচেষ্টা তারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
জিবরাঈল (আঃ) প্রতিদিন সকালে নূরের সমূদ্রে ডুব দিয়ে উঠে শরীর ঝাড়া দেন এবং প্রতি ফোটা নূর থেকে ৭০ হাজার ফিরিশতা সৃষ্টি করা হয়। এ অর্থে ও এ জাতীয় সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
মুহাম্মাদ বা আহমাদ নাম রাখার ফযীলতে প্রচারিত সকল হাদীস বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। এ বিষয়ে অনেক বানোয়াট হাদীস প্রচারিত হয়েছে। মুহাম্মাদ ও আহমাদ নামধারীদের আল্লাহ শাস্তি দিবেন না, যাদের পরিবারে কয়েক ব্যক্তির নাম মুহাম্মাদ হবে তাদের ক্ষমা করা হবে, বা বরকত দেয়া হবে ইত্যাদি বিভিন্ন কথা বানিয়ে হাদীসের নামে চালানো হয়েছে। এ নাম দুটি নিঃসন্দেহে উত্তম নাম। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর মহববতে সন্তানদের এ নাম রাখা ভাল। তবে এ বিষয়ের বিশেষ ফযীলত জ্ঞাপক হাদীগুলো বানোয়াট।
বুদ্ধি বা জ্ঞানেন্দ্রিয়ের প্রশংসা বা ফযীলতে বর্ণিত সকল হাদীস ভিত্তিহীন। কুরআন ও হাদীসে জ্ঞান শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং জ্ঞানীগণের প্রশংসা করা হয়েছে। তবে ইন্দ্রিয়ের প্রশংসায় রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে কোনো হাদীস সহীহরূপে বর্ণিত হয় নি। জালিয়াতগণ বুদ্ধি বা জ্ঞানেন্দ্রিয়ের প্রশংসায় অনেক হাদীস বানিয়েছে। যেগুলোতে বুদ্ধির প্রশংসা করা হয়েছে, মানুষ কর্ম নয় বরং বুদ্ধি অনুসারে পুরস্কার লাভ করবে; বুদ্ধিহীন বা নির্বোধের সালাতের চেয়ে বুদ্ধিমানের সালাতের সাওয়াব বেশি.... ইত্যাদি কথা বলা হয়েছে। এগুলো সবই বানোয়াট। কোনো জন্মগত বা বংশগত বিষয়ই আখিরাতের মুক্তি বা মর্যাদার বিষয় নয়। মানুষের ইচ্ছাকৃত কর্মই মূলত তার মুক্তির মাধ্যম। যার বুদ্ধি বেশি ও বুদ্ধি সৎকর্মে ব্যবহার করেন তিনি তার কর্মের জন্য প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হবেন। কিন্তু জন্মগত বা প্রকৃতিগত বুদ্ধি কোনো মুক্তি বা সাওয়াবের বিষয় নয়।
সূরা কাহাফে আল্লাহ মূসার (আঃ) সাথে আল্লাহর একজন বান্দার কিছু ঘটনা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে এ বান্দার নাম উল্লেখ করা হয় নি। তবে সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ বান্দার নাম ‘খাযির’ (প্রচলিত বাংলায়: খিযির)। এ একটি ঘটনা ছাড়া অন্য কোনো ঘটনায় খিযির (আঃ)-এর বিষয়ে কোনো সহীহ বর্ণনা জানা যায় না। তাঁর জন্ম, বাল্যকাল, কর্ম, নবুয়ত, কর্মক্ষেত্র, এ ঘটনার পরবর্তী কালে তার জীবন ও তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে কোনো প্রকারের কোনো বর্ণনা কোনো সহীহ হাদীসে জানতে পারা যায় না। তিনি আবে হায়াতের পানি পান করেছিলেন ইত্যাদি কথা সবই ইহূদী-খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত কথা মুসলিম সমাজে প্রবেশ করেছে।
আল্লামা মাউসিলী বলেন, খিযির (আঃ) ও ইলিয়াস (আঃ) দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন, তাঁরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে দেখেছেন বা কথা বলেছেন, তাঁর পরে বেঁচে আছেন, ইত্যাদি অর্থে বর্ণিত সকল হাদীসই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। তিনি বলেন, ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বালকে খিযির (আঃ) ও ইলিয়াস (আঃ) এর দীর্ঘ জীবন ও জীবিত থাকার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়। তিনি বলেন... শয়তানই এ বিষয়টি মানুষদের মধ্যে প্রচারিত করেছে। ইমাম বুখারীকে প্রশ্ন করা হয়, খিযির (আঃ) ও ইলিয়াস (আঃ) কি এখনো জীবিত আছেন? ইমাম বুখারী বলেন, তা অসম্ভব; কারণ রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: ‘তোমরা আজকের রাত্রিটির কথা মনে রাখবে। আজ রাত্রিতে পৃথিবীর বুকে যারা আছে আজ থেকে একশত বৎসরের মাথায় তাদের কেউই পৃথিবীতে অবশিষ্ট থাকবে না।’[1] ইবনুল জাওযী খিযির (আঃ) ও ইলিয়াস (আঃ) এর দীর্ঘজীবনের বিষয়ে বলেন, এই কথাটি কুরআনের আয়াতের পরিপন্থী। আল্লাহ বলেছেন[2]: ‘আপনার পূর্বে কোনো মানুষকেই আমি অনন্ত জীবন দান করি নি; সুতরাং আপনার মৃত্যু হলে তারা কি চিরজীবী হয়ে থাকবে?’।
উল্লেখ্য যে, কোনো কোনো আলিম খিযিরের জীবিত থাকার সম্ভাবনা স্বীকার করেছেন। তাঁরা বিভিন্ন বুযুর্গের কথার উপর নির্ভর করেছেন। তবে এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে কোনো গ্রহণযোগ্য হাদীস বর্ণিত হয় নি।
[2] সূরা (২১) আম্বিয়া: আয়াত ৩৪।
আল্লামা মাউসিলী বলেন, কুরআনের ফযীলতের বিষয়ে কিছু হাদীস সহীহ, তবে এ বিষয়ে অনেক বানোয়াট হাদীস সমাজে প্রচার করা হয়েছে। নিম্নলিখিত সূরা বা আয়াতের বিষয়ে বিশেষ মর্যাদা বা ফযীলত জ্ঞাপক সহীহ বা হাসান হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সূরা ফাতিহা, সূরা বাকারাহ, সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত, আয়াতুল কুরসী, সূরা আল-ইমরান, সূরা কাহাফ, সূরা কাহাফের প্রথম বা শেষ দশ আয়াত, সূরা মুলক, সূরা যিলযাল, সূরা কাফিরূন, সূরা ইখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস। এছাড়া অন্যান্য সূরার ফযীলতে বর্ণিত হাদীসগুলি বানোয়াট বা অত্যন্ত দুর্বল। এছাড়া উপরের সূরাগুলোর ফযীলতেও অনেক বানোয়াট কথা হাদীস নামে প্রচার করা হয়েছে।
রোদে গরম করা পানি ব্যবহার করলে অসুস্থতা বা অমঙ্গল হতে পারে অর্থে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত সকল হাদীস মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।