৭. ১. ১. জালিয়াতের স্বীকৃতি
মিথ্যা হাদীসের পরিচিতি ও চিহ্নিত-করণের পদ্ধতি উল্লেখ করে আল্লামা ইবনুস সালাহ (৬৪৩ হি) বলেন: ‘‘হাদীস মাউদূ বা জাল কিনা তা জানা যায় জালিয়াতের স্বীকৃতির মাধ্যমে অথবা স্বীকৃতির পর্যায়ের কোনো কিছুর মাধ্যমে। মুহাদ্দিসগণ অনেক সময় বর্ণনাকারীর অবস্থার প্রেক্ষিতে তার জালিয়াতি ধরতে পারেন। কখনো বা বর্ণিত হাদীসের অবস্থা দেখে জালিয়াতি ধরেন। অনেক বড়বড় হাদীস বানোনো হয়েছে যেগুলোর ভাষা ও অর্থের দুর্বলতা সেগুলোর জালিয়াতির সাক্ষ্য দেয়।’’[1]
আল্লামা নাবাবী, ইরাকী, সাখাবী, সুয়ূতী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসও মিথ্যা বা জাল হাদীস চিহ্নিত করার পদ্ধতিগুলো উল্লেখ করেছেন।[2]
[2] ইরাকী, আত-তাকঈদ, পৃ: ১২৮-১৩০; সুয়ূতী, তাদরীবুর রাবী ১/২৭৫-২৭৬;
সাধারণভাবে জালিয়াতের স্বীকৃতি পাওয়া যায় না। এজন্য মুহাদ্দিসগণ মুলত এর উপর নির্ভর করেন না। তাঁরা সনদ নিরীক্ষার মাধ্যমে ‘স্বীকৃতির পর্যায়ের তথ্যাদি’ সংগ্রহ করে সেগুলোর ভিত্তিতে জালিয়াতি নির্ণয় করেন। এজন্য নিরীক্ষাই জালিয়াতি নির্ণয়ের প্রধান পন্থা। প্রধানত দুটি কারণে মুহাদ্দিসগণ হাদীসকে জাল বা মিথ্যা বলে গণ্য করেন: (ক) হাদীসের সনদে মিথ্যাবাদীর অস্তিত্ব ও (খ) হাদীসের কোনো সনদ না থাকা।
মূলত, প্রথম কারণটিই জালিয়াতি নির্ধারণের মূল উপায়। দ্বিতীয় পর্যায়টি ইসলামের প্রথম অর্ধ সহস্র বৎসরে দেখা যায় নি। হিজরী ৪র্থ/৫ম শতক পর্যন্ত কোনো মানুষই সনদ ছাড়া কোনো হাদীস বলতেন না বা বললে কেউ তাতে কর্ণপাত করতেন না। এজন্য জঘন্য জালিয়াতকেও তার মিথ্যার জন্য একটি সনদ তৈরি করতে হতো। পরবর্তী যুগগুলোতে ক্রমান্বয়ে মুসলিম সমাজে কিছু কিছু কথা হাদীস নামে প্রচারিত হয় যেগুলো লোকমুখে প্রচারিত হলেও কোনো গ্রন্থে সনদসহ পাওয়া যায় না। স্বভাবতই মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ একবাক্যে সেগুলোকে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও জাল বলে গণ্য করেছেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে প্রচারিত সকল প্রকারের মিথ্যা বা ভিত্তিহীন কথাকে প্রতিহত করা এবং তাঁর নামে প্রচলিত কথার উৎস ও সূত্র নির্ণয় করার বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ ছিলেন আপোষহীন। এজন্য আমরা দেখতে পাই যে, ৭ম/৮ম হিজরী শতাব্দী থেকে শুরু করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত অগণিত জানবাজ মুহাদ্দিস তাঁদের জীবনপাত করেছেন এ সকল প্রচলিত ‘কথা’র সূত্র বা উৎস সন্ধান করতে। দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় অর্ধ সহস্র বৎসর ধরে লেখা অগণিত হাদীস, ফিকহ, তাফসীর, ইতিহাস, ভাষা, সাহিত্য, জীবনী ইত্যাদি সকল প্রকার পুস্তক-পুস্তিকার মধ্যে তাঁরা এগুলো সন্ধান করেছেন। এ সন্ধানের পরেও যে সকল হাদীস নামে প্রচলিত কথার কোনো ‘সনদ’ তাঁরা পান নি সেগুলোকে তাঁরা ‘ভিত্তিহীন’, ‘সূত্র বিহীন’, বানোয়াট ও মিথ্যা বলে গণ্য করেছেন।
জাল বা মিথ্যা হাদীস চেনার অন্যতম উপায় হলো যে, হাদীসটির সনদে এমন একজন রাবী রয়েছেন, যাকে মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে মিথ্যাবাদী বলে চিহ্নিত করেছেন এবং একমাত্র তার মাধ্যমে ছাড়া অন্য কোনো সূত্রে এ হাদীসটি বর্ণিত হয় নি। এজন্য জাল বা মিথ্যা হাদীসের সংজ্ঞায় মুহাদ্দিসগণ বলেছেন: (ما تفرد بروايته كذاب) ‘‘যে হাদীস শুধুমাত্র কোনো মিথ্যাবাদী রাবী বর্ণনা করেছে তা মাউযূ হাদীস।’’
এ মিথ্যাবাদী রাবীর উস্তাদ বা পূর্ববর্তী রাবীগণ এবং তার ছাত্র বা পরবর্তী রাবীগণ বিশস্ত, সত্যবাদী ও নির্ভরযোগ্য হলেও কিছু আসে যায় না। মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে যদি দেখতে পান যে, এ ব্যক্তি উস্তাদ হিসেবে যার নাম উল্লেখ করেছে তাঁর অন্য কোনো ছাত্রই এই হাদীসটি বর্ণনা করছেন না বা অন্য কোনো সূত্রেও হাদীসটি বর্ণিত হয় নি, তাহলে তারা নিশ্চিত হন যে, এ মিথ্যাবাদী তার উস্তাদের নামে সনদটি বানিয়ে মিথ্যা হাদীসটি প্রচার করেছে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন মুহাদ্দিস এ মিথ্যাবাদীর কাছ থেকে হাদীসটি সংগ্রহ করেছেন নিরীক্ষা, পর্যালোচনা বা সংকলনের জন্য।
যে সকল রাবী মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করেন বলে মুহাদ্দিসগণ বুঝতে পেরেছেন তাদেরকে তাঁরা বিভিন্ন বিশেষণে আখ্যায়িত করেছেন। কখনো তারা তাদেরকে সুস্পষ্টত মিথ্যাবাদী ও জালিয়াত বলে আখ্যায়িত করেছেন। কখনো বা তাদেরকে সরাসরি মিথ্যবাদী বা জালিয়াত না বলে অন্যান্য শব্দ ব্যবহার করেছেন। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, প্রথম তিন শতাব্দীর মুহাদ্দিসগণ সাধারণত সহজে কাউকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলতে চাইতেন না। বিশেষত, যে ব্যক্তির বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা বলেছেন বলে ধারণা করেছেন তার বিষয়ে কিছু ‘নরম’ শব্দ ব্যবহার করতেন। মিথ্যাবাদী রাবীর বিষয়ে মুহাদ্দিসগণের পরিভাষাকে আমরা সংক্ষেপে নিম্নোক্ত কয়েকভাগে ভাগ করতে পারি:
(ক) সরাসরি মিথ্যাবাদী বা জালিয়াত বলে উল্লেখ করা
রাবীর মিথ্যাচারিতা বুঝাতে মুহাদ্দিসগণ বলে থাকেন:
كاذب، كذاب، يكذب، دجال، وضاع، يضع، أكذب الناس، متهم...
মিথ্যাবাদী, জঘন্য মিথ্যাবাদী, মিথ্যা বলে, দাজ্জাল, জঘন্য জালিয়াত, জাল করে, অভিযুক্ত, একটি হাদীস জাল করেছে, সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী, মিথ্যার একটি স্তম্ভ, অমুক মুহাদ্দিস তাকে জালিয়াত বলে উল্লেখ করেছেন, অমুক তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে অভিযুক্ত করেছেন.... ইত্যাদি।
(খ) বাতিল হাদীস বা বালা মুসিবত বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করা
রাবীর মিথ্যাচারিতা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত পরিভাষাগুলোর অন্যতম:
يحدث بالأباطيل، له أباطيل، له بلايا، مصائب، طامات، من بلاياه، مصائبه، من آفته، آفته قلان، خبيث الحديث، يسرق الحديث...
বাতিল হাদীস বর্ণনা করে, তার কিছু বাতিল হাদীস আছে, তার কিছু বালা-মুসিবত আছে, তার বর্ণিত বালা-মুসিবতের মধ্যে অমুক হাদীসটি,... এ হাদীসের বিপদ অমুক... খবীস হাদীস বর্ণনা করে... হাদীস চুরি করে....
(গ) মুনকার (আপত্তিকর) বা মাতরূক (পরিত্যক্ত) বলে উল্লেখ করা
‘মুনকার’ অর্থ ‘অস্বীকারকৃত’, ‘আপত্তিকৃত’ বা ‘গর্হিত’। মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন অর্থে রাবীকে এবং হাদীসকে ‘মুনকার’ বলে অভিহিত করেছেন। অনেকে দুর্বল হাদীস বা দুর্বল রাবীকে ‘মুনকার’ বলেছেন। কেউ কেউ মিথ্যাবাদী রাবীকে ‘মুনকার’ বলেছেন। বিশেষত, ইমাম বুখারী রাবীগণের ত্রুটি উল্লেখের বিষয়ে অত্যন্ত ‘নরম’ শব্দ ব্যবহার করতেন। তিনি সরাসরি কাউকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলে উল্লেখ করেন নি। বরং অন্য মুহাদ্দিসগণ যাকে মিথ্যাবাদী বলেছেন, তিনি তাকে ‘মুনকার’ বলেছেন, অথবা ‘মাতরূক’ বা ‘মাসকূত আনহু’, ‘মানযূর ফীহ’ অর্থাৎ ‘পরিত্যক্ত’, ‘তাঁর বিষয়ে আপত্তি রয়েছে’ বলেছেন।
মুহাদ্দিসগণের মধ্যে প্রচলিত আরেকটি পরিভাষা: ‘‘মাতরূক’’, অর্থাৎ ‘পরিত্যক্ত’ বা ‘পরিত্যাজ্য’। সাধারণত মুহাদ্দিসগণ অত্যন্ত দুর্বল রাবীকে ‘পরিত্যক্ত’ বলেন। তবে ইমাম বুখারী, নাসাঈ, দারাকুতনী ও অন্য কতিপয় মুহাদ্দিস মিথ্যাবাদী রাবীকে ‘মাতরূক’ বলে অভিহিত করেছেন। বিশেষত ইমাম বুখারী ও ইমাম নাসাঈ কাউকে ‘মাতরূক’ বা পরিত্যক্ত বলার অর্থই হলো যে, তাঁরা তাকে মিথ্যাবাদী বলে অভিযুক্ত করছেন।
অনুরূপভাবে মুহাদ্দিসগণ যদি বলেন যে ‘অমুকের হাদীস বর্ণনা করা বৈধ নয়’ তাহলেও তার মিথ্যাচারিতা বুঝা যায়।
(ঘ) তার হাদীস কিছুই নয়, মূল্যহীন... বলে উল্লেখ করা
কেউ কেউ রাবীর মিথ্যাচারিতা বুঝাতে রাবী বা তার বর্ণিত হাদীসকে
ليس بشيء، لا يساوي شيئا، لا يساوي فلسا....
‘মূল্যহীন’, ‘কিছুই নয়’, ‘এক পয়সাতেও নেয়া যায় না’ বা অনুরূপ কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে ইমাম শাফিয়ীর কথা প্রনিধানযোগ্য। ইমাম ইসমাঈল ইবনু ইয়াহইয়া মুযানী (২৬৪ হি) বলেন, একদিন একব্যক্তি সম্পর্কে আমি বলি যে, লোকটি মিথ্যাবাদী। ইমাম শাফিয়ী (২০৪ হি) আমাকে বলেন, তুমি তোমরা কথাবার্তা পরিশীলিত কর। তুমি ‘মিথ্যাবাদী’ (كذاب) না বলে বল, (حديثه ليس بشيء) ‘তার হাদীস কিছুই নয়’।
(ঙ) পতিত, ধ্বংসপ্রাপ্ত, অত্যন্ত দুর্বল ...ইত্যাদি বলে উল্লেখ করা
কিছু শব্দ দ্বারা মুহাদ্দিসগণ রাবীর কঠিন দুর্বলতা ব্যক্ত করেন। যেমন,
ساقط، واه، واه بمرة، هالك، ذاهب الحديث...
পতিত, অত্যন্ত দুর্বল, একেবারেই বাতিল, ধ্বংসগ্রস্থ, তার হাদীস চলে গেছে, উড়ে গেছে... ইত্যাদি। এ সকল রাবীর হাদীস ইচ্ছাকৃত মিথ্যা না হলেও অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা এবং একেবারেই অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ের। অনেক মুহাদ্দিস এ পর্যায়ের রাবীর হাদীসকেও জাল বা মিথ্যা বলে গণ্য করেছেন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, সাধারণভাবে জাল বা মিথ্যা হাদীসকে ‘মাউযূ’ (الموضوع) বলা হলেও, জাল হাদীস বুঝানোর জন্য মুহাদ্দিসগণের আরো কিছু প্রচলিত পরিভাষা রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. বাতিল (باطل)
আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, অনেক সময় মুহাদ্দিসগণ মিথ্যা হাদীসকে ‘মাউযূ’ বা জাল না বলে ‘বাতিল’ বলেন। বিশেষত, অনেক মুহাদ্দিস রাবীর ইচ্ছাকৃত মিথ্যার বিষয়ে নিশ্চিত না হলে হাদীসকে ‘মাউযূ’ বলতে চান না। এ ক্ষেত্রে তাঁরা ‘বাতিল’ শব্দ ব্যবহার করেন। অর্থাৎ হাদীসটি মিথ্যা ও বাতিল, তবে রাবী ইচ্ছা করে তা জাল করেছে কিনা তা নিশ্চিত নয়।
২. সহীহ নয় (لا يصح)
জাল হাদীস বুঝানোর জন্য মুহাদ্দিসগণের অন্যতম পরিভাষা ‘হাদীসটি সহীহ নয়’। এ কথাটি কেউ ভুল বুঝেন। তাঁরা ভাবেন, হাদীসটি সহীহ না হলে হয়ত হাসান বা যয়ীফ হবে। আসলে বিষয়টি তেমন নয়। জাল হাদীস আলোচনার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণ যখন বলেন যে, হাদীসটি সহীহ বা বিশুদ্ধ নয়, তখন তাঁরা বুঝান যে, হাদীসটি অশুদ্ধ, বাতিল ও ভিত্তিহীন। তবে ফিকহী আলোচনায় কখনো কখনো তাঁরা ‘সহীহ নয়’ বলতে ‘যয়ীফ’ বুঝিয়ে থাকেন।
৩. কোনো ভিত্তি নেই, কোনো সূত্র নেই (ليس له أصل، لا أصل له)
মুহাদ্দিসগণ জাল ও মিথ্যা হাদীস বুঝাতে অনেক সময় বলেন, হাদীসটির কোনো ভিত্তি নেই, সূত্র নেই। এদ্বারা তাঁরা সাধারণভাবে বুঝান যে, এ হাদীসটি জনমুখে প্রচলিত একটি সনদ বিহীন বাক্য মাত্র, এর সহীহ, যয়ীফ বা মাউদূ কোনো প্রকারের কোনো সনদ বা সূত্র নেই এবং কোনো গ্রন্থে তা সনদসহ পাওয়া যায় না। কখনো কখনো জাল বা বাতিল সনদের হাদীসকেও তাঁরা এভাবে ‘এর কোনো ভিত্তি নেই’ বলে আখ্যায়িত করেন।
৪. জানি না, কোথাও দেখি নি, পাই নি (لا أعرفه، لم أره، لم أجده)
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীস সংকলিত হয়ে যাওয়ার পরে, কোনো প্রচলিত বাক্য যদি সকল প্রকারের অনুসন্ধানের পরেও কোনো গ্রন্থে সনদ-সহ না পাওয়া যায় তাহলে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হবে যে, কথাটি বাতিল ও ভিত্তিহীন। যে সকল মুহাদ্দিস তাঁদের জীবন হাদীস সংগ্রহ, অনুসন্ধান, যাচাই ও নিরীক্ষার মধ্যে অতিবাহিত করেছেন, তাঁদের কেউ যদি বলেন, এ হাদীসটি আমি চিনি না, জানি না, কোথাও দেখি নি, কোথাও পাই নি, পরিচিত নয়..., তবে তাঁর কথাটি প্রমাণ করবে যে, এ হাদীসটি ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা।
৫. গরীব (অপরিচিত), অত্যন্ত গরীব (غريب، غريب جداً)
গরীব অর্থ প্রবাসী, অপরিচিত বা অনাত্মীয়। যে হাদীস কোনো পর্যায়ে শুধু একজন রাবী বর্ণনা করেছেন মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় তাকে ‘গরীব’ হাদীস বলা হয়। এ পরিভাষা অনুসারে গরীব হাদীস সহীহ হতে পারে, যয়ীফও হতে পারে। কিন্তু কোনো কোনো মুহাদ্দিস জাল হাদীস বুঝাতে এ পরিভাষা ব্যবহার করেছেন। অন্যন্য মুহাদ্দিসগণ যে হাদীসের বিষয়ে বলেছেন ‘জানি না, ভিত্তিহীন..., সেগুলোর বিষয়ে তাঁরা বলেছেন, ‘গরীব’ বা ‘গরীবুন জিদ্দান’ অর্থাৎ অপরিচিত বা অত্যন্ত অপরিচিত। ইমাম দারাকুতনী, খতীব বাগদাদী, যাহাবী প্রমুখ মুহাদ্দিস এভাবে এ পরিভাষাটি কখনো কখনো ব্যবহার করেছেন। এ পরিভাষাটি বেশি ব্যবহার করেছেন ৮ম শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফাকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসূফ যাইলায়ী (৭৬২হি)।[1]
বর্ণনাকারীর বর্ণনার নির্ভুলতা যাচাইয়ের পাশাপাশি মুহাদ্দিসগণ বর্ণনার অর্থও যাচাই করেছেন। কুরআন কারীম, সুপ্রসিদ্ধ সুন্নাত, বুদ্ধি-বিবেক, ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠিত সত্য বা জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সত্যের সুস্পষ্ট বিরুদ্ধ কোনো বক্তব্য তাঁরা ‘হাদীস’ হিসাবে গ্রহণ করেন নি।
হাদীসের বিষয়বস্ত্ত, ভাব ও ভাষাও অভিজ্ঞ নাকিদ মুহাদ্দিসগণকে হাদীসের বিশুদ্ধতা ও অশুদ্ধতা বুঝতে সাহায্য করে। আজীবনের হাদীস চর্চার আলোকে তাঁরা কোনো হাদীসের ভাষা, অর্থ বা বিষয়বস্ত্ত দেখেই অনুভব করতে পারেন যে, হাদীসটি বানোয়াট। বিষয়টি খুব কঠিন নয়। যে কোনো বিষয়ের গবেষক সে বিষয়ে বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। একজন নজরুল বিশেষজ্ঞকে পরবর্তী যুগের কোনো কবির কবিতা নিয়ে নজরুলের বলে চালালে তা ধরে ফেলবেন। কবিতার ভাব ও ভাষা দেখে তিনি প্রথমেই বলে উঠবেন, এ তো নজরুলের কবিতা হতে পারে না! কোথায় পেয়েছেন এ কবিতা? কীভাবে?? অনুরূপভাবে যে কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের সাথে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট গবেষক সেই বিষয়ে বিশেষ অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি লাভ করেন, যা দিয়ে তিনি সে বিষয়ক তথ্যাদি সম্পর্কে প্রাথমিক বিচারের যোগ্যতা লাভ করেন।
হাদীস শাস্ত্রের প্রাজ্ঞ ইমামগণ, যাঁরা তাঁদের পুরো জীবন হাদীস শিক্ষা, মুখস্থ, তুলনা, নিরীক্ষা ও শিক্ষাদান করে কাটিয়েছেন তাঁরাও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদেশ, নিষেধ, উপদেশ, পুরস্কার বর্ণনা, শাস্তি বর্ণনা, শব্দ চয়ন, বিষয়বস্ত্ত, ভাব, অর্থ ইত্যাদি সম্পর্কে বিশেষ অভিজ্ঞতা ও অনুভুতি লাভ করেন। এর আলোকে তাঁরা তাঁর নামে প্রচারিত কোনো বাক্য বা ‘হাদীস’ শুনলে সাথে সাথে অনুভব করতে পারেন যে, এ বিষয়, এ ভাষা, এ শব্দ বা এ অর্থ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস হতে পারে অথবা পারে না। এর পাশাপাশি তাঁরা অন্যান্য নিরীক্ষার মাধ্যমে এর জালিয়াতি নিশ্চিত করেন।
মুহাদ্দিসগণের হাদীস সমালোচনা সাহিত্যের সুবিশাল ভান্ডারে আমরা অগণিত উদাহরণ দেখতে পাই যে, হাদীসের বর্ণনাকারী মিথ্যাবাদী বলে গণ্য না হওয়া সত্ত্বেও হাদীসের ভাষা, ভাব ও অর্থের কারণে মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে ‘পরিত্যক্ত’, জাল বা বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন।
মুহাদ্দিসগণের এ বিষয়ক কর্মধারা আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, এক্ষেত্রে তাঁরা সাহাবীগণের পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। আমরা দেখেছি যে, কোনো হাদীসের বিচারের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বিবেচ্য হলো, কথাটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা বলে প্রমাণিত কিনা তা যাচাই করা। প্রমাণিত হলে তা গ্রহণ করতে হবে, অপ্রমাণিত হলে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে এবং কোনোরূপ দ্বিধা থাকলে তা অতিরিক্ত নিরীক্ষা করতে হবে। এভাবে ভাষা ও অর্থগত নিরীক্ষায় হাদীসের তিনটি পর্যায় রয়েছে:
যদি বর্ণনাকারীগণের সাক্ষ্য ও সকল প্রাসঙ্গিক নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয় যে, কথাটি ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী, কর্ম বা অনুমোদন, তবে তা ‘ওহীর’ নির্দেশনা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। এখানেও ‘শুযূয’ ও ‘ইল্লাতের’ বিচার করতে হবে, যেখানে ভাষা ও অর্থগত নিরীক্ষার প্রক্রিয়া বিদ্যমান। তবে এক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্যণীয়:
(ক) এ পর্যায়ের প্রমাণিত কোনো হাদীসের মধ্যে ভাষাগত বা অর্থগত দুর্বলতা বা অসংলগ্নতা পাওয়া যায় না। কারণ শব্দগত বা অর্থগত ভাবে অসংলগ্ন ‘হাদীস’ বর্ণনা করা, অথবা বুদ্ধি, বিবেক, বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক তথ্যের বিপরীত কোনো ‘হাদীস’ বর্ণনা করাকেই ‘রাবী’র দুর্বলতা বলে বিবেচনা করা হয়েছে। অনেক সৎ ও প্রসিদ্ধ রাবী এরূপ হাদীস বর্ণনা করার ফলে দুর্বল বলে বিবেচিত হয়েছেন এবং তাঁদের বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এজন্য সনদ ও সাধারণ অর্থ নিরীক্ষায় (৫টি শর্ত পূরণকারী) ‘সহীহ’ বলে প্রমানিত কোনো হাদীসের মধ্যে ভাষাগত ও অর্থগত দুর্বলতা পাওয়া যায় না।
(খ) অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘বিবেক’, ‘বুদ্ধি’ বা ‘আকল’-এর নির্দেশনা আপেক্ষিক। একজন মানুষ যাকে ‘বিবেক বিরোধী’ বলে গণ্য করছেন, অন্যজন তাকে ‘বিবেক’ বা বুদ্ধির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে করতে পারেন। এজন্য মুসলিম উম্মাহর মূলনীতি হলো, কোনো কিছু ‘ওহী’ বলে প্রমাণিত হলে তা মেনে নেয়া। যেমন কুরআন কারীমে ‘চুরির শাস্তি হিসেবে হস্তকর্তনের’ নির্দেশ রয়েছে। বিষয়টি কারো কাছে ‘বিবেক’ বিরুদ্ধ মনে হতে পারে। কিন্তু মুমিন কখনোই এ যুক্তিতে এ বিধানটি প্রত্যাখ্যান করেন না। বরং বুদ্ধি, বিবেক ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে এ বিধানের যৌক্তিকতা বুঝতে চেষ্টা করেন। হাদীসের ক্ষেত্রেও মুমিনগণ একইরূপ মূলনীতি অনুসরণ করেন।
(গ) বৈজ্ঞানিক বা ঐতিহাসিক তথ্যের ক্ষেত্রেও মুসলিম উম্মাহ একইরূপ মূলনীতি অনুসরণ করেন। স্বভাবতই কুরআন ও হাদীসে বিজ্ঞান বা ইতিহাস শিক্ষা দেওয়া হয় নি। তবে প্রাসঙ্গিকভাবে এ জাতীয় কিছু কথা আলোচনা করা হয়েছে। ‘ওহী’ বলে প্রমাণিত কোনো বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ যদি কোনো ঐতিহাসিক বা বৈজ্ঞানিক সত্যের বিপরীত হয়, তবে তাঁরা কখনোই সে বক্তব্যকে মিথ্যা বা ভুল বলে মনে করেন না। যেমন কুরআন কারীমের কোনো কোনো আয়াতের ব্যাহ্যিক অর্থ দ্বারা মনে হতে পারে যে, পৃথিবী সমতল বা সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণরত। এক্ষেত্রে মুমিনগণ এ সকল বক্তব্যের সঠিক অর্থ বুঝার চেষ্টা করেন। হাদীসের ক্ষেত্রেও একই নীতি তাঁরা অনুসরণ করেন।
(ঘ) নিরীক্ষায় প্রমাণিত কোনো ‘সহীহ হাদীসের’ সাথে অন্য কোনো সহীহ হাদীস বা কুরআনের আয়াতের মূলত কোনো বৈপরীত্য ঘটে না। বাহ্যত কোনো বৈপরীত্য দেখা দিলে মুহাদ্দিসগণ ঐতিহাসিক ও পারিপার্শ্বিক তথ্যাদির ভিত্তিতে ‘ডকুমেন্টারী’ প্রমাণের মাধ্যমে সেই বৈপরীত্য সমাধান করেছেন। কিন্তু কখনোই ঢালাওভাবে শুধু বাহ্যিক বৈপরীত্যের কারণে কোনো প্রমাণিত তথ্যকে অগ্রাহ্য করেন নি। আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কোন্ স্থান থেকে হজ্জের ‘তালবিয়া’ পাঠ শুরু করেন সে বিষয়ে একাধিক ‘সহীহ’ বর্ণনা রয়েছে, যেগুলো বাহ্যত পরস্পর বিরোধী। মুহাদ্দিসগণ এ বাহ্যিক বৈপরীত্যের সমাধানের জন্য ঐতিহাসিক ও পারিপার্শিক তথ্যাদি বিবেচনা করেছেন, যা আমরা এ পুস্তকের প্রথমে আলোচনা করেছি।
এভাবে কোনো হাদীস ‘ডকুমেন্টারী’ নিরীক্ষায় ‘ওহী’ বলে প্রমাণিত হওয়ার পরেও যদি বাহ্যত অন্য কোনো হাদীস বা আয়াতের সাথে তার বৈপরীত্য দেখা যায়, তবে মুহাদ্দিসগণ সে বৈপরীত্যের ইতিহাস, কারণ ও সমাধান অনুসন্ধান করেছেন ও লিপিবদ্ধ করেছেন।
যদি কোনো কথা বা বক্তব্যের বিষয়ে প্রমাণিত হয় যে, কথাটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী নয়, বরং বর্ণনাকারী ভুলে বা ইচ্ছায় তাঁর নামে তা বলেছেন, তবে সেক্ষেত্রে সে বক্তব্যটির ভাষা বা অর্থ বিবেচনা করা হয় না। কোনোরূপ বিবেচনা ছাড়াই তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। অধিকাংশ জাল হাদীসই এ পর্যায়ের। জালিয়াতগণ সাধ্যমত সুন্দর অর্থেই হাদীস বানাতে চেষ্টা করেন।
যদি প্রমাণিত হয় যে, বর্ণনাকারী ব্যক্তিগতভাবে সৎ ও সত্যপরায়ণ, তবে তিনি তাঁর বর্ণনায় কিছু ভুল করতেন, তবে সেক্ষেত্রে তার দুর্বলতার মাত্রা অনুসারে বর্ণিত হাদীসটিকে হাসান বা যয়ীফ বলে গণ্য করা হয়। এছাড়া কোনো বর্ণনাকারীর পরিচয় জানা না গেলেও হাদীসটি সাধারণভাবে দুর্বল বলে গণ্য করা হয়। সর্বোপরি যদি দেখা যায় যে বর্ণনাকারী সৎ ও সত্যপরায়ণ হওয়া সত্ত্বেও উদ্ভট অর্থের ‘হাদীস’ বর্ণনা করছেন, যা অন্য কেউ বর্ণনা করছেন না সেক্ষেত্রেও তাঁর বর্ণিত হাদীস দুর্বল বলে গণ্য। এই পর্যায়ের অনেক হাদীসকে মুহাদ্দিসগণ শব্দ ও অর্থগত নিরীক্ষার মাধ্যমে ‘জাল’ বলে গণ্য করেছেন। জাল হাদীস বিষয়ক গ্রন্থাবলিতে এরূপ অনেক হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলির সনদে কোনো মিথ্যায় অভিযুক্ত না থাকলেও সেগুলোকে জাল বলা হয়েছে। আবার এ জাতীয় কিছু হাদীসের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ মতভেদ করেছেন। বাহ্যিক সনদের কারণে কেউ কেউ তা দুর্বল বা ‘হাসান’ বললেও, অর্থের কারণে অন্যেরা তা জাল বলে গণ্য করেছেন। এখানে দুটি উদাহরণ উল্লেখ করছি:
(১) আনাস (রা)-এর সূত্রে ‘আরশ’-এর বর্ণনায় একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আনাস বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে মহান প্রভুর ‘আরশ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি বলেন আমি জিবরাঈলকে মহান প্রভুর ‘আরশ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি বলেন, আমি মিকাঈলকে মহান প্রভুর ‘আরশ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি বলেন আমি ইসরাফীলকে মহান প্রভুর ‘আরশ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি বলেন, আমি রাফী-কে মহান প্রভুর ‘আরশ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি বলেন আমি লাওহে মাহফূযকে মহান প্রভুর ‘আরশ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি বলেন, আমি ‘কলম’-কে মহান প্রভুর ‘আরশ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তিনি বলেন: আরশের ৩ লক্ষ ৬০ হাজার খুটি আছে..... ইত্যাদি...।
হাদীসটির সনদে ‘মুহাম্মাদ ইবনু নাসর’ নামক একজন দুর্বল রাবী রয়েছেন, যাকে স্পষ্টত ‘মিথ্যাবাদী’ বলা হয় নি। তবে মুহাদ্দিসগণ একমত যে, হাদীসটি জাল। ইবনু হাজার বলেন: ‘‘এ হাদীসটির মিথ্যাচার সুস্পষ্ট। হাদীস সাহিত্যে যার কিছুটা দখল আছে তিনি কখনোই এ বিষয়ে দ্বিমত করবেন না।’’[1]
(২) তাবি-তাবিয়ী ফুদাইল ইবনু মারযূক (১৬০হি) বলেছেন, ইবরাহীম ইবনু হাসান থেকে, ফাতিমা বিনতুল হুসাইন ইবনু আলী (১০০ হি) থেকে, আসমা বিনতু উমাইস (রা) থেকে, তিনি বলেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর ওহী নাযিল হচ্ছিল। এসময়ে তাঁর মস্তক ছিল আলীর (রা) কোলে। এজন্য আলী আসরের সালাত আদায় করতে পারেন নি। এমতাবস্থায় সূর্য ডুবে যায়। তিনি আলীকে বলেন: তুমি কি সালাত আদায় করেছ? তিনি বলেন না। তখন তিনি বলেন: হে আল্লাহ, আলী যদি আপনার ও আপনার রাসূলের আনুগত্যে থেকে থাকেন তবে তাঁর জন্য আপনি সূর্য ফিরিয়ে দিন। আসমা বলেন: আমি দেখলাম, সূর্য ডুবে গেল। এরপর ডুবে যাওয়ার পরে আবার তা উদিত হলো।’’
এ সনদে আসমা বিনতু উমাইস প্রসিদ্ধ মহিলা সাহাবী। ফাতিমা বিনতুল হুসাইন বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য রাবী। ফুদাইল ইবনু মারযূক সত্যপরায়ণ রাবী, তবে তিনি ভুল করতেন। ইবরাহীম ইবনু হাসান কিছুটা অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। তবে যেহেতু কেউ তাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে সুস্পষ্টত কিছু বলেন নি, এজন্য ইবনু হিববান তাঁকে ‘গ্রহণযোগ্য’ বলে গণ্য করেছেন।
এভাবে আমরা দেখছি যে, সনদ বিচারে হাদীসটি ‘হাসান’ বলে গণ্য হতে পারে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস বাহ্যিক সনদের দিকে তাকিয়ে এরূপ মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ইবনু তাইমিয়া, ইবনু কাসীর, যাহাবী ও অন্যান্য অনেক মুহাদ্দিস হাদীসটির ‘মতন’ বা ‘মূলবক্তব্য’ ‘জাল’ বলে গণ্য করেছেন।
তাঁদের বিস্তারিত আলোচনার সার-সংক্ষেপ হলো, সূর্য অস্তমিত হওয়ার পরে আবার উদিত হওয়া একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা। আর মানবীয় প্রকৃতি ‘অস্বাভাবিক’ ও ‘অলৌকিক’ ঘটনা বর্ণনায় সবচেয়ে বেশি আগ্রহবোধ করে। এজন্য স্বভাবতই আশা করা যায় যে, অন্তত বেশ কয়েকজন সাহাবী থেকে তা বর্ণিত হবে। কিন্তু একমাত্র আসমা বিনতু উমাইস (রা) ছাড়া অন্য কোনো সাহাবী থেকে তা বর্ণিত হয় নি। এরূপ ঘটনা সূর্যগ্রহণের চেয়েও অধিক আশ্চর্যজনক বিষয়। আমরা দেখি যে, সূর্যগ্রহণের ঘটনা অনেক সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত, অথচ এ ঘটনাটি এ একটি মাত্র সূত্রে বর্ণিত।
এরপর আসমা (রা)-এর ২০ জনেরও অধিক প্রসিদ্ধ ছাত্র-ছাত্রী ছিলেন। এরূপ একটি অত্যাশ্চার্য ঘটনা তাঁর অধিকাংশ ছাত্রই বর্ণনা করবেন বলে আশা করা যায়। কিন্তু বস্ত্তত তা ঘটে নি। শুধুমাত্র ফাতেমার সনদে তা বর্ণিত হচ্ছে। ফাতেমার ছাত্র বলে উল্লিখিত ‘ইবরাহীম ইবনু হাসান’ অনেকটা অজ্ঞাত পরিচয়। তিনি ফাতেমার কাছ থেকে আদৌ কিছু শুনেছেন কিনা তা জানা যায় না। অনুরূপ আরেকটি সনদেও ঘটনাটি আসমা বিনতু উমাইস থেকে বর্ণিত। সে সনদেও দুজন অজ্ঞাত পরিচয় বর্ণনাকারী ও একজন দুর্বল বর্ণনাকারী রয়েছেন। এতবড় একটি ঘটনা এভাবে দুই-একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ বলবেন না তা ধারণা করা কষ্টকর।
অন্যদিকে এ ঘটনাটি কুরআন ও হাদীসের অন্যান্য বর্ণনার সাথে বাহ্যত সাংঘর্ষিক। খন্দকের যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে ও আলী (রা) সহ অন্যান্য সকল সাহাবী আসরের সালাত আদায় করতে ব্যর্থ হন। সুর্যাস্তের পরে তাঁরা ‘কাযা’ সালাত আদায় করেন। অন্যদিন ঘুমের কারণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সহ সাহাবীগণের ফজরের সালাত এভাবে কাযা হয়। এ দুই দিনে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও আলী (রা)-সহ সাহাবীগণের জন্য সূর্যকে ফেরত আনা বা নেয়া হলো না, অথচ এ ঘটনায় শুধু আলীর জন্য তা করা হবে কেন? আর ওযরের কারণে সালাতের সময় নষ্ট হলে তো কোনো অসুবিধা হয় না। এছাড়া আলী (রা) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে জামাতে সালাত আদায় করবেন না, আসরের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এক/দেড় ঘন্টা যাবত ওহী নাযিল হবে ইত্যাদি বিষয় স্বাভাবিক মনে হয় না।
এ জাতীয় আরো অন্যান্য বিষয়ের ভিত্তিতে তাঁরা বলেন যে, এ ‘মতন’টি ভুল বা বানোয়াট। এ সকল অজ্ঞাত পরিচয় রাবীগণের মধ্যে কেউ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ভুল করেছেন।[2]
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ভাষা, অর্থ ও বুদ্ধিবৃত্তিক নিরীক্ষার ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসগণের পদ্ধতি অত্যন্ত যৌক্তিক ও সুক্ষ্ম। যে কোনো বিচারালয়ে বিচারক বুদ্ধিবৃত্তিক ও পারিপার্শ্বিক প্রমাণকে ডকুমেন্টারী প্রমাণের পরে বিবেচনা করেন। কোনো অভিযুক্তের বিষয়ে অপরাধের মোটিভ ও যৌক্তিকতা স্পষ্টভাবে দেখতে পারলেও পাশাপাশি প্রমাণাদি না থাকলে তিনি শুধুমাত্র মোটিভ বিচার করে শাস্তি দেন না। অনুরূপভাবে কোনো অভিযুক্তের বিষয়ে যদি তিনি অনুভব করেন যে, তার জন্য অপরাধ করার কোনো যৌক্তিক বা বিবেক সংগত কারণ নেই, কিন্তু সকল ডকুমেন্ট ও সাক্ষ্য সুস্পষ্টরূপে তাকে অপরাধী বলে নির্দেশ করছে, তখন তিনি তাকে অপরাধী বলে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন। মুহাদ্দিসগণও এভাবে সর্বপ্রথম ‘ডকুমেন্টারী’ প্রমাণগুলোর নিরীক্ষা করেছেন এবং এরপর ভাষা, অর্থ, ও তথ্য বিবেচনা করেছেন। দ্বিতীয় পর্বে শব্দ ও অর্থগত নিরীক্ষার কিছু মূলনীতি আমরা দেখতে পাব, ইনশা আল্লাহ।
[2] ইবনু আর্রাক, তানযীহুশ শারীয়াহ ১/৩৭৮-৩৮২; আলবানী, যায়ীফাহ ২/৩৯৫-৪০১।
জাল হাদীস চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে কখনো কখনো মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। এ মতভেদ সীমিত এবং খুবই স্বাভাবিক। আমরা দেখতে পেয়েছি যে, হাদীসের নির্ভুলতা যাচাই করা অবিকল বিচারালয়ে প্রদত্ত সাক্ষ্য প্রমাণের নির্ভুলতা প্রমাণ করার মতই একটি কর্ম। বিভিন্ন ‘কেসে’ আমরা বিচারকগণের মতভেদ দেখতে পাই। এর অর্থ এ নয় যে, বিচার কার্য একটি অনিয়ন্ত্রিত কর্ম এবং বিচারকগণ ইচ্ছা মাফিক মানুষদের ফাঁসি দেন বা একজনের সম্পত্তি অন্যকে প্রদান করেন। প্রকৃত বিষয় হলো, সাক্ষ্য প্রমাণের মূল্যায়ণের ক্ষেত্রে কখনো কখনো বিচারকগণ মতভেদ করতে পারেন। হাদীসের নির্ভুলতা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে, অধিকাংশ হাদীসের বিষয়ে মুহাদ্দিসগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন। কিছু সংখ্যক হাদীসের বিষয়ে তাঁদের মতভেদ রয়েছে। এ মতভেদকে আমরা দুভাগে ভাগ করতে পারি: ১. পরিভাষাগত মতভেদ ও ২. প্রকৃত মতভেদ।