মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় ‘হাদীসের নামে মিথ্যা’ বলার বিভিন্ন প্রকার ও পদ্ধতি রয়েছে। এ অনুচ্ছেদে আমরা সেগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করব।
৬. ১. সনদে মিথ্যা
‘সনদ’ ও ‘মতন’ এর সম্মিলিত রূপই হাদীস। হাদীস বানাতে হলে সনদ জালিয়াতি অত্যাবশ্যক। আবার অনেক সময় সনদ জালিয়াতিই ছিল জালিয়াতের মূখ্য উদ্দেশ্য। মিথ্যাবাদীগণ তাদের উদ্দেশ্য ও সামর্থ্য অনুসারে সনদে জালিয়াতি করত। এদের জালিয়াতি কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়।
সনদ ছাড়া কোনো হাদীস গ্রহণ করা হতো না। কাজেই একটি মিথ্যা কথাকে হাদীস বলে চালাতে হলে তার সাথে একটি সনদ বলতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জালিয়াতগণ নিজেরা মনগড়াভাবে বিভিন্ন সুপরিচিত আলিমদের নামে একটি সনদ বানিয়ে নিত। অথবা তাদের মুখস্থ কোনো সনদ সকল বানোয়াট হাদীসের আগে জুড়ে দিত। আমরা উপরে আলোচিত বিভিন্ন বানোয়াট হাদীসে এর উদাহরণ দেখতে পেয়েছি। এভাবে অধিকাংশ বানোয়াট হাদীসের সনদও মনগড়া। একটি উদাহরণ দেখুন:
ইমাম ইবনু মাজাহ বলেন আমাকে সাহল ইবনু আবী সাহল ও মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল বলেছেন তাদেরকে আব্দুস সালাম ইবনু সালিহ আবুস সালত হারাবী বলেছেন: আমাকে আলী রেযা, তিনি তাঁর পিতা মুসা কাযিম, তিনি তাঁর পিতা জা’ফর সাদিক, তিনি তাঁর পিতা মুহাম্মাদ বাকির, তিনি তার পিতা আলী যাইনুল আবেদীন, তিনি তাঁর পিতা ইমাম হুসাইন (রা), তিনি তাঁর পিতা আলী (রা) থেকে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
اَلإِيْمَانُ مَعْـرِفَـةٌ بِالْقَـلْبِ، وَقَـوْلٌ بِاللِّسَانِ وَعَمَـلٌ بِالأَرْكَانِ
‘‘ঈমান হলো অন্তরের জ্ঞান, মুখের কথা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কর্ম।’’[1]
তাহলে অন্তরের জ্ঞান, মুখের স্বীকৃতি ও কর্মের বাস্তবায়নের সামষ্টিক নাম হলো ঈমান বা বিশ্বাস। কথাটি খুবই আকর্ষণীয়। অনেক তাবিয়ী ও পরবর্তী আলিম এভাবে ঈমানের পরিচয় প্রদান করেছেন। ইমাম মালিক, শাফেয়ী, আহমাদ ইবনু হাম্বাল প্রমুখ এ মত গ্রহণ করেছেন। পক্ষান্তরে ইমাম আবু হানীফা বলেন: ঈমান মূলত মনের বিশ্বাস ও মুখের স্বীকৃতির নাম। কর্ম ঈমানের অংশ নয়, ঈমানের দাবী ও পরিণতি। ঈমান ও কর্মের সমন্বয়ে ইসলাম। এ হাদীসটি সহীহ হলে তা ইমাম আবু হানীফার মতের বিভ্রান্তি প্রমাণ করে। কিন্তু মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষায় হাদীসটি ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে।
পাঠক লক্ষ্য করুন। এ সনদের রাবীগণ রাসূলুল্লাহর (ﷺ) বংশের অন্যতম বুযুর্গ ও শিয়া মযহাবে ১২ ইমামের ৭ জন ইমাম। এ জন্য সহজেই আমরা সরলপ্রাণ মানুষেরা ধোঁকা খেয়ে যাই। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাতের হেফাজতে নিয়োজিত মুহাদ্দিসগণকে এভাবে প্রতারণা করা সম্ভব ছিল না। তাঁরা তাঁদের নিয়মে হাদীসটি পরীক্ষা করেছেন। তাঁরা তাদের নিরীক্ষায় দেখেছেন যে, সনদে উল্লিখিত ৭ প্রসিদ্ধ ইমামের কোনো ছাত্র এ হাদীসটি বর্ননা করেন নি এবং অন্য কোনো সনদেও হাদীসটি বর্ণিত হয় নি।
শুধু আব্দুস সালাম আবুস সাল্ত দাবী করলেন যে, ইমাম আলী রেযা (২০৩হি:) তাকে এ হাদীসটি বলেছেন। এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ইন্তেকালের ২০০ বছর পরে এসে আবুস সাল্ত নামের এ ব্যক্তি হাদীসটি প্রচার করছেন। মুহাদ্দিসগণ তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখেছেন যে, আবূস সাল্ত আব্দুস সালাম নামক এই ব্যক্তি অনেক হাদীস শিক্ষা করেছেন এবং বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তার বর্ণিত হাদীসের মধ্যে অগণিত ভুল। তিনি এমন সব হাদীস বিভিন্ন মুহাদ্দিস ও আলেমের নামে বলেন যা তাদের অন্য কোন ছাত্র বলেন না। এতে প্রমাণিত হয় যে তিনি হাদীস ঠিকমত মুখস্থ রাখতে পারতেন না। তবে তিনি ইচ্ছাপূর্বক মিথ্যা হাদীস বলতেন কিনা তা নিয়ে তাঁরা কিছুটা দ্বিধা করেছেন। ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন ও কতিপয় ইমাম বলেছেন যে, তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ভাল ছিলেন বলেই দেখা যায়। শিয়া হলেও বাড়াবাড়ি করতেন না। কিন্তু তিনি অগণিত উল্টোপাল্টা ও ভিত্তিহীন (মুনকার) হাদীস বলেছেন, যা আর কোন বর্ণনাকারী কখনো বর্ণনা করেন নি। তবে তিনি ইচ্ছা করে মিথ্যা বলতেন না বলে বুঝা যায়। অপরপক্ষে আল-জুযানী, উকাইলী প্রমুখ ইমাম বলেছেন যে, তিনি মিথ্যাবাদী ছিলেন।[2]
যারা তিনি অনিচ্ছাকৃত ভুল বলেছেন বলে মনে করেছেন তাঁরা হাদীসটিকে ‘‘বাতিল’’, ‘‘ভিত্তিহীন’’ ‘‘খুবই যয়ীফ’’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করেছেন। আর যারা তাকে ইচ্ছাকৃত মিথ্যাবাদী বলে দেখেছেন, তাঁরা হাদীসটিকে ‘‘মাওযূ’’, বা বানোয়াট বলে অভিহিত করেছেন।[3]
অষ্টম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইবনুল কাইয়িম মুহাম্মাদ ইবনু আবী বাকর (৭৫১ হি) হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন ও কর্মকে ঈমানের অংশ বলে গণ্য করতেন। তাঁর মতে ঈমান হলো অন্তরের জ্ঞান, মুখের স্বীকৃতি ও বিধিবিধান পালন। তিনি এ মতের পক্ষে দীর্ঘ আলোচনার পরে বলেন, তবে এ বিষয়ে আব্দুস সালাম ইবনু সালিহ বর্ণিত যে হাদীসটি ইবনু মাজাহ সংকলন করেছেন, সে হাদীসটি মাউযূ, তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা নয়।’’[4]
আমরা দেখছি যে, এ সনদের সকল রাবী অত্যন্ত প্রসিদ্ধ সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। এ হলো জাল হাদীসের একটি বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জালিয়াতগণ তাদের জালিয়াতি চালানোর জন্য প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্বদের সমন্বয়ে সনদ তৈরী করতো। তাদের এ জালিয়াতি সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দিলেও নিরীক্ষক মুহাদ্দিসদের ধোঁকা দিতে পারত না। কারণ সনদে জালিয়াতের নাম থেকে যেত। জালিয়াত যাকে উস্তাদ বলে দাবী করেছে তার নাম থাকত। উস্তাদের অন্যান্য ছাত্রের বর্ণিত হাদীস এবং এ জালিয়াতের বর্ণিত হাদীসের তুলনা ও নিরীক্ষার মাধ্যমে মুহাদ্দিসগণ জালিয়াতি ধরে ফেলতেন।
জালিয়াতির আরেকটি উদাহরণ দেখুন। ইসমাঈল ইবনু যিয়াদ দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন হাদীস বর্ণনাকারী। তিনি বলেন: আমাকে সাওর ইবনু ইয়াযিদ (১৫৫হি:) বলেছেন, তিনি খালিদ ইবনু মা’দান (মৃ: ১০৩ হি:) থেকে, তিনি মু‘আয ইবনু জাবাল থেকে বর্ণনা করেছেন, আমরা বললাম: ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমরা কি বিনা ওযূতে কুরআন স্পর্শ করতে পারব? তিনি বলেন: হাঁ, তবে যদি গোসল ফরয থাকে তাহলে কুরআন স্পর্শ করবে না। আমরা বললাম: ইয়া রাসূলাল্লাহ, তাহলে কুরআনের বাণী: (পবিত্রগণ ছাড়া কেউ তা স্পর্শ করে না)[5] এর অর্থ কি? তিনি বলেন: এর অর্থ হলো: কুরআনের সাওয়াব মুমিনগণ ছাড়া কেউ পাবে না।’’
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, এ হাদীসটি বানোয়াট। হাদীসের ইমামগণ ইসমাঈল ইবনু যিয়াদ (আবী যিয়াদ) নামক এ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীসসমূহ সংগ্রহ করে অন্যান্য সকল বর্ণনার সাথে তার তুলনামূলক নিরীক্ষা করে দেখতে পেয়েছেন যে, এ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীস কোনটিই সঠিক নয়। তিনি একজন ভাল আলিম ছিলেন ও মাওসিল নামক অঞ্চলের বিচারক ছিলেন। কিন্তু তিনি শু’বা (১৬০হি:), ইবনু জুরাইজ (১৫০হি:), সাওর (১৫৫হি:) প্রমুখ তৎকালীন বিভিন্ন সুপরিচিত মুহাদ্দিসের নামে এমন অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন যা তারা কখনো বলেন নি বা তাদের কোন ছাত্র তাদের থেকে বর্ণনা করেন নি।
যেমন এখানে সাওর-এর নামে তিনি হাদীসটি বলেছেন। সাওর দ্বিতীয় হিজরী শতকের সিরিয়ার অন্যতম প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ ছিলেন। তাঁর অগণিত ছাত্র ছিল। অনেকে বছরের পর বছর তাঁর কাছে থেকে হাদীস শিক্ষা করেছেন। কোনো ছাত্রই তার থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করে নি। অথচ ইসমাঈল তার নামে এ হাদীসটি বললেন। অবস্থা দেখে মনে হয় তিনি ইচ্ছাপূর্বক এভাবে বানোয়াট হাদীস বলতেন। ইমাম দারাকুতনী, ইবনু আদী, ইবনু হিববান, ইবনুল জাওযী ও অন্যান্য ইমাম এ সকল বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, তাকে দাজ্জাল ও মিথ্যাবাদী বলেছেন। তার বর্ণিত সকল হাদীস, যা শুধুমাত্র তিনিই বর্ণনা করেছেন, অন্য কেউ বর্ণনা করেনি, এরূপ সকল হাদীসকে তাঁরা মাওযূ বা বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন।
এ ইসমাঈল বর্ণিত আরেকটি বানোয়াট ও মিথ্যা কথা যা তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস হিসাবে বর্ণনা করেছেন: তিনি বলেন: আমাকে গালিব আল-কাত্তান, তিনি আবু সাঈদ মাকবুরী থেকে তিনি আবু হুরাইরা (রা:) থেকে বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
أَبْغَـضُ الْكَلاَمِ إِلَى اللهِ الْفَارِسِيَّةُ وَكَلاَمُ أَهْلِ الْجَنَّـةِ الْعَرَبِيَّـةُ
‘‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ভাষা হলো ফার্সী ভাষা, আর জান্নাতের অধিবাসীদের ভাষা হলো আরবী ভাষা।’’[6]
[2] বিস্তারিত দেখুন: ইবনু হাজার আসকালানী, তাহযীবুত তাহযীব ৬/২৮৫-২৮৬; তাকরীবুত তাহযীব, পৃ: ৩৫৫; আল-বুসীরী, মিসবাহুয যুজাজাহ ১/১২।
[3] আল-বুসীরী, যাওয়াইদ ইবনু মাজাহ, পৃ ৩৭; আলবানী, যায়ীফ সুনান ইবন মাজাহ পৃ ১০।
[4] ইবনুল কাইয়িম, হাশিয়াত আবী দাউদ ১২/২৯৪।
[5] সূরা (৫৬) ওয়াকিয়া: ৭৯ আয়াত।
[6] ইবনু আদী, আল-কামিল ১/৫১০-৫১১, ইবনু হিববান, মাজরুহীন ১/১২৯, ইবনু হাজার, তাকরীবুত তাহযীব, পৃ: ১০৭, ইবনুল জাওযী, আল-মাউযূ্‘আত ২/১০, যাহাবী, মীযানুল ইতিদাল ১/৩৮৭-৩৮৮, ইবনু আর্রাক, তানযীহুশ শারী‘আহ ২/৭৬, শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ, পৃ: ৮।
আমরা দেখেছি যে, অনেক সময় জালিয়াতের উদ্দেশ্য হতো নিজের স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য তারা প্রচলিত ‘মতন’ বা বক্তব্যের জন্য বিশেষ সনদ তৈরি করত। এখানে একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি।
ইমাম মালিক ২য় হিজরী শতকের মুহাদ্দিসগণের অন্যতম ইমাম। তিনি তাঁর উস্তাদ নাফি’ থেকে আব্দুল্লাহ ইবনু উমারের সূত্রে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন। এজন্য (مالك عن نافع عن عبد الله بن عمر) ‘‘মালিক, নাফি’ থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু উমার থেকে’’ অত্যন্ত সহীহ ও অতি প্রসিদ্ধ সনদ। এ সনদে বর্ণিত সকল হাদীসই মুহাদ্দিসগণের কাছে সংরক্ষিত। তৃতীয় হিজরী শতকের একজন রাবী আব্দুল মুনইম ইবনু বাশীর বলেন, আমাকে মালিক বলেছেন, তিনি নাফি’ থেকে, তিনি আব্দুল্লাহ থেকে, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
اللّهُـمَّ بَارِكْ لأُمَّـتِـيْ فِـيْ بُكُـوْرِهَـا
‘‘হে আল্লাহ, আমার উম্মতের জন্য তাদের সকালের সময়ে বরকত দান করুন।’’[1]
৫ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা খালীল ইবনু আব্দুল্লাহ আল-খালীলী (৪৪৬ হি) বলেন: এটি একটি মাউদূ বা বানোয়াট হাদীস। আব্দুল মুনইম নামক এ ব্যক্তি ছিল একজন মিথ্যাবাদী জালিয়াত। ইমাম আহমদের পুত্র আব্দুল্লাহ বলেন, আমি একদিন আমার পিতাকে বললাম: আমি আব্দুল মুনইম ইবনু বাশীরকে বাজারে দেখলাম। তিনি বলেন: বেটা, সে মিথ্যাবাদী জালিয়াত এখনো বেঁচে আছে? এ হাদীস এ সনদে একেবারেই ভিত্তিহীন ও অস্তিত্বহীন। কখনোই কেউ তা মালিক থেকে বা নাফি’ থেকে বর্ণনা করেনি। এ হাদীস মূলত সাখর আল-গামিদী নামক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন।[2]
এখানে আমরা দেখছি যে, আল্লামা খালীলী হাদীটিকে মাউযূ বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আবার তিনি নিজেই উল্লেখ করছেন যে, হাদীসটি অন্য সাহাবী থেকে বর্ণিত। তাঁর উদ্দেশ্য হলো, এ সনদে এ হাদীসটি মাউদূ। এ সনদ ও মতনের সম্মিলিত রূপটি বানোয়াট। তিনি সংক্ষেপে মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষার ফলাফলও বলে দিয়েছেন। ইমাম মালিকের অগণিত ছাত্রের কেউ এই হাদীসটি তাঁর সূত্রে এ সনদে বর্ণনা করেনি। একমাত্র আব্দুল মুনইম দাবী করছে যে, ইমাম মালিক তাকে হাদীসটি বলেছেন। আর আব্দুল মুনইমের বর্ণিত অন্যান্য সকল হাদীসের আলোকে মুহাদ্দিসগণ তার মিথ্যাচার ধরেছেন এবং তাকে মিথ্যাবাদী বলে চিহ্নিত করেছেন।
লক্ষণীয় যে, সনদটি জাল হলেও হাদীসের মতনটি মিথ্যা নয়। মতনটি অন্য বিভিন্ন সনদে সাখর আল-গামিদী ও অন্যান্য সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে এবং মুহাদ্দিসগণের নিরীক্ষায় তা সহীহ বলে প্রমাণিত হয়েছে।[3]
এভাবে আমরা দেখছি যে, আব্দুল মুনইম একটি প্রচলিত ও সহীহ ‘মতন’ এর জন্য একটি ‘সুপ্রসিদ্ধ সহীহ সনদ’ জাল করেছে। আর সে যুগে প্রসিদ্ধি অর্জনের জন্য এরূপ বানোয়াট সনদের কি গুরুত্ব ছিল তা আমাদের যুগে অনুধাবন করা অসম্ভব। মুহাদ্দিসগণ সাখার আল-গামিদীর সূত্রে হাদীসটি জানতেন। কিন্তু তাঁরা যখনই শুনেছেন যে, অমুক শহরে এক ব্যক্তি মালিকের সূত্রে আব্দুল্লাহ ইবনু উমার থেকে হাদীসটি বর্ণনা করছেন তখন তাঁরা তার কাছে গিয়েছেন, তার হাদীস লিখেছেন ও নিরীক্ষা করেছেন। যখন নিরীক্ষার মাধ্যমে লোকটির জালিয়াতি ধরা পড়েছে তখন তারা তা প্রকাশ করেছেন। আবার অন্যান্য মুহাদ্দিস তার কাছে গিয়েছেন। মোটামুটি লোকটি বেশ মজা অনুভব করেছে যে, কত মানুষ তার কাছে হাদীস শুনতে আসছে! কিভাবে সে সবাইকে বোকা বানাচ্ছে!! কিন্তু তার জালিয়াতি যে ধরা পড়বে তা নিয়ে সে মাথা ঘামায় নি। কোনো জালিয়াতই ধরা পড়ার চিন্তা করে জালিয়াতি করে না।
ইবরাহীম ইবনুল হাকাম ইবনু আবান তৃতীয় হিজরী শতকের একজন হাদীস বর্ণনাকারী। তিনি এভাবে হাদীস বর্ণনায় কিছু জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ করতেন। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বালের মত প্রসিদ্ধ ইমামও তার কাছে হাদীস শিখতে গমন করেন। ইমাম আহমাদ পরবর্তীকালে বলতেন: ‘‘ইবরাহীম ইবনুল হাকামের কাছে হাদীস শিখতে বাগদাদ থেকে ইয়ামানের এডেন পর্যন্ত সফর করলাম। সফরের টাকাগুলো ‘ফী সাবিলিল্লাহ’ চলে গেল!’’[4]
[2] খালীলী, আল-ইরশাদ, পৃ: ৭।
[3] তিরমিযী, আস-সুনান ৩/৫১৭, ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/৭৫২, আলবানী, সাহীহুল জামিয়িস সাগীর ১/২৭৮।
[4] ইবনুল জাওযী, আদ-দুআফা ওয়াল মাতরূকীন ১/৩০।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা যেভাবে শুনতে হবে ঠিক অবিকল সেভাবেই বলতে হবে। সনদের মধ্যে কমবেশি করাও জালিয়াতি। মুহাদ্দিসগণ এজন্য সনদের মধ্যে কমবেশি করাকে জালিয়াতি বলে গণ্য করেছেন। মাউকূফ বা মাকতূ’ হাদীসকে অর্থাৎ সাহাবীর কথা বা তাবিয়ীর কথাকে মারফূ হাদীস রূপে বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু (ﷺ)-এর কথা রূপে বর্ণনা করা, মুরসাল বা মুনকাতি’ হাদীসকে মুত্তাসিল রূপে বর্ণনা করা, সনদের কোনো একজন দুর্বল বর্ণনাকারীর পরিবর্তে অন্য একজন প্রসিদ্ধ বর্ণনাকারীর নাম ঢুকানো বা যে কোনো প্রকারে হাদীসের সনদের মধ্যে পরিবর্তন করা হাদীসের নামে মিথ্যাচার বলে গণ্য। এধরনের মিথ্যাচার ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হতে পারে। ইচ্ছাকৃত মিথ্যাচারী ‘মিথ্যাবাদী’ ও জালিয়াত বলে গণ্য। অনিচ্ছাকৃত মিথ্যাচারী অগ্রহণযোগ্য, দুর্বল ও পরিত্যক্ত বলে গণ্য। এ বিষয়ে দু-একটি উদাহরণ দেখুন।
আবু সামুরাহ আহমাদ ইবনু সালিম ২য়-৩য় হিজরী শতকের একজন ‘রাবী’। তিনি বলেন: আমাদেরকে শারীক বলেছেন, আ’মাশ থেকে, তিনি আতিয়্যা থেকে তিনি আবু সাঈদ খুদরী থেকে বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: (علي خـيـر البـرية) ‘‘আলী সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ।’’
মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখেন যে, আবু সালামাহ আহমাদ ইবনু সালিম অত্যন্ত দুর্বল রাবী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন মুহাদ্দিস থেকে তাদের নামে এমন সব হাদীস বর্ণনা করেছেন যা অন্য কেউ বর্ণনা করেন নি। তার একটি মিথ্যা বা ভুল বর্ণনা হলো এ হাদীসটি। এ হাদীসটি শারীক ইবনু আব্দুল্লাহর অন্যান্য ছাত্রও বর্ণনা করেছেন, এছাড়া শারীকের উস্তাদ আ’মাশ থেকে শারীক ছাড়াও অন্য অনেকে বর্ণনা করেছেন। কিন্ত তারা বলেছেন: আ’মাশ থেকে, তিনি আতিয়্যাহ থেকে বলেছেন, জাবির (রা) বলতেন: (كنا نعد عليا خيرنا) ‘‘আমরা আলীকে আমাদের মধ্যে উত্তম বলে মনে করতাম।’’
তাহলে আমরা দেখছি যে, আবু সালামাহ ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে তিনটি বিষয় পরিবর্তন করেছেন।
প্রথমত: হাদীসটি আতিয়্যাহ জাবির থেকে বর্ণনা করেছেন, অথচ আবু সালামাহ আতিয়্যার উস্তাদের নাম ভুল করে আবু সাঈদ খুদরী বলে উল্লেখ করেছেন। এভাবে তিনি সনদের মধ্যে সাহাবীর নাম পরিবর্তন করেছেন।
দ্বিতীয়ত: তিনি হাদীসটির শব্দ বা মতনও পরিবর্তন করেছেন।
তৃতীয়ত: তিনি সনদের মধ্যে পরিবর্তন করে জাবিরের কথাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা বলে বর্ণনা করেছেন।
হাদীসটি মূলত জাবিরের (রা) নিজের কথা, অথচ তিনি একে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। আর এটিই হলো সবচেয়ে মারাত্মক পরিবর্তন। কারণ এখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বলেন নি তা তার নামে বলা হয়েছে, যা অত্যন্ত বড় অপরাধ। কোন সাহাবী, তাবিয়ী বা বুজুর্গের কথা বা জ্ঞান মূলক প্রবাদকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা হিসাবে উল্লেখ করা মাওযূ বা বানোয়াট হাদীসের একটি বিশেষ প্রকার।[1] আমরা একটু পরেই বিষয়টি আবারো উল্লেখ করব, ইনশা আল্লাহ।
ইবরাহীম ইবনুল হাকাম ইবনু আবান তৃতীয় হিজরী শতকের একজন রাবী। তিনি হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে জালিয়াতি করতেন। তবে সনদের মধ্যে। তৃতীয় শতকের মুহাদ্দিস আববাস ইবনু আব্দুল আযীম বলেন: ইবরাহীম ইবনুল হাকাম তার পিতার সূত্রে তাবিয়ী ইকরিমাহ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কিছু হাদীস শিক্ষা করেন ও লিখে রাখেন। এ হাদীসগুলো তার পান্ডুলিপিতে এভাবে মুরসাল রূপেই লিখিত ছিল। কোনো সাহাবীর নাম তাতে ছিল না। পরবর্তী সময়ে তিনি এগুলোতে আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস, আবু হুরাইরা প্রমুখ সাহাবীর (রা) নাম উল্লেখ করে বর্ণনা করতেন। এ সনদগত মিথ্যাচারের ফলে তিনি গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন।[2]
[2] ইবনু আদী, আল-কামিল ১/২৪১-২৪২।
হাদীস জালিয়াতির ক্ষেত্রে মিথ্যাচারীদের একটি বিশেষ পদ্ধতি হলো ‘চুরি’ (سرقة)। ‘হাদীস চুরি’ অর্থ হলো, কোনো মিথ্যাচারী রাবী অন্য একজন ‘রাবী’র কোনো হাদীস শুনে সে হাদীস উক্ত রাবীর সূত্রে বর্ণনা না করে বানোয়াট সনদে তা বর্ণনা করবে। চুরি কয়েক প্রকারে হতে পারে:
ক. ‘চোর’ জালিয়াত মূল সনদ ঠিক রাখবে। তবে যার কাছ থেকে হাদীসটি শুনেছে তার নাম না বলে তার উস্তাদের নাম বলবে এবং নিজেই সে উস্তাদের কাছ থেকে শুনেছে বলে দাবী করবে।
খ. চোর জালিয়াত মূল সনদের মধ্যে কিছু পরিবর্তন করবে। সনদের মধ্যে একজন রাবীর নাম পরিবর্তন করে সে নতুন সনদ বানাবে।
গ. চোর জালিয়াত হাদীসটির মতন-এর জন্য নতুন সনদ বানাবে। একজন দুর্বল বা মিথ্যাচারী রাবীর বর্ণিত কোনো হাদীস তার মুখে বা কোনো স্থানে শুনে তার ভাল লাগে। হাদীসটির ‘আকর্ষণীয়তার’ কারণে তারও ইচ্ছা হয় হাদীসটি বলার। তবে হাদীসটি মূল জালিয়াতের নামে বললে তার ‘সম্মান’ কমে যায়। এছাড়া এতে আকর্ষণীয়তা ও নতুনত্ব থাকে না। এজন্য সে এ ‘জাল’ হাদীসটির জন্য আরেকটি ‘জাল’ সনদ তৈরি করবে।
জাল হাদীস চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে চুরির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন দুর্বল বা জাল হাদীস অনেক সময় ১০/১৫ টি সনদে বর্ণিত থাকে। এতগুলো সনদ দেখে অনেক সময় মুহাদ্দিস ধোঁকা খেতে পারেন। তিনি ভাবতে পারেন, হাদীসের সনদগুলো দুর্বল হলেও যেহেতু এতগুলো সনদ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সেহেতু হয়ত এর কোনো ভিত্তি আছে। এক্ষেত্রে তাকে দুইটি বিষয় নিশ্চিত হতে হবে। প্রথমত: তাকে দেখতে হবে যে, প্রত্যেক সনদেই মিথ্যাবাদী রাবী আছে কিনা। দ্বিতীয়ত: নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখতে হবে যে, এখানে চুরি আছে কিনা। যদি দেখা যায় যে, হাদীসটি নির্দিষ্ট কোনো যুগে নির্দিষ্ট কোনো রাবীর বর্ণনায় প্রসিদ্ধি লাভ করে। সে যুগের মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে সে রাবীর হাদীস বলে চিহ্নিত করেছেন। এরপর কোনো কোনো দুর্বল বা জালিয়াত রাবী তা উক্ত রাবীর উস্তাদ থেকে বা অন্য কোনো সনদে বর্ণনা করছেন। এক্ষেত্রে বুঝা যাবে যে, পরের রাবীগণ ‘চুরি’ করেছেন। এখানে চুরির কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করছি।
আমরা ইতোপূর্বে নেককারদের অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার উদাহরণ হিসাবে তৃতীয় হিজরী শতকের মাশহুর আবিদ সাবিত ইবনু মূসা (২২৯ হি) বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করেছি, যে হাদীসে বলা হয়েছে: ‘যার রাতের সালাত (তাহাজ্জুদ) অধিক হবে দিবসে তার চেহারা সৌন্দর্যময় হবে।’ এ হাদীসটি সর্বপ্রথম সাবিতই বলেন। মুহাদ্দিসগণ সাবিতের মুখে হাদীসটি শোনার পরে বিস্তারিত নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হন যে, সাবিত ছাড়া কেউ হাদীসটি ইতোপূর্বে বলেন নি। কিন্তু এ হাদীসটি সাবিতের মাধ্যমে পরিচিতি ও প্রসিদ্ধি লাভ করার পরে কোনো কোনো দুর্বল ও মিথ্যাচারী রাবী এই হাদীসটি সাবিতের উস্তাদ শারীক থেকে বা অন্যান্য সনদে বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণ এগুলোকে চুরি বলে চিহ্নিত করেছেন। এ সকল চোর জালিয়াতের একজন আব্দুল হামীদ ইবনু বাহর আবুল হাসান আসকারী, তিনি সাবিতের পরের যুগে দাবী করেন যে, তিনিও হাদীসটি শারীক থেকে শুনেছেন। ৪র্থ হিজরীর প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনু আদী বলেন, আমাকে হাসান ইবনু সুফিয়ান বলেন, আমাকে আব্দুল হামীদ ইবনু বাহর বলেছেন, আমাদেরকে শারীক বলেছেন, আ’মাশ থেকে, আবু সুফিয়ান থেকে জাবির থেকে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি রাত্রে সালাত (তাহাজ্জুদ) আদায় করে তবে দিনে তার চেহারা সৌন্দর্যময় হবে।’ ইবনু আদী বলেন, হাদীসটি সাবিত ইবনু মুসা থেকে প্রসিদ্ধ। তার থেকে পরবর্তীতে অনেক দুর্বল রাবী হাদীসটি চুরি করেছে। আব্দুল হামীদ তাদের একজন।[1]
চতুর্থ হিজরী শতকের একজন জালিয়াত রাবী হাসান ইবনু আলী ইবনু সালিহ আল-আদাবী। আল্লামা ইবনু আদী বলেন: আমি লোকটির কাছ থেকে হাদীস শুনেছি ও লিখেছি। লোকটি হাদীস জাল করত এবং চুরি করত। একজনের হাদীস আরেকজনের নামে বর্ণনা করতো। এমন সব লোকের নাম বলে হাদীস বলতো যাদের কোনো পরিচয় জানা যায় না।
এরপর তিনি এ হাসান ইবনু আলীর হাদীস চুরির অনেক উদাহরণ উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইবনু আদী বলেন: আমাকে হাসান ইবনু আলী আদাবী বলেন, আমাদেরকে হাসান ইবনু আলী ইবনু রাশিদ বলেছেন, তিনি শারীক থেকে, তিনি আ’মাশ থেকে, তিনি আবু সুফিয়ান থেকে, তিনি জাবির থেকে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: ‘যার রাতের সালাত অধিক হবে দিবসে তার চেহারা সৌন্দর্যময় হবে।’ ইবনু আদী বলেন: হাদীসটি সাবিত ইবনু মুসার হাদীস। সাবিতের পরে অনেক দুর্বল রাবী হাদীসটি চুরি করে বিভিন্ন রাবীর নাম দিয়ে চালিয়েছে। এ সনদে হাসান ইবনু আলী আল-আদাবী হাদীসটিকে হাসান ইবনু আলী ইবনু রাশিদের নামে চালাচ্ছে। অথচ হাসান ইবনু আলী ইবনু রাশিদ প্রসিদ্ধ ও সত্যপরায়ণ রাবী ছিলেন, তিনি কখনোই এ হাদীসটি শারীক থেকে বা অন্য কোনো সনদে বর্ণনা করেন নি। তাঁর পরিচিত কোনো ছাত্র হাদীসটি তাঁর থেকে বর্ণনা করেন নি।[2]
২য় শতকের একজন দুর্বল রাবী ‘হুযাইল ইবনুল হাকাম’। তিনি বলেন, আমাকে আব্দুল আযীয ইবনু আবী রাওয়াদ (১৫৯ হি) বলেছেন, তিনি ইকরিমাহ থেকে, তিনি ইবনু আববাস থেকে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
مَوْتُ الْغَرِيْبِ (مَوْتُ غُرْبَةٍ) شَهَادَةٌ
‘‘প্রবাসের মৃত্যু শাহাদত বলে গণ্য।’’[3]
হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী হুযাইল নামক এ রাবী। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতকের মুহাদ্দিসগণ বিস্তারিত সন্ধান ও নিরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন যে, এ হাদীসটি একমাত্র এ ব্যক্তি ছাড়া কোনো রাবী আব্দুল আযীয থেকে বা অন্য কোনো সূত্রে বর্ণনা করেন নি।
এ যুগের অন্য একজন রাবী ইবরাহীম ইবনু বাকর আল-আ’ওয়ার। তিনি এসে দাবী করলেন যে, তিনি হাদীসটি আব্দুল আযীয থেকে শুনেছেন। তিনিও বললেন: আমাদেরকে আব্দুল আযীয বলেছেন, ইকরিমাহ থেকে, ইবনু আববাস থেকে...। মুহাদ্দিসগণ নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করলেন যে, ইবরাহীম নামক এ ব্যক্তি হাদীসটি চুরি করেছেন। তাঁরা দেখলেন যে, ইবরাহীম আব্দুল আযীয থেকে হাদীস শুনেন নি। যখন হুযাইল হাদীস বলতেন তখনও তিনি বলেন নি যে, তিনিও হাদীসটি শুনেছেন। হুযাইলের সূত্রে যখন হাদীসটি মুহাদ্দিসগণের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করে তখন তিনিও হাদীসটি হুযাইলের সূত্রে জানতে পারেন। এখন হুযাইলের সূত্রে হাদীসটি বললে তার ‘মর্যাদা’ কমে যাবে। এজন্য তিনি হুযাইলের সনদ চুরি করলেন। হুযাইলের উস্তাদকে নিজের উস্তাদ দাবী করে তিনি হাদীসটি বলতে শুরু করলেন।[4]
[2] ইবনু আদী, আল-কামিল ২/৩৩৮-৩৪১ আরো দেখুন ৬/৩০৩।
[3] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৫১৫; আবু ইয়ালা আল-মাউসিলী, আল-মুসনাদ ৪/২৬৯, আল-বুসীরী, মিসবাহুয যুজাজাহ ২/৫৪।
[4] ইবনু আদী, আল-কামিল ১/২৫৭।
জালিয়াতির প্রধান ক্ষেত্র হলো হাদীসের ‘মতন’ বা মূল বক্তব্য। মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে প্রচারিত মিথ্যা কথা মূলত দুই প্রকারের হতে পারে: জালিয়াত নিজের মনগড়া কথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বলবে অথবা প্রচলিত কোনো কথাকে তাঁর নামে বলবে। উভয় প্রকারের মিথ্যা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হতে পারে।[1]
অনেক সময় আমরা দেখতে পাই যে, মিথ্যাবাদী রাবী নিজের বানানো কথা হাদীস বলে চালাচ্ছে। আল্লামা সুয়ূতী (৯১১ হি) উল্লেখ করেছেন যে, মাউযূ বা মিথ্যা হাদীসের মধ্যে এ প্রকারের হাদীসের সংখ্যায় বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জালিয়াত প্রয়োজন ও সুবিধা অনুসারে একটি বক্তব্য বানিয়ে তা হাদীস নামে চালায়।[1] উপরে উল্লিখিত বিভিন্ন উদাহরণের মধ্যে আমরা এ প্রকারের অনেক ‘জাল হাদীস’ দেখতে পেয়েছি। কুরআনের বিভিন্ন সূরার ফযীলতে বানোনো, বিভিন্ন প্রকারের ‘বানোয়াট আমলের’ বানোয়াট ফযীলতে বানানো, দেশ, জাতি, দল, মত ইত্যাদির পক্ষে বা বিপক্ষে বানানো জাল হাদীসগুলো সবই এ পর্যায়ের।
অনেক সময় দুর্বল রাবী বা মিথ্যাবাদী রাবী ভুলক্রমে বা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো সাহাবী বা তাবিয়ীর কথা, অথবা কোনো প্রবাদ বাক্য, নেককার ব্যক্তির বাণী, পূর্ববর্তী নবীদের নামে প্রচলিত কথা, চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোনো কথা, কোনো প্রসিদ্ধ পন্ডিতের বাণী বা অনুরূপ কোনো প্রচলিত কথাকে ‘হাদীসে রাসূল’ বলে বর্ণনা করেন। আল্লামা ইরাকী (৮০৬হি) এ জাতীয় মাউদূ হাদীসের দুটি উদাহরণ উল্লেখ করেছেন। প্রথম উদাহরণ
حُبُّ الدُّنْيَا رَأْسُ كُلِّ خَطِيْـئَـةٍ
‘দুনিয়ার ভালবাসা সকল পাপের মূল।’ আল্লামা ইরাকী বলেন, এ বাক্যটি মূলত কোনো কোনো নেককার আবিদের কথা। ঈসা (আঃ)-এর কথা হিসাবেও প্রচার করা হয়। তবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা হিসেবে এর কোনো ভিত্তি নেই। আর দ্বিতীয় উদাহরণ:
اَلْمَـعِـدَةُ بَـيْـتُ الدَّاءِ وَالْحِـمْيَـةُ رَأْسُ الدَّوَاءِ.
‘পাকস্থলী রোগের বাড়ি আর খাদ্যভ্যাস নিয়ন্ত্রণ সকল ঔষধের মূল।’
কথাটি চিকিৎসকদের কথা। হাদীস হিসেবে এর কোনো ভিত্তি নেই।[1]
উপরে ‘সনদের মধ্যে কমবেশি করা’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে আমরা এ জাতীয় কিছু উদাহরণ দেখেছি। এ প্রকারের ‘মিথ্যা’ বা জালিয়াতির আরো অনেক উদাহরণ আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখতে পাব। এখানে আমাদের দেশে আলিমগণের মধ্যে প্রচলিত এরূপ একটি হাদীসের কথা উল্লেখ করছি।
আমাদের দেশে ‘হাদীস’ বলে প্রচলিত একটি কথা:
مَا رَأَى الْمُسْـلِمُونَ حَسَـنـًا فـَهُـوَ عِـنْدَ اللَّهِ حَسَنٌ
‘‘মুসলিমগণ যা ভাল মনে করবেন তা আল্লাহর কাছে ভাল।’’
আমাদের দেশে সাধারণভাবে কথাটি হাদীসে নাবাবী বলে প্রচারিত। কথাটি মূলত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা)-এর। একে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা হিসাবে বর্ণনা করলে তাঁর নামে মিথ্যা বলা হবে। ইবনু মাসঊদ বলেন:
إِنَّ اللَّهَ نَظَرَ فِي قُلُوبِ الْعِبَادِ فَوَجَدَ قَلْبَ مُحَمَّدٍ ﷺ خَيْرَ قُلُوبِ الْعِبَادِ فَاصْطَفَاهُ لِنَفْسِهِ فَابْتَعَثَهُ بِرِسَالَتِهِ ثُمَّ نَظَرَ فِي قُلُوبِ الْعِبَادِ بَعْدَ قَلْبِ مُحَمَّدٍ فَوَجَدَ قُلُوبَ أَصْحَابِهِ خَيْرَ قُلُوبِ الْعِبَادِ فَجَعَلَهُمْ وُزَرَاءَ نَبِيِّهِ يُقَاتِلُونَ عَلَى دِينِهِ فَمَا رَأَى الْمُسْلِمُونَ حَسَنًا فَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ حَسَنٌ وَمَا رَأَوْا سَيِّئًا فَهُوَ عِنْدَ اللَّهِ سَيِّئٌ.
আল্লাহ তাঁর বান্দাদের হৃদয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। তিনি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর হৃদয়কে সমস্ত সৃষ্টি জগতের মধ্যে সর্বোত্তম হৃদয় হিসাবে পেয়েছেন। এজন্য তিনি তাঁকে নিজের জন্য বেঁছে নেন এবং তাঁকে রিসালাতের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেন। এরপর তিনি মুহাম্মাদ ﷺ -এর হৃদয়ের পরে অন্যান্য বান্দাদের হৃদয়গুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করেন। তখন তিনি তাঁর সাহাবীগণের হৃদয়গুলোকে সর্বোত্তম হৃদয় হিসাবে পেয়েছেন। এজন্য তিনি তাঁদেরকে তাঁর নবীর সহচর ও পরামর্শদাতা বানিয়ে দেন, তাঁরা তাঁর দীনের জন্য যুদ্ধ করেন। অতএব, মুসলমানগণ (অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ ﷺ -এর সহচর পরামর্শদাতা পবিত্র হৃদয় সাহাবীগণ) যা ভালো মনে করবেন তা আল্লাহর কাছেও ভালো। আর তাঁরা যাকে খারাপ মনে করবেন তা আল্লাহর কাছেও খারাপ।’’[2]
কোনো কোনো ফকীহ বা আলিম ভুলবশত কথাটি হাদীসে নাবাবী বলে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণ হাদীসের সকল গ্রন্থ তালাশ করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, হাদীসটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে বর্ণিত হয় নি। আল্লামা যাইলায়ী আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসূফ (৭৬২ হি), ইবনু কাসীর ইসমাঈল ইবনু উমার (৭৭৪ হি), ইবনু হাজার আসকালানী আহমাদ ইবনু আলী (৮৫২ হি), সাখাবী, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রাহমান (৯০২হি) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, হাদীসটি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদের (রা) কথা হিসাবে হাসান সনদে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কথা হিসাবে কোথাও বর্ণিত হয়নি।[3]
[2] আহমাদ, আল-মুসনাদ ১/৩৭৯; তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ৪/৫৮, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৩/৮৩; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১৭৭।
[3] যাইলায়ী, আব্দুল্লাহ ইবনু ইউসূফ (৭৬২ হি), নাসবুর রাইয়াহ ৪/১৩৩; ইবনু কাসীর ইসমাঈল ইবনু উমার (৭৭৪ হি), তুহফাতুল তালিব পৃ: ৪৫৫; ইবনু হাজার আসকালানী, আদ-দিরাইয়াহ ২/১৮৭; সাখাবী, আল-মাকাসিদুল হাসানা, পৃ: ৩৬৮; আল-আজলূনী, ইসমাঈল ইবনু মুহাম্মাদ (১১৬২ হি), কাশফুল খাফা ২/২৪৫।
হাদীসের নামে মিথ্যার একটি ক্ষেত্র অনুবাদ ও ব্যাখ্যা। আমরা সাধারণত বই-পুস্তক ও ওয়ায-নসীহতে হাদীস উল্লেখের ক্ষেত্রে নিজেদেরকে ১০০% স্বাধীনতা প্রদান করে থাকি। হাদীসের মূল বক্তব্যকে আমরা আমাদের পছন্দমত কমবেশি করে অনুবাদ করি, অনুবাদের মধ্যে ব্যাখ্যা সংযোগ করি এবং সবকিছুকে ‘হাদীস’ নামেই চালাই। অথচ সাহাবাীগণ একটি শব্দের হেরফেরের কারণে গলদঘর্ম হয়ে যেতেন!
কুরআন ও হাদীসের আলোকে কিয়াস ও ইজতিহাদ ইসলামী ফিকহের অন্যতম উৎস। যে সকল বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে সুস্পষ্ট কিছু বিধান দেয়া হয় নি কিয়াস ও ইজতিহাদের মাধ্যমে সেগুলোর বিধান নির্ধারণ করতে হয়। যেমন রাসুলুল্লাহ (ﷺ) উম্মাতকে সালাত শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু কোন কাজটি ফরয, কোনটি মুস্তাহাব ইত্যাদি বিস্তারিত বলেন নি। বিভিন্ন হাদীসের আলোকে মুজতাহিদ তা নির্ণয় করার চেষ্টা করেন। অনুরূপভাবে মাইক, টেলিফোন, প্লেন ইত্যাদি বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে কিছু বলা হয় নি। কুরআন ও হাদীসের প্রাসঙ্গিক নির্দেশাবলির আলোকে কিয়াস ও ইজতিহাদের মাধ্যমে এগুলোর বিধান অবগত হওয়ার চেষ্টা করেন মুজতাহিদ।
তবে কিয়াস বা ইজতিহাদ দ্বারা কোনো গাইবী বিষয় জানা যায় না বা ইবাদত বন্দেগি তৈরি করা যায় না। হজ্জের সময় ইহরাম পরিধানের উপর কিয়াস করে সালাতের মধ্যে ইহরাম পরিধানের বিধান দেওয়া যায় না। অনুরূপভাবে মসজিদুল হারামে সালাতের ১ লক্ষগুণ সাওয়াবের উপর কিয়াস করে তথায় যাকাত প্রদানের সাওয়াব ১ লক্ষগুণ বৃদ্ধি হবে বলে বলা যায় না। অথবা আমরা বলতে পারি না যে, রামাদানে যাকাত দিলে ৭০ গুণ সাওয়াব এবং রামাদানে মসজিদে হারামে যাকাত প্রদান করলে ৭০ লক্ষ গুণ সাওয়াব।
এখানে কিছু উদাহরণ উল্লেখ করছি। ইমাম তিরমিযী জিহাদের ফযীলতের অধ্যায়ে নিম্নের ‘হাসান’ বা গ্রহণযোগ্য হাদীসটি সংকলন করেছেন। খুরাইম ইবনু ফাতিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
مَنْ أَنْفَقَ نَفَقَةً فِي سَبِيلِ اللَّهِ كُتِبَتْ لَهُ بِسَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ
‘‘যদি কেউ আল্লাহর রাস্তায় কোনো ব্যয় করেন তবে তার জন্য সাত শত গুণ সাওয়াব লেখা হয়।’’[1]
ইমাম ইবনু মাজাহ সংকলিত একটি যয়ীফ হাদীসে বলা হয়েছে:
مَنْ أَرْسَلَ بِنَفَقَةٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَأَقَامَ فِي بَيْتِهِ فَلَهُ بِكُلِّ دِرْهَمٍ سَبْعُ مِائَةِ دِرْهَمٍ وَمَنْ غَزَا بِنَفْسِهِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَأَنْفَقَ فِي وَجْهِ ذَلِكَ فَلَهُ بِكُلِّ دِرْهَمٍ سَبْعُ مِائَةِ أَلْفِ دِرْهَمٍ ثُمَّ تَلا هَذِهِ الآيَةَ: وَاللَّهُ يُضَاعِفُ لِمَنْ يَشَاءُ
‘‘যে নিজে বাড়িতে অবস্থান করে আল্লাহর রাস্তায় খরচ পাঠিয়ে দেয় সে প্রত্যেক দিরহামের জন্য ৭০০ দিরহাম লাভ করবে। আর যে নিজে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং এ জন্য খরচ করে সে প্রত্যেক দিরহামের জন্য ৭ লক্ষ দিরহাম (সাওয়াব) লাভ করবে। এরপর তিনি (সূরা বাকারার ২৬১ আয়াত) পাঠ করেন: ‘আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা বৃদ্ধি করে দেন।’’[2]
হাদীসটির একমাত্র বর্ণনাকারী ইবনু আবী ফুদাইক। তিনি বলেন, ‘খালীল ইবনু আব্দুল্লাহ নামক এক ব্যক্তি হাসান বসরীর সূত্রে হাদীসটি বলেছেন। মুহাদ্দিসগণ খালীল ইবনু আব্দুল্লাহ নামক এ ব্যক্তির বিশ্বস্ততা তো দূরের কথা তার কোনো পরিচয়ও জানতে পারেন নি। এজন্য আল্লামা বূসীরী বলেন: ‘‘এ সনদটি দূর্বল; কারণ খালীল ইবনু আব্দুল্লাহ অজ্ঞাত পরিচয়।’’[3]
তাবিয়ী মুজাহিদ বলেন, আবূ হুরাইরা (রা) একবার সীমান্ত প্রহরায় নিয়োজিত ছিলেন। শত্রুর আগমন ঘটেছে মনে করে হঠাৎ করে ডাকাডাকি করা হয়। এতে সকলেই ছুটে সমূদ্র উপকূলে চলে যান। তখন বলা হয় যে, কোনো অসুবিধা নেই। এতে সকলেই ফিরে আসলেন। শুধু আবূ হুরাইরা দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন একব্যক্তি তাঁকে প্রশ্ন করেন, আবূ হুরাইরা, আপনি এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি:
مَوْقِفُ سَاعَةٍ فِيْ سِبِيْلِ اللهِ خَيْرٌ مِنْ قِيَامِ لَيْلَةِ الْقَدْرِ عِنْدَ الْحَجَرِ الأَسْوَدِ
‘‘আল্লাহর রাস্তায় এক মুহূর্ত অবস্থান করা লাইলাতুল কাদ্রে ‘হাজারে আসওয়াদ’-এর কাছে কিয়াম (সালাত আদায়) করার চেয়ে উত্তম।’’[4]
উপরের হাদীসগুলোতে ‘আল্লাহর পথে’ ব্যয়, অবস্থান ইত্যাদির সাওয়াব উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর সকল আলিম একমত যে, এখানে ‘আল্লাহর রাস্তায়’ বলতে অমুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুসলিম রাষ্ট্রের যুদ্ধ বা জিহাদ বুঝানো হয়েছে। সকল মুহাদ্দিসই হাদীসগুলোকে ‘জিহাদ’ বা যুদ্ধের অধ্যায়ে সংকলন করেছেন। এখানে যদি আমরা অনুবাদে ‘আল্লাহর রাস্তায়’ বলি, অথবা ‘জিহাদ’ বলি তবে হাদীসগুলোর সঠিক অনুবাদ করা হবে।
অন্য একটি সহীহ হাদীসে কা’ব ইবনু আজুরা (রা) বলেন, একজন উদ্দীপনাময় শক্তিশালী ব্যক্তিকে দেখে সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, এ লোকটি যদি আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদে) থাকত! তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
إِنْ كَانَ خَرَجَ يَسْعَى عَلَى وَلَدِهِ صِغَارًا فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، وَإِنْ كَانَ خَرَجَ يَسْعَى عَلَى أَبَوَيْنِ شَيْخَيْنِ كَبِيرَيْنِ فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، وَإِنْ كَانَ خَرَجَ يَسْعَى عَلَى نَفْسِهِ يُعِفُّهَا فَهُوَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ.
‘‘যদি লোকটি তার ছোটছোট সন্তানদের জন্য উপার্জনের চেষ্টায় বেরিয়ে থাকে তাহলে সে আল্লাহর রাস্তায় রয়েছে। যদি সে তার বৃদ্ধ পিতামাতার জন্য উপার্জনের চেষ্টায় বেরিয়ে থাকে তাহলে সে আল্লাহর রাস্তায় রয়েছে। যদি সে নিজেকে পরনির্ভরতা থেকে মুক্ত রাখতে উপার্জনের চেষ্টায় বেরিয়ে থাকে তাহলে সে আল্লাহর রাস্তায় রয়েছে।’’[5]
এখানে অর্থ উপার্জনের জন্য কর্ম করাকে ‘আল্লাহর রাস্তায় থাকা’ বা ‘আল্লাহর রাস্তায় চলা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। অন্যান্য হাদীসে ইলম শিক্ষা, হজ্জ, সৎকাজে আদেশ, ঠান্ডার মধ্যে পূর্ণরূপে ওযু করা, মসজিদে সালাতের অপেক্ষা করা, নিজের নফসকে আল্লাহর পথে রাখার চেষ্টা করা ইত্যাদি কর্মকে জিহাদ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আমরা উপরের হাদীসগুলোর সঠিক ও শাব্দিক অর্থ বর্ণনা করার পরে বলতে পারি যে, বিভিন্ন হাদীসে হালাল উপার্জন, ইলম শিক্ষা, সৎকাজে আদেশ, হজ্জ আদায় ইত্যাদি কর্মকেও ‘আল্লাহর রাস্তায় কর্ম’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কাজেই আমরা আশা করি যে, এরূপ কর্মে রত মানুষেরাও এসকল হাদীসে উল্লিখিত ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের সাওয়াব পেতে পারেন।
কিন্তু আমরা যদি সেরূপ না করে, সরাসরি বলি যে, ‘হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, হালাল উপার্জনে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা হাজারে আসওয়াদের কাছে লাইলাতুল কাদ্রের সালাত আদায়ের চেয়ে উত্তম’, অথবা ‘সৎকাজে আদেশের জন্য র্যালি বা মিছিলে একটি টাকা ব্যয় করলে ৭০ লক্ষ টাকার সাওয়াব পাওয়া যাবে’ ... তবে তা মিথ্যাচার বলে গণ্য হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনোই এভাবে বলেন নি।
অনুরূপভাবে উপরের হাদীসগুলোতে আল্লাহর পথে যুদ্ধে ব্যায় করলে ৭০০ বা ৭ লক্ষ গুণ সাওয়াবের কথা বলা হয়েছে। অন্য হাদীসে বলা হয়েছে:
إِنَّ الصَّلاةَ وَالصِّيَامَ وَالذِّكْرَ تُضَاعَفُ عَلَى النَّفَقَةِ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِسَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ
‘‘সালাত, সিয়াম ও যিক্র (এগুলোর সাওয়াব) আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার চেয়ে সাত শত গুণ বর্ধিত হয়।’’[6]
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসগণ বলেছেন যে, এ হাদীসে সুস্পষ্ট অর্থ হলো, ঘরে বসে সালাত, সিয়াম ও যিক্র পালন করলে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য অর্থ ব্যয়ের চেয়েও সাত শত গুণ বেশি সাওয়াব পাওয়া যায়। কেউ কেউ এখানে কিছু কথা উহ্য রয়েছে বলে মনে করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এ হাদীসের অর্থ হলো ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদরত অবস্থায়’ সালাত, সিয়াম ও যিকর পালন করলে সেগুলোর সাওয়াব আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে খরচ করার চেয়ে সাত শত গুণ বর্ধিত হয়।[7] এখানে আমাদের দায়িত্ব হলো হাদীসটি শাব্দিক অর্থ বলার পরে আমাদের ব্যাখ্যা পৃথকভাবে বলা।
এখানে বিভিন্নভাবে হাদীসের নামে মিথ্যা বলার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন কেউ গুণভাগ করে বলতে পারেন যে, ‘জিহাদে যেয়ে অর্থ ব্যায় করলে ৭ লক্ষগুণ সাওয়াব। আর ঘরে বসে যিক্র করলে তার ৭ শত গুণ সাওয়াব। এর অর্থ হলো ঘরে বসে যিক্র করলে ৪৯ কোটি নেক আমলের সাওয়াব।’ তিনি যদি উপরের হাদীসগুলোর সঠিক অনুবাদ করার পরে পৃথকভাবে এ ব্যাখ্যা করেন তবে অসুবিধা নেই। কিন্তু তিনি যদি এ কথাটিকে হাদীসের কথা বলে বুঝান তবে তিনি হাদীসের নামে মিথ্যা বললেন। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কখনোই এভাবে বলেন নি। তিনি আল্লাহর পথে খরচের চেয়ে ৭০০ গুণ বৃদ্ধি বলতে মুল সাওয়াবের চেয়ে ৭০০ গুণ, নাকি ৭০০ গুণের ৭০০ গুণ বুঝাচ্ছেন তাও বলেন নি। কাজেই তিনি যা সুস্পষ্ট করে বলেন নি, তা তাঁর নামে বলা যায় না। তবে পৃথকভাবে ব্যাখ্যায় বলা যেতে পারে।
অনুরূপভাবে যদি কেউ বলেন যে, ‘হাদীস শরীফে বলা হয়েছে, হালাল উপার্জনের জন্য কর্মরত অবস্থায়, হজ্জের সফরে থাকা অবস্থায়, ইলম শিক্ষারত অবস্থায়, দাওয়াতে রত অবস্থায়, সৎকাজের আদেশের জন্য মিছিলে থাকা অবস্থায় বা নফস'কে শাসন করার অবস্থায় যিক্র করলে ৪৯ কোটি গুণ সাওয়াব পাওয়া যায়’ তবে তিনিও হাদীসের নামে মিথ্যা বললেন।
হাদীসের নামে মিথ্যা বলার একটি প্রকরণ হলো, অনুবাদের ক্ষেত্রে শাব্দিক অনুবাদ না করে অনুবাদের সাথে নিজের মনমত কিছু সংযোগ করা বা কিছু বাদ দিয়ে অনুবাদ করা। অথবা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বলেছেন তার ব্যাখ্যাকে হাদীসের অংশ বানিয়ে দেয়া। আমাদের সমাজে আমরা প্রায় সকলেই এ অপরাধে লিপ্ত রয়েছি। আত্মশুদ্ধি, পীর-মুরিদী, দাওয়াত-তাবলীগ, রাজনীতিসহ মতভেদীয় বিভিন্ন মাসআলা-মাসাইল-এর জন্য আমরা প্রত্যেক দলের ও মতের মানুষ কুরআন ও হাদীস থেকে দলীল প্রদান করি। এরূপ দলীল প্রদান খুবই স্বাভাবিক কর্ম ও ঈমানের দাবি। তবে সাধারণত আমরা আমাদের এ ব্যাখ্যাকেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে চালাই।
যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, কিন্তু প্রচলিত অর্থে ‘দলীয় রাজনীতি’ করেন নি, অর্থাৎ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের মত কিছু করেন নি। বর্তমানে গণতান্ত্রিক ‘রাজনীতি’ করছেন অনেক আলিম। ন্যায়ের আদেশ, অন্যায়ের নিষেধ বা ইকামতে দীনের একটি নতুন পদ্ধতি হিসেবে একে গ্রহণ করা হয়। তবে যদি আমরা বলি যে, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাজনীতি করেছেন’, তবে শ্রোতা বা পাঠক ‘রাজনীতি’র প্রচলিত অর্থ, অর্থাৎ ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের কথাই বুঝবেন। আর এ রাজনীতি তিনি করেন নি। ফলে এভাবে তাঁর নামে মিথ্যা বলা হবে। এজন্য আমাদের উচিত তিনি কী করেছেন ও বলেছেন এবং আমরা কি ব্যাখ্যা করছি তা পৃথকভাবে বলা।
রাসূলুল্লাহ ﷺ দীন প্রচার করেছেন আজীবন। দীনের জন্য তিনি ও তাঁর অনেক সাহাবী চিরতরে বাড়িঘর ছেড়ে ‘হিজরত’ করেছেন। কিন্তু তিনি কখনোই দাওয়াতের জন্য সময় নির্ধারণ করে ২/১ মাসের জন্য সফরে ‘বাহির’ হন নি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকে হিজরত না করলেও অন্তত কিছুদিনের জন্য বিভিন্ন স্থানে যেয়ে দাওয়াতের কাজ করছেন। কিন্তু আমরা এ কর্মের জন্য যদি বলি যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ দাওয়াতের জন্য ‘বাহির’ হতেন, তবে পাঠক বা শ্রোতা ‘নির্ধারিত সময়ের জন্য বাহির হওয়া’ বুঝবেন। অথচ তিনি কখনোই এভাবে দাওয়াতের কাজ করেন নি। এতে তাঁর নামে মিথ্যা বলা হবে।
যদি আমরা বলি যে, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণ মীলাদ মাহফিল করতেন’ তবে অনুরূপভাবে তাঁর নামে মিথ্যা বলা হবে। কারণ তাঁরা শুধু ‘মীলাদ’ আলোচনা বা উদযাপনের জন্য কোনো মাহফিল করেন নি। তবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর জন্ম বিষয়ক দু চারটি ঘটনা সাহাবীদেরকে বলেছেন। এ সকল হাদীস সাহাবীগণ তাবিয়ীগণকে বলেছেন। এগুলোর জন্য তাঁরা কোনো মাহফিল করেন নি বা এগুলোকে পৃথকভাবে আলোচনা করেন নি। আজ যদি কোনো মুসলিম ‘আনুষঙ্গিক আনুষ্ঠানিকতা’ ছাড়া অবিকল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের পদ্ধতিতে এ সকল হাদীস বর্ণনা করেন, তবে কেউই বলবেন না যে তিনি মীলাদ মাহফিল করছেন। এতে আমরা বুঝি যে, ‘মীলাদ মাহফিল’ বলতে যে অর্থ আমরা সকলেই বুঝি সে কাজটি তিনি করেন নি।
এজন্য আমাদের উচিত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কি করেছেন বা বলেছেন এবং তা থেকে আমরা কি বুঝলাম তা পৃথকভাবে বলা। আমরা দেখেছি যে, একটি শব্দের হেরফেরের ভয়ে সাহাবীগণ কিভাবে সন্ত্রস্ত হয়েছেন। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
[2] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/৯২২।
[3] বূসীরী, মিসবাহুয যুজাজাহ ৩/১৫৪।
[4] ইবনু হিববান, আস-সহীহ ১০/৪৬২; হাইসামী, মাওয়ারিদুয যামআন ৫/১৬১-১৬২; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান ৪/৪০।
[5] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৩২৫। হাদীসটির সনদ সহীহ।
[6] আবূ দাঊদ, আস-সুনান ৩/৮, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/৮৮। হাদীসটির একমাত্র রাবী যাববান ইবনু ফাইদ হাদীস বর্ণনায় দুর্বল ছিলেন। ইবনু হাজার, তাকরীব, পৃ. ২১৩।
[7] হাশিয়াতু ইবনিল কাইয়িম ৭/১২৭।