ওহীর জ্ঞানের নির্ভুল সংরক্ষণের বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের সামগ্রিক নির্দেশ, ওহীর নামে মিথ্যা বা আন্দাজে কথা বলার ভয়াবহ পরিণতি, হাদীসের নির্ভুল সংরক্ষণে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর বিশেষ নির্দেশ ও হাদীসের নামে মিথ্যা বলার নিষেধাজ্ঞার আলোকে সাহাবীগণ হাদীসে রাসূল (ﷺ)-কে সকল প্রকার অনিচ্ছাকৃত, অজ্ঞতাপ্রসূত বা ইচ্ছাকৃত ভুল, বিকৃতি বা মিথ্যা থেকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেন। প্রথমত: তাঁরা নিজেরা হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতেন। পরিপূর্ণ ও নির্ভুল মুখস্থ সম্পর্কে পূর্ণ নিশ্চিত না হলে তাঁরা হাদীস বলতেন না। দ্বিতীয়ত: তাঁরা সবাইকে এভাবে পূর্ণরূপে হুবহু ও নির্ভুলভাবে মুখস্থ করে হাদীস বর্ণনা করতে উৎসাহ ও নির্দেশ প্রদান করতেন। তৃতীয়ত: তাঁরা সাহাবী ও তাবিয়ী যে কোনো হাদীস বর্ণনাকারীর হাদীসের নির্ভুলতার বিষয়ে সামান্যতম দ্বিধা হলে তা বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করার পরে গ্রহণ করতেন।
এখানে লক্ষণীয় যে, তাঁদের যুগে ইচ্ছাকৃত ভুলের কোনো প্রকার সম্ভাবনা ছিল না। মানুষের জাগতিক কথাবার্তা ও লেনদেনেও কেউ মিথ্যা বলতেন না। সততা ও বিশ্বস্ততা ছিলই তাঁদের বৈশিষ্ট্য। তা সত্ত্বেও অনিচ্ছাকৃত, অজ্ঞতাপ্রসূত বা অসাবধানতাজনিত সামান্যতম ভুল থেকে হাদীসে রাসূল (ﷺ) এর রক্ষায় তাঁদের কর্মধারা দেখলে হতবাক হয়ে যেতে হয়।
আমরা দেখেছি যে, অনিচ্ছাকৃত ভুলও মিথ্যা বলে গণ্য। সাহাবীগণ নিজে হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে অনিচ্ছাকৃত ‘মিথ্যা’ থেকে আত্মরক্ষার জন্য নির্ভুলভাবে ও আক্ষরিকভাবে হাদীস বলার সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন। হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁদের সতর্কতার অগণিত ঘটনা হাদীস গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এখানে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
তাবিয়ী আম্র ইবনু মাইমূন আল-আযদী (৭৪ হি) বলেন,
مَا أَخْطَأَنِي ابْنُ مَسْعُودٍ عَشِيَّةَ خَمِيسٍ إِلا أَتَيْتُهُ فِيهِ، قَالَ فَمَا سَمِعْتُهُ يَقُولُ بِشَيْءٍ قَطُّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ. فَلَمَّا كَانَ ذَاتَ عَشِيَّةٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ، فَنَكَسَ، قَالَ: فَنَظَرْتُ إِلَيْهِ فَهُوَ قَائِمٌ مُحَلَّلَةً أَزْرَارُ قَمِيصِهِ قَدِ اغْرَوْرَقَتْ عَيْنَاهُ وَانْتَفَخَتْ أَوْدَاجُهُ، قَالَ: أَوْ دُونَ ذَلِكَ أَوْ فَوْقَ ذَلِكَ أَوْ قَرِيبًا مِنْ ذَلِكَ أَوْ شَبِيهًا بِذَلِكَ.
‘‘আমি প্রতি বৃহস্পতিবার বিকালে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা) এর কাছে আগমন করতাম। তিনি তাঁর কথাবার্তার মধ্যে ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন’ একথা কখনো বলতেন না। এক বিকালে তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন’, এরপর তিনি মাথা নিচু করে ফেলেন। আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখি, তিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাঁর জামার বোতামগুলো খোলা। তাঁর চোখ দুটি লাল হয়ে গিয়েছে এবং গলার শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। তিনি বললেন: অথবা এর কম, অথবা এর বেশি, অথবা এর মত, অথবা এর কাছাকাছি কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন।’’[1]
তাবিয়ী মাসরূক ইবনুল আজদা’ আবু আইশা (৬১ হি) বলেন,
إن عبد الله حَدَّثَ يَوْماً عَنْ رَسُولِ اللهِ فَارْتَعَدَ وَارْتَعَدَتْ ثِيَابُهُ، ثُمَّ قَالَ: أَوْ نَحْوَ هَذَا.
‘‘একদিন আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেন। তখন তিনি কেঁপে উঠেন এমনকি তাঁর পোশাকেও কম্পন পরিলক্ষিত হয়। এরপর তিনি বলেন: অথবা অনুরূপ কথা তিনি বলেছেন।’’[2]
তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবনু সিরীন (১১০ হি) বলেন:
كَانَ أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ إِذَا حَدَّثَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ حَدِيثًا فَفَرَغَ مِنْهُ قَالَ أَوْ كَمَا قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ.
আনাস ইবনু মালিক (রা) যখন হাদীস বলতেন তখন হাদীস বর্ণনা শেষ করে বলতেন: অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেছেন (আমার বর্ণনায় ভুল হতে পারে)।’’[3]
হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সাহাবীগণ জ্ঞাতসারে একটি শব্দেরও পরিবর্তন করতেন না। আক্ষরিকভাবে হুবহু বর্ণনা করতেন তাঁরা। তাবিয়ী সা’দ ইবনু উবাইদাহ সুলামী (১০৩ হি) বলেন: সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (৭৩ হি) বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
بُنِىَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسَةٍ: عَلَى أَنْ يُوَحَّدَ اللَّهُ وَإِقَامِ الصَّلاَةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَصِيَامِ رَمَضَانَ وَالْحَجِّ. فَقَالَ رَجُلٌ: الْحَجِّ وَصِيَامِ رَمَضَانَ. قَالَ: لاَ،্রصِيَامِ رَمَضَانَ وَالْحَجِّগ্ধ، هَكَذَا سَمِعْتُهُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ.
‘‘পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে: একমাত্র আল্লাহর ইবাদত বা তাওহীদ, সালাত প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত প্রদান করা, রামাদানের সিয়াম পালন এবং হজ্জ।’’ তখন একব্যক্তি বলে: ‘‘হজ্জ ও রামাদানের সিয়াম’’। তিনি বলেন: না, ‘‘রামাদানের সিয়াম ও হজ্জ।’’ এভাবেই আমি রাসূলুললাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছি।’’[4]
ইয়াফুর ইবনু রূযী নামক তাবিয়ী বলেন, আমি শুনলাম, উবাইদ ইবনু উমাইর (৭২ হি) নামক প্রখ্যাত তাবিয়ী ও মক্কার সুপ্রসিদ্ধ ওয়ায়িয একদিন ওয়াযের মধ্যে বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
مَثُلُ الْمُنَافِقِ كَمَثَلِ الشَّاةِ الرَّابِضَةِ بَيْنَ الْغَنَمَيْنِ.
‘‘মুনাফিকের উদাহরণ দু’টি ছাগলের পালের মধ্যে অবস্থানরত ছাগীর ন্যায়।’’
একথা শুনে সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (৭৩ হি) বলেন:
وَيْلَكُمْ لاَ تَكْذِبُوا عَلَى رَسُولِ اللَّهِ ﷺ، إِنَّمَا قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم: ্রمَثَلُ الْمُنَافِقِ كَمَثَلِ الشَّاةِ الْعَائِرَةِ بَيْنَ الْغَنَمَيْنِগ্ধ
‘‘দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে মিথ্যা বলবে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ তো বলেছেন: ‘‘মুনাফিকের উদাহরণ হলো দু’টি ছাগলের পালের মধ্যে যাতায়াতরত (wandering, roaming) ছাগীর ন্যায়।’’[5]
হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা ও পরিপূর্ণ নির্ভুলতা নিশ্চিত করার জন্য অধিকাংশ সাহাবী রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে হাদীস বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকতেন। শুধুমাত্র যে কথাগুলো বা ঘটনাগুলো তাঁরা পরিপূর্ণ নির্ভুলভাবে মুখস্থ রেখেছেন বলে নিশ্চিত থাকতেন সেগুলোই বলতেন। অনেকে কখনোই রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে কিছু বলতেন না। সাহাবীগণের সংখ্যা ও হাদীস-বর্ণনাকারী সাহাবীগণের সংখ্যার মধ্যে তুলনা করলেই আমরা বিষয়টি বুঝতে পারি। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কমবেশি সাহচর্য লাভ করেছেন এমন সাহাবীর সংখ্যা লক্ষাধিক। নাম পরিচয় সহ প্রসিদ্ধ সাহাবীর সংখ্যা ১০ সহস্রাধিক। অথচ হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীর সংখ্যা মাত্র দেড় হাজার।
সাহাবীদের নামের ভিত্তিতে সংকলিত প্রসিদ্ধ সর্ববৃহৎ হাদীস গ্রন্থ মুসনাদ আহমাদ। ইমাম আহমাদ এতে মোটামুটি গ্রহণ করার মত সকল সহীহ ও যয়ীফ হাদীস সংকলিত করেছেন। এতে ৯০৪ জন সাহাবীর হাদীস সংকলিত হয়েছে। পরিচিত, অপরিচিত, নির্ভরযোগ্য, অনির্ভরযোগ্য সকল হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবীর সংখ্যা একত্রিত করলে ১৫৬৫ হয়।
আরো লক্ষণীয় যে, হাদীস বর্ণনাকারী সহস্রাধিক সাহাবীর মধ্যে অধিকাংশ সাহাবী মাত্র ১ থেকে ২০/৩০ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। ১০০ টির অধিক হাদীস বর্ণনা করেছেন এমন সাহাবীর সংখ্যা মাত্র ৩৮ জন। তাঁদের মধ্যে মাত্র ৭ জন সাহাবী থেকে এক হাজারের অধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। বাকী ৩১ জন সাহাবী থেকে একশত থেকে কয়েকশত হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[6]
অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকার অনেক ঘটনা সাহাবীগণ থেকে বর্ণিত। সাইব ইবনু ইয়াযিদ (৯১ হি) সাহাবী ছিলেন। ছোট বয়সে তিনি বিদায় হজ্জে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহচর্য লাভ করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি সাহাবীগণের সাহচর্যে জীবন কাটিয়েছেন। তিনি বলেন,
صَحِبْتُ عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ عَوْفٍ، وَطَلحَةَ بْنَ عُبَيْدِ اللهِ، وَسَعْدَ بْنَ أَبِيْ وَقَّاصٍ، وَالْمِقْدَادَ بْنَ الأَسْوَدِ، فَلَمْ أَسْمَعْ أَحَداً مِنْهُمْ يَتَحَدَّثُ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ، إلاَّ أَنِّيْ سَمِعْتُ طَلْحَةَ بْنَ عُبَيْدِ اللهِ يَتَحَدَّثُ عَنْ يَوْمِ أُحُدٍ.
‘‘আমি আব্দুর রাহমান ইবনু আউফ (রা), তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহ (রা), সা’দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রা), মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ (রা) প্রমূখ সাহাবীর সাহচর্যে সময় কাটিয়েছি। তাঁদের কাউকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদীস বলতে শুনিনি। তবে শুধুমাত্র তালহা ইবনু উবাইদুল্লাহকে আমি উহদ যুদ্ধ সম্পর্কে বলতে শুনেছি।’’[7]
তিনি আরো বলেন:
صَحِبْتُ سَعْدَ بْنَ مَالِكٍ مِنَ الْمَدِينَةِ إِلَى مَكَّةَ فَمَا سَمِعْتُهُ يُحَدِّثُ عَنِ النَّبِيِّ ﷺ بِحَدِيثٍ وَاحِدٍ
‘‘আমি সা’দ ইবনু মালিক (রা) এর সাথে মদীনা থেকে মক্কা পর্যন্ত গিয়েছি, অথচ তাঁকে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে একটি হাদীসও বলতে শুনিনি।’’[8]
হিজরী প্রথম শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী শা’বী (২০৪ হি) বলেন:
جَالَسْتُ ابْنَ عُمَرَ سَنَةً فَمَا سَمِعْتُهُ يُحَدِّثُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ شَيْئًا.
‘‘আমি আব্দুল্লাহ ইবনু উমারের (রা) সাথে একটি বছর থেকেছি, অথচ তাঁকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কিছুই বলতে শুনিনি।’’[9]
অন্যত্র তিনি বলেন:
قَاعَدْتُ ابْنَ عُمَرَ قَرِيبًا مِنْ سَنَتَيْنِ أَوْ سَنَةٍ وَنِصْفٍ فَلَمْ أَسْمَعْهُ يُحَدِّثُ عَنِ النَّبِيِّ ﷺ غَيْرَ هَذَا (حديثاً واحداً).
‘‘আমি দুই বছর বা দেড় বছর আব্দুল্লাহ ইবনু উমারের (রা) কাছে বসেছি। এ দীর্ঘ সময়ে তাঁকে মাত্র একটি হাদীস বলতে শুনেছি...।’’[10]
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রা) বলেন, আমি আমার পিতা যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা)-কে বললাম, কোনো কোনো সাহাবী যেমন হাদীস বর্ণনা করেন আপনাকে তদ্রূপ হাদীস বলতে শুনিনা কেন? তিনি বলেন:
أَمَا إِنِّي لَمْ أُفَارِقْهُ وَلَكِنْ سَمِعْتُهُ يَقُولُ مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ (مُتَعَمِّداً) فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ.
‘‘(ইসলাম গ্রহণের পর থেকে) আমি কখনই তাঁর সাহচর্য থেকে দূরে যাই নি। কিন্তু আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, আমার নামে (ইচ্ছাকৃতভাবে) যে ব্যক্তি মিথ্যা বলবে তাকে অবশ্যই জাহান্নামে বসবাস করতে হবে।’’[11]
তাহলে যুবাইর ইবনুল আওয়াম (৩৬ হি)-এর হাদীস না বলার কারণ অজ্ঞতা নয়। তিনি নবুয়তের প্রথম পর্যায়ে কিশোর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এরপর দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্যে জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর ইন্তেকালের পরে তিনি প্রায় ২৫ বছর বেঁচে ছিলেন। অথচ তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৪০ টিরও কম। মুসনাদ আহমদে তাঁর থেকে ৩৬ টি হাদীস সংকলিত হয়েছে। ইবনু হাযাম উল্লেখ করেছেন যে, নির্ভরযোগ্য ও অনির্ভরযোগ্য সনদে তাঁর নামে বর্ণিত সকল হাদীসের সংখ্যা মাত্র ৩৮ টি।[12]
আমরা দেখছি যে, অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে তিনি হাদীস বলা থেকে বিরত থাকতেন। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে মিথ্যা বলার শাস্তি জাহান্নাম। আর অনিচ্ছাকৃত ভুল বা শব্দগত পরিবর্তন ও তাঁর নামে মিথ্যা বলা হতে পারে। এজন্য তিনি হাদীস বর্ণনা থেকে অধিকাংশ সময় বিরত থাকতেন।
অন্যান্য সাহাবীও এভাবে অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকতেন। তাবিয়ী আব্দুর রাহমান ইবনু আবী লাইলা (৮৩ হি) বলেন,
قُلْنَا لِزَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ: حَدِّثْنَا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ قَالَ كَبِرْنَا وَنَسِينَا وَالْحَدِيثُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ شَدِيدٌ.
‘‘আমরা সাহাবী যাইদ ইবনু আরকাম (৬৮ হি) কে বললাম, আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস বর্ণনা করুন। তিনি বলেন: আমরা বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছি এবং বিস্মৃতি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে হাদীস বলা খুবই কঠিন দায়িত্ব।’’[13]
সাহাবী সুহাইব ইবনু সিনান (রা) বলতেন:
هَلُمُّوْا أُحَدِّثْكُمْ مِنْ مَغَازِيْنَا، فَأَمَّا أَنْ أَقُوْلَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ، فَلاَ
‘‘তোমরা এস, আমি তোমাদেরকে আমাদের যুদ্ধ বিগ্রহের কাহিনী বর্ণনা করব। তবে কোনো অবস্থাতেই আমি ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন’ একথা বলব না।’’[14]
তাবিয়ী হাশিম হুরমুযী বলেন, আনাস ইবনু মালিক (রা) বলতেন:
لَوْلا أَنْ أَخْشَى أَنْ أُخْطِئَ لَحَدَّثْتُكُمْ بِأَشْيَاءَ سَمِعْتُهَا مِنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ، لَكِنَّهُ قَالَ مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ.
‘‘আমার ভয় হয় যে, আমি অনিচ্ছাকৃত ভুল করে ফেলব। এ ভয় না থাকলে আমি অনেক কিছু তোমাদেরকে বলতাম যা আমি তাঁকে বলতে শুনেছি। কিন্তু তিনি বলেছেন: যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার নামে মিথ্যা বলবে তাকে জাহান্নামে বসবাস করতেই হবে।’’[15]
তাবিয়ী আব্দুর রাহমান ইবনু কা’ব ইবনু মালিক (৯৮ হি) বলেন: আমি আবু কাতাদাহ (রা) কে বললাম রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মুখ থেকে যা শুনেছেন সেসব হাদীস থেকে কিছু আমাকে বলুন। তিনি বলেন:
إني أَخْشَى أَنْ يَزِلَّ لِسَانِي بِشَيْءٍ لَمْ يَقُلْهُ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ، إِنِّيْ سَمِعْتُهُ يَقُوْلُ: إِيَّاكُمْ وَكَثْرَةَ الْحَدِيْثِ عَنِّي، مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ.
‘‘আমার ভয় হয় যে, আমার জিহবা পিছলে এমন কিছু বলবে যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন নি। আর আমি তাঁকে বলতে শুনেছি, সাবধান, তোমরা আমার নামে বেশি হাদীস বলা পরিহার করবে। যে ব্যক্তি আমার নামে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলবে তাকে অবশ্যই জাহান্নামে বসবাস করতে হবে।’’[16]
এভাবে সাহাবীগণ অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকতেন। এখানে লক্ষণীয় যে, আনাস ইবনু মালিক ও আবু কাতাদাহ দুজনেই বলছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর নামে মিথ্যা বলার শাস্তি বর্ণনা করেছেন।’ কিন্তু তাঁরা অনিচ্ছাকৃত ভুলের ভয়ে হাদীস বর্ণনা পরিহার করছেন। কারণ ভুল হতে পারে জেনেও সাবধান না হওয়ার অর্থ ‘ইচ্ছাকৃতভাবে অনিচ্ছাকৃত ভুলের সুযোগ দেয়া।’ অনিচ্ছাকৃত ভুল থেকে সর্বাত্মক সতর্ক না হওয়ার অর্থ ইচ্ছাকৃত বিকৃতিকে প্রশ্রয় দেয়া। কাজেই যে ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃত ভুল থেকে সতর্ক না হওয়ার কারণে ভুল করল, সে ইচ্ছাকৃতভাবেই রাসূলুল্লাহর (ﷺ) নামে মিথ্যা বলল। কোনো মুমিন রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর হাদীসের বিষয়ে অসতর্ক হতে পারেন না।
[2] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/১৯৩।
[3] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১১।
[4] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪৫।
[5] আহমাদ, আল-মুসনাদ ২/৮৮; মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ (২৬১ হি) কিতাবুত তাময়ীয, পৃ: ১৭৩-১৭৪; আস-সহীহ ৪/২১৪৬।
[6] ইবনু হাযম, আলী ইবনু আহমাদ (৪৫৬ হি), আসমাউস সাহাবাহ আর-রুওয়াত
[7] ইবনু আদী, আল-কামিল ফী দুআফাইর রিজাল ১/৯৩।
[8] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১২; আলবানী, সহীহ সুনানি ইবনি মাজাহ ১/২৮।
[9] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১১, আলবানী, সহীহ সুনানি ইবনি মাজাহ ১/২৬।
[10] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৫২; ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১৩/২৪৩।
[11] বুখারী, আস-সহীহ ১/৫২; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১৪; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১/২০০।
[12] ইবনু হাযাম, আসমাউস সাহাবাহ আর-রুওয়াত, পৃ: ৯৫।
[13] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/১১।
[14] বালাযুরী আহমাদ ইবনু ইয়াহইয়া (২৭৯ হি), আনসাবুল আশরাফ ১/১৮৩।
[15] আহমাদ, আল-মুসনাদ ৩/১৭২।
[16] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/১৯৫।
এভাবে আমরা দেখছি যে, সাহাবীগণ নিজেরা হাদীস বর্ণনার সময় আক্ষরিকভাবে নির্ভুল বলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন এবং কোনো প্রকারের দ্বিধা বা সন্দেহ হলে হাদীস বলতেন না। হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষায় তাঁদের দ্বিতীয় কর্মধারা ছিল অন্যের বর্ণিত হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রেও অনুরূপ সতর্কতা অবলম্বন করা। অন্য কোনো সাহাবী বা তাঁদের সমকালীন তাবিয়ীর বর্ণিত হাদীসের আক্ষরিক নির্ভুলতা বা যথার্থতা (Accuracy) সম্বন্ধে সামান্যতম সন্দেহ হলে তাঁরা তা যাচাই না করে গ্রহণ করতেন না।
অর্থাৎ তাঁরা নিজে হাদীস বলার সময় যেমন ‘অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা’ থেকে আত্মরক্ষার সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন, তদ্রূপভাবে অন্যের বর্ণিত হাদীস সঠিক বলে গণ্য করার পূর্বে তাতে কোনো মিথ্যা বা ভুল আছে কিনা তা যাচাই করতেন। এ সুক্ষ্ম যাচাই ও নিরীক্ষাকে তাঁরা হাদীসের বিশুদ্ধতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য আল্লাহ ও তাঁর মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশিত অন্যতম দায়িত্ব বলে মনে করতেন। এজন্য এতে কেউ কখনো আপত্তি করেন নি বা অসম্মানবোধ করেন নি।
পূর্বের আলোচনা থেকে আমরা জেনেছি যে, মিথ্যা ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত উভয় প্রকারের হতে পারে। উভয় ধরনের মিথ্যা বা ভুল থেকে হাদীসকে রক্ষার জন্য সাহাবায়ে কেরাম কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
তাঁদের যুগে কোনো সাহাবী মিথ্যা বলতেন না এবং নির্ভুলভাবে হাদীস বলার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি করতেন না। তবুও তাঁরা হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীর কোনো ভুল হতে পারে সন্দেহ হলেই তাঁর বর্ণনাকে তুলনামূলক নিরীক্ষার (معارضة ومقابلة وموازنة) মাধ্যমে যাচাই করে তা গ্রহণ করতেন। তুলনামূলক নিরীক্ষার প্রক্রিয়া ছিল বিভিন্ন ধরনের:
১. বর্ণিত হাদীস অর্থাৎ বাণী, নির্দেশ বা বর্ণনাকে মূল নির্দেশদাতার নিকট পেশ করে তার যথার্থতা ও নির্ভুলতা (Accuracy) নির্ণয় করা।
২. বর্ণিত বাণী, নির্দেশ বা বর্ণনা (হাদীস)-কে অন্য কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তির বর্ণনার সাথে মিলিয়ে এর যথার্থতা ও নির্ভুলতা নির্ণয় করা।
৩. বর্ণিত বাণী, নির্দেশ বা বর্ণনা (হাদীস)-কে বর্ণনাকারীর বিভিন্ন সময়ের বর্ণনার সাথে মিলিয়ে এর যথার্থতা ও নির্ভুলতা নির্ণয় করা।
৪. বর্ণিত হাদীসটির বিষয়ে বর্ণনাকারীকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে বা শপথ করিয়ে বর্ণনাটির যথার্থতা বা নির্ভুলতা নির্ধারণ করা।
৫. বর্ণিত বাণী, নির্দেশ বা হাদীসটির অর্থ কুরআন ও হাদীসের প্রসিদ্ধ অর্থ ও নির্দেশের সাথে মিলিয়ে দেখা।
এ সকল নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা হাদীস বর্ণনাকারী হাদীসটি সঠিকভাবে মুখস্থ রাখতে ও বর্ণনা করতে পেরেছে কিনা তা যাচাই করতেন। হাদীসের পরিভাষায় একে ‘ضبط’ বিচার বলা হয়। বাংলায় আমরা (ضبط) অর্থ ‘বর্ণনার নির্ভুলতা’ বা ‘নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা’ বলতে পারি।
সাহাবীগণের যুগ থেকে পরবর্তী সকল যুগে হাদীসের ‘বর্ণনার নির্ভুলতা’ ও বিশুদ্ধতা নির্ধারণে এ সকল পদ্ধতিতে নিরীক্ষাই ছিল মুহাদ্দিসগণের মূল পদ্ধতি। আমরা জানি যে, বিশ্বের সকল দেশের সকল বিচারালয়ে প্রদত্ত সাক্ষ্যের যর্থার্থতা ও নির্ভুলতা নির্ণয়ের জন্যও এ পদ্ধতিই অনুসরণ করা হয়। কোনো বর্ণনা বা সাক্ষ্যের বিশুদ্ধতা ও নির্ভুলতা নির্ণয়ের জন্য এটিই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। আমরা এখানে সাহাবীগণের যুগের কিছু উদাহরণ আলোচনা করব।
কোনো সাক্ষ্য বা বর্ণনার সত্যাসত্য যাচাইয়ের সর্বোত্তম উপায় বক্তব্যদাতার কাছে প্রশ্ন করা। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জীবদ্দশায় কোনো সাহাবী অন্য কোনো সাহাবীর বর্ণিত হাদীসের নির্ভুলতার বিষয়ে সন্দীহান হলে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে প্রশ্ন করে নির্ভুলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়ক অনেক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
১. জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা) বিদায় হজ্জের বর্ণনার মধ্যে বলেন:
وَقَدِمَ عَلِيٌّ مِنَ الْيَمَنِ ... فَوَجَدَ فَاطِمَةَ مِمَّنْ حَلَّ وَلَبِسَتْ ثِيَابًا صَبِيغًا وَاكْتَحَلَتْ فَأَنْكَرَ ذَلِكَ عَلَيْهَا فَقَالَتْ إِنَّ أَبِي أَمَرَنِي بِهَذَا قَالَ فَكَانَ عَلِيٌّ يَقُولُ بِالْعِرَاقِ فَذَهَبْتُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ ﷺ مُحَرِّشًا عَلَى فَاطِمَةَ لِلَّذِي صَنَعَتْ مُسْتَفْتِيًا لِرَسُولِ اللَّهِ ﷺ فِيمَا ذَكَرَتْ عَنْهُ فَأَخْبَرْتُهُ أَنِّي أَنْكَرْتُ ذَلِكَ عَلَيْهَا فَقَالَ صَدَقَتْ صَدَقَتْ".
(বিদায় হজ্জের পূর্বে রাসূলুল্লাহ ﷺ আলী (রা) কে ইয়ামানের প্রশাসক রূপে প্রেরণ করেন। ফলে) আলী (রা) ইয়ামান থেকে মক্কায় হজ্জে আগমন করেন। তিনি মক্কায় এসে দেখেন যে, ফাতিমা (রা) উমরা পালন করে ‘হালাল’ হয়ে গিয়েছেন। তিনি রঙিন সুগন্ধময় কাপড় পরিধান করেছেন এবং সুরমা ব্যবহার করেছেন। আলী এতে আপত্তি করলে তিনি বলেন: আমার আববা আমাকে এভাবে করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আলী বলেন: আমি ফাতিমার বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে অভিযোগ করলাম, সে যে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নির্দেশের কথা বলেছে তাও বললাম এবং আমার আপত্তির কথাও বললাম। ... তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: ‘‘সে ঠিকই বলেছে, সে সত্যই বলেছে।’’[1]
এখানে আমরা দেখতে পাই যে, আলী (রা) ফাতেমার (রা) বর্ণনার যথার্থতার বিষয়ে সন্দীহান হন। তিনি তাঁর সত্যবাদীতায় সন্দেহ করেন নি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বক্তব্য সঠিকভাবে বুঝা ও বর্ণনা করার বিষয়ে তাঁর সন্দেহ হয়। অর্থাৎ তিনি ‘অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার’ বিষয়ে সন্দীহান হন। এজন্য তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রশ্ন করে নির্ভুলতা যাচাই করেন।
২. উবাই ইবনু কা’ব বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ قَرَأَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ تَبَارَكَ وَهُوَ قَائِمٌ فَذَكَّرَنَا بِأَيَّامِ اللَّهِ وَأَبُو الدَّرْدَاءِ أَوْ أَبُو ذَرٍّ يَغْمِزُنِي، فَقَالَ: مَتَى أُنْزِلَتْ هَذِهِ السُّورَةُ؟ إِنِّي لَمْ أَسْمَعْهَا إِلا الآنَ. فَأَشَارَ إِلَيْهِ أَنِ اسْكُتْ. فَلَمَّا انْصَرَفُوا قَالَ: سَأَلْتُكَ مَتَى أُنْزِلَتْ هَذِهِ السُّورَةُ فَلَمْ تُخْبِرْنِي؟ فَقَالَ أُبَيٌّ: لَيْسَ لَكَ مِنْ صَلاتِكَ الْيَوْمَ إِلا مَا لَغَوْتَ. فَذَهَبَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ ﷺ فَذَكَرَ ذَلِكَ لَهُ وَأَخْبَرَهُ بِالَّذِي قَالَ أُبَيٌّ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: "صَدَقَ أُبَيٌّ".
একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ জুমু‘আর দিনে খুতবায় দাঁড়িয়ে সূরা তাবারাকা (সূরা ২৫- আল-ফুরকান) পাঠ করেন এবং আমাদেরকে আল্লাহর নেয়ামত ও শান্তি সম্পর্কে ওয়ায করেন। এমতাবস্থায় আবু দারদা বা আবু যার আমার দেহে মৃদু চাপ দিয়ে বলেন: এ সূরা কবে নাযিল হলো, আমি তো এখনই প্রথম সূরাটি শুনছি। তখন উবাই তাঁকে ইশারায় চুপ করতে বলেন। সালাত শেষ হলে তিনি (আবু যার বা আবু দারদা) বলেন: আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, সূরাটি কখন নাযিল হয়েছে, অথচ আপনি আমাকে কিছুই বললেন না! তখন উবাই বলেন: আপনি আজ আপনার সালাতের কোনোই সাওয়াব লাভ করেন নি, শুধুমাত্র যে কথাটুকু বলেছেন সেটুকুই আপনার (কারণ খুতবার সময়ে কথা বললে সালাতের সাওয়াব নষ্ট হয়)। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে যেয়ে বিষয়টি বলেন: তিনি বলেন: ‘‘উবাই সত্য কথাই বলেছে।’’[2]
৩. আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রা) বলেন:
حُدِّثْتُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ قَالَ صَلاةُ الرَّجُلِ قَاعِدًا نِصْفُ الصَّلاةِ قَالَ فَأَتَيْتُهُ فَوَجَدْتُهُ يُصَلِّي جَالِسًا فَوَضَعْتُ يَدِي عَلَى رَأْسِهِ فَقَالَ مَا لَكَ يَا عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرٍو قُلْتُ حُدِّثْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَنَّكَ قُلْتَ صَلاةُ الرَّجُلِ قَاعِدًا عَلَى نِصْفِ الصَّلاةِ وَأَنْتَ تُصَلِّي قَاعِدًا قَالَ أَجَلْ وَلَكِنِّي لَسْتُ كَأَحَدٍ مِنْكُمْ
‘‘আমাকে বলা হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: কোনো ব্যক্তি বসে সালাত আদায় করলে তা অর্ধেক সালাত হবে। তখন আমি তাঁর কাছে গমন করলাম। আমি দেখলাম যে, তিনি বসে সালাত আদায় করছেন। তখন আমি তাঁর মাথার উপর আমার হাত রাখলাম। তিনি বললেন: হে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর, তোমার বিষয় কি? আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে বলা হয়েছে যে, আপনি বলেছেন, কোনো ব্যক্তি বসে সালাত আদায় করলে তা অর্ধ-সালাত হবে, আর আপনি বসে সালাত আদায় করছেন। তিনি বললেন: হ্যাঁ, (আমি তা বলেছি), তবে আমি তোমাদের মত নই।’’[3]
এভাবে অনেক ঘটনা আমরা হাদীসে দেখতে পাই যে, কারো বর্ণিত হাদীসের যথার্থতা বা নির্ভুলতার বিষয়ে সন্দেহ হলে সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রশ্ন করে যথার্থতা যাচাই করতেন। তাঁরা বর্ণনাকারীর সততার বিষয়ে প্রশ্ন তুলতেন না। মূলত তিনি বক্তব্য সঠিকভাবে বুঝেছেন কিনা এবং নির্ভুলভাবে বর্ণনা করেছেন কিনা তা তাঁরা যাচাই করতেন। এভাবে তাঁরা হাদীসের নামে ‘অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা’ বা ভুলক্রমে বিকৃতি প্রতিরোধ করতেন।
[2] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৩৫২-৩৫৩; বুসীরী, আহমাদ ইবনু আবী বাকর (৮৪০হি), যাওয়াইদ ইবনি মাজাহ, পৃ: ১৭৩; আলবানী, সহীহু সুনানি ইবনি মাজাহ ১/৩২৯।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫০৭।
সাক্ষ্য বা বক্তব্যের যথার্থতা নির্ণয়ের জন্য দ্বিতীয় পদ্ধতি বক্তব্যটি অন্য কেউ শুনেছেন কিনা এবং কিভাবে শুনেছেন তা খোঁজ করা। যে কোনো সাক্ষ্য বা বক্তব্যের নির্ভুলতা নির্ণয়ের জন্য তা সর্বজনীন পদ্ধতি। সকল বিচারালয়ে বিচারপতিগণ একাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্যের তুলনামূলক নিরীক্ষার মাধ্যমেই রায় প্রদান করেন। একাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্যের মিল বিষয়টির সত্যতা প্রমাণিত করে এবং অমিল প্রামাণ্যতা নষ্ট করে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পরে সাহাবীগণ এ পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। কোনো সাহাবীর বর্ণিত কোনো হাদীসের যথার্থতা বা নির্ভুলতা বিষয়ে তাঁদের কারো দ্বিধা হলে তাঁরা অন্যান্য সাহাবীকে প্রশ্ন করতেন বা বর্ণনাকারীকে সাক্ষী আনতে বলতেন। যখন এক বা একাধিক ব্যক্তি বলতেন যে, তাঁরাও সে হাদীসটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মুখ থেকে শুনেছেন, তখন তাঁরা হাদীসটি গ্রহণ করতেন। আবু বাকর সিদ্দীক (রা) এ পদ্ধতির শুরু করেন। পরবর্তী খলীফাগণ ও সকল যুগের মুহাদ্দিসগণ তা অনুসরণ করেন। এখানে সাহাবীগণের যুগের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
১. সাহাবী কাবীসাহ ইবনু যুআইব (৮৪ হি) বলেন:
جَاءَتِ الْجَدَّةُ إِلَى أَبِي بَكْرٍ الصِّدِّيقِ تَسْأَلُهُ مِيرَاثَهَا فَقَالَ لَهَا أَبُو بَكْرٍ مَا لَكِ فِي كِتَابِ اللَّهِ شَيْءٌ وَمَا عَلِمْتُ لَكِ فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ شَيْئًا فَارْجِعِي حَتَّى أَسْأَلَ النَّاسَ، فَسَأَلَ النَّاسَ فَقَالَ الْمُغِيرَةُ بْنُ شُعْبَةَ: حَضَرْتُ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ أَعْطَاهَا السُّدُسَ. فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ: هَلْ مَعَكَ غَيْرُكَ؟ فَقَامَ مُحَمَّدُ بْنُ مَسْلَمَةَ الأَنْصَارِيُّ فَقَالَ مِثْلَ مَا قَالَ الْمُغِيرَةُ، فَأَنْفَذَهُ لَهَا أَبُو بَكْرٍ الصِّدِّيقُ.
‘‘এক দাদী আবু বাকর (রা) এর কাছে এসে মৃত পৌত্রের সম্পত্তিতে তার উত্তরাধিকার দাবী করেন। আবু বাকর (রা) তাকে বলেন: আল্লাহর কিতাবে আপনার জন্য (দাদীর উত্তরাধিকার বিষয়ে) কিছুই নেই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাতেও আমি আপনার জন্য কিছু আছে বলে জানি না। আপনি পরে আসবেন, যেন আমি এ বিষয়ে অন্যান্য মানুষকে প্রশ্ন করে জানতে পারি। তিনি এ বিষয়ে মানুষদের প্রশ্ন করেন। তখন সাহাবী মুগীরাহ ইবনু শু’বা (রা) বলেন: আমার উপস্থিতিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দাদীকে (পরিত্যক্ত সম্পত্তির) এক-ষষ্ঠাংশ প্রদান করেন। তখন আবু বাকর (রা) বলেন: আপনার সাথে কি অন্য কেউ আছেন? তখন অন্য সাহাবী মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ আনসারী (রা) উঠে দাঁড়ান এবং মুগীরার অনুরূপ কথা বলেন। তখন আবু বাকর সিদ্দীক (রা) দাদীর জন্য ১/৬ অংশ প্রদানের নির্দেশ প্রদান করেন।’’[1]
এখানে আমরা দেখছি যে, আবু বাকর সিদ্দীক (রা) হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা শিক্ষা দিলেন। মুগীরাহ ইবনু শু’বার একার বর্ণনার উপরেই তিনি নির্ভর করতে পারতেন। কারণ তিনি প্রসিদ্ধ সাহাবী এবং কুরাইশ বংশের অত্যন্ত সম্মানিত নেতা ছিলেন। সমাজের যে কোনো পর্যায়ে তাঁর একার সাক্ষ্যই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু তা সত্ত্বেও আবু বাকর (রা) সাবধানতা অবলম্বন করলেন। মুগীরাহর (রা) বিশ্বস্ততা প্রশ্নাতীত হলেও তাঁর স্মৃতি বিশ্বাসভঙ্গ করতে পারে বা তাঁর অনুধাবনে ভুল হতে পারে। এজন্য তিনি দ্বিতীয় আর কেউ হাদীসটি জানেন কিনা তা প্রশ্ন করেন। দু’জনের বিবরণের উপর নির্ভর করে তিনি হাদীসটি গ্রহণ করেন।
এজন্য মুহাদ্দিসগণ আবু বাকর (রা)-কে হাদীস সমালোচনার জনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লামা হাকিম নাইসাপূরী (৪০৫ হি) বলেন:
أَوَّلُ مَنَ وَقَىَ الْكَذِبَ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ.
‘‘তিনিই (আবূ বকর সিদ্দীকই) সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে মিথ্যা হাদীস বর্ণনা প্রতিরোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।’’[2]
আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু তাহির ইবনুল কাইসুরানী (৫০৭ হি) সিদ্দীকে আকবারের জীবনী আলোচনা কালে বলেন:
وَهُوَ أَوَّلُ مَنِ احْتَاطَ فِيْ قَبُوْلِ الأَخْبَارِ.
‘‘তিনিই সর্বপ্রথম হাদীস গ্রহণ করার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করেন।’’[3]
২. দ্বিতীয় খলীফ উমার (রা) এ বিষয়ে সিদ্দীকে আকবারের অনুসরণ করেছেন। বিভিন্ন ঘটনায় তিনি সাহাবীগণকে বর্ণিত হাদীসের জন্য দ্বিতীয় কোনো সাহাবীকে সাক্ষী হিসাবে আনয়ন করতে বলতেন। এ জাতীয় কতিপয় ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি। আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন:
كُنْتُ فِي مَجْلِسٍ مِنْ مَجَالِسِ الأَنْصَارِ إِذْ جَاءَ أَبُو مُوسَى كَأَنَّهُ مَذْعُورٌ فَقَالَ اسْتَأْذَنْتُ عَلَى عُمَرَ ثَلاثًا فَلَمْ يُؤْذَنْ لِي فَرَجَعْتُ، فَقَالَ مَا مَنَعَكَ؟ قُلْتُ: اسْتَأْذَنْتُ ثَلاثًا فَلَمْ يُؤْذَنْ لِي فَرَجَعْتُ وَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: "إِذَا اسْتَأْذَنَ أَحَدُكُمْ ثَلاثًا فَلَمْ يُؤْذَنْ لَهُ فَلْيَرْجِعْ". فَقَالَ: "وَاللَّهِ لَتُقِيمَنَّ عَلَيْهِ بِبَيِّنَةٍ"! أَمِنْكُمْ أَحَدٌ سَمِعَهُ مِنَ النَّبِيِّ ﷺ؟ فَقَالَ أُبَيُّ بْنُ كَعْبٍ: وَاللَّهِ لا يَقُومُ مَعَكَ إِلا أَصْغَرُ الْقَوْم،ِ فَكُنْتُ أَصْغَرَ الْقَوْمِ فَقُمْتُ مَعَهُ فَأَخْبَرْتُ عُمَرَ أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ قَالَ ذَلِكَ
‘‘আমি আনসারদের এক মাজলিসে বসে ছিলাম। এমতাবস্থায় আবু মূসা আশআরী (রা) সেখানে আগমন করেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি অস্থির বা উৎকণ্ঠিত। তিনি বলেন: আমি উমার (রা) এর ঘরে প্রবেশের জন্য তিনবার অনুমতি প্রার্থনা করি। অনুমতি না দেয়ায় আমি ফিরে আসছিলাম। উমার (রা) আমাকে ডেকে বলেন: আপনার ফিরে যাওয়ার কারণ কি? আমি বললাম: আমি তিনবার অনুমতি প্রাথনা করি, কিন্তু অনুমতি জানানো হয় নি। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: ‘‘যদি তোমরা তিনবার অনুমতি প্রার্থনা কর এবং অনুমতি না দেয়া হয় তাহলে তোমরা ফিরে যাবে।’’ তখন উমার (রা) বলেন: আল্লাহর শপথ, এই বর্ণনার উপর আপনাকে অবশ্যই সাক্ষ্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। (আবু মুসা বলেন): আপনাদের মধ্যে কেউ কি এ হাদীসটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে থেকে শুনেছেন? তখন উবাই ইবনু কা’ব (রা) বলেন: আমাদের মধ্যে যার বয়স সবচেয়ে কম সে আপনার সাথে যাবে। (আবু সাঈদ খুদরী বলেন) আমি উপস্থিতদের মধ্যে সবচেয়ে কমবয়স্ক ছিলাম। আমি আবু মুসার (রা) সাথে যেয়ে উমারকে (রা) বললাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা বলেছেন।’’[4]
৩. তাবিয়ী উরওয়া ইবনুয যুবাইর (৯৪ হি) বলেন:
إنَّ عُمَرَ نَشَدَ النَّاسَ مَنْ سَمِعَ النَّبِيَّ ﷺ قَضَى فِي السِّقْطِ؟ فَقَالَ الْمُغِيرَةُ: أَنَا سَمِعْتُهُ قَضَى فِيهِ بِغُرَّةٍ عَبْدٍ أَوْ أَمَةٍ. قَالَ: ائْتِ مَنْ يَشْهَدُ مَعَكَ عَلَى هَذَا. فَقَالَ مُحَمَّدُ بْنُ مَسْلَمَةَ: أَنَا أَشْهَدُ عَلَى النَّبِيِّ ﷺ بِمِثْلِ هَذَا.
‘‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) মানুষদের কাছে জানতে চান, আঘাতের ফলে গর্ভস্থ সন্তানের মৃত্যু হলে তার দিয়াত বা ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কী বিধান দিয়েছেন তা কেউ জানে কিনা? তখন মুগীরাহ ইবনু শু’বা (রা) বলেন: আমি তাঁকে এ বিষয়ে একজন দাস বা দাসী প্রদানের বিধান প্রদান করতে শুনেছি। উমার (রা) বলেন: আপনার সাথে এ বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য কাউকে আনয়ন করুন। তখন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ বলেন: আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অনুরূপ বিধান দিয়েছেন।’’[5]
৪. সাহাবী আম্র ইবনু উমাইয়াহ আদ-দামরী (রা) বলেন:
إِنَّ عُمَرَ مَرَّ عَلَيْهِ وَهُوَ يُسَاوِمُ بِمِرْطٍ فَقَالَ: مَا هَذَا؟ قَالَ: أُرِيدُ أَنْ أَشْتَرِيَهُ وَأَتَصَدَّقَ بِهِ. فَاشْتَرَاهُ فَدَفَعَهُ إِلَى أَهْلِهِ وَقَالَ: إِنِّى سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ يَقُولُ: ্রمَا أَعْطَيْتُمُوهُنَّ فَهُوَ صَدَقَةٌ فَقَالَ عُمَرُ : مَنْ يَشْهَدُ مَعَكَ فَأَتَى عَائِشَةَ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهَا فَقَامَ مِنْ وَرَاءِ الْبَابِ فَقَالَتْ: مَنْ هَذَا؟ قَالَ عَمْرٌو. قَالَت: مَا جَاءَ بِكَ؟ قَالَ سَمِعْتِ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ يَقُولُ: ্রمَا أَعْطَيْتُمُوهُنَّ فَهُوَ صَدَقَةٌগ্ধ. قَالَتْ: نَعَمْ.
‘‘তিনি একটি চাদর ক্রয়ের জন্য তা দাম করছিলেন। এমতাবস্থায় উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) তাঁর কাছে দিয়ে যাচ্ছিলেন। উমার বলেন: এটি কি? তিনি বলেন: আমি এ চাদরটি ক্রয় করে দান করতে চাই। এরপর তিনি তা ক্রয় করে তাঁর স্ত্রীকে প্রদান করেন এবং বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি: ‘তোমরা স্ত্রীগণকে যা প্রদান করবে তাও দান বলে গণ্য হবে।’ তখন উমার বলেন: আপনার সাথে সাক্ষী কে আছে? তখন তিনি আয়েশা (রা) এর কাছে গমন করেন এবং দরজার বাইরে দাঁড়ান। আয়েশা (রা) বলেন? কে? তিনি বলেন: আমি আম্র। আয়েশা বলেন: কি জন্য আপনি এসেছেন? তিনি বলেন: আপনি কি শুনেছেন যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: তোমরা স্ত্রীগণকে যা প্রদান করবে তা দান? আয়েশা বলেন: হ্যাঁ।’’[6]
৫. ওয়ালীদ ইবনু আব্দুর রাহমান আল-জুরাশী নামক তাবিয়ী বলেন:
إن عبد الله بن عمر مَرَّ بِأَبِي هُرَيْرَةَ وَهُوَ يُحَدِّثُ عَنِ النَّبِيِّ ﷺ أَنَّهُ قَالَ مَنْ تَبِعَ جَنَازَةً فَصَلَّى عَلَيْهَا فَلَهُ قِيرَاطٌ فَإِنْ شَهِدَ دَفْنَهَا فَلَهُ قِيرَاطَانِ الْقِيرَاطُ أَعْظَمُ مِنْ أُحُدٍ. فَقَالَ لَهُ ابْنُ عُمَرَ: أَبَا هُرَيْرَةَ انْظُرْ مَا تُحَدِّثُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ، فَقَامَ إِلَيْهِ أَبُو هُرَيْرَةَ حَتَّى انْطَلَقَ بِهِ إِلَى عَائِشَةَ فَقَالَ لَهَا يَا أُمَّ الْمُؤْمِنِينَ أَنْشُدُكِ بِاللَّهِ أَسَمِعْتِ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ يَقُولُ مَنْ تَبِعَ جَنَازَةً فَصَلَّى عَلَيْهَا فَلَهُ قِيرَاطٌ فَإِنْ شَهِدَ دَفْنَهَا فَلَهُ قِيرَاطَانِ فَقَالَتِ: اللَّهُمَّ نَعَمْ.
‘‘আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) আবু হুরাইরা (রা) এর কাছে দিয়ে গমন করছিলেন। সে সময় আবু হুরাইরা (রা) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে হাদীস বর্ণনা করছিলেন। হাদীস বর্ণনার মধ্যে তিনি বলেন: ‘কেউ যদি কারো জানাযার অনুগমন করে ও সালাতে অংশ গ্রহণ করে তবে সে এক ‘কীরাত’ সাওয়াব অর্জন করবে। আর যদি সে তার দাফনে (কবরস্থ করায়) উপস্থিত থাকে তাহলে সে দুই কীরাত সাওয়াব অর্জন করবে। এক কীরাত উহদ পাহাড়ের চেয়েও বড়।’ তখন আব্দুল্লাহ ইবনু উমার বলেন: আবু হুরাইরা, আপনি ভেবে দেখুন তো আপনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে কি বলছেন! তখন আবু হুরাইরা (রা) তাকে সাথে নিয়ে আয়েশা (রা)-এর কাছে গমন করেন এবং তাঁকে বলেন: হে উম্মুল মুমিনীন, আমি আপনাকে আল্লাহর নামে কসম করে জিজ্ঞাসা করছি, আপনি কি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছেন যে, ‘কেউ যদি কারো জানাযার অনুগমন করে ও সালাতে অংশ গ্রহণ করে তবে সে এক ‘কীরাত’ সাওয়াব অর্জন করবে। আর যদি সে তার দাফনে উপস্থিত থাকে তাহলে সে দুই কীরাত সাওয়াব অর্জন করবে।’ তিনি বলেন: হ্যাঁ, অবশ্যই শুনেছি।’’[7]
[2] মুহাম্মাদ মুস্তাফা আল-আযামী, মানহাজুন নাকদ ইনদাল মুহাদ্দিসীন, পৃ: ১০।
[3] মুহাম্মাদ ইবনু তাহির ইবনুল কাইসুরানী (৫০৭হি), তাযকিরাতুল হুফফায ১/২।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ৫/২৩০৫; ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১১/২৬-২৭; মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৬৯৪।
[5] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৫৩১; ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১২/২৪৭, মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৩১১।
[6] বাইহাকী, আহমাদ ইবনুল হুসাইন (৪৫৮হি.), আস-সুনানুল কুবরা ৪/১৭৮; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৩২৪-৩২৫।
[7] আহমাদ, আল-মুসনাদ ২/২, আহমাদ শাকির, মুসনাদু আহমাদ ৬/২১৩, নং ৪৪৫৩; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৩/৫৮৪।
কোনো সাক্ষ্য বা বক্তব্যের নির্ভুলতা নির্ণয়ের জন্য অন্য একটি পদ্ধতি হলো তাকে একই বিষয়ে একাধিক সময়ে প্রশ্ন করা। যদি দ্বিতীয় বারের উত্তর প্রথম বারের উত্তরের সাথে হুবহু মিলে যায় তবে তার নির্ভুলতা প্রমাণিত হয়। আর উভয়ের বৈপরীত্য অগ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে। সাহাবীগণ হাদীসের নির্ভুলতা নির্ণয়ে এ পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। একটি উদাহরণ দেখুন।
তাবিয়ী উরওয়া ইবনু যুবাইর বলেন:
قَالَتْ لِي عَائِشَةُ: يَا ابْنَ أُخْتِي، بَلَغَنِي أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرٍو مَارٌّ بِنَا إِلَى الْحَجِّ فَالْقَهُ فَسَائِلْهُ فَإِنَّهُ قَدْ حَمَلَ عَنِ النَّبِيِّ ﷺ عِلْمًا كَثِيرًا. قَالَ: فَلَقِيتُهُ فَسَاءَلْتُهُ عَنْ أَشْيَاءَ يَذْكُرُهَا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ، قَالَ عُرْوَةُ: فَكَانَ فِيمَا ذَكَرَ أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ قَالَ: إِنَّ اللَّهَ لا يَنْتَزِعُ الْعِلْمَ مِنَ النَّاسِ انْتِزَاعًا وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعُلَمَاءَ فَيَرْفَعُ الْعِلْمَ مَعَهُمْ وَيُبْقِي فِي النَّاسِ رُءُوسًا جُهَّالا يُفْتُونَهُمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ فَيَضِلُّونَ وَيُضِلُّونَ. قَالَ عُرْوَةُ: فَلَمَّا حَدَّثْتُ عَائِشَةَ بِذَلِكَ أَعْظَمَتْ ذَلِكَ وَأَنْكَرَتْهُ، قَالَتْ: أَحَدَّثَكَ أَنَّهُ سَمِعَ النَّبِيَّ ﷺ يَقُولُ هَذَا؟! قَالَ عُرْوَةُ: حَتَّى إِذَا كَانَ قَابِلٌ قَالَتْ لَهُ: إِنَّ ابْنَ عَمْرٍو قَدْ قَدِمَ فَالْقَهُ ثُمَّ فَاتِحْهُ حَتَّى تَسْأَلَهُ عَنِ الْحَدِيثِ الَّذِي ذَكَرَهُ لَكَ فِي الْعِلْمِ. قَالَ: فَلَقِيتُهُ فَسَاءَ لْتُهُ فَذَكَرَهُ لِي نَحْوَ مَا حَدَّثَنِي بِهِ فِي مَرَّتِهِ الأُولَى. قَالَ عُرْوَةُ: فَلَمَّا أَخْبَرْتُهَا بِذَلِكَ قَالَتْ: "مَا أَحْسَبُهُ إِلا قَدْ صَدَقَ، أَرَاهُ لَمْ يَزِدْ فِيهِ شَيْئًا وَلَمْ يَنْقُصْ.
‘‘আমার খালাম্মা আয়েশা (রা) আমাকে বলেন: ভাগ্নে,শুনেছি সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আম্র ইবনুল আস (রা) আমাদের এলাকা দিয়ে হজ্জে গমন করবেন। তুমি তাঁর সাথে দেখা কর এবং তার থেকে প্রশ্ন করে শিখ। কারণ তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে অনেক জ্ঞান অর্জন করেছেন। উরওয়া বলেন: আমি তখন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করি এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করি। তিনি সে সব বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। তিনি যে সকল কথা বলেন, তার মধ্যে তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: ‘‘নিশ্চয় আল্লাহ মানুষ থেকে জ্ঞান ছিনিয়ে নিবেন না। কিন্তু তিনি জ্ঞানীদের কব্জা করবেন (মৃত্যুর মাধ্যমে তাদের গ্রহণ করবেন), ফলে তাদের সাথে জ্ঞানও উঠে যাবে। মানুষের মধ্যে মুর্খ নেতৃবৃন্দ অবশিষ্ট থাকবে, যারা ইলম ছাড়াই ফাতওয়া প্রদান করবে এবং এভাবে নিজেরা বিভ্রান্ত হবে এবং অন্যদেরও বিভ্রান্ত করবে।’’ উরওয়া বলেন: আমি যখন আয়েশাকে (রা) একথা বললাম তখন তিনি তা গ্রহণ করতে আপত্তি করলেন। তিনি বলেন: তিনি কি তোমাকে বলেছেন যে, একথা তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে শুনেছেন?
উরওয়া বলেন: পরের বছর আয়েশা (রা) আমাকে বলেন: আব্দুল্লাহ ইবনু আমর আগমন করেছেন। তুমি তাঁর সাথে সাক্ষাত করে তাঁর সাথে কথাবার্তা বল। কথার ফাঁকে ইলম উঠে যাওয়ার হাদীসটির বিষয়েও কথা তুলবে। উরওয়া বলেন: আমি তখন তাঁর সাথে সাক্ষাত করি এবং তাঁকে প্রশ্ন করি। তিনি তখন আগের বার যেভাবে বলেছিলেন সেভাবেই হাদীসটি বললেন। উরওয়া বলেন: আমি যখন আয়েশা (রা) কে বিষয়টি জানালাম তখন তিনি বলেন: আমি বুঝতে পারলাম যে, আব্দুল্লাহ ইবনু আম্র ঠিকই বলেছেন। আমি দেখছি যে, তিনি একটুও বাড়িয়ে বলেন নি বা কমিয়ে বলেন নি।[1]
এখানেও আমরা হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে সাহাবীগণের অকল্পনীয় সাবধানতার নমুনা দেখি। আয়েশা (রা) আব্দুল্লাহ (রা)-এর সত্যবাদিতায় সন্দেহ করেন নি। কিন্তু সত্যবাদী ব্যক্তিরও ভুল হতে পারে। কাজেই বিনা নিরীক্ষায় তাঁরা কিছুই গ্রহণ করতে চাইতেন না। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে কথিত কোনো হাদীস তারা নিরীক্ষার আগেই ভক্তিভরে হৃদয়ে স্থান দিতেন না।
বর্ণনা বা সাক্ষ্যের নির্ভুলতা যাচাইএর জন্য প্রয়োজনে বর্ণনাকারী বা সাক্ষীকে শপথ করানো হয়। সত্যপরায়ণ ও আল্লাহভীরু মানুষ ইচ্ছাপূর্বক মিথ্যা বলেন না। তবে তাঁর স্মৃতি তাকে ধোঁকা দিতে পারে বা অনিচ্ছাকৃত ভুলের মধ্যে তিনি নিপতিত হতে পারেন। কিন্তু আল্লাহর নামে শপথ করতে হলে তিনি কখনো পরিপূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলবেন না। এজন্য সত্যপরায়ণ ব্যক্তির জন্য শপথ করানো বক্তব্যের নির্ভুলতা যাচাইয়ের জন্য কার্যকর পদ্ধতি। তবে মিথ্যাবাদীর জন্য শপথ যথেষ্ট নয়। তার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রশ্ন (cross interrogation)-এর মাধ্যমে তার বক্ত্যব্যের যথার্থতা যাচাই করতে হয়।
সাহাবীগণ সকলেই ছিলেন সত্যপরায়ণ অত্যন্ত আল্লাহভীরু মানুষ। তা সত্ত্বেও অনিচ্ছাকৃত ভুলের সম্ভাবনা দূর করার জন্য সাহাবীগণ কখনো কখনো হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীকে শপথ করাতেন। আলী (রা) বলেন:
إِنِّي كُنْتُ رَجُلا إِذَا سَمِعْتُ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ حَدِيثًا نَفَعَنِي اللَّهُ مِنْهُ بِمَا شَاءَ أَنْ يَنْفَعَنِي بِهِ. وَإِذَا حَدَّثَنِي رَجُلٌ مِنْ أَصْحَابِهِ اسْتَحْلَفْتُهُ فَإِذَا حَلَفَ لِي صَدَّقْتُهُ.
‘‘আমি এমন একজন মানুষ ছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোনো কথা নিজে শুনলে আল্লাহ আমাকে তা থেকে তাঁর মর্জিমত উপকৃত হওয়ার তাওফীক প্রদান করতেন। আর যদি তাঁর কোনো সাহাবী আমাকে কোনো হাদীস শুনাতেন তবে আমি তাকে শপথ করাতাম। তিনি শপথ করলে আমি তার বর্ণিত হাদীস সত্য বলে গ্রহণ করতাম।’’[1]
‘ওহী’র জ্ঞান সাধারণ মানবীয় জ্ঞানের অতিরিক্ত, কিন্তু কখনোই মানবীয় জ্ঞানের বিপরীত বা বিরুদ্ধ নয়। অনুরূপভাবে হাদীসের মাধ্যমে প্রাপ্ত ‘ওহী’ কুরআনের মাধ্যমে প্রাপ্ত ‘ওহী’র ব্যাখ্যা, সম্পূরণ বা অতিরিক্ত সংযোজন হতে পারে, কিন্তু কখনোই তা কুরআনের বিপরীত বা বিরুদ্ধ হতে পারে না।
সাহাবীগণের কর্মপদ্ধতি থেকে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁরা এ সব মূলনীতির ভিত্তিতে বর্ণিত হাদীসের অর্থগত নিরীক্ষা করতেন। আমরা দেখেছি যে, সাধারণভাবে তাঁরা কুরআনের অতিরিক্ত ও সম্পূরক অর্থের জন্যই হাদীসের সন্ধান করতেন। কুরআন কারীমে যে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই তা হাদীসে আছে কিনা তা জানতে চাইতেন। পাশাপাশি তাঁরা প্রদত্ত তথ্যের অর্থগত নিরীক্ষা করতেন। তাঁদের অর্থ নিরীক্ষা পদ্ধতি ছিল নিম্নরূপ:
(১) হাদীসের ক্ষেত্রে প্রথম বিবেচ্য হলো, তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথা বলে প্রমাণিত কিনা। যদি বর্ণনাকারীর বর্ণনা, শপথ বা অন্যান্য সাক্ষ্যের মাধ্যমে নিশ্চিতরূপে প্রমাণিত হয় যে, কথাটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, তবে সেক্ষেত্রে তাঁদের নীতি ছিল তাকে কুরআনের সম্পূরক নির্দেশনা হিসাবে গ্রহণ করা এবং তারই আলোকে কুরআনের ব্যাখ্যা করা। ইতোপূর্বে দাদীর উত্তরাধিকার ও গৃহে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনার বিষয়ে আমরা তা দেখতে পেয়েছি। দাদীর বিষয়ে কুরআনে কিছু বলা হয় নি। এক্ষেত্রে হাদীসের বিবরণটি অতিরিক্ত সংযোজন। অনুমতি প্রার্থনার ক্ষেত্রে কুরআনে বলা হয়েছে যে, অনুমতি চাওয়ার পরে ‘‘যদি তোমাদেরকে বলা হয় যে, ‘তোমরা ফিরে যাও’ তবে তোমরা ফিরে যাবে।’’[1] এক্ষেত্রে হাদীসের নির্দেশনাটি বাহ্যত এ কুরআনী নির্দেশনার ‘বিরুদ্ধ’। কারণ তা কুরআনী নির্দেশনাকে আংশিক পরিবর্তন করে বলছে যে, তিন বার অনুমতি প্রার্থনার পরে ‘তোমরা ফিরে যাও’ বলা না হলেও ফিরে যেতে হবে।
সাহাবীগণ উভয় হাদীসকে কুরআনের ব্যাখ্যা হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা কখনোই চিন্তা করেন নি যে, এগুলো কুরআনের নির্দেশের বিপরীত, বিরুদ্ধ বা অতিরিক্ত কাজেই তা গ্রহণ করা যাবে না।
(২) কোনো কথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন নি বলে প্রমাণিত হলে বা গভীর সন্দেহ হলে, কোনোরূপ অর্থ বিবেচনা না করেই তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। আমরা দেখেছি যে, বর্ণনাকারীর বিশ্বস্ততায় ও নির্ভরযোগ্যতায় সন্দেহ হলে তাঁরা কোনোরূপ অর্থ বিবেচনা ছাড়াই সে বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করতেন।
(৩) কখনো দেখা গিয়েছে যে, বর্ণনাকারীর বিশ্বস্ততার কারণে বর্ণিত হাদীস বাহ্যত গ্রহণযোগ্য। তবে বর্ণনাকারীর অনিচ্ছাকৃত ভুলের জোরালো সম্ভাবনা বিদ্যমান রয়েছে। সেক্ষেত্রে তাঁরা সে হাদীসের অর্থ কুরআন কারীম ও তাঁদের জানা হাদীসের আলোকে পর্যালোচনা করেছেন এবং হাদীসটির অর্থ কুরআন ও প্রসিদ্ধ সুন্নাতের সুস্পষ্ট বিপরীত হলে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এরূপ অর্থ বিচার ও নিরীক্ষার কয়েকটি উদাহরণ দেখুন:
১. আবু হাস্সান আল-আ’রাজ নামক তাবিয়ী বলেন:
إنَّ رَجُلَيْنِ دَخَلا عَلَى عَائِشَةَ فَقَالا: إِنَّ أَبَا هُرَيْرَةَ يُحَدِّثُ أَنَّ نَبِيَّ اللَّهِ ﷺ كَانَ يَقُولُ: إِنَّمَا الطِّيَرَةُ فِي الْمَرْأَةِ وَالدَّابَّةِ وَالدَّارِ. قَالَ: فَطَارَتْ شِقَّةٌ مِنْهَا فِي السَّمَاءِ وَشِقَّةٌ فِي الأَرْضِ!- وفي رواية: فَغَضِبَتْ غَضَبًا شَدِيدًا فَطَارَتْ شُقَّةٌ مِنْهَا فِي السَّمَاءِ وَشُقَّةٌ فِي الأَرْضِ!- فَقَالَتْ: وَالَّذِي أَنْزَلَ الْقُرْآنَ عَلَى أَبِي الْقَاسِمِ ﷺ مَا هَكَذَا كَانَ يَقُولُ، وَلَكِنَّ نَبِيَّ اللَّهِ ﷺ كانَ يَقُولُ: "كَانَ أَهْلُ الْجَاهِلِيَّةِ يَقُولُونَ الطِّيَرَةُ فِي الْمَرْأَةِ وَالدَّارِ وَالدَّابَّةِ"، ثُمَّ قَرَأَتْ عَائِشَةُ: مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الأَرْضِ وَلا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلا فِي كِتَابٍ.
‘‘দুই ব্যক্তি আয়েশা (রা) -এর কাছে গমন করে বলেন: আবু হুরাইরা (রা) বলছেন যে, নাবীউল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: নারী, পশু বা বাহন ও বাড়ি-ঘরের মধ্যে অযাত্রা ও অশুভত্ব আছে। একথা শুনে আয়েশা (রা) এত বেশি রাগন্বিত হন যে, মনে হলো তাঁর দেহ ক্রোধে ছিন্নভিন্ন হয়ে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি বলেন: আবুল কাসিম (ﷺ)-এর উপর যিনি কুরআন নাযিল করেছেন তাঁর কসম, তিনি এভাবে বলতেন না। নাবীউল্লাহ (ﷺ) বলতেন: ‘‘জাহিলিয়্যাতের যুগের মানুষেরা বলত: নারী, বাড়ি ও পশু বা বাহনে অশুভত্ব আছে। এরপর আয়েশা (রা) কুরআন কারীমের আয়াত তিলাওয়াত করেন:[2] ‘‘পৃথিবীতে অথবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদিগের উপর যে বিপর্যয় আসে আমি তা সংঘটিত করবার পূর্বেই তা লিপিবদ্ধ থাকে।’’[3]
এখানে আয়েশা (রা) আবু হুরাইরা (রা) এর বর্ণনা গ্রহণ করেন নি। তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে যা শুনেছেন এবং কুরআনের যে আয়াত পাঠ করেছেন তার আলোকে এ বর্ণনা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
২. আমরাহ বিনতু আব্দুর রাহমান বলেন:
أَنَّهَا سَمِعَتْ عَائِشَةَ وَذُكِرَ لَهَا أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ يَقُولُ: (سمعت رسول الله ﷺ يقول) إِنَّ الْمَيِّتَ لَيُعَذَّبُ بِبُكَاءِ الْحَيِّ فَقَالَتْ عَائِشَةُ: يَغْفِرُ اللَّهُ لأَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ، أَمَا إِنَّهُ لَمْ يَكْذِبْ وَلَكِنَّهُ نَسِيَ أَوْ أَخْطَأَ (وَلَكِنَّ السَّمْعَ يُخْطِئُ) (وَلَكِنَّهُ وَهِمَ)؛ إِنَّمَا مَرَّ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ عَلَى يَهُودِيَّةٍ يُبْكَى عَلَيْهَا فَقَالَ: "إِنَّهُمْ لَيَبْكُونَ عَلَيْهَا وَإِنَّهَا لَتُعَذَّبُ فِي قَبْرِهَا" (لا تزر وازرة وزر أخرى).
আয়েশা (রা)-এর কাছে উল্লেখ করা হয় যে, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রা) রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে বর্ণনা করছেন যে, ‘জীবিতের ক্রন্দনে মৃতব্যক্তি শাস্তি পায়।’ তখন আয়েশা (রা) বলেন: আল্লাহ ইবনু উমারকে ক্ষমা করুন। তিনি মিথ্যা বলেন নি। তবে তিনি বিস্মৃত হয়েছেন বা ভুল করেছেন (দ্বিতীয় বর্ণনায়: শুনতে অনেক সময় ভুল হয়)। প্রকৃত কথা হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ইহুদী মহিলার (কবরের) কাছ দিয়ে গমন করেন, যার জন্য তার পরিজনেরা ক্রন্দন করছিল। তিনি তখন বলেন: ‘এরা তার জন্য ক্রন্দন করছে এবং সে তার কবরে শাস্তি পাচ্ছে।’ আল্লাহ বলেছেন[4]: ‘এক আত্মা অন্য আত্মার পাপের বোঝা বহন করবে না।’’’[5]
৩. ফাতিমা বিনতু কাইস (রা) নামক একজন মহিলা সাহাবী বলেন, তাঁর স্বামী তাঁকে তিন তালাক প্রদান করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন যে, তিনি (সে মহিলা) ইদ্দত-কালীন আবাসন ও ভরণপোষণের খরচ পাবেন না। তাঁর এ কথা শুনে খলীফা উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেন:
لا نَتْرُكُ كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّنَا ﷺ لِقَوْلِ امْرَأَةٍ لا نَدْرِي لَعَلَّهَا حَفِظَتْ أَوْ نَسِيَتْ (لا نَدْرِي أَحَفِظَتْ أَمْ نَسِيَتْ)، لَهَا السُّكْنَى وَالنَّفَقَةُ قَالَ اللَّهُ: لا تُخْرِجُوهُنَّ مِنْ بُيُوتِهِنَّ وَلا يَخْرُجْنَ إِلا أَنْ يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ
‘‘আমরা আল্লাহর গ্রন্থ ও আমাদের নবী (ﷺ)-এর সুন্নাত একজন মহিলার কথায় ছেড়ে দিতে পারি না; আমরা বুঝতে পারছি না যে, তিনি বিষয়টি মুখস্থ রেখেছেন না ভুলে গিয়েছেন। তিন-তালাক প্রাপ্ত মহিলাও ইদ্দত-কালীন আবাসন ও খোরপোশ পাবেন। আল্লাহ বলেছেন[6]: ‘‘তোমরা তাদেরকে তাদের বাসগৃহ থেকে বহিষ্কার করো না এবং তারাও যেন বের না হয়, যদি না তারা লিপ্ত হয় স্পষ্ট অশ্লীলতায়।’’[7]
৪. অর্থগত নিরীক্ষার আরেকটি উদাহরণে আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস যখন তাবিয়ী ইবনু আবী মুলাইকার জন্য ‘আলীর বিচার’ পুস্তিকা থেকে কিছু বিবরণ নির্বাচন করেন, তখন তিনি কিছু কিছু বিচারের বিষয়ে বলেন: ‘‘আল্লাহর কসম, আলী এ বিচার কখনোই করতে পারেন না। বিভ্রান্ত না হলে কেউ এ বিচার করতে পারে না।’’
এখানেও আমরা দেখছি যে, ইবনু আববাস অর্থ বিচার করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, এগুলো আলী (রা)-এর নামে বানোয়াট কথা; কারণ কোনো বিভ্রান্ত মানুষ ছাড়া এরূপ বিচার কেউ করতে পারে না।
[2] সূরা (৫৭) আল-হাদীদ, আয়াত ২২।
[3] আহমাদ, আল-মুসনাদ ৬/১৫০, ২৪৬।
[4] সূরা (৬) আন‘আম: ১৬৪; সূরা (১৭) ইসরা (বানী ইসরাঈল): ১৫; সূরা (৩৫) ফাতির: ১৮; সূরা (৩৯) যুমার: ৭: সূরা (৫৩) নাজম: ৩৮ আয়াত।
[5] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৬৪০-৬৪৩, তিরমিযী, আস-সুনান ৩/৩৩৭।
[6] সূরা (৬৫) তালাক: আয়াত ১।
[7] মুসলিম, আস-সহীহ ২/১১১৮, আবু দাউদ, আস-সুনান ২/২৯৭।
সাহাবীগণের যুগের প্রথম দিকে সাহাবীগণই হাদীস বর্ণনা করতেন। এক সাহাবী অন্য সাহাবীকে অথবা পরবর্তী প্রজন্ম তাবিয়ীগণকে হাদীস শুনাতেন ও শিক্ষা দিতেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ইন্তেকালের ২০/২৫ বছরের মধ্যে একদিকে যেমন অনেক সাহাবী ইন্তেকাল করেন, তেমনি অপরদিকে অনেক তাবিয়ী হাদীস বর্ণনা ও শিক্ষাদান শুরু করেন। আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি যে, এ সময় থেকে কোনো কোনো নও মুসলিম তাবিয়ীর মধ্যে ইচ্ছাকৃত মিথ্যার প্রবণতা দেখা দেয়। তখন সাহাবীগণ হাদীস গ্রহণের বিষয়ে আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে থাকেন।
এক সাহাবী অন্য সাহাবীকে হাদীস বর্ণনা করলে শ্রোতা বা শিক্ষার্থী সাহাবী বর্ণনাকারীর ব্যক্তিগত সততা ও সত্যপরায়ণতায় কোনো সন্দেহ করতেন না বা তিনি নিজ কর্ণে হাদীসটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে শুনেছেন না অন্য কেউ তাকে বলেছেন সে বিষয়েও প্রশ্ন করতেন না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহচর্য প্রাপ্ত সকল মানুষই ছিলেন তাঁরই আলোয় আলোকিত মহান মানুষ এবং সত্যবাদিতায় আপোষহীন। তবে বিস্মৃতি, অনিচ্ছাকৃত ভুল বা হৃদয়ঙ্গমের অপূর্ণতা-জনিত ভুল হতে পারে বিধায় উপরোক্ত বিভিন্ন পদ্ধতিতে তাঁরা বর্ণিত হাদীসের নির্ভুলতা যাচাই করতেন।
তাবিয়ী বর্ণনাকারীদের হাদীস গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁরা উপরোক্ত নিরীক্ষার পাশাপাশি অতিরিক্ত দু’টি বিষয় যুক্ত করেন। প্রথমত: তাঁরা বর্ণনাকারীর ব্যক্তিগত সত্যপরায়ণতা ও বিশ্বস্ততার বিষয়ে অনুসন্ধান করতেন এবং দ্বিতীয়ত: তাঁরা বর্ণনাকারী কার কাছ থেকে হাদীসটি শুনেছেন তা (reference) জানতে চাইতেন। প্রথম বিষয়টিকে হাদীস বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘عدالة’ যাচাই করা বলা হয়। আমরা বাংলায় একে ‘ব্যক্তিগত সততা ও সত্যপরায়ণতা’ যাচাই বলে অভিহিত করতে পারি। দ্বিতীয় বিষয়টিকে হাদীসের পরিভাষায় ‘سند’ বর্ণনা বলা হয়। বাংলায় আমরা একে ‘সূত্র (reference) উল্লেখ করা’ বলতে পারি।
উসমান (রা)-এর খিলাফতকালে (২৩-৩৫হি) মদীনার কেন্দ্র থেকে দূরে অবস্থিত নও-মুসলিমদের মধ্যে বিভ্রান্তিকর প্রচারণার কারণে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভক্তি ও হানাহানি ঘটে এবং নও-মুসলিমদের মধ্যে সত্যপরায়ণতার কমতি দেখা দেয়। তখন থেকেই সাহাবীগণ উপরের দুটি পদ্ধতি গ্রহণ করেন। প্রথম হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবনু সিরীন (১১০ হি) বলেন:
لَمْ يَكُونُوا يَسْأَلُونَ عَنِ الإِسْنَادِ فَلَمَّا وَقَعَتِ الْفِتْنَةُ قَالُوا سَمُّوا لَنَا رِجَالَكُمْ فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ فَيُؤْخَذُ حَدِيثُهُمْ وَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ الْبِدَعِ فَلا يُؤْخَذُ حَدِيثُهُمْ.
‘‘তাঁরা (সাহাবীগণ) সনদ বা তথ্যসূত্র সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতেন না। যখন (উসমানের খেলাফতের শেষদিকে: ৩০-৩৫ হি) ফিতনা-ফাসাদ ঘটে গেল তখন তাঁরা বললেন: তোমাদেরকে যারা হাদীস বলেছেন তাদের নাম উল্লেখ কর। কারণ দেখতে হবে, তারা যদি আহলুস সুন্নাত বা সুন্নাত-পন্থী হন তাহলে তাদের হাদীস গ্রহণ করা হবে। আর তারা যদি আহলুল বিদ‘আত বা বিদ‘আত-পন্থী হন তাহলে তাদের হাদীস গ্রহণ করা হবে না।’’[1]
প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (৬৮ হি) বলেন:
إِنَّمَا كُنَّا نَحْفَظُ الْحَدِيثَ وَالْحَدِيثُ يُحْفَظُ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ فَأَمَّا إِذْ رَكِبْتُمْ كُلَّ صَعْبٍ وَذَلُولٍ فَهَيْهَاتَ.
‘‘আমরা তো হাদীস মুখস্থ করতাম এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস (যে কোনো বর্ণনাকারী থেকে) মুখস্থ করা হতো। কিন্তু তোমরা যেহেতু খানাখন্দক ও ভালমন্দ সব পথেই চলে গেলে সেহেতু এখন (বর্ণনাকারীর বিচার-নিরীক্ষা ছাড়া) কোনো কিছু গ্রহণ করার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত।’’[2]
তাবিয়ী মুজাহিদ (১০৪ হি) বলেন:
جَاءَ بُشَيْرٌ الْعَدَوِيُّ إِلَى ابْنِ عَبَّاسٍ فَجَعَلَ يُحَدِّثُ وَيَقُولُ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ، قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ، فَجَعَلَ ابْنُ عَبَّاسٍ لا يَأْذَنُ لِحَدِيثِهِ وَلا يَنْظُرُ إِلَيْهِ. فَقَالَ: يَا ابْنَ عَبَّاسٍ مَالِي لا أَرَاكَ تَسْمَعُ لِحَدِيثِي أُحَدِّثُكَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ وَلا تَسْمَعُ؟ فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: إِنَّا كُنَّا مَرَّةً إِذَا سَمِعْنَا رَجُلا يَقُولُ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ ابْتَدَرَتْهُ أَبْصَارُنَا وَأَصْغَيْنَا إِلَيْهِ بِآذَانِنَا فَلَمَّا رَكِبَ النَّاسُ الصَّعْبَ وَالذَّلُولَ لَمْ نَأْخُذْ مِنَ النَّاسِ إِلا مَا نَعْرِفُ.
‘‘(তাবিয়ী) বাশীর ইবনু কা’ব আল-আদাবী ইবনু আববাসের (রা) কাছে আগমন করেন এবং হাদীস বলতে শুরু করেন। তিনি বলতে থাকেন: রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন। কিন্তু ইবনু আববাস (রা) তার দিকে কর্ণপাত ও দৃষ্টিপাত করলেন না। তখন বাশীর বলেন: হে ইবনু আববাস, আমার কি হলো! আপনি আমার হাদীস শুনছেন কি? আমি আপনাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস বর্ণনা করছি অথচ আপনি কর্ণপাত করছেন না!? তখন ইবনু আববাস বলেন: একসময় ছিল যখন আমরা যদি কাউকে বলতে শুনতাম: ‘রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন’ তখনই আমাদের দৃষ্টিগুলো তার প্রতি আবদ্ধ হয়ে যেত এবং আমরা পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তার প্রতি কর্ণপাত করতাম। কিন্তু যখন মানুষ খানাখন্দক ভালমন্দ সব পথেই চলে গেল তখন থেকে আমরা আর মানুষদের থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করি না, শুধুমাত্র সুপরিচিত ও পরিজ্ঞাত বিষয় ব্যতিরেকে।[3]
[2] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১৩।