কোনো সাক্ষ্য বা বর্ণনার সত্যাসত্য যাচাইয়ের সর্বোত্তম উপায় বক্তব্যদাতার কাছে প্রশ্ন করা। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর জীবদ্দশায় কোনো সাহাবী অন্য কোনো সাহাবীর বর্ণিত হাদীসের নির্ভুলতার বিষয়ে সন্দীহান হলে রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে প্রশ্ন করে নির্ভুলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতেন। বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়ক অনেক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এখানে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
১. জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রা) বিদায় হজ্জের বর্ণনার মধ্যে বলেন:
وَقَدِمَ عَلِيٌّ مِنَ الْيَمَنِ ... فَوَجَدَ فَاطِمَةَ مِمَّنْ حَلَّ وَلَبِسَتْ ثِيَابًا صَبِيغًا وَاكْتَحَلَتْ فَأَنْكَرَ ذَلِكَ عَلَيْهَا فَقَالَتْ إِنَّ أَبِي أَمَرَنِي بِهَذَا قَالَ فَكَانَ عَلِيٌّ يَقُولُ بِالْعِرَاقِ فَذَهَبْتُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ ﷺ مُحَرِّشًا عَلَى فَاطِمَةَ لِلَّذِي صَنَعَتْ مُسْتَفْتِيًا لِرَسُولِ اللَّهِ ﷺ فِيمَا ذَكَرَتْ عَنْهُ فَأَخْبَرْتُهُ أَنِّي أَنْكَرْتُ ذَلِكَ عَلَيْهَا فَقَالَ صَدَقَتْ صَدَقَتْ".
(বিদায় হজ্জের পূর্বে রাসূলুল্লাহ ﷺ আলী (রা) কে ইয়ামানের প্রশাসক রূপে প্রেরণ করেন। ফলে) আলী (রা) ইয়ামান থেকে মক্কায় হজ্জে আগমন করেন। তিনি মক্কায় এসে দেখেন যে, ফাতিমা (রা) উমরা পালন করে ‘হালাল’ হয়ে গিয়েছেন। তিনি রঙিন সুগন্ধময় কাপড় পরিধান করেছেন এবং সুরমা ব্যবহার করেছেন। আলী এতে আপত্তি করলে তিনি বলেন: আমার আববা আমাকে এভাবে করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আলী বলেন: আমি ফাতিমার বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে অভিযোগ করলাম, সে যে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নির্দেশের কথা বলেছে তাও বললাম এবং আমার আপত্তির কথাও বললাম। ... তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: ‘‘সে ঠিকই বলেছে, সে সত্যই বলেছে।’’[1]
এখানে আমরা দেখতে পাই যে, আলী (রা) ফাতেমার (রা) বর্ণনার যথার্থতার বিষয়ে সন্দীহান হন। তিনি তাঁর সত্যবাদীতায় সন্দেহ করেন নি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বক্তব্য সঠিকভাবে বুঝা ও বর্ণনা করার বিষয়ে তাঁর সন্দেহ হয়। অর্থাৎ তিনি ‘অনিচ্ছাকৃত মিথ্যার’ বিষয়ে সন্দীহান হন। এজন্য তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রশ্ন করে নির্ভুলতা যাচাই করেন।
২. উবাই ইবনু কা’ব বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ قَرَأَ يَوْمَ الْجُمُعَةِ تَبَارَكَ وَهُوَ قَائِمٌ فَذَكَّرَنَا بِأَيَّامِ اللَّهِ وَأَبُو الدَّرْدَاءِ أَوْ أَبُو ذَرٍّ يَغْمِزُنِي، فَقَالَ: مَتَى أُنْزِلَتْ هَذِهِ السُّورَةُ؟ إِنِّي لَمْ أَسْمَعْهَا إِلا الآنَ. فَأَشَارَ إِلَيْهِ أَنِ اسْكُتْ. فَلَمَّا انْصَرَفُوا قَالَ: سَأَلْتُكَ مَتَى أُنْزِلَتْ هَذِهِ السُّورَةُ فَلَمْ تُخْبِرْنِي؟ فَقَالَ أُبَيٌّ: لَيْسَ لَكَ مِنْ صَلاتِكَ الْيَوْمَ إِلا مَا لَغَوْتَ. فَذَهَبَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ ﷺ فَذَكَرَ ذَلِكَ لَهُ وَأَخْبَرَهُ بِالَّذِي قَالَ أُبَيٌّ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: "صَدَقَ أُبَيٌّ".
একদিন রাসূলুল্লাহ ﷺ জুমু‘আর দিনে খুতবায় দাঁড়িয়ে সূরা তাবারাকা (সূরা ২৫- আল-ফুরকান) পাঠ করেন এবং আমাদেরকে আল্লাহর নেয়ামত ও শান্তি সম্পর্কে ওয়ায করেন। এমতাবস্থায় আবু দারদা বা আবু যার আমার দেহে মৃদু চাপ দিয়ে বলেন: এ সূরা কবে নাযিল হলো, আমি তো এখনই প্রথম সূরাটি শুনছি। তখন উবাই তাঁকে ইশারায় চুপ করতে বলেন। সালাত শেষ হলে তিনি (আবু যার বা আবু দারদা) বলেন: আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, সূরাটি কখন নাযিল হয়েছে, অথচ আপনি আমাকে কিছুই বললেন না! তখন উবাই বলেন: আপনি আজ আপনার সালাতের কোনোই সাওয়াব লাভ করেন নি, শুধুমাত্র যে কথাটুকু বলেছেন সেটুকুই আপনার (কারণ খুতবার সময়ে কথা বললে সালাতের সাওয়াব নষ্ট হয়)। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে যেয়ে বিষয়টি বলেন: তিনি বলেন: ‘‘উবাই সত্য কথাই বলেছে।’’[2]
৩. আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রা) বলেন:
حُدِّثْتُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ قَالَ صَلاةُ الرَّجُلِ قَاعِدًا نِصْفُ الصَّلاةِ قَالَ فَأَتَيْتُهُ فَوَجَدْتُهُ يُصَلِّي جَالِسًا فَوَضَعْتُ يَدِي عَلَى رَأْسِهِ فَقَالَ مَا لَكَ يَا عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عَمْرٍو قُلْتُ حُدِّثْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَنَّكَ قُلْتَ صَلاةُ الرَّجُلِ قَاعِدًا عَلَى نِصْفِ الصَّلاةِ وَأَنْتَ تُصَلِّي قَاعِدًا قَالَ أَجَلْ وَلَكِنِّي لَسْتُ كَأَحَدٍ مِنْكُمْ
‘‘আমাকে বলা হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: কোনো ব্যক্তি বসে সালাত আদায় করলে তা অর্ধেক সালাত হবে। তখন আমি তাঁর কাছে গমন করলাম। আমি দেখলাম যে, তিনি বসে সালাত আদায় করছেন। তখন আমি তাঁর মাথার উপর আমার হাত রাখলাম। তিনি বললেন: হে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর, তোমার বিষয় কি? আমি বললাম: হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে বলা হয়েছে যে, আপনি বলেছেন, কোনো ব্যক্তি বসে সালাত আদায় করলে তা অর্ধ-সালাত হবে, আর আপনি বসে সালাত আদায় করছেন। তিনি বললেন: হ্যাঁ, (আমি তা বলেছি), তবে আমি তোমাদের মত নই।’’[3]
এভাবে অনেক ঘটনা আমরা হাদীসে দেখতে পাই যে, কারো বর্ণিত হাদীসের যথার্থতা বা নির্ভুলতার বিষয়ে সন্দেহ হলে সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে প্রশ্ন করে যথার্থতা যাচাই করতেন। তাঁরা বর্ণনাকারীর সততার বিষয়ে প্রশ্ন তুলতেন না। মূলত তিনি বক্তব্য সঠিকভাবে বুঝেছেন কিনা এবং নির্ভুলভাবে বর্ণনা করেছেন কিনা তা তাঁরা যাচাই করতেন। এভাবে তাঁরা হাদীসের নামে ‘অনিচ্ছাকৃত মিথ্যা’ বা ভুলক্রমে বিকৃতি প্রতিরোধ করতেন।
[2] ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৩৫২-৩৫৩; বুসীরী, আহমাদ ইবনু আবী বাকর (৮৪০হি), যাওয়াইদ ইবনি মাজাহ, পৃ: ১৭৩; আলবানী, সহীহু সুনানি ইবনি মাজাহ ১/৩২৯।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৫০৭।