ইসলামী ইলম-এর মূল উৎস দু’টি: কুরআন ও হাদীস। আমরা দেখেছি যে, হাদীসের জ্ঞান কুরআনের জ্ঞানের অতিরিক্ত। তা কুরআনের ব্যাখ্যা হতে পারে বা কুরআনের সংযোজন হতে পারে। প্রথম পর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, এ মূলনীতির ভিত্তিতেই সাহাবীগণের যুগ থেকে সকল যুগে মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ হাদীসের বিশুদ্ধতা, সূত্র, উৎস, অর্থ ইত্যাদি বিচার করেছেন। এ ক্ষেত্রেও জালিয়াতগণ বিভিন্ন রকমের জালিয়াতি করেছে। এ সকল জালিয়াতির উদ্দেশ্য হলো, ‘ডকুমেন্টারী’ নিরীক্ষা না করে ‘ইচ্ছামাফিক’ ‘অর্থ’ বিচার করে হাদীস ‘গ্রহণ’ বা বর্জন করা। কেউ ‘কুরআন দিয়ে হাদীস বিচার’ করার পক্ষে জাল হাদীস বানিয়েছে। কেউ ‘ভাল-মন্দ’ অর্থ দেখে হাদীস বিচারের জন্য জাল হাদীস বানিয়েছে। কেউ নির্বিচারে ‘ভক্তিভরে’ হাদীস গ্রহণ করার জন্য জাল হাদীস বানিয়েছে। এ জাতীয় একটি হাদীসে বলা হয়েছে:
إِذَا رُوِيَ عَنِّيْ حَدِيْثٌ (إِذَا حُدِّثْتُمْ عَنِّيْ حَدِيْثاً) فَاعْرِضُوْهُ عَلَى كِتَابِ اللهِ، فَإِذَا وَافَقَهُ فَاقْبَلُوْهُ، وَإِنْ خَالَفَهُ فَرُدُّوْهُ
‘‘যখন তোমাদেরকে আমার থেকে কোনো হাদীস বলা হবে, তখন তোমরা তা আল্লাহর কিতাবের উপরে পেশ করবে (কুরআনের সাথে মিলিয়ে দেখবে।) যদি তা আল্লাহর কিতাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তবে তা গ্রহণ করবে। আর যদি তা তার বিরোধী হয় তবে তা প্রত্যাখ্যান করবে।’’
এ ‘হাদীস’টি এবং এ অর্থে বর্ণিত বিভিন্ন ‘বাক্য’ সবই ভিত্তিহীন। এ অর্থের অধিকাংশ বক্তব্যই সনদবিহীন মিথ্যা কথা। দু একটি বাক্য এ অর্থে সনদসহও বর্ণিত হয়েছে, যেগুলোর সনদে মাতরূক, মুনকার বা ‘পরিত্যক্ত’ ও মিথ্যায় অভিযুক্ত রাবী বিদ্যমান। মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন যে ইসলামের গোপন শত্রু যিনদীকগণ এ সকল হাদীস তৈরি করে প্রচার করে।
স্বভাবতই কোনো হাদীসই কুরআন ‘বিরোধী’ হয় না। তবে ‘ডকুমেন্টারী’ প্রমাণ ছাড়া যদি ‘কুরআন’ দিয়ে হাদীস বিচার করা হয় তবে প্রত্যেকেই তার নিজ ‘মর্জি’ দিয়ে হাদীস বিচার করবে। একজন সহজেই বলতে পারবে যে, কুরআনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের কথা নেই অতএব পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের হাদীসগুলো কুরআন বিরোধী, কাজেই তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। অন্য ব্যক্তি বলবে, বৎসরপূর্তির পরে ‘যাকাত’ প্রদানের বিধান কুরআন বিরোধী। আরেকজন সহজেই বলতে পারবে, ‘উকাশার প্রতিশোধ গ্রহণের কাহিনী’ কুরআনের ইনসাফ প্রতিষ্ঠার নির্দেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কাজেই তা সহীহ। অথবা কুরআনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ বলা হয়েছে, কাজেই ‘আপনি না হলে বিশ্ব সৃষ্টি করতাম না’ হাদীসটি সহীহ। অথবা কুরআনে সাহাবীদের প্রশংসা করা হয়েছে, কাজেই ‘আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রতুল্য’ হাদীসটি সহীহ। এভাবে প্রত্যেকেই নিজের মর্জি মত দাবি দাওয়া করতে থাকত এবং মুসলিম উম্মাহ অন্তহীন বিভ্রান্তির আবর্তে পড়তেন। এ উদ্দেশ্যেই যিনদীকগণ এ হাদীসগুলো বানিয়েছিল। তবে মুহাদ্দিসগণের সনদ নিরীক্ষার ফলে তাদের জালিয়াতি ধরা পড়েছে।[1]