পীর-মুরীদি বিষয়ক সুন্নাত, খেলাফে সুন্নাত, বিদআত ও শিরক-কুফর বিষয়াদি আমি অন্যান্য গ্রন্থে আলোচনা করেছি। ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থে[1], ‘ফুরফুরার পীর আবূ জাফর সিদ্দিকী রচিত আল-মাউযূআত’ গ্রন্থের পর্যালোচনায়[2], ‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা গ্রন্থে[3] এবং রাহে বেলায়াত গ্রন্থে[4] আলোচনা করেছি। মূলত আল্লাহর নৈকট্য বা বেলায়াতের পথে অগ্রসর হতে নেককার মানুষদের সাহচর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নেককার মানুষদের ভালবাসা, তাদের সাহচর্য গ্রহণ, তাদের সাথে মাঝে মাঝে বসে আল্লাহর নৈকট্য বিষয়ক আলোচনা ইত্যাদি কর্ম শুধু ইবাদতই নয়; উপরন্তু অন্যান্য ইবাদত পালনের সহায়ক। এ ইবাদত পালনের জন্যই পীর-মুরিদী ব্যবস্থা গড়ে ওঠে মুসলিম সমাজে। ক্রুসেড যুদ্ধোত্তর এবং বিশেষত তাতার আক্রমনোত্তর মুসলিম বিশ্বে সূফী মাশাইখগণ-ই মূলত দীনী দাওয়াতের ধারা অব্যাহত রাখেন। পাশাপাশি তাসাউফের নামে ব্যাপক শিরক-বিদআত ও কুসংস্কার সর্বত্র প্রসারিত হয়ে যায়। অগণিত জাল হাদীস এ সকল শিরক ও বিদআতের সমর্থনে তৈরি করা হয়। এ সকল জাল হাদীসের একটি:
مَنْ لاَ شَيْخَ لَهُ فَشَيْخُهُ الشَّيْطَانُ
‘‘যার শাইখ (পীর) নেই তার শাইখ (পীর) শয়তান।’’
এ বইয়ের প্রথম পর্বে ‘‘জাল হাদীস চিহ্নিতকরণে বাঙালী আলিমগণ’’ শীর্ষক নবম পরিচ্ছেদে দেখেছি যে, এ কথাটি হাদীস হিসেবে ভিত্তিহীন ও জাল কথা। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা কোনো সাহাবী-তাবিয়ী থেকে কোনোরূপ সহীহ, যয়ীফ বা জাল সনদেও কথাটি বর্ণিত হয় নি। অনেক পরের যুগের কোনো কোনো বুজুর্গ এ কথাটি বলেছেন। এ কথাটির ভাল ও খারাপ অর্থ হতে পারে।
(ক) কুরআন-হাদীসের বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্জনের জন্য আলিমগণের সহযোগিতা গ্রহণ মুমিনের জন্য জরুরী । আল্লাহ বলেন: ‘‘তোমরা যদি না জান তবে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞাসা কর’’[5]। আল্লাহ আরো বলেন: ‘‘প্রত্যেক জনগোষ্ঠী থেকে কিছু মানুষ বেরিয়ে যেয়ে দীনের বিষয়ে ফিকহ অর্জন করবে; যেন তারা ফিরে এসে তাদের জনপদকে ভয় প্রদর্শন করে; ফলে তারা সতর্ক হবে।’’[6] এজন্য আলিমগণের কোনোরূপ সাহচর্য ও সহযোগিতা ছাড়া একাকী কুরআন-হাদীস পড়ে নিজে যা বুঝলাম সেটিকেই চূড়ান্ত বলে হঠকারিতা করা মুমিনকে শয়তানের খপ্পরে ফেলতে পারে। এ অর্থে হয়ত অতীত যুগের কোনো আলিম এ কথাটি বলে থাকতে পারেন।
(খ) এ কথাটি থেকে অনেকেই দাবি করেন যে, প্রত্যেক মুসলিমের জন্য কোনো ‘একজন’ মানুষকে ‘শাইখ’ বা ‘পীর’ হিসেবে গ্রহণ করা জরুরী। যদি কেউ কোনো মানুষকে পীর না ‘ধরে’ তবে সে শয়তানের মুরীদ হিসেবে গণ্য হবে এবং সে নাজাত বা জান্নাত লাভ করবে না। এরূপ ধারণা ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তি।
(গ) ইলম বা তাযকিয়া অর্জনের জন্য সাহাবী, তাবিয়ী, তাবি-তাবিয়ীগণের যুগে নির্দিষ্ট এক ব্যক্তিকে ‘পীর’ বা ‘শাইখ’ হিসেবে গ্রহণ করার কোনো প্রচলন ছিল না। তাঁরা সকল নেককার মানুষকে আল্লাহর জন্য ভালবাসতেন, কিছু মানুষকে বিশেষভাবে ভালবাসতেন এবং তাঁদের সাহচর্য গ্রহণ করতে সর্বদা চেষ্টা করতেন। কিন্তু কখনোই একজনকে নির্দিষ্ট করতেন না। সাহচর্য গ্রহণের নামে ‘বাইয়াত’ গ্রহণ করার কোনোরূপ প্রচলন তাঁদের মধ্যে ছিল না। তাঁরা উন্মুক্ত সাহচর্য গ্রহণ করতেন। আবূ নুআইম ইসপাহানীর হিলইয়াতুল আওলিয়া ও ৪র্থ শতকের তাসাউফ বিষয়ক অন্যান্য গ্রন্থে উমার ইবন আব্দুল আযীয, হাসান বসরী, ইবন সিরীন, সুফইয়ান সাওরী, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক, ইবরাহীম ইবনুল আদহাম, বিশর আল-হাফী, যুন্নুন মিসরী, হারিস মুহাসিবী, জুনাইদ বাগদাদী ও ‘সূফী’ হিসেবে প্রসিদ্ধ অন্যান্যদের জীবনী অধ্যয়ন করলেই পাঠক তা বুঝতে পারবেন। ৪র্থ-৫ম হিজরী শতক থেকে একজন নির্দিষ্ট নেককার মানুষের সাহচর্য গ্রহণের প্রবণতা বাড়তে থাকে। তবে তখনও ‘বাইয়াত’ পদ্ধতি ছিল না। আরো কয়েক শত বৎসর পরে বাইয়াতের মাধ্যমে পীর-মুরীদি পদ্ধতির প্রচলন হয়।
(গ) উপরের বইগুলো পাঠ করলে পাঠক দেখবেন যে, মুজাদ্দিদ আলফ সানী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী, সাইয়িদ আহমাদ ব্রেলবী-সহ ভারতের ও বিশ্বের প্রসিদ্ধ সূফীগণ একমত যে, ‘পীরের মুরীদ হওয়া’ ইবাদত নয়; উপকরণ মাত্র। ঈমান ও তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে বেলায়াত লাভের জন্য এটি সহায়ক উপকরণ। মুমিনের বেলায়াত নির্ভর করবে তার ঈমান ও তাকওয়ার গভীরতার উপরে, মুরীদ হওয়ার উপরে নয়। মুরীদ হয়ে বা না হয়ে, নির্দিষ্ট একজনের সাহচর্য নিয়ে বা বিভিন্ন মানুষের সাহচর্য নিয়ে মুমিন বেলায়াত অর্জন করতে পারেন। বিষয়টি অনেকটা মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার মতই। মাদরাসায় ভর্তি হওয়া কোনো ইবাদত নয়; ইলম শিক্ষা করা ইবাদত। মাদরাসায় ভর্তি না হয়ে বিভিন্ন আলিমের মজলিসে যেয়ে, বাড়িতে বইপত্র পড়ে বা অন্য যে কোনো পদ্ধতিতে ইলম শিক্ষা করলেও মুমিন একইরূপ সাওয়াব লাভ করবেন। মাদরাসায় ভর্তি হওয়াকে ইবাদত বা ইবাদতের অংশ মনে করলে তা বিদআতে পরিণত হয়। অর্থাৎ কেউ যদি মনে করেন যে, ইলম শিক্ষা করি বা না করি মাদরাসায় ভর্তি হলেই ইবাদত পালন হয়ে গেল, অথবা মাদরাসায় ভর্তি না হয়ে বিভিন্ন আলিমের বাড়িতে বা দরসে যেয়ে বা অন্যভাবে যতই ইলম অর্জন করুক ইলম শিক্ষার ইবাদত এতে পালিত হবে না তবে তিনি বিদআতে লিপ্ত।
(ঘ) ‘‘যার শাইখ নেই তার শাইখ শয়তান’’ কথা দ্বারা অনেকে দাবি করেন আল্লাহ এবং বান্দার মাঝখানে কোনো মানুষের মধ্যস্থতা প্রয়োজন। কোনো একজন মানুষের মধ্যস্থতা ছাড়া আল্লাহর রহমত, বরকত বা বেলায়াত লাভ সম্ভব নয়। এরূপ বিশ্বাস সন্দেহাতীতভাবেই শিরক।
[2] ফুরফুরার পীর আবূ জাফর সিদ্দিকী রচিত আল-মাউযূআত, পৃষ্ঠা ১১১-১৩১।
[3] কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃষ্ঠা ৪৬৭-৪৮৪।
[4] রাহে বেলায়াত, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৩১৭-৩১৯।
[5] সূরা (১৬) নাহল: ৪৩ আয়াত ও সূরা (২১) আম্বিয়া ৭ আয়াত।
[6] সূরা (৯) তাওবা: ১২২ আয়াত।