ব্যাংকের সুদ কি হালাল সূচি ও বিবরন শাইখ মুশ্তাক আহমাদ কারীমী ১ টি

এবারে দেখুন, সরকার দেশের বাইরের বিদেশী মহাজনদের নিকট থেকে যে ঋণ গ্রহণ করে তাতে অর্থনৈতিক কি ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে; এ ধরনের ঋণ সাধারণতঃ ১০/২০ কোটির মাত্রা অতিক্রম করে ১০০ থেকে ১০০০০ কোটির পর্যায়ে পৌঁছে থাকে। এ ধরনের ঋণ সরকার সাধারণতঃ তখন গ্রহণ করে থাকে যখন দেশে কোন অস্বাভাবিক সংকটাবর্ত ও দুরবস্থা আপতিত হয় এবং দেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণ সে বিপদ থেকে নিস্কৃতি লাভে যথেষ্ট প্রমাণিত হয় না। আবার কখনো এ লোভে পড়েও ঋণ গ্রহণ করে থাকে যে, বড় অংকের পুঁজি নিয়ে উন্নয়নমূলক প্রকল্পসমূহে বিনিয়োগ করলে দেশের উপায়-উপকরণ স্বল্প সময়ে বৃদ্ধি পেয়ে যাবে। এই শ্রেণীর ঋণে সূদের হার সাধারণতঃ ৬/৭ শতাংশ থেকে ৯/১০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর সূদের উক্ত হার অনুযায়ী কয়েক শত কোটি টাকার বার্ষিক সূদ কয়েক কোটি টাকা হয়। অপর দিকে ঋণদাতা দেশ যমানত স্বরূপ ঋণ গ্রহীতা দেশের কোন একটা শুল্ক; যেমন চিনি লবণ অথবা অন্য কোন খাতের আয়কে বন্ধক রেখে নেয়।

ইতিপূর্বে সূদের যে সমস্ত অনিষ্টকারিতা আমরা আলোচনা করেছি তার সবটাই নিহিত রয়েছে এই ধরনের সূদী ঋণে। উপরন্তু ঋণের এই শ্রেণীতে এ সকল ক্ষতি ছাড়াও আরো এক প্রকার ক্ষতিকর দিক রয়েছে, যা পূর্বালোচিত ক্ষতিসমূহের মধ্যে সব চাইতে বেশী ভয়াবহ। আর তা হল এই যে, এ ধরনের বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে পুরাপুরিভাবে জাতির আর্থিক অবস্থা ধ্বংস এবং অর্থনৈতিক মান সর্বনাশগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আর এর নিতান্ত ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর। অধিকন্তু এরই মাধ্যমে জাতির মানুষের হৃদয়ে-হৃদয়ে রোপিত হয় শত্রুতা ও বিদ্বেষের বীজ ।

পরিশেষে এরই কারণে বিপদাপন্ন ও দুর্দশাগ্রস্ত জাতির তরুণদল বিক্ষুব্ধ ও অতিষ্ঠ হয়ে চরমপন্থী রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক দর্শন গ্রহণ করতে শুরু করে। অতঃপর এক রক্তক্ষয়ী বিপ্লব অথবা সর্বনাশী সংগ্রামের মাধ্যমে নিজের জাতির দুর্দশা ও সংকট নিরসনের উপায় অনুসন্ধান করতে আরম্ভ করে দেয়।

নিজের সংকট নিরসনের উদ্দেশ্যে যে জাতিই কোন বড় অংকের অর্থ সূদী ঋণ গ্রহণ করে, তাকে খুব কমভাগই সেই সমস্যা অপসারণে সফলকাম হতে দেখা যায়---যার কারণে সে ঋণ গ্রহণ করে। বিপরীত পক্ষে এই ঋণই সে জাতির সংকট ও সমস্যার বৃদ্ধিতে সহায়কশক্তি হিসাবে কাজ করে। ঋণের কিস্তি ও সূদ আদায় করার জন্য তার নিজের দেশবাসীর উপর খুব বেশী ট্যাক্স ও করভার চাপিয়ে দিতে হয় এবং অনেক দিক থেকেই ব্যয়ের পরিমাণ খুব বেশী হরাস করতে হয়। এর ফলে এক দিকে যেমন জাতির সাধারণ মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে যায় তেমনি অপর দিকে নিজের দেশবাসী জনগণের উপর এত পরিমাণে ভারী বোঝা চাপিয়েও সরকারের পক্ষে ঋণের কিস্তি এবং সূদ নিয়মিতভাবে আদায় করে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অতঃপর ঋণগ্রহীতা দেশের পক্ষ থেকে যখন ঋণ আদায়ে অনবরত শৈথিল্য দেখা দেয়, তখন বৈদেশিক ঋণদাতা দেশ তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ও অপবাদ লাগিয়ে বলতে থাকে, ‘বেঈমান দেশ, আমাদের ঋণের টাকা ফাঁকি দিতে চায়’ ইত্যাদি। তাদের ইশারা মতে তাদের জাতীয় সংবাদপত্র এবং আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমগুলো এই দরিদ্র দেশের বিরুদ্ধে কটূক্তি করতে লাগে।

ঋণগ্রহীতা দেশ এই ফাঁদ থেকে সত্বর বের হতে চেষ্টা করে। এতদুদ্দেশ্যে সে দেশবাসীর উপর করভার আরো বৃদ্ধি করে এবং অধিকতর ব্যয় সঙ্কোচন করে কোন প্রকারে দ্রুত নিস্কৃতি লাভের চেষ্টা করে। শেষে দেশের জনগণ দেশ ও তার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।[1]

সূদের এ সকল ধ্বংসকারিতা ও সর্বনাশিতা ছাড়াও কিছু ঋণগ্রহীতা দেশের অবস্থা একবার ঠান্ডা মাথায় পড়ুনঃ-

১৯৮১ সালে ২৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণগ্রস্ত দেশ পোলান্ড ঘোষণা করেছে যে, ঋণদাতাদেরকে পরিশোধ করার মত আড়াই বিলিয়ন ডলার তার নিকট নেই। এ বছরেই আগষ্ট মাসে মেক্সিকো ঘোষণা করেছে যে, সে বৈদেশিক ঋণের সূদ ৮০ বিলিয়ন ডলার আদায় করতে অক্ষম। এরপর ব্রাজিল ঘোষণা করেছে যে, সে তার ৮৭ বিলিয়ন চাইতেও বেশী ডলারের ঋণ আদায় করতে অসমর্থ।

আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (INTERNATIONAL MONETARY FUND) এ কথা ঘোষণা করেছে যে, ৩২ টি দেশ এমন রয়েছে যে, ১৯৮১ সাল থেকে তারা তাদের ঋণ পরিশোধে অক্ষম।

এবারে কতিপয় দেশের গৃহীত ঋণের সংক্ষিপ্ত হিসাব লক্ষ্য করুনঃ

১৯৮৩ সালের ঋণরাশির আনুমানিক তালিকা (বিলিয়ন ডলারে)

দেশের নাম

১৯৮২র শেষ পর্যন্ত সর্বমোট ঋণ

১৯৮৩ পর্যন্ত আদায়কৃত অর্থ

রপ্তানীর তুলনায় আদায়কৃত অর্থের হার

ব্রাজিল

৮৭

৩০.৮

১১৭%

মেক্সিকো

৮০.১

৪৩.১

১২৬%

আর্জেন্টিনা

৩৪.১

১৮.৪

১৫৩%

উত্তর কোরিয়া

৩৬

১৫.৭

৪৯%

ভেনিজুয়েলা

২৮

১৯.৯

১০০%

পোল্যান্ড

২৬

৭.৮

৯৪%

রাশিয়া

২৩

১২.২

২৫%

মিসর

১৯.২

৪৬%

যুযোস্লাভিয়া

১৯

৪১%

ফিলিপাইন

১৬.৬

৭৯%

পশ্চিম জার্মানী

১৪

৬.৩

৮৩%

পেরো

১১.৫

৩.৯

৭৯%

রোমানিয়া

৯.৯

৫.৫

৬১%

নাইজেরিয়া

৯.৩

৪.৯

২৮%

হাঙ্গেরী

৩.৫

৫৫%

যাইর

৫.১

১.২

৮৩%

নামিবিয়া

৪.৫

১৯৫%

বলিভিয়া

৩.১

১১৮%

(দেখুন, আর রিবা, ডক্টর উমার আশকার ১৪৮-১৫২ পৃঃ)

আল্লাহ তাআলা কি সত্যই না বলেছেন,

﴿يَمْحَقُ اللهُ الرِّبا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ وَاللهُ لا يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيمٍ﴾

অর্থাৎ, আল্লাহ সূদকে ধ্বংস করেন এবং সাদকাহকে বৃদ্ধি দান করেন।[2]

তিনি আরো বলেন,

﴿سَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنْفُسِهِمْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ أَوَلَمْ يَكْفِ بِرَبِّكَ أَنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ﴾

অর্থাৎ, আমি ওদেরকে আমার নিদর্শনাবলী দিকচক্রবালে প্রদর্শন করব এবং তাদের নিজেদের মধ্যেও; ফলে ওদের নিকট স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, এ (কুরআন) সত্য।[3]

প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন,

إن الربا وإن كثر فإن عاقبته تصير إلى قل.

অর্থাৎ, ‘‘সূদ পরিমাণে যতই বেশী হোক না কেন পরিণামে তা কম হতে বাধ্য।’’[4]

প্রিয় পাঠক! সূদের এমন মারাত্মক পরিণতি ও ফলাফল দর্শন করার পরেও কি কোন জ্ঞানসম্পন্ন ও বিবেকবান মানুষ এ কথা মেনে নিতে দ্বিধা করতে পারে যে, সূদ এমন এক ক্ষতিকর নিকৃষ্ট জিনিস, যা চূড়ান্তভাবে হারাম হওয়া অবশ্যই উচিত? সূদের এ অপকারিতা ও ভয়াবহ পরিণাম প্রত্যক্ষ করার পরও কি নবী (ﷺ) এর নিম্নোক্ত বাণী সম্বন্ধে কোন প্রকার সন্দেহ করতে পারে?

الربا سبعون جزءا، أيسرها أن ينكح الرجل أمه.

অর্থাৎ, ‘‘সূদ এমন একটি বড় গোনাহ যে, যদি তাকে সত্তর ভাগে ভাগ করা হয়, তাহলে তার সবচেয়ে হালকা অংশটিও নিজের মায়ের সহিত ব্যভিচার করার সমান গোনাহর শামিল!’’[5]

প্রিয় পাঠক! সূদের উপরোক্ত বিস্তারিত আলোচনা পাঠের পর আশা করি আপনার এ অনুমান ও ধারণা হয়েছে যে, সূদ ইসলামের দৃষ্টিতে কত বিরাট অপরাধ ও পাপ এবং সূদের মধ্যে কি কি অনিষ্টকারিতা ও সর্বনাশিতা নিহিত রয়েছে। এবারে পরবর্তী আলোচনায় উক্ত সূদ বর্তমান যুগে কোন্ শ্রেণীর ব্যবসা ও কারবারে পাওয়া যায়, তা আমরা অবগত করাতে চাই। তাই আসুন, প্রথমত আমরা প্রচলিত বিভিন্ন কারবার প্রসঙ্গে পুরাপুরি জ্ঞানলাভ করে নিই। তাহলেই কোন্ ধরনের কারবারে সূদ আছে এবং কোন্ ধরনের কারবারে সূদ নেই তা সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আর একজন তওহীদবাদী এবং পূর্ণ ঈমান ও দ্বীনদার মুসলিমকে কোন্ কোন্ ধরনের কারবার করা এবং কোন্ ধরনের কারবার থেকে দূরে থাকা উচিত---তাও পরিষ্কার হয়ে যাবে।

[1] (সূদ ও আধুনিক ব্যাংকিং দ্রষ্টব্য)

[2] (সূরা বাক্বারাহ ২৭৬ আয়াত)

[3] (সূরা ফুসসিলাত ৫৩ আয়াত)

[4] (মুসনাদে আহমদ ১/৩৯৫, ৪২৪, ইবনে মাজাহ ২২৭৯, বাইহাকী, মিশকাত ২৮২৭ নং)

[5] (ইবনে মাজাহ, বাইহাকী, মিশকাত ২৮২৬ নং, সহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব ১৮৫৭)