রোযার দ্বিতীয় প্রকার হল সুন্নত, নফল (অতিরিক্ত) রোযা; যা পালন করা মুসলিমের জন্য ওয়াজেব নয়। কিন্তু পালন করলে ফযীলত ও সওয়াবের অধিকারী হওয়া যায়।
মহান আল্লাহর একটি হিকমত ও অনুগ্রহ এই যে, তিনি ফরয ইবাদতের মতই নফল ইবাদতও বিধিবদ্ধ করেছেন। তিনি যে আমল ফরয করেছেন, অনুরূপ সেই আমল নফলও করেছেন বান্দার জন্য। ফরয ইবাদতের মাঝে একদিকে যেমন ঘটিত ত্রুটি নফল ইবাদত দ্বারা পূরণ হয়ে যায়। তেমনি অপর দিকে তারই মাধ্যমে আমলকারীর নেকী ও সওয়াব বৃদ্ধি হয়। পক্ষান্তরে তা বিধিবদ্ধ না হলে তা পালন করা ভ্রষ্টকারী বিদআত বলে গণ্য হত। আর হাদীসে বলা হয়েছে যে, ‘‘কিয়ামতের দিন নফল ইবাদত দ্বারা ফরয ইবাদতের অসম্পূর্ণতা পূর্ণ করা হবে।’’[1]
নফল রোযার নিয়ত ফজরের আগে থেকে হওয়া জরুরী নয়। বরং দিনের বেলায় সূর্য ঢলার আগে বা পরে নিয়ত করলেই রোযা শুদ্ধ হয়ে যায়। অবশ্য ফরয রোযার বেলায় তা হয় না- যেমন পূর্বেই এ কথা আলোচিত হয়েছে। তবে নফল রোযার ক্ষেত্রেও শর্ত হল, যেন নিয়ত করার আগে ফজর উদয় হওয়ার পর কোন রোযা নষ্টকারী জিনিস ব্যবহার না করা হয়। বলা বাহুল্য, যদি তা (পানাহার বা অন্য কিছু) ব্যবহার করে থাকে তাহলে রোযা হবে না।
এ কথার দলীল মা আয়েশার হাদীস; তিনি বলেন, একদা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তাঁর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘তোমাদের কাছে (খাবার) কিছু আছে কি?’’ বললেন, ‘জী না।’ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তখন বললেন, ‘‘তাহলে আজকে আমি রোযা থাকলাম।’’[1]
আর এই আমল ছিল সাহাবা (রাযি.)-দের।[2]
কিন্তু জানার কথা যে, দিনের বেলায় নিয়ত করলে, কেবল নিয়ত করার পর থেকেই সওয়াবের অধিকারী হবে। সুতরাং কেউ সূর্য ঢলার সময় নিয়ত করলে সে কেবল অর্ধেক রোযার সওয়াব প্রাপ্ত হবে; তার বেশী নয়।[3] যেহেতু প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘যাবতীয় আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং প্রত্যেক ব্যক্তির তা-ই প্রাপ্য হয়, যার সে নিয়ত করে থাকে।’’[4]
[2] (দ্রঃ বুখারী ৩৭৯পৃঃ)
[3] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৩৭২-৩৭৪)
[4] (বুখারী ১নং, মুসলিম ১৯০৭নং)
নফল রোযা দুই প্রকার; সাধারণ নফল এবং নির্দিষ্ট নফল। এখানে নির্দিষ্ট রোযাসমূহের কথা আলোচনা করা হচ্ছে।
যে ব্যক্তির রমাযানের রোযা পূর্ণ হয়ে যাবে, তার জন্য শওয়াল মাসের ৬টি রোযা রাখা মুস্তাহাব। আর এতে তার জন্য রয়েছে বৃহৎ সওয়াব। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি রমাযানের রোযা রাখার পরে-পরেই শওয়াল মাসে ছয়টি রোযা পালন করে সে ব্যক্তির পূর্ণ বৎসরের রোযা রাখার সমতুল্য সওয়াব লাভ হয়।’’[1]
এই সওয়াব এই জন্য হবে যে, আল্লাহর অনুগ্রহে ১টি কাজের সওয়াব ১০টি করে পাওয়া যায়। অতএব সেই ভিত্তিতে ১ মাসের (৩০ দিনের) রোযা ১০ মাসের (৩০০ দিনের) সমান এবং ৬ দিনের রোযা ২ মাসের (৬০ দিনের) সমান; সর্বমোট ১২ মাস (৩৬০ দিন) বা এক বছরের সওয়াব লাভ হয়ে থাকে। আর এই ভাবে সেই রোযাদারের জীবনের প্রত্যেকটি দিন রোযা রাখা হয়! দয়াময় আল্লাহ বলেন,
(مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا)
অর্থাৎ, কেউ কোন ভাল কাজ করলে, সে তার ১০ গুণ প্রতিদান পাবে। (কুরআনুল কারীম ৬/১৬০)
এই রোযা বিধিবদ্ধ হওয়ার কারণ -আর আল্লাহই ভাল জানেন - তা হল ফরয নামাযের পর সুন্নাতে মুআক্কাদার মত। যা ফরয নামাযের উপকারিতা ও তার অসম্পূর্ণতা সম্পূর্ণ করে। অনুরূপ এই ছয় রোযা রমাযানের ফরয রোযার অসম্পূর্ণতা সম্পূর্ণ করে এবং তাতে কোন ত্রুটি ঘটে থাকলে তা দূর করে থাকে। সে অসম্পূর্ণতা ও ত্রুটির কথা রোযাদার জানতে পারুক অথবা না পারুক।[2]
তা ছাড়া রমাযানের ফরয রোযা রাখার পর পুনরায় রোযা রাখা রমাযানের রোযা কবুল হওয়ার একটি লক্ষণ। যেহেতু মহান আল্লাহ যখন কোন বান্দার নেক আমল কবুল করেন, তখন তার পরেই তাকে আরো নেক আমল করার তওফীক দান করে থাকেন। যেমন উলামাগণ বলে থাকেন, ‘নেক কাজের সওয়াব হল, তার পরে পুনঃ নেক কাজ করা।’[3]
এই রোযার উত্তম সময় হল, ঈদের সরাসরি পরের ৬ দিন। কারণ, তাতেই রয়েছে নেক আমলের দিকে সত্বর ধাবমান হওয়ার দলীল। আর এ কথা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর এই উক্তি ‘‘যে ব্যক্তি রমাযানের রোযা রাখার পরে-পরেই শওয়াল মাসে ছয়টি রোযা পালন করে---’’ থেকে বুঝা যায়।
তদনুরূপ উত্তম হল, উক্ত ছয় রোযাকে লাগাতার রাখা। কেননা, এমনটি করা রমাযানের অভ্যাস অনুযায়ী সহজসাধ্য। আর তাতে হবে বিধিবদ্ধ নেক আমল করার প্রতি সাগ্রহে ধাবমান হওয়ার পরিচয়।
অবশ্য তা লাগাতার না রেখে বিচ্ছিন্নভাবেও রাখা চলে। যেহেতু হাদীসের অর্থ ব্যাপক। কিন্তু শওয়াল মাস অতিবাহিত হয়ে গেলে তা কাযা করা বিধেয় নয়। যেহেতু তা সুন্নত এবং তার যথাসময় পার হয়ে গেছে। তাতে তা কোন ওযরের ফলে পার হোক অথবা বিনা ওযরে।[4]
রমাযানের রোযা কাযা না করে শওয়ালের রোযা রাখা বিধেয় নয়। যেমন কাফ্ফারার রোযা থাকলে তা না রেখে শওয়ালের রোযা রাখা চলে না। আর শওয়াল মাসে রমাযানের কাযা রাখলে তাই শওয়ালের রোযা বলে যথেষ্ট হবে না।[5]
[2] (ফাইযুর রাহীমির রাহমান, ফী আহকামি অমাওয়াইযি রামাযান ৭৬পৃঃ)
[3] (ইতহাফু আহলিল ইসলাম বিআহকামিস সিয়াম ৯২পৃঃ)
[4] (ইবনে বায : ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ ২/১৬৫-১৬৬)
[5] (ইবনে জিবরীন, ফাসিঃ ১০৭পৃঃ)
যুল-হজ্জ মাসের ৯ তারীখ (সৌদি আরবের) হল আরাফার দিন। এই দিনে হাজীগণ আরাফার ময়দানে উপস্থিত হন বলে এই নামকরণ হয়েছে। এই দিনের রোযা রাখার মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বলেছিলেন, ‘‘(উক্ত রোযা) গত এক বছরের এবং আগামী এক বছরের কৃত পাপরাশিকে মোচন করে দেয়।’’[1]
সাহ্ল বিন সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি আরাফার দিন রোযা রাখে তার উপর্যুপরি দুই বৎসরের পাপরাশি মাফ হয়ে যায়।’’[2]
অবশ্য এই রোযা গৃহবাসীর জন্য বিধেয়; আরাফাতে অবস্থানরত হাজীর জন্য তা বিধেয় নয়। কেননা, ঐ দিনে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) রোযা রেখেছেন কি না লোকেরা তা নিয়ে সন্দেহ করলে, তাঁর নিকট এক পাত্র দুধ পাঠানো হল। তিনি ঐ দিনের চাশ্তের সময় তা পান করলেন। সে সময় লোকেরা তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখছিল।[3]
আরাফার ময়দানে ঐ রোযা বিধেয় না হওয়ার কারণ এই যে, ঐ দিন হল দুআ ও যিক্রের দিন। আর রোযা রাখলে তাতে দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া সেটা হল সফর। আর সফরে রোযা না রাখাটাই উত্তম।[4]
পক্ষান্তরে অহাজীদের জন্য ঐ রোযা বিধেয় হওয়ার পশ্চাতে হিকমত হল, ঐ রোযা রেখে রোযাদার হাজীদের সাদৃশ্য বরণ করতে পারে, তাঁদের কর্মের প্রতি আকাঙ্ক্ষী হয় এবং তাঁদের উপর আল্লাহর যে রহমত অবতীর্ণ হয় তাতে শামিল হতে ও সেই রহমতের দরিয়ায় আপ্লুত হতে পারে।[5]
প্রকাশ থাকে যে, রমাযানের কাযা রোযার নিয়তে কেউ আরাফা অথবা আশূরার দিন রোযা রাখলে তার উভয় সওয়াব লাভ হবে ইন শাআল্লাহ।
[2] (আবু য়্যা’লা, সহীহ তারগীব ৯৯৮নং)
[3] (বুখারী ১৯৮৮, মুসলিম ১১২৩নং)
[4] (দ্রঃ যামাঃ ২/৭৭, আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৪৭৩)
[5] (ফাইযুর রাহীমির রাহমান, ফী আহকামি অমাওয়াইযি রামাযান ৭৬পৃঃ)
সুন্নত রোযাসমূহের মধ্যে মুহার্রাম মাসের (অধিকাংশ দিনের) রোযা অন্যতম। রমাযানের পর পর রয়েছে এই রোযার মান। আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘‘রমাযানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ রোযা হল আল্লাহর মাস মুহার্রামের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামায হল রাতের (তাহাজ্জুদের) নামায।’’[1]
মুহার্রাম মাসের রোযার মধ্যে সবচেয়ে বেশী তাকীদপ্রাপ্ত হল ঐ মাসের ১০ তারীখ আশূরার দিনের রোযা। রমাযানের রোযা ফরয হওয়ার আগে এই রোযা ওয়াজেব ছিল। রুবাইয়ে’ বিন্তে মুআউবিয বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) আশূরার সকালে মদ্বীনার আশেপাশে আনসারদের বস্তিতে বস্তিতে খবর পাঠিয়ে দিলেন যে, ‘‘যে রোযা অবস্থায় সকাল করেছে, সে যেন তার রোযা পূর্ণ করে নেয়। আর যে ব্যক্তি রোযা না রাখা অবস্থায় সকাল করেছে সেও যেন তার বাকী দিন পূর্ণ করে নেয়।’’
রুবাইয়ে’ বলেন, ‘আমরা তার পর হতে ঐ রোযা রাখতাম এবং আমাদের ছোট ছোট বাচ্চাদেরকেও রাখাতাম। তাদের জন্য তুলোর খেলনা তৈরী করতাম এবং তাদেরকে মসজিদে নিয়ে যেতাম। অতঃপর তাদের মধ্যে কেউ খাবারের জন্য কাঁদতে শুরু করলে তাকে ঐ খেলনা দিতাম। আর এইভাবে ইফতারের সময় এসে পৌঁছত।’[1]
মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘কুরাইশরা জাহেলিয়াতের যুগে আশূরার রোযা পালন করত। আর আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-ও জাহেলিয়াতে ঐ রোযা রাখতেন। (ঐ দিন ছিল কাবায় গিলাফ চড়াবার দিন।) অতঃপর তিনি যখন মদ্বীনায় এলেন, তখনও তিনি ঐ রোযা রাখলেন এবং সকলকে রাখতে আদেশ দিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে যখন রমাযানের রোযা ফরয হল, তখন আশূরার রোযা ছেড়ে দিলেন। তখন অবস্থা এই হল যে, যার ইচ্ছা হবে সে রাখবে এবং যার ইচ্ছা হবে সে রাখবে না।’[2]
ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদ্বীনায় এলেন, তখন দেখলেন, ইয়াহুদীরা আশূরার দিনে রোযা পালন করছে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘এটা কি এমন দিন যে, তোমরা এ দিনে রোযা রাখছ?’’ ইয়াহুদীরা বলল, ‘এ এক উত্তম দিন। এ দিনে আল্লাহ বানী ইসরাঈলকে তাদের শত্রু থেকে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। তাই মূসা এরই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে এই দিনে রোযা পালন করেছিলেন। (আর সেই জন্যই আমরাও এ দিনে রোযা রেখে থাকি।)’
এ কথা শুনে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘‘মূসার স্মৃতি পালন করার ব্যাপারে তোমাদের চাইতে আমি অধিক হকদার।’’ সুতরাং তিনি ঐ দিনে রোযা রাখলেন এবং সকলকে রোযা রাখতে আদেশ দিলেন।[3]
বলাই বাহুল্য যে, উক্ত আদেশ ছিল মুস্তাহাব। যেমন মা আয়েশার উক্তিতে তা স্পষ্ট। তা ছাড়া মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘আজকে আশূরার দিন; এর রোযা আল্লাহ তোমাদের উপর ফরয করেন নি। তবে আমি রোযা রেখেছি। সুতরাং যার ইচ্ছা সে রোযা রাখবে, যার ইচ্ছা সে রাখবে না।’’[4]
আবু কাতাদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লার রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) আশূরার দিন রোযা রাখা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বললেন, ‘‘আমি আশা করি যে, (উক্ত রোযা) বিগত এক বছরের পাপরাশি মোচন করে দেবে।’’[5]
ইবনে আববাস (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) রমাযানের রোযার পর আশূরার দিন ছাড়া কোন দিনকে অন্য দিন অপেক্ষা মাহাত্ম্যপূর্ণ মনে করতেন না।’[6] অনুরূপ বর্ণিত আছে বুখারী ও মুসলিম শরীফে।[7]
এক বর্ণনায় আছে, এই রোযা এক বছরের রোযার সমান।[8]
অবশ্য যে ব্যক্তি আশূরার রোযা রাখবে তার জন্য তার একদিন আগে (৯ তারীখে)ও একটি রোযা রাখা সুন্নত। যেহেতু ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) যখন আশূরার রোযা রাখলেন এবং সকলকে রাখার আদেশ দিলেন, তখন লোকেরা বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! এ দিনটিকে তো ইয়াহুদ ও নাসারারা তা’যীম করে থাকে।’ তিনি বললেন, ‘‘তাহলে আমরা আগামী বছরে ৯ তারীখেও রোযা রাখব ইনশাআল্লাহ।’’ কিন্তু আগামী বছর আসার আগেই আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর ইন্তিকাল হয়ে গেল।[9]
ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ‘তোমরা ৯ ও ১০ তারীখে রোযা রাখ।’[10]
পক্ষান্তরে ‘‘তোমরা এর একদিন আগে বা একদিন পরে একটি রোযা রাখ’’ -এই হাদীস সহীহ নয়।[11] তদনুরূপ সহীহ নয় ‘‘তোমরা এর একদিন আগে একটি এবং একদিন পরেও একটি রোযা রাখ’’ -এই হাদীস।[12]
বলা বাহুল্য, ৯ ও ১০ তারীখেই রোযা রাখা সুন্নত। পক্ষান্তরে কেবল ১০ তারীখে রোযা রাখা মকরূহ।[13] যেহেতু তাতে ইয়াহুদীদের সাদৃশ্য সাধন হয় এবং তা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর আশার প্রতিকূল। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, ‘মকরূহ নয়। তবে কেউ একদিন (কেবল আশূরার দিন) রোযা রাখলে পূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হবে না।’
জ্ঞাতব্য যে, হুসাইন (রাঃ)-এর এই দিনে শহীদ হওয়ার সাথে এ রোযার কোন নিকট অথবা দূরতম কোন সম্পর্ক নেই। কারণ, তার পূর্বে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম); বরং তাঁর পূর্বে মূসা নবী u এই দিনে রোযা রেখে গেছেন। আর এই দিনে শিয়া সম্প্রদায় যে মাতম ও শোক পালন, মুখ ও বুক চিরে, গালে থাপর মেরে, চুল-জামা ছিঁড়ে, পিঠে চাবুক মেরে আত্মপ্রহার ইত্যাদি করে থাকে, তা জঘন্যতম বিদআত। সুন্নাহতে এ সবের কোন ভিত্তি নেই।
তদনুরূপ এই দিনে নিজ পরিবার-পরিজনের উপর খরচ বৃদ্ধি করা, বিশেষ কোন নামায পড়া, দান-খয়রাত করা, বিশেষ করে শরবত-পানি দান করা, কলফ ব্যবহার করা, তেল মাখা, সুরমা ব্যবহার করা প্রভৃতি বিদআত। এ সকল বিদআত হুসাইন (রাঃ)-এর খুনীরাই আবিষ্কার করে গেছে।[14]
[2] (বুখারী ১৯৫২, ২০০২, মুসলিম ১১২৫নং প্রমুখ)
[3] (বুখারী ২০০৪, মুসলিম ১১৩০নং)
[4] (বুখারী ২০০৩, মুসলিম ১১২৯নং)
[5] (আহমাদ, মুসনাদ ৫/২৯৭, মুসলিম ১১৬২, আবূ দাঊদ ২৪২৫, বাইহাকী ৪/২৮৬)
[6] (ত্বাবারানী, মু’জাম আওসাত্ব, সহীহ তারগীব, আলবানী ১০০৬ নং)
[7] (বুখারী ২০০৬, মুসলিম ১১৩২নং)
[8] (ইবনে হিববান, সহীহ ৩৬৩১নং)
[9] (মুসলিম ১১৩৪, আবূ দাঊদ ২৪৪৫নং)
[10] (বাইহাকী ৪/২৮৭, আব্দুর রায্যাক, মুসান্নাফ ৭৮৩৯নং)
[11] (ইবনে খুযাইমাহ, সহীহ ২০৯৫নং, আলবানীর টীকা দ্রঃ)
[12] (যামাঃ ২/৭৬ টীকা দ্রঃ)
[13] (ইবনে বায, ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ ২/১৭০)
[14] (তামামুল মিন্নাহ, আল্লামা আলবানী ৪১২পৃঃ দ্রঃ)
যুলহজ্জ মাসের প্রথম নয় দিন রোযা রাখা মুস্তাহাব। যেহেতু আল্লাহ আয্যা অজাল্ল যুলহজ্জের প্রথম দশ দিনকে অন্যান্য দিনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা দান করেছেন। আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন। ‘‘এই দশদিনের মধ্যে কৃত নেক আমলের চেয়ে আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় আর কোন আমল নেই।’’ (সাহাবাগণ) বললেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদও নয় কি?’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে এমন কোন ব্যক্তি (এর আমল) যে নিজের জান-মাল সহ বের হয় এবং তারপর কিছুও সঙ্গে নিয়ে আর ফিরে আসে না।[1]
আর রোযা হল একটি নেক আমল। সুতরাং তা পালন করাও এ দিনগুলিতে মুস্তাহাব।[2]
প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) ও এই নয় দিনে রোযা পালন করতেন। তাঁর পত্নী ( হাফসাহ রাঃ) বলেন, ‘‘নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) যুল হজ্জের নয় দিন, আশূরার দিন এবং প্রত্যেক মাসের তিন দিন; মাসের প্রথম সোমবার এবং বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন।’’[3]
বাইহাকী ‘ফাযায়েলুল আওকাত’ এ বলেন, এই হাদীসটি আয়েশা (রাঃ) এর ঐ হাদীস অপেক্ষা উত্তম যাতে তিনি বলেন, ‘রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) কে (যুলহজ্জের) দশ দিনে কখনো রোযা রাখতে দেখিনি।’[4] কারণ, এ হাদীসটি ঘটনসূচক এবং তা আয়েশার ঐ অঘটনসূচক হাদীস হতে উত্তম। আর মুহাদ্দেসীনদের একটি নীতি এই যে, যখন ঘটনসূচক ও অঘটনসূচক দু’টি হাদীস পরস্পর-বিরোধী হয় তখন সমন্বয় সাধনের অন্যান্য উপায় না থাকলে ঘটনসূচক হাদীসটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কারণ কেউ যদি কিছু ঘটতে না দেখে তবে তার অর্থ এই নয় যে, তা ঘটেই নি। তাই যে ঘটতে দেখেছে তার কথাটিকে ঘটার প্রমাণস্বরূপ গ্রহণ করা হয়।
মোট কথা, যুলহজ্জ মাসের এই নয় দিনে রোযা রাখা মুস্তাহাব। ইমাম নওবী বলেন, ‘ঐ দিনগুলিতে রোযা রাখা পাকা মুস্তাহাব।’[5]
[2] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৬/৪৭১)
[3] (আবূ দাঊদ ২৪৩৭, সহীহ আবূ দাঊদ ২১২৯নং, নাসাঈ)
[4] (মুসলিম ১১৭৬, আবূ দাঊদ ২৪৩৯, তিরমিযী ৭৫৬, ইবনে মাজাহ ১৭২৯নং)
[5] (শরহুন নওবী ৮/৩২০)
আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) শা’বান মাসের অধিকাংশ দিনগুলিতে রোযা রাখতেন। মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আমি আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে রমাযান ছাড়া অন্য কোন মাস সম্পূর্ণ রোযা রাখতে দেখি নি। আর শা’বান মাস ছাড়া অন্য কোন মাসের অধিকাংশ দিনগুলিতে তাঁকে রোযা রাখতে দেখি নি।’[1]
উসামাহ বিন যায়দ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনাকে শা’বান মাসে যত রোযা রাখতে দেখি তত অন্য কোন মাসে তো রাখতে দেখি না, (এর রহস্য কি)?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘এটা তো সেই মাস, যে মাস সম্বন্ধে মানুষ উদাসীন, যা হল রজব ও রমাযানের মাঝে। আর এটা তো সেই মাস; যাতে বিশব জাহানের প্রতিপালকের নিকট আমলসমূহ পেশ করা হয়। তাই আমি পছন্দ করি যে, আমার রোযা রাখা অবস্থায় আমার আমল (আল্লাহর নিকট) পেশ করা হোক।[2]
মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট রোযা রাখার জন্য পছন্দনীয় মাস ছিল শা’বান। তিনি সে মাসের রোযাকে রমাযানের সাথে মিলিত করতেন।’[3]
এখানে তাঁর শা’বানের অধিকাংশ দিনগুলিতে রোযা এবং এই মাসের রোযার সাথে রমাযানের রোযাকে মিলিত করার হাদীসের সাথে রমাযানের ২/১ দিন আগে রোযা রাখতে নিষেধকারী হাদীসের[4] অথবা তার কৃষ্ণপক্ষের দিনগুলিতে রোযা রাখতে নিষেধকারী হাদীসের[5] কোন সংঘর্ষ বা পরস্পর-বিরোধিতা নেই। কেননা, উভয় শ্রেণীর হাদীসের মাঝে সম¦বয় সাধন সম্ভব। আর তা এইভাবে যে, ঐ দিনগুলিতে রোযা রাখা নিষিদ্ধ; যদি অভ্যাসগতভাবে কোন রোযা না পড়ে তাহলে। পক্ষান্তরে অভ্যাসগতভাবে ঐ দিনগুলিতে রোযা পড়লে রাখা বৈধ। আর সেটাই ছিল মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর আমল।[6] অর্থাৎ, তিনি অভ্যাসগতভাবে ঐ দিনগুলিতে রোযা রাখতেন। এখতিয়ার করে নয়।
অন্য দিকে এই মাসের ১৫ তারীখের রোযা রাখা এবং তাতে পৃথক কোন বৈশিষ্ট্য বা মাহাত্ম্য আছে মনে করা বিদআত; যেমন এ কথা পূর্বেও আলোচিত হয়েছে। কেননা, এ ব্যাপারে বর্ণিত কোন হাদীস সহীহ নয়।
[2] (নাসাঈ, সহীহ তারগীব, আলবানী ১০০৮নং, তামামুল মিন্নাহ, আল্লামা আলবানী ৪১২পৃঃ)
[3] (সহীহ আবূ দাঊদ ২১২৪নং)
[4] (বুখারী ১৯১৪, মুসলিম ১০৮২নং)
[5] (সহীহ আবূ দাঊদ ২০৪৯, সহীহ তিরমিযী, আলবানী ৫৯০নং)
[6] (আহকামুস সাওমি অল-ই’তিকাফ, আবূ সারী মঃ আব্দুল হাদী ১৭৪পৃঃ)
প্রত্যেক সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখা সুন্নত ও মুস্তাহাব। যেহেতু তা ছিল মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর আমল। আর দিন দুটিতে বিশবাধিপতি আল্লাহর নিকট বান্দার আমল পেশ করা হয়।
মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) সোম ও বৃহস্পতিবারে রোযা রাখাকে প্রাধান্য দিতেন।’[1]
আবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘সোম ও বৃহস্পতিবার (মানুষের) সকল আমল (আল্লাহর দরবারে) পেশ করা হয়। তাই আমি এটা পছন্দ করি যে, আমার রোযা রাখা অবস্থায় আমার আমল (তাঁর নিকট) পেশ করা হোক।’’[2]
উক্ত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতেই বর্ণিত, তিনি বলেন আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘‘প্রত্যেক সোম ও বৃহস্পতিবারে (মানুষের) সকল আমল (আল্লাহর নিকট) পেশ করা হয়। (এবং বেহেশ্তের দ্বারসমূহ উ¦মুক্ত করা হয়।) আর (ঐ উভয় দিনে) আল্লাহ আয্যা অজাল্ল্ প্রত্যেক সেই ব্যক্তিকে মার্জনা করে দেন যে কোন কিছুকে তাঁর অংশী স্থাপন করে না। তবে সেই ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না যার নিজ ভায়ের সাথে বিদ্বেষ থাকে; এই দুই ব্যক্তির জন্য (ফিরিশ্তার উদ্দেশ্যে) তিনি বলেন, উভয়ের মিলন না হওয়া পর্যন্ত ওদেরকে অবকাশ দাও। উভয়ের মিলন না হওয়া পর্যন্ত ওদেরকে অবকাশ দাও।’’[3]
আবূ কাতাদাহ (রাঃ) বলেন, ‘সোমবার রোযা রাখার ব্যাপারে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বললেন, ‘‘এটা হল সেই দিন, যেদিনে আমার জ¦ম হয়েছে এবং আমার উপর সর্বপ্রথম কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।’’ অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘‘ঐ দিনে আমি (নবীরূপে) প্রেরিত হয়েছি।’’[4]
[2] (তিরমিযী, সহীহ তারগীব, আলবানী ১০২৭নং)
[3] (আহমাদ, মুসনাদ ২/৩২৯, মুসলিম ২৫৬৫ নং, প্রমুখ)
[4] (আহমাদ, মুসনাদ ৫/২৯৭, ২৯৯, মুসলিম ১১৬২, আবূ দাঊদ ২৪২৫নং)