ঈদ হল সেই দিন পালনের নাম, যা মানুষের চিরাচরিত অভ্যাস। ঈদ মানে ফিরে আসা। যেহেতু খুশীর বার্তা নিয়ে ঈদ বাৎসরিক বারবার ফিরে আসে এবং মানুষ তা বারবার পালন করে, তাই তাকে ঈদ বলা হয়। প্রত্যেক জাতির আচরণে ঈদ পালন করার প্রথা বড় প্রাচীন। প্রত্যেক বড় বড় ঘটনা-প্রবাহকে উপলক্ষ্য করে তারই মাধ্যমে সেই স্মৃতি জাগরণ করে ঈদ (পর্ব) পালন করে থাকে এবং তাতে তারা নানা ধরনের খুশী ও আনন্দ প্রকাশ করে থাকে।
অমুসলিম জাতির পর্ব সাধারণতঃ কোন না কোন বৈষয়িক ব্যাপারের সাথে জড়িত। যেমন নওরোজ, ক্রিসমাস ডে, মাতৃদিবস, ভালোবাসা দিবস, জন্মদিন, বিবাহ-বার্ষিকী প্রভৃতি পর্ব। যেহেতু সেগুলো তাদের মনগড়া ঈদ, সেহেতু তাতে তাদের স্রেফ বস্ত্তবাদী উৎসব ও আড়ম্বরই পরিলক্ষিত হয়।
পক্ষান্তরে মুসলিম উম্মাহর ঈদ হয় কোন দ্বীনী উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে। মহান আল্লাহর কোন ইবাদত পরিপূর্ণ করে এবং তাঁর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর বিধিবদ্ধ শরীয়ত অনুযায়ী তাঁকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে তা পালন করা হয়। কেননা, মুমিনদের এ দুনিয়ায় খুশী হল একমাত্র মাওলাকে রাজী করেই। যখন মুমিন নিজ মাওলার কোন আনুগত্য পরিপূর্ণ করে এবং তার উপর তাঁর দেওয়া সওয়াব ও পুরস্কার লাভ করে তখনই খুশীর ঢল নেমে আসে তার হৃদয়-মনে। যেহেতু সে বিশ্বাস ও ভরসা রাখে সেই আনুগত্যের উপর তাঁর মাওলার অনুগ্রহ ও ক্ষমার প্রতিশ্রুতির উপর। মহান আল্লাহ বলেন,
(قُلْ بِفَضْلِ اللهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَلِكَ فَلْيَفْرَحُوْا هُوَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُوْنَ)
অর্থাৎ, তুমি বল, আল্লাহর এই অনুগ্রহ ও করুণা নিয়েই তাদেরকে খুশী হওয়া উচিত। আর তারা যা পূঞ্জীভূত করে তা (দুনিয়া) অপেক্ষা এটি শ্রেয়। (কুরআনুল কারীম ১০/৫৮)
আলী (রাঃ) বলেন, ‘যেদিন আমি আল্লাহর কোন প্রকার নাফরমানি করি না, সেদিনই আমার ঈদ।’
অন্যান্য জাতির ঈদ অনেক। কারণ, সেসব ঈদ তাদের নিজস্ব মনগড়া। কিন্তু মুসলিমদের (বাৎসরিক) মাত্র দুটি ঈদ; এর কোন তৃতীয় নেই - ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। আর এ দুটি ঈদ মহান আল্লাহরই বিধান। তিনিই বান্দার জন্য পালনীয় করেছেন। আনাস (রাঃ) বলেন, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) মদ্বীনায় আগমন করলে দেখলেন, মদ্বীনাবাসীরা দুটি ঈদ পালন করছে। তা দেখে তিনি বললেন, (জাহেলিয়াতে) তোমাদের দুটি দিন ছিল যাতে তোমরা খেলাধূলা করতে। এক্ষণে ঐ দিনের পরিবর্তে আল্লাহ তোমাদেরকে দুটি উত্তম দিন প্রদান করেছেন; ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহার দিন।’[1]
অবশ্য এ ছাড়া একটি সাপ্তাহিক ঈদ আছে। আর তা হল জুমআহর দিন। সপ্তাহান্তে একবার ফিরে আসে এই ঈদ। অবশ্য এখানে আমাদের আলোচনা হবে ঈদুল ফিত্বর নিয়ে।([2])
([2]( ঈদুল আযহা নিয়ে আলোচনা ‘যুল-হজ্জের তের দিন’-এ দরষ্টব্য।
ঈদের খুশীর প্রধান অঙ্গ হল, ঈদের নামায। এই নামায বিধিবদ্ধ হয় হিজরীর প্রথম সনেই। এ নামায ২ রাকআত সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তাঁর জীবনের প্রত্যেক ঈদেই এ নামায আদায় করেছেন এবং পুরুষ ও মহিলা সকলকেই এ নামায আদায় করার জন্য (ঈদগাহে) বের হতে আদেশ করেছেন।[1]
সত্যানুসন্ধানী বহু উলামা ঈদের নামাযকে ওয়াজেব মনে করেন; যা কোন ওযর ছাড়া মাফ নয়। তাঁরা এর কারণ দর্শিয়ে বলেন, যেহেতু মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তাঁর জীবনে প্রত্যেকটি ঈদে এ নামায আদায় করেছেন এবং কোন ঈদেই তা ত্যাগ করেন নি। মহিলাদেরকে এ নামায আদায় করার লক্ষ্যে ঘর থেকে বের হতে আদেশ করেছেন। আর আদেশ করার মানেই হল তা ওয়াজেব। তাছাড়া ঈদের নামায হল ইসলামের অন্যতম প্রতীক। আর দ্বীনের প্রতীক ওয়াজেব ছাড়া আর কি হতে পারে? যেমন ঈদ ও জুমআহ একই দিনে একত্রিত হলে এবং ঈদের নামায আদায় করলে আর জুমআহ না পড়লেও চলে। আর এ কথা বিদিত যে, কোন নফল আমল কোন ফরয আমলকে গুরুত্বহীন করতে পারে না।[2]
কিন্তু যাঁরা বলেন, ঈদের নামায ওয়াজেব নয়; বরং তা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ, তাঁরা দলীলস্বরূপ সেই আরব বেদুইনের হাদীসটি পেশ করেন, যে হাদীসে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) ঐ বেদুইনকে ইসলামের ফরয আমল শিক্ষা দিলেন এবং তার মধ্যে ৫ অক্ত্ নামাযও শামিল ছিল। বেদুইন তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, এ ছাড়া কি আমার উপর অন্য কিছু ফরয আছে? উত্তরে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘‘না, অবশ্য তুমি যদি নফল হিসাবে পড়, (তাহলে সে কথা আলাদা।)’’[3] অতএব বুঝা গেল যে, ৫ অক্ত্ নামায ছাড়া অন্য কোন নামায ফরয বা ওয়াজেব নয়।
ঈদের নামায ওয়াজেব না হলেও তার পৃথক বৈশিষ্ট্য ও বড় গুরুত্ব রয়েছে। আর আল্লাহই ভাল জানেন।
[2] (দ্রঃ মাজমূ’ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ ২৩/১৬১, কিতাবুস সালাহ, ইবনুল কাইয়্যেম ইবনুল কাইয়্যেম ১১পৃঃ, নাইলুল আওতার, ইমাম শওকানী ৩/৩১০-৩১১, আশ্শারহুল মুমতে’ ৫/১৫১, তামামুল মিন্নাহ, আল্লামা আলবানী ৩৪৪পৃঃ, ফাসিঃ মুসনিদ ১১৬পৃঃ)
[3] (বুখারী ৪৬, মুসলিম ১১নং)
ঈদের নামাযের জন্য গোসল করা মুস্তাহাব। ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত যে, তিনি ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন।[1]
সাঈদ বিন মুসাইয়াব থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘ঈদুল ফিতরের সুন্নত হল ৩টি; পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া, যাওয়ার আগে কিছু খাওয়া এবং গোসল করা।’[2] আর সম্ভবতঃ তিনি এ সুন্নত ৩টি কোন কোন সাহাবা থেকে গ্রহণ করেছেন।
ইমাম নওবী ঈদের নামাযের জন্য গোসল করা মুস্তাহাব হওয়ার ব্যাপারে উলামাগণ একমত আছেন বলে উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া যে অর্থে জুমআহ ইত্যাদি সাধারণ সমাবেশের জন্য গোসল করা মুস্তাহাব, সেই অর্থ ঈদেও বর্তমান। বরং সেই অর্থ ঈদে অধিকতর স্পষ্ট।[3]
[2] (ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩/১০৪)
[3] (দুরুসু রামাযান অকাফাত লিস্-সায়েমীন ৯৭পৃঃ)
সহীহ বুখারীতে ‘ঈদ ও তার জন্য সাজসজ্জা গ্রহণ’-এর বাবে বর্ণিত আষারে আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) বলেন, একদা উমার (রাঃ) একটি মোটা রেশমের তৈরী জুববা বাজারে বিক্রয় হতে দেখে তিনি তা নিয়ে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনি এটা ক্রয় করে নিন। এটি ঈদ ও বহিরাগত রাজ-প্রতিনিধিদের জন্য পরিধান করে সৌন্দর্য ধারণ করবেন।’ কিন্তু তিনি বললেন, ‘‘এটি তো তাদের লেবাস, যাদের (পরকালে) কোন অংশ নেই।’’[1]
ইবনে কুদামাহ বলেন, এই হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, উক্ত সময়ে সৌন্দর্য ধারণ করা তাঁদের নিকট প্রচলিত ছিল।[2] উক্ত ঘটনায় আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) সৌন্দর্য ধারণের ব্যাপারে আপত্তি জানালেন না। কিন্তু তা ক্রয় করতে আপত্তি জানালেন; কেননা তা ছিল রেশমের তৈরী।[3]
ত্বাবারানীতে ইবনে আববাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত আছে যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) ঈদের দিনে একটি লাল রঙের চেক-কাটা চাদর পরতেন।[4]
ইবনে উমার (রাঃ) ঈদের জন্য তাঁর সবচেয়ে বেশী সুন্দর লেবাসটি পরিধান করতেন।[5]
আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ) উভয় ঈদে তাঁর সব চাইতে বেশী সুন্দর পোশাকটি পরিধান করতেন।[6]
ইমাম মালেক বলেন, ‘আমি আহলে ইল্মদের কাছে শুনেছি, তাঁরা প্রত্যেক ঈদে সাজসজ্জা ও সুগন্ধি ব্যবহারকে মুস্তাহাব মনে করতেন।’
সুতরাং পুরুষের জন্য উচিত হল, ঈদের নামাযের জন্য বের হওয়ার আগে তার সব চাইতে সুন্দর পোশাকটি পরিধান করবে। অবশ্য মহিলারা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় (ভিতর বাহিরের) সর্বপ্রকার সৌন্দর্য প্রদর্শন থেকে দূরে থাকবে। যেহেতু বেগানা পুরুষের সম্মুখে মহিলার সৌন্দর্য প্রকাশ করা হারাম। অনুরূপ হারাম - ঘর থেকে বের হওয়ার আগে কোন প্রকার সে¦ট্, পারফিউম, আতর বা সুগন্ধময় ক্রিম-পাউডার অথবা অন্য কোন প্রসাধন ব্যবহার। যেমন, বাইরে বের হয়ে তার চলনে, বলনে, ভাবে, ভঙ্গিমায় যেন-তেন প্রকারে কোন পুরুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করাও বৈধ নয়। যেহেতু সে তো সে সময় কেবল মহান আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য করার উদ্দেশ্যেই বের হয়। তাহলে যে মুমিন মহিলা তাঁর আনুগত্যে সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে বের হয়, সে আবার তাঁরই নাফরমানি করে টাইটফিট্ বা চুস্ত্ অথবা দৃষ্টি-আকর্ষক রঙিন পোশাক পরিধান করে কি করে অথবা সুগন্ধি ব্যবহার করে বের হয় কিভাবে?[7]
[2] (আল-মুগনী ৩/২৫৭)
[3] (দুরুসু রামাযান অকাফাত লিস্-সায়েমীন ৯৯পৃঃ)
[4] (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ১২৭৯নং দ্রঃ)
[5] (বাইহাকী ৩/২৮১)
[6] (বাইহাকী, ফাতহুল বারী ২/৫১০)
[7] (দুরুসু রামাযান অকাফাত লিস্-সায়েমীন ৯৯-১০০পৃঃ)
ঈদগাহের জন্য বের হওয়ার পূর্বে ৩ অথবা ৫ বেজোড় সংখ্যক খেজুর খাওয়া মুস্তাহাব। আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) ঈদুল ফিতরের দিন কিছু খেজুর না খেয়ে বের হতেন না।’ এক বর্ণনায় আছে যে, ‘তিনি তা বেজোড় সংখ্যক খেতেন।’[1]
এই খাওয়ার পিছনে হিকমত হল, যাতে কেউ মনে না করে যে, ঈদের নামায পর্যন্ত রোযা রাখতে হয়। আর এতে রয়েছে রোযা ভেঙ্গে সত্বর মহান আল্লাহর হুকুম পালন।[2]
কোন কোন উলামা মনে করেন যে, যদি কেউ ফজর উদয় হওয়ার পরে এবং ফজরের নামায পড়ার আগেও খেয়ে নেয়, তাহলে উদ্দেশ্য সফল হয়ে যাবে। কারণ, সে অবস্থায় সে দিনের বেলায় খেয়েছে বলেই বিবেচিত হবে। অবশ্য উত্তম হল, ঈদগাহে বের হওয়ার অব্যবহিত পূর্বেই তা খাওয়া।[3]
প্রকাশ থাকে যে, খেজুর না পাওয়া গেলে যে কোন খাবার খেলেই যথেষ্ট হবে।
[2] (ফাতহুল বারী ২/৫১৮)
[3] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৫/১৬১)
সুন্নত এই যে, ঈদের নামাযের জন্য গ্রাম-শহরের বাইরে ঈদগাহ হবে। যেহেতু মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) উভয় ঈদের দিন মসজিদ ত্যাগ করে ঈদগাহে বের হতেন। অনুরূপ আমল ছিল খুলাফায়ে রাশেদ্বীনের এবং তাঁদের পরবর্তীদের।[1]
পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া মুস্তাহাব। ইবনে উমার ও অন্যান্য সাহাবা y কর্তৃক বর্ণিত যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যেতেন এবং পায়ে হেঁটেই বাড়ি ফিরতেন।[1]
আলী (রাঃ) বলেন, ‘একটি সুন্নত হল, পায়ে হেঁটে ঈদগাহ যাওয়া।’[2]
এ ছাড়া সাঈদ বিন মুসাইয়েবের উক্তি পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে; তিনি বলেছেন, ‘ঈদুল ফিতরের সুন্নত হল ৩টি; পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া, যাওয়ার আগে কিছু খাওয়া এবং গোসল করা।’[3] যুহরী বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) কখনো জানাযায় অথবা ঈদুল ফিতরে অথবা ঈদুল আযহায় সওয়ার হয়ে যান নি।’[4] ইমাম আহমাদ বলেন, ‘আমরা হেঁটে যাই, আমাদের ঈদগাহ নিকটে। দূরে হলে সওয়ার হয়ে যাওয়ায় দোষ নেই।’[5]
[2] (তিরমিযী ৫৩০, সহীহ ইবনে মাজাহ, আলবানী ১০৭২, বাইহাকী ৩/২৮১)
[3] (ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩/১০৪)
[4] (ঐ ৩/১০৩)
[5] (আল-মুগনী ২/৩৭৪)
শিশু ও মহিলার জন্যও ঈদগাহে যাওয়া বিধেয়। চাহে মহিলা কুমারী হোক অথবা অকুমারী, যুবতী হোক অথবা বৃদ্ধা, পবিত্রা হোক অথবা ঋতুমতী। উম্মে আতিয়্যাহ বলেন, ‘আমাদেরকে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) আদেশ দিয়েছেন যে, আমরা যেন মহিলাদেরকে উভয় ঈদে (ঘর থেকে ঈদগাহে) বের করি। তবে ঋতুমতী মহিলা নামাযের স্থান থেকে দূরে থাকবে। তারা অন্যান্য মঙ্গল ও মুসলিমদের দুআর জন্য উপস্থিত হবে। তারা পুরুষদের পিছনে অবস্থান করবে। পুরুষদের সাথে তারাও (নিঃশব্দে) তকবীর পাঠ করবে।’
তিনি বলেন, আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমাদের কারো কারো চাদর না থাকলে?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘তার কোন বোন তাকে নিজ (অতিরিক্ত অথবা পরিহিত বড়) চাদর পরতে দেবে।’’[1]
ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) নিজ কন্যা ও স্ত্রীদেরকে উভয় ঈদে ঈদগাহে বের হতে আদেশ দিতেন।’[2]
বিদিত যে, ঈদগাহে বের হলে মহিলাদের জন্য পর্দা গ্রহণ করা ওয়াজেব। বেপর্দা হয়ে, সে¦ট বা আতর ব্যবহার করে, পুরুষদের দৃষ্টি-আকর্ষী সাজ-সজ্জা করে বের হওয়া বৈধ নয়। বৈধ নয় পুরুষদের পাশাপাশি চলা, তাদের ভিড়ে প্রবেশ করা।
বলা বাহুল্য, পরবর্তী যুগে মহিলা দ্বারা নানা ফাসাদ ও অঘটন ঘটার ফলে যাঁরা তাদেরকে ঈদগাহে যেতে বাধা দেন বা অবৈধ মনে করেন, তাঁদের মত সঠিক নয়। অবশ্য যদি তাঁরা কেবল বেপর্দা মহিলা এবং পর্দায় ঢিল মারে এমন মহিলাদের ক্ষেত্রে ঐ বাধা প্রয়োগ করেন, তাহলে তা সঠিক বলে সকলে মেনে নেবে।[3] পক্ষান্তরে পর্দানশীন মহিলা সহ সকল মহিলার জন্য ঐ বাধা ব্যাপক করা শুদ্ধ নয়। কারণ, মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে বের হতে আদেশ করেছেন। এমন কি শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রঃ) বলেছেন, ‘মহিলাদের জন্য ঈদগাহে বের হওয়া ওয়াজেবও বলা যেতে পারে।’[4]
অতএব স্পষ্ট যে, ঈদের নামায আদায়ের জন্য মহিলাদের মসজিদে অথবা কোন ঘরে জমায়েত হয়ে পৃথকভাবে জামাআত করা এবং মুসলিমদের সাধারণ জামাআতের সাথে তাদের বের না হওয়া মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর আদেশের পরিপন্থী কাজ। উচিত হল, মহিলাদেরকে পর্দা করা এবং ঈদগাহেও পর্দার ব্যবস্থা করা।
[2] (আহমাদ, মুসনাদ ১/২৩১, ইবনে আবী শাইবাহ, মুসান্নাফ প্রমুখ, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২১১৫, সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৪৮৮৮নং)
[3] (আসইলাতুন অআজবিবাতুন ফী সবলাতিল ঈদাঈন ২৬পৃঃ, মাজাল্লাতুল বায়ান ১৩৬/২৫)
[4] (আল-ইখতিয়ারাতুল ফিকহিয়্যাহ, ইবনে তাইমিয়্যাহ ৮২পৃঃ, মাজাল্লাতুল বায়ান ১৩৬/২৫)
শেষ রোযার দিন সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকে ঈদের নামায শুরু হওয়া পর্যন্ত তকবীর পাঠ করা বিধেয়। এর দলীল মহান আল্লাহর স্পষ্ট বাণীঃ
(وَلِتُكْمِلُوا الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ)
অর্থাৎ, যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করে নিতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন তার জন্য তোমরা আল্লাহর তকবীর পাঠ কর এবং যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার।
(কুরআনুল কারীম ২/১৮৫)
কোন কোন উলামা বলেন, এই তকবীর পাঠ করা ওয়াজেব। অবশ্য তা একবার পাঠ করলেই ওয়াজেব পালনে যথেষ্ট হবে।[1]
এই তকবীর আল্লাহর তা’যীম ঘোষণা এবং তাঁর ইবাদত ও শুকরিয়া প্রকাশের উদ্দেশ্যে পুরুষের জন্য মসজিদে, ঘরে, বাজারে ও রাস্তা-ঘাটে উচ্চস্বরে পাঠ করা সুন্নত। সলফদের নিকট ঈদগাহের প্রতি বের হওয়া থেকে শুরু করে ইমাম আসার আগে পর্যন্ত উক্ত তকবীর পাঠ করার কথা অতিশয় প্রসিদ্ধ ছিল। এ কথা সলফদের আমল বর্ণনাকারী এক জামাআত গ্রন্থকার; যেমন ইবনে আবী শাইবাহ, আব্দুর রায্যাক ও ফিরয়াবী তাঁদের এ আমল নিজ নিজ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। আর মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) কর্তৃকও এ কথা সরাসরিভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।[2]
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) উচ্চস্বরে তকবীর পাঠ করতে করতে উভয় ঈদে বের হতেন।[3]
[2] (ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩/১২১-১২৩, আল্লামা আলবানী এ ব্যাপারে মারফূ’ ও মাওকূফ উভয় সূত্রকে সহীহ বলেছেন।)
[3] (সহীহুল জামেইস সাগীর, আলবানী ৪৯৩৪নং)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) তকবীর পাঠ করে বলতেন,
(اللهُ أَكْبَر، اَللهُ أَكْبَر، لاَ إِلهَ إِلاَّ الله وَالله أَكْبَر، اَلله أَكْبَر، وَللهِ الْـحَمْد).
‘আল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু অল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার অলিল্লাহিল হাম্দ।’[1]
ইবনে আববাস (রাঃ) বলতেন,
(اللهُ أَكْبَر، اَللهُ أَكْبَر، اَلله أَكْبَر، وَللهِ الْحَمْد، اَللهُ أَكْبَر وَأَجَلُّ، اَلله أَكْبَر عَلىَ مَا هَدَانَا)
‘আল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার, অলিল্লাহিল হাম্দ। আল্লা-হু আকবার অ আজাল্ল্, আল্লাহু আকবার আলা মা হাদা-না।’[2]
অন্য এক বর্ণনায় আছে,
(اللهُ أَكْبَر كَبِيْراً، اَلله أَكْبَركَبِيْراً، اَللهُ أَكْبَر وَأَجَلُّ، اَلله أَكْبَر، وَللهِ الْـحَمْد)
‘আল্লা-হু আকবার কাবীরা, আল্লা-হু আকবার কাবীরা, আল্লা-হু আকবার অ আজাল্ল্, আল্লাহু আকবার, অলিল্লাহিল হাম্দ।’[3]
মহিলারাও এই তকবীর পাঠ করবে, তবে নিম্নস্বরে। যাতে গায়র মাহরাম কোন পুরুষ তার এই তকবীর পাঠের শব্দ না শুনতে পায়। উম্মে আতিয়্যাহ (রাঃ) বলেন, ‘--- এমনকি আমরা ঋতুমতী মহিলাদেরকেও ঈদগাহে বের করতাম। তারা পুরুষদের পিছনে অবস্থান করত; তাদের তকবীর পড়া শুনে তারাও তকবীর পাঠ করত এবং তাদের দুআ শুনে তারাও দুআ করত। তারা ঐ দিনের বর্কত ও পবিত্রতা আশা করত।’[4]
পক্ষান্তরে সমবেত কণ্ঠে সমস্বরে জামাআতী তকবীর অথবা একজন বলার পর অন্য সকলের একই সাথে তকবীর পাঠ বিদআত। যেহেতু যিক্র-আযকারে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর আদর্শ হল, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ যিক্র একাকী পাঠ করবে। সুতরাং তাঁর ও তাঁর সাহাবাদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়া কারো জন্য উচিত নয়।[5]
[2] (বাইহাকী ৩/৩১৫, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩/১২৫)
[3] (ইবনে আবী শাইবাহ, মুসান্নাফ ৫৬৪৫, ৫৬৫৪, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩/১২৫)
[4] (বুখারী ৯৭১, মুসলিম ৮৯০নং)
[5] (আসইলাতুন অআজবিবাতুন ফী সবলাতিল ঈদাঈন ৩১-৩২পৃঃ)