মাহাত্ম্যপূর্ণ রমাযান মাসে কি কি নেক কাজ করা কর্তব্য তা উল্লেখ করার পূর্বে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়ঃ-
(এই মৌসমের মূল্য ও মাহাত্ম্য প্রকৃতভাবে উপলব্ধি করা। আপনি এ কথা স্মরণে রাখবেন যে, যদি এই সওয়াবের মৌসম আপনার হাত ছাড়া হয়ে যায়, তাহলে তা পুনরায় ফিরে পাওয়ার কোন নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া এটি হল সংকীর্ণ সময়ের একটি সুবর্ণ সুযোগ। আল্লাহ সত্যই বলেছেন,
(أَيَّاماً مَعْدُودَاتٍ)
‘‘তা গোনা-গাঁথা কয়েকটি দিন।’’ (কুরআনুল কারীম ২/১৮৪)
‘রমাযান এসে গেল’ এবং ‘রমাযান শেষ হয়ে গেল’ লোকেদের এই উভয় উক্তির মাঝে ব্যবধান কত সংকীর্ণ! এ ক্ষেত্রে সাধারণভাবে অস্পষ্ট উপলব্ধি থাকা যথেষ্ট নয় যে, রমাযান মাস হল একটি মাহাত্ম্যপূর্ণ মৌসম।
- মর্যাদা ও সওয়াবের দিক থেকে আমলসমূহের মাঝে তারতম্য আছে। সুতরাং তাতে কোন আমল বড়। আবার কোন আমল ছোট। কোন আমল আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়; কিন্তু অন্য কোন আমল তাঁর নিকট অধিক পছন্দনীয়। অতএব মুসলিমের উচিৎ, সেই আমল করতে অধিক চেষ্টা ও যত্নবান হওয়া, যা সবার চাইতে শ্রেষ্ঠ আমল, মহান আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় এবং সওয়াবের দিক থেকে অধিক মর্যাদাসমৃদ্ধ।[1]
সলফে সালেহীন প্রত্যেক আমলকে পূর্ণাঙ্গ ও সুনিপুণ করার জন্য যথাসাধ্য প্রয়াস চালাতেন। তারপরেও তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে কি না তা নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত থাকতেন। ভয় করতেন যে, তাঁর সে আমল হয়তো প্রত্যাখ্যাত হবে। আর তাঁরা তো তাঁরা, যাঁরা
(وَالَّذِينَ يُؤْتُونَ مَا آتَوْا وَقُلُوبُهُمْ وَجِلَةٌ)
‘‘সশঙ্ক ও ভীত-কম্পিত হৃদয়ে দান করে।’’ (কুরআনুল কারীম ২৩/৬০)
আলী (রাঃ) বলেন, ‘আমল করার চাইতে তার কবুল হওয়ার ব্যাপারে অধিক যত্নবান হও। তোমরা কি শুননি, মহান আল্লাহ বলেন,
(إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ)
অর্থাৎ, আল্লাহ কেবল মুত্তাকী (পরহেযগার) লোকদের কাছ থেকেই (আমল) গ্রহণ করে থাকেন।’ (কুরআনুল কারীম ৫/২৭)
হাসান বাসরী (রঃ) বলেন, ‘মহান আল্লাহ রমাযান মাসকে তাঁর বান্দাদের জন্য প্রতিযোগিতার ময়দান স্বরূপ নির্ধারিত করেছেন; যার মধ্যে তারা তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আপোসে প্রতিযোগিতা করতে পারে। বলা বাহুল্য, কিছু লোক অগ্রবর্তী হয়ে সফলকাম হয়েছে এবং অন্য কিছু লোক পশ্চাদ্বর্তী হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতএব অবাক লাগে সেই খেল-তামাশায় মত্ত ব্যক্তিকে দেখে; যে সেই দিনেও নিজ খেলায় মত্ত থাকে, যেদিনে সৎকর্মশীলরা সাফল্য লাভ করেন এবং অকর্মণ্যরা হয় ক্ষতিগ্রস্ত।’[2]
[2] (আল-আশরুল আওয়াখিরু মিন রামাযান থেকে উদ্ধৃত)
কিয়ামে রামাযান বা রমাযানের কিয়ামকে স্বালাতুত তারাবীহ বা তারাবীহর নামায বলা হয়। ‘তারাবীহ’ মানে হল আরাম করা। যেহেতু সলফে সালেহীনগণ ৪ রাকআত নামায পড়ে বিরতির সাথে বসে একটু আরাম নিতেন, তাই তার নামও হয়েছে তারাবীহর নামায। আর ঐ আরাম নেওয়ার দলীল হল মা আয়েশার হাদীস; যাতে তিনি বলেন, ‘নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) ৪ রাকআত নামায পড়তেন। সুতরাং তুমি সেই নামাযের সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করো না। (অর্থাৎ অত্যন্ত সুন্দর ও দীর্ঘ হত।) অতঃপর তিনি ৪ রাকআত নামায পড়তেন। সুতরাং তুমি সেই নামাযের সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করো না। অতঃপর তিনি ৩ রাকআত (বিত্র) নামায পড়তেন।’[1]
উক্ত হাদীসের মানে হল, তিনি প্রথম ৪ রাকআত নামাযকে এক সময়ে একটানা পড়েছেন। অর্থাৎ, তিনি ২ রাকআত নামায পড়ার পর সাথে সাথেই আবার ২ রাকআত নামায পড়তেন। অতঃপর বসে বিরতি নিতেন। অতঃপর তিনি উঠে পুনরায় ২ রাকআত নামায পড়ার পর সাথে সাথে আবার ২ রাকআত পড়তেন। অতঃপর আবার বসে একটু জিড়িয়ে নিতেন এবং সবশেষে ৩ রাকআত বিত্র পড়তেন। এখান থেকেই সলফগণ ১১ রাকআত নামাযের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন এবং তাই তাঁরা প্রথমে ২ সালামে ৪ রাকআত নামায পড়ে একটু আরাম নেন। অতঃপর আবার ২ সালামে ৪ রাকআত নামায পড়ে পরিশেষে ৩ রাকআত বিত্র পড়েন।[2]
[2] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৪/১৩, ৬৫, ৬৭)
তারাবীহর নামায নারী-পুরুষ সকলের জন্য সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। বহু হাদীসগ্রন্থে আবূ হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) কিয়ামে রামাযানের ব্যাপারে (সকলকে) উৎসাহিত করতেন; কিন্তু তিনি বাধ্যতামূলকরূপে আদেশ দিতেন না। তিনি বলতেন, ‘‘যে ব্যক্তি ঈমান রেখে সওয়াবের আশায় রমাযানের কিয়াম করবে, সে ব্যক্তির পূর্বকৃত পাপসমূহ মাফ হয়ে যাবে।’’[1]
আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘একদা নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) মসজিদে নামায পড়লেন। তাঁর অনুসরণ (ইক্তিদা) করে অনেক লোক নামায পড়ল। অতঃপর পরের রাতে নামায পড়লে লোক আরো বেশী হল। তৃতীয় রাতে লোকেরা জমায়েত হলে তিনি বাসা থেকে বের হলেন না। ফজরের সময় তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘‘আমি তোমাদের আগ্রহ লক্ষ্য করেছি। তোমাদের নিকট (নামাযের জন্য) বের হতে আমার কোন বাধা ছিল না। কিন্তু আমি আশঙ্কা করলাম যে, ঐ নামায তোমাদের জন্য ফরয করে দেওয়া হবে।’’ আর এ ঘটনা হল রমাযানের।’[2]
[2] (বুখারী ২০১২, মুসলিম ৭৬১নং)
তারাবীহর নামায আদায় করার সময় হল, রমাযানের (চাঁদ দেখার রাত সহ) প্রত্যেক রাত্রে এশার ফরয ও সুন্নত নামাযের পর বিত্র পড়ার আগে। অবশ্য শেষ রাত্রে ফজর উদয় হওয়ার আগে পর্যন্ত এর সময় বিস্থির্ণ। যেহেতু মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) প্রথম রাত্রে তার প্রথম ভাগে শুরু করে রাত্রের এক-তৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়া পর্যন্ত নামায পড়েছিলেন। দ্বিতীয় রাত্রেও তার প্রথম ভাগে শুরু করে রাত্রের অর্ধেকাংশ অতিবাহিত হওয়া পর্যন্ত নামায পড়েছিলেন এবং তৃতীয় রাত্রে তার প্রথম ভাগে শুরু করে শেষ রাত অবধি নামায পড়েছিলেন।[1]
আর উমার (রাঃ) বলেন, ‘রাতের প্রথম ভাগে নামায অপেক্ষা তার শেষ ভাগের নামাযই অধিক উত্তম।’ অবশ্য লোকেরা তাঁর খেলাফতকালে রাত্রের প্রথম ভাগেই তারাবীহ পড়ত।[2]
[2] (বুখারী ২০১০নং)
নিয়ত মানে মনের সংকল্প। আর তার স্থান হল অন্তর; মুখ নয়। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) ও তাঁর সাহাবাদের কেউই কোন নির্দিষ্ট শব্দ মুখে উচ্চারণ করতেন না। তাই তা মুখে উচ্চারণ করা বিদআত। তাছাড়া নিয়তের জন্য কোন বাঁধা-ধরা শব্দাবলীও নেই।
জ্ঞাতব্য যে, তারাবীহর শুরুতেই কেউ যদি সমস্ত নামাযের একবার নিয়ত করে নেয়, তাহলে তাই যথেষ্ট। প্রত্যেক ২ রাকআতে নিয়ত করা জরুরী নয়। অবশ্য নামায পড়তে পড়তে কেউ কোন প্রয়োজনে তা ছেড়ে দিয়ে পুনরায় পড়তে লাগলে নতুন নিয়তের দরকার।
সতর্কতার বিষয় যে, নিয়ত করা জরুরী; কিন্তু পড়া বিদআত।
সুন্নত ও আফযল হল এই নামায বিত্র সহ ১১ রাকআত পড়া। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর রাতের নামায সম্বন্ধে সর্বাধিক বেশী খবর রাখতেন যিনি, সেই আয়েশা (রাঃ)কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, রমাযানে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর নামায কত রাকআত ছিল? উত্তরে তিনি বললেন, ‘তিনি রমাযানে এবং অন্যান্য মাসেও ১১ রাকআত অপেক্ষা বেশী নামায পড়তেন না।’[1]
সায়েব বিন ইয়াযীদ বলেন, ‘(খলীফা) উমার উবাই বিন কা’ব ও তামীম আদ্-দারীকে আদেশ করেছিলেন, যেন তাঁরা রমাযানে লোকদের নিয়ে ১১ রাকআত তারাবীহ পড়েন।’[2]
কিছু উলামা বলেন, কিন্তু যদি কেউ তার চাইতে বেশী নামায পড়তে চায়, তাহলে তাতে কোন বাধা ও ক্ষতি নেই। কারণ, রাতের নামায প্রসঙ্গে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বললেন, ‘‘রাতের নামায ২ রাকআত ২ রাকআত করে। অতঃপর তোমাদের কেউ যখন ফজর হয়ে যাওয়ার ভয় করে, তখন সে যেন ১ রাকআত বিত্র পড়ে নেয়। এতে তার পড়া নামাযগুলো বেজোড় হয়ে যাবে।’’[3] বলা বাহুল্য, উক্ত নির্দেশ দেওয়ার সময় তিনি রাতের নামাযের কোন নির্দিষ্ট রাকআত নির্ধারিত করেননি; না রমাযানের এবং না অরমাযানের।
তাছাড়া খোদ মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) কখনো কখনো ১৩ রাকআত নামাযও পড়েছেন। আর তা এ কথারই দলীল যে, রাতের নামাযের ব্যাপারে কোন সংকীর্ণতা নেই; অর্থাৎ তার এমন কোন নির্দিষ্ট রাকআত-সংখ্যা নেই যার অন্যথা করা যাবে না। তবে অবশ্য সেই সংখ্যার নামায পড়তে অভ্যাসী হওয়া অধিক উত্তম ও পূর্ণাঙ্গ আমল, যে সংখ্যার কথা মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর সুন্নাহতে (খোদ আমলে) এসেছে। পরন্তু সেই সাথে নামায এমন ধীরে-সুস্থে ও লম্বা করে পড়া উচিৎ, যাতে নামাযীদের কষ্টবোধ না হয়। আর এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, উক্ত (১১ রাকআত) সংখ্যাই সাধারণ মানুষের জন্য অধিকতর সহজ এবং ইমামের জন্যও অধিক উপযোগী। এতে সকলের রুকূ, সিজদা ও কিরাআতে বিনয় রাখা, ধীরে ধীরে স্পষ্টভাবে কুরআন পড়া ও তার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা এবং প্রত্যেক বিষয়ে তাড়াহুড়া না করার ব্যাপারে বড় সহযোগিতা পাওয়া যাবে।[4]
পক্ষান্তরে ২০ রাকআত তারাবীহ নির্দিষ্ট হওয়ার ব্যাপারে কোন হাদীস নেই। সাহাবাদের তরফ থেকে যে আসার বর্ণিত করা হয়, তার সবগুলিই যয়ীফ।[5]
[2] (মালেক, মুওয়াত্তা ২৪৯নং, বাইহাকী ২/৪৯৬)
[3] (বুখারী ৯৯০, মুসলিম ৭৪৯নং)
[4] (দ্রঃ আশ্শারহুল মুমতে’ ৪/৭০, ৭৩, ইবনে বায সালাতুল লাইল, আলবানী ৫পৃঃ, রিসালাতানি মু’জাযাতানি ফিয যাকাতি অস্সিয়াম ২৬পৃঃ, ফুসূলুন ফিস্-সিয়ামি অত্-তারাবীহি অয্-যাকাহ ১৭পৃঃ)
[5] (মুহাদ্দিস আল্লামা আলবানীর পুস্তিকা ‘স্বালাতুত তারাবীহ’ দ্রষ্টব্য)
রমাযানের কিয়াম জামাআতে পড়া বিধেয়; যেমন একাকী পড়াও বৈধ। তবে মসজিদে জামাআত সহকারে এই নামায আদায় করাই (অধিকাংশ উলামার মতে) উত্তম। পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে যে, রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) সাহাবাদেরকে নিয়ে উক্ত নামায জামাআত সহকারে আদায় করেছেন। অবশ্য তা ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তিনি জামাআত করে পড়া বর্জন করেছিলেন। অতঃপর আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর ইন্তেকাল হল। তখনও ঐ নামাযের অবস্থা অনুরূপ জামাআতহীন ছিল। অনুরূপ ছিল আবূ বাকরের খিলাফতকালে এবং উমারের খিলাফতের প্রথম দিকেও একই অবস্থা ছিল। অতঃপর উমার (রাঃ) সকলকে একটি ইমামের পশ্চাতে জামাআতবদ্ধ করলেন।
আব্দুর রহমান বিন আব্দ্ আলক্বারী বলেন, একদা রমাযানের রাত্রে উমার বিন খাত্তাবের সাথে মসজিদে গেলাম; দেখলাম, লোকেরা ছিন্ন ছিন্ন বিভিন্ন জামাআতে বিভক্ত। কেউ তো একাকী নামায পড়ছে। কারো নামাযের ইক্তিদা করে কিছু লোক জামাআত করে নামায পড়ছে। তা দেখে উমার বললেন, ‘আমি মনে করি, যদি ওদেরকে একটি ক্বারী (ইমামের) পশ্চাতে জামাআতবদ্ধ করে দিই, তাহলে তা উত্তম হবে।’ অতঃপর তিনি তাতে সংকল্পবদ্ধ হয়ে উবাই বিন কা’বের ইমামতিতে সকলকে এক জামাআতবদ্ধ করলেন। তারপর আর এক রাত্রিতে আমি তাঁর সাথে বের হয়ে গেলাম। তখন লোকেরা তাদের ইমামের পশ্চাতে জামাআত সহকারে নামায পড়ছে। তা দেখে উমার বললেন, ‘এটা একটি উত্তম আবিষ্কার।’[1]
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি ইমামের সাথে নামায পড়ে এবং তার নামায শেষ করা পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকে (ইক্তিদা করে), সেই ব্যক্তির জন্য সারা রাত্রি কিয়াম করার সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হয়।’’[2] এই হাদীসও প্রমাণ করে যে, তারাবীহর নামাযের জামাআত ও ইমাম আছে।
[2] (আহমাদ, মুসনাদ, সহীহ আবূ দাঊদ ১২২৭, সহীহ তিরমিযী, আলবানী ৬৪৬, সহীহ নাসাঈ, আলবানী ১৫১৪, সহীহ ইবনে মাজাহ, আলবানী ১৩২৭নং)
যদি কোন ফিতনা সৃষ্টির আশঙ্কা না থাকে, তাহলে তারাবীহর জামাআতে মহিলাদের উপস্থিত হওয়া দোষাবহ নয়। অবশ্য শর্ত হল, তারা যেন সম্ভ্রমপূর্ণ লেবাস পরিধান করে, বেপর্দা হয়ে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে এবং কোন প্রকারের সুবাস ও সুগন্ধি ব্যবহার না করে মসজিদে যায়।[1] মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘যে মহিলা সুগন্ধি ব্যবহার করেছে, সে যেন আমাদের সাথে এশার নামাযে উপস্থিত না হয়।’’[2]
এতদ্সত্ত্বেও সবগৃহে নামায পড়াই তাদের জন্য উত্তম। প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘তোমরা তোমাদের মহিলাদেরকে মসজিদে যেতে বাধা দিও না। অবশ্য তাদের ঘরই তাদের জন্য উত্তম।’’[3]
মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) শেষ রাত্রে নামায পড়তে দাঁড়িয়ে তাঁর সাথে তাঁর পরিবার ও স্ত্রীগণকে এবং সেই সাথে সাহাবাবর্গকে নিয়ে জামাআত করে নামায পড়েছিলেন।[4]
বলা বাহুল্য, জ্ঞানী মহিলার উচিৎ, মসজিদে উপস্থিত হয়ে নামায পড়া তার জন্য উত্তম মনে করে, তাহলে সে যেন সেই আকার ও লেবাসে বের হয়, যে আকার ও লেবাস সলফদের মহিলারা মসজিদে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করতেন।
মহিলার জন্য জরুরী, মসজিদে যাওয়ার পথে সৎ-নিয়ত মনে উপস্থিত রাখা। তাকে মনে রাখতে হবে যে, সে মসজিদে নামায আদায় করতে এবং মহান আল্লাহর আয়াত শ্রবণ করতে যাচ্ছে। মনের মধ্যে এই খেয়াল থাকলে তার আকারে-চলনে শান্তভাব, শিষ্টতা ও গাম্ভীর্য প্রকাশ পাবে এবং তার প্রতি পুরুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে না।
দুঃখের বিষয় যে, কতক মহিলা প্রাইভেট ড্রাইভারের সাথে একাকিনী মসজিদে যায়। আর এতে সে নফল আদায় করে সওয়াব কামাতে গিয়ে হারাম কাজ করে গোনাহ কামিয়ে আসে। অথচ তার এ কাজ যে বিরাট মুর্খামি এবং নিরেট বোকামি তা বলাই বাহুল্য।
মহিলাদের জন্য উচিৎ নয়, সে রকম কোন শিশু সঙ্গে নিয়ে মসজিদে আসা, যারা মায়ের নামায-ব্যস্ততায় ধৈর্য রাখতে পারবে না এবং কান্না, চিৎকার, চেঁচামেচি বা ছুটাছুটি করে, মসজিদের কুরআন, আসবাব-পত্র ইত্যাদি নিয়ে খেলা করে সকল নামাযীর ডিষ্টার্ব করবে।[5]
[2] (আহমাদ, মুসনাদ ২/৩০৪, মুসলিম ৪৪৪, আবূ দাঊদ ৪১৭৫নং, নাসাঈ)
[3] (আহমাদ, মুসনাদ ২/৭৬, ৭৭, সহীহ আবূ দাঊদ ৫৩০নং) (এ বিষয়ে বিস্তারিত দ্রষ্টব্য ‘স্বালাতি মুবাশ্শির’ ২/১৯৪-১৯৬)
[4] (আহমাদ, মুসনাদ, সহীহ আবূ দাঊদ ১২২৭, সহীহ তিরমিযী, আলবানী ৬৪৬, সহীহ নাসাঈ, আলবানী ১৫১৪, সহীহ ইবনে মাজাহ, আলবানী ১৩২৭নং)
[5] (আশরু অক্বাফাতিন লিন্নিসা ফী রামাযান ৭-৮পৃঃ)
কোন কিশোর, পুরুষ বা মহিলার ইমামতিতে কোন বাড়িতে তারাবীহর নামাযের জন্য মহিলাদের পৃথক জামাআত করা দোষাবহ নয়।
আয়েশার ক্রীতদাস যাকওয়ান রমাযানে কুরআন দেখে তাঁর ইমামতি করতেন।[1]
জাবের বিন আব্দুল্লাহ বলেন, একদা ক্বারী সাহাবী উবাই বিন কা’ব (রাঃ) আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে এসে আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! (রমাযানের) গতরাত্রে আমি একটি (অস্বাভাবিক) কাজ করেছি।’ তিনি বললেন, ‘‘সেটা কি?’’ উবাই বললেন, ‘কিছু মহিলা আমার ঘরে জমা হয়ে বলল, আপনি (ভালো ও বেশী) কুরআন পড়তে পারেন, আমরা পারি না। অতএব আপনি আজ আমাদের ইমামতি করেন। তাদের এই অনুরোধে আমি তাদেরকে নিয়ে ৮ রাকআত এবং বিতর পড়েছি।’ এ কথা শুনে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) চুপ থাকলেন। অর্থাৎ তাঁর এই নীরব থাকা এ ব্যাপারে তাঁর মৌনসম্মতির সুন্নত হয়ে গেল।[2]
অবশ্য এ ক্ষেত্রে শর্ত হল, মহিলা একাকিনী হলে সে ইমাম যেন তার কোন এগানা হয় এবং বেগানা না হয়। নতুবা মহিলা যেন একাধিক থাকে এবং তারা পর্দার সাথে থাকে। আর সর্বক্ষেত্রে যেন কোন প্রকার ফিতনার ভয় না থাকে।[3]
উম্মে অরাকাহ বিন নাওফাল (রাঃ)কে মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) তাঁর পরিবারের মহিলাদের ইমামতি করতে আদেশ করেছিলেন।[4]
অবশ্য এ ক্ষেত্রে মহিলা ইমাম মহিলাদের কাতার ছেড়ে পুরুষের মত সামনে একাকিনী দাঁড়াবে না। বরং কাতারের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে ইমামতি করবে। উম্মে সালামাহ মহিলাদের ইমামতি করার সময় কাতারের মাঝখানেই দাঁড়াতেন।[5] অনুরূপ বর্ণিত আছে আয়েশা থেকেও।[6]
[2] (ত্বাবারানী, মু’জাম, আবূ য়্যা’লা, মাজমাউয যাওয়ায়েদ ২/৭৪, সালাতুত তারাবীহ আলবানী ৬৮পৃঃ)
[3] (আশ্শারহুল মুমতে’ ৪/৩৫২)
[4] (আবূ দাঊদ ৫৯১-৫৯২নং, দারাকুত্বনী, সুনান ১০৭১, ১৪৯১নং)
[5] (দারাকুত্বনী, সুনান ১৪৯৩নং, বাইহাকী ৩/১৩১, ইবনে আবী শাইবাহ, মুসান্নাফ, আব্দুর রায্যাক, মুসান্নাফ)
[6] (দারাকুত্বনী, সুনান ১৪৯২নং, আব্দুর রায্যাক, মুসান্নাফ, মুহাল্লা ইবনে হাযম ৩/১৭১-১৭৩)
তারাবীহর নামাযের জন্য সুমধুর কণ্ঠবিশিষ্ট হাফেয-ক্বারী ইমাম অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেয়া দোষাবহ নয়। তবে (ক্বারী সাহেবের তরফ থেকে) পারিশ্রমিক নির্দিষ্ট করা উচিৎ নয়। যেহেতু এক জামাআত সলফ এ কাজকে অপছন্দ করেছেন। অবশ্য মসজিদের জামাআত যদি অনির্দিষ্ট- ভাবে তাঁকে অনেক কিছু দিয়ে পুরস্কৃত বা সাহায্য করেন, তাহলে তাতে কোন ক্ষতি নেই।
পক্ষান্তরে এমন ইমামের পিছনে নামায শুদ্ধ। বেতন নির্দিষ্ট করলেও নামাযের কোন ক্ষতি হবে না - ইন শাআল্লাহ। কারণ, এমন ইমামের প্রয়োজন পড়েই থাকে। তবে চুক্তিগতভাবে বেতন নির্ধারিত করার কাজ না করাই উচিৎ। জামাআতের সুস্থ বিবেক অনুযায়ী ইমাম বিনিময়-সাহায্য পাবেন; তবে তা শর্ত-সাপেক্ষ হওয়া উচিৎ নয়। এটাই হল উত্তম ও পূর্বসতর্কতামূলক কর্ম। এ রকমই বলেছেন সলফের একটি জামাআত। রাহিমাহুমুল্লাহ।
আর এ কথার ইঙ্গিত রয়েছে হাদীসে। মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) উসমান বিন আবুল আস (রাঃ)-কে বলেছিলেন, ‘‘এমন মুআয্যিন রাখ, যে আযান দেওয়ার বিনিময়ে কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করে না।’’[1] এ নির্দেশ স্পষ্টতঃ যদিও মুআয্যিনের জন্য, তবুও ইমামের ক্ষেত্রে এ নির্দেশ অধিকতর প্রযোজ্য।
বলা বাহুল্য, হাফেয ও ক্বারী সাহেবদের উচিৎ, তাঁরাও যেন কুরআন-তেলাঅতকে অর্থোপার্জনের মাধ্যমরূপে ব্যবহার না করেন। যেহেতু মহানবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘‘তোমরা কুরআন পাঠ কর, তার উপর আমল কর, (তার নির্দেশ অনুযায়ী কাজ কর,) তার প্রতি বৈমুখ হয়ে যেও না, তাতে অতিরঞ্জন করো না, তার মাধ্যমে উদরপূর্তি করো না এবং তার অসীলায় ধনবৃদ্ধিও করো না।’’[2]
[2] (আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানী, মু’জাম, আবূ য়্যা’লা, প্রমুখ, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৬০নং)