এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি মাসআলা। এর সঠিক বিবরণ মানুষের জানা দরকার। তাই বিস্তারিতভাবে আমি প্রশ্নটির জবাব দিব। ইন্শাআল্লাহ্।
কুরআন ও সুন্নাহ্র দলীলের ভিত্তিতে মোজার উপর মাসেহ করার বিষয়টি সুপ্রমাণিত। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ
“হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা নামাযের ইচ্ছা কর, তখন তোমরা মুখমণ্ডল ও হাত দু’টি কনুই পর্যন্ত ধৌত কর, মাথা মাসেহ কর এবং দু’পা টাখনু পর্যন্ত ধৌত কর।” (সূরা মায়িদা- ৬)
উল্লেখিত আয়াতের মধ্যে أَرْجُلَكُمْ শব্দটিতে لام অক্ষরটিতে যবর এবং যের দিয়ে উভয়ভাবে পড়া যায়। যবর দিয়ে পাঠ করলে তা وُجُوهَكُمْ শব্দের উপর ভিত্তি করবে। তখন মুখমণ্ডল ধৌত করার মত পাও ধৌত করতে হবে। আর যের দিয়ে পাঠ করলে তখন তার ভিত্তি হবে بِرُءُوسِكُمْ শব্দের উপর। তখন পা ও মাথা মাসেহের অন্তর্ভুক্ত হবে। অতএব পূর্বোল্লিখিত দু’ক্বিরাত অনুযায়ী পদ যুগল ধৌতও করা যায় এবং মাসেহও করা যায়। সুন্নাতে নববীতে বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে যে, কখন ধৌত করতে হবে এবং কখন মাসেহ করতে হবে? সুতরাং পা যখন অনাবৃত থাকবে তখন তা ধৌত করতে হবে। আর মোজা প্রভৃতি দ্বারা আবৃত করা থাকলে তা মাসেহ করবে।
হাদীছে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে মুতাওয়াতির সনদে মোজার উপর মাসেহ করা প্রমাণিত হয়েছে। যেমনটি জনৈক কবি বলেছেনঃ
মোতাওয়াতির পর্যায়ের হাদীছ সমূহ হচ্ছেঃ ১) নবীজীর উপর মিথ্যারোপ করা ২) আল্লাহর জন্য ঘর (মসজিদ) তৈরী করা। ৩) ক্বিয়ামত দিবসে আল্লার দিদার লাভ। ৪) শাফাআতের বর্ণনা। ৫) হাওয কাওছার ৬) মোজার উপর মাসেহ করা।
মোজার উপর মাসেহ করার বর্ণনা নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে মুতাওয়াতির সনদে বর্ণিত। তাই পবিত্র (ওযু) অবস্থায় কোন মানুষ মোজা পরিধান করে থাকলে- ওযু করার সময় মোজা খুলে পা ধৌত করার চাইতে উক্ত মোজার উপর মাসেহ করা উত্তম। এই কারণে মুগীরা বিন শো’বা (রাঃ) যখন নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ওযুর সময় তাঁর পরিহিত মোজা খুলতে চাইলেন, তিনি বললেন, “খুলতে হবে না। কেননা পবিত্র অবস্থায় আমি তা পরিধান করেছি।” তারপর তার উপর মাসেহ করলেন।
মোজার উপর মাসেহ করার কয়েকটি শর্ত রয়েছেঃ
প্রথম শর্তঃ ছোট বড় সবধরণের নাপাকী থেকে পূর্ণরূপে পবিত্রতা অর্জন করার পর মোজা পরিধান করবে। যদি পবিত্রতা অর্জন না করে মোজা পরিধান করে, তবে তাতে মাসেহ করা বিশুদ্ধ হবে না।
দ্বিতীয় শর্তঃ মাসেহ করার নির্দিষ্ট সময় সীমার মধ্যে মাসেহ করতে হবে। এর বর্ণনা অচিরেই আসবে। ইনশাআল্লাহ।
তৃতীয় শর্তঃ ছোট নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জন তথা ওযুর ক্ষেত্রে মাসেহ হতে হবে। কিন্তু গোসল ফরয হলে মোজা অবশ্যই খুলতে হবে এবং সমস্ত শরীর ধৌত করতে হবে। এ জন্য জানাবাত তথা স্ত্রী সহবাস জনিত কারণে অপবিত্র হলে মোজার উপর মাসেহ করা যাবে না। যেমনটি ছাফওয়ান বিন আস্সাল (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রয়েছেঃ তিনি বলেন, আমরা সফরে থাকলে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে আদেশ করতেন, নাপাক না হলে আমরা যেন তিন দিন তিন রাত মোজা না খুলি।
মোজার উপর মাসেহ করার সময় সীমাঃ মুক্বীম তথা গৃহে অবস্থানকারীর জন্য একদিন একরাত তথা ২৪ ঘন্টা। আর মুসাফিরের জন্য তিন দিন তিন রাত তথা ৭২ ঘন্টা। নামায কয় ওয়াক্ত হল সেটা বিষয় নয়, আসল কথা হচ্ছে নির্ধারিত সময় পূর্ণ হওয়া।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই সময় গণনা কখন থেকে শুরু হবে? এই হিসাব শুরু হবে প্রথম বার মাসেহ করার সময় থেকে। মোজা পরিধান বা ওযু ভঙ্গের সময় থেকে হিসাব শুরু হবে না। কেননা হাদীছে ‘মাসেহ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যখন এই কাজটি হবে তখনই শব্দটির ব্যবহার হবে। “মুক্বীম একদিন একরাত্র মাসেহ করবে এবং মুসাফির তিনদিন তিন রাত মাসেহ করবে।” প্রথমবার মাসেহ করার সময় থেকে হিসাব শুরু হবে। তখন থেকে নিয়ে ২৪ ঘন্টা পূর্ণ হলেই মুক্বীমের নির্দিষ্ট সময় শেষ। আর ৭২ ঘন্টা পূর্ণ হলে মুসাফিরের নির্দিষ্ট সময় শেষ। বিষয়টিকে অধিক সুস্পষ্ট করার জন্য একটি উদাহরণ পেশ করা হচ্ছেঃ
জনৈক ব্যক্তি ফজরের সময় পবিত্রতা অর্জন করে মোজা পরিধান করেছে। এরপর যোহর পর্যন্ত পবিত্র অবস্থায় থেকেছে। এমনকি আছর পর্যন্ত তার ওযু নষ্ট হয়নি। তাই সে ঐ ওযুতে যোহর ও আছর নামায সময়মত আদায় করেছে। তারপর মাগরিবের পূর্বে বিকাল ৫টার সময় ওযু করেছে এবং মোজার উপর মাসেহ করেছে। এই ৫টা থেকে তার সময়ের হিসাব শুরু হবে। সে পরবর্তী দিন বিকাল ৫টা পর্যন্ত মোজার উপর মাসেহ করতে পারবে। যদি পরবর্তী দিন ৫টা বাজার পনর মিনিট আগে মোজাতে মাসেহ করে এবং এশা পর্যন্ত তার ওযু ভঙ্গ না হয়, তবে ঐ মাসেহকৃত ওযু দ্বারা মাগরিব নামায আদায় করতে পারবে কোন অসুবিধা নেই। অতএব এই লোক প্রথমবার ওযু করার পর প্রথম দিন যোহর আছর মাগরিব এশা এবং দ্বিতীয় দিন ফজর যোহর আছর মাগরিব ও এশা মোট নয়টি নামায আদায় করতে পারছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ধারণা হচ্ছে, মাসেহের মাধ্যমে শুধুমাত্র পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা যায়। অথচ একথার কোন ভিত্তি নেই।
শরীয়তে মাসেহ করার যে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে তা শুরু হবে প্রথমবার মাসেহ করার সময় থেকে। এই উদাহরণে আপনি দেখলেন কতগুলো ছালাত আদায় করা সম্ভব। উল্লেখিত উদাহরণে যে সময় দেখানো হয়েছে, তা যদি শেষ হয়ে যায় এবং তারপর মাসেহ করে, তবে তা বাতিল বলে গণ্য হবে এবং তার ওযু হবে না। কিন্তু মাসেহের নির্দিষ্ট সময় পূর্ণ হওয়ার কিছুক্ষণ পূর্বে মাসেহ করে যদি আর ওযু ভঙ্গ না হয়, তবে যতক্ষণ ওযু ভঙ্গ না হবে নামায পড়তে পারবে- যদিও নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। কেননা নামায আদায় করার সময় সে তো পবিত্র অবস্থাতেই রয়েছে।
নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হলেই মাসেহ ভঙ্গ হয়ে যাবে এমন কথা দলীল বিহীন। কেননা সময় অতিবাহিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে, আর মাসেহ করা যাবে না। এমন অর্থ নয় যে, সে আর পবিত্র থাকবে না। যে সময় সীমা দেয়া হয়েছে তা মাসেহের জন্য প্রজোয্য পবিত্রতার জন্য নয়। তাই সময় অতিবাহিত হলেই ওযু নষ্ট হয়ে যাবে এর কোন দলীল নেই। অতএব আমরা বলব, যখন কিনা এই ব্যক্তি বিশুদ্ধ শরঈ দলীলের ভিত্তিতে ওযু করে পবিত্র হয়েছে, তখন তার ওযু নষ্ট হয়েছে একথার পক্ষেও বিশুদ্ধ শরঈ দলীল দরকার। আর যেহেতু সময় অতিবাহিত হলেই ওযু ভঙ্গ হয়ে যাবে এরকম কোন দলীল নেই, সেহেতু ওযু ভঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত সে পবিত্র হিসেবেই অবশিষ্ট থাকবে।
মুসাফিরের সময়সীমা তিনদিন তিনরাত। অর্থাৎ ৭২ ঘন্টা। এই হিসেব শুরু হবে প্রথমবার মাসেহের সময় থেকে। এজন্য হাম্বলী মাযহাবের ফিক্বাহবীদগণ উল্লেখ করেছেন, কোন লোক যদি মুক্বীম অবস্থায় মোজা পরিধান করে অতঃপর নিজ শহরে থাকাবস্থাতেই তার ওযু ভঙ্গ হয়, এরপর সফর করে এবং সফরের স্থানে গিয়ে ওযু করে মাসেহ করে, তবে তাঁরা বলেন, সে মুসাফিরের সময়সীমা পূর্ণ করবে। এ দ্বারা বুঝা যায় যারা বলেন, মোজা পরিধান করে প্রথমবার ওযু ভঙ্গ হওয়ার পর থেকে সময় গণনা শুরু হবে, তাদের এই কথা দুর্বল।
কখন মোজার উপর মাসেহ বাতিল হবে? ১) সময় অতিবাহিত হলে এবং ২) মোজা খুলে ফেললে। অর্থাৎ- মোজা খুলে ফেললে আর মাসেহ করা যাবে না, কিন্তু সে পবিত্র অবস্থাতেই থাকবে যতক্ষণ তার ওযু ভঙ্গ না হয়। একথার দলীল হচ্ছে ছাফ্ওয়ান বিন আস্সালের পূর্ববর্তী হাদীছ। তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন মোজা না খোলার।’ এ থেকে বুঝা যায়, মোজা খুলে ফেললে মাসেহ বাতিল হয়ে যাবে। অর্থাৎ- একবার মাসেহ করার পর যদি মোজা খুলে ফেলে, তবে পুনরায় তা পরিধান করে তাতে মাসেহ করতে পারবে না- যতক্ষণ না সে নতুন করে পূর্ণ ওযুর মাধ্যমে পা ধৌত করে মোজা পরিধান করবে।
কিন্তু মোজা খুলে ফেললে পবিত্রতা অবশিষ্ট থাকবে। কেননা মাসেহ করার মাধ্যমে যখন কোন ব্যক্তি ওযু করবে তখন শরঈ দলীলের ভিত্তিতেই সে পবিত্রতা অর্জন করে থাকে, সুতরাং তার এই পবিত্রতা নষ্ট হয়েছে একথা বলার জন্য শরঈ দীলল দরকার। আর মাসেহ করে ওযু করার পর মোজা খুলে ফেললে ওযু বিনষ্ট হয়ে যাবে একথার পক্ষে কোন দলীল নেই। কিন্তু একথার দলীল আছে যে, একবার মাসেহ করার পর মোজা খুলে ফেললে পুনরায় পরিধান করে আবার তাতে মাসেহ করা যাবে না। যেমনটি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। (আল্লাহ্ তাওফীক্ব দাতা)