রাতের নিঃঝুম পরিবেশে যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে, নিদ্রার আবেশে মানুষ যখন মহান সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালকের কথা বিস্মৃত হয়, সেই সময় আল্লাহর কিছু খাস বান্দা নিদ্রা, আরাম-আয়েশ ও স্ত্রীর শয্যা ত্যাগ করে আল্লাহকে বিশেষভাবে স্মরণ করার জন্য, তাঁর সাথে মুনাজাতে নিমগ্ন হওয়ার জন্য উঠে ওযূ করে তাহাজ্জুদ পড়েন। আল্লাহর ক্ষমা লাভ করতে প্রয়াস পান। চেয়ে নেন আল্লাহর কাছে অনেক কিছু। নিশ্চয় সে বান্দাগণ বড় ভাগ্যবান, আর নিশ্চয় সে নামায বড় গুরুত্ব ও মাহাত্মপূর্ণ।
এই নামাযের কথা উল্লেখ করত: মহান আল্লাহ তাঁর রসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে সম্বোধন করে বলেন,
(وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَّكَ، عَسَى أَنْ يَّبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَاماً مَّحْمُوْداً)
অর্থাৎ, রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ নামায পড়; এ তোমার জন্য একটি অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায় তোমার প্রতিপালক তোমাকে মাকামে মাহ্মূদে (প্রশংসিত স্থানে) প্রতিষ্ঠিত করবেন। (কুরআন মাজীদ ১৭/৭৯)
“হে বস্ত্র আচ্ছাদনকারী (নবী)! উপাসনার জন্য রাত্রিতে উঠ (জাগরণ কর); রাত্রির কিছু অংশ বাদ দিয়ে; অর্ধরাত্রি অথবা তদপেক্ষা অল্প। অথবা তদপেক্ষা বেশী। কুরআন তেলাওয়াত কর ধীরে ধীরে স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে। আমি তোমার উপর অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী। ইবাদতের জন্য রাত্রি জাগরণ গভীর অভিনিবেশ ও হৃদয়ঙ্গম করার পক্ষে অতিশয় অনুকূল।” (কুরআন মাজীদ ৭৩/১-৫)
“রাত্রিতে তাঁর প্রতি সিজদাবনত হও এবং রাত্রির দীর্ঘ সময় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর।” (কুরআন মাজীদ ৭৬/২৬)
এ সম্বোধন মহানবীর জন্য হলেও তাঁর অনুসরণ করতে মুসলিম উম্মাহ্ অনুপ্রাণিত হয়েছে। যাঁরা তাহাজ্জুদ পড়েন, তাঁরা অবশ্যই সৎলোক, মহান আল্লাহর কৃপা ও অনুগ্রহের অধিকারী। মহান আল্লাহ বলেন,
(إِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِيْ جَنَّاتٍ وَّعُيُوْنٍ آخِذِيْنَ مَا آتَاهُمْ رَبُّهُمْ إِنَّهُمْ كَانُوْا قَبْلَ ذَلِكَ مُحْسِنِيْنَ، كَانُوْا قَلِيْلاً مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُوْنَ، وَبِالأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُوْنَ)
অর্থাৎ, নিশ্চয়ই পরহেযগারগণ বেহেশত ও প্রসবণে অবস্থান করবে। তাদের প্রতিপালক তাদেরকে যা দেবেন তা উপভোগ করবে। কারণ, পার্থিব জীবনে তারা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। তারা রাত্রির সামান্য অংশই নিদ্রায় অতিবাহিত করত। রাত্রির শেষ প্রহ্রে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত। (কুরআন মাজীদ ৫১/১৫-১৮)
রাত্রি জাগরণ করে ইবাদত করা রহ্মানের বান্দাগণের গুণ। তিনি বলেন,
(وَعِبَادُ الرَّحْمنِ الَّذِيْنَ يَمْشُوْنَ عَلَى الأَرْضِ هَوْناً، وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُوْنَ قَالُوْا سَلاَماً، وَالَّذِيْنَ يَبِيْتُوْنَ لِرَبِّهِمْ سُجَّداً وَّقِيَاماً)
অর্থাৎ, রহ্মানের বান্দা তারা, যারা ভূপৃষ্ঠে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা প্রশান্তভাবে জবাব দেয়। আর তারা তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে ও দন্ডায়মান থেকে রাত্রি অতিবাহিত করে। (কুরআন মাজীদ ২৫/৬৩-৬৪)
এই শ্রেণীর মানুষদের জন্য আল্লাহ ঈমানের সাক্ষ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন,
(إِنَّمَا يُؤْمِنُ بِآيَاتِنَا الَّذِيْنَ إِذَا ذُكِّرُوْا بِهَا خَرُّوْا سُجَّداً وَّسَبَّحُوْا بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَهُمْ لاَ يَسْتَكْبِرُوْنَ، تَتَجَافَى جُنُوْبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ خَوْفاً وَّطَمَعاً وَّمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُوْنَ، فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُمْ مِّنْ قُرِّةِ أَعْيُنٍ، جَزَاءً بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ)
অর্থাৎ, কেবল তারাই আমার আয়াতসমূহের প্রতি ঈমান রাখে, যারা ওর দ্বারা উপদিষ্ট হলে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং অহংকার করে না। তারা শয্যা ত্যাগ করে আশায় ও আশংকায় তাদের প্রতিপালককে ডাকে এবং আমি তাদেরকে যে রুযী দান করেছি তা হতে তারা ব্যয় করে। কেউই জানে না তাদের জন্য তাদের কৃতকর্মের নয়ন-প্রDতিকর কি পুরস্কার রক্ষিত আছে। এ হল তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান। (সূরা সিজদাহ ১৫-১৬ আয়াত)
তারা অবশ্যই তাঁদের মত নয়, যারা তাঁদের মত রাত্রি জাগরণ করে মহান আল্লাহর ইবাদত করে না। তিনি বলেন,
(أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِداً وَّقَائِماً يَّحْذَرُ الآخِرَةَ وَيَرْجُوْ رَحْمَةَ رَبِّهِ، قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِيْنَ يَعْلَمْوْنَ وَالَّذِيْنَ لاَ يَعْلَمُوْنَ، إِنَّمَا يَتَذَّكَّرُ أُولُو الأَلْبَابِ)
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সিজদাবনত হয়ে এবং দন্ডায়মান থেকে ইবাদত করে, পরকালকে ভয় করে এবং তার প্রতিপালকের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে (সে কি তার সমান, যে তা করে না?) বল, যারা জানে এবং যারা জানে না তারা উভয়ে কি এক সমান? বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে থাকে। (কুরআন মাজীদ ৩৯/৯)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন শয়তান তার মাথার শেষাংশে (ঘাড়ে) তিনটি গাঁট মেরে দেয়। প্রত্যেক গাঁটের সময় এই মন্ত্র পড়ে অভিভূত করে দেয়, ‘তোমার এখনো লম্বা রাত বাকী। সুতরাং এখনও ঘুমাও।’ অতঃপর সে যদি জেগে আল্লাহর যিক্র করে, তবে একটি বাঁধন খুলে যায়, অতঃপর ওযু করলে আর একটি বাঁধন খুলে যায়, অতঃপর নামায পড়লে সকল বাঁধনগুলোই খুলে যায়। ফলে ফজরের সময় সে উদ্যম ও ফুর্তিভরা মন নিয়ে ওঠে। নতুবা (তাহাজ্জুদ না পড়লে) আলস্যভরা ভারী মন নিয়ে সে ফজরে উঠে।” (মালেক, মুঅত্তা, বুখারী১১৪২নং, মুসলিম, সহীহ ৭৭৬নং, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন, “রমযানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ রোযা হল আল্লাহর মাস মুহার্রামের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামায হল রাতের (তাহাজ্জুদের) নামায।” (মুসলিম, সহীহ ১১৬৩নং, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ)
হযরত আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (ﷺ) এর বাণী হতে সর্বপ্রথম যা শুনেছি তা হল, “হে মানুষ! তোমরা সালাম প্রচার কর, অন্নদান কর, জ্ঞাতি-বন্ধন অক্ষুন্ন রাখ এবং লোকেরা যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন তোমরা নামায পড়। এতে তোমরা নিবিঘ্নে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।” (তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক,সহিহ তারগিব ৬১০নং)
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আম্র (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন, “জান্নাতের মধ্যে এমন একটি কক্ষ আছে যার বাহিরের অংশ ভিতর থেকে এবং ভিতরের অংশ বাহির থেকে দেখা যাবে।” তা শুনে আবু মালেক আশআরী (রাঃ) বললেন, ‘সে কক্ষ কার জন্য হবে, হে আল্লাহর রসূল?’ তিনি বললেন, “যে ব্যক্তি উত্তম কথা বলে, অন্নদান করে ও লোকেরা যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নামাযে রত হয়; তার জন্য।” (ত্বাবারানী,হাকেম, সহীহ তারগীব ৬১১নং)
হযরত জাবের (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “রাত্রিকালে এমন এক মুহূর্ত রয়েছে যখনই তা লাভ করে মুসলিম ব্যক্তি ইহ্-পরকালের কোন কল্যাণ আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে তখনই তিনি তাকে তা প্রদান করে থাকেন। অনুরুপ প্রত্যেক রাত্রিতেই ঐ মুহূর্ত আবির্ভূত হয়ে থাকে।” (মুসলিম, সহীহ ৭৫৭নং)
হযরত আবু উমামাহ্ বাহে লী (রাঃ) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, তোমরা তাহাজ্জুদের নামাযে অভ্যাসী হও। কারণ, তা তোমাদের পূর্বতন নেক বান্দাদের অভ্যাস; তোমাদের প্রভুর নৈকট্যদানকারী ও পাপক্ষালনকারী এবং গুনাহ হতে বিরতকারী আমল।” (তিরমিযী, ইবনে আবি নয়্যা, ইবনে খুযাইমাহ্,হাকেম, সহীহ তারগীব ৬১৮ নং)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) ও আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তাঁরা বলেন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন, “কোন ব্যক্তি যখন তার স্ত্রীকে রাত্রে ঘুম থেকে জাগিয়ে উভয়ে তাহাজ্জুদের নামায পড়ে অথবা দুই রাকাআত নামায পড়ে তখন তাদের প্রত্যেকের নাম (আল্লাহর) যিক্রকারী ও যিক্রকারিণীদের তালিকাভুক্ত হয়।” (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক সহিহ তারগিব ৬২০ নং)
হযরত আবু দারদা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেন, “তিন ব্যক্তিকে আল্লাহ ভালোবাসেন, তাদের প্রতি (সন্তুষ্ট হয়ে) হাসেন এবং তাদের কারণে খুশী হন; (প্রথম) সেই ব্যক্তি যার নিকট স্বদলের পরাজয় প্রকাশ পেলে নিজের জান দিয়ে আল্লাহ আয্যা অজাল্লার ওয়াস্তে যুদ্ধ করে। এতে সে হয় শহীদ হয়ে যায় নতুবা আল্লাহ তাকে সাহায্য (বিজয়ী) করেন ও তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হন। তখন আল্লাহ বলেন, ‘আমার এই বান্দাকে তোমরা লক্ষ্য কর, আমার জন্য নিজের প্রাণ দিয়ে কেমন ধৈর্য ধরেছে?’
(দ্বিতীয়) সেই ব্যক্তি যার আছে সুন্দরী স্ত্রী এবং নরম ও সুন্দর বিছানা। কিন্তু সে (এসব ত্যাগ করে) রাত্রে উঠে নামায পড়ে। এর জন্য আল্লাহ বলেন, ‘সে নিজের প্রবৃত্তিকে দমন করে আমাকে স্মরণ করছে, অথচ ইচ্ছা করলে সে নিদ্রা উপভোগ করতে পারত।’
আর (তৃতীয়) সেই ব্যক্তি যে সফরে থাকে। তার সঙ্গে থাকে কাফেলা। কিছু রাত্রি জাগরণ করে সকলে ঘুমেঢলে পড়ে। কিন্তু সে শেষরাত্রে উঠে কষ্ট ও আরামের সময় নামায পড়ে।” (ত্বাবারানী কাবীর, সহীহ তারগীব ৬২৩ নং)
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আম্র বিন আস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ১০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে উদাসীনদের তালিকাভুক্ত হয় না, যে ১০০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে আবেদদের তালিকাভুক্ত হয়। আর যে ১০০০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে অজস্র সওয়াব অর্জনকারীদের তালিকাভুক্ত হয়।” (আবু দাঊদ, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ তারগীব ৬৩৩ নং)
মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমার কাছে জিবরীল এসে বললেন, হে মুহাম্মাদ! যত ইচ্ছা বেঁচে থাকুন, আপনি মারা যাবেনই। যাকে ইচ্ছা ভালো বাসুন, আপনি তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন। যা ইচ্ছা তাই আমল করুন, আপনি তার বদলা পাবেন। আর জেনে রাখুন, মুমিনের মর্যাদা হল তাহাজ্জুদের নামাযে এবং তার ইজ্জত হল লোকেদের অমুখাপেক্ষী থাকায়।” (ত্বাবরানী, হাকেম, মুস্তাদরাক, বায়হাকী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৮৩১নং)
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (ﷺ)-এর কাছে বলল, ‘অমুক রাত্রে (তাহাজ্জুদের) নামায পড়ে। কিন্তু সকাল হলে (দিনে) চুরি করে!?’ এ কথা শুনে তিনি বললেন, “ঐ নামায তাকে তুমি যা বলছ তাতে (চুরিতে) বাধা দেবে।” (আহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী শুআবুল ঈমান, মিশকাত ১২৩৭নং, সহীহ, সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ১/৫৭-৫৮ দ্র:)
১। ঘুমাবার আগে তাহাজ্জুদের নিয়ত করে ঘুমাতে হবে। এতে সে শেষ রাত্রে ঘুম থেকে জেগে নামায পড়তে সক্ষম না হলেও তার জন্য তাহাজ্জুদের সওয়াব লিখা হবে।
হযরত আবু দারদা (রাঃ) নবী (ﷺ) এর নিকট হতে বর্ণনা করে বলেন, তিনি বলেছেন, “রাত্রে উঠে তাহাজ্জুদ পড়বে এই নিয়ত (সংকল্প) করে যে ব্যক্তি নিজ বিছানায় আশ্রয় নেয়, অতঃপর তার চক্ষুদ্বয় তাকে নিদ্রাভিভূত করে ফেলে এবং যদি এই অবস্থাতেই তার ফজর হয়ে যায় তবে তার আমলনামায় তাই লিপিবদ্ধ হয় যার সে নিয়ত (সংকল্প) করেছিল। আর তার ঐ নিদ্রা তার প্রতিপালকের তরফ হতে সদকাহ্ (দান) রুপে প্রদত্ত হয়।” (নাসাঈ, ইবনে মাজাহ্, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ তারগীব ৫৯৮নং)
২। ঘুম থেকে উঠে, চোখ মুছে দাঁতন করা এবং সূরা আলে ইমরানের শেষের ১০ আয়াত পাঠ করা সুন্নত। (বুখারী ১৮৩নং, মুসলিম, সহীহ)
৩। ওযূ করার পর হাল্কা দুই রাকআত পড়ে তাহাজ্জুদের নামায শুরু করা কর্তব্য। মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের কেউ (তাহাজ্জুদের জন্য) রাত্রে উঠলে সে যেন তার নামায হাল্কা দুই রাকআত দিয়ে শুরু করে।” (মুসলিম, সহীহ)
৪। তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য নিজের স্ত্রীকে জাগানো মুস্তাহাব। এর জন্য রয়েছে পৃথক মাহাত্ম। মহানবী (ﷺ) বলেন, “আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে রহ্ম করেন, যে ব্যক্তি রাত্রে উঠে নামায পড়ে ও নিজ স্ত্রীকে জাগায় এবং সেও নামায পড়ে। কিন্তু সে যদি উঠতে না চায় তাহলে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়। আল্লাহ সেই মহিলাকে রহ্ম করেন, যে মহিলা রাত্রে উঠে নামায পড়ে ও নিজ স্বামীকে জাগায় এবং সেও নামায পড়ে। কিন্তু সে যদি উঠতে না চায় তাহলে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ১৩০৮, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৩৪৯৪নং)
তিনি বলেন, “যখন কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে রাত্রে উঠিয়ে উভয়ে (তাহাজ্জুদ) নামায পড়ে অথবা ২ রাকআত নামায পড়ে, তখন তাদের উভয়কে (আল্লাহর) যিক্রকারী ও যিক্রকারিণীদের দলে লিপিবদ্ধ (শামিল) করা হয়।” (আবূদাঊদ, সুনান ১৩০৯নং, প্রমুখ)
৫। রাত্রে নামায পড়তে পড়তে ঘুম এলে বা ঢুললে নামায ত্যাগ করে ঘুমিয়ে যাওয়া কর্তব্য। মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের কেউ যখন নামায পড়তে পড়তে ঢুলতে শুরু করে, তখন সে যেন শুয়ে পড়ে; যাতে তার ঘুম দূর হয়ে যায়। নচেৎ, কেউ ঢুলতে ঢুলতে নামায পড়লে সে হয়তো বুঝতে পারবে না, সম্ভবত: সে ক্ষমা চাইতে গিয়ে নিজেকে গালি দিয়ে বসবে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১২৪৫নং)
তিনি বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ রাতে উঠে (নামায পড়তে শুরু করে) তার জিভে কুরআন পড়া জড়িয়ে গেলে এবং সে কি বলছে তা বুঝতে না পারলে, সে যেন শুয়ে পড়ে।” (মুসলিম)
তিনি বলেন, “তোমাদের প্রত্যেকে যেন মনে উদ্দীপনা থাকা পর্যন্ত নামায পড়ে। ক্লান্ত হয়ে পড়লে যেন বসে যায়।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১২৪৪নং)
একদা তিনি মসজিদে দুই খুঁটির মাঝে লম্বা হয়ে রশি বাঁধা থাকতে দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “এটা কি?” সাহাবাগণ বললেন, এটি যয়নাবের। তিনি নামায পড়েন। অতঃপর যখন আলস্য আসে অথবা ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তখন ঐ রশি ধরে (দাঁড়ান)। তিনি বললেন, “খুলে ফেল ওটাকে। তোমাদের প্রত্যেকে যেন চাঙ্গা থাকা অবস্থায় নামায পড়ে। আর যখন সে অলস অথবা ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তখন সে যেন শুয়ে পড়ে।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)
৬। নিজেকে কষ্ট দিয়ে লম্বা তাহাজ্জুদ পড়া বিধেয় নয়। বরং স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতায় যতটা কুলায়, ততটাই নামায পড়া উচিৎ। মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমরা তত পরিমাণে আমল কর যত পরিমাণে তোমরা করার ক্ষমতা রাখ। আল্লাহর কসম! আল্লাহ (সওয়াব দিতে) ক্লান্ত হবেন না, বরং তোমরাই (আমল করতে) ক্লান্ত হয়ে পড়বে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১২৪৩)
৭। অল্প হলেও তা নিরবচ্ছিন্নভাবে নিয়মিত করে যাওয়া উচিৎ এবং ভীষণ অসুবিধা ছাড়া তা ত্যাগ করা উচিৎ নয়। মহানবী (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, ‘কোন (ধরনের) আমল আল্লাহর অধিক পছন্দনীয়?’ উত্তরে তিনি বললেন, “সেই আমল, যে আমল নিরবচ্ছিন্নভাবে করে যাওয়া হয়; যদিও তা পরিমাণে কম হয়।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১২৪২নং) মহানবী (ﷺ)-এর আমল ছিল নিরবচ্ছিন্ন। তিনি একবার যে আমল করতেন, তা বাকী রাখতেন (ত্যাগ করতেন না)।” (মুসলিম, সহীহ) তিনি আব্দুল্লাহ বিন উমার (রাঃ)-কে বলেন, “হে আব্দুল্লাহ! তুমি অমুকের মত হয়ো না; যে তাহাজ্জুদ পড়ত, পরে সে তা ত্যাগ করে দিয়েছে।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)
রসূল (ﷺ)-এর কাছে এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হল, যে ফজর পর্যন্ত ঘুমিয়ে থেকেছে। তিনি বললেন, “ও তো সেই লোক, যার উভয় কানে শয়তান পেশাব করে দিয়েছে।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)
একদা তিনি ইবনে উমারের প্রশংসা করে বললেন, “আব্দুল্লাহ কত ভাল লোক হয়, যদি সে রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে!” এ কথা শোনার পর ইবনে উমার (রাঃ) রাতে খুব কম ঘুমাতেন। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)
তাহাজ্জুদ নামাযের সময় শুরু হয় এশার নামাযের পর থেকে এবং শেষ হয় ফজর উদয় হওয়ার সাথে সাথে। রাতের প্রথমাংশে, মধ্য রাতে এবং শেষাংশে যে কোন সময়ে তাহাজ্জুদ পড়া যায়। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘আমরা রাতের যে কোন অংশে নবী (ﷺ)-কে নামায পড়তে দেখতে চাইতাম, সেই সময়ই দেখতে পেতাম, তিনি নামায পড়ছেন। আবার রাতের যে কোন অংশে আমরা তাঁকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে চাইতাম, তখনই আমরা দেখতে পেতাম, তিনি ঘুমিয়ে আছেন।’ (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১২৪১নং)
সুতরাং এ কথা স্পষ্ট যে, এশার পর থেকে নিয়ে ফজর পর্যন্ত সময়ের ভিতরে তাহাজ্জুদের জন্য কোন নির্দিষ্ট সময় নেই। অবশ্য আফযল বা উত্তম সময় হল, রাতের শেষ তৃতীয়াংশ।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “আল্লাহ তাআলা প্রত্যহ্ রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশে নীচের আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, “কে আমায় ডাকে? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আমার নিকট প্রার্থনা করে? আমি তাকে দান করব। এবং কে আমার নিকট ক্ষমা চায়? আমি তাকে ক্ষমা করব।” (বুখারী, মুসলিম, সুনানু আরবাআহ (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ্), মিশকাত ১২২৩নং)
তিনি বলেন, “শেষ রাতের গভীরে প্রতিপালক নিজ বান্দার সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী হন। সুতরাং তুমি যদি ঐ সময় আল্লাহর যিক্রকারীদের দলভুক্ত হতে সক্ষম হও, তাহলে তা হয়ে যাও।” (তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, জামে ১১৭৩নং)
তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল যে, কোন্ সময়ের তাহাজ্জুদ সব চাইতে উত্তম? উত্তরে তিনি বললেন, “বাকী (শেষ) রাতের গভীরে (যা পড়া হয়)। আর খুব কম লোকই তা (ঐ সময়) পড়ে থাকে।” (আহমাদ, মুসনাদ)
সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকে ফজর উদয় হওয়ার আগের সময়কে তিন ভাগে ভাগ করলে রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশ বুঝা যায়।রাত্রের শেষাংশে মোরগ যখন বাং দেয় তখন উঠলেও তাহাজ্জুদ পড়া যায়। মহানবী (ﷺ) কখনো কখনো এই সময় উঠতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১২০৭নং)
রাতের নামাযের কোন নির্দিষ্ট রাকআত সংখ্যা নেই। এক রাকআত পড়লেও রাতের নামায পড়া হয়। ইবনে আব্বাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, মহানবী (ﷺ) তাহাজ্জুদের ব্যাপারে বলেন, “(রাতের নামায) অর্ধ রাত্রি, এক তৃতীয়াংশ, এক চতুর্থাংশ, উট বা ছাগলের দুধ দোয়াবার সময় একবার দুইয়ে দ্বিতীয়বার দুয়ানোর জন্য যতটুকু বিরতি দেওয়া ততটুক (সামান্য) সময়ও।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ২৪৮পৃ:)
তবে উত্তম হল প্রত্যেক ২ রাকআতে সালাম ফিরে ৮ রাকআত পড়া। অতঃপর ৩ রাকআত বিত্র পড়া। অথবা অনুরুপ ১০ রাকআত পড়ে শেষে ১ রাকআত বিত্র পড়া। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য ‘রোযা ও রমযানের ফাযায়েল ও মাসায়েল’ তারাবীহ্র বিবরণ।)
তাহাজ্জুদ নামাযের ক্বিরাআত লম্বা হওয়া বাঞ্ছনীয়। মহানবী (ﷺ) বলেন, “শ্রেষ্ঠ নামায হল লম্বা কিয়াম।” (আহমাদ, মুসনাদ, মুসলিম, মিশকাত ৪৬, ৮০০নং)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, এক রাতে নবী (ﷺ)-এর সাথে নামায পড়লাম। তিনি কিয়াম করতেই থাকলেন, পরিশেষে আমি মন্দ ইচ্ছা করে ফেলেছিলাম। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, সে মন্দ ইচ্ছাটি কি? তিনি বললেন, আমি ইচ্ছা করেছিলাম যে, তাঁকে ছেড়ে দিয়ে বসে যাব! (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)
হুযাইফা বিন ইয়ামান বলেন, এক রাতে নবী (ﷺ)-এর সাথে নামায পড়লাম। তিনি সূরা বাক্বারাহ্ পড়তে শুরু করলেন। আমি ভাবলাম, হয়তো বা তিনি ১০০ আয়াত পাঠ করে সিজদাহ করবেন। কিন্তু তিনি তা অতিক্রম করে গেলেন। ভাবলাম হয়তো বা তিনি সূরাটিকে ২ রাকআতে পড়বেন। কিন্তু তিনি তাও অতিক্রম করে গেলেন। ভাবলাম, তিনি হয়তো সূরাটি শেষ করে রুকূ করবেন। (কিন্তু না, তা না করে) সূরা নিসা শুরু করলেন। তাও পড়ে শেষ করলেন। তারপর সূরা আলে ইমরান ধরলেন এবং তাও পড়ে শেষ করলেন! ([1])
তিনি ধীরে-ধীরে আয়াত পাঠ করছিলেন। তাসবীহর আয়াত পাঠ করলে তাসবীহ পড়ছিলেন। প্রার্থনার আয়াত পাঠ করলে প্রার্থনা করছিলেন। আশ্রয় প্রার্থনার আয়াত পাঠ করলে আশ্রয় প্রার্থনা করছিলেন। অতঃপর রুকূ করছিলেন। (মুসলিম, নাসাঈ, সুনান)
তিনি এই নামাযে এত দীর্ঘ কিয়াম করতেন যে, তার ফলে তাঁর পা ফুলে যেত। তাঁকে বলা হল যে, আপনার তো আগে-পিছের সকল ত্রুটি আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? (তাও আপনি এত কষ্ট করে ইবাদত করেন কেন?) তিনি বললেন, “আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হ্ব না?” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১২২০নং)
অবশ্য তিনি এক রাতে কুরআন খতম করতেন না। অবশ্য তিনি তিন রাতে কুরআন খতম করার অনুমতি দিয়েছেন; তার কমে নয়। তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি ৩ রাতের কমে কুরআন পড়ে, সে কিছুই বুঝে না।” (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান, দারেমী, সুনান)
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি ১০০টি আয়াত পাঠ করে রাতের নামায পড়বে, তার নাম বিশুদ্ধচিত্ত কিয়ামকারীদের তালিকাভুক্ত হবে।” (দারেমী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক)
তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি ১০০টি আয়াত পাঠ করে রাতের নামায পড়বে, সে উদাসীনদের তালিকাভুক্ত হবে না।” (দারেমী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক)
আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ১০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে উদাসীনদের তালিকাভুক্ত হয় না, যে ১০০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে আবেদদের তালিকাভুক্ত হয়। আর যে ১০০০টি আয়াত নামাযে পড়ে সে অজস্র সওয়াব অর্জনকারীদের তালিকাভুক্ত হয়।” (আবু দাঊদ, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ তারগীব ৬৩৩ নং)
কখনো তিনি তাহাজ্জুদের নামাযে সূরা বানী ইসরাঈল ও যুমার পড়তেন। (আহমাদ, মুসনাদ) কখনো প্রায় ৫০ আয়াতের মত বা তার থেকে বেশী আয়াত তেলাওয়াত করতেন। (বুখারী, আবূদাঊদ, সুনান) কখনো বা সূরা মুযযাম্মলের মত লম্বা সূরা পাঠ করতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান) একদা তিনি সূরা মাইদার ১১৮নং আয়াত বারবার পাঠ করতে করতে ফজর করে দিয়েছেন। (আহমাদ, মুসনাদ, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ১২০৫নং)
এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল! আমার এক প্রতিবেশী রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে, কিন্তু ‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ ছাড়া অন্য কিছু পড়ে না; এটাকেই সে বারবার ফিরিয়ে পড়ে এবং এর চাইতে বেশী কিছু পড়ে না। আসলে এ ব্যক্তি তা খুবই কম মনে করল। কিন্তু নবী (ﷺ) বললেন, “সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ আছে! ঐ সূরা এক তৃতীয়াংশ কুরআনের সমতুল্য।” (আহমাদ, মুসনাদ, বুখারী)
কখনো সশব্দে, কখনো বা নিঃশব্দে এ ক্বিরাআত করা যায়। সাহাবী গুযাইফ বিনহারেস বলেন, একদা আমি আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, ‘আল্লাহর রসূল (ﷺ) প্রথম রাতে নাপাকীর গোসল করতেন, নাকি শেষ রাতে?’ তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘কোন রাতে তিনি প্রথম ভাগে গোসল করতেন, আবার কোন কোন রাতে শেষ ভাগে।’ আমি বললাম, ‘আল্লাহু আকবার! সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি (দ্বীনের) ব্যাপারে প্রশস্ততা রেখেছেন।’ অতঃপর আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তিনি বিতরের নামায প্রথম রাত্রিতে পড়তেন, নাকি শেষ রাত্রিতে?’ তিনি বললেন, ‘কখনো তিনি প্রথম রাত্রিতে বিত্র পড়তেন, আবার কখনো শেষ রাত্রিতে।’ আমি বললাম, ‘আল্লাহু আকবার! সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি (দ্বীনের) ব্যাপারে প্রশস্ততা রেখেছেন।’ পুনরায় আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তিনি (তাহাজ্জুদের নামাযে) সশব্দে ক্বিরাআত পড়তেন, নাকি নিঃশব্দে?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘তিনি কখনো সশব্দে পড়তেন, আবার কখনো নিঃশব্দে।’ আমি বললাম, ‘আল্লাহু আকবার! সেই আল্লাহর প্রশংসা যিনি (দ্বীনের) ব্যাপারে প্রশস্ততা রেখেছেন।’ (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ২০৯, ইবনে মাজাহ্, সুনান, মিশকাত ১২৬৩নং)
একদা মহানবী (ﷺ) রাত্রিকালে বাইরে এলে তিনি দেখলেন, আবূ বাক্র নিম্নস্বরে (তাহাজ্জুদের) নামায পড়ছেন। অতঃপর তিনি উমারের কাছে গিয়ে দেখলেন, তিনি উচ্চস্বরে নামায পড়ছেন। অতঃপর যখন তাঁরা উভয়ে তাঁর নিকট জমায়েত হলেন, তখন তিনি বললেন, “হে আবূ বাক্র! আমি তোমার কাছ দিয়ে পার হয়ে গেলাম, দেখলাম, তুমি নিম্নস্বরে নামায পড়ছ।” আবূ বাক্র বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমি কেবল তাঁকে শুনিয়েছি, যাঁর কাছে আমি মুনাজাত করেছি।’ অতঃপর তিনি উমারের উদ্দেশ্যে বললেন, “আর আমি তোমার কাছ দিয়ে পার হয়ে গেলাম, দেখলাম, তুমি উচ্চস্বরে নামায পড়ছ।” উমার বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমি তন্দ্রাভিভূত লোকদেরকে জাগিয়ে দিই এবং শয়তান বিতাড়ণ করি।’ নবী (ﷺ) বললেন, “হে আবূ বাক্র! তোমার আওয়াজকে একটু উঁচু কর। আর হে উমার! তোমার আওয়াজকে একটু নিচু কর।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১২০৪নং)
যে তাহাজ্জুদ-গুযার বান্দার কোন কারণবশত: রাতের ১১ রাকআত নামায ছুটে যায় সে তা দিনে বিশেষ করে চাশতের সময় ১২ রাকআত কাযা করতে পারে।
মহানবী (ﷺ)-এর তাহাজ্জুদ ঘুম বা ব্যথা-বেদনার কারণে ছুটে গেলে দিনে ১২ রাকআত কাযা পড়তেন। (মুসলিম, সহীহ) হযরত উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি তার (পূর্ণ) অযীফা (তাহাজ্জুদের নামায, কুরআন ইত্যাদি) অথবা তার কিছু অংশ রেখে ঘুমিয়ে যায়, কিন্তু তা যদি ফজর ও যোহরের নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে আদায় করে নেয় তবে তার জন্য পূর্ণ সওয়াবই লিপিবদ্ধ করা হয়, যেন সে ঐ অযীফা রাত্রেই সম্পন্ন করেছে।” (মুসলিম, সহীহ ৭৪৭নং, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ)