নামাযে দাঁড়িয়ে নবী মুবাশ্শির (ﷺ) ‘আল্লা-হু আকবার’ বলে নামায শুরু করতেন। (এর পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ্’ বা অন্য কিছু বলতেন না।) নামায ভুলকারী সাহাবীকেও এই তকবীর পড়তে আদেশ দিয়েছেন। আর তাকে বলেছেন, “ততক্ষণ পর্যন্ত কোন মানুষেরই নামায পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে ঠিক যথার্থরুপে ওযু করেছে। অতঃপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলেছে।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ৮৬পৃ:)
তিনি আরো বলেছেন, “নামাযের চাবিকাঠি হল পবিত্রতা (গোসল-ওযু), (নামাযে প্রবেশ করে পার্থিব কর্ম ও কথাবার্তা ইত্যাদি)হারাম করার শব্দ হল তকবীর। আর (নামায শেষ করে সে সব)হালাল করার শব্দ হল সালাম।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০১নং)
এই তকবীরও নামাযে ফরয। ‘আল্লাহু আকবার’ ছাড়া অন্য শব্দে (যেমন আল্লাহ আজাল্ল্, আল্লাহু আ’যাম প্রভৃতি সমার্থবোধক) তকবীর বৈধ ও যথেষ্ট নয়। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/২৬)
ইবনুল কাইয়েম (রহঃ) বলেন, ‘তাহ্রীমার সময় তাঁর অভ্যাস ছিল, ‘আল্লাহু আকবার’ শব্দ বলা। অন্য কোন শব্দ নয়। আর তাঁর নিকট হতে কেউই এই শব্দ ছাড়া অন্য শব্দে তকবীর বর্ণনা করেন নি।’ (যাদুল মাআদ ১/২০১-২০২)
তাকবীরে তাহ্রীমা বলার সময় (একটু আগে, সাথে সাথে বা একটু পরে) মহানবী (ﷺ) তাঁর নিজহাত দু’টিকে কাঁধ বরাবর তুলতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৭৯৩নং) আর কখনো কখনো কানের ঊর্ধ্বাংশ বরাবরও ‘রফ্য়ে ইয়াদাইন’ করতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৭৯৫নং) হাত তোলার সময় তাঁর হাতের আঙ্গুলগুলো লম্বা (সোজা) হয়ে থাকত। (জড়সড় হয়ে থাকত না)। আর আঙ্গুলগুলোর মাঝে (খুব বেশী) ফাঁক করতেন না, আবার এক অপরের সাথে মিলিয়েও রাখতেন না। (আবূদাঊদ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৪৫৯নং,হাকেম, মুস্তাদরাক)
প্রকাশ থাকে যে, ‘রফ্য়ে ইয়াদাইন’ করার সময় কানের লতি স্পর্শ করা বিধেয় নয়। যেমন এই সময় মাথা তুলে উপর দিকে তাকানোও অবিধেয়। (মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ্ ২৩/৯৫) তদনুরুপহাত তোলার পর নিচে ঝুলিয়ে দিয়ে তারপর হাত বাঁধাও ভিত্তিহীন। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৪৩) যেমন তকবীরের পূর্বে নামায শুরু করার সময় ‘বিসমিল্লাহ্’ বলা বিদআত। (ঐ ১/১৩৩)
এরপর নবী মুবাশ্শির (ﷺ) তাঁর ডানহাতকে বামহাতের উপর রাখতেন। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৫২নং) আর তিনি বলতেন, “আমরা আম্বিয়ার দল শীঘ্র ইফতারী করতে, দেরী করে সেহ্রী খেতে এবং নামাযে ডানহাতকে বামহাতের উপর রাখতে আদিষ্ট হয়েছি।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, মাজমাউয যাওয়াইদ,হাইষামী ২/১০৫)
একদা তিনি নামাযে রত এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে পার হতে গিয়ে দেখলেন, সে তার বাম হাতকে ডান হাতের উপর রেখেছে। তিনি তার হাত ছাড়িয়ে ডান হাতকে বাম হাতের উপর চাপিয়ে দিলেন। (আহমাদ, মুসনাদ ৩/৩৮১, আবূদাঊদ, সুনান ৭৫৫নং)
সাহল বিন সা’দ (রাঃ) বলেন, লোকেরা আদিষ্ট হত, তারা যেন নামাযে তাদের ডানহাতকে বাম প্রকোষ্ঠ (হাতের রলার) উপর রাখে। (বুখারী ৭৪০নং)
ওয়াইল বিন হুজর (রাঃ) বলেন, তিনি ডান হাতকে বাম হাতের চেটোর পিঠ, কব্জি ও প্রকোষ্ঠের উপর রাখতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৭২৭ নং, নাসাঈ, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, ইবনে হিব্বান, সহীহ)
কখনো বা ডান হাত দ্বারা বাম হাতকে ধারণ করতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৭২৬নং, নাসাঈ, সুনান, তিরমিযী, সুনান ২৫২, দারাক্বুত্বনী, সুনান)
আল্লামা আলবানী বলেন, উক্ত হাদীস এই কথার দলীল যে, সুন্নত হল ডান হাত দিয়ে বাম হাতকে ধারণ করা। আর পূর্বের হাদীস প্রমাণ করে যে, ডান হাত বাম হাতের উপর (ধারণ না করে) রাখা সুন্নত। সুতরাং উভয় প্রকার আমলই সুন্নত। পক্ষান্তরে একই সঙ্গে প্রকোষ্ঠের উপর রাখা এবং ধারণ করা -যা কিছু পরবর্তী হানাফী উলামাগণ উত্তম মনে করেছেন তা বিদআত। তাদের উল্লেখ মতে তার পদ্ধতি হল এই যে, ডান হাতকে বাম হাতের উপর রাখবে, কড়ে ও বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বাম হাতের প্রকোষ্ঠ (রলা) কে ধারণ করবে। আর বাকী তিনটি আঙ্গুল তার উপর বিছিয়ে দেবে। (হাশিয়া ইবনে আবেদ্বীন ১/৪৫৪) সুতরাং উক্ত পরবর্তীগণের কথায় আপনি ধোকা খাবেন না। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ৮৮পৃ:, ৩নং টীকা)
পক্ষান্তরে উভয় হাদীসের উপর আমল করতে হলে কখনো না ধরে রাখতে হবে এবং কখনো ধারণ করতে হবে। যেহেতু একই সঙ্গে ঐ পদ্ধতি হাদীসে বর্ণিত হয় নি।
প্রকাশ থাকে যে, ডান হাত দ্বারা বাম হাতের বাজু ধরারও কোন ভিত্তি নেই। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৪৫)
এরপর মহানবী (ﷺ) উভয় হাতকে বুকের উপর রাখতেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৭৫৯ নং, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ ৪৭৯ নং, আহমাদ, মুসনাদ, আবুশ শায়খ প্রমুখ)
প্রকোষ্ঠের উপর প্রকোষ্ঠ রাখার আদেশ একথাও প্রমাণ করে যে, হাত বুকের উপরেই বাঁধা হবে। নচেৎ তার নিচে ঐভাবে রাখা সম্ভব নয়। মুহাদ্দিস আলবানী (রহঃ) বলেন, বুকের উপরেই হাত বাঁধা সুন্নাহতে প্রমাণিত। আর এর অন্যথা হয় যয়ীফ, না হয় ভিত্তিহীন। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ৮৮পৃ:)
বুকে রয়েছে হৃদয়। যার উপর হাত রাখলে অনন্ত প্রশান্তি, একান্ত বিনয় ও নিতান্ত আদব অভিব্যক্ত হয়।
নবী মুবাশ্শির (ﷺ) নামাযে তাঁর দৃষ্টি অবনত করে সিজদার স্থানে নিবদ্ধ রাখতেন। (বায়হাকী,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৫৪ নং) নামাযের প্রারম্ভে তিনি বিভিন্ন রুপে আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতি বর্ণনা করতেন এবং প্রার্থনা করতেন। পরন্তু নামায ভুলকারী সাহাবীকেও তিনি বলেছিলেন, “কোন ব্যক্তিরই নামায ততক্ষণ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তকবীর দিয়েছে, আল্লাহ আয্যা অজাল্লার প্রশংসা ও স্তুতি বর্ণনা করেছে এবং যথাসম্ভব কুরআন পাঠ করেছে।” (আবূদাঊদ, সুনান ৮৫৭ নং,হাকেম, মুস্তাদরাক)
এই অবস্থায় তিনি বিভিন্ন সময় ও নামাযে বিভিন্ন দুআ পড়েছেন। যার কিছু নিম্নরুপ:-
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) যখন নামাযে (তাহ্রীমার) তকবীর দিতেন, তখন ক্বিরাআত শুরু করার পূর্বে কিছুক্ষণ চুপ থাকতেন। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আপনি তকবীর ও ক্বিরাআতের মাঝে চুপ থেকে কি পড়েন আমাকে বলে দিন।’ তিনি বললেন, “আমি বলি,
اَللّــهُمَّ بَاعِدْ بَيْنِيْ وَبَيْنَ خَطَايَاىَ كَـمَا بَاعَــدْتَّ بَيْنَ الْمَشــْرِقِ وَالْمَغْرِبِ، اَللّهُمَّ نَقِّنِيْ مِنَ الْخَطَايَا كَمَا يُنَقَّى الثَّوْبُ الأَبْيَضُ مِنَ الدَّنَسِ، اَللّهُمَّ اغْسِلْ خَطَايَاىَ بِالْمَاءِ وَالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ।
উচ্চারণ:- আল্লা-হুম্মা বা-ইদ বাইনী অ বাইনা খাত্বা-য়্যা-য়্যা কামা বা-আত্তা বাইনাল মাশরিক্বি অল মাগরিব, আল্লা-হুম্মা নাক্বিনী মিনাল খাত্বা-য়্যা, কামা য়্যুনাক্বাষ ষাওবুল আবয়্যাযুমিনাদ দানাস, আল্লাহু-ম্মাগসিল খাত্বা-য়্যা-য়্যা বিল মা-য়ি অষষালজি অলবারাদ।
অর্থ- হে আল্লাহ! তুমি আমার মাঝে ও আমার গুনাহসমূহের মাঝে এতটা ব্যবধান রাখ যেমন তুমি পূর্ব ও পশ্চিমের মাঝে ব্যবধান রেখেছ। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে গুনাহসমূহ থেকে পরিষ্কার করে দাও যেমন সাদা কাপড় ময়লা থেকে পরিষ্কার করা হয়। হে আল্লাহ! তুমি আমার গুনাহসমূহকে পানি, বরফ ও করকি দ্বারা ধৌত করে দাও।” (বুখারী ৭৪৪, মুসলিম, সহীহ ৫৯৮, আবূদাঊদ, সুনান ৭৮১, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান, আআহমাদ, মুসনাদ ২/৯৮, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৮০৫, আহমাদ, মুসনাদ ২/২৩১, ৪৯৪, ইআশা: ২৯১৯৯ নং)
লক্ষ্যণীয় যে, উক্ত দুআটি তিনি ফরয নামাযে বলতেন। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ৯১পৃ:)
২। আবূ সাঈদ ও আয়েশা (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) নামাযের শুরুতে এই দুআ পাঠ করতেন,
سُبْحَانَكَ اللّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَ تَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالى جَدُّكَ وَلاَ إِلهَ غَيْرُكَ।
উচ্চারণ:- সুবহা-নাকাল্লা-হুম্মা অবিহামদিকা অতাবা-রাকাসমুকা অতাআ’-লা জাদ্দুকা অ লা ইলা-হা গায়রুক।
অর্থ:- তোমার প্রশংসার সাথে তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করি হে আল্লাহ! তোমার নাম অতি বর্কতময়, তোমার মাহাত্ম অতি উচ্চ এবং তুমি ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই। (আবূদাঊদ, সুনান ৭৭৬, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৮০৬, ত্বাহাবী ১/১১৭, দারাক্বুত্বনী, সুনান ১১৩, বায়হাকী ২/৩৪,হাকেম, মুস্তাদরাক ১/২৩৫, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান, ইআশা:)
মহানবী (ﷺ) বলেন, “নি:সন্দেহে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কথা হল বান্দার ‘সুবহানাকাল্লাহুম্মা---’ বলা।” (তাওহীদ, ইবনে মাজাহ্, নাসাঈ, সুনান, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৯৩৯ নং)
৩। মহানবী ফরযে ও নফলে তাকবীরে তাহ্রীমার পর বলতেন,
وَجَّهْتُ وَجْهِىَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ حَنِيْفاً وَّمَا أَناَ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ، إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَ مَحْيَاىَ وَمَمَاتِيْ للهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَبِذلِكَ أُمِرْتُ وَ أَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ اَللّهُمَّ أَنْتَ الْمَلِكُ لاَ إِلهَ إَلاَّ أَنْتَ سُبْحَانَكَ وَبِحَمْدِكَ أَنْتَ رَبِّيْ وَ أَنَا عَبْدُكَ ، ظَلَمْتُ نَفْسِيْ وَاعْتَرَفْتُ بِذَنْبِيْ، فَاغْفِرْ لِيْ ذَنْبِيْ جَمِيْعاً إِنَّهُ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلاَّ أَنْتَ وَاهْدِنِيْ لأَحْسَنِ الأَخْلاَقِ لاَ يَهْدِيْ لأَحْسَنِهَا إِلاَّ أَنْتَ، وَاصْرِفْ عَنِّيْ سَيِّئَهَا لاَ يَصْرِفُ عَنِّيْ سَيِّئَهَا إِلاَّ أَنْتَ، لَبَّيْكَ وَسَعْدَيْكَ وَالْخَيْرُ كُلُّهُ فِيْ يَدَيْكَ وَالشَّرُّ لَيْسَ إِلَيْكَ وَالْمَهْدِيْ مَنْ هَدَيْتَ، أَنَا بِكَ وَإِلَيْكَ، لاَ مَنْجَا وَلاَ مَلْجَأَ مِنْكَ إِلاَّ إِلَيْكَ، تَبَارَكْتَ وَتَعَالَيْتَ، أَسْتَغْفِرُكَ وَ أَتُوْبُ إِلَيْكَ।
উচ্চারণ:- অজজাহ্তু অজহিয়া লিল্লাযী ফাত্বারাস সামা-ওয়া-তি অলআরযা হানীফাঁউ অমা আনা মিনাল মুশরিকীন। ইন্না সালা-তী অনুসুকী অমাহ্য়্যা-য়্যা অমামা-তী লিল্লা-হি রাব্বিল আ’-লামীন। লা শারীকা লাহু অবিযা-লিকা উমিরতু অআনা আওয়ালুল মুসলিমীন। আল্লা-হুম্মা আন্তাল মালিকু লা ইলা-হা ইল্লা আন্ত। সুবহা-নাকা অবিহামদিকা আন্তা রাব্বী অ আনা আব্দুক। যালামতু নাফসী অ’তারাফতু বিযামবী, ফাগফিরলী যামবী জামীআন ইন্নাহু লা য়্যাগফিরুয যুনূবা ইল্লা আন্ত। অহ্দিনী লিআহ্সানিল আখলা-ক্বি লা য়্যাহ্দী লিআহ্সিনহা ইল্লা আন্ত। অস্বরিফ আন্নী সাইয়্যিআহা লা য়্যাস্বরিফু আন্নী সাইয়্যিআহা ইল্লা আন্ত। লাব্বাইকা অ সা’দাইক, অলখায়রু কুল্লুহু ফী য়্যাদাইক। অশশার্রু লাইসা ইলাইক, অল-মাহ্দীয়্যু মানহাদাইত, আনা বিকা অ ইলাইক। লা মানজা অলা মালজাআ মিনকা ইল্লা ইলাইক, তাবা-রাকতা অতাআ’-লাইত, আস্তাগফিরুকা অ আতূবু ইলাইক।
অর্থ:- আমি একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর প্রতি মুখ ফিরিয়েছি যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। নিশ্চয় আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ বিশ্ব -জাহানের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যই। তাঁর কোন অংশী নেই। আমি এ সম্বন্ধেই আদিষ্ট হয়েছি এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের প্রথম। হে আল্লাহ! তুমিই বাদশাহ্ তুমি ছাড়া কেউ সত্য উপাস্য নেই। আমি তোমার সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা করি। তুমি আমার প্রভু ও আমি তোমার দাস। আমি নিজের উপর অত্যাচার করেছি এবং আমি আমার অপরাধ স্বীকার করেছি। সুতরাং তুমি আমার সমস্ত অপরাধ মার্জনা করে দাও, যেহেতু তুমি ছাড়া অন্য কেউঅপরাধ ক্ষমা করতে পারে না। সুন্দরতম চরিত্রের প্রতি আমাকে পথ দেখাও, যেহেতু তুমি ছাড়া অন্য কেউ সুন্দরতম চরিত্রের প্রতি পথ দেখাতে পারে না। মন্দ চরিত্রকে আমার নিকট হতে দূরে রাখ, যেহেতু তুমি ছাড়া অন্য কেউমন্দ চরিত্রকে আমার নিকট থেকে দূর করতে পারে না। আমি তোমার আনুগত্যে হাজির এবং তোমার আজ্ঞা মানতে প্রস্তুত। যাবতীয় কল্যাণ তোমার হাতে এবং মন্দের সম্পর্ক তোমার প্রতি নয়। আমি তোমার অনুগ্রহে আছি এবং তোমারই প্রতি আমার প্রত্যাবর্তন। তুমি বরকতময় ও মহিমময়, তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তোমার দিকেই প্রত্যাবর্তন করি। (মুসলিম, সহীহ ৭৭১, আআহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ আহমাদ, মুসনাদ, শাফেয়ী, ত্বাবারানী, মু’জাম)
৪- اَللهُ أَكْبَرُ كَبِيْراً، اَلْحَمْدُ للهِ كَثِيْراً، وَسُبْحَانَ اللهِ بُكْرَةً وَّأَصِيْلاً।
উচ্চারণ:- আল্লা-হু আকবারু কাবীরা, অলহামদু লিল্লা-হি কাসীরা, অ সুবহা-নাল্লা-হি বুকরাতাঁউঅ আস্বীলা।
অর্থ:- আল্লাহ অতি মহান, আল্লাহর অনেক অনেক প্রশংসা, আমি সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করি।
এই দুআটি দিয়ে নফল নামায শুরু করতে হয়। জনৈক সাহাবী এই দুআ দিয়ে নামায শুরু করলে মহানবী (ﷺ) বললেন, “এই দুআর জন্য আমি বিস্মিত হয়েছি। কারণ ওর জন্য আসমানের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করা হল।”
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর নিকট ঐ কথা শোনার পর থেকে আমি কোন দিন ঐ দুআ পড়তে ছাড়ি নি। (মুসলিম, সহীহ ৬০১, আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান)
আবূ নুআইম ‘আখবারু আসবাহান’ গ্রন্থে (১/২১০) জুবাইর বিন মুত্বইম হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি নবী (ﷺ) কে উক্ত দুআ নফল নামাযে পড়তে শুনেছেন।
৫। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘এক ব্যক্তি হাঁপাতে হাঁপাতে কাতারে শামিল হয়ে বলল,
اَلْحَمْدُ للهِ حَمْداً كَثِيْراً طَيِّباً مُّبَارَكاً فِيْهِ।
উচ্চারণ:- আলহামদু লিল্লা-হিহামদান কাসীরান ত্বাইয়িবাম মুবা-রাকান ফীহ্।
অর্থ:- আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা; যে প্রশংসা অজস্র, পবিত্র ও প্রাচুর্যময়।
আল্লাহর রসূল (ﷺ) নামায শেষ করার পর বললেন, “তোমাদের মধ্যে কে ঐ দুআ পাঠ করেছে?” লোকেরা সকলে চুপ থাকল। পুনরায় তিনি বললেন, “কে বলেছে ঐ দুআ? যে বলেছে, সে মন্দ বলে নি।” উক্ত ব্যক্তি বলল, ‘আমিই হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলে ফেলেছি।’ তিনি বললেন, “আমি ১২ জন ফিরিশ্তাকে দেখলাম, তাঁরা ঐ দুআ (আল্লাহর দরবারে) উপস্থিত করার জন্য প্রতিযোগিতা করছে!” (মুসলিম, সহীহ ৬০০, আহমাদ, মুসনাদ)
৬। তিনি তাহাজ্জুদের নামাযের শুরুতে পড়তেন,
اَللّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ نُوْرُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَ مَنْ فِيْهِنَّ، وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ قَيِّمُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيْهِنَّ، وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ مَلِكُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيْهِنَّ، وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ الْحَقُّ وَوَعْدُكَ الْحَقُّ وَ قَوْلُكَ الْحَقُّ وَلِقَاؤُكَ حَقٌّ وَالْجَنَّةُ حَقٌ وَالنَّارُ حَقٌّ وَالسَّاعَةُ حَقٌّ وَالنَّبِيُّوْنَ حَقٌّ وَمُحَمَّدٌ حَقٌّ، اَللّهُمَّ لَكَ أَسْلَمْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ وَبِكَ آمَنْتُ وَإِلَيْكَ أَنَبْتُ وَبِكَ خَاصَمْتُ وَإِلَيْكَ حَاكَمْتُ، أَنْتَ رَبُّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيْرُ، فَاغْفِرْ لِيْ مَا قَدَّمْتُ وَمَا أَخَّرْتُ وَمَا أَسْرَرْتُ وَمَا أَعْلَنْتُ وَمَا أَنْتَ أَعْلَمُ بِهِ مِنِّيْ، أَنْتَ الْمُقَدِّمُ وَأَنْتَ الْمُؤَخِّرُ أَنْتَ إِلهِيْ، لاَ إِلهَ إِلاَّ أَنْتَ، وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِكَ।
উচ্চারণ- আল্লা-হুম্মা লাকালহামদু আন্তা নূরুস সামা-ওয়া-তি অলআরযি অমান ফীহিন্ন। অলাকালহামদু আন্তা কাইয়্যিমুস সামা-ওয়া-তি অলআরযি অমান ফীহিন্ন। অলাকালহামদু আন্তা মালিকুস সামা-ওয়া-তি অলআরযি অমান ফীহিন্ন। অলাকালহামদু আন্তালহাক্ব, অওয়া’দুকালহাক্ব, অক্বাওলুকালহাক্ব, অলিক্বা-উকা হাক্ব, অলজান্নাতুহাক্ব, অন্না-রুহাক্ব, অসসা-আতুহাক্ব, অন্নাবিয়্যুনাহাক্ব, অমুহাম্মাদুনহাক্ব। আল্লা-হুম্মা লাকা আসলামতু অআলাইকা তাওয়াক্কালতু অবিকা আ-মানতু অইলাইকা আনাবতু, অবিকা খা-সামতু অইলাইকাহা-কামতু আন্তা রাব্বুনা অইলাইকাল মাসীর। ফাগ্ফিরলী মা ক্বাদ্দামতু অমা আখখারতু অমা আসরারতু অমা আ’লানতু অমা আন্তা আ’লামু বিহী মিন্নী। আন্তাল মুক্বাদ্দিমু অআন্তাল মুআখখিরু আন্তা ইলা-হী, লা ইলা-হা ইল্লা আন্তা অলাহাওলা অলা ক্বুউওয়াতা ইল্লা বিক।
অর্থ- হে আল্লাহ! তোমারই যাবতীয় প্রশংসা। তুমি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং উভয়ের মধ্যে অবস্থিত সকল কিছুর জ্যোতি। তোমারই সমস্ত প্রশংসা, তুমি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী ও উভয়ের মধ্যে অবস্থিত সকল কিছুর নিয়ন্তা, তোমারই সমস্ত প্রশংসা। তুমি আকাশম ন্ড লী, পৃথিবী ও উভয়ের মধ্যে অবস্থিত সকল কিছুর অধিপতি। তোমারই সমস্ত প্রশংসা, তুমিই সত্য, তোমার প্রতিশ্রুতিই সত্য, তোমার কথাই সত্য, তোমার সাক্ষাৎ সত্য, জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য, কিয়ামত সত্য, নবীগণ সত্য, মুহাম্মদ (ﷺ) সত্য। হে আল্লাহ! আমি তোমারই নিকট আত্মসমর্পণ করেছি, তোমার উপরেই ভরসা করেছি, তোমার উপরেই ঈমান (বিশ্বাস) রেখেছি, তোমার দিকে অভিমুখী হয়েছি, তোমারই সাহায্যে বিতর্ক করেছি, তোমারই নিকট বিচার নিয়ে গেছি। তুমি আমাদের প্রতিপালক, তোমারই দিকে প্রত্যাবর্তনস্থল। অতএব তুমি আমার পূর্বের, পরের, গুপ্ত, প্রকাশ্য এবং যা তুমি অধিক জান সে সব পাপকে মাফ করে দাও। তুমিই প্রথম, তুমিই শেষ। তুমি আমার উপাস্য, তুমি ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই এবং তোমার তওফীক ছাড়া পাপ থেকে ফিরার ও সৎকাজ (নড়া-সরা) করার সাধ্য নেই। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ১২১১ নং)
নিম্নোক্ত দুআগুলিও তিনি তাহাজ্জুদের নামাযের শুরুতে পাঠ করতেন:-
৭। ‘সুবহানাকাল্লাহুম্মা---’ (২নং দুআ) পড়ে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ ৩ বার, এবং ‘আল্লাহু আকবারু কাবীরা’ ৩ বার। (আবূদাঊদ, সুনান, ৭৭৫ নং, ত্বাহাকেম, মুস্তাদরাক, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ৯৪পৃ:)
اَللّهُمَّ رَبَّ جِبْرَآئِيْلَ وَ مِيْكَائِيْلَ وَإِسْرَآفِيْلَ، فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ، عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبَادِكَ فِيْمَا كَانُوْا فِيْهِ يَخْتَلِفُوْنَ، اِهْدِنِيْ لِمَا اخْتُلِفَ
فِيْهِ مِنَ الْحَقِّ بِإِذْنِكَ إِنَّكَ تَهْدِيْ مَنْ تَشَاءُ إِلى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ।
উচ্চারণ- আল্লা-হুম্মা রাব্বা জিবরা-ঈলা অমীকা-ঈলা অ ইসরা-ফীল। ফা-তিরাস সামা-ওয়া-তি অলআরয্ব, আ-লিমাল গায়বি অশশাহা-দাহ্। আন্তা তাহ্কুমু বাইনা ইবাদিকা ফীমা কা-নূ ফীহি য়্যাখতালিফূন। ইহ্দিনী লিমাখতুলিফা ফীহি মিনালহাক্বি বিইযনিক, ইন্নাকা তাহ্দী মান তাশা-উইলা স্বিরাতীম-মুস্তাক্বীম।
অর্থ- হে আল্লাহ! হে জিবরাঈল, মীকাঈল ও ইসরাফীলের প্রভু! হে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃজনকর্তা! হে দৃশ্য ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা! তুমি তোমার বান্দাদের মাঝে মীমাংসা কর যে বিষয়ে ওরা মতভেদ করে। যে বিষয়ে মতভেদ করা হয়েছে সে বিষয়ে তুমি আমাকে তোমার অনুগ্রহে সত্যের পথ দেখাও। নিশ্চয় তুমি যাকে ইচ্ছা সরল পথ দেখিয়ে থাক। (মুসলিম, আআহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৭৬৭, মিশকাত ১২১২ নং)
৯। ‘আল্লাহু আকবার’ ১০বার, ‘আলহামদু লিল্লা-হ্’ ১০বার, ‘সুবহা-নাল্লাহ্’ ১০বার, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’১০বার, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ্’ ১০বার, ‘আল্লা-হুম্মাগফির লী অহ্দিনী অরযুক্বনী অআ-ফিনী’ (অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা কর, হেদায়াত কর, রুজি ও নিরাপত্তা দাও) ১০ বার, এবং ‘আল্লা-হুম্মা ইন্নী আঊযু বিকা মিনায্বযাইক্বি ইয়াউমাল হিসাব’ (অর্থাৎ হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি হিসাবের দিনে সংকীর্ণতা থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি) ১০ বার। (আহমাদ, মুসনাদ, ইআশা:, আবূদাঊদ, সুনান ৭৬৬ নং, ত্বাবারানী, মু’জাম আউসাত্ব ২/৬২)
১০। ‘আল্লাহু আকবার’ ৩ বার। অতঃপর,
ذُو الْمَلَكُوْتِ وَالْجَبَرُوْتِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْعَظَمَةِ।
উচ্চারণ- যুল মালাকূতি অলজাবারুতি অলকিবরিয়া-য়ি, অলআযামাহ্।
অর্থ- (আল্লাহ) সার্বভৌমত্ব, প্রবলতা, গর্ব ও মাহাত্মের অধিকারী। (আবূদাঊদ, সুনান ৮৭৪ নং)
উপরোক্ত একটি দুআ পড়ার পর নবী মুবাশ্শির (ﷺ) ক্বিরাআত শুরু করার জন্য শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন, বলতেন,
أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ، مِنْ هَمْزِهِ وَنَفْخِهِ وَنَفْثِهِ।
উচ্চারণ:- আঊযু বিল্লা-হি মিনাশ শাইত্বা-নির রাজীম, মিনহামযিহী অনাফখিহী অনাফষিহ্।
আবার কখনো বলতেন,
أَعُوْذُ بِاللهِ السَّمِيْعِ الْعَلِيْمِ، مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ، مِنْ هَمْزِهِ وَنَفْخِهِ وَنَفْثِهِ।
উচ্চারণ- আঊযু বিল্লা-হিস সামীইল আলীম, মিনাশ শাইত্বা-নির রাজীম, মিনহামযিহী অনাফখিহী অনাফষিহ্।
অর্থ- আমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর নিকট বিতাড়িত শয়তান থেকে তার প্ররোচনা ও ফুৎকার হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (আবূদাঊদ, সুনান ৭৭৫, দারাক্বুত্বনী, সুনান, তিরমিযী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইআশা:, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৪২নং)
এরপর নবী মুবাশ্শির (ﷺ)بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْم‘ বিসমিল্লা-হির রাহ্মা-নির রাহীম’ (অনন্ত করুণাময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি।) পাঠ করতেন। এটিকে তিনি নি:শব্দেই পড়তেন। এ ছাড়া সশব্দে ‘বিসমিল্লাহ্’ পড়ার ব্যাপারে কোন স্পষ্ট ও সহীহ হাদীস নেই। (তামামুল মিন্নাহ্, আলবানী ১৯৬পৃ:)
আনাস (রাঃ) বলেন, আমি নবী (ﷺ), আবূ বকর ও উমার (রাঃ) এর সাথে নামায পড়েছি। তাঁরা সকলেই ‘আলহামদু লিল্লা-হি রাব্বিল আ-লামীন’ বলে ক্বিরাআত শুরু করতেন। (বুখারী ৭৪৩, আবূদাঊদ, সুনান ৭৮২, তিরমিযী, সুনান ২৪৬, নাসাঈ, সুনান ৮৬৭ নং প্রমুখ) অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, তাঁরা ক্বিরাআতের শুরুতে বা শেষেও ‘বিসমিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম’ উল্লেখ করতেন না। আর এক বর্ণনায় তিনি বলেন, তাঁদের কাউকেই ‘বিসমিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম’ বলতে শুনি নি। (মুসলিম, সহীহ ৩৯৯, সহিহ,নাসাঈ, সুনান ৮৭০, ৮৭১নং, ইবনে হিব্বান, সহীহ)
অতঃপর মহানবী (ﷺ) জেহরী (মাগরিব, এশা, ফজর, জুমুআহ, তারাবীহ্, ঈদ প্রভৃতি) নামাযে সশব্দে ও সির্রী (যোহ্র, আসর, সুন্নত প্রভৃতি) নামাযে নি:শব্দে সূরা ফাতিহা পাঠ করতেন,
الْحَمْدُ للهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، اَلرَّحْمنِ الرَّحِيْم، مَالِكِ يَوْمِ الدِّيْن، إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِيْن، اِهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيْم، صِرَاطَ الَّذِيْنَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَيْهِمْ وَلاَ الضَّالِّيْن।
উচ্চারণ:- আলহামদু লিল্লা-হি রাব্বিল আ’-লামীন। আররাহ্মা-নির রাহীম। মা-লিকি য়্যাউমিদ্দ্বীন। ইয়্যা-কা না’বুদু অইয়্যা-কা নাস্তাঈন। ইহ্দিনাস স্বিরা-ত্বাল মুস্তাক্বীম। স্বিরা-ত্বাল্লাযীনা আন্আ’মতা আলাইহিম। গাইরিল মাগযুবি আলাইহিম অলায্ব যা-ল্লীন।
অর্থ:- সমস্ত প্রশংসা সারা জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। যিনি অনন্ত করুণাময়, পরম দয়ালু। যিনি বিচার দিনের মালিক। আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই। আমাদেরকে সরল পথ দেখাও; তাদের পথ -যাদেরকে তুমি পুরস্কার দান করেছ। তাদের পথ নয় -যারা ক্রোধভাজন (ইয়াহুদী) এবং যারা পথভ্রষ্ট ( খ্রিষ্টান)।
এই সূরা তিনি থেমে থেমে পড়তেন; ‘বিসমিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম’ পড়ে থামতেন। অতঃপর ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ’-লামীন’ বলে থামতেন। আর অনুরুপ প্রত্যেক আয়াত শেষে থেমে থেমে পড়তেন। (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩৪৩নং)
সুতরাং একই সাথে কয়েকটি আয়াতকে জড়িয়ে পড়া সুন্নতের পরিপন্থী আমল। পরস্পর কয়েকটি আয়াত অর্থে সম্পৃক্ত হলেও প্রত্যেক আয়াতের শেষে থেমে পড়াই মুস্তাহাব। (সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ৯৬পৃ:)
মহানবী (ﷺ) বলতেন, “সেই ব্যক্তির নামায হয় না, যে ব্যক্তি তাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করে না।” (বুখারী, মুসলিম, আআহমাদ, মুসনাদ, বায়হাকী, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০২নং)
“সেই ব্যক্তির নামায যথেষ্ট নয়, যে তাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করে না।” (দারাক্বুত্বনী, সুনান, ইবনে হিব্বান, সহীহ, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ৩০২নং)
“যে ব্যক্তি এমন কোনও নামায পড়ে, যাতে সে সূরা ফাতিহা পাঠ করে না, তার ঐ নামায (গর্ভচ্যুত ভ্রুণের ন্যায়) অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ।” (মুসলিম, আআহমাদ, মুসনাদ, মিশকাত ৮২৩নং)
“আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি নামায (সূরা ফাতিহা) কে আমার ও আমার বান্দার মাঝে আধাআধি ভাগ করে নিয়েছি; অর্ধেক আমার জন্য এবং অর্ধেক আমার বান্দার জন্য। আর আমার বান্দা তাই পায়, যা সে প্রার্থনা করে।’ সুতরাং বান্দা যখন বলে, ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আ-লামীন।’ তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমার বান্দা আমার প্রশংসা করল।’ অতঃপর বান্দা যখন বলে, ‘আররাহ্মা-নির রাহীম।’ তখন আল্লাহ বলেন, ‘বান্দা আমার স্তুতি বর্ণনা করল।’ আবার বান্দা যখন বলে, ‘মা-লিকি য়্যাউমিদ্দ্বীন।’ তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বান্দা আমার গৌরব বর্ণনা করল।’ বান্দা যখন বলে, ‘ইয়্যা-কা না’বুদু অইয়্যা-কা নাস্তাঈন।’ তখন আল্লাহ বলেন, ‘এটা আমার ও আমার বান্দার মাঝে। আর আমার বান্দা তাই পায়, যা সে প্রার্থনা করে।’ অতঃপর বান্দা যখন বলে, ‘ইহ্দিনাস স্বিরা-ত্বাল মুস্তাকীম। স্বিরা-ত্বাল্লাযীনা আনআমতা আলাইহিম, গাইরিল মাগযূবি আলাইহিম অলায্ব যা-ল্লীন।’ তখন আল্লাহ বলেন, ‘এ সব কিছু আমার বান্দার জন্য। আর আমার বান্দা যা চায়, তাই পাবে।” (মুসলিম, সহীহ ৩৯৫, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, আআহমাদ, মুসনাদ, প্রমুখ, মিশকাত ৮২৩নং)
“উম্মুল কুরআন (কুরআনের জননী সূরা ফাতিহা) এর মত আল্লাহ আয্যা অজাল্ল্ তাওরাতে এবং ইঞ্জিলে কোন কিছুই অবতীর্ণ করেন নি। এই (সূরাই) হল (নামাযে প্রত্যেক রাকআতে) পঠিত ৭টি আয়াত এবং মহা কুরআন, যা আমাকে দান করা হয়েছে।” (নাসাঈ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ২১৪২ নং)
নামায ভুলকারী সাহাবীকে মহানবী (ﷺ) এই সূরা তার নামাযে পাঠ করতে আদেশ দিয়েছিলেন। (বুখারী জুযউল ক্বিরাআহ্, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ৯৮পৃ:) অতএব নামাযে এ সূরা পাঠ করা ফরয এবং তা নামাযের একটি রুক্ন।
সূরা ফাতিহা পাঠের সময় যদি কেউতার একটি হ্রফের উচ্চারণ অন্য হ্রফের মত করে পড়ে, তাহলে এই মহা রুক্ন আদায় সহীহ হবে না। ঐ হ্রফ (আয়াত)কে পুন: শুদ্ধ করে পড়া জরুরী। যেমন যদি কেউع কে أ ,ح কে هـ , ط কে ت পড়ে তাহলে তার ফাতিহা শুদ্ধ হবে না। (অনুরুপ যে কোন সূরাই।)
আরবী বর্ণমালার সবচেয়ে কঠিনতম উচ্চারিতব্য অক্ষর হল ض । এরও বাংলায় কোন সম-উচ্চারণবোধক অক্ষর নেই। যার জন্য এক শ্রেণীর লেখক এর উচ্চারণ করতে ‘য’ লিখেন এবং অন্য শ্রেণীর লেখক লিখে থাকেন ‘দ’ বা ‘দ্ব’। অথচ উভয় উচ্চারণই ভুল। পক্ষান্তরে যাঁরা ‘জ’-এর উচ্চারণ করেন, তাঁরাও ভুল করেন। অবশ্য স্পষ্ট ‘দ’-এর উচ্চারণ আরো মারাত্মক ভুল।
আসলে ض এর উচ্চারণ হয় জিভের কিনারা (ডগা নয়) এবং উপরের মাড়ির (পেষক) দাঁতের স্পর্শে। যা ‘য’ ও ‘দ’-এর মধ্যবর্তী উচ্চারণ। অবশ্য ‘য’ বা ظ এর মত উচ্চারণ সঠিকতার অনেক কাছাকাছি। পক্ষান্তরে ‘দ’-এর উচ্চারণ জিভের উপরি অংশ ও সামনের দাঁতের মাড়ির গোড়ার স্পর্শে হয়ে থাকে। সুতরাং ض এর উক্ত উচ্চারণ করা নেহাতই ভুল। (দেখুন আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৯১-৯৪)
ض এর উচ্চারণ ظ বা ‘য’-এর কাছাকাছি হওয়ার আরো একটি দলীল এই যে, আরবের লোক শ্রুতিলিখনের সময় শব্দের ض অক্ষরকে ظ লিখে এবং কখনো বা ظ অক্ষরের ক্ষেত্রে ض লিখে ভুল করে থাকেন। আর এ কথা পত্র-পত্রিকা এবং বহু বই-পুস্তকেও আরবী পাঠকের নজরে পড়ে।
সুতরাং আমি মনে করি যে, ض যখন ظ এর জাত ভাই এবং د এর জাত ভাই নয়, তখন তার উচ্চারণ লিখতে ‘য’ অক্ষর লিখাই যুক্তিযুক্ত। অবশ্য তার নিচে ছোট ‘ব’ লাগিয়ে ‘য্ব’ লিখলে ظ থেকে পার্থক্য নির্বাচন করা সহ্জ হয়।
সূরা ফাতিহা শেষ করে নবী মুবাশ্শির (ﷺ) (জেহরী নামাযে) সশব্দে টেনে ‘আ-মীন’ বলতেন। (বুখারী জুযউল ক্বিরাআহ্, আবূদাঊদ, সুনান ৯৩২, ৯৩৩নং)
পরন্তু তিনি মুক্তাদীদেরকে ইমামের ‘আমীন’ বলা শুরু করার পর ‘আমীন’ বলতে আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “ইমাম যখন ‘গাইরিল মাগযূবি আলাইহিম অলায যা-ল্লীন’ বলবে, তখন তোমরা ‘আমীন’ বল। কারণ, ফিরিশ্তাবর্গ ‘আমীন’ বলে থাকেন। আর ইমামও ‘আমীন’ বলে। (অন্য এক বর্ণনা মতে) ইমাম যখন ‘আমীন’ বলবে, তখন তোমরাও ‘আমীন’ বল। কারণ, যার ‘আমীন’ বলা ফিরিশ্তাবর্গের ‘আমীন’ বলার সাথে সাথে হয়- (অন্য এক বর্ণনায়) তোমাদের কেউ যখন নামাযে ‘আমীন’ বলে এবং ফিরিশ্তাবর্গ আকাশে ‘আমীন’ বলেন, আর পরস্পরের ‘আমীন’ বলা একই সাথে হয় -তখন তার পূর্বেকার পাপরাশি মাফ করে দেওয়া হয়।” (দেখুন, বুখারী ৭৮০-৭৮২, ৪৪৭৫, ৬৪০২, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৯৩২-৯৩৩, ৯৩৫-৯৩৬, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান)
মহানবী (ﷺ) আরো বলেন, “ইমাম ‘গাইরিল মাগযূবি আলাইহিম অলায যা-ল্লীন’ বললে তোমরা ‘আমীন’ বল। তাহলে (সূরা ফাতিহায় উল্লেখিত দুআ) আল্লাহ তোমাদের জন্য মঞ্জুর করে নেবেন।” (ত্বাবারানী, মু’জাম, সহিহ তারগিব ৫১৩নং) বলাই বাহুল্য যে, ‘আমীন’ এর অর্থ ‘কবুল বা মঞ্জুর কর।’
ইবনে জুরাইজ বলেন, আমি আত্বা-কে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সূরা ফাতিহা পাঠের পর ইবনে যুবাইর ‘আমীন’ বলতেন কি?’ উত্তরে আত্বা বললেন, ‘হ্যাঁ, আর তাঁর পশ্চাতে মুক্তাদীরাও ‘আমীন’ বলত। এমনকি (‘আমীন’-এর গুঞ্জরণে) মসজিদ মুখরিত হয়ে উঠত।’ অতঃপর তিনি বললেন, ‘আমীন’ তো এক প্রকার দুআ। (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ ২৬৪০ নং, মুহাল্লা ৩/৩৬৪, বুখারী তা’লীক, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩০৬)
আবূ হুরাইরা (রাঃ) মারওয়ান বিনহাকামের মুআযযিন ছিলেন। তিনি শর্ত লাগালেন যে, ‘আমি কাতারে শামিল হয়ে গেছি এ কথা না জানার পূর্বে (ইমাম মারওয়ান) যেন ‘অলায যা-ল্লীন’ না বলেন।’ সুতরাং মারওয়ান ‘অলায যা-ল্লীন’ বললে আবূ হুরাইরা টেনে ‘আমীন’ বলতেন। (বায়হাকী ২/৫৯, বুখারী তা’লীক, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩০৬)
নাফে’ বলেন, ইবনে উমার ‘আমীন’ বলা ত্যাগ করতেন না। তিনি তাঁর মুক্তাদীগণকেও ‘আমীন’ বলতে উদ্বুদ্ধ করতেন। (বুখারী তা’লীক, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৩০৬-৩০৭)
পরের ঐশ্বর্য, উন্নতি বা মঙ্গল দেখে কাতর বা ঈর্ষান্বিত হয়ে সে সবের ধ্বংস কামনার নামই পরশ্রীকাতরতা বা হিংসা। ইয়াহুদ এমন এক জাতি, যে সর্বদা মুসলিমদের মন্দ কামনা করে এবং তাদের প্রত্যেক মঙ্গল ও উন্নতির উপর ধ্বংস-কামনা ও হিংসা করে। কোন উন্নতি ও মঙ্গলের উপর তাদের বড় হিংসা হয়। আবার কোনর উপর ছোট হিংসা। কিন্তু মুসলিমদের সমূহ মঙ্গলের মধ্যে জুমুআহ, কিবলাহ্, সালাম ও ইমামের পিছনে ‘আমীন’ বলার উপর ওদের হিংসা সবচেয়ে বড় হিংসা।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “ইয়াহুদ কোন কিছুর উপর তোমাদের অতটা হিংসা করে না, যতটা সালাম ও ‘আমীন’ বলার উপর করে।” (ইবনে মাজাহ্, সুনান, ইবনে খুযাইমাহ্, সহীহ, সহিহ তারগিব ৫১২নং)
তিনি আরো বলেন, “ওরা জুমুআহ -যা আমরা সঠিকরুপে পেয়েছি, আর ওরা পায় নি, কিবলাহ্ -যা আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকরুপে দান করেছেন, কিন্তু ওরা এ ব্যাপারেও ভ্রষ্ট ছিল, আর ইমামের পশ্চাতে আমাদের ‘আমীন’ বলার উপরে যতটা হিংসা করে, ততটা হিংসা আমাদের অন্যান্য বিষয়ের উপর করে না।” (আহমাদ, মুসনাদ, সহিহ তারগিব ৫১২নং)
প্রকাশ যে, ‘আমীন’ ও ‘আ-মীন’ উভয় বলাই শুদ্ধ। (সহিহ তারগিব ২৭৮পৃ:) ইমামের ‘আমীন’ বলতে ‘আ-’ শুরু করার পর ইমামের সাথেই মুক্তাদীর ‘আমীন’ বলা উচিৎ। ইমামের বলার পূর্বে বা পরে বলা ইমামের এক প্রকার বিরুদ্ধাচরণ, যা নিষিদ্ধ। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/৯৭, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৬/৮১)