আযান ফরয এবং তা দেওয়া হল ফ র্যে কিফায়াহ্। আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “নামাযের সময় উপস্থিত হলে তোমাদের একজন আযান দেবে এবং তোমাদের মধ্যে যে বড় সে ইমামতি করবে।” (বুখারী ৬২৮নং, মুসলিম, নাসাঈ, সুনান, দারেমী, সুনান)
আযান ইসলামের অন্যতম নিদর্শন ও প্রতীক। কোন গ্রাম বা শহরবাসী তা ত্যাগ করলে ইমাম (রাষ্ট্রপ্রধান) তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবেন। যেমন মহানবী (ﷺ) অভিযানে গেলে কোন জনপদ থেকে আযানের ধ্বনি শুনলে তাদের উপর আক্রমণ করতেন না। (বুখারী ৬১০ নং, মুসলিম, সহীহ)
সফরে একা থাকলে অথবা মসজিদ খুবই দূর হলে এবং আযান শুনতে না পাওয়া গেলে একাই আযান ও ইকামত দিয়ে নামায পড়া সুন্নত। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৫৫)
আযান দেওয়ায় (মুআযযেনের জন্য) রয়েছে বড় সওয়াব ও ফযীলত। মহান আল্লাহ বলেন, “সে ব্যক্তি অপেক্ষা আর কার কথা উৎকৃষ্ট, যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করে, সৎকাজ করে এবং বলে আমি একজন ‘মুসলিম’ (আত্মসমর্পণকারী)?” (কুরআন মাজীদ ৪১/৩৩)
প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “লোকে যদি আযান ও প্রথম কাতারের মাহাত্ম জানত, অতঃপর তা লাভের জন্য লটারি করা ছাড়া আর অন্য কোন উপায় না পেত, তাহলে তারা লটারিই করত।” (বুখারী ৬১৫, মুসলিম, সহীহ ৪৩৭নং)
“আল্লাহ প্রথম কাতারের উপর রহ্মত বর্ষণ করেন এবং ফিরিশ্তাগণ তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকেন। মুআযযিনকে তার আযানের আওয়াযের উচ্চতা অনুযায়ী ক্ষমা করা হয়। তার আযান শ্রবণকারী প্রত্যেক সরস বা নীরস বস্তু তার কথার সত্যায়ন করে থাকে। তার সাথে যারা নামায পড়ে তাদের সকলের নেকীর সমপরিমাণ তার নেকী লাভ হয়।” (আহ্মদ, নাসাঈ, সহীহ তারগীব ২২৮নং)
“কিয়ামতের দিন মুআযযিনগণের গর্দান অন্যান্য লোকেদের চেয়ে লম্বা হবে।” (মুসলিম, সহীহ৩৮৭নং)
“যে ব্যক্তি বারো বৎসর আযান দেবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজেব হয়ে যাবে। আর প্রত্যেক দিন আযানের দরুন তার আমল নামায় ষাটটি নেকী লিপিবদ্ধ করা হবে এবং তার ইকামতের দরুন লিপিবদ্ধ হবে ত্রিশটি নেকী।” (ইবনে মাজাহ্, দারাকুত্বনী,হাকেম, সহীহ তারগীব ২৪০নং)
“যে কোন মানুষ, জ্বিন বা অন্য কিছু মুআযযিনের আযানের শব্দ শুনতে পাবে, সেই মুআযযিনের জন্য কিয়ামতের দিন সাক্ষ্য প্রদান করবে।” (বুখারী ৬০৯ নং)
মক্কায় অবস্থানকালে মহানবী (ﷺ) তথা মুসলিমগণ বিনা আযানে নামায পড়েছেন। অতঃপর মদ্বীনায় হিজরত করলে হিজরী ১ম (মতান্তরে ২য়) সনে আযান ফরয হয়। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৭৮)
সকল মুসলমানকে একত্রে সমবেত করে জামাআতবদ্ধভাবে নামায পড়ার জন্য এমন এক জিনিসের প্রয়োজন ছিল, যা শুনে বা দেখে তাঁরা জমা হতে পারতেন। এ জন্যে তাঁরা পূর্ব থেকেই মসজিদে উপস্থিত হয়ে নামাযের অপেক্ষা করতেন। এ মর্মে তাঁরা একদিন পরামর্শ করলেন; কেউ বললেন, ‘নাসারাদের ঘন্টার মত আমরাও ঘন্টা ব্যবহার করব।’ কেউ কেউ বললেন, ‘বরং ইয়াহুদীদের শৃঙ্গের মত শৃঙ্গ ব্যবহার করব।’ হযরত উমার (রাঃ) বললেন, ‘বরং নামাযের প্রতি আহ্বান করার জন্য একটি লোককে (গলি-গলি) পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়?’ কিন্তু মহানবী (ﷺ) বললেন, “হে বিলাল! ওঠ, নামাযের জন্য আহ্বান কর।”(বুখারী ৬০৪ , মুসলিম, সহীহ)
কেউ বললেন, ‘নামাযের সময় মসজিদে একটি পতাকা উত্তোলন করা হোক। লোকেরা তা দেখে একে অপরকে নামাযের সময় জানিয়ে দেবে।’ কিন্তু মহানবী (ﷺ) এ সব পছন্দ করলেন না। (আবূদাঊদ, সুনান ৪৯৮নং) পরিশেষে তিনি একটি ঘন্টা নির্মাণের আদেশ দিলেন। এই অবসরে আব্দুল্লাহ বিন যায়দ (রাঃ) স্বপ্নে দেখলেন, এক ব্যক্তি ঘন্টা হাতে যাচ্ছে। আব্দুল্লাহ বলেন, আমি তাকে বললাম, ‘হে আল্লাহর বান্দা! ঘন্টাটি বিক্রয় করবে?’ লোকটি বলল, ‘এটা নিয়ে কি করবে?’ আমি বললাম, ‘ওটা দিয়ে লোকেদেরকে নামাযের জন্য আহ্বান করব।’ লোকটি বলল, ‘আমি তোমাকে এর চাইতে উত্তম জিনিসের কথা বলে দেব না কি?’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই।’
তখন ঐ ব্যক্তি আব্দুল্লাহকে আযান ও ইকামত শিখিয়ে দিল। অতঃপর সকাল হলে তিনি রসূল (ﷺ) এর নিকট উপস্থিত হয়ে স্বপ্নের কথা খুলে বললেন। সব কিছু শুনে মহানবী (ﷺ) বললেন, “ইনশাআল্লাহ! এটি সত্য স্বপ্ন। অতএব তুমি বিলালের সাথে দাঁড়াও এবং স্বপ্নে যেমন (আযান) শুনেছ ঠিক তেমনি বিলালকে শুনাও; সে ঐ সব বলে আযান দিক। কারণ, বিলালের আওয়াজ তোমার চেয়ে উচ্চ।”
অতঃপর আব্দুল্লাহ (রাঃ) স্বপ্নে প্রাপ্ত আযানের ঐ শব্দগুলো বিলাল (রাঃ) কে শুনাতে লাগলেন এবং বিলাল (রাঃ) উচ্চস্বরে আযান দিতে শুরু করলেন। উমার (রাঃ) নিজ ঘর হতেই আযানের শব্দ শুনতে পেয়ে চাদর ছেঁচড়ে (তাড়াতাড়ি) বের হয়ে মহানবী (ﷺ) এর নিকট উপস্থিত হলেন; বললেন, ‘সেই সত্তার কসম, হে আল্লাহর রসূল! আমিও (২০ দিন পূর্বে) স্বপ্নে ঐরুপ দেখেছি।’ আল্লাহর রসূল (ﷺ) তাঁকে বললেন, “অতএব যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহরই।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৪৯৮-৪৯৯, তিরমিযী, সুনান ১৮৯, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৭০৬নং)
মহানবী (ﷺ) এর মুআযযিন ছিল মোট ৪ জন। মদ্বীনায় ২ জন; বিলাল বিন রাবাহ্ ও আম্র বিন উম্মে মাকতূম কুরাশী। আম্র ছিলেন অন্ধ।আর কুবায় ছিলেন সা’দ আল-কুর্য। মক্কায় আবূ মাহ্যূরাহ্ আওস বিন মুগীরাহ্ জুমাহী। (যাদুল মাআদ, ইবনুল কাইয়েম ১/১২৪)
আব্দুল্লাহ বিন যায়দ (রাঃ) এর বর্ণিত বিলাল (রাঃ) এর আযান ছিল নিম্নরুপ:-
اَللهُ أَكْبَر
(আল্লা-হু আকবার) ৪ বার।
أَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلهَ إِلاَّ الله
(আশহাদু আল লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ্) ২ বার।
أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً رَّسُوْلُ الله
(আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লা-হ্) ২ বার।
حَيَّ عَلَى الصَّلاَة
(হাইয়্যা আলাস স্বলা-হ্) ২ বার।
حَيَّ عَلَى الْفَلاَح
(হাইয়্যা আলাল ফালা-হ্) ২ বার।
اَللهُ أَكْبَر
(আল্লা-হু আকবার) ২ বার।
لا إِلهَ إِلاَّ الله
(লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ্) ১ বার। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৪৯৯নং)
আবূ মাহ্যূরাহ্ (রাঃ) কে আল্লাহর রসূল (ﷺ) নিম্নরুপ আযান শিখিয়েছিলেন:-
اَللهُ أَكْبَر
(আল্লাহ সবার চেয়ে মহান) ৪ বার।
أَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلهَ إِلاَّ الله
(আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ভিন্ন কোন সত্য উপাস্য নেই।) ২বার চুপে চুপে।
أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً رَّسُوْلُ الله
(আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রসূল।) ২ বার চুপে চুপে।
পুনরায় أشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلهَ إِلاَّ الله ২বার উচ্চস্বরে।
أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً رَّسُوْلُ الله
২বার উচ্চস্বরে।
حَيَّ عَلَى الصَّلاَة
(এস নামাযের জন্য) ২ বার।
حَيَّ عَلَى الْفَلاَح
(এস মুক্তির জন্য) ২ বার।
اَللهُ أَكْبَر
(আল্লাহ সবার চেয়ে মহান) ২ বার।
لاَ إِلهَ إِلاَّ الله
(আল্লাহ ভিন্ন কোন সত্য মা’বূদ নেই।) ১ বার।
আর এই আযানকে ‘তারজী’ আযান’ বলা হয়। (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৫০০নং, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
ফজরের আযান হলে حيَّ عَلَى الْفَلاَح এর পরে ২বার বলতে হয়,
اَلصَّلاَةُ خَيْرٌ مِّنَ النَّوْم
(আসস্বলা-তু খাইরুম মিনান্ নাওম। অর্থাৎ, নিদ্রা অপেক্ষা নামায উত্তম। (ঐ)
১। আযান যেন তার শব্দবিন্যাসের বিপরীত না হয়। যার পর যে বাক্য পরস্পর সজ্জিত আছে ঠিক সেই পর্যায়ক্রমে তাই বলা জরুরী। সুতরাং -উদাহ্রণস্বরুপ- যদি কেউحيَّ عَلَى الصَّلاَة বলার আগে حيَّ عَلَى الْفَلاَح বলে ফেলে, তাহলে পুনরায় حيَّ عَلَى الصَّلاَة বলে যথা অনুক্রমে আযান শেষ করবে। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৪৮)
২। একটা বাক্য বলার পর অন্য বাক্য বলতে যেন বেশী দেরী না হয়। মাইক ইত্যাদি ঠিক করতে গিয়ে বা অন্য কোন কারণে বিরতি অধিক হলে পুনরায় শুরু থেকে আযান দিতে হবে।
৩। আযান যেন নামাযের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পূর্বে না হয়। যেহেতু ওয়াক্তের পূর্বে আযান যথেষ্ট নয়। (মুগনী ১/৪৪৫) পূর্বে দিয়ে ফেললে ওয়াক্ত হলে পুনরায় আযান দেওয়া জরুরী। (আউনুল মা’বূদ ২/১৬৬) একদা হযরত বিলাল (ﷺ) (ফজরের) আযান ফজর উদয় হওয়ার আগেই দিয়ে ফেলেছিলেন। মহানবী (ﷺ) তাঁকে আদেশ করলেন যে, তিনি যেন ফিরে গিয়ে বলেন, ‘শোনো! বান্দা ঘুমিয়েছিল। শোনো! বান্দা ঘুমিয়েছিল।’ (অর্থাৎ ঘুমের ঘোরে সময় বুঝতে পারিনি।) (আবূদাঊদ, সুনান ৫৩২নং)
৪। আযানের শব্দাবলী আরবী। ভিন্ন ভাষায় (অনুবাদ করে) আযান তো শুদ্ধ নয়ই; পরন্তু ঐ আরবী শব্দগুলোর উচ্চারণে ভুল করাও বৈধ নয়। সুতরাং যদি আযানের এমন উচ্চারণ করা হয়, যাতে তার অর্থ বদলে যায়, তাহলে আযান শুদ্ধ নয়। যেমন, آللهُ أَكْبَر ‘আ-ল্লা-হু আকবার’ (প্রথমকার আলিফে টান দিয়ে) বলা। এর অর্থ হবে, ‘আল্লাহ কি সবার চেয়ে মহান?’ আল্লাহর মহানতায় সন্দেহ্ পোষণ করে এ ধরনের প্রশ্ন বোধক বাক্য বললে মানুষ কাফের হয়ে যায়। না জেনে বললে কাফের না হলেও আযান শুদ্ধ নয়।
তদনুরুপ الله أكبار ‘আল্লাহু আকবা-র’ (আকবারের শেষে টান দিয়ে) বললে এর অর্থ দাঁড়াবে, ‘আল্লাহ একমুখো তবলা!’ অথবা ‘আল্লাহ আকবা-র (এক শয়তানের নাম)! নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিক।
অনুরুপ যেখানে টান আছে সেখানে না টানা এবং যেখানে টান নেই সেখানে টান দেওয়া, ع (আইন) কে ا (আলিফ) এর মত অথবা তার বিপরীত, ح (বড় হে বাহা) কে هـ (ছোট হে বাহা)এর মত অথবা তার বিপরীত উচ্চারণ, ‘ফালাহ্’ ও ‘স্বালাহ্’ বলার সময় ‘হ্’এর উচ্চারণ বাদ দিয়ে ‘ফালা’ ও ‘সালা’ বলা, যের-যবর প্রভৃতি উল্টাপাল্টা করা ইত্যাদি আযানের অর্থ বদলে দেয়। এতে আযান শুদ্ধ হয় না।
৫। আযানের সমস্ত শব্দাবলী গোনা- গাঁথা। এর উপর কিছু অতিরিক্ত করা বিদআত। মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাদের এ (দ্বীনের) ব্যাপারে কোন নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)
তাই ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমাল,’ ‘আশহাদু আন্না সাইয়্যিদানা---’ প্রভৃতি বাড়তি শব্দ ও বাক্য বিদআত। (ফাতাওয়া মুহিম্মাহ্ তাতাআল্লাকু বিসসলাহ্, ইবনে বায ৩৪পৃ:)
তদনুরুপ ফজর ছাড়া অন্য ওয়াক্তের আযানে ‘আসস্বলাতু খাইরুম--’ বলা বৈধ নয়। ইবনে উমার (রাঃ) এটিকে বিদআত বলেছেন এবং তা শুনে সে আযানের মসজিদ ত্যাগ করেছেন। (আবূদাঊদ, সুনান ৫৩৮নং)
অনুরুপ আযানের পর আযানের মত চিল্লিয়ে ‘নামায পড়’ ইত্যাদি বলাও বিদআত। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ্, সঊদী উলামা-কমিটি ১/২৫২)
প্রকাশ যে, ফজরের আযানে ‘আসস্বলাতু খাইরুম--’ বলতে ভুলে গেলে আযানের কোন ক্ষতি হয় না। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৩৪৯)
আযান দিতে দিতে অতি প্রয়োজনে কথা বলায় দোষ নেই। (বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১১৬)
কোন কারণে আযান দিতে দিতে মুআযযিন তা শেষ করতে না পারলে অন্য ব্যক্তি নতুন করে শুরু থেকে আযান দেবে।
টেপ-রেকর্ডারের মাধমে আযান শুদ্ধ নয়। কারণ, আযান এক ইবাদত। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/৬১-৬২)
১। মুআযযিন যেন ‘মুসলিম’ ও জ্ঞানসম্পন্ন (সাবালক বা নাবালক) পুরুষ হয়। কোন মহিলার জন্য (পুরুষ-মহলে) আযান দেওয়া বৈধ নয়; দিলে সে আযান শুদ্ধ নয়। (মুগনী ১/৪৫৯)
২। মুআযযিন হবে সুন্দর চরিত্রের অধিকারী। যাতে তার আযান শুনে কারো মনে (আযানের প্রতি) বিতৃষ্ণা ও ঘৃণার উদ্রেক না হয়। (কাবীরা গুনাহ করে এমন) ফাসেকের আযান যদিও শুদ্ধ, তবুও কোন ফাসেককে মসজিদের মুআযযিন নিয়োগ করা ঠিক নয়। (মুগনী ১/৪৪৯)
৩। সেই ব্যক্তিই হবে যোগ্য মুআযযিন, যে আযানের শব্দাবলীর যথার্থ উচ্চারণ করতে সক্ষম।
৪। উপযুক্ত মুআযযিন সেই, যে আযান দেওয়ার উপর কোন পারিশ্রমিক নেয় না। একদা উসমান আবিল আস (রাঃ) আল্লাহর রসূল (ﷺ) কে বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমাকে আমার কওমের ইমাম বানিয়ে দিন।’ তিনি বললেন, “তুমি ওদের ইমাম। (তবে) ওদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তির কথা খেয়াল করে ইমামতি (ও নামাযহাল্কা) করো। আর এমন মুআযযিন রেখো, যে আযান দেওয়ার বিনিময়ে কোন বেতন নেবে না।” (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৫৩১, তিরমিযী, সুনান ২০৯, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান ৯৮৭নং,হাকেম, মুস্তাদরাক ৫/৩)
অবশ্য তার কিছু নেওয়ার উদ্দেশ্য না থাকার পরেও যদি তাকে কিছু পারিশ্রমিক দেওয়া হয়, তাহলে তা গ্রহণ করায় দোষ নেই। কিন্তু উদ্দেশ্য যদি বেতন পাওয়াই হয় অথবা নাম নেওয়া বা লোক-প্রদর্শন হয়, তবে তার ঐ আমল ছোট শির্কে পরিগণিত হবে। (রিসালাতুন ইলা মুআযযিন ৪২-৪৫ দ্র:)
৫। আযান দেওয়ার জন্য ওযু জরুরী নয়। কারণ, এ ব্যাপারে সহীহ হাদীস নেই। (ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ১/২৪০, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৩৫)
৬। আযান দিতে হবে উঁচু স্থানে; যাতে তার শব্দ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ইবনে উমার (রাঃ) উটের উপর চড়ে আযান দিতেন। (বায়হাকী, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২২৬নং) বিলাল (রাঃ) আযান দিতেন নাজ্জার গোত্রের এক মহিলার ঘরের ছাদে উঠে। কারণ, মসজিদের আশেপাশে সমস্ত ঘরের চেয়ে তার ঘরটাই ছিল বেশী উঁচু। আর আব্দুল্লাহ বিন শাকীক বলেন, ‘সুন্নাহ্ (মহানবী (ﷺ) এর তরীকা) হল মিনারে আযান দেওয়া এবং মসজিদের ভিতর ইকামত দেওয়া।’ (ইআশা: ২৩৩১ নং)
অবশ্য এ প্রয়োজন মাইকে মিটিয়ে দেয়। কিন্তু মাইক-ঘর মিনারের উপরে করলে সুন্নত পালনে ত্রুটি হয় না এবং আযান চলা অবস্থায় মাইক বন্ধ হলেও আযান পুরা করা যায়।
৭। দাঁড়িয়ে আযান দেওয়াই সুন্নত। ইবনুল মুনযির বলেন, ‘যাঁদের নিকট হতে ইলম সংরক্ষণ করা হয় তাঁরা এ বিষয়ে একমত যে, মুআযযিনের দাঁড়িয়ে আযান দেওয়াই সুন্নত।’ (ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ১/২৪১)
অবশ্য কোন অসুবিধার ক্ষেত্রে বসে আযান দেওয়াও দোষাবহ্ নয়। যেমন সাহাবী আবূ যায়দ (রাঃ) কোন জিহাদে গিয়ে তাঁর পা ক্ষত হলে বসে আযান দিতেন। (আষরাম, বায়হাকী ১/৩৯২, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২২৫নং)
৮। আযানের সময় কেবলামুখ হওয়া মুস্তাহাব। পূর্বে উল্লেখিত আব্দুল্লাহ বিন যায়দের হাদীসের এক বর্ণনায় আছে যে, এক ফিরিশ্তা আসমান থেকে অবতীর্ণ হয়ে এক পোড়ো বাড়ির দেওয়ালের উপর কেবলামুখে খাড়া হলেন---। (মুসনাদ ইসহাক বিন রাহওয়াইহ্, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ১/২৫০)
আযানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ্’ বলতে হবে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বলা উত্তম হলে নিশ্চয় এর কোন নির্দেশ থাকত। (রিসালাতুন ইলা মুআযযিন ৫১পৃ:)
৯। শব্দ জোর করার উদ্দেশ্যে দুই কানে আঙ্গুল রেখে নেওয়া সুন্নত। বিলাল (রাঃ) আযান দেওয়ার সময় কানে আঙ্গুল রাখতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, ইরওয়াউল গালীল, আলবানী ২৩০নং) অবশ্য আঙ্গুল দেওয়াটা জরুরী নয়। যেমন ইবনে উমার (রাঃ) আযান দেওয়ার সময় কানে আঙ্গুল রাখতেন না। (বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৩৫)
ইবনে হাজার (রহঃ) বলেন, ‘নির্দিষ্ট করে কোন্ আঙ্গুলকে কানে রাখতে হবে সে বিষয়ে কোন নির্দেশ আসে নি।’ (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৩৭)
১০। উপযুক্ত মুআযযিন সেই ব্যক্তি, যার গলার আওয়াজে জোর বেশী। যেহেতু উদ্দেশ্য হল বেশী বেশী লোককে নামাযের সময় জানিয়ে মসজিদের দিকে আহ্বান করা। তাই তো সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন যায়দ (রাঃ) এর মাধ্যমে আযানের সূচনা হলেও মুআযযিন হলেন বিলাল (রাঃ)। আর তার জন্যই মহানবী (ﷺ) আব্দুল্লাহ (রাঃ) কে বললেন, “তুমি আযানের শব্দ গুলো বিলালকে শিখিয়ে দাও। কারণ, তোমার চেয়ে ওর গলার জোর বেশী।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ৪৯৯নং প্রমুখ)
অনেকে বলেছেন, এই সাথে কণ্ঠ স্বর মিষ্টি হওয়াও মুস্তাহাব। কারণ, তাহলে আযান শুনে মানুষের হৃদয় নরম হবে এবং কারো মনে আযানের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মাবেনা। (মুগনী ১/৪২৮)
কোন নির্জন প্রান্তরে একা হলেও নামাযের সময় জোরদার শব্দে আযান দেওয়া উত্তম। মহানবী (ﷺ) আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহ্মান (রাঃ) কে বলেছিলেন, “আমি দেখছি, তুমি ছাগল-ভেঁড়া ও মরু-ময়দান পছন্দ কর। সুতরাং তুমি যখন তোমার ছাগল-ভেঁড়ার সাথে মরু-ময়দানে থাকবে এবং নামাযের (সময় হলে) আযান দেবে, তখন যেন উচ্চস্বরে আযান দিও। কারণ, মানুষ, জিন অথবা যে কেউই মুআযযিনের সামান্য শব্দও শুনতে পাবে, সে তার জন্য কিয়ামতে সাক্ষ্য দেবে।” (মালেক, মুঅত্তা, বুখারী, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান, মিশকাত ৬৫৬নং)
উচ্চস্বর বাঞ্জিত বলেই আযানে মাইক্রোফোন ব্যবহার (বিদআত) দূষনীয় নয়। বরং এ জন্য মাইক মুসলিমদের পক্ষে আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ২/৪৬)
১১। আযান ও ইকামতে তকবীরের শব্দ একটা একটা করে পৃথক পৃথক না বলা; বরং জোড়া জোড়া এক সাথে বলা বিধেয়। যেহেতু মহানবী (ﷺ) বলেন, “মুআযযিন যখন বলে, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’ এবং তোমাদের কেউ তার জওয়াবে বলে, ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার’---।” (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, সহিহ তারগিব ২৪৪নং)
১২। আযান টেনে টেনে হলেও গানের মত সুললিত কণ্ঠে লম্বা টান টানা মাকরুহ। সলফদের এক জামাআত এরুপ টানাকে অপছন্দ করেছেন। মালেক বিন আনাস প্রমুখ উলামাগণের নিকট তা মাকরুহ বলে বর্ণিত আছে। (তালবীসু ইবলীস, ইবনুল জাওযী ১৬৮পৃ:) উমার বিন আব্দুল আযীযের যুগে একজন মুআযযিন আযানে গানের মত টান দিলে তিনি তাকে বললেন, ‘সাধারণ (সাদা-সিধা) ভাবে আযান দাও। নচেৎ আমাদের নিকট থেকে দূর হয়ে যাও!’ (ইআশা:, বুখারী, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১০৫)
১৩। ‘হাইয়্যা আলাস সলা-হ্’ ও ‘---ফালা-হ্’ বলার সময় ডানে-বামে মুখ ফিরানো সুন্নত। আবূ জুহাইফাহ্ বলেন, আমি বিলালকে আযান দিতে দেখেছি। তিনি ‘হাইয়্যা আলাস সলা-হ্,হাইয়্যা আলাল ফালা-হ্’ বলার সময় তাঁর মুখকে এদিক ওদিক ডানে-বামে ফিরাতেন। (বুখারী ৬৩৪নং, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৫২০নং, নাসাঈ, সুনান)
২ বার ‘হাইয়্যা আলাস স্বলাহ্’ বলার সময় ডান দিকে এবং ‘---ফালা-হ্’ বলার সময় বাম দিকে মুখ ফিরানো যায়। এরুপ আমলই উক্ত হাদীসের অর্থের কাছাকাছি। পক্ষান্তরে প্রথমবার ‘হাইয়্য আলাস সলা-হ্’ বলার সময় ডান দিকে, তারপর দ্বিতীয়বার বলার সময় বাম দিকে, অনুরুপ ‘---ফালা-হ্’ বলার সময় ডান দিকে এবং দ্বিতীয়বার বলার সময় বাম দিকে মুখ ফিরালেও চলে। এতে উভয় দিকেই উভয় বাক্যই বলা হয়। (ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৩৬) উক্ত উভয় প্রকার আমলের মধ্যে কোন একটিকে নির্দিষ্ট করার ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই।
আযান মাইক্রো ফোনে ঘরের ভিতরে হলেও উক্ত সুন্নাত ত্যাগ করা উচিৎ নয়। (রিসালাতুন ইলা মুআযযিন ৩০পৃ:)
১৪। মুআযযিনের কর্তব্য যথা সময়ে আযান দেওয়া। কারণ, তার আযানের উপর লোকেদের নামায-রোযা শুদ্ধ-অশুদ্ধ হওয়া নির্ভর করে। অসময়ে আযান দিলে নামায ও রোযা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সুতরাং সময় জেনে আযান দেওয়া জরুরী। আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “মুআযযিনগণ লোকেদের নামায ও সেহ্রীর জিম্মেদার।” (বায়হাকী ১/৪২৬, ইর: ১/২৩৯)
তিনি আরো বলেন, “ইমাম (লোকেদের) যামিন, আর মুআযযিন হল তাদের (নামায-রোযার) জিম্মেদার। হে আল্লাহ! তুমি ইমামগণকে পথপ্রদর্শন কর এবং মুআযযিনগণকে ক্ষমা করে দাও।” এক ব্যক্তি বলল, ‘এ কথা শুনিয়ে আপনি তো আমাদেরকে আযানে প্রতিযোগিতা করতে লাগিয়ে দিলেন।’ তিনি বললেন, “তোমাদের পরে এমন যুগ আসবে, যে যুগের নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানুষরাই হবে মুআযযিন।” (আহমাদ, মুসনাদ, তাব:, বায়হাকী, ইবনে আসাকের প্রমুখ, ইর: ২১৭নং)
আযান শুরু হলে চুপ থেকে শুনে তার জওয়াব দেওয়া বিধেয় (সুন্নত)। মুআযযিন ‘আল্লাহু আকবার’ বললে, শ্রোতাও তার জবাবে ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে। মুআযযিন ‘আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্, আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্’ বললে শ্রোতা বলবে, ‘অআনা, অআনা।’ অর্থাৎ আমিও সাক্ষি দিচ্ছি, আমিও। (আবূদাঊদ, সুনান ৫২৬নং)
এই সময় নিম্নের দুআও বলতে হয়:-
وَ أَنَا أَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ وَ (أَشْهَدُ) أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، رَضِيْتُ بِاللهِ رَباًّ وَبِمُحَمَّدٍ رَسُوْلاً وَّ بِالإِسْلاَمِ دِيْناً।
উচ্চারণ:- অআনা আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু অহ্দাহু লা শারীকা লাহ্, অ (আশহাদু) আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু অরাসূলুহ্। রাযীতু বিল্লাহি রা ব্বাঁ উঅবিমুহাম্মাদিন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামা) রাসূলাঁউঅবিল ইসলামি দ্বীনা।
অর্থাৎ, আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ সত্য উপাস্য নেই, তিনি একক, তাঁর কোন অংশী নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর বান্দা ও রসূল। আল্লাহ আমার প্রতিপালক হওয়ার ব্যাপারে, মুহাম্মাদ (ﷺ) রসূল হওয়ার ব্যাপারে এবং ইসলাম আমার দ্বীন হওয়ার ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট।
এই দুআ পড়লে গুনাহসমূহ মাফ হয়ে যায়। (মুসলিম, সহীহ ৩৮৬, আবূদাঊদ, সুনান ৫২৫নং, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
আযানে মহানবী (ﷺ) এর নাম শুনে চোখে আঙ্গুল বুলানো বিদআত। এ ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসটি জাল। (তাযকিরাহ্, ইবনে তাহের, রিসালাতুন ইলা মুআযযিন ৫৬পৃ:) অনুরুপ সেই সময় আঙ্গুলে চুমু খাওয়াও বিদআত।
মুআযযিন ‘হাইয়্যা আলাস স্বালাহ্’ ও ‘---ফালাহ্’ বললে জওয়াবে শ্রোতা বলবে,
لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِالله
উচ্চারণ:- লাহাউলা অলা ক্বু ওঅতা ইল্লা বিল্লাহ্।
অর্থাৎ, আল্লাহর তওফীক ছাড়া পাপকর্ম ত্যাগ করা এবং সৎকর্ম করার সাধ্য কারো নেই। (মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান ৫২৭নং)
মুআযযিন ‘আসস্বলাতু খাইরুম মিনান নাউম’ বললে অনুরুপ বলে জওয়াব দিতে হবে। এর জওয়াবে অন্য কোন দুআ (যেমন ‘স্বাদাকতা অবারিরতা বা বারারতা--’ বলার হাদীস নেই। (সুবুলুস সালাম ৮৭পৃ:, তুহ্ফাতুল আহওয়াযী ১/৫২৫)
আযান শেষ হলে মহানবী (ﷺ) এর উপর দরুদ পাঠ করে নিম্নের দুআ পড়লে কিয়ামতে তাঁর সুপারিশ নসীব হবে;
اَللّهُمَّ رَبَّ هذِهِ الدَّعْوَةِ التَّامَّةِ، وَالصَّلاَةِ الْقَائِمَةِ، آتِ مُحَمَّداً الْوَسِيْلَةَ وَالْفَضِيْلَةَ وَابْعَثْهُ مَقَاماً مَّحْمُوْداً الَّذِيْ وَعَدْتَّهُ।
“আল্লাহুম্মা রাব্বাহা-যিহিদ দা’ওয়াতিত তা-ম্মাতি অসসালা-তিল ক্বা-ইমাহ্, আ-তি মুহাম্মাদানিল অসীলাতা অলফাযীলাহ্, অবআসহু মাক্বা-মাম মাহ্মূদানিল্লাযী অআত্তাহ্।”
অর্থাৎ, হে আল্লাহ! হে এই পরিপূর্ণ আহবান ও প্রতিষ্ঠালাভকারী নামাযের প্রভু! তুমি মুহাম্মাদ (ﷺ) কে অসীলাহ্ (জান্নাতের সুউচ্চ স্থান) এবং মর্যাদা দান কর। আর তাঁকে সেই মাক্বামে মাহ্মূদ (প্রশংসিত স্থানে) প্রেরণ করো যার প্রতিশ্রুতি তুমি তাঁকে দান করেছ। (বুখারী ৬১৪নং, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্, সুনান)
প্রকাশ যে, উক্ত দুআর মাঝে ইবনে সুন্নীর বর্ণনায় ‘অদ্দারাজাতার রাফীআহ্’, (তদনুরুপ লোকেদের বর্ণনায় ‘সাইয়্যিদানা মুহাম্মাদান’, অরযুক্বনা শাফাআতাহু’) এবং শেষে বাইহাকীর বর্ণনায় অতিরিক্ত ‘ইন্নাকা লা তুখলিফুল মীআদ’ প্রভৃতি শুদ্ধ নয়। (ইর: ১/২৬১)
আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “মুআযযিনকে আযান দিতে শুনলে তোমরাও ওর মতই বল। অতঃপর আমার উপর দরুদ পাঠ কর; কেননা, যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ এর বিনিময়ে তার উপর দশবার রহ্মত বর্ষণ করেন। অতঃপর তোমরা আমার জন্য আল্লাহর নিকট অসীলা প্রার্থনা কর; কারণ, অসীলা হল জান্নাতের এমন এক সুউচ্চ স্থান, যা আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে একটি বান্দার জন্য উপযুক্ত। আর আমি আশা রাখি যে, সেই বান্দা আমিই। সুতরাং যে ব্যক্তি আমার জন্য ঐ অসীলা প্রার্থনা করবে, তার জন্য আমার শাফাআত (সুপারিশ) অবধার্য হয়ে যাবে।” (মুসলিম, সহীহ প্রমুখ, মিশকাত ৬৫৭নং)
আযানের পূর্বে শুরুতে (উচ্চস্বরে বা মাইক্রোফোনে) দরুদ বা তাসবীহ পাঠ এবং অনুরুপ শেষেও দরুদ বা উক্ত দুআ (জোরে-শোরে) পাঠ বিদআত। শিখাবার উদ্দেশ্যেও আল্লাহর নবী (ﷺ) বা সলফদের কেউই এরুপ করে যান নি। (ইবনে বায, ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/৯২, টীকা) যেমন আযান ও ইকামতের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ্’ পড়া বিদআত। (আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ১/১৩২) তদ্রুপ উপরোক্ত ঐ দুআ পড়ার সময় হাত তোলাও বিধেয় নয়। বিধেয় নয় আযান শুরু হলে মহিলাদের মাথায় কাপড় নেওয়া।
জ্ঞাতব্য যে, আযানের জওয়াব দেবে প্রত্যেক সেই ব্যক্তি যার জন্য আল্লাহর যিক্র করা বৈধ। অতএব পবিত্র অবস্থায়, অপবিত্র বা মাসিক অবস্থায় নারী-পুরুষ সকলের জন্যই আযানের জওয়াব দেওয়া মুস্তাহাব। অবশ্য নামায পড়া অবস্থায়, প্রস্রাব-পায়খানা করা অথবা বাথরুমে থাকা অবস্থায় এবং স্ত্রী-মিলন রত অবস্থায় আযানের উত্তর দেওয়া বৈধ নয়। এসব কাজ থেকে ফারেগ হওয়ার পর বাকী আযানের উত্তর দেওয়া বিধেয়।
যে ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত বা যিক্র করে অথবা দারস দেয় সে ব্যক্তি তা বন্ধ রেখে আযানের জওয়াব দিয়ে পুনরায় তা ছেড়ে রাখা জায়গা থেকে শুরু করবে। (ফিকহুস সুন্নাহ্ ১/৮৭)
খাওয়ার সময় আযান হলে খেতে খেতেও আযানের জওয়াব দিতে এবং তারপর দুআ পড়তে কোন বাধা নেই। (ফাতাওয়া ইবনে উষাইমীন ১/৫৩২)
আযানের সময় দুআ কবুল হয়ে থাকে। (আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, জামে ৩০৭৯ নং)
ভয়, শত্রুতা প্রভৃতির কারণে মসজিদে যেতে বাধা থাকলে, মসজিদ বহু দূরে হলে (এবং আযান শুনতে না পেলে), সফরে কোন নির্জন প্রান্তরে থাকলে, যে জায়গায় থাকবে সেই জায়গাতেই নামাযের সময় হলে আযান-ইকামত দিয়ে নামায আদায় করতে হবে। একা হলে আযান ওয়াজেব না হলেও সুন্নত অবশ্যই বটে।
মহানবী (ﷺ) বলেন, “যখন সফরে থাকবে, তখন তোমরা আযান দিও এবং ইকামত দিও। আর তোমাদের মধ্যে যে বড় সে ইমামতি করো।” (বুখারী, মিশকাত ৬৮২নং)
তাছাড়া আল্লাহর নবী (ﷺ) এবং সাহাবাগণ সফরে থাকলে ফাঁকা মাঠে আযান দিয়ে নামায পড়েছেন। (মুসলিম, সহীহ ৬৮১নং, প্রমুখ)
মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমার প্রতিপালক বিস্মিত হন পর্বত চূড়ায় সেই ছাগলের রাখালকে দেখে যে নামাযের জন্য আযান দিয়ে (সেখানেই) নামায আদায় করে; আল্লাহ আযযা অজাল্ল্ বলেন, “তোমরা আমার এই বান্দাকে লক্ষ্য কর, (এমন জায়গাতেও) আযান দিয়ে নামায কায়েম করছে! সে আমাকে ভয় করে। আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম এবং জান্নাতে প্রবেশ করালাম।” (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, সহিহ তারগিব ২৩৯ নং)
তিনি বলেন, “কোন ব্যক্তি যখন কোন বৃক্ষ-পানিহীন প্রান্তরে থাকে, অতঃপর সেখানে নামাযের সময় উপস্থিত হয়, তখন সে যেন ওযু করে। পানি না পেলে যেন তায়াম্মুম করে। অতঃপর সে যদি শুধু ইকামত দিয়ে নামায পড়ে, তাহলে তার সাথে তার সঙ্গী দুই ফিরিশ্তা নামায পড়েন। কিন্তু সে যদি আযান দিয়ে ও ইকামত দিয়ে নামায পড়ে, তাহলে তার পশ্চাতে আল্লাহর এত ফিরিশ্তা নামায পড়েন, যাদের দুই প্রান্ত নজরে আসে না!” (আব্দুর রাযযাক, মুসান্নাফ, সহিহ তারগিব ২৪১নং)
আর একদা তিনি আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহ্মানকে মরুভূমিতে ছাগপালে থাকাকালে নামাযের জন্য উচ্চশব্দে আযান দিতে আদেশ করেছিলেন। (বুখারী প্রমুখ, মিশকাত ৬৫৬নং)
মসজিদে কেউ আযান না দিলে এবং শহরে বা গ্রামে থাকতে সকলের নামায কাযা হলে অথবা সফরে পুরো জামাআতের বা একাকীর নামায কাযা হলে অসময়েও আযান-ইকামত দিয়ে নামায পড়া কর্তব্য।
একদা মহানবী (ﷺ) সাহাবাসহ্ সফরে থাকাকালীন তাঁদের ফজরের নামায কাযা হয়ে যায়। সূর্য ওঠার পর তেজ হয়ে এলে ঐ স্থান ত্যাগ করে অন্য স্থানে গিয়ে বিলাল (রাঃ) আযান দেন। অতঃপর যথা নিয়মে ফজরের নামায আদায় করেন। (মুসলিম, সহীহ ৬৮১নং, প্রমুখ)
যেমন খন্দকের যুদ্ধের সময় একদা সকলের চার ওয়াক্তের নামায ক্বাযা হলে, এশার পর আযান দিয়ে যোহ্র, আসর, মাগরিব ও এশার নামায আদায় করেছিলেন। (আহমাদ, মুসনাদ প্রমুখ, ইর: ১/২৫৭)
নামাযের সময় বাকী থাকলে এবং আযানের যথা সময় পার হয়ে গেলে খুব দেরীতে হলেও আযান দিয়েই নামায পড়তে হবে। অবশ্য গ্রামে বা শহরে অন্যান্য মসজিদে আযান হয়ে থাকলে যে মসজিদে আযান দিতে খুব দেরী হয়ে গেছে সে মসজিদে আযান না দিলেও চলবে। তবে দেরী সামান্য হলে আযান দেওয়াই উত্তম। কিন্তু গ্রামে এ ছাড়া অন্য মসজিদ না থাকলে খুব দেরী হয়ে গেলেও আযান দেওয়া জরুরী। (ফ: ইবনে বায, রিসালাতুন ইলা মুআযযিন ৬৭পৃ:, তুহ্ফাতুল ইখওয়ান, ইবনে বায ৭৭পৃ:)
হযরত আয়েশা (রাঃ) এর আযান ও ইকামত দেওয়ার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীস সহীহ নয়। অবশ্য বাইহাকীতে আছে, আম্র বিন আবী সালামাহ্ বলেন, আমি সওবানকে জিজ্ঞাসা করলাম যে, ‘মেয়েরা কি ইকামত দিতে পারে?’ উত্তরে তিনি তাঁর পিতা হতে বর্ণনার কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘মকহুল বলেছেন, যদি মহিলারা আযান-ইকামত দেয় তবে তা আফযল। আর যদি শুধু ইকামত দেয়, তবে তাও যথেষ্ট।’ সওবান বলেন, যুহ্রী উরওয়া হতে এবং তিনি হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি (আয়েশা) বলেছেন, ‘আমরা বিনা ইকামতেই নামায পড়তাম।’ (এর সনদটি হাসান।)
ইমাম বাইহাকী বলেন, ‘প্রথমোক্ত আসারের সাথে -যদি এই আসার সহীহ হয় তাহলে উভয়ের মধ্যে- পরস্পর বিরোধিতা নেই। কারণ, হতে পারে যে, জায়েয বর্ণনার উদ্দেশ্যে তিনি উভয় প্রকারের আমল (কখনো এরুপ, কখনো ঐরুপ) করেছেন। আর আল্লাহই অধিক জানেন।’
আল্লামা আলবানী বলেন, এ ব্যাপারে সঠিক অভিমত হল নবাব সিদ্দীক হাসান খানের; তিনি বলেছেন, ‘---আর প্রকাশ যে, মহিলারা আমলে পুরুষদের মতই। কারণ, মহিলারা পুরুষদের সহোদরা। পুরুষদেরকে যা করতে আদেশ হয়, সে আদেশ মহিলাদের উপরেও বর্তায়। পক্ষান্তরে তাদের পক্ষে আযান-ইকামত ওয়াজেব না হওয়ার ব্যাপারে কোন গ্রহণযোগ্য দলীল নেই। আযান না থাকার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসের সনদের কিছু বর্ণনাকারী পরিত্যক্ত; যাদের হাদীস দলীলযোগ্য নয়। সুতরাং মহিলাদেরকে সাধারণ এ নির্দেশ থেকে খারিজ করার মত কোন নির্ভরযোগ্য দলীল থাকলে উত্তম; নচেৎ ওরাও পুরুষদের মতই।’ (আর-রওযাতুন নাদিয়্যাহ্ ১/৭৯, সিলসিলাহ যায়ীফাহ, আলবানী ২/২৭১)