সুন্নাহতে এ কথা স্পষ্ট যে, নামাযীর উভয় হাত নামাযে কিয়াম অবস্থায় বক্ষস্থলে থাকবে। কিন্তু ‘নামায’ ও ‘কিয়াম’ নির্দিষ্ট করে কোন্ অবস্থাকে বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
কিয়ামে হাত বাঁধা বলতেও কি (রুকূর আগের ও পরের) উভয় কিয়ামকেই বুঝায়?
প্রত্যেক হাড় তার স্বস্থানে বা নিজ জোড়ে ফিরে যায় বলতে কি হাতও নিজের জায়গায় ফিরে যায়? নাকি এখানে শুধু মেরুদন্ডের হাড়ের কথাই বুঝানো হয়েছে? হাড়গুলোর নিজের জায়গায় বা জোড়ে ফিরে যাওয়ার অর্থে পুন:হাত বাঁধাও কি শামিল? নাকি উদ্দেশ্য হল উক্ত অবস্থায় পিঠ সোজা করে স্থির হওয়া (ইত্বমিনান)? হাত নিজের জায়গায় ফিরে গেলে, তার নিজের জায়গা বুকে থাকা অবস্থাটা, নাকি স্বাভাবিকভাবে ঝুলে থাকা অবস্থাটা?
বাস্তবপক্ষে ‘নামায’ ও ‘কিয়াম’ বলতে যদি রুকূর আগের কিয়াম (লম্বা দাঁড়ানো) ও রুকূর পরের কওমাহ্ (একটু দাঁড়ানো) উভয়কে এবং হাড় বলতে যদি হাতকেও তথা তার নিজ জায়গা বলতে বুকের উপরকে বুঝা হয়, তাহলে কওমাতেও বুকে হাত বাঁধা সুন্নত।
তাছাড়া (রুকূর আগের) কিয়ামে হাত বুকের উপর, রুকূ অবস্থায় হাঁটুর উপর, সিজদাহ অবস্থায় চেহারার দুই পাশে মুসাল্লায়, বসা অবস্থায় হাঁটু বা রানের উপর রাখার ব্যাপারে দলীল স্পষ্ট। কিন্তু রুকূর পর কওমার অবস্থায় হাত কোথায় থাকবে সে ব্যাপারে কোন প্রত্যক্ষ ও স্পষ্ট দলীল সুন্নাহতে নেই। অতএব অস্পষ্ট দলীলকে ভিত্তি করে বলা যায়, এই কিয়াম (কওমাহ্) ও ঐ কিয়ামেরই মত। তাই উভয় অবস্থায় বুকে হাত বাঁধা সুন্নত। (ইবনে বায, মাজমূআতু রাসাইল ফিস স্বালাহ্, ১৩৪পৃ:, ইবনে উসাইমীন, মুম ৩/১৪৬)
পক্ষান্তরে সাহাবাগণের এত এত হাদীসে রসূল (ﷺ) এর নামায-পদ্ধতির সূক্ষ্ণ বর্ণনা ও প্রত্যেক স্থানে হাত রাখার কথা উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ হাদীস বা বর্ণনা না থাকার ফলে তা বিদআতও হতে পারে। (আলবানী, সিফাতু স্বালাতিন নাবী (ﷺ), আলবানী ১৩৯পৃ:)
সুতরাং বিষয়টি যে বিতর্কিত তা বলাই বাহুল্য। ফায়সালা ইজতিহাদের উপর। আর “মুজতাহিদ (আলেম) যখন ইজতিহাদ করে (কোন বিষয়ে সঠিক সি দ্ধান্তে পৌঁছনোর চেষ্টা করে) এবং সে সঠিকতায় পৌঁছে যায়, তখন তার ডবল সওয়াব লাভ হয়। কিন্তু ইজতিহাদ করে ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছলেও তার (গুনাহ হয় না, বরং) একটি সওয়াব লাভ হয়।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৩৭৩২ নং) এ ব্যাপারে কেউই অপরাধী নয়।
ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, খন্দকের যুদ্ধ শেষে যখন নবী (ﷺ) ফিরে এলেন, তখন তিনি আমাদেরকে বললেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যেন বনী কুরাইযাহ্ ছাড়া অন্য স্থানে (আসরের) নামায না পড়ে।” পথে চলতে চলতে আসরের সময় উপস্থিত হল। একদল বলল, সেখানে না পৌঁছে আমরা নামায পড়ব না। (কারণ, তিনি সেখান ছাড়া অন্য স্থানে নামায পড়তে নিষেধ করেছেন।) অপর দল বলল, বরং আমরা পথেই নামায পড়ে নেব। (কারণ, নামাযের সময় এসে উপস্থিত হয়েছে। তাছাড়া) তাঁর উদ্দেশ্য এই ছিল না যে, আসরের সময় হলেও আমরা নামায পড়ব না। (বরং তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, আমরা যেন তাড়াতাড়ি বনী কুরাইযায় পৌঁছে যাই, যাতে সেখানে গিয়ে আসরের সময় হয়। ফলে প্রথম দল পথিমধ্যে নামায পড়ল না। আর দ্বিতীয় দল পড়ে নিল।) অতঃপর নবী (ﷺ) এর নিকট ঘটনাটি খুলে বলা হলে তিনি কোন দলকেই ভর্ত্সনা করলেন না। (বুখারী ৯৪৬ নং, মুসলিম, সহীহ)
যেহেতু তাঁদের দলীল ছিল দ্ব্যর্থ বোধক। তাই প্রত্যেকের ধারণা এবং সিদ্ধান্তও ছিল সঠিক। আর তার জন্যই নিন্দার্হও হলেন না কেউ।
কওমায় হাত বাঁধার ব্যাপারটিও অনুরুপ ইজতিহাদী পর্যায়ের। দ্ব্যর্থবোধক বা অস্পষ্ট দলীল নিয়ে একে অন্যের নিন্দা করা অবশ্যই উচিৎ নয়।
ব্যাপারটি স্পষ্ট দলীল-ভিত্তিক নয় বলেই ইমাম আহমাদ বিনহাম্বল (রহঃ) বলেছেন, ‘নামাযীর ইচ্ছা হলে রুকূর পর উঠে নিজেরহাত দু’টিকে ছেড়ে রাখবে, নচেৎ চাইলে বুকের উপর রাখবে।’ (মাসাইলু আহমাদ, সালেহ্ বিন ইমাম আহমাদ ২/২০৫, ফুরু’ ১/৪৩৩, মুবদি’ ১/৪৫১, ইনসাফ ২/৬৩, শারহু মুন্তাহাল ইরাদাত ১/১৮৫, আলমুমতে’, শারহে ফিক্হ, ইবনে উষাইমীন ৩/১৪৬) আর তাঁর নিকট কিয়াম ও কওমাহ্ এক নয় বলেই কওমায় এই এখতিয়ার।
সুতরাং আপনার জন্যও এখতিয়ার রয়েছে কওমায়হাত বাঁধা বা না বাঁধার। তবে মনে রাখবেন যে, এটি একটি সন্দিগ্ধ সুন্নত। সুন্নত হলে এবং তা পালন করলে আপনি তার সওয়াবের অধিকারী হবেন। না মানলে অপরাধী বা গুনাহগার হবেন না। পক্ষান্তরে বিদআত হলে তা আপত্তি কর। পরন্তু সেটাও সন্দিগ্ধ। অতএব এ নিয়ে বাড়াবাড়ি এবং আপোসে মনোমালিন্য তথা বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্য আনা আদৌ সমীচীন নয়।