সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ স্বভাবজাত (ফিতরাত) সুন্নাতসমূহ আবূ মালিক কামাল বিন আস-সাইয়্যিদ সালিম ৪ টি
স্বভাবজাত সুন্নাতসমূহ দ্বারা উদ্দেশ্য কী? এবং সেগুলো কি কি?

স্বভাবজাত সুন্নাত হলো এমন রীতি যা সম্পাদন করলে এর সম্পাদনকারী এমন ফিতরাতের সাথে বিশেষিত হবেন যে ফিতরাতের উপর আল্লাহ্‌ তার বান্দাদের সৃষ্টি করেছেন এবং এর উপর ভিত্তি করে তার হাশর-নাশর হবে। আল্লাহ্‌ তাদেরকে এর জন্য ভালবাসবেন। যেন তারা এর মাধ্যমে পূর্ণগুণের অধিকারী হতে পারে এবং আকৃতিগতভাবে মর্যাদা পায়। এ ব্যাপারে ইসলামী শরীয়াত একমত যে, এটা একটি প্রাচীন সুন্নাত যা সকল নাবী পছন্দ করেছেন। এটি স্বভাবজাত বিষয়, যা সকল নাবী পছন্দ করেছেন।[1]

স্বভাবজাত রীতি অনুসরণের মাধ্যমে দ্বীনই ও দুনিয়াবী অনেক কল্যাণ রয়েছে। যেমন: এর ফলে সমুদয় দৈহিক গঠন সুন্দর থাকে এবং শরীর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নণ থাকে।[2]

অতঃপর কতিপয় স্বভাবজাত সুন্নাত নিম্নে আলোচিত হলো:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ قَالَ: الْفِطْرَةُ خَمْسٌ: الِاخْتِتَانُ، وَالِاسْتِحْدَادُ، وَقَصُّ الشَّارِبِ، وَتَقْلِيمُ الْأَظْفَارِ، وَنَتْفُ الْإِبْطِ

(ক) আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন: স্বভাবজাত বিষয় ৫ টি। খাতনা করা, নাভীর নীচের লোম পরিষ্কার করা, গোঁফ খাটো করা, নখ কাটা, বগলের পশম উপড়িয়ে ফেলা।[3]

عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ: " عَشْرٌ مِنَ الْفِطْرَةِ: قَصُّ الشَّارِبِ، وَإِعْفَاءُ اللِّحْيَةِ، وَالسِّوَاكُ، وَاسْتِنْشَاقُ الْمَاءِ، وَقَصُّ الْأَظْفَارِ، وَغَسْلُ الْبَرَاجِمِ، وَنَتْفُ الْإِبِطِ، وَحَلْقُ الْعَانَةِ، وَانْتِقَاصُ الْمَاءِ " قَالَ زَكَرِيَّا: قَالَ مُصْعَبٌ: وَنَسِيتُ الْعَاشِرَةَ إِلَّا أَنْ تَكُونَ الْمَضْمَضَةَ

(খ) আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: ১০ টি বিষয় স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত। গোঁফ খাটো করা, দাঁড়ি লম্বা করা, মিসওয়াক করা, নাকে পানি দেয়া, নখ কাটা, অঙ্গের গিরাসমূহ ঘষে মেজে ধৌত করা, বগলের পশম উপড়িয়ে ফেলা, নাভীর নীচের পশম পরিষ্কার করা, মলমূত্র ত্যাগের পর পানি ব্যবহার করা তথা ইসতিনজা করা। যাকারিয়া বলেন, মাস‘আব বলেছেন: আমি দশ নম্বরটি ভুলে গেছি। সম্ভবতঃ তা হলো কুলি করা।[4]


এ দু’টি হাদীস থেকে বুঝা যায় স্বভাবজাত ফিতরাতসমূহ শুধু এই দশটির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নিম্নে তা থেকে উল্লেখ করা হলো:

(১) খাতনা করা বা সুন্নৎ দেয়া

(২) মলমূত্র ত্যাগের পর পানি ব্যবহার করা তথা ইসতিনজা করা

(৩) মিসওয়াক করা

(৪) নখ কাটা

(৫) গোঁফ খাটো করা

(৬) দাঁড়ি লম্বা করা

(৭) নাভীর নীচের পশম পরিষ্কার করা

(৮) বগলের পশম উপড়িয়ে ফেলা

(৯) বিভিন্ন অঙ্গের গিরাসমূহ ঘষে মেজে ধৌত করা। এর দ্বারা উদ্দেশ্য ঐ সমস্ত গিরা যেগুলোতে ময়লা জমা হয়। যেমন: আঙ্গুলের গিরাসমূহ, কানের গোড়াসমূহ ইত্যাদি।

(১০) কুলি করা ও নাকে পানি দেয়া।

[1] নাইলুল আওতার (১/১০৯), আলস্নামা আইনী প্রণীত উম্মদাতুল কারী (২২/৪৫)।

[2] মানাভী প্রণীত ফাইযুল কাদীর (১/৩৮)।

[3] সহীহ; বুখারী হা/ ৫৮৯১; মুসলিম হা/২৫৭।

[4] হাসান; মুসলিম হা/ ২৬১ আবূ দাউদ হা/ ৫২, তিরমিযী ৬/২৯ নাসাঈ ৮/১২৬; ইবনে মাজাহ হা/ ২৯৩;

الختان বা খাতনার পরিচয় ও তার হকুম:

الختان শব্দটি মাসদার। এর মূলবর্ণ ختن -আভিধানিক অর্থ কর্তন করা।

পরিভাষায়: পুরুষাংগের অগ্রভাগ আবৃতকারী চামড়া ও নারীর যৌনাংগের পর্দা (ভৌগলিক কারণে পর্দা বা হাইমেন মেমব্রেন অনেক মোটা হয়) কেটে দেয়াকে খাতনা বলে।[1]

খাতনা করার হকুম: বিদ্বানগণ এ ব্যাপারে তিনটি মতামত পেশ করেছেন।

(১) নারী পুরুষ সকলের খাতনা করা ওয়াজিব।

(২) উভয়ের জন্য খাতনা করা মুস্তাহাব।

(৩) পুরুষের জন্য ওয়াজিব ও নারীর জন্য মুস্তাহাব।

ইবনে কুদামা মুগনি গ্রন্থে (১/৮৫) বলেন: খাতনা করা পুরুষের জন্য ওয়াজিব। আর মহিলাদের জন্য সম্মানজনক কাজ। এটা তাদের প্রতি ওয়াজিব নয়। অনেক আলিম এ অভিমত পেশ করেছেন।

ইমাম নাববী মাজমু গ্রন্থে (১/৩০১) বলেন: সঠিক মতামত হলো- যা ইমাম শাফেঈ দলীলসহ বর্ণনা করেছেন এবং অধিকাংশ এ মতামতকে অকাট্য বলে প্রমাণ করেছেন যে, এটা নারী-পুরুষ সকলের উপর ওয়াজিব।

আমার বক্তব্য: পুরুষের খাতনা করা নিম্নোক্ত কারণে ওয়াজিব:

(১) কেননা এটা হযরত ইবরাহীম (ؑআঃ) এর রীতি। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

عن أبي هريرة قال قال رسول الله ﷺ: اختتن إبراهيم خليل الرحمن بعد ما أتت عليه ثمانون سنة

আবূ হুরাইরা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: ইবরাহীম খলীলুর রহমান ৮০ বছর বয়সে তাঁর খাতনা করেছিলেন।[2]

মহান আল্লাহ্‌ তার রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) কে লক্ষ্য করে বলেন:

﴿ثُمَّ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ أَنِ اتَّبِعْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ﴾

অর্থাৎ: তারপর আমি তোমার প্রতি ওহী পাঠিয়েছি যে, তুমি মিলস্নাতে ইবরাহীমের আনুগত্য কর, সে ছিল একনিষ্ঠ এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না (সূরা নাহল-১২৩)।

(২) বর্ণিত আছে: একদা এক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূল (ﷺ) তাকে বলেন:

« أَلْقِ عَنْكَ شَعْرَ الْكُفْرِ وَاخْتَتِنْ»

অর্থাৎ: তুমি তোমার দেহ থেকে কুফরীর চিহ্ন দূর কর এবং খাতনা কর।[3]

(৩) খাতনা করা মুসলমানদের নিদর্শন। এটা তাদের (মুসলমানদের) ইহুদি-খ্রিষ্টান থেকে পৃথককারী স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। সুতরাং অন্যান্য নিদর্শনের মত এটাও ওয়াজিব।

(৪) শরীরের কোন অংশ কাটা হারাম। আর হারাম জিনিস ওয়াজিব না হলে তা বৈধ হয় না। এটা ইমাম মালিক, শাফেঈ ও আহমাদ এর অভিমত। ইমাম মালিক এ ব্যাপারে কঠোর নীতি অবলম্বন করেছেন। এমন কি তিনি বলেছেন: যে ব্যক্তি খাতনা করে নি, তার ইমামতি করা বৈধ হবে না এবং তার সাক্ষ্যও গ্রহণ করা হবে না।

আবার অনেক ফক্বীহ্ ইমাম মালিক এর বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছেন যে, এটা সুন্নাত। কিন্তু এটা তার কাছে সুন্নাত হলেও তা পরিত্যাগ করা গুনাহের কাজ।[4]

মহিলাদের খাতনা:

শরীয়াতে মহিলাদের খাতনা করার বিধান রয়েছে। মহানাবী (ﷺ) বলেন:

«إِذَا الْتَقَى الْخِتَانَانِ فَقَدْ وَجَبَ الْغُسْلُ»

অর্থাৎ: যখন নারী-পুরুষ উভয়ের গোপনাঙ্গ একত্রিত হবে, তখন তাদের উপর গোসল ওয়াজিব হবে।[5]

এখানে الختان শব্দটি দ্বারা নারী-পুরুষের যৌনাংগের কর্তিত স্থানকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং এ দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মহিলারা খাতনা করতেন।

নারীদের খাতনা করার ব্যাপারে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তবে একটিও ক্রটিমুক্ত নয়। তন্মধ্যে উম্মে আত্বীয়া বর্ণিত হাদীস:

أَنَّ امْرَأَةً كَانَتْ تَخْتِنُ بِالْمَدِينَةِ فَقَالَ لَهَا النَّبِيُّ ﷺ: «لَا تَنْهِكِي فَإِنَّ ذَلِكَ أَحْظَى لِلْمَرْأَةِ، وَأَحَبُّ إِلَى الْبَعْلِ

উম্মে আত্বীয়া হতে বর্ণিত, জনৈক মহিলা মদ্বীনায় (মেয়েদের) খাতনা করাতো। নাবী (ﷺ) তাকে বললেন, খাতনাস্থানের অংশ খুব বেশি কাটিও না। কেননা এটা (কম কাটার জন্য সঙ্গমের সময়) নারীর জন্য অধিক তৃপ্তিদায়ক এবং স্বামীর কাছে খুবই প্রিয়।[6]

অপর বর্ণনায় রয়েছে:

إذا خفضت فأشمى ولا تنهكى فإنه أضوأ للوجه وأحظى عند الزوج

অর্থাৎ: ‘‘যখন নারীদের খাতনা করবে, তখন একে বারে কেটে শেষ করে দিও না । কেননা এতে চেহারা উজ্জল থাকবে এবং স্বামীর জন্য তা তৃপ্তিদায়ক হবে’’।[7]

এ হাদীসগুলোর সনদ দুর্বল, যদিও আলবানী সিলসিলা সহীহাহ’’ গ্রন্থে (হাদীস নং ৭২২) সহীহ বলেছেন। ব্যাপারটি এরূপ হওয়ার ফলে এক দল বলেন: এসব হাদীস যঈফ হলেও পুরুষের ন্যায় মহিলাদের খাতনা করা ওয়াজিব। কেননা নারী-পুরুষ উভয়েই শরীয়াতের বিধান পালনে সমধিকারী, যতক্ষণ না বিধানগতভাবে উভয়কে পৃথক করার দলীল বর্ণিত হয়। অথচ এরূপ দলীল বর্ণিত হয় নি।

আর অপর একদল বলেন: এটা মহিলাদের জন্য মুস্তাহাব ও সম্মানজনক কাজ। এটা ওয়াজিব নয়।[8] আর নারী পুরুষের মাঝে পৃথক করার কারণ হলো, পুরুষদের খাতনা করায় অনেক কল্যাণ রয়েছে। এর ফলে সালাতের জন্য পবিত্র হওয়ার যে শর্ত রয়েছে তা রক্ষা পায়। কেননা পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগের এ চামড়াটি যদি কাটা না হয়, তাহলে তাতে পেশাব অবশিষ্ট ও জমা হয়ে থাকে।

আর মহিলাদের খাতনা করার ফলে তাদের কামভাব হরাস পায়, অথচ এটা পরিপূর্ণ পাওয়াটা স্বাভাবিকতার দাবী। মূলতঃ তাদের কষ্ট দূর করার জন্য খাতনা করা হয় না।

আমার বক্তব্য: মহিলাদের খাতনার বিধান ওয়াজিব ও মুস্তাহাবের মাঝা-মাঝি। মহানাবী (ﷺ) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, খাতনা করা পুরুষের জন্য সুন্নাত ও মহিলাদের জন্য সম্মানজনক কাজ।[9] কিন্তু হাদীসটি যঈফ। যদি তা সহীহ হতো তাহলে দ্বন্দ্ব নিরসন করা সম্ভব হতো। আল্লাহ্‌ই সর্বাধিক অবগত।

[1] ইবনুল কাইয়্যূম প্রণীত তুহফাতুল মাওদূদ ( ১০৬-১৩২), মাজমূ (১/৩০১)।
[2] বুখারী হা/ ৬২৯৮; মুসলিম হা/ ৩৭০
[3] শাহেদ থাকার কারণে আলবানী এ হাদীসকে হাসান বলেছেন। আবু দাউদ (৩৫৬), বাইহাক্বী (১/১৭২) এ হাদীসের সনদে দু’জন মাজহুল (অপরিচিত) রাবী ও বিচ্ছিন্নতা আছে। এসত্ত্বেও এর কতিপয় শাহেদ (সমর্থক) হাদীস থাকার কারণে আলবানী হাসান বলেছেন। যা তার সহীহ আবূ দাউদ (৩৮৩), ইরওয়াউল গালীল (৭৯) এ বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আমি তা অবগত হতে পারি নি। ইমাম নাববী ও শাওকানী এ হাদীসকে যঈফ আখ্যা দিয়েছেন।
[4] তুহফাতুল মাউদুদ- ১১৩ পৃ.।
[5] সহীহ; আলোচ্য শব্দে ইবনে মাজাহ (৬১১) তে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। আর সহীহাইনে এসেছে "ومس الختان الختان فقد وجب الغسل" এ শব্দে।
[6] যঈফ; আবূ দাউদ (৫২৭১) এবং তিনি একে যঈফ বলেছেন।
[7] মুনকার; খতীব বাগদাদী প্রণীত আত তারিখ-(৫/৩২৭), জামি’ আহকামুন নিসা (১/১৯)।
[8] এ পদ্ধতিটি ইবনু উসাইমীন উল্লেখ করেছেন। যেমন এসেছে আল-মুমতি’ (১/১৪৩) তে।
[9] যঈফ; আহমাদ (৫/৭৫)।

السواك মিসওয়াক করা

السواك বা মিসওয়াকের পরিচয় এবং শরীয়াতে এর বিধান:

السواك শব্দটি ساك শব্দ থেকে গৃহীত। এর আভিধানিক অর্থ:دلك বা ঘষা, মাজা, মর্দন করা ইত্যাদি।

পরিভাষায়ঃ দাঁত থেকে হলুদ বর্ণ বা এ জাতীয় ময়লা দূর করার জন্য কাঠ বা গাছের ডাল ব্যবহার করাকে মিসওয়াক বলে।[1]

সবসময় মেসওয়াক করা মুস্তাহাব। যেমন আয়িশা বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে:

عَن عَائِشَةَ، النَّبِيِّ ﷺ قَالَ: السِّوَاكُ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ

আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল­াহ (ﷺ) থেকে বর্ননা করেন : তিনি বলেছেন যে, মিসওয়াক মুখের পবিত্রতা অর্জনের উপকরণ ও আল্লাহ্‌র সমেত্মাষ লাভের উপায়।[2]

নিম্নোক্ত সময়গুলোতে মিসওয়াক করা উত্তম বলে তাকিদ দেয়া হয়েছে:

১। ওযূর সময়:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَال: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: لَوْلا أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِي، لَأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ مَعَ الْوضُوْءِ

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: যদি অমার উম্মতের জন্য কষ্ট মনে না করতাম তাহলে আমি ওযূর সময় তাদের মিসওয়াক করতে নির্দেশ দিতাম।[3]

২। সালাতের সময়:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَال: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَوْلا أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِي، لَأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ عِنْدَ كُلِّ صَلَاةٍ

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্ট মনে না করতাম তাহলে আমি প্রত্যেক সালাতের সময় তাদের মিসওয়াক করতে নির্দেশ দিতাম।[4]

৩। কুরআন পাঠের সময়:

عَنْ عَلِىٍّ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ : أُمِرْنَا بِالسِّوَاكِ وَقَالَ : إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا قَامَ يُصَلِّى أَتَاهُ الْمَلَكُ فَقَامَ خَلْفَهُ يَسْتَمِعُ الْقُرْآنَ وَيَدْنُو ، فَلاَ يَزَالُ يَسْتَمِعُ وَيَدْنُو حَتَّى يَضَعَ فَاهُ عَلَى فِيهِ ، فَلاَ يَقْرَأُ آيَةً إِلاَّ كَانَتْ فِى جَوْفِ الْمَلَكِ.

আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমাদের মিসওয়াক করার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে। কেননা যখন কোন বান্দা সালাতে দাঁড়ায় তখন তার কাছে ফেরেশতা এসে তার পিছনে দাঁড়ায় ও কুরআন পড়া শুনতে থাকে এবং তার নিকটবর্তী হতে থাকে, এমন কি ফেরেশতা তার মুখকে তেলাওয়াতকারীর মুখের সাথে লাগিয়ে দেয়। ফলে প্রত্যেক আয়াত ফেরেশতার পেটের ভিতর প্রবেশ করে।[5]

৪। গৃহে প্রবেশের সময়:

عَنِ الْمِقْدَامِ بْنِ شُرَيْحٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ سَأَلْتُ عَائِشَةَ قُلْتُ بِأَىِّ شَىْءٍ كَانَ يَبْدَأُ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- إِذَا دَخَلَ بَيْتَهُ قَالَتْ بِالسِّوَاكِ.

আল মিকদাদ ইবন শুরাইহ থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমি আয়িশা (রা.) কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল­াহ (ﷺ) ঘরে প্রবেশ করে সর্বপ্রথম কোন কাজ করতেন? তিনি বলেন, মিসওয়াক দিয়ে দাঁত মাজা।

৫। রাতের সালাত আদায়ের সময়:

عَنْ حُذَيْفَةَ، قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا قَامَ لِيَتَهَجَّدَ يَشُوصُ فَاهُ بِالسِّوَاكِ .

হুযাইফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন: রাসুলুল্লাহ (ﷺ) যখন তাহাজ্জুদ সালাতের জন্য উঠতেন তখন মিসওয়াক দ্বারা ঘষে মুখ পরিষ্কার করতেন। তথা তার দাঁতগুলোকে মিসওয়াক দ্বারা ঘষতেন।[6]

মিসওয়াক করার জন্য ‘আরাক’ নামক গাছের ডাল ব্যবহার করা মুস্তাহাব। যদি তা না পাওয়া যায়, তাহলে দাঁত ও মুখ পরিষ্কার হয়ে যায় এমন কোন বস্ত্ত ব্যবহার করা যথেষ্ট হবে। যেমন নির্দিষ্ট কোন পেষ্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করা। আল্লাহ্‌ই সর্বাধিক অবগত।

নখ কাটা, গোঁফ ছাঁটা, বগলের লোম উপড়ানো ও নাভীর নীচের লোম পরিষ্কার জন্য কি নির্দিষ্ট সময় সীমা রয়েছে?

এ রীতিগুলোর জন্য কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা বাঁধা নেই। বরং প্রয়োজন অনুযায়ী তা কাট ছাট করবে। সুতরাং যে সময় তা কাটছাট করার প্রয়োজন হবে, সেটাই তার সময়। তবে চল্লিশ দিনের বেশি তা রেখে দেয়া উচিৎ নয়।

যেমন আনাস (রাঃ) এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন:

وُقِّتَ لَنَا فِي قَصِّ الشَّارِبِ، وَتَقْلِيمِ الْأَظْفَارِ، وَنَتْفِ الْإِبِطِ، وَحَلْقِ الْعَانَةِ، أَنْ لَا نَتْرُكَ أَكْثَرَ مِنْ أَرْبَعِينَ لَيْلَةً

রাসূল (ﷺ) আমাদের জন্য গোঁফ খাটো করা, নখ কাটা, বগলের পশম উপড়িয়ে ফেলা ও নাভীর নীচের পশম পরিষ্কার করার জন্য নির্দিষ্ট সীমারেখা বেঁধে দিয়েছেন, আমরা যেন তা চল্লিশ রাতের বেশি ছেড়ে না রাখি।[7]

[1] নাইলুল আওতার (১/১০২)।

[2] সহীহ; নাসাঈ (১/৫০), আহমাদ (৬/৪৭, ৬২) প্রভৃতি।

[3] আহমাদ; তা বর্ণিত হয়েছে, সহীহ আল-জামে’ (৫৩১৬)।

[4] সহীহ; বুখারী (৬৮১৩), মুসলিম (২৫২)।

[5] আলবানী একে সহীহ বলেছেন; বাইহাক্বী (১/৩৮), সহীহা (১২১৩)।

[6] সহীহ; বুখারী (২৪৬), মুসলিম (২৫৫)।

[7] সহীহ; মুসলিম (২৫৭ ) ও অন্যান্য।

দাড়ি লম্বা করার হুকুম:

পুরুষের জন্য দাড়ি লম্বা করা ওয়াজিব। এর কারণ নিম্নরূপ:

১। মহানবী (ﷺ) দাড়ি লম্বা করার নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশটা ওয়াজিব অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মানদূব (যা আমল করলে সাওয়াব পাওয়া যাবে আর পরিত্যাগ করলে শাস্তি হবে না) অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার কোন ইঙ্গিত এখানে নেই।

এ ব্যাপারে মহানাবী (ﷺ)এর বাণী হলো:

خالفوا المشركين : وفروا اللحى وأحفوا الشوارب

(দাড়ি ও গোফের ব্যাপারে) তোমরা মুশরিকদের বিপরীত কর। দাড়ি লম্বা কর এবং গোঁফ ছোট কর।[1]

তিনি আরও বলেন:

جزوا الشوارب وأرخوا اللحى خالفوا المجوس

‘তোমরা গোঁফ কাট এবং দাড়ি লম্বা কর আর অগ্নি পুজকদের বিরোধিতা কর ’।[2]

২। দাড়ি মুণ্ডন করা কাফিরদের সাথে সাদৃশ্য রাখে। যেমনটি পূর্বোলেস্নখিত হাদীসদ্বয়ে বর্ণিত হয়েছে।

৩। দাড়ি কর্তন করলে আল্লাহ্‌র সৃষ্টির পরিবর্তন করা হয় এবং শয়তানের আনুগত্য করা হয়।

আল্লাহ্‌র বাণী:

﴿وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللَّهِ﴾

অবশ্যই তাদেরকে আদেশ করব, ফলে অবশ্যই তারা আল্লাহ্‌র সৃষ্টি বিকৃত করবে (সূরা নিসা-১১৯)।

৪। দাড়ি মুণ্ডন করলে নারীদের সাদৃশ্য হয়ে যায়। যে সব পুরুষেরা নারীর সাদৃশ্য গ্রহণ করে; আল্লাহ্‌র রাসূল (ﷺ) তাদের প্রতি অভিশাপ করেছেন।[3]

এজন্য শাইখুল ইসলাম বলেন: দাড়ি মুণ্ডন করা হারাম।[4] ইবনে হাযম ও অন্যান্য বিদ্বানগণ বলেন: দাড়ি মুণ্ডন করা হারাম, এ ব্যাপারে ইজমা রয়েছে।[5]

এক মুষ্টির অতিরিক্ত দাড়ি ছাটা জায়েয আছে কি?

কতিপয় বিদ্বানের মতে: এক মুষ্টি দাড়ি রেখে বাকি অংশ কেটে ফেলা জায়েয আছে। তারা ইবনে উমার (রাঃ) এর হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করে থাকেন।

كَانَ ابْنُ عُمَرَ: «إِذَا حَجَّ أَوِ اعْتَمَرَ قَبَضَ عَلَى لِحْيَتِهِ، فَمَا فَضَلَ أَخَذَهُ»

ইবনে উমার (রাঃ) যখন হাজ্জ ও উমরা করতেন তখন তার দাড়ি ধরে অতিরিক্ত অংশ ছেঁটে ফেলতেন।[6]

তারা বলেন: তিনি (উমার) দাড়ি লম্বার নির্দেশ দেয়া হাদীসের রাবী। সুতরাং তিনিই তার বর্ণনা সম্পর্কে বেশি বুঝেন।


এই আসারের মাধ্যে তাদের কোন দলীল নেই।[7] কেননা-

(১) ইবনে উমার এটা হাজ্জ ও উমরা থেকে হালাল হওয়ার পর করেছিলেন। অথচ সেটাকে তারা সর্বাবস্থার জন্য বৈধ মনে করেন।

(২) ইবনে উমার (রাঃ) এ কাজটি আল্লাহ্‌র বাণী- مُحَلِّقِينَ رُءُوسَكُمْ وَمُقَصِّرِينَ অর্থাৎ: তোমাদের মাথা মুণ্ডন করে এবং চুল ছেঁটে (নির্ভয়ে মাসজিদুল হারামে অবশ্যই প্রবেশ করবে) (সূরা : ফাতাহ-২৭)। এ আয়াতটির উপর তা‘বীল করে করেছেন। অর্থাৎ: হাজ্জের সময় মাথা মুণ্ডন করতে হবে, আর দাড়ি ছোট করতে হবে।[8]

(৩) সাহাবাগণ যখন তাদের বর্ণনার বিপরীত কিছু বলেন বা করেন, তখন যা বর্ণনা করেছেন তাই গ্রহণ করতে হয়। তাদের বোধগম্যতা ও কর্ম ধর্তব্য নয়। বরং মহানাবী (ﷺ) এর দিকে সম্পৃক্ত বিষয়টিই ধর্তব্য।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, বিশুদ্ধ মতামত হলো, দাড়ি ছেড়ে দেয়া ওয়াজিব। অনেক সহীহ হাদীসে দাড়ি লম্বা করার ব্যাপারে সাধারণভাবে নির্দেশ দেয়ার ফলে তা কাট-ছাট করা যাবে না। হাদীসে বিভিন্ন শব্দে এ নির্দেশগুলো বর্ণিত হয়েছে। যেমন: أعفوا তথা লম্বা হতে দাও, أرخوا তথা ছেড়ে দাও, أرجوا তথা অবকাশ দাও, وفروا তথা পূর্ণ বা বেশি হতে দাও, أوفوا সম্পূর্ণ কর। অধিকাংশ বিদ্বানগণ এ মতামত পোষণ করেছেন। আল্লাহ্‌ই সর্বাধিক অবগত।

[1] সহীহ; বুখারী (৫৮৯২), মুসলিম (২৫৯)।

[2] সহীহ; মুসলিম (২৬০)।

[3] বুখারী (৫৮৮৫), তিরমিযী (২৯৩৫)।

[4] ইখতিয়ারাতুল ফিকহিয়্যাহ (পৃ. ১০) আলাউদ্দীন আলবা’লী প্রণীত। আল-ফুরু’ (১/২৯১) ‘ইবনু মুফালিহ’ প্রণীত।

[5] মারাতীবুল ইজম’, রাদ্দুল মুহতার-(২/১১৬)।

[6] সহীহ; বুখারী (৫৮৯২), মুসলিম (২৫৯)।

[7] ইহা শাইখ আল-হাবীহ ওয়াহিদ আঃ সালাম তাঁর আল ইকলিল (১/৯৬) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।

[8] দেখুন! ‘শারহুল কিরমানী আলাল বুখারী (২১/১১১)।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৪ পর্যন্ত, সর্বমোট ৪ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে