সহীহ ফিক্বহুস সুন্নাহ ত্বহারাত অধ্যায় আবূ মালিক কামাল বিন আস-সাইয়্যিদ সালিম ১৪ টি
নিম্নোক্ত প্রাণীগুলো মৃত হওয়া সত্ত্বেও নাপাক নয়

(ক) মাছ ও পঙ্গপালের মৃত দেহ:

এগুলো পাক। কেননা মহানাবী (ﷺ) বলেন:

»أحلت لنا ميتتان ودمان : الميتتان : الحوت والجراد والدمان : الكبد والطحال »

‘‘দুই প্রকারের মৃত ও দুই প্রকারের রক্ত আমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। সেই মৃত দু’টি হলো- মাছ ও পঙ্গপাল বা টিড্ডি। আর দু‘প্রকারের রক্ত হলো, যকৃত ও পস্নীহা’’।[1]

(খ) এমন প্রাণীর মৃত দেহ যে সব প্রাণীর রক্ত প্রবহমান নয় । যেমন: মাছি, মৌমাছি, পিঁপড়ে ও ছারপোকা ইত্যাদি। মহানাবী (ﷺ) বলেন:

«إِذَا وَقَعَ الذُّبَابُ فِي إِنَاءِ أَحَدِكُمْ فَلْيَغْمِسْهُ كُلَّهُ، ثُمَّ لِيَطْرَحْهُ، فَإِنَّ فِي أَحَدِ جَنَاحَيْهِ شِفَاءً، وَفِي الآخَرِ دَاءً»

যখন তোমাদের কারও কোন খাবার পাত্রে মাছি পড়ে, তখন তাকে সম্পূর্ণভাবে ডুবিয়ে দিবে, তারপর ফেলে দিবে । কারণ,তার এক ডানায় থাকে রোগ মুক্তি , আর অন্য ডানায় থাকে রোগ জীবানু ।[2]

(গ) মৃত প্রাণীর হাড়, শিং, নখ, চুল, পালক এই জাতীয় সব কিছুই মূলতঃ পাক। ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) তার সহীহ গ্রন্থে (১/৩৪২) মু’আল্লাক সূত্রে বর্ণনা করেন, যুহরী হাতী বা এরূপ প্রাণীর হাড্ডির ব্যাপারে বলেছেন: প্রাচীন আলিমদের অনেককে দেখেছি এর চিরুনী দ্বারা তারা চুল আচড়াতেন ও এর তেল ব্যবহার করতেন। তারা এতে কোন আপত্তিকর কিছু দেখেন নি। হাম্মাদ বলেন: মৃত প্রাণীর পালক নাপাক নয়।

[1] ইবনে মাজাহ হা/৩২১৮,৩৩১৪; আহমাদ ১/৪৬ পৃঃ সনদ সহীহ।

[2] বুখারী (৫৭৮২),

طهارة এর আভিধানিক অর্থ:

পবিত্রতা বা পরিচ্ছন্নতা, বাহ্যিক তথা অনুভূতিসূচক নাপাকী বা ময়লা আবর্জনা থেকে মুক্তি লাভ করা। যেমন- পেশাব ইত্যাদির নাপাকী এবং অভ্যন্তরীণ অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জন করা। যেমন- দোষ ত্রুটি ও পাপ পঙ্কিলতা থেকে পবিত্রতা অর্জন।

এর আরেকটি অর্থ হলো পরিচ্ছন্নণ করণ। আর এটা স্থান পরিচ্ছন্নণ করাকে বলা হয়।[1]

ত্বহারাতের পারিভাষিক সংজ্ঞা:

যে অপবিত্রতা বা নাপাকী সালাত আদায় করতে বাধা প্রদান করে তা পানি বা অন্য কিছু দ্বারা দূর করা বা হুকুমগতভাবে মাটি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করাকে ত্বহারাত বলে।[2]

ত্বহারাতের হুকুম:

স্মরণ থাকলে ও ক্ষমতা থাকলে নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জন করা এবং নাপাকী দূর করা ওয়াজিব। আল্লাহ্‌ বলেন: ﴾ وَثِيَابَكَ فَطَهِّرْ ﴿আপনার পোশাক পবিত্র করুন! (সূরা মুদ্দাসসির-৪)

আল্লাহ্‌ অপর আয়াতে বলেন:

أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সাজদাকারীদের জন্য পবিত্র কর। (সূরা বাক্বারাহ- ১২৫)

আর সালাত বৈধ হওয়ার জন্য অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জন করা আবশ্যক।

রাসূল (ﷺ) বলেন::« لَا تُقْبَلُ صَلَاةٌ بِغَيْرِ طُهُورٍ» -পবিত্রতা ছাড়া সালাত কবুল হয় না।[3]


পবিত্রতা অর্জনের গুরুত্ব

১। বান্দার সালাত বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত হলো পবিত্রতা অর্জন করা।

মহানাবী (ﷺ) বলেন:

عن أَبى هُرَيْرَةَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تُقْبَلُ صَلَاةُ أَحَدِكُمْ إِذَا أَحْدَثَ حَتَّى يَتَوَضَّأَ

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: যে ব্যক্তির বায়ু নির্গত হয় তার সালাত কবুল হবে না, যতক্ষণ না সে ওযূ করে।[4]

ত্বহারাতের মাধ্যমে সালাত আদায় করলে আল্লাহ্‌কে সম্মান করা হয়। হাদাস (বায়ু ত্যাগ) এবং জানাবাত (যে সব কারণে গোসল ফরয) এ দু’টি যদিও দৃশ্যমান নাপাকী নয় বরং অভ্যন্তরীণ নাপাকী তবুও এগুলো নাপাক মুক্ত করা ওয়াজিব। এর উপস্থিতিতেও আল্লাহ্‌র মর্যাদা হানি হয় এবং পরিচ্ছন্নতার মূলনীতি বিরোধী হয়।

২। মহান আল্লাহ্‌ পবিত্রতা অর্জনকারীদের প্রশংসা করেন। যেমন- তিনি বলেন:

﴿إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ ﴾

নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তাওবাকারীদেরকে ভালবাসেন এবং ভালবাসেন অধিক পবিত্রতা অর্জনকারীদেরকে। (সূরা বাক্বারাহ- ২২২)

মহান আল্লাহ্‌ তা‘আলা মাসজিদে কুবার অধিবাসীদের পবিত্রতা অর্জনের প্রশংসা করে বলেন:

﴿ فِيهِ رِجَالٌ يُحِبُّونَ أَنْ يَتَطَهَّرُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِينَ﴾

সেখানে এমন লোক আছে, যারা উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করতে ভালবাসে। আর আল্লাহ্‌ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন (তাওবা- ১০৮)।

৩। নাপাকী থেকে পবিত্রতা অর্জনের ক্ষেত্রে অবহেলা করা কবরে শাস্তি হওয়ার অন্যতম কারণ।

«عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: مَرَّ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ عَلَى قَبْرَيْنِ، فَقَالَ: " إِنَّهُمَا يُعَذَّبَانِ، وَمَا يُعَذَّبَانِ فِي كَبِيرٍ، أَمَّا هَذَا فَكَانَ لَا يَسْتَنْزِهُ مِنَ الْبَوْلِ»

ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) একদা দু‘টি কবরের কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, অতঃপর বললেন, এ দুই কবরবাসীকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। তবে এদেরকে বড় কোন গুনাহের কারণে শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। বরং এদের একজন পেশাবের নাপাকী থেকে বেঁচে থাকত না।[5]

[1] আল-লুবাব শারহুল কিতাব (১/১০) দুর্রম্নল মুখতার (১/৭৯)

[2] ইবনে কুদামাহ প্রণীত মুগনী (১/১২)

[3] সহীহ; মুসলিম (২২৪)

[4] বুখারী (১৩৫), মুসলিম (২২৫)

[5] আবূ দাউদ (২০), নাসাঈ (৩১-২০৬৯), ইবনে মাজাহ (৩৪৭) সনদ সহীহ।

আলিমগণ শারঈ ত্বহারাতকে দু‘ভাগে ভাগ করেছেন। যথা:

১। طهارة حقيقية বা প্রকৃত পবিত্রতা:

এ প্রকার ত্বহারাত হলো: ময়লা বা নাপাকী হতে পবিত্রতা অর্জন করা। আর এ ত্বহারাত শরীর, কাপড় ও স্থানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

২। طهارة حكمية বিধানগত পবিত্রতা:

এ প্রকার ত্বহারাত হলো: অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জন। আর এটা শরীরের সাথে নির্দিষ্ট। এ প্রকার ত্বহারাত তিন ধরণের হয়ে থাকে। যথা:

(ক) বড় ধরণের পবিত্রতা। তা হলো, গোসল করা।

(খ) ছোট ধরণের পবিত্রতা অর্জন। তা হলো, ওযূ করা।

(গ) অপারগতা বশতঃ গোসল ও ওযূর পরিবর্তে তায়াম্মুম করা।


طهارة حقيقية বা প্রকৃত পবিত্রতার বিবরণ

নাজাসাত দ্বারা উদ্দেশ্য:

নাজাসাত হলো ত্বহারাত এর বিপরীত শব্দ। পরিভাষায়, শরীয়াত নির্ধারিত নাপাকীর নাম নাজাসাত। মুসলমানদের জন্য এরূপ নাজাসাত থেকে পবিত্রতা অর্জন করা এবং তা শরীর বা কাপড়ে লেগে গেলে ধৌত করা ওয়াজিব।

শরীয়াত যে সব বস্তকে নাপাক বলে প্রমাণ করেছে তা হলো :

(১) মানুষের পায়খানা ও (২) মানুষের পেশাব :

আলিমদের ঐকমত্যে, এ দু’টি নাজাসাত বা নাপাকীর অন্তর্ভুক্ত। পায়খানা অপবিত্র হওয়ার ব্যাপারে মহানাবীর উক্তি হলো: «إِذَا وَطِئَ أَحَدُكُمْ بِنَعْلِهِ الْأَذَى، فَإِنَّ التُّرَابَ لَهُ طَهُورٌ » যদি তোমাদের কারও জুতার তলায় নাপাক বস্ত্ত (মল-মূত্র) লাগে, তাহলে মাটি তা পবিত্র করার জন্য যথেষ্ট হবে।[1] এ হাদীস পায়খানা অপবিত্র হওয়ার প্রমাণ বহন করে। এরূপ অনেক হাদীস রয়েছে যেগুলো দ্বারা পায়খানা থেকে ইসতিনজা করার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ হাদীসগুলো সামনে আলোচনা করা হবে। আর পেশাব অপবিত্র হওয়ার ব্যাপারে হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে :

أَنَّ أَعْرَابِيًّا بَالَ فِي الْمَسْجِدِ، فَقَامَ إِلَيْهِ بَعْضُ الْقَوْمِ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «دَعُوهُ وَلَا تُزْرِمُوهُ» قَالَ: فَلَمَّا فَرَغَ دَعَا بِدَلْوٍ مِنْ مَاءٍ فَصَبَّهُ عَلَيْهِ

একজন বেদুঈন এসে মাসজিদের মধ্যে পেশাব করতে শুরু করল। উপস্থিত লোকদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে বাধা দিতে দাঁড়ালে, রাসূল (ﷺ) বললেন, থাম তাকে পেশাব করতে বাধা দিওনা! আনাস (রাঃ) বলেন লোকটির পেশাব করা শেষ হলে, রাসূল (ﷺ) এক বালতি পানি আনিয়ে তার পেশাবের উপর ঢেলে দিলেন।[2]

(৩) মযি:

মযি হলো সাদা আঠালো পানি যা আদর, সোহাগ বা সহবাসের চিন্তা ও ইচ্ছা করার সময় নির্গত হয়। এটা সজোরে প্রবাহিত হয় না। এর ফলে দুর্বলতা অনুভব হয় না। তা নির্গত হওয়ার কথা মানুষ খুব কমই টের পায়। নারী ও পুরুষ উভয়ের যৌনাঙ্গ থেকে এটা নির্গত হয়ে থাকে। তবে নারীর যৌনাঙ্গ থেকেই এটা অধিকতর নির্গত হয়।[3] এটা সর্বসম্মতভাবে নাপাক।[4] এজন্যই মহানাবী (ﷺ) এটা নির্গত হওয়ার কারণে লজ্জাস্থান ধৌত করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমনঃ সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, একদা এক ব্যক্তি রাসূল (ﷺ) কে মযি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন: « «يَغْسِلُ ذَكَرَهُ وَيَتَوَضَّأُ তথা, সে তার লজ্জা স্থান ধৌত করবে এবং ওযূ করবে।[5]

(৪) ওদি:

ওদি এক ধরণের সাদা ঘন পানি, যা পেশাবের পর নির্গত হয়। এটি সর্বসম্মতিক্রমে নাপাক।

عن بن عباس قال : المني والودي والمذي أما المني فهو الذي منه الغسل وأما الودي والمذي فقال اغسل ذكرك أو مذاكيرك وتوضأ وضوءك للصلاة

ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: মনি, ওদি ও মযির হুকুম হলো, মনি (বীর্য) নির্গত হলে গোসল করতে হবে। আর ওদি ও মযির ব্যাপারে তিনি বলেন, তা নির্গত হলে তোমার লজ্জাস্থান ধৌত কর এবং সালাতের জন্য ওযূ কর।[6]

(৫) হায়েযের রক্ত:

عَنْ أَسْمَاءَ قَالَتْ: جَاءَتِ امْرَأَةٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَتْ: إِحْدَانَا يُصِيبُ ثَوْبَهَا مِنْ دَمِ الْحَيْضَةِ، كَيْفَ تَصْنَعُ بِهِ؟ قَالَ: تَحُتُّهُ، ثُمَّ تَقْرُصُهُ[7] بِالْمَاءِ، ثُمَّ تَنْضَحُهُ، ثُمَّ تُصَلِّي فِيهِ

আসমা বিনতে আবূ বকর বলেন, একদিন একজন স্ত্রী লোক নাবী (ﷺ) এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহ্‌র রাসূল (ﷺ)! আমাদের কারও কাপড়ে যদি হায়েযের রক্ত লেগে যায় তখন সে কি করবে? তিনি বললেন: রক্তের জায়গাটি ভালোভাবে রগড়াবে, তারপর পানি দিয়ে কচলিয়ে উত্তমরূপে ধুয়ে ফেলবে, অতঃপর ঐ কাপড় পরে সালাত পড়তে পারবে।[8]

(৬) যে সকল প্রাণীর মাংস খাওয়া না জায়েয সেগুলোর গোবর:

عن عبد الله بن مسعود قال : أراد النبي صلى الله عليه و سلم أن يتبرز فقال : إئتني بثلاثة أحجار فوجدت له حجرين وروثة حمار فأمسك الحجرين وطرح الروثة وقال : هي رجس

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: মহানাবী (ﷺ) প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার ইচ্ছা করলেন, অতঃপর বললেন: আমাকে তিনটি পাথর এনে দাও। আমি দু’টি পাথর ও একখণ্ড গাধার শুকনো গোবর পেলাম। তিনি পাথর দু’টি নিলেন এবং গোবর খণ্ড ফেলে দিয়ে বললেন, এটা অপবিত্র।[9]

হাদীসে বর্ণিত رجس শব্দের অর্থ নাপাক। এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, যে সকল প্রাণীর মাংস খাওয়া না জায়েয সেগুলোর গোবর নাপাক।

(৭) কুকুরের লালা বা উচ্ছিষ্ট:

মহানাবী (ﷺ) বলেন: طُهُورُ إِنَاءِ أَحَدِكُمْ إِذَا وَلَغَ فِيهِ الْكَلْبُ أَنْ يَغْسِلَهُ سَبْعَ مَرَّاتٍ أُولاَهُنَّ بِالتُّرَابِ» »- কুকুর যদি তোমাদের পাত্রে লেহন করে (খায় বা পান করে) তবে তা পাক করার নিয়ম এই যে, তা সাতবার পানি দ্বারা ধৌত করতে হবে, প্রথম বার মাটি দ্বারা ঘর্ষণ করতে হবে।[10] এ হাদীস কুকুরের লালা বা উচ্ছিষ্ট নাপাক হওয়ার প্রমাণ বহন করে।

(৮) শুকরের মাংস:

এটি আলিমগণের ঐকমত্যে নাপাক। কেননা এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ্‌ কুরআনে প্রকাশ্য নির্দেশ দিয়েছেন:

﴿قُلْ لَا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَى طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَنْ يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنْزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ﴾

বল, ‘আমার নিকট যে ওহী পাঠানো হয়, তাতে আমি আহারকারীর উপর কোন হারাম পাই না, যা সে আহার করে। তবে যদি মৃত কিংবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শুকরের মাংস হয়- কারণ, নিশ্চয় তা অপবিত্র। (সূরা আল আনআম-১৪৫)

(৯) মৃত প্রাণী:

মৃত প্রাণী হলো: স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে এমন প্রাণী। অর্থাৎ শরীয়াত সম্মতভাবে যা যবেহকৃত নয়। এটি সর্বসম্মতিক্রমে নাপাক। কেননা মহানাবী (ﷺ) বলেন: إذا دبغ الإهاب فقد طهر তথা, কাঁচা চামড়াকে পাকা করা হলে তা পবিত্র হয়ে যায়।[11] হাদীসে বর্ণিত الإهاب অর্থ : মৃত প্রাণীর চামড়া।

[1] আবূ দাউদ (৩৮৫) সনদ সহীহ।

[2] বুখারী (৬০২৫), মুসলিম (২৮৪)

[3] ফাতহুল বারী (১/৩৭৯), ইমাম নববী প্রণীত শারহে মুসলিম (১/৫৯৯)

[4] ইমাম নববী প্রণীত মাজমূ (২/৬), ইবনে কুদামাহ প্রণীত মুগনী (১/১৬৮)

[5] বুখারী (২৬৯), মুসলিম (৩০৩)

[6] সুনানে বাইহাক্বী ১/১১৫, আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। সহীহ সুনানে আবূ দাউদ হা/ ১৯০।

[7] হাদীসে বর্ণিত تقرصه শব্দের অর্থ আঙ্গুলের কিনারা দ্বারা ঘর্ষণ করা, যাতে নাপাকী দূর হয়ে যায়।

[8] বুখারী হা/২২৭ মুসলিম হা/২৯১

[9] বুখারী হা/১৫৬; তিরমিযী হা/১৭; নাসাঈ হা/৪২, ইবনে খুযায়মা।

[10] মুসলিম হা/ ২৭৯

[11] মুসলিম হা/৩৬৬
জীবিত প্রাণীর দেহ থেকে কর্তিত অংশ নাপাক

জীবিত প্রাণীর দেহ থেকে কর্তিত অংশের বিধান মৃত প্রাণীর ন্যায়। কেননা রাসূল (ﷺ) বলেন:

«مَا قُطِعَ مِنَ الْبَهِيمَةِ وَهِيَ حَيَّةٌ فَهِيَ مَيْتَةٌ»

জীবিত পশুর দেহ থেকে যে মাংস কেটে নেয়া হয় , তা মৃত পশুর ন্যায় ।[1]

[1] তিরমিযী (১৪৮০), আবুদাউদ (২৮৫৮), ইবনে মাজাহ (৩২১৬)।
এমন হিংস্র প্রাণী ও চতুষ্পদ জন্তুর উচ্ছিষ্ট যাদের গোশত খাওয়া জায়েয নয়

سؤر এর পরিচয়:

পান করার পর পাত্রে যে অবশিষ্ট অংশ থাকে তাকে سؤر (উচ্ছিষ্ট) বলে। মহানাবী (ﷺ) এর বাণীর মাধ্যমে এটি নাপাক হওয়ার প্রমাণ বহন করে।

একদা রাসুলুল্লাহ (ﷺ) কে এমন পানি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো, যা বিরান ভূমিতে থাকে এবং যেখানে চতুষ্পদ জন্তু ও হিংস্র প্রাণী তা পান করার জন্য পুনঃপুন আগমন করে এবং তা যথেচ্ছা ব্যবহার করে। সে পানির হুকুম কি? তিনি বলেন:

« إِذَا كَانَ الْمَاءُ قُلَّتَيْنِ لَمْ يَحْمِلِ الْخَبَثَ»

যখন উক্ত পানি দুই কুল্লা (মট্কা) পরিমাণ হবে, তখন তা অপবিত্র হবে না ।[1]

আর বিড়াল বা তদনিম্ন প্রাণীর উচ্ছিষ্ট পবিত্র। রাসূল (ﷺ) বলেন: বিড়ালের উচ্ছিষ্ট নাপাক নয়। কেননা এগুলো তোমাদের আশে-পাশেই ঘোরা-ফিরা করে।[2]

[1] সহীহ; আবুদাউদ (৬৩), নাসাঈ (১/৪৬), তিরমিযী (৬৭); এটা সহীহ, যেমনটি সহীহুল জামেতে বর্ণিত (৭৫৮)।

[2] সহীহ; আহমাদ (৫/৩০৩) এবং আসহাবে সুনান, ইরওয়া (১৭৩)।
যে প্রাণীর গোশত খাওয়া হারাম তার গোশত

এ ব্যাপারে আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন:

«عَنْ أَنَسٍ، قَالَ: لَمَّا فَتَحَ رَسُولُ اللهِ ﷺ خَيْبَرَ، أَصَبْنَا حُمُرًا خَارِجًا مِنَ الْقَرْيَةِ، فَطَبَخْنَا مِنْهَا، فَنَادَى مُنَادِي رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَلَا إِنَّ اللهَ وَرَسُولَهُ يَنْهَيَانِكُمْ عَنْهَا، فَإِنَّهَا رِجْسٌ»

আনাস (রাঃ) বলেন, খায়বার যুদ্ধে আমরা (গনীমত হিসেবে) গাধার মাংস লাভ করেছিলাম (আর তা পাকানো হচ্ছিল)। এমন সময়ে নাবী (ﷺ) এর পক্ষ থেকে জনৈক ঘোষণাকারী ঘোষণা করলেন, আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) তোমাদিগকে গাধার মাংস খেতে নিষেধ করেছেন । কেননা তা নাপাক ।[1]

عَنْ سَلَمَةَ بْنِ الْأَكْوَعِ، قَالَ: خَرَجْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ ﷺ إِلَى خَيْبَرَ، ثُمَّ إِنَّ اللهَ فَتَحَهَا عَلَيْهِمْ، فَلَمَّا أَمْسَى النَّاسُ الْيَوْمَ الَّذِي فُتِحَتْ عَلَيْهِمْ، أَوْقَدُوا نِيرَانًا كَثِيرَةً، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ: «مَا هَذِهِ النِّيرَانُ؟ عَلَى أَيِّ شَيْءٍ تُوقِدُونَ؟» قَالُوا: عَلَى لَحْمٍ، قَالَ: «عَلَى أَيِّ لَحْمٍ؟» قَالُوا: عَلَى لَحْمِ حُمُرٍ إِنْسِيَّةٍ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَهْرِيقُوهَا وَاكْسِرُوهَا» ، فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَوْ نُهَرِيقُهَا وَنَغْسِلُهَا؟ قَالَ: «أَوْ ذَاكَ»

সালামাহ ইবনুল আকওয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একবার আমরা রাসূল (ﷺ) এর সাথে খায়বার অভিমুখে রওনা হলাম। আল্লাহ্‌ তা‘আলা খায়বার বাসীদের উপর মুসলমানদের বিজয় দান করলেন। যে দিন মুসলমানরা জয় করলেন সে দিন তারা অনেকগুলো চুলায় আগুন ধরালেন। এত চুলায় আগুন জ্বলতে দেখে রাসূল (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কিসের আগুন এবং তা কেন জ্বালানো হয়েছে? লোকেরা বলল, মাংস রাঁধা হচ্ছে। তিনি জানতে চাইলেন, কিসের মাংস? তারা বললেন গৃহ পালিত গাধার মাংস। তাদের কথা শুনে রাসূল (ﷺ) বললেন, সম্পূর্ণ ফেলে দাও এবং হাঁড়ি-পাতিলগুলো ভেঙ্গে ফেল। এ সময় এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! মাংস ঢেলে ফেলে হাঁড়িগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করে আমরা কি তা ব্যবহার করতে পারব না? তিনি বললেন, হাঁ! অবশ্য তা করতে পার।[2]

সুতরাং, উল্লেখিত হাদীসদ্বয় থেকে বুঝা যায় যে, গৃহ পালিত গাধার মাংস নাপাক। কেনেনা ১ম হাদীসে বলা হয়েছে, ‘فَإِنَّهَا رِجْسٌ’ অর্থাৎ, তা নাপাক। আর ২য় হাদীসে আল্লাহ্‌র রাসূল (ﷺ) প্রথমে পাতিল ভেঙ্গে ফেলার কথা বলেছেন। অতঃপর ২য় বারে তা ধুয়ে পবিত্র করার বৈধতা দিয়েছেন।

[1] মুসলিম হা/১৯৪০, আহমাদ ৩/১২১, হাদীসটি বুখারীতে ‘فَإِنَّهَا رِجْسٌ’ শব্দ ছাড়া বর্ণিত হয়েছে।

[2] মুসলিম হা/১৮০২

মনি পবিত্র, না অপবিত্র এ নিয়ে আলিমগণ মতভেদ করেছেন। এ ব্যাপারে দু’টি অভিমত পাওয়া যায়।

১ম অভিমত:

মনি নাপাক। এটা ইমাম আবূ হানীফা, মালিক এবং আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) এর দুইটি অভিমতের একটি অভিমত। এ ব্যাপারে তাদের দলীল হলো, আয়িশা (রা.) এর বর্ণিত হাদীস। তাঁকে কাপড়ে মনি লাগা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন:

كُنْتُ أَغْسِلُهُ مِنْ ثَوْبِ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ ، فَيَخْرُجُ إِلَى الصَّلاَةِ، وَأَثَرُ الغَسْلِ فِي ثَوْبِهِ بُقَعُ المَاءِ

আমি এটা রাসূল (ﷺ) এর কাপড় থেকে ধৌত করতাম। অতঃপর তিনি সালাতে বের হতেন, এমতাবস্থায় তার কাপড়ে ধৌত করার চিহ্ন লেগে থাকত।[1]‎ আর কাপড় নাপাক না হলে তো ধৌত করার প্রশ্নই আসে না।

২য় অভিমত:

২য় অভিমত হলো মনি পবিত্র। এটা ইমাম শাফেঈ, দাউদ ও আহমাদ এর ২টি অভিমতের মধ্যে একটি সহীহ অভিমত। এ ব্যাপারে তারা আয়িশা (রা.) এর হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করেন।

عَنْ عَائِشَةَ فِي الْمَنِيِّ قَالَتْ: كُنْتُ أَفْرُكُهُ مِنْ ثَوْبِ رَسُولِ اللهِ ﷺ "

আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি মনির ব্যাপারে বলেন: আমি রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর কাপড় থেকে বীর্য রগ্ড়িয়ে ফেলতাম।[2]

আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত অপর এক হাদীস থেকেও তারা দলীল পেশ করে থাকেন:

أَنَّ رَجُلاً نَزَلَ بِعَائِشَةَ فَأَصْبَحَ يَغْسِلُ ثَوْبَهُ فَقَالَتْ عَائِشَةُ إِنَّمَا كَانَ يُجْزِئُكَ إِنْ رَأَيْتَهُ أَنْ تَغْسِلَ مَكَانَهُ فَإِنْ لَمْ تَرَ نَضَحْتَ حَوْلَهُ وَلَقَدْ رَأَيْتُنِى أَفْرُكُهُ مِنْ ثَوْبِ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ - فَرْكًا فَيُصَلِّى فِيهِ.

একদিন জনৈক ব্যক্তি আয়িশা (রা.) এর গৃহে মেহমান হলো। আয়িশা দেখলেন, ভোরে সে তার কাপড় ধুচ্ছে। (অর্থাৎ রাতে তার স্বপ্নদোষ হয়েছিল)। তা দেখে আয়িশা বললেন: মূলতঃ তোমার পক্ষে এতটুকুই যথেষ্ট হতো যে, তুমি নাপাক বস্ত্তটি দেখে থাকলে কেবলমাত্র সে স্থানটি ধুয়ে নিতে। আর যদি তা দেখে না থাক, তাহলে (সন্দেহ দূর করার নিমিত্তে) স্থানটিতে পানি ছিটিয়ে হালকাভাবে ধুয়ে নিতে পারতে। কেননা এমনও হয়েছে আমি নিজে রাসূল (ﷺ) এর কাপড় থেকে শুকনো বীর্য রগ্ড়িয়ে ফেলেছি, আর তিনি সে কাপড় পরে সালাত আদায় করেছেন।[3] ঘর্ষণ বা রগ্ড়ানোর মাধ্যমে যথেষ্ট মনে করাটাই পবিত্রতা প্রমাণ করে।

যারা এটাকে নাপাক বলেন, এ ব্যাপারে তাদের জবাব হলো: ঘর্ষণ করাটা পবিত্রতা প্রমাণ করে না, বরং তা পবিত্র করার একটি মাধ্যম মাত্র। যেমনটি জুতা পবিত্র করার মাধ্যম হলো তা মাটিতে ঘর্ষণ করা।

এর প্রতিউত্তরে বলা যায়[4] যে, আয়িশা (রা.) কখনও মনিকে ঘর্ষণ করেছেন আবার কখনও তা ধৌত করেছেন। সুতরাং তা (মনি) নাপাক হওয়ার দাবী রাখে না। যেমন কাপড়ে নাকের ময়লা, থুথু কিংবা আবজর্না লাগলে তা ধুয়ে ফেলা হয়। সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ), ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও আরও অনেকেই এরূপ কথাই বলেছেন যে, ‘‘এটা (মনি) নাকের ময়লা এবং থুথুর সমতুল্য। ঘাস দিয়ে হলেও তা মুছে ফেল’’।

সুতরাং, একথা স্পষ্ট হলো যে, হযরত আয়িশা (রা.) এর কাজটি পরিচ্ছন্নতার এখতিয়ারের অন্তর্ভুক্ত ছিল।[5] মনি পবিত্র হওয়ার সমর্থনে আরও একটি দৃষ্টান্ত হলো, মহানাবী (ﷺ) এর যুগে অনেক সাহাবার স্বপ্নদোষ হতো। ফলে তাদের কারও শরীরে বা কাপড়ে মনি (বীর্য) লেগে যেত। এটা কারও অসুস্থতার কারণে ব্যাপকভাবে নির্গত হতো। যদি তা নাপাক হতো, তাহলে রাসুল (ﷺ) এর উপর সাহাবাদের জন্য তা দূর করার আদেশ দেয়া ওয়াজিব হতো, যেমনটি তিনি ইসতিনজার ক্ষেত্রে আদেশ দিয়েছেন। অথচ কেউ এটা বর্ণনা করেন নি। সুতরাং নিশ্চিতভাবে জানা গেল যে, তা দূর করা ওয়াজিব ছিল না। আল্লাহ্‌ই সর্বাধিক অবগত।[6]

[1] বুখারী হা/ ২৩০; মুসলিম হা/ ২৮৯

[2] মুসলিম হা/ ২৮৮

[3] মুসলিম হা/ ২৮৮

[4] মাজমুউল ফাতওয়া (২১/৬০৫)

[5] শারহে মুসলিম

[6] মাজমুউল ফাতওয়া (২১/৬০৪)

আলিমগণ এ ব্যাপারে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন অভিমত পেশ করেছেন।

১ম অভিমত:

মদ নাপাক। এটা জমহুর ওলামার অভিমত। চার ইমামও এমতামত ব্যক্ত করেছেন। শাইখুল ইসলাম এ মতটিকে পছন্দ করেছেন। তাদের দলীল হলো আল্লাহ্‌র বাণী-

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ﴾

হে মু‘মিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সূরা আল-মায়েদা-৯০)

তারা বলেন: এখানে رِجْسٌ শব্দের অর্থ نجس বা নাপাকী। তারা স্বয়ং মদকেই অনুভূতি সূচক নাপাক বলে আখ্যা দিয়েছেন।

২য় অভিমত:

২য় অভিমতে মদ পবিত্র। এটা বলেছেন রাবিয়াহ লাইস, মাযানি এবং অন্যান্য সালাফগণ। ইমাম শাওকানী, সনআনী, আহমাদ শাকির ও আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) এ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। আর এটাই বিশুদ্ধ মতামত।

এর কারণ নিম্নরূপ-

(১) আলোচ্য আয়াতে মদ নাপাক হওয়ার কোন দলীল নেই। কারণ-

(ক) এখানে رِجْسٌ শব্দটি مشترك (বহুঅর্থবোধক) শব্দ। তা অনেক অর্থের সম্ভাবনা রাখে।[1] যেমন: القذر (পংকিলতা) المحرم (হারামকৃত) القبيح (মন্দ) العذاب (শাস্তি) اللعنة (অভিশাপ) الكفر (কুকুরী) الشر (ক্ষতি) الإثم (পাপ) এবং النجس (নাপাক) ইত্যাদি।

(খ) আমরা সালাফদের কাউকেও দেখি নি যে, তারা অত্র আয়াতে رجس এর ব্যাখ্যা نجس (নাপাকী) দ্বারা করেছেন। বরং ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন رجس অর্থ سخط বা অসমেত্মাষ। ইবনে যায়েদ বলেন رجس অর্থ شر ক্ষতি।

(গ) رجس শব্দটি আল্লাহ্‌র কিতাবে অত্র আয়াত ব্যতীত আরও তিন জায়গায় উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর কোথাও رجس অর্থ نجس (নাপাকী) করা হয় নি। যেমনঃ (১) رجسশব্দটি আল্লাহ্‌র নিম্নোক্ত বাণীতে উল্লেখ হয়েছে: ﴾ كَذَلِكَ يَجْعَلُ اللَّهُ الرِّجْسَ عَلَى الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ ﴿ এমনিভাবে আল্লাহ্‌ অকল্যাণ বা শাস্তি দেন তাদের উপর, যারা ঈমান আনে না (সূরা আল-আনআম-১২৫)। এখানে رجس অর্থ العذاب (শাস্তি)। (২) অন্যত্র মহান আল্লাহ্‌ মুনাফিকদের ব্যাপারে বলেন:﴾ ﴿ إِنَّهُمْ رِجْسٌ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُনিশ্চয়ই তাদের আমল মন্দ এবং জাহান্নাম হলো তাদের আশ্রয়স্থল (সূরা তাওবা ৯৫)। এখানে উদ্দেশ্য হলো: তাদের আমল নিকৃষ্ট বা মন্দ। অত্র আয়াতে رجس অর্থ قبيح (মন্দ)। (৩) আল্লাহ্‌র বাণী: ﴾ فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْأَوْثَانِ ﴿ সুতরাং মূর্তিপূজার শাস্তি হতে বিরত থাক (সূরা হাজ্জ্ব-৩০), অত্র আয়াতে أوثَانِ (মূর্তীসমূহ) কে رجس নামে নামকরণ করা হয়েছে। কেননা তা শাস্তির কারণ। এর দ্বারা نجاسة حسية বা অনুভূতি সূচক নাপাক উদ্দেশ্য নয়। কেননা স্বয়ং পাথর ও মূর্তীসমূহ নাপাক নয়।

আল্লাহ্‌র বাণী:

﴿قُلْ لَا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَى طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَنْ يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنْزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ﴾

আপনি বলে দিন: যা কিছু বিধান ওহীর মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে, তন্মধ্যে আমি কোন হারাম খাদ্য পাই না কোন ভক্ষণকারীর জন্যে, যা সে ভক্ষণ করে; কিন্তু মৃত অথবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শুকরের মাংস ব্যতীত, নিশ্চয় তা অপবিত্র । (সূরা আল-আনআম :১৪৫) অত্র আয়াতে رجس অর্থ নাপাক হওয়াটা সম্ভাবনাময়।

(ঘ) আয়াতে خمر (মদ) শব্দটি أنصاب ও أزلام এর সাথে উল্লেখ হওয়ায় رجس এর অর্থ শারঈ নাপাক না হওয়ার দিকেই ইঙ্গিত করে। এরূপভাবে আল্লাহ্‌র বাণী-﴾ إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ ﴿ মুশরিকগণ নাপাক (সূরা তাওবা-২৮)। অত্র আয়াতে মুশকিদের نجس বা নাপাক বলা হলেও এমন সহীহ দলীল রয়েছে যা মুশরিকদের সত্ত্বাকে নাপাক না হওয়া প্রমাণ করে।

(ঙ) মদ হারাম হওয়ার কারণে তা নিজে নাপাক হওয়াকে আবশ্যক করে না। তবে নাপাক জিনিস মাত্রই অনিবার্যভাবে হারাম। পুরুষের জন্য রেশম ও স্বর্ণ হারাম। অথচ এদুটোই শারঈভাবে ও সর্বসম্মতিক্রমে পবিত্র।

(চ) অত্র আয়াতে الرجس শব্দটি শয়তানের আমলের সাথে নির্দিষ্ট। অতএব তা আমল গত ভাবে رجس । সুতরাং এর অর্থ হতে পারে- قبيح (মন্দ), محرم (নিষিদ্ধ) অথবা إثم (পাপ)। এর দ্বারা প্রকৃত رجس বা নাপাক উদ্দেশ্য নয়, যার ফলে এর কারণে এই বস্ত্তগুলো নাপাক হবে।

(২) মদ পবিত্র হওয়ার ব্যাপারে দলীল:

মদ হারাম হওয়ার ঘটনায় আনাস (রাঃ) এর হাদীসে বলা হয়েছে-

فأمر رسول الله ﷺ مُنَادِيا يُنَادِي :أَلَا إِنَّ الْخَمْرَ قَدْ حُرِّمَتْ، ... قَالَ: فخرجت فأهرقتها فَجَرَتْ فِي سِكَكِ الْمَدِينَةِ

অতঃপর রাসূল (ﷺ) একজন ঘোষণাকারীকে ঘোষণা দিতে বললেন, ‘‘শুনে নাও! এখন থেকে মদ হারাম করা হয়েছে।’’আনাস বলেন, অতএব আমি গিয়ে সমস্ত মদ ফেলে দিলাম। সে দিন মদিনার অলিতে-গলিতে মদের স্রোত বয়ে গেছিল।[2]

(৩) ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে বর্ণিত হাদীস, যার কাছে দু‘মশক মদ ছিল। রাসূলুল­াহ্ (ﷺ) তাকে বললেন:

«إِنَّ الَّذِي حَرَّمَ شُرْبَهَا حَرَّمَ بَيْعَهَا، فَفَتَحَ الرجل الْمَزَادَتَيْنِ، حَتَّى ذَهَبَ مَا فِيهِمَا»

যিনি এটা পান করা হারাম করেছেন তিনিই এটা বিক্রি করাও হারাম করেছেন। অতঃপর ব্যক্তিটি মশক দু‘টি খুলে সম্পূর্ণ মদ ঢেলে ফেললেন।[3]

যদি মদ নাপাক হতো তাহলে অবশ্যই মহানাবী (ﷺ) জমিনে পানি ঢেলে তা পবিত্র করার আদেশ দিতেন, যেমনটি তিনি জনৈক বেদুঈন লোকের পেশাব করার কারণে তাতে পানি ঢেলে দেয়ার আদেশ দিয়েছিলেন এবং তা থেকে সতর্কতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দিয়েছেন । আর যদি তা নাপাক হতো তাহলে মশক ওয়ালা ব্যক্তিকে তার মদ ঢেলে ফেলার পর মশক দু’টি ধুয়ে ফেলতে বলতেন।

(৪) মূলতঃ মদ পবিত্র। পবিত্র ছাড়া ভিন্ন কিছু গ্রহণ করা যাবে না, যতক্ষণ না সহীহ দলীল পাওয়া যাবে। যেহেতু এটা নাপাক হওয়ার ব্যাপারে দলীল পাওয়া যায় না, সুতরাং মদ মূলত পবিত্র হওয়ার উপর বহাল থাকবে। আল্লাহ্‌ই সর্বাধিক অবগত।

[1] ইবনে আসীর প্রণীত নিহায়্যাহ, লিসানুল আরাব, মুখতারম্নস সিহাহ ও তাফসীর সমূহ।

[2] বুখারী হা/ ২৩৩২; মুসলিম হা/ ১৯৮০

[3] মুসলিম হা/ ১২০৬; মুয়াত্তা মালেক হা/ ১৫৪৩

রক্ত কয়েক প্রকার যথা-

১। হায়েযের রক্ত: এটা সর্বসম্মতিক্রমে নাপাক। এটা নাপাক হওয়ার দলীল পূর্বে আলোচিত হয়েছে।

২। মানুষের রক্ত:[1] এটা পাক বা নাপাক হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। ফিক্বহী মাযহাবের অনুসারীদের নিকট এ কথাই প্রসিদ্ধ যে, রক্ত অপবিত্র। এ ব্যাপারে তাদের কাছে কোন দলীল নেই। তবে কুরআনের আয়াত দ্বারা এটা (রক্ত) হারাম করা হয়েছে।

আল্লাহ্‌র বাণী:

﴿قُلْ لَا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَى طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَنْ يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنْزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ﴾

আপনি বলে দিন: যা কিছু বিধান ওহীর মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে, তন্মধ্যে আমি কোন হারাম খাদ্য পাই না কোন ভক্ষণকারীর জন্যে, যা সে ভক্ষণ করে; কিন্তু মৃত অথবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শুকরের মাংস ব্যতীত, নিশ্চয় তা অপবিত্র । (সূরা আল-আনআম :১৪৫)

রক্ত হারাম হওয়ার কারণে তা নাপাক হওয়াকেও আবশ্যক করে বলে তারা মনে করেন, যেমনটি তারা মদের ব্যাপারে মনে করে থাকেন। এর প্রকৃত ব্যাপারটি গোপন নয়। কিন্তু একাধিক বিদ্বানের বর্ণনা মতে, এটা (রক্ত) নাপাক হওয়ার উপর ইজমা হয়েছে। এ ব্যাপারে সামনে আলোচনা হবে।

অপরদিকে পরবর্তী মুজতাহিদগণ, তথা ইমাম শাওকানী, সিদ্দীক খান, আলবানী ও ইবনে উসাইমীন বলেন: (মানুষের) রক্ত পবিত্র। কেননা এ ব্যাপারে তাদের কাছে কোন ইজমা সাব্যাস্ত হয় নি। তারা নিম্নোক্তভাবে দলীল দিয়ে থাকেন।

(১) প্রত্যেক বস্ত্তই মূলতঃ পবিত্র; যতক্ষণ না তা নাপাক হওয়ার দলীল প্রতিষ্ঠিত হয়। মহানাবী (ﷺ) হায়েযের রক্ত ব্যতীত মানুষের শরীরের বিভিন্ন ক্ষত-বিক্ষত স্থান থেকে অধিক রক্ত ঝরার পরও তা ধৌত করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। যদি রক্ত নাপাক হতো, তাহলে মহানাবী (ﷺ) তার প্রয়োজনীয় বিধানের কথা অবশ্যই বর্ণনা করতেন।

(২) মুসলমানেরা তাদের ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় সালাত আদায় করতেন। অথচ তাদের শরীর থেকে এত রক্ত ঝরত যে তা সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। আর তা ধৌত করার নির্দেশ মহানাবী (ﷺ) এর পক্ষ থেকে কেউ বর্ণনা করেন নি এবং এটাও বর্ণিত হয় নি যে, তারা এ থেকে ব্যাপকভাবে সতর্ক থাকতেন।

হাসান বলেন: مَا زَالَ المُسْلِمُونَ يُصَلُّونَ فِي جِرَاحَاتِهِمْ অর্থাৎ:‘‘মুসলমানেরা সর্বদাই তাদের শরীর ক্ষত-বিক্ষত বা যখম থাকা অবস্থায় সালাত আদায় করতেন’’।[2]

আনসার সাহাবীর ব্যাপারে বর্ণিত হাদীস। যিনি রাতে সালাত আদায় করেছিলেন। এমতাবস্থায় এক মুশরিক তাকে একটি তীর নিক্ষেপ করল। ফলে তিনি আঘাত প্রাপ্ত হলেন, অতঃপর তিনি তা খুলে ফেললেন। এমনকি মুশরিক ব্যক্তি তাকে তিনটি তীর নিক্ষেপ করল। তারপর এ ভাবেই তিনি রুকু সাজদা করে, সমস্ত সালাত শেষ করলেন। আর তার শরীর দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল।[3]


আলবানী (রাহি.) বলেন,[4] এ হাদীসটি মারফূ হাদীসের হুকুমে। কেননা রাসূল (ﷺ) এ ব্যাপারে জানতেন না এমন ধারণা করা অনেক দূরের ব্যাপার। যদি অধিক রক্ত নাপাক হতো তাহলে মহানাবী (ﷺ) তা বর্ণনা করতেন। কেননা উসূল শাস্ত্রের নিয়ম হলো, কোন বিষয় প্রয়োজনের সময় ছাড়া পরে বর্ণনা করা বৈধ নয়। যদি ধরে নেয়া হয় যে, মহানাবী (ﷺ) এর কাছে এটা গোপন ছিল, তাহলে বলা হবে যে, আল্লাহ্‌র কাছে কিভাবে তা গোপন থাকতে পারে, যার কাছে আসমান জমিনের কোন কিছুই গোপন থাকে না। যদি রক্ত ওযূ ভঙ্গের কারণ হতো বা নাপাক হতো, তাহলে অবশ্যই মহানাবী (ﷺ) এর উপর তা ওহী করা হতো। এটা স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে। বিষয়টি অস্পষ্ট নয়।

উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) এর শাহাদাতের ঘটনায় বর্ণিত হাদীস- صَلَّى عُمَرُ وَجُرْحُهُ يَثْعَبُ دَمًا অর্থাৎ: অতঃপর উমার (রাঃ) সালাত আদায় করলেন অথচ তাঁর যখম হতে তখন রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল।[5]

(৩) সা‘দ ইবনে মু’আয (রাঃ) এর মৃত্যুর ঘটনায় বর্ণিত আয়িশা (রা.) এর হাদীস। তিনি বলেন:

لَمَّا أُصِيبَ سَعْدُ بْنُ مُعَاذٍ يَوْمَ الْخَنْدَقِ، رَمَاهُ رَجُلٌ فِي الْأَكْحَلِ فَضَرَبَ عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ خَيْمَةً فِي الْمَسْجِدِ لِيَعُودَهُ مِنْ قَرِيبٍ (سنن أبي داود).......... فبينما هو ذات ليلة إذ تفجر كلمه فسال الدم من جرحه حتى دخل خباء إلى جنبه فقال الله أهل الخباء يا أهل الخباء ما هذا الذي يأتينا من قبلكم ؟ فنظروا فإذا سعد قد انفجر كلمه والدم له هدير فمات [ المعجم الكبير - الطبراني ]

অর্থাৎ: যখন সা‘দ ইব্ন মু‘আয (রাঃ) খন্দকের যুদ্ধে জনৈক ব্যক্তির তীরের আঘাতে আহত হয়েছিলেন, যা তার হাতের শিরায় বিদ্ধ হয়েছিল, তখন রাসুলুল­াহ (ﷺ) তার জন্য মাসজিদে (নাববীতে) একটা তাবু খাটিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে তিনি নিকট থেকে বার বার তার দেখাশুনা করতে পারেন।

অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে, হঠাৎ এক রাতে তার যখমটি ফেটে গিয়ে রক্ত প্রবাহিত হলো, এমনকি তার পার্শ্ববর্তী তাবুতে রক্ত প্রবাহিত হলো, ফলে তাবুর মধ্যে যারা অবস্থান করছিলেন, তারা বললেন, হে তাবুবাসী তোমাদের তাবুতে এগুলো কি আসছে! এরপর তারা দেখল যে, সা‘দ (রাঃ) এর যখম ফেটে তিনি রক্তশূন্য হয়ে পড়েছেন। ফলে তিনি মারা যান।[6]

আমার বক্তব্য: মহানাবী (ﷺ) তার উপর পানি ঢেলে দেয়ার আদেশ দিয়েছিলেন এমনটি বর্ণিত হয় নি। অথচ তিনি মাসজিদে ছিলেন। যেমনটি তিনি জনৈক বেদুঈন লোকের পেশাব করার বেলায় তার উপর পানি ঢেলে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

(৪) ইবনে রুশদ মাছের রক্তের ব্যাপারে আলিমদের মতভেদের কথা উল্লেখ করে বলেন: তাদের মতভেদের কারণ হল, মৃত মাছের ব্যাপারে। যারা মৃত মাছকে ‘মৃত প্রাণী বিশেষ হারাম’ এর আওতায় মনে করেন, তারা তার রক্তকেও অনুরূপ হারাম মনে করেন।

আর যারা মৃত মাছকে সার্বজনীন হারামের বহির্ভূত মনে করেন, তারা তার রক্তকেও মাছের উপর অনুমান বা কিয়াস করে হালাল মনে করেন।

উত্তরে আমরা বলব যে, তারা মৃত মানুষকে পবিত্র বলে থাকেন। তাহলে তাদের কায়দা অনুযায়ী মৃত মানুষের রক্তও পবিত্র!

এজন্য শেষভাগে ইবনে রুশদ বলেছেন, নাস বা দলীল শুধু হায়েযের রক্তকেই নাপাক বলে প্রমাণ করে। এটা ব্যতীত অন্য রক্ত তার মৌলিকতার উপর বহাল থাকবে। তথা তা পবিত্র। আর এ ব্যাপারটিতে সকল বিতর্ককারী ঐকমত্য পোষণ করেছেন। সুতরাং দলীলের উপযোগী নস বা প্রমাণাদী ছাড়া তা পবিত্রতার হুকুম থেকে বহির্ভূত করা যাবে না।


যদি বলা হয় মানুষের রক্তকে হায়েযের রক্তের সাথে কিয়াস বা অনুমান করা যায় কি না? আর হায়েযের রক্ততো নাপাক।

তাহলে উত্তরে আমরা বলব, এটা قياس مع الفارق (বিচ্ছিন্ন জিনিসের সঙ্গে কিয়াস) হয়ে গেল। হায়েযের রক্ত হলো, নারীদের প্রকৃতি বা জন্মগত স্বভাব। মহানাবী (ﷺ) বলেন: إِنَّ هَذَا شَيْءٌ كَتَبَهُ اللهُ عَلَى بَنَاتِ آدَمَ অর্থাৎ: এটা এমন একটা ব্যাপার যা আল্লাহ্‌ তা‘আলা সকল আদম-কন্যাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন।[7]

মহানাবী (ﷺ) ইসেত্মহাযার ব্যাপারে বলেন: إنه دم عِرْق অর্থাৎ: এটা শিরা নির্গত রক্ত।[8] তদুপরি, হায়েযের রক্ত হয় গাঢ়, দুর্গন্ধময় এবং তা বিশ্রী গন্ধ করে। তা পেশাব পায়খানার মতই। এটা দুই রাস্তা ব্যতীত অন্য কোথাও থেকে নির্গত রক্ত নয়।


৩। যে প্রাণীর মাংস খাওয়া হয় তার রক্ত:

এ বিষয়ের আলোচনা মানুষের রক্তের ব্যাপারে পূর্বে যে আলোচনা করা হয়েছে তদ্রূপ। কেননা এটা নাপাক হওয়ার ব্যাপারে কোন দলীল নেই। সুতরাং তা মৌলিক দিক থেকে নাপাকী মুক্ত হওয়ার দাবীদার। নিম্নোক্ত বাণী দ্বারাও তা পবিত্র হওয়ার দলীলকে শক্তিশালী করে। যেমন ইবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, তিনি বলেন:

كَانَ يُصَلِّي عِنْدَ الْبَيْتِ وَأَبُو جَهْلٍ وَأَصْحَابٌ لَهُ جُلُوسٌ إِذْ قَالَ بَعْضُهُمْ لِبَعْض أيكم يقوم إلى جزور آل فلان فيعمد إلى فرثها ودمها وسلاها فيجيء به ثم يمهله حتى إذا سجد وضعه بين كتفيه فانبعث أشقاهم فلما سجد رسول الله عليه الصلاة والسلام وضعه بين كتفيه وثبت النبي عليه الصلاة والسلام ساجدا فضحكوا

একবার রাসুলুল্লাহ কা‘বা ঘরের নিকট দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় আবূ জাহল তার সাথীদের নিয়ে সেখানে বসে ছিল। অতঃপর তারা একে অপরে বলতে লাগল, তোমাদের এমন কে আছে যে অমুক গোত্রের উট যবেহ করার স্থান পর্যন্ত যেতে রাযী? সেখান থেকে গোবর, রক্ত ও গর্ভাশয় নিয়ে এসে অপেক্ষায় থাকবে। যখন এ ব্যক্তি সাজদায় যাবে, তখন এগুলো তার দুই কাঁধের মাঝখানে রেখে দেবে। এ কাজের জন্য তাদের চরম হতভাগা ব্যক্তি (‘উকবা) উঠে দাঁড়াল ( এবং তা নিয়ে আসলো)। যখন রাসুলুল্লাহ সাজদায় গেলেন তখন সে তার দু‘কাঁধের মাঝখানে সেগুলো রেখে দিল। নাবী সাজদায় স্থির হয়ে গেলেন। এতে তারা হাসাহাসি করতে লাগল.......।[9]

যদি উটের রক্ত নাপাক হতো, তাহলে মহানাবী (ﷺ) অবশ্য তার কাপড় খুলে ফেলতেন অথবা সালাত আদায় করা থেকে বিরত থাকতেন।

ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে:

« أن ابن مسعود صلى وعلى بطنه فرث ودم من جزور نحرهاولم يتوضأ»

একদা ইবনে মাসউদ (রাঃ) সালাত আদায় করছিলেন। এমতাবস্থায় তার পেটের উপর উট যবেহ করা রক্ত ও গোবর বা অনুরূপ কিছু ছিল। অথচ তিনি এ জন্য ওযূ করেন নি।[10]

যদিও অত্র আসারটি প্রাণীর রক্ত পবিত্র হওয়ার ব্যাপারে দলীল হওয়ার ক্ষেত্রে বিতর্কিত। কেননা ইবনে মাসউদ সালাত বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য শরীর ও কাপড় পাক হওয়াকে শর্ত মনে করেন না। তিনি এটাকে মুস্তাহাব মনে করেন।

আমার বক্তব্য: যদি রক্ত নাপাক হওয়ার ব্যাপারে ইজমা সাব্যাস্ত হয়, তাহলে পরবর্তীদের দলীলের দিকে আমরা ভ্রূক্ষেপ করব না। আর যদি ইজমা সাব্যাস্ত না হয়, তাহলে প্রকৃতপক্ষে রক্ত পবিত্র। এ সমস্ত দলীলাদীর প্রয়োজন নেই। যদিও আমার নিকট দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ রক্ত পবিত্র হওয়ার অভিমতটিই পছন্দনীয় ছিল। কিন্তু এখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, এ মাসআলার ব্যাপারে ইজমা সাব্যাস্ত আছে। অনেক বিদ্বানই এর ইজমা হওয়ার কথাটি বর্ণনা করেছেন। এর বিপরীত প্রমাণিত হয় নি। এ ইজমার বর্ণনাগুলোর মধ্যে উচ্চমানের বর্ণনা হলো, ইমাম আহমাদ (রাহি.) এর বর্ণনা, অতঃপর ইবনে হাযম (রাহি.) এর বর্ণনা। (তবে যারা ধারণা করেন যে, আহমাদের মাযহাব হলো ‘রক্ত পবিত্র’ তাদের এ কথা সম্পূর্ণ বিপরীত।) এ ব্যাপারে আমি যতটুক জেনেছি তা হলো,

ইবনুল কাইয়্যিম ইগাসাতুল লুহফান গ্রন্থে (১/৪২০) বলেন: ইমাম আহমাদকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনার দৃষ্টিতে কি রক্ত ও বমি সমান? উত্তরে তিনি বলেন: না, রক্তের ব্যাপারে কেউ মতভেদ করেন নি। তিনি পুনরায় বলেন: বমি, নাকের ময়লা ও পুঁজ আমার কাছে রক্তের চেয়ে শিথিল।

ইবনে হাযম মারাতিবুল ইজমা গ্রন্থে বলেন: আলিমগণ রক্ত নাজাসাত বা নাপাক হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন।

অনুরূপভাবে হাফেজ ফাতাহ গ্রন্থে (১/৪২০) এ ঐকমত্যের কথা উল্লেখ করেছেন। ইবনু আব্দুল বার তামহীদ গ্রন্থে (২২/২৩০) বলেন: সব রক্তের হুকুম হায়েযের রক্তের হুকুমের মত। তবে অল্প রক্ত হলে তা উক্ত হুকুমের বহির্ভূত হবে তথা তা পবিত্র হবে। কেননা আল্লাহ্‌ তা‘আলা রক্ত নাপাক হওয়ার জন্য প্রবহমান হওয়াকে শর্ত করেছেন। আর যখন রক্ত প্রবহমান হবে তখন তা رجس তথা নাপাক হবে। এ ব্যাপারে মুসলমানদের ইজমা রয়েছে যে, প্রবহমান রক্ত رجس বা নাপাক। ইবনুল আরাবী আহকামুল কুরআনে (১/৭৯) বলেন: আলিমগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, রক্ত হারাম এবং নাপাক। তা খাওয়া যায় না এবং এর মাধ্যমে উপকার গ্রহণও করা যায় না। আল্লাহ্‌ তা‘আলা এখানে রক্তকে মুত্বলাক বা সাধারণ ভাবে উল্লেখ করেছেন। আর সূরা আন‘আম এর মধ্যে তা مسفوح (প্রবহমান) শব্দের সাথে مقيد (নির্দিষ্ট) করেছেন। আলিমগণ এখানে সর্বসম্মতভাবে مطلق (সাধারণ) কে مقيد (নির্দিষ্ট) এর উপর ব্যবহার করেছেন।

ইমাম নাববী (রাহি:) মাজমু গ্রন্থে (২/৫৭৬) বলেন: দলীলসমূহ প্রকাশ্যভাবে রক্ত নাপাক হওয়ার উপর প্রমাণ বহন করে। মুসলমানদের মধ্যে কেউ এ ব্যাপারে মতভেদ করেছেন বলে আমার জানা নেই। তবে হাবী গ্রন্থকার কতিপয় উক্তিকারী থেকে বর্ণনা করে বলেন: রক্ত পবিত্র। কিন্তু এ সমস্ত উক্তিকারীগণকে ইজমা ও ইখতিলাফকারী আলিমদের মধ্যে গণ্য করা হয় না।

আমি বলি (আবূ মালিক): উপরের আলোচনা থেকে আমার কাছে যা স্পষ্ট হচ্ছে তা হলো: ইজমা সাব্যাস্ত থাকার কারণে রক্ত অপবিত্র। তবে ইমাম আহমাদ (রাহি.) এর চেয়ে যদি আর কোন বড় মাপের ইমামের কাছ থেকে সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে রক্ত পবিত্র হওয়ার মতামতটি প্রাধান্য পাবে। আল্লাহ্‌ই ভাল জানেন।

[1] তাফসীরে কুরতুবী (২/২২১), মাজমূ (২/৫১১), মুহালস্না (১/১০২), কাফী (১/১১০), বিদায়াতুল মুজতাহীদ, সায়লুল জিরার (১/৩১), শারহুল মুমতে (১/৩৭৬), সিলসিলাতুছ সহীহাহ ও তামামুল মিন্নাহ পৃঃ ৫০।

[2] সনদ সহীহ, ইমাম বুখারী ময়ালস্নাক্ব সূত্রে বর্ণনা করেছেন ১/৩৩৬, ইবনে আবি শায়বা সহীহ সনদে মাওসূল সূত্রে বর্ণনা করেছেন, যেমনটি ফাতহুল বারীতে বর্ণিত হয়েছে (১/৩৩৭)।

[3] সহীহ; ইমাম বুখারী মুয়ালস্নাক্ব সূত্রে বর্ণনা করেছেন ১/৩৩৬, অহমাদ মাওসূল সূত্রে বর্ণনা করেছেন, হাদীসটি সহীহ।

[4] তামামুল মিন্নাহ (৫১,৫২)

[5] সহীহ; মালিক (৮২), মালিক থেকে বাইহাকী বর্ণনা করেছেন (১/৩৫৭) ও অন্যান্যরা, এর সনদ সহীহ।

[6] সহীহ; আবুদাউদ মুখতাসারভাবে বর্ণনা করেছেন (৩১০০), তবারানী ফিল কাবীর (৬/৭)।

[7] বুখারী হা/ ২৯৪; মুসলিম হা/ ১২১১

[8] বুখারী হা/ ৩২৭; মুসলিম হা/ ৩৩৩

[9] বুখারী হা/ ২৪০; মুসলিম হা/ ১৭৯৪

[10] মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক ১/২৫ পৃঃ; ইবনে আবী শায়বা ১/৩৯২
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৪ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 পরের পাতা »