প্রতি বছর আল্লাহর সম্মানিত ঘর বায়তুল্লার হজ করা পুরো উম্মতের ওপর ওয়াজিব কিফায়া, অর্থাৎ সবার ওপর ওয়াজিব, তবে কতক সংখ্যক আদায় করলে বাকিদের থেকে আদায় হয়ে যায়। যেসব মুসলিমের মাঝে হজের সকল শর্ত বিদ্যমান, তাদের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরয, তার অতিরিক্ত হজ নফল। হজ ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ রুকন। নারীর জন্য হজ জিহাদ সমতুল্য। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:
»يا رسول الله، هل على النساء جهاد ؟ قال: نعم، عليهن جهاد لا قتال فيه: الحج والعمرة«
“হে আল্লাহর রাসূল, নারীদের ওপর কি জিহাদ আছে? তিনি বললেন: হ্যাঁ, তাদের ওপর এমন জিহাদ আছে যেখানে মারামারি নেই: (অর্থাৎ) হজ ও উমরাহ”।[1] আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে ইমাম বুখারী আরো বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন:
»يا رسول الله، نرى الجهاد أفضل العمل، أفلا نجاهد ؟ قال: لكن أفضل الجهاد حج مبرور «
“হে আল্লাহর রাসূল, আমরা জিহাদকে সর্বোত্তম আমল মনে করি, আমরা কি জিহাদ করব না? তিনি বলেন: তোমাদের জন্য সর্বোত্তম জিহাদ মাবরুর হজ”।[2]
হজ সংক্রান্ত নারীর বিশেষ বিধান
১. মুহরিম:
হজে নারী-পুরুষ সবার জন্য কিছু বিধান রয়েছে সাধারণ, যেখানে কোনো ভিন্নতা নেই, সমানভাবে সবার জন্যই তা প্রযোজ্য, যেমন ইসলাম, বিবেক, স্বাধীনতা, সাবালক ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য।
তবে নারীর জন্য অতিরিক্ত শর্ত হচ্ছে মাহরাম থাকা, যার সাথে সে হজের সফর করবে। মাহরাম যেমন স্বামী অথবা রক্তের সম্পর্কের কারণে নারীর ওপর চির দিন হারাম এমন পুরুষ, যেমন বাবা, সন্তান ও ভাই। অথবা রক্ত-সম্পর্ক ব্যতীত মাহরাম, যেমন দুধ ভাই অথবা মায়ের (পূর্ববর্তী বা পরবর্তী) স্বামী অথবা স্বামীর (অপর স্ত্রীর) ছেলে।
মাহরাম শর্ত হওয়ার দলীল: ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বর্ণনা করেন, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে খুৎবায় বলতে শোনেন:
»لا يخلون رجل بامرأة إلا ومعها ذو محرم، ولا تسافر المرأة إلا مع ذي محرم، فقام رجل فقال: يا رسول الله إن امرأتي خرجت حاجة، وإني اكتتبت في غزوة كذا وكذا، قال: فانطلق فحج مع امرأتك«
“মাহরাম ব্যতীত কোনো নারী পুরুষের সাথে একান্তে থাকবে না, অনুরূপ মাহরাম ব্যতীত নারী সফর করবে না। এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমার স্ত্রী হজের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে, আর আমিও অমুক অমুক যুদ্ধে নাম লিখিয়েছি। তিনি বললেন: যাও, তোমার স্ত্রীর সাথে হজ কর”।[3] ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
»لا تسافر المرأة ثلاثا، إلا معها ذو محرم«
“কোনো নারী মাহরাম ব্যতীত তিন দিন সফর করবে না”।[4]
এ জাতীয় অর্থ প্রদানকারী অনেক হাদীস রয়েছে, যা নারীকে হজ ও অন্যান্য প্রয়োজনে একাকী সফর থেকে নিষেধ করে। কারণ, নারী দুর্বল, সফরে সে এমন সমস্যা ও কষ্টের সম্মুখীন হয়, যা পুরুষ ব্যতীত কেউ সমাধান করতে পারে না। দ্বিতীয়ত নারী ফাসিক পুরুষদের লালসার বস্তু, অতএব তার জন্য অবশ্যই মাহরাম জরুরি, যে তাকে সুরক্ষা দিবে ও তাদের কষ্ট থেকে তাকে নিরাপদ রাখবে।
নারীর হজের মাহরামকে অবশ্যই সাবালক, মুসলিম ও বিবেকী হওয়া জরুরি। কারণ, মাহরাম হিসেবে কাফের বিশ্বাসযোগ্য নয়, যদি তার মাহরাম যোগাড় না হয়, কাউকে প্রতিনিধি করবে, যে তার পক্ষে হজ করবে।
[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪৪৮), নাসাঈ, হাদীস নং২৬২৮)\
[3] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৭৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৪১; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৯০০; আহমদ (১/২২২)
[4] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১০৩৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৩৮; আবু দাউদ, হাদীস নং ১৭২৭; আহমদ: (২/১৯)
স্ত্রী নফল হজ করতে চাইলে স্বামীর অনুমতি প্রয়োজন। কারণ, স্ত্রী নফল হজে বের হলে তার ওপর স্বামীর যে হক রয়েছে তা বিনষ্ট হয়। ইবন কুদামাহ রহ. ‘আল-মুগনি’: (৩/২৪০) গ্রন্থে বলেন: “স্ত্রীকে নফল হজ থেকে নিষেধ করার অধিকার স্বামীর রয়েছে। ইবনুল মুনযির বলেন: যেসব আলেমের ইলম আমার নিকট রয়েছে, তারা সবাই একমত যে স্ত্রীকে নফল হজ থেকে বারণ করার ইখতিয়ার স্বামীর রয়েছে, তার কারণ স্বামীর হক তার ওপর ওয়াজিব, অতএব নফল ইবাদতের জন্য ওয়াজিব নষ্ট করার সুযোগ স্ত্রীর নেই, যেমন মনিব ও গোলামের পরস্পর হক”। সমাপ্ত।
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. ‘মাজমুউল ফতোয়ায়’: (২৬/১৩) বলেন: “আলেমদের ঐক্যমত্যে নারীর জন্য বৈধ অপর নারীর পক্ষ থেকে হজ করা, হোক সে তার মেয়ে অথবা অন্য কেউ। অনুরূপ চার ইমাম ও জমহুর আলেমদের নিকট পুরুষের পক্ষ থেকেও নারীর হজ করা বৈধ, যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাসআমিয়াহ নারীকে তার বাবার পক্ষ থেকে হজ করার নির্দেশ দিয়েছেন, যখন সে বলেছিল:
»يا رسول الله إن فريضة الله في الحج على عباده أدركت أبي وهو شيخ كبير، فأمرها النبي صلى الله عليه وسلم أن تحج عن أبيها، مع أن إحرام الرجل أكمل من إحرامها«.
“হে আল্লাহর রাসূল, বান্দার ওপর আল্লাহর ফরজ বিধান হজ আমার বাবাকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার বাবার পক্ষ থেকে হজ করার নির্দেশ দেন, যদিও নারীর তুলনায় পুরুষের ইহরাম অধিক পরিপূর্ণ”।[1] সমাপ্ত।
ইহরামের সময় যদি নারীর ঋতু বা নিফাস হয়, অন্যান্য পবিত্র নারীর মতো সেও ইহরাম বাঁধবে। কারণ, ইহরামের জন্য পবিত্রতা শর্ত নয়। ইবন কুদামাহ রহ. ‘আল-মুগনি’: (৩/২৯৩ ও ২৯৪) গ্রন্থে বলেন: ইহরামের সময় নারীর গোসল করার বিধান রয়েছে, যেমন রয়েছে পুরুষের। ইহরাম হজের অংশ, তাই হায়েয ও নিফাসের নারীদের ক্ষেত্রে গোসল বেশি গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু তাদের ব্যাপারে হাদীস রয়েছে, জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:
»حتى أتينا ذا الحليفة فولدت أسماء بنت عميس محمد بن أبي بكر، فأرسلت إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم كيف أصنع ؟ قال: اغتسلي، واستثفري بثوب، وأحرمي«
“আমরা যখন যুল হুলাইফা আসি তখন আসমা বিনতে উমাইস মুহাম্মাদ ইবন আবু বকরকে প্রসব করেন। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট জানতে চেয়ে প্রেরণ করল, কীভাবে করবে? তিনি বললেন: গোসল কর, একটি কাপড় পেঁচিয়ে নাও ও ইহরাম বাঁধ”।[1]
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
»النفساء والحائض إذا أتيا على الوقت يحرمان ويقضيان المناسك كلها غير الطواف بالبيت«
“নিফাস ও ঋতুমতী নারী মিকাতে পৌঁছে ইহরাম বাঁধবে ও হজের সকল ইবাদত আঞ্জাম দিবে শুধু তাওয়াফ ব্যতীত”।[2]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশাকে হায়েয অবস্থায় হজের তালবিয়ার জন্য গোসল করার নির্দেশ দিয়েছেন”। সমাপ্ত।
ঋতুমতী ও নিফাসের নারীর ইহরামের পূর্বে গোসল করার হিকমত পবিত্রতা অর্জন করা, দুর্গন্ধ দূর করা যেন মানুষ জড়ো হলে তার থেকে কষ্ট না পায়। যদি ইহরাম অবস্থায় তাদের হায়েয ও নিফাস শুরু হয়, তবুও গোসল করবে নাপাক হালকা করার জন্য, তাদের ইহরামের কোনো সমস্যা হবে না। তারা ইহরাম অবস্থায় থাকবে ও গোসল করবে। অতঃপর ‘আরাফার দিন চলে আসার পরও যদি পবিত্র না হয়, তাহলে যদি উমরা শেষে হজ করার ইচ্ছায় ইহরাম বেঁধে থাকে, এখন হজের ইহরাম বাঁধবে এবং হজকে উমরার সাথে মিলিয়ে ঋতুমতী ও নিফাসী উভয় কারিন হয়ে যাবে অর্থাৎ কিরান হজ আদায়কারী হবে।
এ মাস’আলার দলীল: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা ঋতুমতী হন, তার পূর্বে তিনি উমরার ইহরাম বেঁধেছিলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নিকট গেলে তাকে কাঁদতে দেখেন, তিনি বলেন: তুমি কাঁদ কেন, হয়তো তোমার ঋতু শুরু হয়েছে? সে বলল: হ্যাঁ, তিনি বললেন: এটা এমন এক বস্তু, যা আল্লাহ আদমের মেয়েদের ওপর অবধারিত করে দিয়েছেন। হাজীগণ যা করে তুমিও তাই কর, তবে তাওয়াফ করো না”।[3]
জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে:
»ثم دخل النبي صلى الله عليه وسلم على عائشة فوجدها تبكي، فقال: ما شأنك ؟ قالت: شأني أني قد حضت، وقد حل الناس ولم أحلل ولم أطف بالبيت، والناس يذهبون إلى الحج الآن، فقال: إن هذا أمر قد كتبه الله على بنات آدم، فاغتسلي، ثم أهلي ففعلت ووقفت المواقف كلها، حتى إذا طهرت طافت بالكعبة وبالصفا والمروة، ثم قال: قد حللت من حجك وعمرتك جميعا«
“অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশার নিকট এসে তাকে কাঁদতে দেখেন। তিনি বললেন: তোমার কী হয়েছে? সে বলল: আমার অবস্থা, আমি ঋতুমতী হয়ে গেছি, অথচ মানুষেরা হালাল হয়ে গেছে আমি এখনো হালাল হয় নি এবং তওয়াফও করি নি, মানুষেরা এখন হজে যাচ্ছে। তিনি বললেন: এটা এমন বস্তু, যা আল্লাহ আদমের মেয়েদের ওপর অবধারিত করে দিয়েছেন। অতএব, তুমি গোসল কর, অতঃপর তালবিয়াহ পাঠ কর। তিনি তাই করলেন এবং হজের প্রত্যেক স্থানে অবস্থান করলেন, যখন পবিত্র হলেন তখন কা‘বা ও সাফা-মারওয়া প্রদক্ষিণ করলেন। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন: তুমি তোমার হজ ও উমরা উভয়টা থেকে পবিত্র হয়ে গেছো”।[4]
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম ‘তাহযীবুস সুনান’: (২/৩০৩) গ্রন্থে বলেন: সহীহ ও স্পষ্ট অর্থ প্রদানকারী হাদীস থেকে প্রমাণিত যে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা প্রথম উমরার ইহরাম বাঁধেন, অতঃপর যখন তিনি ঋতুমতী হন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে হজের ইহরাম বাঁধার নির্দেশ দেন, এভাবে তিনি কারিন হন, (অর্থাৎ কেরান হজ আদায়কারী)। এ জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন: “হজ ও উমরার জন্য তোমার (একবার) কাবার তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়া প্রদক্ষিণ করাই যথেষ্ট”।[5] সমাপ্ত।
[2] আবু দাউদ, হাদীস নং ১৭৪৪
[3] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৯৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১১; নাসাঈ, হাদীস নং ২৭৬৩; আবু দাউদ, হাদীস নং ১৭৮২; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৯৬৩; আহমদ: (৬/২৭৩)
[4] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬৯৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১৩; নাসাঈ, হাদীস নং ২৭৬৩; আবু দাউদ, হাদীস নং ১৭৮৫; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩০৭৪
[5] আবু দাউদ, হাদীস নং ১৮৯৭
ইহরামের সময় পুরুষরা যা করে নারীরাও তাই করবে, যেমন গোসল করা, চুল ও নখ কাঁটা এবং দুর্গন্ধ দূর করে পরিচ্ছন্ন হওয়া, যেন ইহরামে প্রবেশের পর এসবের প্রয়োজন না হয়। কারণ, ইহরামে তা নিষিদ্ধ। যদি ইহরামের সময় এ জাতীয় পরিচ্ছন্নতার প্রয়োজন না হয়, তাহলে তা জরুরি নয়। কারণ, এগুলো ইহরামের বৈশিষ্ট্য নয়। শরীরে সুগন্ধি ব্যবহার করা বৈধ, যদি তার সুভাস ও সুগন্ধি প্রকট না হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত,
»كنا نخرج مع رسول الله صلى الله عليه وسلم فنضمد جباهنا بالمسك عند الإحرام، فإذا عرقت إحدانا سال على وجهها، فيراها النبي فلا ينهانا«
“আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বের হওয়ার সময় আমাদের কপালে মিসকের প্রলেপ দিতাম, যখন আমাদের কেউ ঘর্মাক্ত হত, মিসক তার চেহারায় গড়িয়ে পড়ত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা দেখতেন, কিন্তু আমাদের নিষেধ করতেন না”।[1]
শাওকানী রহ. ‘নাওলুল আওতার’: (৫/১২) গ্রন্থে বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চুপ থাকা বৈধতা প্রমাণ করে। কারণ, তিনি না জায়েযের ওপর চুপ থাকেন না”। সমাপ্ত।
যদি নারী ইহরামের পূর্বে বোরকা ও নিকাব পরিহিতা থাকে তাহলে ইহরামের সময় তা খুলে ফেলবে। বোরকা ও নিকাব নারীর চেহারার এক জাতীয় পর্দা, তাতে চোখ বরাবর দু’টি ছিদ্র থাকে, তা দিয়ে সে দেখে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
»لا تنتقب المحرمة«
“মুহরিম নারী নিকাব পরবে না”।[1]
বোরকা নিকাবের চেয়ে অধিক আচ্ছাদনকারী। অনুরূপ যদি ইহরামের পূর্বে হাতমোজা পরিহিতা থাকে তাও খুলে ফেলবে। বোরকা ও নিকাব ছাড়া নারী স্বীয় চেহারা ঢেকে রাখবে। যেমন, পর-পুরুষ দেখার সময় চেহারার ওপর উড়না বা কাপড় ছেড়ে দেওয়া, অনুরূপভাবে হাতমোজা ছাড়াই পুরুষের দৃষ্টি থেকে হাত ঢেকে রাখা, যেমন হাতের ওপর উড়না বা চাদর ফেলে রাখা। কারণ, চেহারা ও হাত সতর, যা ইহরামের ভেতর ও বাইরে পর-পুরুষ থেকে ঢেকে রাখা ওয়াজিব।
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন: “নারী পুরোটাই সতর, তাই ইহরাম অবস্থায় শরীর আচ্ছাদনকারী কাপড় পরিধান করা তার পক্ষে বৈধ, আরো বৈধ পালকি/বাহনের ছায়া গ্রহণ করা, তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীকে নিকাব ও মোজা পরিধান করতে নিষেধ করেছেন। যদি নারী এমন বস্তু দ্বারা চেহারা আবৃত করে, যা তার চেহারাকে স্পর্শ করে না তাহলে সবার নিকট বৈধ, যদি স্পর্শ করে তবুও বিশুদ্ধ মতে সহীহ। তবে নারী স্বীয় চেহারা থেকে নেকাব বা আচ্ছাদনের কাপড় পৃথক রাখার জন্য কোনো বস্তুর সাহায্য গ্রহণ করবে না, যেমন কাঠ, হাত বা এ জাতীয় বস্তু দ্বারা পৃথক রাখবে না। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্দার ক্ষেত্রে হাত ও চেহারাকে বরাবর গণ্য করেছেন। নারীর হাত ও চেহারা পুরুষের শরীরের মতো, মাথার মতো নয় যা সর্বদা খোলা রাখা জরুরি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীগণ তাদের চেহারার ওপর মাথার কাপড় ছেড়ে দিতেন, চেহারা তা স্পর্শ করছে না বিচ্ছিন্ন আছে ভ্রুক্ষেপ করতেন না। ‘নারীর ইহরাম তার চেহারায়’ এ কথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত নেই। এটি কোনো পূর্বসূরির কথা”। সমাপ্ত।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম রহ. ‘তাহযীবুস সুনান’: (২/৩৫০) গ্রন্থে বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একটি হরফও বর্ণিত নেই, যা প্রমাণ করে ইহরামের সময় নারীর চেহারা খুলে রাখা ফরয, শুধু চেহারায় নিকাব ব্যবহার করার নিষেধাজ্ঞা ব্যতীত... অতঃপর তিনি বলেন: আসমা থেকে বর্ণিত, ইহরাম অবস্থায় তিনি স্বীয় চেহারা ঢেকে রাখতেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন:
»كان الركبان يمرون بنا ونحن مع رسول الله صلى الله عليه وسلم محرمات، فإذا حاذوا بنا سدلت إحدانا جلبابها من رأسها على وجهها؛ فإذا جاوزنا كشفناه«
“আমরা যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম আরোহীরা আমাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করত, যখন তারা আমাদের বরবার হত আমাদের প্রত্যেকে তার আঁচল মাথার ওপর থেকে চেহারার ওপর ঝুলিয়ে দিত, যখন তারা আমাদের অতিক্রম করে যেত আমরা তা চেহারা থেকে সরিয়ে ফেলতাম”।[2] সমাপ্ত।
হে মুহরিম মুসলিম নারী, তুমি জেনে রাখ যে, এমন কাপড় দিয়ে চেহারা ঢাকা নিষেধ, যা একমাত্র শরীর ঢাকার জন্য সেলাই করে তৈরি করা, যেমন নিকাব ও হাতমোজা। এ ছাড়া তোমার চেহারা ও হাত উড়না, কাপড় ও এ জাতীয় বস্তু দ্বারা পর-পুরুষ থেকে ঢেকে রাখা ওয়াজিব। কাপড় যেন চেহারা স্পর্শ না করে এ জন্য মুখের ওপর (খাঁচা জাতীয়) কোনো বস্তু রাখার ভিত্তি নেই, না লাকড়ি, না পাগড়ি, না কোনো বস্তু।
[2] আবু দাউদ, হাদীস নং ১৮৩৩; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৯৩৫; আহমদ (৬/৩০)
নারীদের জন্য ইহরাম অবস্থায় যাবতীয় মেয়েলী পোশাক পরা বৈধ, যাতে সৌন্দর্য চর্চা ও পুরুষের পোশাকের সাথে সামঞ্জস্য নেই। এমন সংকীর্ণ হবে না যা তার শরীরের পরিমাণ বলে দেয় এবং এমন স্বচ্ছও হবে না যা তার ভেতর অংশ প্রকাশ করে দেয়। আবার এমন ছোটও হবে না, যা তার পা ও হাতের জন্য যথেষ্ট নয়, বরং পর্যাপ্ত, মোটা ও প্রশস্ত হওয়া জরুরি।
ইবনুল মুনযির বলেন: আহলে ইলমগণ একমত যে, মুহরিম নারীর জন্য জামা, চাদর, পায়জামা, উড়না ও পায়ের মোজা পরিধান করা বৈধ।[1] সমাপ্ত।
নারীর জন্য নির্দিষ্ট রঙের কাপড় পরিধান করা জরুরি নয়। যেমন সবুজ রঙ, বরং নারীদের সাথে সম্পৃক্ত লাল, সবুজ ও কালো যে রঙের ইচ্ছা কাপড় পরিধান করা বৈধ, যখন ইচ্ছা রঙ পরিবর্তন করতে বাধা নেই।
ইবনু আব্দুল বারর বলেন: আহলে ইলমগণ একমত যে, নারীর ক্ষেত্রে সুন্নত হচ্ছে তালবিয়ার সময় আওয়াজ উঁচু না করা, সে শুধু নিজেকে শুনিয়ে বলবে। ফিতনার আশঙ্কার কারণে তার আওয়াজ উঁচু করা মাকরূহ। এ জন্য তার পক্ষে আযান ও ইকামত সুন্নত নয়, অনুরূপ সালাতের মধ্যে সতর্ক করার জন্য সে শুধু তাসফিক তথা হাতে আওয়াজ করবে, মুখে তাসবীহ বলবে না”।[1] সমাপ্ত।
তওয়াফের সময় নারী পরিপূর্ণ পর্দা করবে, আওয়াজ নিচু ও চোখ অবনত রাখবে, পুরুষদের সাথে ভিড় করবে না, বিশেষভাবে হজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানীর নিকট। নারীর জন্য পুরুষের ভিড় ঠেলে কা‘বার নিকট দিয়ে তাওয়াফ করা অপেক্ষা তাদের ভিড় এড়িয়ে মাতাফের শেষ প্রান্ত দিয়ে তাওয়াফ করা উত্তম। কারণ, এতে ফিতনার আশঙ্কা রয়েছে। হ্যাঁ, যদি সহজ হয় কা‘বার নিকট দিয়ে তাওয়াফ করা ও হাজরে আসওয়াদ চুমু দেওয়া দু’টি সুন্নত, তবে সুন্নতের জন্য হারামে লিপ্ত হওয়া যাবে না, বরং ভিড়ে সুন্নতও নয়। তখন সুন্নত হচ্ছে হাজরে আসওয়াদের বরাবর হলে হাত দিয়ে ইশারা করা।
ইমাম নাওয়াওয়ী রহ. ‘আল-মাজমু’: (৮/৩৭) গ্রন্থে বলেন: আমাদের সাথীগণ বলেছেন: নারীদের জন্য রাত কিংবা অন্য কোনো সময় খালি মাতাফ ব্যতীত হাজরে আসওয়াদ চুমু খাওয়া কিংবা স্পর্শ করা মুস্তাহাব নয়। কারণ, এতে তাদের ও অন্যদের ফিতনার আশঙ্কা রয়েছে। সমাপ্ত।
ইবন কুদামাহ রহ. ‘মুগনি’: (৩/৩৩১) গ্রন্থে বলেন: নারীর জন্য রাতে তাওয়াফ করা মুস্তাহাব। কারণ, এটা তার পর্দার সহায়ক এবং ভিড়ও তাতে কম হয়। এ সময় কাবার নিকট যাওয়া ও হাজরে আসওয়াদ চুমু খাওয়া তার পক্ষে সম্ভব। সমাপ্ত।
ইবন কুদামাহ ‘আল-মুগনি’: (৩/৩৯৪) গ্রন্থে বলেন: নারীর তাওয়াফ ও সা‘ঈ সবটাই হাঁটা। ইবনুল মুনযির বলেন: আহলে-ইলম সবাই একমত যে, নারীদের জন্য কা‘বার তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়ার সা‘ঈতে রমল ও ইদ্বতেবা নেই। কারণ, এর উদ্দেশ্য শক্তিমত্তা ও বীরত্ব প্রকাশ করা, যা নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অধিকন্তু নারীদের ক্ষেত্রে পর্দা রক্ষা করা মূল বিষয়, রমল ও ইদ্বতেবায় পর্দা বিগ্ন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সমাপ্ত।