বাইবেল গবেষক ও সমালোচকরা বাইবেল বিষয়ে সবচেয়ে বড় অভিযোগ করেন বাইবেলের নৃশংসতা (Bible Atrocities) প্রসঙ্গে। তারা বলেন যে, বাইবেল সৃষ্টিকর্তাকে অত্যন্ত নৃশংস ও হত্যাপ্রিয় হিসেবে এবং বাইবেলীয় ধর্মকে হত্যা ও নিষ্ঠুরতা নির্ভর বলে চিত্রিত করেছে। আমরা এ অধ্যায়ে এ বিষয়টা আলোচনা করব। উল্লেখ্য যে, এ অধ্যায়ের বাইবেলীয় উদ্ধৃতিগুলো মূলত কিতাবুল মোকাদ্দস-২০০৬ থেকে গৃহীত।
৯. ১. ঈশ্বরের চিরন্তন ও অলঙ্ঘনীয় বিধান
বাইবেলীয় হত্যা ও যুদ্ধ বিষয়ক আলোচনার পূর্বে পাঠককে মনে রাখতে হবে যে, আমরা এখানে ইতিহাস আলোচনা করছি না, বরং ধর্ম আলোচনা করছি। ইতিহাসের কিছু হত্যা ও যুদ্ধের বর্ণনা এবং হত্যা ও যুদ্ধের বিষয়ে কোনো ধর্মের চিরন্তন নির্দেশ ও আদর্শ এক নয়। ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মবিশ্বাস অনুসারে বাইবেলের বিধান রহিত বা পরিবর্তিত হয় না। পরবর্তী পরিচ্ছেদগুলোতে আমরা হত্যা ও যুদ্ধ বিষয়ে বাইবেলের যে সকল আদেশ, নির্দেশনা, কর্ম ও বর্ণনা উল্লেখ করব সব কিছুই ঈশ্বরের চিরন্তন অলঙ্ঘনীয় আদেশ ও আদর্শ। এ সকল আদেশ ও আদর্শ পুরাতন নিয়মের নবীদের যুগে যেমন ঈশ্বরের অলঙ্ঘনীয় বিধান ছিল; কিয়ামত পর্যন্ত সকল বাইবেল বিশ্বাসীর জন্য তা তেমনিভাবে ঈশ্বরের অলঙ্ঘনীয় নির্দেশ ও চিরন্তন বিধান। যদি কেউ দাবি করেন যে, এগুলো একটা প্রাচীন জাতির ইতিহাস অথবা প্রাচীন যুগের বর্বরতা তবে তিনি বাইবেল ও খ্রিষ্টধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে অজ্ঞ অথবা তিনি বিষয়টা জেনেও এভাবে অজ্ঞ বা অনভিজ্ঞ মানুষকে ভুল বুঝাতে চেষ্টা করেন।
অতীতের ক্রুসেডাররা যেমন বাইবেলের এ সকল নির্দেশনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন, বর্তমানের খ্রিষ্টানরাও এ সকল নির্দেশনাকে তাদের যুদ্ধবিগ্রহের অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করছেন। অতীতের ক্রুসেডাররা ধর্মযুদ্ধ বা পবিত্র যুদ্ধ শব্দ ব্যবহার করতেন। আধুনিক ক্রুসেডাররা ‘নৈতিক যুদ্ধ’ বা ‘ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ’ (moral war/ just war) শব্দ ব্যবহার করেন। এগুলোর ভিত্তিতেই প্রসিদ্ধ আমেরিকান ধর্মগুরু রেভারেন্ড বিলি গ্রাহাম (Billy Graham) ভিয়েতনাম ও ইরাক যুদ্ধের গণহত্যা সমর্থন করেন।[1]
বাইবেলের দ্বিতীয় পুস্তক ‘যাত্রাপুস্তক’ প্রসঙ্গে গ্যারি ডেভানি লেখেছেন:
“EXODUS EXPLAINED: PARABLE: Imagine you have no home of your own. A "STRANGER" authoritatively tells you that he has chosen you and that he will give you a home of your own. You want to believe him. He takes you to a distant land and points out a house to you. He now says, "There is the home I give you." You look and you see people in the house. He says, "Now, you go into that house and kill every man, woman and child in that house or I will do to you what I thought to do to them." This is the Exodus story. How do you like it? How do you like the Biblical God now? What if the Biblical God gave your, your wife's and your children's house to His new chosen?”
‘‘যাত্রাপুস্তকের ব্যাখ্যা: দৃষ্টান্ত। কল্পনা করুন, আপনার নিজের কোনো বাড়ি নেই। একজন নবাগত ব্যক্তি কর্তৃত্বপূর্ণভাবে বললেন যে, তিনি আপনাকে নিজের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি আপনাকে আপনার নিজের জন্য একটা বাড়ি প্রদান করবেন। আপনি তাকে বিশ্বাস করতে চাইলেন। তিনি আপনাকে অনেক দূরের একটা দেশে নিয়ে গিয়ে একটা বাড়ি আপনাকে দেখালেন। এরপর তিনি বললেন: ‘‘এ বাড়িটাই তোমাকে প্রদান করলাম।’’ আপনি তাকিয়ে দেখলেন যে, বাড়িটার মধ্যে মানুষজন বসবাস করছে। তখন তিনি বললেন: ‘‘এখন তুমি বাড়িটাতে প্রবেশ কর এবং বাড়ির মধ্যে বিদ্যমান সকল নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা কর। যদি তা না কর তবে তাদের যে পরিণতির কথা আমি চিন্তা করেছিলাম সে পরিণতি তোমারই হবে।’’ এটাই যাত্রাপুস্তক/ হিজরত-এর গল্প। আপনি এটাকে কেমন পছন্দ করছেন? বাইবেলীয় ঈশ্বরকে আপনি এখন কী পরিমাণ ভালবাসছেন? যদি বাইবেলীয় ঈশ্বর এখন আপনার, আপনার স্ত্রীর ও আপনার সন্তানদের বাড়িটাকে তার নতুন কোনো মনোনীতকে এভাবে দান করেন তবে আপনার কেমন লাগবে?’’[1]
তৌরাতের চতুর্থ পুস্তক ‘গণনা’ বা ‘শুমারী’। এ পুস্তকের হত্যানির্দেশনা সম্পর্কে ‘মৃত্যুদণ্ড দৃশ্যকল্প’ (Execution Scenario) লেখেছেন গ্যারি ডেভানি:
“The warden stated: You have been found guilty of theft and four (4) counts of murder. By the laws of this state, your life will be forfeited at 12:01 by lethal-injection. Do you have any last words? Prisoner: Yes warden. I have heard clergy. I am God-fearing and I want to be, what I interpret to be, God-like. I confess that I went into another family’s home and took their valuables. When the father objected I murdered him, and his wife. The reason I murdered his little children too, was so they couldn’t come back on me in later years. In the Bible, God ordered Moses and Joshua to take peoples’ lands and to murder every man, woman and child in the process. I know that I am one of God’s elect. I believe in God’s unmerited gifts. I will be rewarded for doing what I believe God told me to do. With God, through Jesus, I am forgiven and innocent. You are a man who cannot understand the wonderment of God and the spirit of the Holy Ghost. Although, you may kill me, my spirit will live in the house of the Lord, through Jesus Christ, forever. You now will have to live with what you have done to me, God’s saved-elect servant. God and I will deal with you warden!
‘‘জেলার কয়েদীকে বললেন: চুরি এবং চারজন মানুষকে হত্যা করার বিষয়ে আপনার অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় আইন অনুসারে ১২.০১ টায় বিষাক্ত ইনজেকশনের মাধ্যমে আপনাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হবে। কোনো শেষ বক্তব্য কি আপনি বলতে চান? কয়েদী বললেন : ‘‘জি, হ্যাঁ। আমি পাদরির কথা শুনেছি। আমি ঈশ্বরকে ভয় করি এবং আমি চাই যে, আমি যা ব্যাখ্যা করব তা ঈশ্বরের মতই হোক। আমি স্বীকার করছি যে, আমি অন্য একটা পরিবারের বাড়িতে ঢুকে তাদের মূল্যবান দ্রব্যাদি চুরি করছিলাম। বাড়ির কর্তা আমাকে আপত্তি করলে আমি তাকে ও তার স্ত্রীকে হত্যা করি। সন্তানদেরকে হত্যা করার কারণ, আমি চাইনি যে, পরবর্তী সময়ে বড় হয়ে তারা আমার বিরুদ্ধে লাগুক। বাইবেলের মধ্যে ঈশ্বর মোশি এবং যিহোশূয়কে আদেশ করেছেন অন্য মানুষদের দেশ অধিকার করতে এবং এ প্রক্রিয়ায় সে সকল দেশের প্রতিটা পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করতে। আমি জানি, আমি ঈশ্বরের একজন মনোনীত। আমি ঈশ্বরের অযাচিত দানে বিশ্বাস করি। ঈশ্বর আমাকে যা বলেছেন তা পালন করার কারণে আমি পুরস্কৃত হব বলে আমি বিশ্বাস করি। ঈশ্বরের সাথে, যীশুর মাধ্যমে আমি ক্ষমা লাভ করেছি এবং আমি নিষ্পাপ। আপনি এমন একজন মানুষ যিনি ঈশ্বর এবং পবিত্র আত্মার বিস্ময়করতা অনুধাবন করতে পারেন না। যদিও আপনি হয়ত আমাকে হত্যা করবেন, তবে আমার আত্মা অনন্তকাল যীশু খ্রিষ্টের মাধ্যমে ঈশ্বরের বাড়িতে বাস করবে। আমি ঈশ্বরের একজন মনোনীত ও সংরক্ষিত দাস। আমাকে হত্যা করার পরিণতির মধ্যেই আপনাকে বাস করতে হবে। জেলার, ঈশ্বর এবং আমি আপনার বিষয়টা দেখব!’’[1]
বাইবেলের পঞ্চম পুস্তক ‘দ্বিতীয় বিবরণ’ প্রসঙ্গে ‘যায়নবাদ বিতর্ক’ (The Controversy Of Zion) পুস্তকের লেখক ডগলাস রীড (Douglas Reed) বলেন:
“Deuteronomy is above all a complete political programme: the story of the planet, created by Jehovah for this "special people", is to be completed by their triumph and the ruination of all others. The rewards offered to the faithful are exclusively material: slaughter, slaves, women, booty, territory, empire. The only condition laid down for these rewards is observance of "the statutes and judgments", which primarily command the destruction of others. The only guilt defined lies is non-observance of these laws. Intolerance is specified as observance; tolerance as non-observance, and therefore as guilt. The punishments prescribed are of this world and of the flesh, not of the spirit. By the time the end of Deuteronomy is reached the moral commandments have been nullified in this way, for the purpose of setting up, in the guise of a religion, the grandiose political idea of a people especially sent into the world to destroy and "possess" other peoples and to rule the earth. The idea of destruction is essential to Deuteronomy. If it be taken away no Deuteronomy, or Mosaic Law, remains.”
‘‘সর্বোপরি দ্বিতীয় বিবরণ একটা পুরোপুরি রাজনৈতিক কর্মসূচি। পৃথিবী নামক গ্রহের গল্প হল, বাইবেলের ঈশ্বর যিহোভা তার বিশেষ প্রজা ‘ইসরাইলের’ জন্য এটাকে সৃষ্টি করেছেন। অন্য সকলের ধ্বংসের মাধ্যমে তাঁর এ প্রিয় প্রজার বিজয়ে এ গল্প পূর্ণ হবে। বিশ্বাসীদের জন্য যে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে তা নির্ভেজালভাবে জাগতিক: গণহত্যা, দাসদাসী, নারী, যুদ্ধলব্ধ সম্পদ, দেশ দখল, সাম্রাজ্য স্থাপন। আর এ সকল পুরস্কার লাভের জন্য একটাই শর্ত: বিধান ও বিচার মান্য করা। আর এ বিধান ও বিচারের মূল কথা: সকলকে ধ্বংস ও নির্মূল কর। একমাত্র পাপ এ নির্দেশ পালনে অবহেলা। অসহিষ্ণুতাকেই বিধান পালন হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে এবং সহিষ্ণুতাকে বিধান অমান্য করা বলে গণ্য করা হয়েছে। কাজেই সহিষ্ণুতাই অপরাধ। যত শাস্তির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সবই জাগতিক ও দৈহিক, কোনো কিছুই পরলৌকিক বা আত্মিক নয়। দ্বিতীয় বিবরণ যখন সমাপ্তিতে উপনীত হল তখন এভাবে সকল নৈতিক বিধানকে অকার্যকর করা হয়েছে। একটা বিশেষ জাতিকে পৃথিবীর উপরের সকল জাতিকে পদানত ও শাসন করতে প্রেরণ করা হয়েছে এমন একটা সুবৃহৎ রাজনৈতিক চিন্তাকে ধর্মের ছদ্মাবরণে পেশ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিবরণের মূল ও অবিচ্ছেদ্য চেতনা ধ্বংস করা। ধ্বংসের তত্ত্বকে বাদ দিলে কোনো দ্বিতীয় বিবরণ থাকে না এবং কোনো মূসায়ী শরীয়তও থাকে না।’’[1]
বাইবেলের মধ্যে বিদ্যমান হত্যা ও যুদ্ধ-জিহাদ বিষয়ক তথ্যাদিকে কয়েকভাগে ভাগ করা যায়: (১) হত্যার নির্দেশনা, (২) ঐশ্বরিক হত্যা, (৩) যুদ্ধ-জিহাদ বিষয়ক নির্দেশনা, (৪) বাইবেলীয় যুদ্ধ-জিহাদের চিত্র, (৫) ঠাণ্ডা মাথায় শত্রু, যুদ্ধবন্দি বা বিধর্মী হত্যা ও নির্যাতন... ইত্যাদি।
হত্যার নির্দেশনা বিষয়ে আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে কিছু আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, বাইবেলে ছোট-বড় বিভিন্ন পাপের জন্য অথবা ঈশ্বরের নির্বাচিত জাতির সাথে শত্রুতার কারণে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও গ্রাম বা জনপদসহ সকল মানুষের হত্যা করার, পাথর মেরে হত্যা করার বা আগুনে পুড়িয়ে ফেলার বহুবিধ নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এজন্য এ প্রসঙ্গটা এ অধ্যায়ে আর আলোচনা করব না।
বাইবেলে ঈশ্বরের অন্যতম পরিচয় যে, তিনি আঘাত করেন ও হত্যা করেন: ‘‘তিনি আঘাত করেছিলেন বড় বড় জাতিকে, হত্যা করেছিলেন বিক্রমী বাদশাহদেরকে।’’ (গীতসংহিতা/ জবুর শরীফ ১৩৫/১০, মো.-১৩)
দুষ্ট মানুষদের হত্যা করাই ঈশ্বরের কর্ম এবং ধার্মিক মানুষদের মনের বাসনা ও প্রার্থনা: ‘‘(Surely thou wilt slay the wicked, O God) কেরির অনুবাদ: ‘‘হে ঈশ্বর, তুমি নিশ্চয় দুষ্টকে বধ করিবে।’’ কিতাবুল মোকাদ্দস-০৬: ‘‘হে আল্লাহ, আমি চাই তুমি দুষ্টদের মেরে ফেল।’’ (গীতসংহিতা/ জবুর শরীফ ১৩৯/১৯)
ঈশ্বরীয় হত্যা বিষয়ক কিছু তথ্য আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে দেখেছি। আমরা দেখেছি, ঈশ্বর কোনো অপরাধ ছাড়া অথবা সামান্য অপরাধে পুরো বিশ্বের সকল মানুষ ও প্রাণি, মিসরের সকল পশুপ্রাণি, মাছ, সকল মানুষ ও পশুর প্রথম সন্তান, বাইরে অবস্থানরত সকল মানুষ ও পশু হত্যা করেছেন। তিনি পিতার অপরাধে নিরপরাধ সন্তান ও পরবর্তী বংশধরদের হত্যা করেছেন। এছাড়া সামান্য ভুলত্রুটি বা অবাধ্যতার কারণে তিনি বনি-ইসরাইলের হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছেন। ঐশ্বরিক হত্যা বিষয়ে পূর্ববর্তী বিষয়াদি ছাড়া আরো অনেক বিষয় বাইবেলে পাওয়া যায়। বিশেষত যুদ্ধ প্রসঙ্গে বাইবেলের ঈশ্বর শুধু ধার্মিকদেরকে যুদ্ধের নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হননি; উপরন্তু তিনি ধার্মিকদের পক্ষে শত্রুদের হাজার হাজার মানুষ নিজে বা ফেরেশতাদের দিয়ে হত্যা করেছেন। আবার অনেক সময় নিজ প্রজাদেরকেও হত্যা করেছেন।
বাইবেলে ঈশ্বরকে এমন ভয়ঙ্কর হত্যাকারী হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে যে, গ্যারি ডেভানি লেখেছেন, আপনি যদি বাজি ধরেন যে, ঈশ্বরের প্রতিটা কল্যাণ কর্মের জন্য আপনি ১০০ ডলার লাভ করবেন অথবা প্রতিটা হত্যার জন্য আপনি ১০০ ডলার লাভ করবেন তাহলে কোন বাজিতে আপনি বেশি টাকা লাভ করবেন? সৃষ্টির গল্প বাদ দিলে বাইবেল থেকে কয়টা ঘটনা প্রমাণ করা যাবে যে, ঈশ্বর অন্য কোনো মানুষের ক্ষতি না করে কোনো মানুষের কোনো উপকার করেছেন? এর বিপরীতে যদি আপনি বাজি ধরেন যে, ঈশ্বরের প্রতিটা হত্যাকাণ্ড-র জন্য আপনি ১০০ ডলার বাজি লাভ করবেন তাহলেই কি আপনি অনেক অনেক সম্পদ লাভ করবেন না?[1]
বাইবেলের মধ্যে বিদ্যমান ঐশ্বরিক হত্যা আমরা দুভাগে ভাগ করতে পারি: (ক) নিজ প্রজা বনি-ইসরাইলকে হত্যা এবং (খ) অন্যান্য জাতিকে হত্যা।
বাইবেলের বর্ণনায় বনি-ইসরাইল জাতি ঈশ্বরের একমাত্র প্রিয় সন্তান ও মনোনীত জাতি। কিন্তু ঈশ্বরের বিরুদ্ধে ইসরাইল জাতির বিদ্রোহ ও ছোটবড় অপরাধে তাদের প্রতি ঈশ্বরের শাস্তির বিবরণ সত্যই অবিশ্বাস্য। আমরা ইতোপূর্বে বলেছি যে, মিসর থেকে প্রায় ত্রিশ লক্ষ বনি-ইসরাইলকে ঈশ্বর বের করে নিয়ে আসেন, তাদের মধ্যে লেবীয় গোষ্ঠী বাদেই ছয় লক্ষাধিক ছিল ২০-৪০ বছর বয়সী যোদ্ধা। তাদেরকে দুধ ও মধুর দেশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঈশ্বর বের করে নিয়ে আসেন। ফিলিস্তিনের কাছে আসলে ঈশ্বর বলেন এ দেশের বাসিন্দাদের হত্যা করে তোমাদেরকে এ দেশ দখল করতে হবে। যুদ্ধ ও হত্যায় বনি-ইসরাইল আপত্তি করে। এতে ঈশ্বর ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের জন্য প্রতিশ্রুত দুধ ও মধুর দেশে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন। পরবর্তী ৩৮ বছরে মরুভূমিতে অবস্থানকালে মিসর থেকে বের হয়ে আসা প্রায় ত্রিশ লক্ষ বনি-ইসরাইলের মধ্যে মাত্র দুজন-যিহোশূয় ও কালেব ছাড়া সকলেই মৃত্যুবরণ করেন। (গণনাপুস্তক ১৪/২-৩৮; ৩২/১১-১৩; দ্বিতীয় বিবরণ ২/১৪-১৫) সমালোচকদের ভাষায় ঈশ্বর তাঁর প্রিয় মনোনীতদের মধ্য থেকে প্রায় ত্রিশ লক্ষ প্রিয় প্রজাকে হত্যা করেন। এ ছাড়াও ঈশ্বর কর্তৃক বনি-ইসরাইলদের হত্যার কিছু ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি।
‘‘এর পর বনি-ইসরাইলরা ইদোম দেশের পাশ দিয়ে ঘুরে যাওয়ার জন্য হোর পাহাড়ের কাছ থেকে আকাবা উপসাগরের পথ ধরে চলল। কিন্তু পথে তারা ধৈর্য হারিয়ে আল্লাহ ও মূসার বিরুদ্ধে বলতে লাগল, ‘এই মরুভূমির দেশে মারা পড়বার জন্য কেন তোমরা মিসর দেশ থেকে আমাদের বের করে এনেছ? এখানে রুটিও নেই পানিও নেই, আর এই বাজে খাবার আমরা দু’ চোখে দেখতে পারি না।’ তখন মাবুদ তাদের মধ্যে এক রকম বিষাক্ত সাপ পাঠিয়ে দিলেন। সেগুলোর কামড়ে অনেক ইসরাইলীয় মারা গেল।’’ (গণনাপুস্তক/ শুমারী ২১/৪-৬, কি. মো.-০৬)
শুমারী/ গণনাপুস্তকের ১৬ এবং ১৭ অধ্যায়দ্বয়ের শ্লোকসংখ্যা ও বিন্যাসে ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। পাঠক বাংলায় জুবিলী বাইবেলের সাথে পবিত্র বাইবেল বা কিতাবুল মোকাদ্দস মিলিয়ে পড়লে পার্থক্য ধরতে পারবেন। এ দুটো অধ্যায় পাঠ করলে পাঠক দেখবেন যে, কোরহ বা কারুন (Korah) মোশি ও হারোণের মতই লেবীয় বংশের মানুষ ছিলেন। মোশি তাঁর ভাই হারোণকে মহা-যাজক পদে নিয়োগ দিলে কোরহের নেতৃত্বে আড়াই শত মানুষ আপত্তি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, বনি-ইসরাইলের সকলেই তো ঈশ্বরের পবিত্র বান্দা ও সকলেই ঈশ্বরের সমান প্রিয়। তাহলে আপনারা তাদের উপর সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণ করছেন কেন? এতে ঈশ্বর ক্রোধান্বিত হয়ে কারুন (Korah), দাথন (Dathan) ও অবিরাম (Abriam)-কে তাদের স্ত্রী-সন্তান ও লোকজনসহ মাটির নিচে প্রোথিত করে হত্যা করেন। এরপর কোরাহ-পন্থি আড়াইশত নেতাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন। (গণনা/শুমারী: কিতাবুল মোকাদ্দস ও প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেল ১৬/১-৪০ এবং জুবিলী বাইবেল ১৬/১-৩৫ ও ১৭/১-৫)।
এতগুলো মানুষের করুণ মৃত্যুতে ব্যথিত ও বিক্ষুব্ধ বনি ইসরাইলের মানুষেরা মূসা ও হারুনের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তোমাদের কারণেই এতগুলো মানুষ মারা গেল। এ অভিযোগে ক্রুদ্ধ হয়ে ঈশ্বর এবার আরো চৌদ্দ হাজার সাত শত (১৪,৭০০) ইসরাইলীয়কে হত্যা করেন! (কিতাবুল মোকাদ্দস, শুমারী ১৬/৪১-৫০)
পরদিন বনি-ইসরাইলের মানুষেরা এ হত্যাকাণ্ড-র প্রতিবাদ করে মোশিকে বলেন, তুমিই সদাপ্রভুর প্রজাদের হত্যা করেছ। এ অভিযোগে ক্রুদ্ধ হয়ে ঈশ্বর বনি- ইসরাইলের মধ্যে মহামারি প্রেরণ করেন। হাজার হাজার মানুষ মরতে থাকে। তখন মোশি সুপারিশ করে পাপের কাফফারার ব্যবস্থা করেন। এতে মহামারি থেমে যায়। এ মহামারিতে প্রভুর প্রিয় প্রজা ও বান্দাদের মধ্য থেকে ১৪,৭০০ মানুষ মারা যায়। (গণনাপুস্তক: জুবিলী ১৭/৬-১৫; কিতাবুল মোকাদ্দস/পবিত্র বাইবেল ১৬/৪১-৫০)
বনি-ইসরাইলদের জন্য অন্য জাতির মেয়ে বিবাহ নিষিদ্ধ। অন্য জাতির মেয়ে বিয়ে করাও ব্যভিচার বলে গণ্য। উপরের ঘটনার পরে বনি-ইসরাইলের মানুষেরা শিঠিম শহরের কাছে থাকার সময় মোয়াবীয় (Moab) নারীদের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হতে শুরু করে। মোয়াবীয় নারীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা তাদের দেবতাদেরও পূজা করতে শুরু করে। এতে ঈশ্বর ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ হন। তিনি মোশিকে নির্দেশ দেন: ‘‘তুমি সমস্ত ইসরাইলীয় নেতাদের ধরে হত্যা কর এবং দিনের আলোতে আমার সামনে তাদের লাশগুলো ফেলে রাখ।’’ (শুমারী ২৫/৪)।
মোশি ও ইসরাইলীয় নেতারা যখন কাঁদাকাটি করছিলেন তখন একজন ইসরাইলীয় পুরুষ একজন মাদিয়ানীয় (Midianitish) মহিলাকে নিয়ে নিজের পরিবারের মধ্যে গমন করে। তখন মহাযাজক হারোণের নাতি ইলিয়াসরের ছেলে পীনহস (Phinehas/ Pinchas) একটা বর্শা হাতে উক্ত ব্যক্তির বাড়িতে প্রবেশে করে উক্ত ব্যক্তি ও তার মাদিয়ানীয় স্ত্রীর পেটের মধ্যে দিয়ে বর্শা ঢুকিয়ে দিয়ে উভয়কে হত্যা করেন। ‘‘এরপর বনি-ইসরাইলদের মধ্য থেকে মহামারি দূর হল। কিন্তু যারা ঐ মহামারিতে মারা গেল তাদের সংখ্যা ছিল চবিবশ হাজার।’’ (শুমারী/গণনাপুস্তক ৮/৯)