আধুনিক বাইবেল গবেষকরা বাইবেলের মধ্যে বিদ্যমান অযৌক্তিক বা অশোভন অনেক তথ্য উপস্থাপন করেন। ‘Bible Absurdities’: বাইবেলীয় অযৌক্তিকতা, ‘Bible Vulgarities & Obscenities’: বাইবেলীয় অশিষ্টতা ও অশ্লীলতা, ‘Bible Atrocities’: বাইবেলীয় নৃশংসতা ইত্যাদি শিরোনামে তারা বিষয়গুলো আলোচনা করেন। পাঠক এ তিনটা শিরোনাম লেখে ইন্টারনেটে অনুসন্ধান করলে অথবা তথ্যসূত্রে প্রদত্ত বিভিন্ন ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে এ বিষয়ে আরো অনেক তথ্য জানতে পারবেন। আমরা শুধু বাইবেলের সুনির্দিষ্ট উদ্ধৃতিসহ তথ্য নির্ভর কিছু বিষয় উল্লেখ করব, যদিও সমালোচকরা অনেক ঢালাও কথাও বলেছেন। যেমন, আমেরিকার প্রসিদ্ধ সমাজসংস্কারক রবার্ট ইনগেরসল বলেন: “If a man would follow, today, the teachings of the Old Testament, he would be a criminal. If he would strictly follow the teachings of the New, he would be insane.” ‘‘বর্তমানে যদি কোনো মানুষ পুরাতন নিয়মের শিক্ষা অনুসরণ করে তবে সে একজন অপরাধীতে পরিণত হবে। আর যদি কেউ নতুন নিয়মের শিক্ষা অনুসরণ করে তবে সে উন্মাদে পরিণত হবে।’’[1]
‘নাস্তিক প্রজনক’ (The Atheist Maker) প্রবন্ধে গ্যারি ডেভানি লেখেছেন:
“The greatest Atheist Maker on planet Earth is the Bible itself. If you are a sane, logical and reasonable Human Being, knowing these selected Bible Chapters & Verses that your Bible documents may make you an Atheist. Ask yourself how you could possibly believe in, support, promote and finance the Biblical God documented in these selected Bible C&Vs. Often, in Bible C&V debate, a believer will say: I will ask my preacher what the Bible says. I suggest that you do not check out the Bible with your preacher. I suggest that you check out your preacher with the Bible. Do not believe me or any other man. Read and learn what the Bible documents, C&V, for yourself.”
‘‘পৃথিবী নামক গ্রহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নাস্তিক প্রজনক স্বয়ং বাইবেল। আপনি যদি সুস্থ মস্তিষ্ক, যৌক্তিক ও দায়িত্বশীল মানুষ হন এবং এখানে উদ্ধৃত বাইবেলের বক্তব্যগুলো আপনার নিজের বাইবেলে দেখে নিশ্চিত হয়ে নেন তবে হয়ত আপনার বাইবেলটাই আপনাকে নাস্তিক বানিয়ে ফেলবে। আপনি নিজেকেই প্রশ্ন করুন, অধ্যায় ও শ্লোক নির্ধারিত এ কথাগুলো যে ঈশ্বরের কথা প্রমাণ করছে সে ঈশ্বরকে আপনি কিভাবে বিশ্বাস করবেন, সমর্থন করবেন, প্রচার করবেন এবং অর্থায়ন করবেন?
অধ্যায় ও শ্লোক নির্ধারিত উদ্ধৃতিসহ বাইবেলীয় বিতর্কে অনেক সময় বিশ্বাসী ব্যক্তি বলেন, বাইবেল কি বলে সে বিষয়ে আমি আমার ধর্মপ্রচারক বা পাদরিকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিব। আমার পরামর্শ, আপনি প্রচারককে দিয়ে বাইবেল যাচাই করবেন না। আমার পরামর্শ যে, আপনি বাইবেল দিয়ে প্রচারককে যাচাই করুন। আপনি আমাকে বা অন্য কোনো মানুষকে বিশ্বাস করবেন না। আপনি নিজেই পড়ুন ও শিখুন, অধ্যায় ও শ্লোক নির্ধারিত বক্তব্যগুলো দ্বারা বাইবেল কি প্রমাণ করছে।’’[2]
বাইবেলীয় অশোভনীয়তা বিষয়ক আলোচনা আমরা তিনটা অধ্যায়ে বিভক্ত করেছি: (১) ঈশ্বর ও নবীগণ (২) যীশু ও প্রেরিতগণ (৩) অযৌক্তিকতা ও অশালীনতা। এ অধ্যায়ে আমরা ঈশ্বর ও নবীগণ প্রসঙ্গ পর্যালোচনা করছি।
৬. ১. মহান স্রষ্টা বিষয়ক অশোভনীয়তা
সকল ধর্মের মূল বিষয় মহান স্রষ্টার সাথে তাঁর সৃষ্টির গভীরতম ভালবাসার সম্পর্ক তৈরি করা। বিশ্বাস ও ইবাদতের মাধ্যমে এ ভালবাসা গভীর থেকে গভীরতম হয়। আর এজন্য সকল ধর্মগ্রন্থে মহান স্রষ্টার মহত্ত্ব, মর্যাদা, করুণা, সেণহ, ক্ষমা, উদারতা ও তাঁর মহান গুণাবলি বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। যেন এ সকল বিষয় পাঠ ও অনুধাবনের মাধ্যমে ধার্মিকের বিশ্বাস ও ভালবাসা গভীর হয়। বাইবেলেও মহান স্রষ্টার গুণাবলি, মর্যাদা, প্রেম, উদারতা ইত্যাদি বিষয়ে অনেক সুন্দর কথা বিদ্যমান। কিন্তু এগুলোর পাশাপাশি মহান স্রষ্টার বিষয়ে অনেক অশোভন, অশালীন ও বিবেক বিরোধী বক্তব্য বিদ্যমান। এ সকল অশোভন বক্তব্য পাঠককে ক্ষুব্ধ ও অবিশ্বাসী করে তোলে।
এ প্রসঙ্গে liberalslikechrist.org ওয়েবসাইটের একটা প্রবন্ধের শিরোনাম ‘খ্রিষ্টানরা কিভাবে এ ঈশ্বরকে ভালবাসে?’ (How can Christians love this god)? ‘আপনার ঈশ্বর কি আপনার ইবাদতের যোগ্য’ (Does your God deserve your worship)?[3] এছাড়া আগ্রহী পাঠক ইন্টারনেটে নিম্নের পৃষ্ঠাগুলো দেখতে পারেন:
http://www.slideshare.net/dralamin/vulgarities-in-the-bible-proves-its-distortion.
http://callingchristians.com/2011/12/23/29-sexually-explicit-profane-and-dirty-stories-and-verses-in-the-bible/
ঈশ্বর বিষয়ে বাইবেলের মধ্যে বিদ্যমান অশোভন তথ্যের আধিক্যের কারণে বাইবেল সমালোচক গ্যারি ডেভানি একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন যে, বাইবেলের ঈশ্বর কোনো ভাল কাজ করেছেন বলে কেউ প্রমাণ করতে পারবে না। তিনি লেখেছেন:
“The DeVaney Challenge. Other than the myth of creation, what ‘good’ did the Biblical God do for someone without hurting someone else? Get out a notepad and see if you can put down 5 good things that the Biblical God did, C&V, for people without hurting some one else. Bet you can't. If that be the case, how do you claim the Biblical God to be a ‘good’ God?”
‘‘ডেভানির চ্যালেঞ্জ। সৃষ্টির কাহিনী ছাড়া বাইবেলীয় ঈশ্বর আর কী ভাল কাজ করেছেন? অন্য কারো ক্ষতি না করে কারো জন্য তিনি কী ভাল কাজ করেছেন? একটা নোটপ্যাড হাতে নিন এবং নিজেই চেষ্টা করে দেখুন! বাইবেলীয় ঈশ্বর কোনো মানুষের ক্ষতি না করে অন্য মানুষদের জন্য কোনো ভাল কাজ করেছেন বলে আপনি বাইবেলের অধ্যায় ও শ্লোক নির্ধারণ করে ৫টা ঘটনা প্রমাণ করুন। আমি বাজি ধরে বলছি, আপনি পারবেন না। এটাই যদি হয় বাস্তবতা, তবে আপনি কিভাবে দাবি করবেন যে, বাইবেলীয় ঈশ্বর একজন ‘ভাল’ ঈশ্বর?’’[4]
এক ব্যক্তি যীশুকে ‘সৎ গুরু’/ ওস্তাদ (Good Master) বলে সম্বোধন করে। যীশু তাকে বলেন: ‘‘তুমি আমাকে ‘ভাল’ বা সৎ বলছ কেন? একজন ছাড়া কেউ ভাল নেই; তিনি ঈশ্বর (Why callest thou me good? there is none good but one, that is, God) (মথি ১৯/১৬-১৭ এবং মার্ক ১০/১৬-১৭) যীশুর এ বক্তব্য প্রসঙ্গে ডেভানি বলেন:
“Did Jesus tell the truth? Or, did Jesus lie about Himself not being good? Who do you know, by name, did the Biblical God prove to be good for? Other than the myth of creation, can you provide an evidence list whereby the Old Testament Biblical God did something good for someone without hurting someone else? Does your list prove to be short and weak? If so, why is that?”
‘‘যীশু কি এখানে সত্য বললেন? অথবা তিনি ‘ভাল’ নন বলে তিনি কি মিথ্যা বললেন? আপনি কি এমন কারো নাম জানেন যার জন্য বাইবেলের ঈশ্বর ‘ভাল’ বলে প্রমাণিত হয়েছেন? সৃষ্টির কাহিনী ছাড়া আপনি কি কোনো প্রমাণের তালিকা পেশ করতে পারেন? পুরাতন নিয়মের বাইবেলীয় ঈশ্বর কারো ক্ষতি না করে অন্য কারো ভালো করেছেন বলে কোনো তালিকা কি আপনি পেশ করতে পারেন? আপনার তালিকাটা কি সংক্ষিপ্ত ও দুর্বল? যদি তা হয় তবে কেন?’’[5]
এখানে আমরা বাইবেলের মধ্যে বিদ্যমান মহান স্রষ্টা বিষয়ক কিছু অশোভন বিষয় উল্লেখ করছি:
[2] http://www.thegodmurders.com/id58.html
[3] http://liberalslikechrist.org/LLC_MasterMenu.php
[4] http://www.thegodmurders.com/id58.html
[5] Did Jesus Christ Lie? http://www.thegodmurders.com/id188.html
বাইবেলে বিভিন্ন স্থানে বলা হয়েছে যে, ঈশ্বর পিতার অপরাধে সন্তানদেরকে শাস্তি দেন এবং পুত্রের অপরাধে পিতাকে হত্যা করেন। (যাত্রাপুস্তক ৩৪/৭; দ্বিতীয় বিবরণ ২৪/১৬; ২ শমূয়েল ১২/১১-১২ যিশাইয় ১৪/২১)। এমনকি পাপীর অপরাধে তার তৃতীয় ও চতুর্থ পুরুষ পর্যন্ত বংশধরদের শাস্তি দেন। (গণনাপুস্তক ১৪/১৮)।
আমেরিকান সমাজবিদ ও বাইবেল সমালোচক স্কট বিডস্ট্রাপ লেখেছেন, খ্রিষ্টান প্রচারকরা ব্যাখ্যা দেন যে, ঈশ্বর একের পাপে অন্যের শাস্তি দেন না। তবে পিতার অন্যায়ের কারণে অনেক সময় সন্তানরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। যেমন পিতা যদি তার সকল সম্পত্তি বিনষ্ট করেন তবে সন্তানরা পিতার এ অন্যায়ের কষ্ট ভোগ করেন। বিডস্ট্রাপ বলেন, বাইবেলের ঈশ্বর এর ঠিক বিপরীত কথাই বলেছেন। ঈশ্বর বলেননি যে, পিতার দুষ্কর্মের কারণে সন্তানরা কষ্ট পায়। বরং ঈশ্বর অত্যন্ত স্পষ্ট ও ব্যাখ্যাতীতভাবে বলেছেন যে, তিনি নিজেই পিতার অপরাধের শাস্তি সন্তানদেরকে প্রদান করেন। সর্বোপরি, ঈশ্বরের ন্যায়পরায়ণতা, মহানুভবতা ও সর্ব-কল্যাণকামিতার যে দাবি প্রচারকরা করেন তার সাথে তাদের এ কথা সাংঘর্ষিক।[1]
অন্যত্র বলা হয়েছে যে, ঈশ্বর অপরাধীকে শাস্তি না দিয়ে অপরাধীর অপরাধে তার অধস্তন ১১ পুরুষ পর্যন্ত শাস্তি দান করেন। জারজ ব্যক্তি নিজে অপরাধী নয়; বরং তার পিতামাতা অপরাধী। কিন্তু বাইবেলের বর্ণনায় ঈশ্বর ব্যভিচারীকে শাস্তি দেন না। ঈশ্বরের অনেক ভাববাদী, ঈশ্বরের পুত্র, প্রথম পুত্র এবং ঈশ্বরের ‘জাত’ পুত্র ব্যভিচার ও ধর্ষণ করলেও ঈশ্বর তাঁদের কোনো শাস্তি দেননি। কিন্তু নিরপরাধ জারজ ব্যক্তি এবং দশম পুরুষ পর্যন্ত তার অধস্তন বংশধর সদাপ্রভুর বা মাবুদের সমাজে প্রবেশ করতে পারবে না বলে বিধান দিয়েছেন। (দ্বিতীয় বিবরণ ২৩/২)।
একজন গবেষক এর দু’টা চিত্র তুলে ধরেছেন। একজন জারজ সন্তানের দশম প্রজন্ম পর্যন্ত কয়েক হাজার বংশধর জন্মলাভ করে। আমরা দেখেছি যে, বাইবেলের বর্ণনায় মাত্র চার প্রজন্মে বনি-ইসরাইলদের সন্তানদের সংখ্যা ৭০ ব্যক্তি থেকে ২৫ লক্ষ হয়। তাহলে দশ প্রজন্মে এক কোটি হওয়া মোটেও অসম্ভব নয়। এভাবে আমরা দেখছি যে, বাইবেলের এ বিধান অনুসারে কোনোরূপ অপরাধ ছাড়াই লক্ষ লক্ষ মানব সন্তান মাবুদের সমাজে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত হল।
এর বিপরীতে কোনো মানুষ, এমনকি কোনো পোপ কি নিশ্চিত হতে পারেন যে, দশম পুরুষ পর্যন্ত তার কোনো পূর্বপুরুষ অবৈধ সম্পর্কের ফসল ছিলেন না? ব্যক্তির নিজের পিতামাতা (২ জন), প্রত্যেকের পিতামাতা (৪ জন).... প্রত্যেকের পিতামাতা (৮ জন) ... এভাবে দশম পুরুষ পর্যন্ত ১০২২ জন পূর্বপুরুষ। কোনো ব্যক্তির দশম পূর্বপুরুষ পর্যন্ত ১০২২ জন মানুষের মধ্যে একজনও যদি অবৈধ সম্পর্কের ফসল হন তবে তিনি মাবুদের সমাজে প্রবেশ করতে পারবেন না।
শুধু দশম পুরুষ পর্যন্তই নয়, বাইবেলের বর্ণনায় ঈশ্বর পিতার অপরাধে লক্ষকোটি পুরুষ পর্যন্ত সকল সন্তানের শাস্তির ব্যবস্থা করেন। আমরা দেখেছি, নতুন নিয়মের বিভিন্ন বক্তব্য অনুসারে ঈশ্বর আদমের পাপের কারণে কিয়ামত পর্যন্ত সকল আদম-সন্তানকেই পাপী গণ্য করেন। (রোমীয় ৫/১২, ১৭-১৯, ১ করিন্থীয় ১৫/২২)।
সম্মানিত পাঠক, অপরাধীর বংশধরই শুধু নয়; ঈশ্বর অপরাধীর কারণে সম্পূর্ণ নিরপরাধ অনেক মানুষকে শাস্তি দেন (আদিপুস্তক ৩/১৪-১৬, আদিপুস্তক ২০/১৮)। তিনি একের অপরাধে অন্যকে বিনষ্ট করেন (যিহশূয় ২২/২০; ২ শমূয়েল ১২/১৪)
সাধারণ বিবেকে একের অপরাধে অন্যের, পিতার অপরাধে পুত্রের বা পরবর্তী প্রজন্মগুলোর শাস্তি প্রদান নিশ্চিত জুলুম ও অন্যায়। মহান সর্বশক্তিমান সর্বজ্ঞ প্রেমময় স্রষ্টা এরূপ করবেন বলে ধারণা অত্যন্ত আপত্তিকর বলেই প্রতীয়মান।
আমেরিকান বাইবেল সমালোচক গ্যারি ডেভানি (Gary DeVaney) ‘ঈশ্বরের নিখুঁত বিধান’ (God's Perfect Laws) শিরোনামে এক অনলাইন আর্টিকেলে এ প্রসঙ্গে লেখেছেন[1]:
বাইবেলের ঈশ্বর কি ভাল ও নিখুঁত? ঈশ্বর কি মানবজাতিকে পালনের জন্য নিখুঁত বিধান দিয়েছেন? অপরিবর্তনশীল ও কর্তৃত্বময় ঈশ্বর কি তাঁর নিজের বিধানে স্থির থাকেন? আসুন আমরা বাইবেল দ্বারা প্রমাণিত একটা বিধান পরীক্ষা করি:
দ্বিতীয় বিবরণ ২৪/১৬: ‘‘ছেলেমেয়েদের গুনাহের জন্য বাবাকে কিংবা বাবার গুনাহের জন্য ছেলেমেয়েদেরকে হত্যা করা চলবে না। প্রত্যেককেই তার নিজের গুনাহের জন্য মরতে হবে।’’ আমার মূল্যবোধ ব্যবস্থায় এ বিধানটা ন্যায়নিষ্ঠ ও সুন্দর বলে প্রতীয়মান। আপনি কী মনে করেন?
যিরমিয়/ ইয়ারমিয়া ৩১/৩০: ‘‘প্রত্যেকে নিজের গুনাহের জন্যই মরবে।’’ এ বিধানটাও ন্যায়নিষ্ঠ ও সুন্দর। যিহিষ্কেল/ ইহিস্কেল ১৮/২০: ‘‘ যে গুনাহ করবে সে-ই মরবে। ছেলে বাবার দোষের জন্য শাস্তি পাবে না আর বাবাও ছেলের দোষের জন্য শাস্তি পাবে না।’’ ঈশ্বর, খুব ভাল কথা বললেন আপনি। আমি স্বীকার করছি যে, এ বিধানগুলো ন্যায়নিষ্ঠ ও সুন্দর। কিন্তু বাইবেলীয় ঈশ্বর কি সত্যই ন্যায়নিষ্ঠ ও সুন্দর বলে প্রমাণিত? ঈশ্বর কি সত্যই নিজের এ প্রমাণিত বিধানগুলোকে সম্মান করেছেন এবং এগুলোতে স্থির থেকেছেন? লক্ষ্য করুন:
যাত্রাপুস্তক ২০/৫, গণনাপুস্তক ১৪/১৮ এবং দ্বিতীয় বিবরণ ৫/৯ সবগুলোতেই ঈশ্বর বলছেন: ‘‘আমি একজন ঈর্ষান্বিত ঈশ্বর (jealous God, কেরি: স্বগৌরব রক্ষণে উদযোগী ঈশ্বর) আমি পিতৃগণের অপরাধের প্রতিফল সন্তানদিগের উপর বর্তাই, যাহারা আমাকে দ্বেষ করে, তাহাদের তৃতীয় চতুর্থ পুরুষ পর্যন্ত বর্তাই।’’ যাত্রাপুস্তক ৩৪/৭: ‘‘তিনি পিতার অন্যায়ের শাস্তি বংশের তিন-চার পুরুষ পর্যন্ত দিয়ে থাকেন।’’
বাইবেল কী বলল? বাইবেলের এ বিরক্তিকর বক্তব্যটার চেয়ে অধিক পরিষ্কার ও সহজবোধ্য কথা তেমন হয় না। আর ভাল ও মন্দের বিষয়ে আমার জ্ঞান বলে যে, এ বিধানটা ন্যায়নিষ্ঠ ও সুন্দর নয়। পাঠক, আপনার কি সাহস আছে এ বিধানটাকে ন্যায়নিষ্ঠ এবং সুন্দর বলে দাবি করার? .....
এরপর গ্যারি একের অপরাধে অন্যের শাস্তির কিছু নমুনা উল্লেখ করেছেন।
ঈশ্বর নোহের ঘটনায় কতিপয় মানুষের পাপের অপরাধে বিশ্বের সকল সৃষ্টিকে হত্যা করলেন। (আদিপুস্তক ৭/২১-২৩) আর এ মহা হত্যাকাণ্ড একেবারেই অকারণ ও নিষ্ফল ছিল। কারণ এরপরেও মানুষ একইরূপ পাপাচারী রয়ে গেল।
মোশির ভাই হারোণ বনি-ইসরাইলের জন্য সোনা দিয়ে একটা বাছুর বানিয়ে পূজার ব্যবস্থা করেন। আর এ অপরাধে ঈশ্বর তাঁর নিজের নির্বাচিত প্রজা বনি-ইসরাইলের ৩,০০০ মানুষকে হত্যার ব্যবস্থা করেন (যাত্রাপুস্তক ৩২/২৭-২৮)। এরপর ঈশ্বর বাছুর নির্মাণকারী হারোণকে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে হারোণ ও তাঁর বংশধরকে ঈশ্বরের মহাযাজক বা মহা ইমাম বানান (যাত্রাপুস্তক ৪০/১৩-১৫)। হারোণ মূর্তিটা না বানালে অসহায় নিহত মানুষগুলো মূর্তিটির পূজা করার সুযোগই পেত না। অথচ অসহায় মানুষগুলোকে হত্যা করা হল এবং মূল অপরাধীকে পদোন্নতি দেওয়া হল! আপনি কিভাবে বাইবেলীয় ঈশ্বরের এ কর্মটাকে ন্যায়নিষ্ঠ ও সুন্দর বলে গণ্য করবেন?
ঈশ্বর ফিরাউনের অপরাধে মিসরের সকল খাল, বিল, জলাশয় ও নদীর পানি রক্ত বানান এবং সকল মাছ হত্যা করেন। (যাত্রাপুস্তক/ হিজরত ৭/১৯-২১)। ঈশ্বর ব্যাঙ দিয়ে মিসর দেশ ভরে দিলেন এবং এরপর অগণিত ব্যাঙ হত্যা করলেন (যাত্রাপুস্তক/হিজরত ৮/৬-১৪)। এরপর ঈশ্বর ফেরাউন ও তার অনুসারীদের অপরাধে মিসরীয়দের সকল পশু হত্যা করলেন: ‘‘মিসরীয়দের সব পশু মরে গেল’’ (যাত্রাপুস্তক/ হিজরত ৯/৬)। এরপর ঈশ্বর মিসরীয় সকল মানুষ ও পশুর শরীরে ফোড়া ও ঘা দিলেন। (যাত্রাপুস্তক ৯/১০)। (পাঠক লক্ষ্য করুন, কয়েক দিন আগেই ঈশ্বর মিসরীয়দের সকল পশু মেরে ফেলেছেন। কয়েকদিন পরেই আবার সকল পশুর শরীরে ফোড়া ও ঘা দিলেন!) এরপর ঈশ্বর ভয়ঙ্কর শিলাবৃষ্টির মাধ্যমে মাঠে অবস্থানরত সকল মানুষ ও পশুকে হত্যা করলেন। শুধু যে সকল মিসরীয় তাদের পশুপাল ঘরে এনেছিল তারা বেঁচে গেল। (হিজরত/ যাত্রাপুস্তক ৯/১৮-২৬) (পাঠক আবারো দেখুন! মাত্র কয়েকদিন আগেই কিন্তু সব পশু মরে গিয়েছিল!)
এরপর ঈশ্বর ফিরাউনের অপরাধে মিসরের সকল মানুষের সকল প্রথম ছেলেকে হত্যা করেন। উপরন্তু মিসরীয়দের সকল প্রাণির সকল প্রথম পুরুষ বাচ্চা হত্যা করেন (যদিও মাত্র কয়েকদিন আগেই মিসরীয়দের সব পশু মরে গিয়েছিল!) যাত্রা/হিজরত ১১/১-৫, ২৯; ১২/১২, ১২/২৯-৩০)। ‘‘মূসা ফেরাউনকে বললেন ... মিসর দেশের সব পরিবারের প্রথম ছেলে মারা যাবে। সিংহাসনের অধিকারী ফেরাউনের প্রথম ছেলে থেকে শুরু করে জাঁতা ঘুরানো বাঁদীর প্রথম ছেলে পর্যন্ত কেউ বাদ যাবে না। এছাড়া পশুদেরও প্রথম পুরুষ বাচ্চা মারা যাবে।’’ (যাত্রাপুস্তক/ হিজরত ১১/৪-৫; ১২/১২, ১২/২৯-৩০, মো.-০৬)
বাইবেল বলছে, ঈশ্বর নিজেই পূর্বপরিকল্পিতভাবে ফিরাউনের মনকে শক্ত করে দিয়ে তাকে অবাধ্য বানান, যেন তিনি মিসরীয়দের এভাবে হত্যা করার সুযোগ পান। (যাত্রাপুস্তক ৭/৩-৫, ১৩, ২২-২৩, ৮/১৫, ১৯, ৯/১২, ৩৫, ১০/১-২, ২০, ১০/২৭) ফেরাউনের এ বাধ্যতামূলক অবাধ্যতার জন্য মিসরীয়দের প্রথম ছেলে ও তাদের মায়েদের দায়ভার কী? ফেরাউনকে অবাধ্য বানিয়ে কুদরত দেখানোর ঈশ্বরীয় পরিকল্পনার কারণে এ সকল নিরপরাধ শিশু ও মাতাদের শাস্তি ভোগ করতে হবে কেন? মিসরীয় প্রথম ছেলেরা ও তাদের মায়েরা ঈশ্বরের প্রতি কী মহাপরাধ করেছিলেন? আপনি যদি ঈশ্বর হতেন তবে কি আপনি মিসরীয়দের সকল প্রথম ছেলে হত্যা করতেন?
ঈশ্বর বিনা অপরাধে ত্রিশ জন মানুষের হত্যার ব্যবস্থা করলেন। শিমশোন বা হযরত শামাউন (Samson) বিবাহের সময় ত্রিশ জন সঙ্গীকে বাজি ধরলেন ত্রিশ সেট পোশাক দেওয়ার জন্য। স্ত্রীর কারণে বাজিতে হেরে গেলেন। ‘‘তখন ঈশ্বরের আত্মা বা মাবুদের রূহ (The Spirit of God) পূর্ণ শক্তিতে শামাউনের উপর আসলেন। তিনি অস্কিলোনে গিয়ে সেখানকার ত্রিশজন লোককে হত্যা করে তাদের সব কিছু লুটে নিলেন এবং তাদের কাপড়চোপড় নিয়ে যারা ধাঁধার জবাব দিয়েছিল তাদের দিলেন।’’ (বিচারকর্তৃগণ/ কাজীগণ ১৪/১১-২০, বা-২০০০, মো.-০৬)
ঈশ্বরের আত্মা বা পবিত্র আত্মা তাহলে কী করলেন? ঈশ্বরের প্রিয় ভাববাদী ও বীর হযরত শমউনকে দিয়ে ত্রিশ জন নিরপরাধ নিরস্ত্র মানুষকে খুন করিয়ে, তাদের সর্বস্ব লুট করলেন, হযরত শামউনের জুয়াড়ি বাজির ঋণ শোধ করার জন্য!
বনি-ইসরাইলের একজন মহাযাজক এলি (Eli)। কিতাবুল মোকাদ্দসে তার নাম ‘ইমাম আলী’। ঈশ্বর তাকে চিরস্থায়ী যাজকত্ব প্রদান করেন: ‘‘আমি অবশ্য বলেছিলাম যে, তোমার ও তোমার পূর্বপুরুষদের বংশের লোকেরা চিরকাল আমার এবাদত-কাজ করবে’’ (১ শামুয়েল ২/৩০)। কিন্তু এলির পুত্ররা যাজক বা ইমাম হয়ে ইবাদত করতে আসা মহিলাদের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। যাজক এলি বা ইমাম আলী তাদের কিছু তিরস্কার করলেও তাদের কোনো শাস্তি দেন না। এজন্য ঈশ্বর বলেন: ‘‘কেন তুমি আমার চেয়ে তোমার ছেলেদের বড় করে দেখছ?’’ (১ শামুয়েল ২/২৯)। এলির এ অপরাধে ঈশ্বর তাঁর সিদ্ধান্ত বাতিল করে যাজকত্বের পদ তার থেকে কেড়ে নেন। উপরন্তু তিনি এলির শাস্তির ব্যবস্থা করেন। তবে তিনি এলিকে কোনো শাস্তি দেননি। তাঁর অপরাধী পুত্রদ্বয়কে এবং তাঁর নিরাপরাধ বংশধরদেরকে শাস্তি দিয়েছেন: ‘‘তোমার বংশে একটি লোকও বুড়ো বয়স পর্যন্ত বাঁচবে না... তোমার বংশের সমস্ত লোক যুবা বয়সেই মারা যাবে। তোমার দুই ছেলে হফনি ও পীনহস একই দিনে মারা যাবে....। তোমার বংশের যারা বেঁচে থাকবে তারা এক টুকরা রূপা ও একটি রুটির জন্য তার কাছে এসে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সালাম করবে...।’’ (১ শামুয়েল ২/৩১-৩৬, মো.-০৬)
এলির দু’পুত্রের একত্রে হত্যার কথা ঈশ্বর বললেন। তবে তার সাথে ত্রিশ হাজার মানুষেরও মৃত্যুর ব্যবস্থা তিনি করেন: ‘‘তখন ফিলিস্তিনীরা যুদ্ধ করল আর বনি- ইসরাইলরা হেরে গিয়ে নিজের নিজের বাড়িতে পালিয়ে গেল। বনি-ইসরাইলদের অনেককে হত্যা করা হল; তাদের ত্রিশ হাজার পদাতিক সৈন্য মারা পড়ল। ... আলীর দুই ছেলে হফ্নি আর পীনহস মারা পড়ল। (১ শামুয়েল ৪/১০-১১, মো.-০৬)
ঈশ্বরের নির্বাচিত প্রিয় সন্তান ও প্রজা বনি-ইসরাইল জাতি বাল দেবতার পূজা শুরু করলে ঈশ্বর পূজায় অংশগ্রহণকারী হত্যার নির্দেশ ছাড়াও মহামারি দিয়ে ঢালাওভাবে ২৪,০০০ প্রিয় প্রজাকে হত্যা করেন। (গণনা/ শুমারী ২৫/১-৯)
গণনাপুস্তক/ শুমারী ২৫/১-৩ ও ১৭-১৮: ‘‘শিটীম শহরের কাছে থাকবার সময় বনি-ইসরাইলরা মোয়াবীয় স্ত্রীলোকদের সংগে জেনা শুরু করেছিল। এই সব স্ত্রীলোকেরা তাদের দেব-দেবীর উদ্দেশে কোরবানীর উৎসবে বনি-ইসরাইলদের দাওয়াত করেছিল, আর বনি-ইসরাইলরাও তাদের সংগে খাওয়া-দাওয়া করে সেই সমস্ত দেবতাদের পূজা করেছিল। এভাবে বনি-ইসরাইলরা বিয়োর পাহাড়ের বাল-দেবতার পূজায় যোগ দিতে লাগল। তাতে তাদের উপর মাবুদের গজবের আগুন জ্বলে উঠল.... পরে মাবুদ মূসাকে বললেন, ‘মাদিয়ানীদেরকে তোমরা শত্রু হিসেবে দেখবে এবং তাদের হত্যা করবে, কারণ পিয়োরের দেবতার পূজা এবং কসবীর ব্যাপার নিয়ে কৌশল খাটিয়ে তোমাদের ভুল পথে নিয়ে গিয়ে তারা তোমাদের শত্রু হয়েছে।’’ (মো.-০৬)
ইহুদিরা জেনা করল, দাওয়াত কবুল করে স্বেচ্ছায় পূজায় অংশ নিল, অথচ এ জন্য ঢালাও হত্যার নির্দেশ দিলেন মাদিয়ানীদের! মাদিয়ানীদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি অপরাধী হলে তার শাস্তি হতে পারে। কিন্তু কিছু লোকের অপরাধের জন্য পুরো জাতিকে চিরস্থায়ী শত্রু ঘোষণা এবং নির্বিচারে হত্যার নির্দেশ!