৪. ২. ১৮. ধর্মধাম ধ্বংসের পরেই যীশুর পুনরাগমন

ধর্মধাম (বায়তুল মোকাদ্দস?!) ধ্বংসের পরপরই যীশুর পুনরাগমন ও কিয়ামত সংঘটনের সকল ভবিষ্যদ্বাণীই ভুল। এখানে এ জাতীয় কয়েকটা বক্তব্য উল্লেখ করছি:

(ক) মথির ২৪ অধ্যায়ের শুরুতে ধর্মধাম বা শলোমনের মন্দির (বায়তুল মোকাদ্দস?!) ধ্বংসের বিষয়ে উপরের ভবিষ্যদ্বাণী করার পরে যীশু তাঁর শিষ্যদের নিয়ে জৈতুন পর্বতের (the mount of Olives) উপরে বসেন। তখন শিষ্যরা তাঁকে ধর্মধাম ধ্বংস কখন হবে সে বিষয়ে প্রশ্ন করে বলেন: ‘‘আমাদিগকে বলুন দেখি, এই সকল ঘটনা কখন হইবে? আর আপনার আগমনের এবং যুগান্তরের চিহ্ন কি?’’ (কি. মো.-০৬: ‘‘আমাদের বলুন, কখন এই সব হবে এবং কি রকম চিহ্ন দ্বারা বুঝা যাবে যে, আপনার আসবার সময় ও কেয়ামতের সময় হয়েছে?’’) (মথি ২৪/৩)

তখন যীশু ধর্মধাম (বায়তুল মোকাদ্দস?!) ধ্বংস বর্ণনা করে বলেন: ‘‘আর সেই সময়ের কষ্টের পরেই (তাৎক্ষণিক পরেই: Immediately after) সূর্য অন্ধকার হবে, চন্দ্র জ্যোৎস্না দেবে না, আসমান থেকে তারাগুলোর পতন হবে ও আসমানের পরাক্রমগুলো বিচলিত হবে। আর তখন ইবনুল ইনসানের (কেরি: মনুষ্য পুত্রের) চিহ্ন আসমানে দেখা যাবে, আর তখন দুনিয়ার সমস্ত গোষ্ঠী মাতম করবে, এবং ইবনুল ইনসানকে আসমানের মেঘরথে পরাক্রম ও মহা প্রতাপে আসতে দেখবে। আর তিনি মহা তূরীধ্বনি সহকারে নিজের ফেরেশতাদেরকে প্রেরণ করবেন; তাঁরা আসমানের এক সীমা থেকে অন্য সীমা পর্যন্ত চার দিক থেকে তাঁর মনোনীতদিগকে একত্র করবেন।....  আমি তোমাদেরকে সত্যি বলছি, এই কালের (This generation এই প্রজন্মের) লোকদের লোপ হইবে না, যে পর্যন্ত না এ সমস্ত সিদ্ধ হয় (fulfilled)। আসমানের ও দুনিয়ার লোপ হবে, কিন্তু আমার কথার লোপ কখনও হবে না।’’ (মথি ২৪/২৯-৩৫, মো.-১৩)

(খ) একই ঘটনার বর্ণনা করেছেন মার্ক ১৩ অধ্যায়ে। ভাষা ও বক্তব্য একই। এখানেও যীশু জেরুজালেম ও ধর্মধামের বিনাশ ও কিয়ামত এবং তাঁর নিজের স্বর্গ থেকে অবতরণের কথা উল্লেখ করে বলেন: ‘‘আমি তোমাদেরকে সত্যি বলছি, যে পর্যন্ত এ সব পূর্ণ না হবে, সেই পর্যন্ত এই কালের (This generation এই প্রজন্মের) লোকদের লোপ হবে না ...।’’ (মার্ক ১৩/৩০-৩১)

(গ) একই ঘটনা বর্ণনা করেছেন লূক ২১ অধ্যায়ে। এখানেও যীশু জেরুজালেমের বিনাশ, কিয়ামতের পূর্বাভাস ও নিজের পুনরাগমনের কথা উল্লেখ করে বলেন: ‘‘আমি তোমাদেরকে সত্যি বলছি, যে পর্যন্ত সমস্ত সিদ্ধ না হবে, সেই পর্যন্ত এই কালের (প্রজন্মের) লোকদের লোপ হবে না।’’ (লূক ২১/৩২, মো.-১৩)

উপরের বক্তব্যগুলোতে যীশু দুটো বিষয় নিশ্চিত করেছেন: (১) ধর্মধাম ধ্বংসের ‘তাৎক্ষণিক পরেই (Immediately after) কিয়ামত হবে এবং (২) কিয়ামত হওয়ার আগে তার কালের বা তার প্রজন্মের মানুষেরা মরবে না। দু’টা বিষয়ই সুনিশ্চিতভাবে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। যীশুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল কারো জন্য এ কথাগুলো যীশুর কথা বলে গ্রহণ করা খুবই কঠিন কাজ। এর চেয়ে এগুলোকে ইঞ্জিল লেখকদের বা পরবর্তীদের জালিয়াতি ও বানোয়াট কথা বলে বিশ্বাস করা অনেক সহজ।

এ কথাগুলো সত্য হলে ধর্মধাম ও জেরুজালেমের বিধ্বংস হওয়ার পরপরই, কোনোরূপ বিরতি ছাড়াই, যীশুর পুনরাগমন ও অবতরণ ঘটতে হবে। এছাড়া এ বক্তব্য থেকে এ কথাও জানা যায় যে, ধর্মধামের বিধ্বংস হওয়া, যীশুর অবতরণ ও যুগের সমাপ্তি বা কিয়ামত তিনটা বিষয়ই যীশুর সমসাময়িক মানুষেরা স্বচক্ষে দেখবেন। এ তিনটা বিষয় সংঘটিত হওয়ার আগে সে কালের বা সে প্রজন্মের মানুষদের লোপ হবে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইঞ্জিল লেখকরা যীশুর বাক্য নামে যা বলেছেন তা লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। সে প্রজন্মের মানুষগুলো সকলেই প্রায় ২০০০ বছর আগে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু কিয়ামত বা যীশুর পুনরাগমন কিছুই ঘটেনি। ইঞ্জিল লেখকরা ‘সত্যি বলছি’ বলে যে কথা যীশুর নামে লেখেছেন সে কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। সে কালের লোকেরা লুপ্ত হয়েছে কিন্তু যীশুর পুনরাগমন ঘটেনি।

যীশুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল গবেষকরা মনে করেন যে, যীশু এ সকল কথা বলেননি। তিনি হয়ত এ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলেছিলেন, কিন্তু শিষ্যরা ও পরবর্তী ইঞ্জিল লেখকরা তার অর্থ না বুঝে সংযোজন, বিয়োজন বা সম্পাদনা করে তাঁর নামে এমন কথা বলেছেন যা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। অথবা ৭০ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেমের পতন ও ধর্মধামের ধ্বংসের পরে খ্রিষ্টান প্রচারকরা কিয়ামত সন্নিকটে বলে মানুষদেরকে দ্রুত ধর্মান্তরিত করার জন্য এ সকল কথা যীশুর নামে বানিয়ে প্রচার করেছেন।

এ কথাগুলো যে খুবই বাজার পেয়েছিল তার প্রমাণ তিন ইঞ্জিল লেখক হুবহু এ কথাগুলো লেখেছেন। যীশুর এ বক্তব্য কি জৈতুন পর্বতে না ধর্মধামের মধ্যে ছিল সে বিষয়ে তাঁরা ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। লূকের বর্ণনায় যীশু ধর্মধামের মধ্যেই এ সকল কথা বলেন। পক্ষান্তরে মথি ও মার্কের বর্ণনায় তিনি ধর্মধাম থেকে বেরিয়ে জৈতুন পর্বতের উপরে এ সকল কথা বলেন। তবে মূল বিষয়গুলো সকলেই একইভাবে লেখেছেন।