মথি লেখেছেন (২৪/১-২, ৩৫): ‘‘পরে যীশু ধর্মধাম হইতে বাহির হইয়া গমন করিতেছেন, এমন সময়ে তাঁহার শিষ্যেরা তাঁহাকে ধর্মধামের গাঁথনি সকল দেখাইবার জন্য নিকটে আসিলেন। কিন্তু তিনি উত্তর করিয়া তাঁহাদিগকে কহিলেন, তোমরা কি এই সকল দেখিতেছ না? আমি তোমাদিগকে সত্য কহিতেছি, এই স্থানের একখানি পাথর অন্য পাথরের উপরে থাকিবে না, সমস্তই ভূমিসাৎ হইবে (There shall not be left here one stone upon another, that shall not be thrown down)... আকাশ ও পৃথিবীর লোপ হইবে, কিন্তু আমার বাক্যের লোপ কখনও হইবে না।’’
কি. মো.-২০০৬: ‘‘ঈসা বায়তুল মোকাদ্দস[1] থেকে বের হয়ে চলে যাচ্ছিলেন, এমন সময় তাঁর সাহাবীরা তাঁকে বায়তুল মোকাদ্দসের দালানগুলো দেখাবার জন্য তাঁর কাছে আসলেন। তখন ঈসা তাঁদের বললেন, ‘তোমরা তো এই সব দেখছ, কিন্তু আমি তোমাদের সত্যিই বলছি, এখানে একটা পাথরের উপর আর একটা পাথর থাকবে না; সমস্তই ভেংগে ফেলা হবে।... আসমান ও জমীন শেষ হবে; কিন্তু আমার কথা চিরদিন থাকবে।’’ (একই বক্তব্য দেখুন: মার্ক ১৩/১-২, ৩১ ও লূক ২১/৫-৬, ৩৩)
খ্রিষ্টানরা এটাকে যীশুর অন্যতম সফল ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে গণ্য করেন। তাঁরা দাবি করেন যে, যীশুর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে ধর্মধাম বা বায়তুল মোকাদ্দস ধ্বংস হয়েছে এবং আসমান-জমীন শেষ হলেও কখনোই সেখানে কোনো দালান হবে না।
৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রা্ট কর্তৃক ধর্মধাম ধ্বংসের মাধ্যমে এ ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন শুরু হয়। ভেসপাসিয়ান (Vespasian: ad 9-79) ৬৯ থেকে ৭৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রোমের সম্রাট ছিলেন। তিনি ইহুদিদের বিদ্রোহ দমনের জন্য তার পুত্র টিটাস (Titus)-কে দায়িত্ব প্রদান করেন। টিটাস ৭০ খ্রিষ্টাব্দে ধর্মধাম বা শলোমনের মসজিদ ও জেরুজালেম শহর ধ্বংস করেন। পরবর্তী সময়ে সম্রাট হার্ডিয়ান (Hadrian:117-138) ১৩৪-১৩৫ খ্রিষ্টাব্দে অবশিষ্ট ইহুদিদের বিদ্রোহের মুখে পুনরায় ধর্মধাম ও জেরুজালেম ধ্বংস করেন, ইহুদিদেরকে জেরুজালেম থেকে বিতাড়িত করেন। শুধু বছরে একদিন তাদেরকে ইহুদি ধর্মধাম বা শলোমনের মন্দিরের পশ্চিম দেওয়ালের অবশিষ্ট অংশের নিকট ক্রন্দনের জন্য আগমনের অনুমতি দেন।
এ সবই যীশুর ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন বলে গণ্য করেছেন খ্রিষ্টানরা। তারা আরো দাবি করেছেন যে, যীশুর ভবিষ্যদ্বাণী লঙ্ঘন করে কেউ শলোমনের মন্দির বা মসজিদে আকসা তৈরি করতে চাইলে সে তা পারবে না।
রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন (৩২৩-৩৩৭) খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন এবং একে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা দেন। তার মৃত্যুর পরে প্রায় ২৫ বছর রোমান সাম্রাজ্য অস্থিরতা ও ক্ষমতার কোন্দলের মধ্যে থাকে। এরপর তারই বংশধর জুলিয়ান (Julian the Aopstate) ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি ৩৩১ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। ৩৬১ থেকে ৩৬৩ তিন বছর রাজত্ব করেন। তিনি খ্রিষ্টান ধর্ম ত্যাগ করে পুনরায় প্রাচীন রোমান পৌত্তলিক ধর্ম গ্রহণ করেন এবং রোমান ধর্মের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন এবং প্রাচীন রোমান মন্দিরগুলো পুননির্মাণ করেন।[2]
খ্রিষ্টান ঐতিহাসিক ও প্রচারকরা উল্লেখ করেছেন যে, তিনি যীশু খ্রিষ্টের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করতে জেরুজালেমে ইহুদিদের ধর্মধাম বা শলোমনের মসজিদ পুনর্নিমাণের অনুমতি ও সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। ইহুদিদের ব্যাপক আগ্রহ, প্রচেষ্টা ও সম্রাটের পূর্ণ সহায়তা সত্ত্বেও যীশুর বাক্যের বিরোধিতা সম্ভব হয়নি। ধর্মধামের প্রাচীন ভিত্তি থেকে ভয়ঙ্কর অগ্নিশিখা বের হয়ে রাজমিস্ত্রিদেরকে পুড়িয়ে দেয়। তখন তারা কাজ বন্ধ করে দেয়। এরপর আর কেউ যীশুর কথা প্রত্যাখ্যান করতে সাহস পায়নি, যিনি বলেছেন: ‘আকাশের ও পৃথিবীর লোপ হইবে, কিন্তু আমার বাক্যের লোপ কখনও হইবে না’। এ প্রসঙ্গে ব্রিটানিকার ভাষ্য:
“His project to rebuild the Jewish Temple in Jerusalem ... was dropped when it was reported (as it was on both an earlier and a later occasion) that “balls of fire” had issued from the old foundations and scared away the workmen.” ‘‘তিনি জেরুজালেমের ইহুদি মন্দির পুনর্নিমাণের সিদ্ধান্ত নেন। ... তবে সিদ্ধান্তটা বাতিল করা হয়। কারণ বলা হয় যে, (প্রথম এবং পরবর্তী উভয় বার নির্মাণ প্রচেষ্টার ক্ষেত্রেই) পুরাতন ভিত্তি থেকে আগুনের গোলাগুলো বের হতে থাকে এবং শ্রমিকদেরকে তাড়িয়ে দেয়।’’[3]
নিম্নের বিষয়গুলো প্রমাণ করে যে, যীশুর এ ভবিষ্যদ্বাণী ভুল:
(ক) যীশু বলেছেন যে, ‘‘এই স্থানের একখানি পাথর অন্য পাথরের উপরে থাকিবে না, সমস্তই ভূমিসাৎ হইবে (There shall not be left here one stone upon another, that shall not be thrown down)।’’ কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি যে, সে স্থানের কয়েক হাজার পাথর এখন পর্যন্ত নিজ স্থানে বহাল রয়েছে। ধর্মধাম বা মসজিদে আকসার পশ্চিম প্রাচীরের কিছু অংশ টিটাস ও পরবর্তী রোমন শাসকরা অক্ষত রাখেন। বছরে একদিন ইহুদিদের জন্য এখানে ক্রন্দন ও প্রার্থনার অনুমিত ছিল। একে পশ্চিম প্রাচীর (The Western Wall) বা ক্রন্দনের প্রাচীর (The Wailing Wall) বলা হয়। এনকার্টা লেখেছে: “The Western or Wailing Wall in Jerusalem is a remnant of the great temple built by Herod, king of Judea, in the 1st century bc” ‘‘জেরুজালেমের পশ্চিম প্রাচীর বা ক্রন্দনের প্রাচীর প্রথম শতাব্দীতে যুডিয়া রাজ্যের রাজা হেরোডের বানানো মহা ধর্মধামের অবশিষ্ট অংশ।’’[4]
এনকার্টায় অন্যত্র বলা হয়েছে: “Biblical archaeologists believe that the Western Wall in Jerusalem, also known as the Wailing Wall, is all that remains of the Second Temple, which was destroyed in ad 70.” : বাইবেলীয় প্রত্নতত্ত্ববিদরা বিশ্বাস করেন যে, জেরুজালেমের পশ্চিম প্রাচীর, যা ‘ক্রন্দন প্রাচীর’ হিসেবেও পরিচিত, এটা ব্যাবিলনের নির্বাসন থেকে ফিরে দ্বিতীয়বারে নির্মিত ধর্মধামের অবশিষ্ট অংশ। ধর্মধামটা ৭০ খ্রিষ্টাব্দে ধ্বংস করা হয়।’’[5]
(খ) খ্রিষ্টান ঐতিহাসিক ও ধর্মগুরুরা স্বীকার করেন যে, খলীফা উমার (রা) ধ্বংসকৃত ধর্মধামের ভিত্তির উপরেই নতুনভাবে মাসজিদুল আকসা নির্মাণ করেন। বিগত প্রায় ১৩০০ বছর যাবৎ এগুলোর পাথরগুলো একটার উপর একটা অবস্থান করছে।
(গ) বর্তমানে ইহুদিরা মাসজিদুল আকসা ভেঙ্গে নতুন করে ইহুদি মন্দির তৈরির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন এবং খ্রিষ্টানরা মনপ্রাণ দিয়ে তাতে সাহায্য করছেন। কেউই যীশু খ্রিষ্টের ভবিষ্যদ্বাণী রক্ষার চেষ্টা করছেন না।
(ঘ) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, যীশু সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, ধর্মধাম ধ্বংস হওয়ার সময়েই কিয়ামত হবে, তিনি নেমে আসবেন এবং তাঁর শিষ্যদের কেউ কেউ তখন বেঁচে থাকবেন। আমরা দেখব যে, এগুলোর কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি।
[2] "Julian the Apostate." Microsoft® Student 2008 [DVD]. Redmond, WA: Microsoft Corporation, 2007.
[3] "Julian." Encyclopædia Britannica. Encyclopædia Britannica 2009 Ultimate Reference Suite. Chicago: Encyclopædia Britannica, 2009.
[4] Encarta, Kevin O´Hara/age fotostock
[5] Encarta, Tony Souter/Hutchison Library