প্রাচীন ফিলিস্তিনের একটা প্রসিদ্ধ শহর টায়ার বা টোর (Tyre)। আরবি, হিব্রু ও ফনিকীয় ভাষায় শহরটার নাম ‘সোর’ (صور)। বাংলায় কেরি ও পবিত্র বাইবেল ২০০০-এ ‘সোর’, জুবিলী বাইবেলে ‘তুরস’ ও কিতাবুল মোকাদ্দসে ‘টায়ার’ লেখা হয়েছে। এ শহর বিষয়ে বাইবেল ভবিষ্যদ্বাণী করে যে, ব্যাবিলনের রাজা নেবুকাদনেজার (বখতে নাসার) শহরটা দখল ও ধ্বংস করবেন। কিন্তু এ ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
আমরা দেখেছি যে, ‘Ezekiel’ নবীর নাম বিভিন্ন বাংলা বাইবেলে ‘যিহিষ্কেল’, ‘ইহিস্কেল’, ‘হেজকিল’ ও ‘এজেকিয়েল’ লেখা হয়েছে। বাইবেল গবেষকদের ধারণায় তিনি খৃস্টপূর্ব ৬২২ সালে জেরুজালেমে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৫৭০ সালে ব্যাবিলনে মৃত্যুবরণ করেন। ক্যাথলিক বাইবেলের (বাংলা জুবিলী বাইবেল) ৩৩ নং পুস্তক এবং প্রটেস্ট্যান্ট বাইবেলের (বাংলা কেরি, কিতাবুল মোকাদ্দস ইত্যাদি) ২৬ নং পুস্তকটা যিহিষ্কেল বা ইহিষ্কেল নবীর নামে পরিচিত। এ পুস্তকে তিনি বলছেন:
‘‘টায়ারের বিরুদ্ধে ভবিষ্যদ্বাণী: হে টায়ার, আমি তোমার বিরুদ্ধে উত্তর দিক থেকে ঘোড়া, রথ, ঘোড়সওয়ার ও মস্তবড় এক সৈন্যদলের সংগে বাদশাহদের বাদশাহ, অর্থাৎ ব্যাবিলনের বাদশাহ বখতে নাসারকে নিয়ে আসব। সে যুদ্ধ করে তোমার গ্রামগুলো ধ্বংস করবে। সে তোমার বিরুদ্ধে একটা উঁচু ঢিবি তৈরী করবে এবং তোমার দেয়ালের সংগে লাগানো একটা ঢালু ঢিবি বানাবে; তারা নিজেদের রক্ষা করবার জন্য তাদের সব ঢাল উঁচু করে ধরবে। সে দেয়াল ভাংগার যন্ত্র দিয়ে তোমার দেয়ালে আঘাত করবে এবং তার যন্ত্রপাতি দিযে তোমার উঁচু পাহারা ঘরগুলো ধ্বংস করে ফেলবে। তার এত বেশী ঘোড়া থাকবে যে, সেগুলো তোমাকে ধুলায় ঢেকে দেবে। ভাংগা দেয়ালের মধ্য দিয়ে লোকে যেমন করে শহরে ঢোকে তেমনি করেই সে যখন যুদ্ধের ঘোড়া, গাড়ি ও রথ নিয়ে তোমার সব দরজার মধ্য দিয়ে ঢুকবে তখন তার শব্দে তোমার দেয়ালগুলো কাঁপবে। তার ঘোড়াগুলোর খুর তোমার সব রাস্তা মাড়াবে; তোমার লোকদের সে মেরে ফেলবে ও তোমার শক্ত শক্ত থামগুলো মাটিতে পড়ে যাবে। তারা তোমার ধন-সম্পদ ও তোমার বাণিজ্যের জিনিসপত্র লুট করবে; তারা তোমার দেয়াল ভেংগে ফেলবে, সুন্দর সুন্দর বাড়ী-ঘর ধ্বংস করবে এবং তোমার পাথর, কাঠ ও ধুলা সমুদ্রে ফেলে দেবে। আমি তোমার গানের শব্দ থামিয়ে দেব; বীণার বাজনাও আর শোনা যাবে না। আমি তোমাকে পাথরের মত করে রাখব আর তুমি হবে জালা শুকাবার জায়গা। তোমাকে আর তৈরী করা হবে না। কারণ আমি আল্লাহ মালিকই এই কথা বলছি। (ইহিষ্কেল ২৬/৭-১৪, মো.-০৬)
এখানে যিহিষ্কেল দু’টা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন: (১) নেবুকাদনেজার বা বখতে নাসার দেশটা ধ্বংস করবেন এবং (২) এটা আর কখনো পুনর্নিমিত হবে না। তাঁর দু’টা ভবিষ্যদ্বাণীই সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। নেবুকাদনেজার শহরটা ধ্বংস করা তো দূরের কথা দখলই করতে পারেননি। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮৬ থেকে ৫৭৩ পর্যন্ত ১৩ বছর অবরোধের পর শহরটা দখল করতে ব্যর্থ হয়ে নেবুকাদনেজার কর গ্রহণের চুক্তিতে অবরোধ তুলে নেন। প্রায় আড়াইশো বছর পরে খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩২ সালে আলেকজান্ডার শহরটা অবরোধ করেন, দখল করেন ও ধ্বংস করেন। পরে আবার তা পুনর্নির্মিত হয়। যীশুর সময়েও শহরটা প্রসিদ্ধ ছিল (মার্ক ৭/২৪, প্রেরিত ১২/২০)। বর্তমানেও তা প্রসিদ্ধ শহর ও ইউনেসকো (UNESCO)-র বিশ্ব-ঐতিহ্য (World Heritage Sites) তালিকার অন্তর্ভুক্ত।[1]
উপরে নেবুকাদনেজারের হাতে টায়ার ধ্বংসের যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে তা কখনো ঘটেনি। স্বয়ং যিহিস্কেলই তা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন: ‘‘আমাদের বন্দীদশার সাতাশ বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনে মাবুদের এই কালাম আমার উপর নাযেল হল, হে মানুষের সন্তান ( হে ইবনুল ইনসান বা হে ইবনে আদম), ব্যাবিলনের বাদশাহ্ বখতে-নাসার টায়ারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় তার সৈনদলকে এত বেশী খাটিয়েছে যে, তাদের সকলের মাথার চুল উঠে গেছে। তবুও টায়ারের বিরুদ্ধে সে যে যুদ্ধ চালিয়েছে তার বা তার সৈনদলের কোন লাভ হয়নি। সেজন্য আমি ব্যাবিলনের বাদশাহ্ বখতে-নাসারকে মিসর দেশটা দেব আর সে তার ধন-সম্পদ নিয়ে যাবে। তার সৈন্যদলের বেতনের জন্য সে সেই দেশটা লুটপাট করবে। তার কাজের পাওনা হিসাবে আমি তাকে মিসর দেশটা দিয়েছি, কারণ সে আমার জন্য কাজ করেছে। আমি আল্লাহ্ মালিক এই কথা বলছি।’’ (যিহিষ্কেল ২৯/১৭-২০ মো.-০৬)
আমরা দেখব যে, যিহিস্কেলের এ ভবিষ্যদ্বাণীও ব্যর্থ হয়েছিল।