আমরা দেখলাম যে, যীশু তাঁর অলৌকিক কর্মাদি প্রদর্শন করতেন যেন মানুষেরা বিশ্বাসী হতে পারে। কিন্তু এর বিপরীতে কিছু বর্ণনা আমরা ইঞ্জিলগুলোতে পাই, যেখানে অলৌকিক কর্ম দেখতে আগ্রহী বা বিশ্বাসে আগ্রহী মানুষদেরকে অলৌকিক কর্ম না দেখিয়ে যীশু তাদেরকে অবিশ্বাসের দিকে ঠেলে দিয়েছেন বা অবিশ্বাসী হতে বাধ্য করেছেন। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটা বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে:
(ক) যোহন লেখেছেন যে, জেরুজালেমের ধর্মধামে প্রবেশ করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে ইহুদি ধর্মগুরুরা তাঁর কাছে অলৌকিক কর্ম দেখতে চান। কিন্তু তিনি তাদেরকে তা দেখাতে রাজি হননি। ‘‘তখন ইহুদীরা জবাবে তাঁকে বললো, তুমি আমাদেরকে কি চিহ্ন-কাজ দেখাচ্ছো যে এসব করছো। জবাবে ঈসা তাঁদেরকে বললেন, তোমরা এই এবাদতখানা ভেঙ্গে ফেল, আমি তিন দিনের মধ্যেই তা উঠাবো। তখন ইহুদীরা বললো, এই এবাদতখানা নির্মাণ করতে ছেচল্লিশ বছর লেগেছে; তুমি কি তিন দিনের মধ্যে তা উঠাবে? কিন্তু তিনি আপন দেহরূপ বায়তুল-মোকাদ্দসের বিষয় বলছিলেন। অতএব যখন তিনি মৃতদের মধ্যে থেকে উঠলেন, তখন তাঁর সাহাবীদের মনে পড়লো যে, তিনি এই কথা বলেছিলেন।’’ (ইউহোন্না ২/১৮-২২, মো.-১৩)
তাঁর এ কথার মধ্যে অনেকগুলো সমস্যা বিদ্যমান:
(১) ইহুদিরা তাৎক্ষণিক অলৌকিক কর্ম দেখতে চেয়েছিলেন, ভবিষ্যৎ কোনো অলৌকিক কর্মের কথা শুনতে চান নি। তাদেরকে তাৎক্ষণিক কোনো অলৌকিক কর্ম দেখালে তাদের এবং অগণিত মানুষের বিশ্বাস ও মুক্তি সহজ হত।
(২) যীশু তাদেরকে একটা অসম্ভব কর্মের কথা বলেছেন। ছেচল্লিশ বছরে বানানো একটা মসজিদ অলৌকিক কর্ম দেখার জন্য ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নিলেও দু-চার দিনে বা দু-চার মাসে তা ভেঙ্গে ফেলা অসম্ভব। বরং এর পরিবর্তে যীশু নিজের অলৌকিক কর্মের মাধ্যমে মুহূর্তে এবাদতখানাটা ভেঙ্গে ফেলে আবার গড়ে দিলেই তা ইহুদি নেতাদের চ্যালেঞ্জের সত্যিকার জবাব হত এবং এ সকল মানুষ মুক্তি পেত।
(৩) তিনি এবাদতখানা বলতে তাঁর দেহ বুঝিয়েছিলেন বলে যে দাবি যোহন করেছেন তা খুবই অবাস্তব। উপস্থিত কেউই তা বুঝে নি। এমনকি তাঁর সাহাবীরাও তা বোঝেননি। কাজেই তাঁর এ উত্তর উপস্থিত ধর্মগুরু ও জনগণের জন্য, ঈশ্বরের প্রিয় প্রজা বনি-ইসরাইলের জন্য ও বিশ্বের মানুষের জন্য বিশ্বাসের দরজা রুদ্ধ করেছে।
(খ) ক্রুশের ঘটনা প্রসঙ্গে লূক বলেন: ‘‘ঈসাকে দেখে রাজা হেরোদ (Herod Antipas) খুব খুশি হলেন। তিনি ঈসার সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছিলেন, তাই তিনি অনেক দিন ধরে তাঁকে দেখতে চাইছিলেন। হেরোদ আশা করেছিলেন ঈসা তাকে কোনো অলৌকিক কাজ করে দেখাবেন। তিনি ঈসাকে অনেক প্রশ্ন করলেন, কিন্তু ঈসা কোন কথারই জবাব দিলেন না। প্রধান ইমামেরা এবং আলেমেরা সেখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ঈসাকে দোষ দিতে লাগলেন। তখন হেরোদ ঈসাকে অপমান ও ঠাট্টা করলেন, আর তাঁর সৈন্যরাও তা-ই করল।’’ (লুক ২৩/৮-১১, মো.-০৬)
এখানে যীশু হেরোদের আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ সত্ত্বেও কোনো অলৌকিক কর্ম দেখালেন না। ইতোপূর্বে দেখিয়েছেন অথবা ভবিষ্যতে দেখাবেন- তাও বললেন না। তিনি যদি এরূপ কিছু করতেন তবে হেরোদ-সহ সকল ইহুদি ও সকল মানুষ বিশ্বাস অর্জন করে মুক্তি লাভ করত। এরপর তিনি প্রয়োজনে ক্রুশে উঠে মৃত্যু বরণ করতেন। তা না করে নীরব থেকে কি তিনি তাদের সকলের জন্য মুক্তির দরজা রুদ্ধ করলেন না?
(গ) ক্রুশারোহণ প্রসঙ্গে মথি বলেন: ‘‘যে সব লোক সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল তারা মাথা নেড়ে ঈসাকে ঠাট্টা করে বলল, ‘তুমি না বায়তুল-মোকাদ্দস ভেংগে আবার তিন দিনের মধ্যে তৈরী করতে পার! তাহলে এখন নিজেকে রক্ষা কর। যদি তুমি ইবনুল্লাহ হও তবে ক্রুশ থেকে নেমে এস’। প্রধান ইমামেরা ও আলেমেরা এবং বৃদ্ধ নেতারাও তাঁকে ঠাট্টা করে বললেন, ‘ও অন্যদের রক্ষা করত, নিজেকে রক্ষা করতে পারে না । ও তো ইসরাইলের বাদশাহ! এখন ক্রুশ থেকে ও নেমে আসুক। তাহলে আমরা ওর উপর ঈমান আনব। ও আল্লাহর উপর ভরসা করে, এখন আল্লাহ যদি ওর উপর খুশি থাকেন তবে ওকে তিনি উদ্ধার করুন। ও তো নিজেকে ইবনুল্লাহ বলত। যে ডাকাতদের তাঁর সংগে ক্রুশে দেওয়া হয়েছিল তারাও সেই একই কথা বলে তাঁকে টিট্কারি দিল। (মথি ২৭/৩৯-৪৩, মো.-০৬)
এ সময়ে তো তাঁর দায়িত্ব ছিল যে, বিশ্ববাসীকে মুক্তির প্রকৃত বিশ্বাস জানিয়ে দিতে তিনি অন্তত একবার ক্রুশ থেকে নেমে আসবেন। এরপর আবার ক্রুশে উঠে জীবনত্যাগ করবেন। তাহলে এ সকল মানুষ ও সকল ইহুদি মুক্তি পেত!
(ঘ) মথি ১২/৩৮-৪০: ‘‘কয়েকজন আলেম ও ফরীশী ঈসাকে বললেন, ‘হুজুর, আমরা আপনার কাছ থেকে একটা চিহ্ন দেখতে চাই।’ ঈসা তাঁদের বললেন, ‘এই কালের দুষ্ট ও বেঈমান লোকেরা চিহ্নের খোঁজ করে, কিন্তু ইউনুস নবীর চিহ্ন ছাড়া আর কোন চিহ্নই তাদের দেখানো হবে না। ইউনুস যেমন সেই মাছের পেটে তিন দিন ও তিন রাত ছিলেন ইবনে আদম তেমনি তিন দিন ও তিন রাত মাটির নীচে থাকবেন।’’ (মো.-০৬)
এ বিষয়টাও দুর্বোধ্য। কেউ চিহ্ন দেখতে চাইলে তাকে ভবিষ্যতে তা দেখানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়ার অর্থই তার জন্য বিশ্বাসকে অসম্ভব করে দেওয়া। এছাড়া যীশু তাদেরকে যে চিহ্ন দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিলেন যা তিনি তাদেরকে দেখান নি। তিনি মাটির নিচে তিন দিন তিন রাত থাকেন নি, বরং এক দিন ও দুই রাত ছিলেন (যোহন ২০/১-১৮; মথি ২৮/১-১০; মার্ক ১৬/১-১১; লূক ২৪/১-১২)। আর তিনি ইউনুস নবীর মত জীবিত অবস্থায় মাছের গর্ভে থাকেন নি; বরং বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে তিনি মৃত অবস্থায় মাটির গর্ভে ছিলেন। সর্বোপরি, যীশু তাঁর প্রতিশ্রুতি মত পৃথিবীর গর্ভ থেকে পুনরুত্থানের চিহ্নটা আলেম ও ফরীশীদেরকে দেখান নি। যীশু পুনরুত্থানের পর নিজেকে এদের সামনে প্রকাশিত করে নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। এজন্যই ইহুদিরা যীশুর পুনরুত্থানে বিশ্বাস করেন না। যদি যীশু পাপীদের মুক্তির জন্যই এসে থাকতেন তাহলে তো তিনি পুনরুত্থানের পরে আলেম ও ফরীশীদেরকে দেখা দিয়ে তাদের সকলের, সকল ইহুদি এবং বিশ্বের সকল মানুষের মুক্তির ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
সমালোচকরা বলেন, ইঞ্জিল লেখকরা যীশুকে দেবতা হিসেবে চিত্রিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু তারা তাঁকে প্রকৃত অর্থে স্ববিরোধী, দুর্বোধ্য ও উন্নাসিক হিসেবে চিত্রিত করেছেন। যীশুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল কারো জন্য এ সকল বর্ণনা বিশ্বাস করা অসম্ভব।