যদি কেউ মথির ২য় অধ্যায়ের সাথে লূকের দ্বিতীয় অধ্যায়ের তুলনা করেন তবে অনেক বৈপরীত্য দেখবেন। এখানে শুধু দুটো বৈপরীত্য উল্লেখ করছি:
প্রথমত: মথি থেকে বুঝা যায় যে, যীশুর জন্মের পরে তাঁর পিতামাতা বেথেলহেমেই অবস্থান করছিলেন। যীশুর জন্মের পর থেকে প্রায় দু’ বছর পর্যন্ত তাঁরা বেথেলহেমে অবস্থান করেন। এ সময়ে পূর্বদেশীয় কয়েকজন পণ্ডিত সেখানে আগমন করেন। এরপর তাঁরা মিসরে গমন করেন এবং যুডিয়া রাজ্যের শাসক হেরোদ (Herod) রাজা যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন তারা মিসরেই ছিলেন। হেরোদের মৃত্যুর পরে তারা ফিরে আসেন এবং নাসরৎ নামক নগরে বসবাস করতে লাগলেন।
লূক থেকে জানা যায় যে, বেথেলহেমে যীশুর জন্মের পরে যখন মোশির শরীয়ত অনুসারে মরিয়মের পবিত্র হওয়ার সময় পূর্ণ হল তখন মরিয়ম ও যোষেফ শিশু যীশুকে জেরুজালেমে নিয়ে যান। সেখানে বলি উৎসর্গ করার পরে তাঁরা তাঁদের নিজ নগর নাসরতে ফিরে গেলেন এবং সেখানেই অবস্থান করতে থাকলেন। তাঁরা সেখান থেকে প্রতি বছর নিস্তার-পর্বের সময়[1] জেরুজালেমে গমন করতেন। এভাবে নিয়মিত চলতে থাকে। যীশুর বয়স যখন ১২ বছর তখন পর্ব থেকে ফিরে আসার সময় যীশু পিতামাতাকে না জানিয়ে তিন দিন জেরুজালেমে অবস্থান করেন।
লূকের বক্তব্য অনুসারে যীশুর পিতামাতা কখনোই মিসরে গমন করেননি এবং মিসরে অবস্থান করেননি। লূকের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, জন্মের পর থেকে কখনোই যীশু ইহুদিদের দেশ ছেড়ে অন্য কোনো দেশে গমন করেননি।
দ্বিতীয়ত: মথি থেকে জানা যায় যে, পূর্বদেশীয় পণ্ডিতদের সংবাদ দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত, অর্থাৎ যীশুর জন্মের পরে প্রায় দু বছর পর্যন্ত, জেরুজালেমবাসী এবং তাদের রাজা হেরোদ যীশুর জন্মের বিষয়ে কিছুই জানতেন না। পূর্বদেশীয় পণ্ডিতদের মুখে খ্রিষ্টের জন্ম হয়েছে জানার পরেই তারা তাঁকে হত্যার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু লূকের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, যীশুর জন্মের পরেই জেরুজালেমের মানুষেরা তাঁর জন্ম ও তিনিই যে প্রতিশ্রুত খ্রিষ্ট বা মাসীহ তা জেনে গিয়েছিল।
লূক লেখেছেন যে, যীশুর জন্ম-পরবর্তী পবিত্রতার পরেই তাঁর পিতামাতা তাকে নিয়ে জেরুজালেমে গমন করেন এবং সেখানে বলি উৎসর্গ করেন। তখন ‘শিমিয়োন নামক ব্যক্তি‘ যিনি ‘‘ধার্মিক ও ভক্ত... এবং পবিত্র আত্মা তাঁহার উপরে ছিলেন। আর পবিত্র আত্মা দ্বারা তাঁহার কাছে প্রকাশিত হইয়াছিল যে, তিনি প্রভুর খ্রিষ্টকে দেখিতে না পাইলে মৃত্যু দেখিবেন না’’ সে ব্যক্তি পবিত্র আত্মায় পরিপূর্ণ হয়ে ধর্মধামে বা মন্দিরে (Temple) প্রবেশ করেন এবং যীশুকে তার কোলে তুলে নেন। তিনি সেখানে যীশুর গুণাবলি বর্ণনা করেন। অনুরূপভাবে হান্না নামের এক বৃদ্ধা ভাববাদিনী ‘‘তিনি সেই সময়ে উপস্থিত হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন এবং যত লোক জেরুশালেমের মুক্তির অপেক্ষা করছিল, তাদেরকে ঈসার কথা বলতে লাগলেন।’’ (লূক ২/৩৮)
বড় অবাক বিষয়! জেরুজালেমের মূল কেন্দ্র ধর্মধামের মধ্যে সমবেত অগণিত মানুষের সামনে এবং রোমান শাসন থেকে জেরুজালেমের মুক্তির জন্য উদগ্রীব ইহুদি জাতির সামনে যীশুর খ্রিষ্টত্ব বিষয়ে শিমিয়োন ও নবী হান্নার এ বক্তব্যের পরেও যিরুশালেমের শাসক হেরোদ, তার কর্মকর্তাবৃন্দ ও তার জনগণের কানে বিষয়টা গেল না বা তারা যীশুকে হত্যার কোনো পরিকল্পনা করলেন না। কিন্তু দু’ বছর পরে পূর্বদেশীয় পণ্ডিতদের মুখে যীশুর জন্মের কথা শুনে তাকে হত্যার জন্য এত ব্যাকুল হলেন যে, যীশুকে চিহ্নিত করতে না পারায় দু বছর বয়সী সকল শিশুকে হত্যা করলেন!