২. ১২. ৯. দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষার্ধ পর্যন্ত ইঞ্জিলগুলো অজ্ঞাত

‘আচারিয়া এস (Acharya S) এর ‘ঐতিহাসিক যীশু?’ (The Historical Jesus?) প্রবন্ধের শুরুতে লেখা আছে:

“When were the gospels written? With their absence in Justin Martyr's works, we remain with the dating of the gospels to the last quarter of the second century.”

‘‘ইঞ্জিলগুলো কখন লেখা হয়েছিল? জাস্টিন মার্টারের রচনাবলিতে এগুলোর অনুপস্থিতির কারণে আমরা এ সিদ্ধান্তেই অবিচল থাকছি যে, ইঞ্জিলগুলো দ্বিতীয় খ্রিষ্টীয় শতাব্দীর শেষ ২৫ বছরের মধ্যে লেখা হয়েছিল।’’[1]

এরপর তিনি বিস্তারিত তথ্য প্রদান করেছেন। তার প্রবন্ধের ইংরেজি উদ্ধৃতি বা হুবহু অনুবাদ আমাদের বইয়ের কলেবর বৃদ্ধি করবে। সম্মানিত পাঠক সুযোগ থাকলে দীর্ঘ এ প্রবন্ধটা পাঠ করবেন। এখানে সারসংক্ষেপ উল্লেখ করছি:

(১) সাধু পল যীশু খ্রিষ্টের তিরোধানের প্রায় ৪০ বছর পরে আনুমানিক ৭০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর রচনাবলি থেকে সুস্পষ্ট যে, তিনি প্রচলিত ইঞ্জিলগুলো সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। উপরন্তু ইঞ্জিলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান যীশুর জীবনী ও বক্তব্যগুলোর সাথেও তিনি পরিচিত ছিলেন না।

(২) মূলধারার খ্রিষ্টান গবেষকরা বলছেন যে ৭০ থেকে ১১০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ইঞ্জিলগুলো লেখা। অভ্যন্তরীণ প্রামাণ নিশ্চিত করে যে, এগুলো ৭০ খ্রিষ্টাব্দে জেরুজালেমের ধ্বংসের পরে লেখা। যোহনের ইঞ্জিল ১১০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রচিত। কিন্তু এর পরেও প্রায় এক শতাব্দী পর্যন্ত খ্রিষ্টান প্রচারক, চার্চপিতা বা ধর্মগুরু কেউ পুস্তকগুলোর নামও নিচ্ছেন না।

(৩) চতুর্থ-পঞ্চম শতকের প্রসিদ্ধ ধর্মগুরু, চার্চপিতা ও কন্সট্যান্টিনোপলের আর্চবিশপ জন ক্রীযোসটম (৩৪৭-৪০৭) বলেন, স্বীকৃত ইঞ্জিলগুলো যাদের নামে প্রচলিত এগুলোকে তাদের লেখা বলে প্রথম উল্লেখ করা হয় দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষে।

(৪) দ্বিতীয় শতকের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ খ্রিষ্টান ধর্মগুরু, চার্চপিতা, প্রচারক ও গ্রন্থরচনাকারী জাস্টিন মার্টার বা শহীদ জাস্টিন। তিনি ১০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১৬৫/১৬৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে নিহত হন। খ্রিষ্টধর্মের পক্ষে, বিরোধীদের মত খণ্ডনে তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। দ্বিতীয় শতক থেকে খ্রিষ্টান চার্চগুলোতে তাঁর রচনাবলি সংরক্ষণ করা হয়েছে। স্বভাবতই তাঁর রচনাবলির পাণ্ডুলিপিগুলো অন্যান্য প্রাচীন পুস্তকের মতই পরবর্তীকালে সংযোজন, বিয়োজন ও সম্পাদনার মাধ্যমে বিকৃত হয়েছে। তারপরও আমরা দেখছি যে, তাঁর রচনাবলির কোথাও প্রচলিত চার ইঞ্জিলের নাম একবারও নেওয়া হয়নি।

(৫) অনেক খ্রিষ্টান প্রচারক ও লেখক দাবি করেছেন যে, জাস্টিন মার্টারই প্রথম খ্রিষ্টান লেখক যিনি স্বীকৃত ইঞ্জিলগুলোর সাথে পরিচিত ছিলেন। প্রকৃত সত্য হল, জাস্টিন নতুন নিয়ম থেকে কিছুই উদ্ধৃত করেননি। বরং নতুন নিয়মের পুস্তকগুলো যে সকল সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে তিনিও সে সকল সূত্র থেকে কিছু তথ্য উল্লেখ করেছেন।

(৭) জাস্টিন প্রচলিত চার ইঞ্জিলের নাম কোথাও উল্লেখ করেননি। তাঁর লেখনির মধ্যে কিছু কথার সাথে প্রচলিত চার ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান কথার কিছু মিল রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, এগুলো তিনি ‘প্রেরিতদের স্মৃতিকথা’ (Memoirs of the Apostles) থেকে উদ্ধৃত করেছেন। প্রচারকরা দাবি করেন যে, স্মৃতিকথা বলতে তিনি ইঞ্জিল বুঝিয়েছেন। কিন্তু তাঁর উদ্ধৃতি থেকে প্রমাণ হয় যে, ‘প্রেরিতদের স্মৃতিকথা’ নামে একটা পৃথক পুস্তক তাঁর সময়ে প্রচলিত ছিল, যা বর্তমানে হারিয়ে গিয়েছে। ‘প্রেরিতদের কার্যবিবরণী’ পুস্তকের মতই এটা আরেকটা পুস্তক ছিল।

(৮) জাস্টিন ‘প্রেরিতদের স্মৃতিকথা’ থেকে যে সকল উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন তা সর্বদা প্রচলিত ইঞ্জিলগুলোর বক্তব্য থেকে কম বেশি ভিন্ন। ছোট ছোট কয়েকটা উদ্ধৃতি প্রচলিত ইঞ্জিলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বক্তব্যের সাথে কিছুটা মিল সম্পন্ন। তবে এগুলো একইভাবে তৎকালে প্রচলিত কিন্তু বর্তমানে জাল বলে পরিত্যক্ত বিভিন্ন ইঞ্জিলের মধ্যেও পাওয়া যায়। জাস্টিন কোন্ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করেছেন তা নিশ্চিত নয়। সর্বোপরি খ্রিষ্টধর্মের ইতিহাস ও ঘটনাবলি জাস্টিন যেভাবে উদ্ধৃত করেছেন তা প্রচলিত ইঞ্জিলগুলোর সাথে সাংঘর্ষিক।

(৯) অনেকে দাবি করেন যে, ‘প্রেরিতদের স্মৃতিকথা’ বলতে জাস্টিন প্রচলিত ইঞ্জিলগুলোকে বুঝিয়েছেন। তবে তিনি উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে অযত্নবান ছিলেন। ইচ্ছামত পরিবর্তন ও পরিমার্জন করার কারণে ইঞ্জিলগুলোর বর্ণনার সাথে তাঁর বর্ণনার ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। এছাড়া অবহেলা করেই তিনি ইঞ্জিলগুলোর নাম উল্লেখ করেন নি। এ দাবিটা মোটেও ঠিক নয়। কারণ উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে জাস্টিন সচেতন ও যত্নবান ছিলেন। তিনি তার লেখনিতে পুরাতন নিয়ম থেকে ৩১৪ স্থানে উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। ১৯৭ স্থানে তিনি পুরাতন নিয়মের নির্দিষ্ট পুস্তকটার নাম বা লেখকের নাম উল্লেখ করেছেন।

(১০) পুরাতন নিয়ম থেকে উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে এত সতর্কতা ও সুক্ষ্মতার বিপরীতে যীশু খ্রিষ্ট বিষয়ক তথ্যাদি উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে তিনি প্রচলিত কোনো ইঞ্জিলের নাম উল্লেখ করছেন না, বরং ‘স্মৃতিকথা’ নামক পুস্তকের নাম উল্লেখ করছেন। পুরাতন নিয়ম থেকে উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে তাঁর এ সতর্কতা ও সচেতনতা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যীশু বিষয়ক তথ্যাদির ক্ষেত্রেও তিনি সতর্কতা ও সচেতনতার সাথেই গ্রন্থের নাম ও উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। তিনি ‘স্মৃতিকথা’ নামক পুস্তক থেকেই উদ্ধৃতি দিয়েছেন এবং সে পুস্তকটার বর্ণনার সাথে প্রচলিত ইঞ্জিলগুলোর অমিল থাকার কারণেই তার উদ্ধৃতির সাথে প্রচলিত ইঞ্জিলগুলোর অমিল দেখা দিয়েছে।

(১১) প্রচলিত ইঞ্জিলগুলোর প্রাচীনত্ব প্রমাণ করতে কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, জাস্টিন প্রচলিত স্বীকৃত ইঞ্জিলগুলোর বিষয় জানতেন বা এগুলো তাঁর নিকট ছিল। তবে তিনি এগুলোকে এবং এগুলোর লেখকদেরকে নাম ধরে উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করেননি। আর তিনি ইচ্ছামত সম্পাদনা করে তথ্যগুলো উপস্থাপন করেছেন, ফলে তাঁর উদ্ধৃতির সাথে ইঞ্জিলগুলোর উদ্ধৃতির ভিন্নতা দেখা দিয়েছে। এ দাবিটা অযৌক্তিক। এ দাবি ঠিক হলে প্রমাণ হবে যে, জাস্টিন ‘ইঞ্জিলগুলোকে’ মোটেও গুরুত্ব দিতেন না বা ঐশ্বরিক বলে গণ্য করতেন না।

(১২) জাস্টিন একবার ‘যোহন’ নামটা উল্লেখ করেছেন, তবে যোহনের কোনো ইঞ্জিল আছে বলে উল্লেখ করেননি এবং যোহনের নামের সাথে কোনো ইঞ্জিলের কথাও লেখেননি। মথি, মার্ক ও লূকের নাম তিনি একবারও নেননি। জাস্টিনের কাছে এ ইঞ্জিলগুলো থাকবে, অথচ তিনি এগুলোর নামও নেবেন না এরূপ ধারণা একেবারেই অবাস্তব ও অযৌক্তিক।

(১৩) জাস্টিন তার রচনাবলিতে কোথাও একবারের জন্যও পলের নাম উল্লেখ করেননি। সকল দলিল-প্রমাণ নিশ্চিত করে যে, প্রচলিত চার ইঞ্জিল এবং পলের রচনাবলির সাথে জাস্টিন মোটেও পরিচিত ছিলেন না।

(১৪) জাস্টিন স্বীকৃত চার ইঞ্জিলের ব্যবহার না করলেও তিনি ‘অস্বীকৃত’ বা ‘জাল বলে গণ্য’ অনেকগুলো ‘ইঞ্জিল’ ব্যবহার করেছেন। ‘প্রেরিতগণের স্মৃতিকথা’ ছাড়াও তিনি ইব্রীয়গণের ইঞ্জিল (the Gospel of the Hebrews) ব্যবহার করেছেন। এটা দ্বিতীয় শতাব্দীতে ফিলিসিত্মানের খ্রিষ্টানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল এবং প্রচলিত চার ইঞ্জিল থেকে প্রাচীনতর।

(১৫) দ্বিতীয় শতাব্দীতে প্রচলিত এবং পরবর্তীকালে অস্বীকৃত যে সকল পুস্তক থেকে তিনি তথ্য গ্রহণ করেছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: (ক) পীলাতের কার্যবিবরণ বা নীকদীমের ইঞ্জিল (Acts of Pilate/ Gospel of Nicodemus), (খ) শৈশবীয় ইঞ্জিল (the Protevangelion and Gospel of the Infancy), (গ) পিতরের স্মৃতিকথা বা পিতরের ইঞ্জিল (Memoirs of Peter/ Gospel of Peter), (ঘ) সিবিলের বক্তব্যমালা (the Sibylline Oracles)। তিনি এগুলোর নাম উল্লেখ করেই উদ্ধৃতি দিয়েছেন।

(১৬) সামগ্রিক পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, জাস্টিন লেখকের নাম উল্লেখ করে পুরাতন নিয়ম থেকে প্রায় ২০০ উদ্ধৃতি পেশ করেছেন। নতুন নিয়মের জাল বা সন্দেহজনক পুস্তকগুলো থেকে প্রায় ১০০ উদ্ধৃতি প্রদান করেছেন। অথচ নতুন নিয়মের স্বীকৃত চার ইঞ্জিল থেকে একটাও স্বীকৃত উদ্ধৃতি প্রদান করেন নি। নতুন নিয়মের ইঞ্জিল লেখকদের মধ্যে যোহনের নাম ছাড়া কারো নামই উল্লেখ করেননি। চার ইঞ্জিলের কোনোটারই নাম উল্লেখ করেননি। ইঞ্জিলগুলোর উল্লেখ ছাড়া যীশুর অনেক কর্ম ও কথা তিনি উদ্ধৃত করেছেন, যেগুলোর মধ্যে অতি সামান্য কয়েকটা কথা প্রচলিত ইঞ্জিলের মধ্যে বিদ্যমান কথার সাথে কোনোরকমে মেলে। এগুলো সবই প্রমাণ করে যে, জাস্টিন প্রচলিত চার ইঞ্জিল সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।

(১৭) জাস্টিনের পরেও কোনো লেখক এগুলোর নাম উল্লেখ করছেন না। ১৭০-১৮০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এগুলোর নাম কোনো কোনো লেখকের রচনায় দেখা যায়। পরবর্তী কয়েক দশক এরূপ উল্লেখ খুব সীমিত পর্যায়ে পাওয়া যায়।

(১৮) জাস্টিনের লেখনির মধ্যে প্রচলিত চার ইঞ্জিলের অনুপস্থিতি প্রমাণ করে যে, প্রচলিত চার ইঞ্জিল দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ অংশে লেখা হয়েছে। খ্রিষ্টান গবেষকরা ইচ্ছাকৃতভাবে এগুলোর রচনাকাল এক শতাব্দী আগে নিয়ে গিয়েছেন।[2]

[1] http://www.truthbeknown.com/historicaljc.htm
[2] http://www.truthbeknown.com/historicaljc.htm. আরো দেখুন: http://www. stewartsynopsis.com/theology_tethers.htm