বাইবেলের বিবর্তন বিষয়ে দুটো বিষয় বিবেচ্য: (১) পুস্তকগুলোর সংখ্যা এবং (২) পুস্তকগুলোর বক্তব্য বা বিষয়বস্ত্ত। খ্রিষ্টান প্রচারকরা দাবি করেন যে, বাইবেলের পুস্তকগুলো বিভিন্ন নবীর লেখা এবং তাঁদের সময় থেকেই সংকলিত। তবে বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইহুদি-খ্রিষ্টান গবেষক পণ্ডিতদের গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি যে, বাইবেলের পুস্তকগুলোর সংখ্যা ও বিষয়বস্ত্ত উভয়ই যুগে যুগে পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংযোজন ও বিয়োজনের মাধ্যমে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে। পুস্তকগুলোর সংখ্যার হেরফের আমরা দেখেছি। যীশুর প্রায় ১৩০০ বছর পূর্বে মোশির (মূসা আ.-এর) আগমন। মোশির পরে প্রায় হাজার বছর ধরে ইহুদি জাতির বিভিন্ন নবীর নামে অনেক ধর্মগ্রন্থ তাদের সমাজে প্রচলিত হয়। সময়ের আবর্তনে সেগুলো পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হয়েছে। পুস্তকগুলোর সংখ্যা এবং আকার নিয়ে অনেক মতভেদ ছিল। যীশুর প্রায় ৩০০ বছর পরে ‘ইহুদি বাইবেল’-এর চূড়ান্ত রূপ নির্ধারণ করা হয়।
আমরা দেখেছি যে, যীশু খ্রিষ্টের প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে ইহুদি ধর্মগ্রন্থগুলোকে গ্রিক ভাষায় অনুবাদ করা হয়। কিন্তু প্রায় ৫০০ বছর পরে ইহুদিরা এ পুস্তকের মধ্যে বিদ্যমান অনেক পুস্তক অগ্রহণযোগ্য বলে বাতিল করেন এবং অন্য অনেক পুস্তকের বিষয়বস্ত্তর বিষয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্করণ ও পাণ্ডুলিপির উপর নির্ভর করেন।
প্রথম খ্রিষ্টীয় শতকের শেষ দিক থেকেই ইহুদি বাইবেলের একটা চূড়ান্ত ও নির্ধারিত রূপ দানের প্রচেষ্টা শুরু হয়। এর অন্যতম কারণ ছিল একদিকে রোমান আক্রমণে ইহুদি রাজ্যের বিলুপ্তি, ইহুদিদের নির্বাসন এবং ইহুদি জাতির অস্তিত্বের সংকট। আরেকদিকে উদীয়মান খ্রিষ্টান ধর্ম কর্তৃক ইহুদি বাইবেলের গ্রিক অনুবাদের অপব্যবহার। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার সিডি সংস্করণের Biblical litarature প্রবন্ধে the new testament canon প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:
“In the last decade of the 1st century, the Synod of Jamnia (Jabneh), in Palestine, fixed the canon of the Bible for Judaism, which, following a long period of flux and fluidity and controversy about certain of its books.... A possible factor in the timing of this Jewish canon was a situation of crisis: the fall of Jerusalem and reaction to the fact that the Septuagint was used by Christians and to their advantage, as in the translation of the Hebrew word ʿalma (young woman) in chapter 7, verse 14, of Isaiah—“Behold, a young woman shall conceive and bear a son, and shall call his name Immanuel”—into the Greek term parthenos (virgin).”
‘‘প্রথম খ্রিষ্টীয় শতকের শেষ দশকে ফিলিস্তিনে অনুষ্ঠিত ইহুদি ধর্মগুরুদের ‘জামনিয়া (জাবনেহ) সম্মেলনে ইহুদিদের জন্য বিশুদ্ধ বা স্বীকৃত বাইবেল নির্ধারণ করা হয়। দীর্ঘ সময়ব্যাপী নিরন্তর পরিবর্তন প্রবাহ, তারল্য এবং এর কিছু পুস্তকের বিষয়ে মতপার্থক্যের পরে এ নির্ধারণ সম্পন্ন হয়। ... ইহুদি ধর্মগ্রন্থটা এ সময়ে নির্ধারণ করার একটা সম্ভাব্য কারণ ছিল সঙ্কটময় পরিস্থিতির উদ্ভব: জেরুজালেমের পতন ঘটে (ইহুদিদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়) এবং সেপ্টুআজিন্ট বা ইহুদি বাইবেলের গ্রিক অনুবাদকে খ্রিষ্টানরা তাদের সুবিধামত ব্যবহার করতে থাকে। যেমন যিশাইয়র পুস্তকের ৭ অধ্যায়ের ১৪ শ্লোক নিম্নরূপ: ‘‘দেখ! একজন যুবতী মেয়ে গর্ভবতী হবে এবং একটা শিশু প্রসব করবে এবং তার নাম রাখা হবে ‘ইম্মানুয়েল’। এ শ্লোকে হিব্রু বাইবেল বিদ্যমান ‘আলমা’ (যুবতী মেয়ে) শব্দটাকে গ্রিক ‘পারথেনস’ (কুমারী) বলে অনুবাদ করা।’’
তবে এ প্রচেষ্টা চূড়ান্ত রূপ পেতে আরো শতাধিক বছর পার হয় বলে উল্লেখ করেছেন গবেষকরা। উইকিপিডিয়া লেখেছে: “There is no scholarly consensus as to when the Hebrew Bible canon was fixed: some scholars argue that it was fixed by the Hasmonean dynasty, while others argue it was not fixed until the second century CE or even later”
‘‘স্বীকৃত হিব্রু বাইবেল কখন নির্ধারিত হয়েছে সে বিষয়ে গবেষকদের কোনো ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেই। কেউ বলেন হাসমোনিয়ান (Hasmonean) রাজত্বকালে (খৃস্টপূর্ব ১৪০-১১৬ অব্দ) তা সংকলিত হয়েছে। অন্যরা বলেন খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতক বা তার পরেও ইহুদি বাইবেল নির্ধারিত হয়নি।’’[1]
অর্থোডক্স ধর্মগুরু ফ্রান্সিস জেমস বার্নস্টেইন (Fr. James Bernstein, Orthodox churchman) ‘কোনটা প্রথম: চার্চ না নতুন নিয়ম?’ (Which Came First: The Church or the New Testament? 1994, p 5) পুস্তকে (http://www.protomartyr.org/first.html) বলেন:
“...the Jews did not decide upon a definitive list or canon of Old Testament books until after the rise of Christianity. .... The modern Jewish canon was not rigidly fixed until the third century A.D. Interestingly, it is this later version of the Jewish canon of the Old Testament, rather than the canon of early Christianity, that is followed by most modern Protestants today. When the Apostles lived and wrote, there was no New Testament and no finalized Old Testament. The concept of "Scripture" was much less well-defined than I had envisioned.”
‘‘ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থের তালিকা বা পুরাতন নিয়মের বিশুদ্ধ পুস্তকগুলোর বিষয়ে ইহুদিরা কোনো সিদ্ধান্ত নেননি, খ্রিষ্টধর্মের উত্থানের পরবর্তী সময় পর্যন্ত। .... তৃতীয় খ্রিষ্টীয় শতক পর্যন্ত আধুনিক ইহুদি ধর্মগ্রন্থের স্বীকৃত বা বৈধ রূপটা দৃঢ়ভাবে ঠিক করা হয়নি। মজার বিষয় হল, আধুনিক যুগের অধিকাংশ প্রটেস্ট্যান্ট পুরাতন নিয়মের ক্ষেত্রে প্রথম যুগের খ্রিষ্টধর্মীয় ধর্মগ্রন্থ (সেপ্টুআজিন্ট) বাদ দিয়ে পরবর্তীতে সংকলিত ইহুদি বাইবেল অনুসরণ করেন। যখন শিষ্যরা জীবিত ছিলেন এবং (তাঁদের পুস্তক বা পত্রগুলো) লেখতেন তখন ‘নতুন নিয়ম’ বলে কিছুই ছিল না এবং পুরাতন নিয়মের চূড়ান্ত কোনো রূপও বিদ্যমান ছিল না। ‘ধর্মগ্রন্থ’ বিষয়ক ধারণা আমার পূর্ব ধারণার চেয়ে অনেক বেশি ঢিলেঢালা ছিল।’’
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার biblical literature প্রবন্ধে ইহুদি বাইবেলের তৃতীয় অংশ ‘কেতুবীম’ (The Ketuvim) প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:
“That the formation of the Ketuvim as a corpus was not completed until a very late date is evidenced by the absence of a fixed name, or indeed any real name, for the third division of Scripture. Ben Sira refers to “the other books of our fathers,” “the rest of the books”; Philo speaks simply of “other writings” and Josephus of “the remaining books.” A widespread practice of entitling the entire Scriptures “the Torah and the Prophets” indicates a considerable hiatus between the canonization of the Prophets and the Ketuvim. ... Ben Sira omits mention of Daniel and Esther. No fragments of Esther have turned up among the biblical scrolls (e.g., the Dead Sea Scrolls) from the Judaean Desert. ... A synod at Jabneh (c. 100 CE) seems to have ruled on the matter, but it took a generation or two before their decisions came to be unanimously accepted and the Ketuvim regarded as being definitively closed. The destruction of the Jewish state in 70 CE, the breakdown of central authority, and the ever widening Diaspora (collectively, Jews dispersed to foreign lands) all contributed to the urgent necessity of providing a closed and authoritative corpus of sacred Scriptures.”
‘‘একক সংকলন হিসেবে ‘কেতুবীম’-এর রূপগ্রহণ অনেক দেরি করে হয়েছে। এর প্রমাণ, ইহুদি বাইবেলের তৃতীয় অংশ হিসেবে এর কোনো নির্ধারিত নাম ছিল না, বরং কোনো নামই ছিল না। বেন-সিরা এ অংশের বিষয়ে বলেছেন: ‘আমাদের পিতৃগণের অন্যান্য পুস্তক’ অথবা ‘অন্যান্য পুস্তক’। ফিলো (মৃত্যু ৫০ খ্রি.) শুধু বলেছেন: ‘অন্যান্য লিখনি’। যোশেফাস (মৃত্যু ১০০ খ্রি.) বলেছেন: ‘অবশিষ্ট পুস্তকগুলো’। ইহুদি ধর্মগ্রন্থগুলো একত্রে বুঝাতে ব্যাপকভাবে বলা হত: ‘তৌরাত ও নবীগণ’। এতে বুঝা যায় যে, নবীগণের পুস্তকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা এবং ‘কেতুবীম’ গ্রন্থগুলোর গ্রহণযোগ্যতার মধ্যে দীর্ঘ সময় পার হয়েছে। ... বেন-সিরা দানিয়েল ও ইস্টেরের কোনো উল্লেখই করেননি। জুদিয় রাজ্যের (বর্তমান জর্দানের) মরুভূমিতে পাওয়া বাইবেলের পাণ্ডুলিপিগুলোর (মৃত সাগরের পাণ্ডুলিপি) মধ্যে ইস্টেরের কোনো অংশ পাওয়া যায়নি। ... জাবানেহ-এ অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলন (১০০ খ্রিষ্টাব্দে) এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল বলে প্রতীয়মান। তবে তা সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা পেতে আরো এক বা দু’ প্রজন্ম পার হয়েছিল। ৭০ খ্রিষ্টাব্দে ইহুদি রাষ্টের ধ্বংস, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিলোপ এবং ইহুদিদের সামষ্টিক বিতাড়নের মত ঘটনাগুলো একত্রে ইহুদিদেরকে উদ্বুদ্ধ করে ধর্মগ্রন্থগুলোর বিষয়টি চূড়ান্ত করতে।’’