তাবার্রুক অর্থ বরকত অনুসন্ধান করা বা বরকত আশা করা। আরবের মুশরিকদের শিরকের একটি দিক ছিল তাবার্রুক বা বরকত লাভের জন্য কোনো স্থান বা দ্রব্যের প্রতি ভক্তি প্রকাশ। তারা কাবা ঘরের পাথর ইত্যাদি বরকতের জন্য কাছে রাখত, তাওয়াফ করত বা সম্মান করত। এ সম্পর্কে ইবনু ইসহাক তার ‘‘সীরাতুন্নবী’’ গ্রন্থে বিভিন্ন সাহাবী ও তাবেয়ীর সূত্রে লিখেছেন: ইসমাঈলের বংশে আরবদের মধ্যে শিরক প্রচলনের কারণ ছিল, এরা কাবাঘরের খুবই ভক্তি করত। তারা কাবাঘর ছেড়ে যেতে চাইতেন না। যখন তাদের বাধ্য হয়ে কাবাঘর ছেড়ে বিভিন্ন এলাকায় যেতে হতো, তখন তারা সাথে করে কাবাঘরের তাযীমের জন্য কাবাঘরের কিছু পাথর নিয়ে যেতেন। তারা যেখানেই যেতেন সেখানে এই পাথরগুলি রেখে তার তাওয়াফ করতেন ও সম্মান করতেন। পরবর্তী যুগে ক্রমান্বয়ে এ সকল পাথর ইবাদত করার প্রচলন হয়ে যায়। পরে মানুষেরা খেয়াল খুশি মতো বিভিন্ন পাথর পূজা করতে শুরু করে।[1]
কাবাগৃহের পাথর ইত্যাদি ছাড়া আরো অনেক কিছু তারা ‘তাবার্রুকের নামে’ ভক্তি করত, আর আমরা দেখেছি যে, চূড়ান্ত বা অলৌকিক ভক্তি ও অসহায়ত্ব প্রকাশই ইবাদত। এভাবে তাবার্রুকের নামে তারা শিরকের মধ্যে &&নপতিত হতো। তাদের এ সকল ভক্তিকৃত দ্রব্যের মধ্যে ছিল ‘যাত আনওয়াত’ নামক একটি বৃক্ষ।
আবু ওয়াকিদ লাইসি (রাঃ) বলেছেন:
إنَّ رَسُولَ اللَّهِ (ﷺ) لَمَّا خَرَجَ إِلَى حُنَيْنٍ (خَرَجَنَا مَع رسول الله (ﷺ) إِلَى حُنَيْنٍ وَنَحْنُ حَدِيْثُوْ عَهْدٍ بِكُفْرٍ، وكَانُوا أَسْلَمُوا يَوْمَ الْفَتْحِ) مَرَّ بِشَجَرَةٍ لِلْمُشْرِكِينَ يُقَالُ لَهَا ذَاتُ أَنْوَاطٍ يُعَلِّقُونَ عَلَيْهَا أَسْلِحَتَهُمْ (سِدْرَةٌ يَعْكُفُوْنَ حَوْلَهَا ويُعَلِّقُوْنَ بِهَا أَسْلِحَتَهُمْ فَقَالُوا (قلنا) يَا رَسُولَ اللَّهِ اجْعَلْ لَنَا ذَاتَ أَنْوَاطٍ كَمَا لَهُمْ ذَاتُ أَنْوَاطٍ فَقَالَ النَّبِيُّ (ﷺ) سُبْحَانَ اللَّهِ هَذَا كَمَا قَالَ قَوْمُ مُوسَى اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَتَرْكَبُنَّ سُنَّةَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ
‘‘মক্কা বিজয়ের পরে আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর সাথে হুনাইনের যুদ্ধের জন্য যাত্রা করি। তখন আমরা নও মুসলিম। মক্কা বিজয়ের সময়েই কেবল আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি। চলার পথে তিনি মুশরিকদের একটি (বরই) বৃক্ষের নিকট দিয়ে যান, যে গাছটির নাম ছিল ‘যাতু আনওয়াত’। মুশরিকগণ এ গাছের কাছে বরকতের জন্য ভক্তিভরে অবস্থান করত এবং তাদের অস্ত্রাদি বরকতের জন্য ঝুলিয়ে রাখত। আমাদের কিছু মানুষ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, মুশরিকদের যেমন ‘যাতু আনওয়াত’ আছে আমাদেরও অনুরূপ একটি ‘যাতু আনওয়াত’ নির্ধারণ করে দেন। আমরা যখন এ কথা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বললাম, তিনি বললেন, আল্লাহু আকবার! আল্লাহর কসম, মূসার কওম যেরূপ বলেছিল: মুশরিকদের মূর্তির মতো আমাদেরও মূর্তির দেবতা দাও[2], তোমরাও সেইরূপ বললে। যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর কসম, তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তীদের সুন্নাত অনুসরণ করবে।’’[3]
ইহূদী-খৃস্টানদের এরূপ তাবার্রুক বিষয়ক যে শিরকের কথা হাদীস শরীফে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো নবী ও অলীগণের স্মৃতিবিজড়িত স্থান বা কবর মাজার থেকে বরকত লাভের চেষ্টা। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ বিষয়ে তাদের নিন্দা করেছেন এবং তাঁর উম্মাতকে এরূপ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। অনেক সাহাবী থেকে এ অর্থে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এ অর্থের কয়েকটি হাদীস আমরা ইতোপূর্বে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরিচয় ও জীবনী বিষয়ক আলোচনায় উল্লেখ করেছি। আমরা দেখেছি, এরূপ এক হাদীসে তিনি বলেন, ‘‘তোমরা মনোযোগ দিয়ে শোন! তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মানুষেরা তাদের নবীগণ ও ওলীগণের কবরকে মসজিদ (ইবাদতগাহ) বানিয়ে নিত। তোমরা সাবধান! তোমরা কখনো কবরকে মসজিদ বানিয়ে নেবে না, নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে নিষেধ করছি এ কাজ থেকে।’’ ...
এখানে লক্ষণীয় যে, কবর বা কবরস্থের পূজা নয় বা মৃতের কাছে চাওয়া নয়, কবরের কাছে মসজিদ বানানো বা সালাত আদায়ের জন্য রাসূলুল্লাহ(ﷺ) ইহুদি-নাসারাদেরকে কঠিন ভাষায় অভিশাপ করেছেন। মসজিদ ও মসজিদ কেন্দ্রিক সকল কর্ম আল্লাহর ইবাদত। অথচ আল্লাহর ইবাদত করার জন্য তিনি ঐসব জাতিকে লা’নত করলেন, শুধুমাত্র কবরের কাছে এই ইবাদতগুলি পালন করার কারণে। মসজিদ আল্লাহর ইবা্দতের জন্য। মসজিদে সালাত, দু‘আ ইত্যাদি যা কিছু করা হয় সবই আল্লাহর জন্য। মৃতের জন্য কিছুই নয়। কবরের নিকট মসজিদ বানানোর উদ্দেশ্য কবরবাসীর জন্য সালাত আদায় নয়, বরং আল্লাহর জন্য সালাত আদায়ে নেককার মানুষের সাহচার্য ও বরকত লাভ মাত্র। কিন্তু এরূপ তাবার্রুকের চিন্তাই শিরকের অন্যতম পথ। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কঠোরভাবে এরূপ করতে নিষেধ করেছেন।
[2] সূরা (৭) আ’রাফ: ১৩৮ আয়াত।
[3] ইবনু আবী আসিম, আস-সুন্নাহ, পৃ. ৩৭; তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৪৭৫। হাদীসটি সহীহ।