বিদআতের শাব্দিক অর্থ
দ্বীন পরিপূর্ণ হওয়ার পর তাতে নতুন কিছু প্রবর্তিত হওয়া, অথবা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইনতিকালের পর দ্বীনের মধ্যে ইবাদতের নামে মনগড়া কিছু রসম-রেওয়াজ চালু করা। বিদআত শব্দের মূল ধাতু হল بدع এর অর্থ কোন উপমা ছাড়াই নতুন কিছু সৃষ্টি করা।[1]
যেমন- কুরআনে এসেছে, بَدِيْعُ السََّمَوتِ وَ اْلأَرْضِ
অর্থ : আসমান ও জমিন সৃষ্টিকারী।[2]
পারিভাষিক অর্থ
ওলামায়ে কেরাম বিদআতের বিভিন্ন সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন, যা একটি অপরটির পরিপূরক।
১. শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেনঃ দ্বীনের মধ্যে বিদআত হচ্ছে এমন আমল, যা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলামে প্রবর্তন করেননি এবং মুস্তাহাব বা ওয়াজিব হিসেবেও এর কোন অনুমোদন দেননি।[3]
বিদআত সাধারণত দু’ প্রকার
ক. কথা ও বিশ্বাসের মধ্যে বিদআত ও খ. ইবাদাত ও কাজের মধ্যে বিদআত।
এখানে প্রথম প্রকার দ্বিতীয় প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম আহমদ রহ. ও অন্যান্য আলিমগণ স্বীয় মাযহাবে ঘোষণা দিয়েছেন যে, স্বভাব ও ইবাদতের সমষ্টির নাম আমল।
ইবাদত হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু এসেছে সে অনুযায়ী বিনীত হয়ে আমল করা।
স্বভাবের মূল হচ্ছে আল্লাহ যা নিষিদ্ধ করেছেন একমাত্র তাই ক্ষতিকর মনে করা।[4]
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেনঃ বিদআত হচ্ছে, ইবাদত এবং বিশ্বাসে কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মতের পরিপন্থী কাজ করা। যথা-খারেজী, রাফেজী, কাদরিয়া ও জাহমিয়াদের কার্যক্রম অথবা যারা মসজিদে জিকির আজকারের নামে নাচ-গানের অনুষ্ঠান করে তাদের অনুকরণ করা অথবা কুরআন ও হাদীস বিরোধী জীবন-যাপন করা।[5]
২. আল্লামা শাতবী রহ. বলেনঃ বিদআত হচ্ছে, দ্বীনের মধ্যে নব আবিস্কৃত বিষয়াবলী যা ইবাদতের সাদৃশ কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা ইবাদত নয়। এর দ্বারা আল্লাহর ইবাদত বেশি পরিমাণে করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।[6]
যারা স্বভাবগত কাজকে বিদআতের অন্তর্ভুক্ত মনে করে না এ সংজ্ঞা তাদের মতামত অনুযায়ী । তারা শুধুমাত্র শরীয়ত বহির্ভূত কাজকেই ইবাদত হিসেবে পালন করাকে বিদআত বলে। যারা স্বভাবগত কাজকে বিদআতের অন্তর্ভুক্ত করে; তারা বলেনঃ বিদআত হল, দ্বীনের মাঝে নব আবিস্কৃত বিষয় যা শরীয়তের কার্যক্রমের সাদৃশ এবং বিদআতি কার্যকলাপকে সাওয়াবের কাজ মনে করা।[7]
অতঃপর তিনি আরও একটি সংজ্ঞা বর্ণনা করেনঃ স্বভাবগত কাজকে অভ্যাস হিসেবে আমল করলে তা বিদআত হবে না কিন্তু তা যদি ইবাদত হিসেবে করা হয় কিংবা ইবাদত হিসেবে নামকরণ করা হয় তাহলে বিদআত হবে। এখানে তিনি দু’টি সংজ্ঞাকে একত্রে এনেছেন। স্বভাবগত বিষয় যা করা ইবাদত। যেমন, ক্রয়-বিক্রয়, বিবাহ-তালাক ও ভাড়া দেয়া ইত্যাদি। কেননা এগুলোতে কিছু শর্ত ও নিয়মাবলী রয়েছে যে সম্পর্কে মানুষকে কোন স্বাধীনতা দেয়া হয়নি।[8]
৩. হাফেয ইবনে রজব রহ. বলেন : বিদআত হচ্ছে, দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু বিষয় প্রচলন করা শরীয়তে যার কোন ভিত্তি নেই। শরীয়তে যার ভিত্তি আছে তা বিদআত হবে না।[9]
এমন প্রত্যেক বস্তু যা দ্বীনের অংশ হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয় অথচ ইসলামে এর কোন ভিত্তি নেই, তা স্পষ্ট ভ্রষ্টতা। দ্বীন ইসলাম এ সকল ভ্রষ্টতা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। চাই সেটা বিশ্বাসগত হোক বা বক্তব্যধর্মী অথবা কর্মমূলক। মোট কথা দ্বীন নব আবিস্কৃত বিদআত থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
সালফে সালেহীনের উক্তি মতে কতিপয় নব আবিস্কৃত বিষয়কে উত্তম বলা হয়েছে। এর দ্বারা আভিধানিক বিদআত বুঝানো হয়েছে, শরীয়তে নিষিদ্ধ বিদআত বুঝানো হয়নি।
যেমন- ক. উমর (রা) এর যুগে যখন রমযান মাসে লোকজন মসজিদে একজন ইমামের পিছনে তারাবীহর সালাত পড়ার জন্য একত্রিত হল, তখন তিনি বের হলেন এবং লোকজনকে এ অবস্থায় দেখে বললেন, এটা কতই না উৎকৃষ্ট বিদআত![10]
উমর (রা) এর এ কথার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইতিপূর্বে এ ধরণের কাজ আর কখনো সংঘটিত হয়নি, অথচ এটা শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত।
খ. রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমযান মাসে কিয়ামুল-লাইলের জন্য উৎসাহ প্রদান করেছেন। তাঁর জীবদ্দশায় লোকজন মসজিদে এসে কেউ জামাতে, কেউ একা কিয়ামুল লাইল তথা নফল সালাত আদায় করতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীদের নিয়ে মাঝে মাঝে জামাতে সালাত আদায় করতেন। তিনি ভবিষ্যত উম্মতের অক্ষমতার বিষয় ও পরে তা ফরজ করে দেয়ার আশংকায় তা আদায় করতে নিষেধ করেছিলেন।[11]
গ. অনুরূপ রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতকে খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতের অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর কিয়ামুল লাইল খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাত।[12]
বিদআত সাধারণত দু‘ধরণের :
১। কুফরী : যার মাধ্যমে উক্ত বিদআতপন্থী ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে।
২। ফাসেকী : যার মাধ্যমে উক্ত বিদআতপন্থী ইসলাম থেকে বের হবে না কিন্তু গুনাহগার হবে।[13]
[2] আনআমঃ ১০১
[3] ফতোয়া ইবনে তাইমিয়া : ৪/১০৭
[4] ফতোয়া ইবনে তাইমিয়া :৪/১৯৬
[5] ফতোয়া ইবনে তাইমিয়া : ১৮/৩৪৬
[6] আল-ইতিসাম - শাতেবী (র) : ১/৫৩
[7] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) : ১/৫০-৫৬
[8] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) :২/৫৬৮
[9] জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ২/১২৭
[10] বুখারী : ২০১০
[11] বুখারী : ২০১২
[12] জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম : ২/১২৯
[13] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) : ২/৫১৬
কোন আমলই আল্লাহ তাআলার নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তাতে দু‘টি শর্ত পাওয়া না যাবে।
এক. ইখলাছের সাথে ইবাদত করা, অর্থাৎ আমল বা ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য করা।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى. (متفق عليه)
অর্থঃ প্রত্যেক কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। মানুষ যে নিয়ত করবে তাই পাবে।[1]
দুই. সুন্নাতের অনুসরণ অর্থাৎ ইবাদতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাতের পূর্ণ অনুসরণ।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ. (مسلم)
অর্থঃ যে ব্যক্তি আমাদের পক্ষ থেকে স্বীকৃত নয় এমন কোন আমল করল, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।[2]
সুতরাং যার ঈমান ও আমল একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাত মোতাবেক হবে, তার সে আমল আল্লাহ্ তা’আলার নিকট গ্রহণযোগ্য হবে। আর যদি এ দু‘টি শর্ত বা কোন একটি পাওয়া না যায়, তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন :
(الفرقان :২৩) وَ قَدِمْنآَ إِلى مَاعَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَآءً مُّنْثُوْرًا
অর্থঃ আমি তাদের কর্মগুলোর প্রতি মনোনিবেশ করব, অতঃপর তা বিক্ষিপ্ত ধুলিকণায় পরিণত করে দেব।[3]
এ দু‘টো বিষয়ই আল্লাহ্ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
وَمَنْ أَحْسَنُ دِيْنًا مِّمَّنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلّهِ و هُوَ مَحْسِنٌ. (النساء : 125)
অর্থঃ যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পণ করে ও সৎ কর্ম করে, তার অপেক্ষা কার ধর্ম উৎকৃষ্ট?[4]
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র ইরশাদ করেনঃ
بَلَى مَنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَلَهُ أَجْرُهُ عِنْدَ رَبِّهِ وَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ. (البقرة : 112)
অর্থ : অবশ্য যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করেছে এবং সৎ কর্মশীল হয়েছে, তার জন্য স্বীয় রবের নিকট প্রতিদান রয়েছে এবং তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না।[5]
উমর (রা) বর্ণিত إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ অর্থঃ ‘‘প্রতিটি কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল’’ হাদীসটি আন্তরিক আমল বা কার্যাবলীর মানদন্ড। আর উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা) বর্ণিত, مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ অর্থঃ ‘‘যে ব্যক্তি আমাদের পক্ষ থেকে স্বীকৃত নয় এমন কোন আমলের প্রচলন করল, তা প্রত্যাখ্যাত হবে’’। হাদীসটি বাহ্যিক আমল বা কার্যাবলীর মানদন্ড।
এ দু’টি হাদীসের মধ্যে দ্বীনের সকল বিষয় তথা মৌলিক ও শাখা-প্রশাখা বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সকল কথা বা কাজ সম্পর্কে দিক নির্দেশনা রয়েছে।
ইমাম নববী রহ. আয়েশা (রা) এর হাদীসের উপর একটি মূল্যবান কথা বলেছেন। তিনি বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বাণী :
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ অর্থঃ ‘‘যে ব্যক্তি আমাদের পক্ষ থেকে স্বীকৃত নয় এমন কোন আমলের প্রচলন করল, তা প্রত্যাখ্যাত হবে’’। দ্বিতীয় বর্ণনায় এসেছে, مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ অর্থঃ ‘‘যে ব্যক্তি আমাদের পক্ষ থেকে স্বীকৃত নয় এমন কোন আমল করল, তা প্রত্যাখ্যাত হবে’’। হাদীসদ্বয়ে উল্লেখিত শব্দ সম্পর্কে আরবগণ বলেনঃ الرد শব্দটা এখানেمردود তথা প্রত্যাখ্যাত অর্থে। যার প্রকৃত অর্থ হচ্ছেঃ যে আমল রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পক্ষ থেকে অনুমোদিত নয় তা বাতিল, প্রত্যাখ্যাত ও অগ্রহণযোগ্য। এ হাদীসটি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি উসূল বা মূলনীতি। এর মাধ্যমে সকল প্রকারের বিদআত, নব আবিস্কৃত ও বানোয়াট বিষয়াবলীর মূলোৎপাটন করা হয়েছে।
তবে আয়েশার (রা) বর্ণনা দু’টির প্রথমটিতে من أحدث ও দ্বিতীয়টিতে من عمل শব্দ এসেছে। এ হাদীসদ্বয়ের মাধ্যমে সকল প্রকার বিদআতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন, কেউ পূর্ব প্রবর্তিত বিদআত অনুযায়ী আমল করল কিন্তু সে নিজে এর প্রবর্তক নয়, তাহলে তাকে দ্বিতীয় হাদীসের আওতাভুক্ত বলা হবে। মোট কথা সকল প্রকার বিদআত চাই সেটা আমল করা হোক বা প্রবর্তন করা হোক, সবই পথভ্রষ্টতার শামিল ও প্রত্যাখ্যাত।[6]
[2] মুসলিম : ১৭১৮
[3] ফুরকানঃ ২৩
[4] নিসা : ১২৫
[5] বাকারা : ১১২
[6] ইমাম নববীর শরহে মুসলিম : ১৪/২৫৭
বিদআতের নিন্দা বা তিরস্কার সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে অনেক বর্ণনা এসেছে। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ বিদআত থেকে বিরত থাকার জন্য বিভিন্নভাবে সতর্কতা প্রদর্শন করেছেন। সংক্ষেপে তা আলোচনা করা হলঃ
দ্বীনের মধ্যে বিদআতের নিন্দা
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
هُوَ الَّذِيْ أَنزَلَ عَلَيْكَ الكِتَابَ مِنْهُ أياتٌ مُّحْكَمَاتُ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابَهَاتُ فَأَمَّا الّذِّيْنَ فِى قُلُوبِهِمْ زَيْغُ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَآءَ تَأْوِيْلِهِ وَمَا يَعْلُمُ تَأْوِيْلَهُ إِلاَّ اللهُ. (آل عمران:7)
অর্থঃ তিনিই আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যাতে অকাট্য আয়াতসমূহ রয়েছে ওগুলো কিতাবের মূল। এ ছাড়া কতিপয় আয়াত অস্পষ্ট। অতএব যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে, মূলতঃ তারাই অশান্তি সৃষ্টি ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে অস্পষ্টের অনুসরণ করে। আর আল্লাহ্ ব্যতীত এর প্রকৃত অর্থ অন্য কেউ অবগত নয়।[1]
ইমাম শাতেবী রহ. এর সমর্থনে কিছু আসর (সাহাবীদের উক্তি) পেশ করেছেন। যদ্বারা বুঝা যায়, উক্ত আয়াতটি কুরআনের বক্তব্য নিয়ে যারা বিতর্ক করে তথা খারেজী বা তাদের সমগোত্রীয়দের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :
وَأَنَّ هَذاَ صِِرَاطي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلاَ تَتَّبِعُواْ السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيْلِهِ ذَلكُمْ وَصّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ. (الأنعام: 153)
অর্থঃ এ পথই আমার সরল পথ, সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ কর। এ পথ ছাড়া অন্য কোন পথের অনুসরণ করবে না। কারণ তা তোমাদেরকে হেদায়াতের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। আল্লাহ তোমাদের এ নিদের্শ দিলেন যেন তোমরা সতর্ক হও।[2]
সুতরাং সিরাতে মুস্তাকীম হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত সহজ সরল ও সঠিক পথ। যে পথের দিকে উক্ত আয়াতে আহবান করা হয়েছে। এটাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাত তথা জীবনাদর্শ। আর সুবুল বা বিভিন্ন রাস্তা হচ্ছে (দ্বীনের মধ্যে) মতানৈক্য ও বিদআত সৃষ্টিকারীদের পথ। উপরোক্ত আয়াতে সকল প্রকারের বিদআত সৃষ্টিকারীদের পথ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
وَعَلَى اللهِ قَصْدُ السَّبِيلِ وَ مِنْهاَ جَآئِرٌ وَلَوْ شَآءَ لَهَداكُمْ َأجْمَعِيْنَ. (النحل:9)
অর্থঃ সরল পথ আল্লাহর নিকট পৌছার মাধ্যম, কিন্তু কিছু বক্র পথও রয়েছে; তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সকলকে সৎপথে পরিচালিত করতেন।[3]
কাস্দুস সাবিল হচ্ছে সত্যের পথ, এর বাইরের সকল পথ সত্য হতে বিচ্যুত এবং তা বিদআতে পরিপূর্ণ ও ভ্রান্ত।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
إِنَّ الذِّيْنَ فَرَّقُواْ دِينَهُمْ وَكَانُواْ شِيَعًا لَّسْتَ مِنْهُمْ فِى شَييء إِنَّمَآ أَمْرُهُمْ إِلَى اللهِ ثُمَّ يُنَبِّئُِِهُمْ بِمَا كَانوُاْ يَفْعَلُونَ.(الأنعام:159)
অর্থঃ নিশ্চয়ই যারা নিজেদের দ্বীনে মতভেদ সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন দলে- উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে, তাদের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের বিষয়টি আল্লাহর দায়িত্বে রয়েছে। পরিশেষে তিনিই তাদেরকে নিজ কর্মকান্ড সম্পর্কে অবহিত করবেন।[4]
এরাই হচ্ছে প্রবৃত্তির অনুসারী, পথভ্রষ্ট এবং বিদআত সৃষ্টিকারী।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَلاَ تَكُونُواْ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ مِنَ الَّذِيْنَ فَرَّقُواْ دِينَهُمْ وَكَانُواْ شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيهِمْ فَرِحُونَ . (الروم :31-32)
অর্থঃ তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। যারা নিজেদের দ্বীনের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উৎফুল্ল।[5]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
فَلْيَحْذَرِ الَّذِيْنَ يُخَالِفُوْنَ عَنْ أَمْرِه أَنْ تُصِيْبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيْبَهُمْ عَذَابٌ ألِيْمٌ . ( النور: 63)
অর্থঃ সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের এ ভয় করা উচিত যে, তাদের উপর বিপর্যয় আপতিত হবে অথবা কঠিন শাস্তি তাদের গ্রাস করবে।[6]
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
قُلْ هُوَ الْقاَدِرُ عَلَى أن يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَابًا مِّن فَوْقِكُمْ أَوْ مِن تَحتِ أَرْجُلِكُمْ أَوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعًا.(الأنعام: 65)
অর্থঃ হে রাসূল! বলুন, আল্লাহ তোমাদের উর্ধ্বদেশ অথবা তলদেশ হতে শাস্তি প্রেরণ করতে এবং তোমাদের বিভিন্ন দলে উপদলে বিভিক্ত করতে যথেষ্ট ক্ষমতাবান।[7]
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَلاَ يَزَالُونَ مُخْتَلِفِينَ، إِلاَّ مَن رَّحِمَ رَبُّكَ . (الهود: 118-119)
অর্থঃ আর তারা সদা-সর্বদা মতভেদ সৃষ্টি করতে থাকবে কিন্তু যার প্রতি আপনার রবের অনুগ্রহণ হয় (সে মতভেদ করবে না)।[8]
দ্বিতীয় : হাদীস
বিদআতের নিন্দা, তিরস্কার ও তা থেকে সতর্কতা প্রদর্শন করে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করা হলঃ
আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলছেনঃ
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ. وفي رواية مسلم مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ. (بخاري ومسلم)
অর্থঃ যে আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু প্রবর্তন করল, যা এর অন্তর্ভুনয় তা প্রত্যাখ্যাত। মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় রয়েছেঃ যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যা আমাদের পক্ষ থেকে অনুমোদিত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।[9]
জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বীয় জুমআর খুতবায় বলেছেনঃ
فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَخَيْرُ الْهُدَى هُدَى مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الْأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ. (مسلم)
অর্থঃ উত্তম বাণী হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার বাণী। আর উত্তম পথনির্দেশনা হচ্ছে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পথনির্দেশনা। নিকৃষ্টতম বিষয় হচ্ছে (দ্বীনের মধ্যে) নতুন নতুন বিধান ইবাদতের নামে প্রবর্তন করা, প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা।[10]
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুতবায় আল্লাহর প্রশংসা করার পর বলেনঃ
مَنْ يَهْدِهِ اللَّهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ وَمَنْ يُضْلِلْهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ إِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَأَحْسَنَ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الْأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ وَكُلُّ ضَلَالَةٍ فِي النَّارِ. (مسلم ونسائي)
অর্থঃ আল্লাহ্ যাকে হেদায়াত দান করেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না। আর তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার জন্য কোন পথ প্রদর্শনকারী নেই। নিশ্চয়ই সর্বাধিক সত্যবাণী হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার কিতাবের বাণী। আর সর্বোত্তম পথ হলো মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক প্রদর্শিত পথ। আর মন্দ বিষয়গুলো হলো (দ্বীনের মধ্যে) নবসৃষ্ট আমল বা কাজ। প্রত্যেক নবসৃষ্ট আমলই বিদআত। প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতাই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।[11]
আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنْ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلَالَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنْ الْإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا. (مسلم)
অর্থঃ যে ব্যক্তি (মানুষকে) হেদায়াতের দিকে আহবান করবে, সে হেদায়াতের পথ অনুসরণকারীর সমপরিমাণ সাওয়াব পাবে। এতে কারো সাওয়াব কম হবে না। আর যে ব্যক্তি (মানুষকে) পথভ্রষ্টতার দিকে আহবান করবে সে ঐ ভ্রষ্টপথ অনুসরণকারীর সমপরিমাণ গুনাহগার হবে। এতে কারো গুনাহ কম হবে না।[12]
জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা) বলেন :
مَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُ أَجْرُهَا وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا بَعْدَهُ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْءٌ وَمَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً سَيِّئَةً كَانَ عَلَيْهِ وِزْرُهَا وَوِزْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ بَعْدِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَيْءٌ. (مسلم)
অর্থঃ যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোন ভাল কাজের প্রচলন করল তার জন্য সে কাজের প্রতিদান রয়েছে এবং পরবর্তীতে যারা ঐ ভাল কাজের উপর আমল করল তা থেকেও সে প্রতিদান পাবে, এতে কারো প্রতিদান কম করা হবে না। এমনিভাবে যে ব্যক্তি কোন মন্দ কাজের প্রচলন করল তার আমলনামায় সে মন্দ কাজের গুনাহ রয়েছে এবং পরবর্তীতে উক্ত গুনাহে লিপ্তদের গুনাহও লিখা হবে। এতে কারো গুনাহ কম হবে না।[13]
ইরবাজ বিন সারিয়া (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :
وَعَظَناَرَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَوْعِظَة وَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوْبُ وَذَرَفَتْ مِنْهاَ الْعُيُوْنُ فَقُلْنَا: يَارَسُوْلَ اللهِ! كَأَنَّـهَا مَوْعِظَةُ مُوْدِعُ فَأَوْصِناَ قَالَ: أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ تُأَمَّرُ عَلَيْكُمْ عَبْدُ، فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالٌ. (أبوداود)
অর্থঃ একদা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের মাঝে এমন ভাষণ দিলেন যাতে আমাদের অন্তর বিগলিত হল এবং চক্ষু হতে অশ্রু প্রবাহিত হল, তখন আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! মনে হচ্ছে এ আলোচনা যেন বিদায়ী উপদেশ। সুতরাং আমাদের আরো কিছু ওসিয়ত করুন। তখন তিনি বললেনঃ আল্লাহকে ভয় কর, আমীরের কথা শোন এবং তার আনুগত্য কর; যদিও সে কৃতদাস হয়। আর যে ব্যক্তি আমার পর বেঁচে থাকবে সে অনেক মতানৈক্য দেখতে পাবে, সে সময় তোমাদের উচিত হবে আমার এবং আমার খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা যেমনি তোমরা কোন বস্ত্ত মাড়ির দাঁত দিয়ে মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধর। বিদআত পরিহার কর। কেননা সকল প্রকার বিদআতই পথভ্রষ্টতা।[14]
হুজাইফা (রা) হতে বর্ণিত :
كَانَ النَّاسُ يَسْأَلُونَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ الْخَيْرِ وَكُنْتُ أَسْأَلُهُ عَنْ الشَّرِّ مَخَافَةَ أَنْ يُدْرِكَنِي فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّا كُنَّا فِي جَاهِلِيَّةٍ وَشَرٍّ فَجَاءَنَا اللَّهُ بِهَذَا الْخَيْرِ فَهَلْ بَعْدَ هَذَا الْخَيْرِ مِنْ شَرٍّ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ وَهَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الشَّرِّ مِنْ خَيْرٍ قَالَ نَعَمْ وَفِيهِ دَخَنٌ قُلْتُ وَمَا دَخَنُهُ قَالَ قَوْمٌ يَهْدُونَ بِغَيْرِ هَدْيِي تَعْرِفُ مِنْهُمْ وَتُنْكِرُ قُلْتُ فَهَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الْخَيْرِ مِنْ شَرٍّ قَالَ نَعَمْ دُعَاةٌ عَلَى أَبْوَابِ جَهَنَّمَ مَنْ أَجَابَهُمْ إِلَيْهَا قَذَفُوهُ فِيهَا قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ صِفْهُمْ لَنَا قَالَ هُمْ مِنْ جِلْدَتِنَا وَيَتَكَلَّمُونَ بِأَلْسِنَتِنَا قُلْتُ فَمَا تَأْمُرُنِي إِنْ أَدْرَكَنِي ذَلِكَ قَالَ تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِينَ وَإِمَامَهُمْ قُلْتُ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُمْ جَمَاعَةٌ وَلَا إِمَامٌ قَالَ فَاعْتَزِلْ تِلْكَ الْفِرَقَ كُلَّهَا وَلَوْ أَنْ تَعَضَّ بِأَصْلِ شَجَرَةٍ حَتَّى يُدْرِكَكَ الْمَوْتُ وَأَنْتَ عَلَى ذَلِكَ. (متفق عليه)
অর্থঃ লোকজন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে কল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত, আর আমি অকল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম যাতে তা থেকে বেঁচে থাকতে পারি। কোন এক সময় আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা জাহেলিয়াত ও কুসংস্কারের মাঝে নিমজ্জিত ছিলাম, অতঃপর আল্লাহ আমাদের কল্যাণের পথ দেখালেন, এ কল্যাণের পরে কি আবার অকল্যাণ আসবে? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ; অতঃপর আবার জিজ্ঞেস করলাম, এ অকল্যাণের পর কি আবার কল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ; কিন্তু তার মধ্যে ফ্যাসাদ থাকবে। আমি বললাম, তার মধ্যে ফ্যাসাদ কি? তিনি বললেন, এক দল লোক সুন্নাতের অনুসারী হবে বটে, তবে তা আমার সুন্নাত নয়। তারা আমার সুন্নাত ছেড়ে অন্য মতাদর্শ গ্রহণ করবে, তাদের মাঝে সৎকর্ম এবং অসৎকর্ম উভয়টিই পাওয়া যাবে। আমি বললাম, এ কল্যাণের পরও কি আবার অকল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ; একদল লোক মানুষকে জাহান্নামের দিকে আহবান করবে, যারা তাদের ডাকে সাড়া দেবে তারা জাহান্নামের স্বাদ গ্রহণ করবে। অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের পরিচয় দিন। তিনি বললেন, তারা আমাদের স্ব-জাতি ও আমাদের ভাষাতেই কথা বলবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! ঐ সময় যদি আমি বেঁচে থাকি তাহলে আমার জন্য আপনার পরামর্শ কি? তিনি বললেন, তুমি মুসলিম জামাআত ও তাদের ইমামের অনুসরণ করবে। আমি বললাম, যদি তাদের জামাআত ও ইমাম না থাকে? তিনি বললেন, তাহলে সকল জামাআতই পরিত্যাগ করবে। যদি প্রয়োজন হয় কোন গাছের শিকড় ধরে আমরণ এভাবে পড়ে থাকবে।[15]
এ হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম নববী রহ. বলেন, هدي(হাদী) শব্দের অর্থ হল ত্বরীকা ও আদর্শ। আর জাহান্নামের দিকে আহবানকারী দল প্রসঙ্গে উলামায়ে কেরাম বলেন, তারা হল সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যারা মানুষকে বিদআতের দিকে আহবান করে। যেমন-খারেজী, কারামতী ও বস্ত্তবাদী দল।[16]
যায়েদ বিন আরকাম (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
أَلَا أَيُّهَا النَّاسُ فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ يُوشِكُ أَنْ يَأْتِيَ رَسُولُ رَبِّي فَأُجِيبَ وَأَنَا تَارِكٌ فِيكُمْ ثَقَلَيْنِ أَوَّلُهُمَا كِتَابُ اللَّهِ فِيهِ الْهُدَى وَالنُّورُ [هوحبل الله المتين من أتبعه كان على الـهدى ومن تركه كان على الضلالة] فَخُذُوا بِكِتَابِ اللَّهِ وَاسْتَمْسِكُوا بِهِ.(مسلم)
অর্থঃ হে লোকসকল! নিশ্চয়ই আমি একজন মানুষ, যখনই আমার রবের পক্ষ থেকে মৃত্যুদূত আসবে তখনই আমি তার আহবানে সাড়া দেব। আর আমি তোমাদের জন্য দু‘টি বস্ত্ত রেখে যাচ্ছি। তার একটি হল আল্লাহর কিতাব (অপরটি আমার সুন্নাত), যাতে রয়েছে হেদায়াত ও নূর। এটা আল্লাহর সুদৃঢ় রশি। যারাই এ কিতাব মেনে চলবে তারাই হেদায়াত পাবে। আর যারা তা ছেড়ে দেবে তারা পথভ্রষ্ট হবে। তোমরা আল্লাহর কিতাব সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর।[17]
এ হাদীসে আল্লাহর কিতাব মেনে চলার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।
আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
يَكُونُ فِي آخِرِ الزَّمَانِ دَجَّالُونَ كَذَّابُونَ يَأْتُونَكُمْ مِنْ الْأَحَادِيثِ بِمَا لَمْ تَسْمَعُوا أَنْتُمْ وَلَا آبَاؤُكُمْ فَإِيَّاكُمْ وَإِيَّاهُمْ لَا يُضِلُّونَكُمْ وَلَا يَفْتِنُونَكُمْ.(مسلم)
অর্থঃ শেষ জমানায় এমন কিছু মিথ্যাবাদী প্রতারকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা তোমাদের কাছে এমনসব হাদীস বর্ণনা করবে; যা তোমরা ও তোমাদের পূর্ব পুরুষ কোন দিন শোননি। অতএব তোমরা তাদের হতে দূরে থাক যাতে তারা তোমাদের গোমরাহী ও ফিতনায় ফেলতে না পারে।[18]
তৃতীয় : বিদআত সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামদের মতামত
১. ইবনে সা’দ রহ. আবু বকর সিদ্দিক (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেনঃ উপস্থিত জনতা! নিশ্চয়ই আমি সুন্নাতের অনুসারী বিদআতপন্থী নই। যদি আমি ভাল কাজ করি তাহলে আমাকে সাহায্য করবে, আর যদি ভুল করি তাহলে সংশোধন করে দিবে।[19]
২. ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) বলেন, তোমরা তর্কবীদদের থেকে দূরে থাক। কেননা তারা সুন্নাতের দুশমন এবং হাদীস অনুযায়ী আমলে অক্ষম। তারা মনগড়া মতামত বা রায় দিয়ে নিজেরাও গোমরাহ হয় অন্যকেও গোমারাহ করে।[20]
৩. আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, তোমরা সুন্নাতের অনুসরণ কর, বিদআতের অনুসরণ করবে না। এটাই তোমাদের জন্য যথেষ্ট। কেননা সকল প্রকার বিদআতই ভ্রষ্টতা।[21]
চতুর্থ : বিদআত সম্পর্কে তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীগণের অভিমত
১. ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহ. এক ব্যক্তির নিকট চিঠি লিখেছিলেন, তিনি তাতে বলেছিলেন, আমি তোমাকে আল্লাহর ভয়, তাঁর হুকুমের ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন, তাঁর নবীর সুন্নাতের অনুসরণ করা এবং কোন ব্যাপারে সুন্নাত প্রমাণিত হওয়ার পর তা ছেড়ে বিদআত গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিচ্ছি।[22]
২. হাসান বসরী রহ. বলেন, আমল ব্যতীত কোন কথা ছহীহ হবে না, নিয়ত ব্যতীত কোন কথা ও আমল ছহীহ হবে না এবং সুন্নাতের অনুসরণ ব্যতীত কোন নিয়ত, আমল ও কথা ছহীহ হবে না।[23]
৩. ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, তর্কবীদদের ব্যাপারে আমার ফায়সালা হল খেজুরের ডাল দ্বারা তাদের প্রহার কর, উটের উপর আরোহন করাও, প্রতিটি গোত্রের মধ্যে প্রদক্ষিণ করার কালে একথা বলতে থাক যে, এরা কুরআন ও সুন্নাত ছেড়ে তর্কশাস্ত্র গ্রহণ করেছে। তাই এটাই এর উপযুক্ত বদলা।[24]
৪. ইমাম মালেক রহ. বলেন, যে ইসলামে উত্তম মনে করে কোন বিদআত প্রচলন করল, সে যেন এ ধারণা পোষণ করল যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর রেসালতের দায়িত্বে খিয়ানত করেছেন। পক্ষান্তরে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃالْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ. অর্থঃ আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম।[25]
অতএব এ যুগান্তকারী ঘোষণা কালে যে আমল দ্বীন হিসাবে স্বীকৃত ছিল না, তা আজও দ্বীন হতে পারে না।[26]
৫. ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. বলেন, সুন্নাতের উসূল হল, রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীগণ যা করেছেন তা গ্রহণ করা, তাদের অনুকরণ করা ও বিদআত পরিত্যাগ করা। কেননা সকল বিদআতই ভ্রষ্টতা। তাই ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করা, প্রবৃত্তির অনুসারীদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা, লৌকিকতা পরিহার করা এবং দ্বীনের ব্যাপারে বিতর্কে না জড়ানো উচিত।[27]
পঞ্চম : বিদআত অগ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণ
১. একথা সত্য যে, মানুষের জ্ঞান অহীর জ্ঞান ব্যতীত অসম্পূর্ণ। নিশ্চয়ই বিদআত অহীর পরিপন্থী।
২. শরীয়ত পূর্ণাঙ্গ রূপে এসেছে, তাতে কম-বেশি করার কোন অবকাশ নেই।
৩. বিদআতপন্থী শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণকারী।
৪. বিদআতপন্থী প্রবৃত্তির অনুসারী। কেননা জ্ঞান-বুদ্ধি যদি শরীয়ত সম্মত না হয়, তাহলে তা প্রবৃত্তির অনুসরণেই হয়।
৫. বিদআতপন্থী নিজেকে শরীয়ত প্রবর্তকের (আল্লাহ তা‘আলার) স্থলাভিষিক্ত বানিয়ে নেয়। কেননা শরীয়ত প্রবর্তক তা প্রবর্তন করে সে অনুযায়ী আমল করা অত্যাবশ্যক করেছেন আর বিদআত প্রবর্তক শরীয়তে নতুন কিছু প্রবর্তন করে তাই করতে চাচ্ছে।[28]
[2] আনআম : ১৫৩
[3] নাহলঃ ৯
[4] আনআম : ১৫৯
[5] রূমঃ ৩১-৩২
[6] আন-নূরঃ ৬৩
[7] আনআমঃ ৬৫
[8] হুদঃ ১১৮-১১৯
[9] বুখারী : ২৬৯৭ ও মুসলিম : ১৭১৮
[10] মুসলিম : ৮৬৭
[11] মুসলিম : ৮৬৭ ও নাসাঈ : ১৫৭৮
[12] মুসলিম : ২৬৭৪
[13] মুসলিম : ১০১৭
[14] আবু দাউদ : ৪৭০৭ ও তিরমিযী : ২৬৭৬
[15] বুখারী : ৭০৮৪ ও মুসলিম :১৮৪৭
[16] শরহে মুসলিম : ১২/৪৭৯
[17] মুসলিম : ২৪০৮
[18] মুকাদ্দামায়ে মুসলিম : ৬ ও ৭
[19] আত-তাবাকাতুল কুবরা : ৩/১৩৬
[20] সুনানে দারেমী : ১২১
[21] আল মুজামুল কাবীর : ৮৭৭
[22] আবু দাউদ : ৪৬১২
[23] শরহে উসূলে ই‘তিকাদে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ : ১/৬৩ নং ১৮
[24] আল হিলইয়াহ লেখক আবু নাইম : ৯/১১৬
[25] মায়িদাঃ ৩
[26] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) : ১/৬৫
[27] শরহে উসূলে ই‘তিকাদে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ : ১/১৭৬
[28] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) : ১/৬১-৭০
বিদআত সৃষ্টির অনেকগুলো কারণ রয়েছে। যেমন-
(১) অজ্ঞতা
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَلاَ تَقفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفؤَاد كُلُّ أُؤُلَئِكَ كَانَ عَنهُ مَسْئُولاً.(الإسراء : 36)
অর্থঃ যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই কর্ণ, চক্ষু, হৃদয় এর প্রত্যেকটির ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে।[1]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنهاَ وَ مَا بَطَنَ وَاْلإِثْمَ وَ الْبَغْيَ بَغَيْرِالْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُواْ بِاللّهِ مَالَمْ يُنَزِّلُ بِهِ سٌلْطَانًا وَ اَنْ تَقٌولُواْ عَلَى اللهِ مَا لاَ تَعْلَمُونَ. (الأعراف: 33)
অর্থঃ আপনি বলে দিন, প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা, পাপ, অসংগত বিরোধিতা এবং কোন কিছুকে আল্লাহর সাথে শরিক করা, যার স্বপক্ষে আল্লাহ কোন দলিল অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যে ব্যাপারে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই, এ সবই আমার রব নিষিদ্ধ করেছেন।[2]
আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছিঃ
إِنَّ اللهَ لَا يَنْتَزِعُ الْعِلْمَ مِنَ النَّاسِ اِنْتِزَاعًا، وَلكِنْ يَقْبَضُ الْعُلَماَءَ فَيُرْفَعُ الْعِلْمُ مَعَهُمْ، وَيُبْقي فِيْ النَّاسِ رُؤُوْسًا جُهّالاً يَفْتُوْنَ بِغَيْرِ عِلْمٍ فَيَضَِلُّوْنَ وَ يُضِِلُّوْنَ .(متفق عليه)
অর্থঃ আল্লাহ মানুষ থেকে (দ্বীনি) জ্ঞান ছিনিয়ে নেবেন না বরং আলেমগণকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নিবেন, তাদের সাথে ইল্মও উঠে যাবে। দুনিয়াতে মুর্খ নেতারা বেঁচে থাকবে তারা (কুরআন-হাদীসের) ইল্ম ব্যতীত ফতোয়া দিবে। ফলে নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে, অন্যদেরও পথভ্রষ্ট করবে।[3]
(২) প্রবৃত্তির অনুকরণ
প্রবৃত্তির অনুকরণ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর যা মানুষকে বিদআত সৃষ্টিকারী ও আত্মপুজারী বানিয়ে দেয়।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
يَادَاودُ إِنّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِى الاَرْضِ فَاحْكٍََُِِِمِِِْْْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَ لاَ تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِِِلَّكَ عَن سَبِيلِ اللهِ إِنَّ الَّذِينَ يَِضلُّوْنَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدُ بِماَ نَسُواْ يَوْمَ الْحِساَبِ. (ص: 26)
অর্থঃ হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি। অতএব তুমি মানুষের মাঝে সুবিচার কর এবং প্রবৃত্তির (খেয়াল খুশির) অনুসরণ কর না। কেননা এটা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করবে। যারা আল্লাহর পথ পরিত্যাগ করে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। কেননা তারা বিচার দিবসকে ভুলে গেছে।[4]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا. (الكهف: 28)
অর্থঃ আপনি তার অনুসরণ করবেন না যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে অমনোযোগী করে দিয়েছি। সে আপন প্রবৃত্তির অনুসরণ করে ও তার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে।[5]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
أَفَرَءَيتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَ قَلْبَهِ و جَعَلَ عَلَى بَصَرَهِ غِشوَةً فَمَن يَهْدِيهِ مِنْ بَعْدِ اللهِ أَفَلاَ تَذَكَّرُونَ .(الجاثية: 23)
অর্থঃ আপনি কি ঐ ব্যক্তির দিকে লক্ষ্য করেছেন, যে প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে। আল্লাহ যথার্থই তাকে বিভ্রান্ত করেছেন, তার কর্ণ ও হৃদয়ে মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন এবং তার চোখের উপরে রেখেছেন আবরণ। অতঃপর আল্লাহর পর কে তাকে পথ নির্দেশ করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?[6]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَمَنْ أَضَلُّّّ مِمَّنِ اتَّبَع هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِّّنَ اللهِ.( القصص: 50)
অর্থঃ আল্লাহর পক্ষ হতে হেদায়াত ব্যতীত যে আত্মপুজারী হয়, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে?[7]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
إِن يَتَّبعُونَ إِلاَّ الظَنَّ وَمَا تَهْوَى اْلأَنْفُسُ وَلَقَدْ جَآءَهُمْ مِّن رَّبِّهُمْ الْـهُدى.(النجم: 23)
অর্থঃ তারা তো অনুমান এবং নিজেদের প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে, অথচ তাদের নিকট আপন রবের পথ নির্দেশ এসেছে।[8]
(৩) সন্দিহান হওয়া
বিদআতপন্থী সন্দেহের বশবর্তী হয়ে বিদআতে জড়িয়ে পড়ে।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتاَبَ مِنْهُ أياتٌ مُّحْكَماتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَاب وَأَخَرُ مُتَشَابِهاتٌ فَأَمّا الَّذِينَ فِى قُلُوبِهِمْ زَيَغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَآءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَآءَ تَأْوِيْلِهِ، وَ مَايَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلاَّ اللهُ وَالرَّاسِخُونَ فِى الْعِلْمِ يَقٌولٌوْنَ أمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِّنْ عِند رَبّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلآَّ أُولُواْ الأَلْبَابِ. (آل عمران: 7)
অর্থঃ তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন যাতে সুস্পষ্ট ও অ^কাট্য আয়াতসমূহ রয়েছে। ওগুলো কিতাবের মূল আর কিছু আয়াত অস্পষ্ট। অতএব যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে তারাই অশান্তি সৃষ্টি ও (ইচ্ছামত) ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে অস্পষ্টের অনুসরণ করে। অথচ আল্লাহ ব্যতীত এর অর্থ কেউই জানে না। যারা জ্ঞানী তারা বলে, আমরা এতে বিশ্বাস করি। সবই আমাদের রবের নিকট হতে আগত। জ্ঞানীরা ব্যতীত কেউই উপদেশ গ্রহণ করে না।[9]
(৪) যুক্তির উপর নির্ভর করা
যে ব্যক্তি আকল বা যুক্তির উপর নির্ভর করে এবং কুরআন ও সুন্নাহ ছেড়ে দেয় অথবা কোন একটি ছেড়ে দেয়, সে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ مَآ أتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوهُ وَمَا نَـهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُواْ وَاتَّقُواْ اللهَ إنَّ اللهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ.(الحشر: 7)
অর্থঃ রাসূল তোমাদের জন্য যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ কর এবং যা হতে নিষেধ করেছেন তা হতে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।[10]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِن وَ لاَ مُؤمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَ رَسوُلُه أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمْ الْخيَرَةُ مِنْ أَمْرِِهِمْ وَمَن يَعْصِ اللهَ ورَسَولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاً مُّبِينًا.(الأحزاب : 36)
অর্থঃ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল যদি কোন ব্যাপারে ফায়সালা করেন তখন কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর জন্য নিজেদের ব্যাপারে (অন্য কোন) সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার থাকবে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর হুকুমের অবাধ্য হল সে সুস্পষ্ট পথভ্রষ্ট হয়ে গেল।[11]
(৫) অন্ধ অনুকরণ ও গোঁড়ামী
অধিকাংশ বিদআতপন্থী তাদের পূর্ব পুরুষ ও পীর-মাশায়েখদের তাকলীদ তথা অন্ধ অনুকরণ এবং নিজ মাজহাবের ব্যাপারে গোঁড়ামী করে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ اتَّبِعُواْ مَآ أَنزَلَ اللهُ قاَلُواْ بَلْ نَتَّبِعُ مَآ أَلْفَيْنَا عَلَيهِ آبَاءَنَا.(البقرة : 170)
অর্থঃ যখন তাদের বলা হয়, তোমরা আল্লাহর কিতাবের অনুসরণ কর; তখন তারা বলে, বরং আমরা তারই অনুসরণ করব যার উপর আমাদের পিতৃপুরুষদের পেয়েছি।[12]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
بَلْ قاَلُوآْإِنّاوَجَدْنَآ آبَاءَنَا عَلَى أُمّـةٍ وَ اِنَّا عَلَى آثَارهِمْ مُّهْتَدُونَ.(الزخرف : 22)
অর্থঃ বরং আমরা পূর্বপুরুষদের একটি মতাদর্শের উপর পেয়েছি এবং তাদের পথ ধরেই আমরা হেদায়াত প্রাপ্ত হব।[13]
বিদআতপন্থীদের নিকট তাদের বিদআতী কর্মকান্ড আকর্ষণীয় করে দেয়া হয়।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
أَفَمَن زُيِّنَ لَهُ سُوءُ عَمَلِهِ فَرَءَاهُ حَسَنًا فَإِنَّ اللهَ يُضِلُّ مَن يَشَآء وَ يَهْديْ مَنْ يَّشَاءُ فَلاَ تَذْهَبْ نَفْسُكَ عَلَيْهِمْ حَسَرَاتٍ إِنَّ اللهَ عَلِيمٌ بِمَا يَصْنَعُونَ. (الفاطر: 8)
অর্থঃ কাউকে যদি তার মন্দ কর্ম সুন্দর করে দেখানো হয় তখন সে ওটাকে উত্তম মনে করে। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা গোমরাহ করেন এবং যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দান করেন। অতএব আপনি তাদের জন্য আক্ষেপ করে নিজ প্রাণকে ধ্বংস করবেন না। তারা যা করে আল্লাহ্ সে সম্পর্কে সম্মক জ্ঞাত।[14]
বিদআতপন্থীর পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
يَوْمَ تُقَلَّبُ وَجُوهُهُمْ فِىالنَّارِ يَقُولُونَ يَالَيْتَنَآ أَطَعْنَا اللهَ وأَطَعْنَا الرَّسُولا. وَقَالُواْ رَبَّنَا إنَّآ أَطَعْنَا سَادَتنَا وَكَبُرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السّبِيلا. رَبَّنَآ ءَاتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذاَبِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيْرًا.(الأحزاب:66-68)
অর্থঃ যে দিন তাদের মুখমণ্ডল অগ্নিতে উলট পালট করা হবে সে দিন তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করতাম! তারা আরো বলবে, হে আমাদের রব! আমরা নিজ নেতা ও বড়দের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের রব! তাদের দ্বিগুণ শাস্তি প্রদান করুন ও তাদের উপর লানত বর্ষণ করুন।[15]
(৬) বিদআতপন্থীদের সংশ্রব ও তাদের সাথে উঠা বসা করা
বিদআতপন্থীদের সঙ্গ দেয়া ও তাদের সাথে উঠা বসা করার দ্বারাও সমাজে বিদআত প্রচার-প্রসার লাভ করে। আল্লাহ তা‘আলা বিদআতের অনুসারীদের সংশ্রবকে নিন্দনীয় বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَيَوْمَ يَعضُّ الظَّالِم عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَالَيْتَنِيْ اتّّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِِ سَبِيلاً. يَاوَيْلَتَي لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيلاً. لَّقَدْ أَضَلّنِى عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَآءَنِى وَكَان الشَّيْطَانُ لِلإِنْساَنِ خَذُولاً.(الفرقان: 27-29)
অর্থঃ যালিমরা সে দিন নিজ হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে হায়! আমি যদি রাসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম। হায়! দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধু রূপে গ্রহণ না করতাম। আমার নিকট উপদেশ পৌঁছার পর সে আমাকে বিভ্রান্ত করেছিল । শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক।[16]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَإِذَا رَأْيَتَ الذِّيْنَ يَخُوضُونَ فِي ءَايَاتِنَا فَأَعْرَضَ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوَضُواْ فِى حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنسِيَنَّكَ الشِّيْطَانُ فَلاَ تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِيْنَ. (الأنعام : 68)
অর্থঃ যখন আপনি দেখবেন লোকজন আমার আয়াতসমূহে দোষ-ক্রটি অনুসন্ধান করছে। তখন আপনি তাদের হতে দূরে সরে যাবেন, যতক্ষণ না তারা অন্য কোন প্রসঙ্গে নিমগ্ন হয়। শয়তান যদি এটা আপনাকে ভুলিয়ে দেয় তবে স্মরণ হওয়ার পর আর এ যালিমদের সাথে বসবেন না।[17]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَقَدْ نَزَّل عَلَيْكُمْ فِى الْكِتَاب أَنْ إِذَا سَمِعْتُمْ ءَاياتِ اللهِِ يُكْفَرُبِهَا وَ يُسْتَهْزَأُ بِهَا فَلاَ تَقْعُدُواْ مَعَهُمْ حتَّى يَخُوضُوْا فِى حَديْث غَيْرِهِ إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلَهُمْ إنَّّّ اللهَ جَامِعُ الْمُناَفِقِيْنَ وَالْكَافِرِيْنَ فِيْ جَهَنَّمَ جَمِيْعًا.(النساء: 140)
অর্থঃ নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের নির্দেশ করছেন যে, যখন তোমরা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি কারো অবিশবাস ও উপহাস করার কথা শুনবে, তখন তাদের সাথে বসবে না যে পর্যন্ত না তারা অন্য কথায় লিপ্ত হয়। অন্যথায় তোমরাও তাদের সাদৃশ হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুনাফিক ও কাফিরদের জাহান্নামে একত্রিত করবেন।[18]
রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
إِنَّمَا مَثَلُ الْجَلِيسِ الصَّالِحِ وَالْجَلِيسِ السَّوْءِ كَحَامِلِ الْمِسْكِ وَنَافِخِ الْكِيرِ فَحَامِلُ الْمِسْكِ إِمَّا أَنْ يُحْذِيَكَ وَإِمَّا أَنْ تَبْتَاعَ مِنْهُ وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ مِنْهُ رِيحًا طَيِّبَةً وَنَافِخُ الْكِيرِ إِمَّا أَنْ يُحْرِقَ ثِيَابَكَ وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ رِيحًا خَبِيثَةً.(بخاري ومسلم)
অর্থঃ নিশ্চয়ই সৎসঙ্গ ও অসৎসঙ্গের দৃষ্টান্ত হল মিশ্ক আম্বর বহনকারী ও কামারের ন্যায়। অতঃপর মিশ্ক বহনকারী হয়ত তোমাকে কিছু দেবে অথবা তুমি তার থেকে কিছু কিনবে। আর তা না হলে কমপক্ষে তার থেকে সুঘ্রাণযুক্ত বাতাস পাবে। আর কামার হাপরে ফুৎকারের মাধ্যমে হয়ত তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দেবে অথবা তার থেকে তুমি দূর্গন্ধময় বাতাস পাবে।[19]
(৭) আলেমদের নিশ্চুপ থাকা ও সঠিক ইল্ম গোপন করা
এটা লোক সমাজে বিদআত ও ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُون مَآ أَنزَلْنَا منَ الْبَيّنَاتِ وَالْهُدى مِن بَعْدِ مَابَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِىالْكِتَابِ أُولئِكَ يَلْعَنُهُمُ الله ويلعنهم اللاَّعِنُونَ إِلاَّ الَّذِينَ تَابُواْ وَأَصْلَحُواْ و بَيَّنُواْ فَأُوْلئِكَ أَتُوبُ عَلَيْهِمْ وَأنَا التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ. (البقرة: 159-160)
অর্থঃ আমি যে সকল ষ্পষ্ট নিদর্শন ও পথ-নির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, তা মানুষের নিকট প্রকাশ করার পরও যারা ঐ সকল বিষয় গোপন করে, আল্লাহ তাদের উপর লানত করেন এবং অভিসম্পাতকারীগণও লানত করে থাকেন। কিন্তু তারাই লানত থেকে মুক্ত যারা তাওবা করেছে, নিজেদের সংশোধন করেছে ও সঠিক বিষয় প্রকাশ করেছে। আমি তাদের তাওবা কবুল করি। আমিই তওবা গ্রহণকারী ও দয়ালু।[20]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَآ أَنزَلَ اللهُ مِنَ الْكِتَابِ وَ يَشْتَرُونَ بَهِ ثَمَنًا قَلِيلاً أولئك مَا يَأْكُلُونَ فِى بُطُونِهِمْ إِلاَّ النَّارَ وَلاَ يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ يُزَكِيهِمْ وَلَهُمْ عَذاَبٌ أَلِيْمُ.(البقرة-174)
অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ যা কিতাবে অবতীর্ণ করেছেন তা যারা গোপন করে ও সামান্য মূল্যে বিক্রি করে, তারা স্ব-স্ব উদরে অগ্নি ছাড়া আর কিছুই ভক্ষণ করে না। কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং এদের জন্যই রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।[21]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَاِذْ أَخَذَ اللهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُواْ الْكِتَابَ لَتُبَيِنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلاَ تَكْتُمُونَهُ فَنَبَذُوْهُ وَرَآءَ ظُهُورِهِمْ وَاشْتَرَوْا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلاً فَبِئْسَ مَا يَشْتَرُونَ.(آل عمران- 187)
অর্থঃ স্মরণ করুন, যখন আহলে কিতাবদের থেকে আল্লাহ্ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তোমরা নিশ্চয়ই এটা মানুষের কাছে প্রকাশ করবে, গোপন করবে না। এরপরও তারা তা অগ্রাহ্য করে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করলো। অতএব তারা যা ক্রয় করে তা কতই না নিকৃষ্ট।[22]
আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতের একটি দলের উপর দাওয়াত ইলাল্লাহ, সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা ওয়াজিব করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَلْتَكُنْ مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَ يَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُوْلئِكَ هُمُ المُفْلِحُـونَ. (آل عمران: 104)
অর্থঃ তোমাদের মধ্যে এরূপ একটি দল থাকা উচিত যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। এরাই সফলকাম।[23]
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِ. (مسلم)
অর্থঃ তোমাদের যে কেউ গর্হিত কাজ হতে দেখে, সে যেন তা হাত দ্বারা বাধা করে। যদি এ শক্তি না থাকে তাহলে যেন মুখ দ্বারা বাধা প্রদান করে, তাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে যেন অন্তরে ঘৃণা করে। এটা ঈমানের নিম্নতম স্তর।[24]
এ হাদীস দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক মুসলিমের উপর নিজের ক্ষমতা ও শক্তি অনুযায়ী সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা ওয়াজিব।
এছাড়াও আব্দুল্লাহ ইব্নে মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
مَا مِنْ نَبِيٍّ بَعَثَهُ اللَّهُ فِي أُمَّةٍ قَبْلِي إِلَّا كَانَ لَهُ مِنْ أُمَّتِهِ حَوَارِيُّونَ وَأَصْحَابٌ يَأْخُذُونَ بِسُنَّتِهِ وَيَقْتَدُونَ بِأَمْرِهِ ثُمَّ إِنَّهَا تَخْلُفُ مِنْ بَعْدِهِمْ خُلُوفٌ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ وَيَفْعَلُونَ مَا لَا يُؤْمَرُونَ فَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلْبِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنْ الْإِيمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ.
অর্থঃ আমার পূর্বে যত নবী এসেছেন তাদের প্রত্যেকেরই স্বীয় উম্মতের মধ্য থেকে কিছু সাথী এবং ঘনিষ্ঠ লোক ছিল। যারা তাঁর সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরত এবং তাঁর হুকুম মেনে চলত। পরবর্তীতে এমন এক প্রজন্ম এল, যারা যা বলত তা করত না এবং তারা এমন কাজ করত যার নির্দেশ ছিল না। যে ব্যক্তি সর্বশক্তি দিয়ে তাদের প্রতিরোধ করবে সে মুমিন, যে মৌখিকভাবে প্রতিবাদ করবে সে মুমিন এবং যে অন্তরে ঘৃণা করবে সেও মুমিন। এর বাইরে কারো অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান নেই।[25]
আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ مَنْ سُئِلَ عَنْ عِلْمٍ عَلِمَهُ ثُمَّ كَتَمَهُ أُلْجِمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِلِجَامٍ مِنْ نَارٍ (ترمذي, أبو داود و ابن ماجة)
অর্থঃ যদি কাউকে এমন বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয় যা সে জানে অতঃপর সে তা গোপন করে, তাহলে তাকে কিয়ামতের দিন আগুনের লাগাম পরানো হবে।[26]
(৮) কাফেরদের সাদৃশ অবলম্বন ও তাদের অনুসরণ করা
এটা মুসলিমদের মাঝে বিদআত ছড়ানোর বড় কারণ। এ বিষয়টি আবু ওয়াকেদ লাইছি রহ. বর্ণিত হাদীস দ্বারা বুঝা যায়। তিনি বলেন, আমরা রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে হুনাইনের দিকে রওয়ানা হলাম। আমরা বিগত দিনের কর্মকান্ড (কুফুরী) নিয়ে আলোচনা করছিলাম। কেননা তারা মক্কা বিজয়ের দিন মুসলমান হয়েছিলেন। তিনি বললেন, একটি গাছের সামনে দিয়ে অতিক্রম করতে গিয়ে আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্য একটি ‘‘জাতে আনওয়াত’’ (এক প্রকার গাছ মুশরিকরা যার পূজা করত) এর ব্যবস্থা করে দিন যেমনটি তাদের অর্থাৎ কাফেরদের জন্য রয়েছে। তাদের একটি বরই গাছ ছিল যার পার্শ্বে তারা নীরবে বসে উপাসনা করত এবং তাতে তাদের যুদ্ধের অস্ত্র ঝুলিয়ে রাখত। তারা এটাকে ‘‘জাতু আনওয়াত’’ বলত। যখন আমরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে একথা বললাম, তখন তিনি বললেন, আল্লাহু আকবার! তোমরা এমন কথা বলছ, যেমন বণী ইসরাইলের লোকেরা মূসা (আঃ) কে বলেছিল।
اجْعَل لَّنا إِلـهًاكَمَا لَهُمْ ءَالِهَةٌ قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ. (الأعراف: 138)
‘‘আপনি আমাদের জন্য মাবুদ নির্বাচন করুন, যেমন তাদের জন্য অনেক মা‘বুদ রয়েছে। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই তোমরা তো মূর্খ জাতি।[27]
তোমরা অবশ্যই পূর্ববর্তী লোকদের পথ অবলম্বন করবে।[28]
এ হাদীস থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়, যেমনি কাফিরদের সাদৃশ বনী ইসরাইলদের উপরোক্ত অসংগত প্রার্থনা করতে উৎসাহিত করেছিল তেমনি সাহাবীদেরকেও রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে আল্লাহ ছাড়া অন্যের দ্বারা বরকত হাসিলের উদ্দেশ্যে এমন একটি গাছের প্রার্থনা করতে উৎসাহিত করেছিল। এভাবেই অধিকাংশ মানুষ কাফিরদের অনুসরণ বা সাদৃশ অবলম্বন করতে গিয়ে বিদআত ও শিরকে লিপ্ত হয়। যথা- মিলাদ মাহফিল, জানাযা সংক্রান্ত বিদআত, কবরের উপর বিল্ডিং নির্মাণ ইত্যাদি। নিঃসন্দেহে এ সকল বিষয় বা পূর্ববর্তীদের অনুসরণ প্রবৃত্তি পূজা ও বিদআতেরই অন্তর্ভুক্ত।
এ বিষয়টি আবু সাঈদ খুদরী (রা) বর্ণিত হাদীস দ্বারা আরো স্পষ্ট হয়। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
لَتَتْبَعُنَّ سَنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ شِبْرًا شِبْرًا وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ حَتَّى لَوْ دَخَلُوا جُحْرَ ضَبٍّ تَبِعْتُمُوهُمْ قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى قَالَ فَمَنْ؟(متفق عليه)
অর্থঃ নিশ্চয়ই তোমরা পূর্ববর্তী লোকদের রীতিনীতির পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুকরণ করবে। এমনকি তারা যদি গুইসাপের গর্তে প্রবেশ করে থাকে, তাহলে তোমরাও তা করবে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! ইহুদী-খৃষ্টানদের? তিনি বলেন, তাদের ব্যতীত আর কাদের?[29]
ইমাম নববী রহ. বলেন, ‘‘السَنَنُ ’’ অর্থ রাস্তা। হাদীসের শব্দ شبر، ذراع و جحر الضب তথা বিঘত, হাত ও গুইসাপের গর্তে প্রবেশ দ্বারা এ উম্মতের পুর্বেকার লোকদের সাথে শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ ও অন্যায়ের মাঝে হুবহু মিল থাকার উপমা দেয়া হয়েছে, কুফরীতে মিল থাকার উপমা নয়। এ হাদীসের মাধ্যমে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মু‘জিযা বাস্তবায়িত হল। কেননা তিনি যে সংবাদ দিয়ে গেছেন, তা আজ সংঘটিত হচ্ছে।
প্রকাশ থাকে যে, বিঘত, হাত, রাস্তা ও গর্তে প্রবেশ এ সবই শরীয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ ও নিন্দিত বিষয়ে তাদের (কাফেরদের) অনুসরণ-অনুকরণ করার কারণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপমা হিসেবে তুলে ধরেছেন, অথচ তিনি অমুসলিমদের সাদৃশ অবলম্বন করতে কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
بُعٍثْتُ بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ بِالسَّيْفِ حَتّى يَعْبُدَ اللهَ وَحْدَه لَا شَرِيْكَ لَه، وَجَعَلَ رِزْقِيْ تَحْتَ ظِلِّ رَمْحِيْ وَجَعَلَ الذِلُّ وَالصِّغَارَ عَلى مَنْ خَالَفَ أَمْرِيْ، وَمَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ.
(أحمد)
অর্থঃআমি কিয়ামতের পূর্বে তরবারীসহ প্রেরিত হয়েছি যাতে (মানুষ) এক আল্লাহর ইবাদত করে যার কোন অংশিদার নেই। আর তিনি আমার জীবিকাকে বর্শার ছাঁয়ার নিচে রেখেছেন। যারা আমার দ্বীনের পরিপন্থী কাজ করবে তাদের জন্য রেখেছেন অপমান ও লাঞ্ছনা। আর যারা কোন জাতির সাদৃশ অবলম্বন করবে তারা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।[30]
(৯) দুর্বল ও বানোয়াট হাদীসের উপর নির্ভর করা
এ ধরণের হাদীসের উপর নির্ভর করার ফলে অধিকাংশ বিদআত সৃষ্টি হয় ও তার প্রচার-প্রসার ঘটে। অধিকাংশ বিদআতপন্থীই অনির্ভরযোগ্য, দুর্বল ও মিথ্যা হাদীসের উপর নির্ভর করে। তারা এমন হাদীসের উপর নির্ভরশীল যা হাদীস বিশারদগণের নিকট অগ্রহণযোগ্য। তারা সহীহ হাদীস পরিত্যাগ করে। যার ফলে অনিবার্য ক্ষতি, ধ্বংস ও বিপদে পতিত হয়। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সৎকর্ম সম্পাদন ও অসৎকর্ম পরিত্যাগ সম্ভব নয়।[31]
(১০) বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন
এটাও বিদআত প্রসারের অন্যতম কারণ এবং শিরকে লিপ্ত হওয়ারও কারণ। কেননা আদম (আঃ) এর পরবর্তী ১০ যুগ পর্যন্ত লোকজন তাওহীদ ও আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল। তারপর থেকে লোকজন তৎকালীন নেক্কার ব্যক্তিবর্গের দিকে ঝুঁকে গিয়ে তাদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন করতে করতে এক পর্যায়ে আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের ইবাদত শুরু করে দেয়। এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাওহীদের দিকে আহবান কল্পে নূহ (আঃ) কে প্রেরণ করেন, এরই সূত্র ধরে তাওহীদের বানী নিয়ে নবী-রাসূল (আঃ) প্রেরণের ধারাবাহিকতা শুরু হয়।
সীমালংঘন ব্যক্তি পর্যায়েও হতে পারে। যথা-ইমাম ও অলীদের নিষ্পাপ মনে করা এবং তাদেরকে প্রাপ্য মর্যাদার চেয়ে উঁচু মর্যাদায় আসীন করা। এ ধরণের বাড়াবাড়ির এক পর্যায়ে তাদের ইবাদতও করা হয়।
সীমালংঘন দ্বীনের মাঝেও হতে পারে। যথা-আল্লাহর দেয়া বিধানে অতিরঞ্জন অথবা কোন বিষয়ে কঠোরতা কিংবা অন্যায়ভাবে কাউকে কাফির বলে আখ্যায়িত করা।
সীমালংঘন বলতে বুঝায় : বিশ্বাস ও আমলের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করা। এটা কারো প্রশংসা বা দূর্নাম বর্ণনার ক্ষেত্রে অত্যধিক বাড়াবাড়ির ফলে হয়ে থাকে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করতে গিয়ে আহলে কিতাবদের উদ্দেশ্য করে বলেনঃ
يَااَهْلَ الكِتَابِ لاَ تَغْلُوأ فِى دِينِكُمْ. (النساء: 171)
অর্থঃ হে আহলে কিতাবরা! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করো না।[32]
তেমনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও দ্বীনের ব্যাপারে সীমালংঘন করতে নিষেধ করেছেন।
ইবনে আববাস (রা) বর্ণনা করেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
وَإِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ فِي الدِّينِ فَإِنَّمَا أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ الْغُلُوُّ فِِِي الدِّينِ.(نسائي)
অর্থঃ তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে সীমালংঘন থেকে বিরত থাক, কেননা তোমাদের পূর্ববতী লোকেরা দ্বীনের ব্যাপারে সীমালংঘন করার ফলে ধ্বংস হয়েছে।[33]
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দ্বীনের মধ্যে সীমালংঘনই শিরক ও বিদআত সৃষ্টি এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণের অন্যতম কারণ।
দ্বীনের মধ্যে সীমালংঘনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করতঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
لَا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ.(بخاري)
অর্থঃ তোমরা আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না যেমনিভাবে খ্রীষ্টানরা ঈসা ইবনে মারিয়াম (আঃ) কে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছিল। আমি আল্লাহর বান্দা, তাই আমাকে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল বলবে।[34]
[2] আ‘রাফঃ ৩৩
[3] বুখারী : ৭৩০৭ ও মুসলিম : ২৬৭৩
[4] ছোয়াদঃ ২৬
[5] কাহাফঃ ২৮
[6] জাছিয়াঃ ২৩
[7] কাছাছঃ ৫০
[8] নাজমঃ ২৩
[9] আলে-ইমরানঃ ৭
[10] আল-হাশর : ৭
[11] আহযাব : ৩৬
[12] আল-বাকারাঃ ১৭০
[13] যুখরুফঃ ২২
[14] ফাতির : ৮
[15] আহযাবঃ ৬৬-৬৮
[16] ফুরকানঃ ২৭-২৯
[17] আনআমঃ ৬৮
[18] নিসাঃ ১৪০
[19] বুখারী : ৫৫৩৪ ও মুসলিম : ২৬২৮
[20] বাকারাঃ ১৫৯-১৬০
[21] বাকারাঃ ১৭৪
[22] আলে-ইমরানঃ ১৮৭
[23] আলে-ইমরানঃ ১০৪
[24] মুসলিম : ৪৯
[25] মুসলিম : ৫০
[26] তিরমিযী :২৬৪৯ ও আবু দাউদ : ৩৬৫৮ ইবনে মাজাহ: ২৬৬
[27] আ‘রাফ : ১৩৮
[28] তিরমিযী : ২১৮০
[29] বুখারী : ৭৩২০ ও মুসলিম : ২৬৬৯
[30] আহমদ : ২/৫০
[31] ফতোয়া ইবনে তাইমিয়াঃ ২২নং খন্ড; ৩৬১-৩৬৩, ইতিসামঃ আল্লামা শাতেবী ১মঃ ২৮৭-২৯৪
[32] নিসাঃ ১৭১
[33] নাসাঈ : ৫/২৬৮
[34] বুখারী : ৩৪৪৫
বিভিন্ন দিক বিবেচনায় বিদআত কয়েক প্রকার। সংক্ষেপে তা নিম্নে তুলে ধরা হল
প্রথম প্রকার : হাকীকী বিদআত ও আপেক্ষিক বিদআত।
হাকীকী বা প্রকৃত বিদআত
তা হলো দ্বীনের মধ্যে এমন কাজ সংযোজন যার উপর কুরআন, হাদীস, ইজমা ও বিজ্ঞ আলেম-উলামাদের নিকট সংক্ষিপ্ত বা বিস্তারিত কোন দলিল-প্রমাণ নেই। বিদআতকে এজন্যই বিদআত বলা হয়, কেননা তা দ্বীনের মাঝে নব আবিষ্কার।[1]
উদাহরণ : বৈরাগ্যবাদের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য কামনা করা। অর্থাৎ মানব সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গলে অবস্থান, আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে দুনিয়া ও দুনিয়ার নিয়ামত ত্যাগ করা ইত্যাদি। যারা এমন করে তারা মনগড়া ইবাদত করে এবং তা নিজের উপর বাধ্য করে নেয়। যেমন-আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় হালাল বস্ত্তকে হারাম করে নেয়া ইত্যাদি।[2]
আপেক্ষিক বিদআত
আপেক্ষিক বিদআতের দু‘টি দিক বা শাখা রয়েছে।
একঃ এ ধরণের বিদআতের ক্ষেত্রে প্রমাণাদি থাকে, এ বিবেচনায় এটা বিদআত হবে না।
দুইঃ এর সাথে বিদআতের সংশ্লিষ্টতা নেই বরং তাতে প্রকৃত বিদআতের সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে। অর্থাৎ এক দিক বিবেচনায় প্রমাণাদির সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকার কারণে এটা সুন্নাত হিসেবে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে অন্য দিক বিবেচনায় প্রমাণাদির সাথে সংশ্লিষ্টতা না থাকার কারণে বিদআত হিসেবে গণ্য হবে। কারণ এর মাঝে সন্দেহ ও সংশয় রয়েছে, গ্রহণযোগ্য কোন প্রমাণ নেই।
অর্থের দিক থেকেও উভয়ের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। মৌলিকত্বের দিক থেকে প্রমাণাদি আছে। আর অবস্থার, পরিস্থিতির অথবা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দিক থেকে প্রমাণাদি নেই। কেননা তা ইবাদতের মধ্যে সংযোজিত হলে বিদআত হবে, শুধু অভ্যাস গত হলে বিদআত হবে না। যেমন-সালাতের পর সম্মিলিতভাবে সমস্বরে যিকির করা কিংবা সালাতের পর ইমাম কর্তৃক সম্মিলিত দু‘আ জরুরী মনে করা।
যিকির করা শরীয়ত সিদ্ধ। কিন্তু বিশেষ পদ্ধতি বা ভংগিতে তা আদায় করা শরীয়ত সম্মত নয়। তা বিদআত ও সুন্নাত পরিপন্থী।[3]
এমনিভাবে শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে ইবাদত ও তৎপরবর্তী দিনকে সিয়ামের জন্য নির্ধারিত করা। রজব মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে সালাতে রাগায়েব (উৎসাহমূলক সালাত) আদায় করা। এটা কুসংস্কার ও আপেক্ষিক বিদআত। কেননা সালাত, সিয়াম এগুলো মৌলিকভাবে শরীয়ত সম্মত। কিন্তু এটা সময়, স্থান বা অবস্থার সাথে নির্দিষ্ট করার কারণে বিদআত হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। কারণ কুরআন ও হাদীসে তা এভাবে বর্ণিত হয় নি।
মূল কথা হলঃ এসব আমল মৌলিক দিক বিবেচনায় শরীয়ত সম্মত, তবে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে বিদআত।
দ্বিতীয় প্রকারঃ কর্মমূলক ও বর্জনমূলক বিদআত।
১. কর্মমূলক বিদআতঃ যা বিদআতের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। এটা দ্বীনের মধ্যে নব আবিস্কৃত ও শরীয়তের সাথে সামঞ্জস্যশীল। এর দ্বারা ইবাদতে আধিক্য উদ্দেশ্য থাকে। যেমন, শরীয়ত বহির্ভূত বিষয় শরীয়তে সংযোজন করা। যেমন, সালাতে রাকাত বৃদ্ধি করা, দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু প্রবিষ্ট করা যা দ্বীনের মধ্যে নেই, সুন্নাহর বিপরীত পদ্ধতিতে ইবাদত করা, শরীয়ত সম্মত ইবাদতের জন্য এমন সময় নির্ধারণ করা যা শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত নয়। যেমন শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে ইবাদত করা ও পরবর্তী দিনকে সিয়ামের জন্য নির্ধারণ করা।[4]
২. বর্জনমূলক বিদআতঃ যা বিদআতের সংজ্ঞার ব্যাপকতার অন্তর্ভুক্ত। তা হল দ্বীনের মধ্যে নব আবিস্কৃত পন্থা, যা বিদআত। সুতরাং বিদআত কখনও কোন কিছু পরিহার করার মাধ্যমে হয়, চাই তা নিজের উপর হারাম করা হোক বা না হোক। যেমন-শরীয়ত কর্তৃক হালাল বিষয়কে নিজের উপর হারাম করা, অথবা ইচ্ছাপূর্বক কোন বস্ত্ত বর্জন করা। এ বর্জন শরীয়ত অনুমোদিত বা অনুমোদনহীন হতে পারে। অতএব যদি তা শরীয়ত অনুমোদিত কোন বিষয়ে হয় তাহলে তাতে কোন ক্ষতি নেই। কেননা সে শরীয়ত কর্তৃক বৈধ বিষয় পরিহার করেছে। যেমন কেউ শরীর অথবা মেধা অথবা দ্বীন অথবা এ জাতীয় কোন কিছুর জন্য ক্ষতিকর হওয়ার কারণে নির্দিষ্ট খাদ্য থেকে নিজেকে বিরত রাখল। এক্ষেত্রে খাদ্য বর্জন করায় কোন দোষ নেই।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
يَا مَعْشَرَالشَّبَابِ مَنْ اسْتَطَاعَ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ فَإِنَّهُ أَغَضُّ لِلْبَصَرِ وَأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاءٌ.(بخاري ومسلم)
অর্থঃ হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যার সামর্থ আছে সে যেন বিবাহ করে। কেননা তা দৃষ্টি অবনমিতকারীও লজ্জাস্থান হিফাযতকারী। আর যে বিবাহের সামর্থ রাখে না, সে যেন সিয়াম পালন করে। কেননা তা উত্তেজনা দমনকারী।[5]
এমনিভাবে ক্ষতিকর বিষয় থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে এমন বিষয় বর্জন করা যাতে ক্ষতি নেই। যেমন-হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়াবলীতে পতিত হওয়া থেকে বাঁচার জন্য সন্দেহযুক্ত বস্ত্ত বর্জন করা যা সম্মান ও দ্বীনের পবিত্রতার উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে।
এ ছাড়া অন্য কোন কারণে যদি বর্জন করা হয়, তাহলে তা দ্বীন মনে করে বর্জন করা হবে অথবা অন্য কোন কারণে। সুতরাং যদি তা দ্বীন মনে করে না হয়, তাহলে বর্জনকারী উক্ত কাজটি নিজের উপর অহেতুক নিষিদ্ধকারী অথবা স্বেচ্ছায় পরিহারকারী। এটাকে বিদআত নামে অভিহিত করা যায় না। কেননা তা বিদআতের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। তবে উল্লিখিত দ্বিতীয় সংজ্ঞা অনুযায়ী অভ্যাসগত বিদআতের অন্তর্ভুক্ত হয় কিন্তু প্রথম সংজ্ঞা অনুযায়ী অন্তর্ভুক্ত হয় না। তবে বর্জনকারী তা পরিহার করার কারণে বা আল্লাহ তা‘আলা যা হালাল করেছেন তা হারাম মনে করার কারণে (আল্লাহর বিধানের) বিরুদ্ধাচারণকারী গণ্য হবে। বর্জিত বস্ত্তর মর্যাদার ভিন্নতার কারণে শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণের পাপও বিভিন্ন রকম হয়। যেমন-ওয়াজিব, মুবাহ।
যদি দ্বীন মনে করে কোন কিছু বর্জন করা হয়, তাহলে তা বিদআত বলে গণ্য হবে। চাই সে বর্জিত বিষয় বৈধ হোক কিংবা আদিষ্ট, চাই তা ইবাদতের অর্ন্তভুক্ত হোক বা লেন-দেনের অন্তর্ভুক্ত কিংবা অভ্যাসের অন্তর্ভুক্ত। চাই তা কথা, কাজ বা বিশ্বাসগত বিষয়ের মাধ্যমে হোক। সুতরাং যখন পরিহার করাকে আল্লাহর ইবাদত মনে করা হবে, তখন সে বিদআতের অনুসারী হিসাবে পরিগণিত হবে।[6]
প্রমাণাদির মাধ্যমে জানা যায়, এ জাতীয় বিষয় বর্জন করা বিদআত। যেমন- جَاءَ ثَلَاثَةُ رَهْطٍ إِلَى بُيُوتِ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسْأَلُونَ عَنْ عِبَادَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَمَّا أُخْبِرُوا كَأَنَّهُمْ تَقَالُّوهَا فَقَالُوا وَأَيْنَ نَحْنُ مِنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَدْ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ قَالَ أَحَدُهُمْ أَمَّا أَنَا فَإِنِّي أُصَلِّي اللَّيْلَ أَبَدًا وَقَالَ آخَرُ أَنَا أَصُومُ الدَّهْرَ وَلَا أُفْطِرُ وَقَالَ آخَرُ أَنَا أَعْتَزِلُ النِّسَاءَ فَلَا أَتَزَوَّجُ أَبَدًا فَجَاءَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَيْهِمْ فَقَالَ أَنْتُمْ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا أَمَا وَاللَّهِ إِنِّي لَأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ لَكِنِّي أَصُومُ وَأُفْطِرُ وَأُصَلِّي وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي.(متفق عليه)
অর্থঃ তিন ব্যক্তির ঘটনা, যারা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর স্ত্রীগণের ঘরে এসে তাঁর ইবাদত সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তাদের তাঁর ইবাদত সম্পর্কে অবহিত করা হল, তখন তারা নিজেদের আমল কম মনে করল। তারা বলল, আমরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে কোথায় পড়ে আছি। অথচ তার অগ্র-পশ্চাতের সকল গুনাহ আল্লাহ্ ক্ষমা করে দিয়েছেন। অতঃপর তাদের একজন বলল, আমি রাত ভর সালাত আদায় করব। দ্বিতীয় জন বলল, আমি সারা বছর সিয়াম পালন করব, পরিত্যাগ করব না। তৃতীয় জন বলল, আমি নারীদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকব কখনও বিবাহ করব না। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ তোমরা কি এমন এমন বলেছ? শুনে রাখ! আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের চেয়ে আল্লাহ্কে অধিক ভয় করি এবং তোমাদের চেয়ে অধিক মুত্তাকী। তবে আমি সিয়াম পালন করি আবার ছেড়েও দেই। রাত জেগে সালাত আদায় করি আবার নিদ্রা যাই তেমনি নারীদের বিবাহ করেছি। সুতরাং যে আমার সুন্নাতের প্রতি অনিহা প্রকাশ করে সে আমার দলভুক্ত নয়।[7]
এখানে সুন্নাত বলে পথ বা আদর্শ বুঝানো হয়েছে। ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাত বুঝানো হয়নি। আর কোন জিনিসের প্রতি অনিহা থাকার অর্থ তা থেকে বিমুখ হয়ে অন্য কিছুর প্রতি আগ্রহী হওয়া। তাহলে হাদীসের অর্থ হল, যে ব্যক্তি আমার আদর্শ থেকে বিমুখ হয়ে অন্য কোন আদর্শ গ্রহণ করল, সে আমার দলভুক্ত হবে না।[8]
ইতিপূর্বে স্পষ্ট হয়েছে যে, বিদআত দু‘প্রকারঃ
(ক) কর্মমূলক বিদআত ও (খ) বর্জনমূলক বিদআত।
যেমনিভাবে স্পষ্ট হয়েছে যে, সুন্নাত দু‘প্রকার করণীয় সুন্নাত ও বর্জনীয় সুন্নাত।
সুতরাং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাত, কখনও কোন কাজ করার মাধ্যমে হতে পারে। আবার কোন কিছু বর্জন করার মাধ্যমেও হতে পারে।
যেমনিভাবে আল্লাহ তাআলা আমাদের উপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ঐ সকল কাজের অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক করেছেন, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। তবে শর্ত হলো সে ইবাদতটি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্য নির্দিষ্ট না হওয়া।
তেমনিভাবে আল্লাহ্ তাআলা আমাদের কাছে কামনা করেন যে, আমরা যেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা বর্জন করেছেন তা বর্জন করার মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য করি। সুতরাং তখন বর্জন করাটাই সুন্নাত। আবার তিনি যা করেছেন তা পালন করাটাই সুন্নাত।
তাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা করেছেন তা বর্জন করার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারব না। তেমনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা বর্জন করেছেন সে গুলো পালন করার মাধ্যমেও আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারব না। সুতরাং বর্জিত বিষয়াবলী কর্মে পরিণতকারী কৃত বিষয়াবলী পরিহারকারীর ন্যায়। উভয়ের মাঝে কোন পার্থক্য নাই।[9]
তৃতীয় প্রকারঃ বিশ্বাসগত, বক্তব্যধর্মী ও কর্মমূলক বিদআত
১। বিশ্বাসগত ও বক্তব্যধর্মী বিদআত
যেমন জাহমিয়্যাহ, মু‘তাজিলা, শিয়া, রাফেজি ও সকল পথভ্রষ্টদলগুলোর বক্তব্য ও তাদের বিশ্বাস। তাদের মাঝে ঐ সকল জামাআতও অন্তর্ভুক্ত হবে, যারা নতুন আত্মপ্রকাশ করেছে। যেমন কাদিয়ানী, বাহাই। এছাড়াও সকল বাতেনী জামাত। যেমন ইসমাঈলী নাছিরিয়্যাহ, দরওয়াজ ও রাফেজা।
২। কর্মমূলক বিদআত যা কয়েক প্রকার
প্রথম প্রকারঃ মূল ইবাদতের মধ্যে বিদআত। নতুন কোন ইবাদত প্রবর্তন করা শরীয়তে যার কোন ভিত্তি নেই। যেমন শরীয়তের অনুমোদন বিহীন সালাত প্রবর্তন করা, শরীয়তের অনুমোদন বিহীন সিয়াম প্রবর্তন করা বা এমন ঈদ পালন করা যা শরীয়তে নেই। যেমন ঈদে মিলাদুন্নবী পালন ইত্যাদি।
দ্বিতীয় প্রকারঃ শরীয়ত সমর্থিত ইবাদতে কিছু সংযোজন। যেমনঃ জোহর অথবা আছর সালাতের রাকাত বৃদ্ধি করে পাঁচ রাকাত পড়া।
তৃতীয় প্রকারঃ শরীয়ত সমর্থিত ইবাদত আদায়ের পদ্ধতিতে বিদআত অর্থাৎ বৈধ ইবাদতকে অবৈধ পন্থায় আদায় করা। এমনিভাবে শরীয়ত সম্মত জিকির দলবদ্ধভাবে সমস্ব^রে আদায় করা এবং ইবাদত করার ক্ষেত্রে নিজ জীবনের উপর কঠোরতা করা যা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত নেই।
চতুর্থ প্রকারঃ শরীয়ত সম্মত ইবাদতের জন্য এমন এক সময় নির্ধারণ করা যা শরীয়ত নির্ধারণ করেনি। যেমন-শাবান মাসের ১৫তম দিন সিয়াম পালন ও ১৪তম দিবাগত রাত সালাত আদায়ের জন্য নির্ধারণ করা। কেননা সিয়াম ও সালাত শরীয়ত সম্মত, তবে তা কোন বিশেষ সময়ে আদায়ের জন্য নির্ধারণের জন্য প্রমাণের প্রয়োজন, যা এ ক্ষেত্রে নেই।[10]
[2] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) : ১/৪১৭
[3] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) : ১/৪৫২
[4] কিতাবুত তাওহীদ লেখক ড.সালেহ ফাওযান : ৮২পৃ:
[5] বুখারী : ১৯০৫ ও মুসলিম : ১৪০০
[6] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) : ১/৫৮
[7] বুখারী : ৫০৬৩ ও মুসলিম : ১৪০১
[8] ফাতহুল বারী : ৯/১০৫
[9] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) : ১/৫৭-৬০
[10] মাজমুয়ায়ে ফতোয়ায়ে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া : ১৮/৩৪৬
নিশ্চয়ই শরীয়তে সকল প্রকার বিদআত হারাম ও পথভ্রষ্টতা
এ প্রসঙ্গে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ. (أبو داود و ترمذي)
অর্থঃ তোমরা নব্য সৃষ্ট বিষয় হতে বেঁচে থাক। কেননা সকল নবসৃষ্ট বস্ত্ত বিদআত ও সকল বিদআত পথভ্রষ্টতা।[1]
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ. (بخاري و مسلم)
অর্থঃ যে আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু প্রবর্তন করে যা এর অন্তর্ভূক্ত নয় তা প্রত্যাখ্যাত।[2]
অন্য বর্ণনায় রয়েছেঃ
مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ. (مسلم)
অর্থঃ যে ব্যক্তি (ইবাদতের) নামে এমন কোন আমল করে যা আমাদের পক্ষ থেকে অনুমোদিত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।[3]
উভয় হাদীসে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, দ্বীনের মাঝে নবসৃষ্ট সকল বিষয় বিদআত এবং সকল বিদআতই ভ্রষ্টতা ও প্রত্যাখ্যাত। অতএব ইবাদতে বিদআত হারাম। তবে বিদআতের বিভিন্নতার কারণে এ হারাম বিভিন্ন রকম হয় ।
(১) কুফরীঃ যেমন-কবর বাসীর সম্মানে কবর তাওয়াফ করা, তার নামে মান্নত করা, জবেহ করা, তার কাছে দুআ করা ও আশ্রয় চাওয়া। যেমন- জাহমিয়া, মুতাজিলা ও শিয়া সম্প্রদায় করে থাকে।
(২) শিরকঃ যেমন-কবরের উপর গম্বুজ নির্মাণ ও কবরের পাশে সালাত আদায় ও দুআ করা।
(৩) গোনাহের কাজঃ যেমন-বিবাহ না করে বৈরাগ্য অবলম্বন করা, রোদে দাঁড়িয়ে সিয়াম পালন করা ও কামশক্তি নির্মূলের জন্য হিজরা হওয়া ইত্যাদি।[4]
ইমাম শাতেবী রহ. বলেন, বিদআতপন্থীর গুনাহ একটির মধ্যে সীমিত থাকে না। বরং বিভিন্ন দিকে শাখা বিস্তার করে। যেমন-
১। বিদআতী ব্যক্তি ইজতিহাদের দাবীদার হয় বা কারো তাকলীদ করে।
২। বিদআতপন্থী হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে বিদআত প্রবর্তন করে। যথা মান-সম্মান, ধন-দৌলত, ধর্ম, বুদ্ধি অথবা অন্য কোন স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে।
৩। বিদআতপন্থী স্বীয় কর্মকান্ড প্রকাশ্যে অথবা গোপনে করে।
৪। স্বীয় বিদআতের দিকে মানুষকে আহবান করে আবার কখনও করে না।
৫। সে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের বহির্ভূত গণ্য হবে বা হবে না।
৬। সেটা মৌলিক বিদআত অথবা আপেক্ষিক বিদআত হবে।
৭। বিদআতটি স্পস্ট হবে অথবা অস্পস্ট হবে।
৮। বিদআতটি কুফরী হবে বা হবে না।
৯। বিদআতটি একাধিকবার করা হবে বা হবে না।
তিনি (ইমাম শাতেবী) বলেন, এ সকল দিক তথা কারণগুলোর ভিন্নতার ফলে গুনাহও বিভিন্ন ধরণের হয়।[5] তিনি আরো বলেন, এ সকল কারণে কোন কোন বিদআত হারাম আবার কোনটি মাকরূহ। তবে পথভ্রষ্ট করার ক্ষেত্রে সবগুলো একই পর্যায়ের।
গুনাহের দিকে লক্ষ্য করে বিদআত তিন ভাগে বিভক্ত।
১মঃ সুষ্পষ্ট কুফরী,
২য়ঃ কবীরা গুনাহ,
৩য়ঃ সগীরা গুনাহ।[6]
যে সকল বিদআত সগীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত তার জন্য কয়েকটি শর্ত আছে।
১। এটা সর্বদা করা যাবে না। কেননা সর্বদা করার ফলে তা কবীরা গুনাহ হয়ে যাবে।
২। বিদআতের দিকে মানুষকে আহবান না করা। কেননা এর ফলে উক্ত বিদআতী কাজ বৃদ্ধি পেয়ে কবীরা গুনাহ হয়ে যাবে।
৩। মানুষ জমায়েতের স্থানে এবং যেখানে সুন্নাত আমল আদায় করা হয় সেখানে বিদআতটি পালন না করা।
৪। বিদআতকে ছোট ও তুচ্ছ মনে না করা। কেননা এর ফলে গুনাহকে ছোট করে দেখা হয়। আর গুনাহকে ছোট করে দেখাও কবিরা গুনাহ।
এ তিন প্রকারের সব গুলোকেই গোমরাহী বলা হয়েছে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকল বিদআতকে গোমরাহী বা পথভ্রষ্টতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। ফলে এ হাদীস কুফর ও পাপাচারমূলক সকল বিদআতকেই অন্তর্ভুক্ত করবে, চাই তা ছোট হোক বা বড়।
কিছু সংখ্যক উলামায়ে কেরাম শরীয়তের আহকামের দিকে লক্ষ্য করে বিদআতকেও পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেন। যথাঃ
১. ওয়াজিব, ২. হারাম, ৩. মানদুব, ৪. মাকরূহ ও ৫. মুবাহ।
কিন্তু বিদআতের এ প্রকারভেদ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বানীঃ فَإنَّ كُلَّ مُحْدَثَة بدْعَةٌ وَ كُلَّ بدْعَة ضَلالَة. (أبوداود) এর পরিপন্থী।[7]
ইমাম শাতেবী রহ. প্রকারভেদগুলো বর্ণনা করার পর তা খন্ডন করে বলেন, এ প্রকারভেদও নবসৃষ্ট, কারণ শরীয়তে এর কোন দলিল নেই।
বিদআতের মৌলীকত্ব হল, তার পক্ষে শরয়ী কোন দলিল, বর্ণনা ও নীতিমালা না থাকা। যদি শরীয়তে তা ওয়াজিব, সুন্নাত, মুবাহ হওয়ার কোন দলিল থাকে তাহলে তা বিদআত হবে না। বরং তা শরীয়ত কর্তৃক আদিষ্ট বা অনুমোদিত আমলের অন্তর্ভুক্ত হবে। অতএব বিদআত ও শরীয়তের দলিল সম্পন্ন আমল এক হতে পারে না। আর যা মাকরুহ ও হারাম তা পুরোপুরিই বিদআত।[8]
[2] বুখারী : ২৬৯৭ ও মুসলিম : ১৭১৮
[3] মুসলিম : ১৭১৮
[4] কিতাবুত তাওহীদ -ড.সালেহ ফাওযান : ৮২পৃ:
[5] আল-ইতিসাম- শাতেবী (র) : ১/২১৬-২২৪পৃ:
[6] আল-ইতিসাম- শাতেবী (র) : ২/৫১৬-৫১৭পৃ:
[7] . আবু দাউদ-৪৬০৭
[8]. আল-ইতিসাম- শাতেবী ১/২৪৬
১। মৃত ব্যক্তির নিকট নিজের প্রয়োজনীয় বস্তু চাওয়া। এ প্রকার বিদআত মূর্তি পুজার অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ
قٌلْ ادْعُواْ الَّذِينَ زَعَمْتُم مِّن دُونِهِ فَلاَ يَمْلِكُونَ كَشْفَ الضُّرِّ عَنكُمْ وَلاَ تَحْوِيلاً. أُوْلِئِكَ الَّذِيْنَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى ربِهِمُ الوَسِيلَةَ أَيُّهُمُ أَقَْربُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ إِنَّ عَذابَ ربِّكَ كَانَ مَحْذُورًا ( الإسراء: 56-57)
অর্থঃ বলুন, তোমরা আল্লাহ্ ছাড়া যাদেরকে মা‘বুদ মনে করে আহবান কর; তারা তোমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার অথবা পরিবর্তন করার শক্তি রাখে না। তারা যাদের আহবান করে তারাই তো নিজ রবের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে যে, তাদের কে কত নিকটতম হতে পারে, তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে ও তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। তোমার রবের শাস্তি ভয়াবহ।[1]
অতএব যারাই নবী, অলী, নেককার বুজুর্গদের ডাকে করে এবং তাদের এক প্রকার মা‘বুদ বানায়; এ আয়াত তাদের সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে। কেননা এ আয়াত ঐ সকল লোকদের ব্যপারে যারা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যকে মা‘বুদ হিসেবে ডাকে। অথচ সকল মা‘বুদই আল্লাহর নৈকট্য লাভের উসিলা তালাশ করে, তাঁর রহমত কামনা করে এবং তাঁর আযাবকে ভয় করে।
অতএব যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত মৃত অথবা অদৃশ্য কোন পীর, অলী বা নবীর কাছে কোন কিছু প্রার্থনা করল, সে বড় শিরক করল, যা আল্লাহ কখনও ক্ষমা করবেন না। এমনিভাবে যে ব্যক্তি কোন নবী বা অলীর ব্যাপারে অতিরঞ্জন করল এবং গায়রুল্লাহকে এভাবে সম্বোধন করল যে, হে বাবা! আমাকে সাহায্য কর, আমাকে মদদ কর, আমার ফরিয়াদ কবুল কর, আমাকে রিযিক দাও, আমাকে সন্তান দাও ইত্যাদি। এটাও বড় শিরক। এ ধরণের ব্যক্তিকে তওবা করতে হবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূলগণকে একমাত্র তাঁর ইবাদত করার এবং তাঁর সাথে কোন প্রকার শিরক না করার বিধান দিয়ে প্রেরণ করেছেন।
২। মৃত ব্যক্তির ওয়াসিলায় আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা। এটা বিদআতের অর্ন্তভুক্ত। তবে শিরকে আকবার হবে না।
কোন কোন লোক নবী এবং অলীগণের ওসিলায় দুআ করেন। যেমন- হে আল্লাহ! তোমার নবীগণের, ফেরেশতাগণের, ওলীগণের, অমুক শায়খের, অমুকের সম্মানে এবং লৌহ কলমের ওসিলায় আমার দুআ কবুল কর ইত্যাদি শব্দে দুআ করে থাকে। এগুলো সব নিকৃষ্টতম বিদআতের অন্তর্ভুক্ত।
তবে হ্যাঁ; ওসিলা সম্পর্কে হাদীসে যা পাওয়া যায় তা হল, আল্লাহর নাম, তাঁর গুণাবলী ও নিজ নেক আমলের ওসিলা করে দুআ করা জায়েয। যেমন- বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত (গুহায় আটকে পড়া) তিন ব্যক্তির ঘটনা দ্বারা জানা যায়। তবে জীবিত ব্যক্তির দুআর ওসিলায় অপর মুসলিম ভাইয়ের জন্য দুআর প্রমাণ পাওয়া যায়।
৩। কবরের পাশে দুআ করলে কবুল হয় অথবা কবরের পাশে দুআ করাকে মসজিদে দুআ করার চেয়ে উত্তম মনে করা এবং এ উদ্দেশ্যে কবরের পাশে যাওয়া ইত্যাদি সকলের ঐকমত্যে হারাম।
এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন অনুমোদন দেননি। এমন কি সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন ও ইমামগণের কেউ এমন আমল করেননি। সাহাবীগণ অনেক বিপদ-আপদে পড়েছেন, তথাপি কোন দিন কোন সাহাবী রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবরে আসেননি। বরং উমর (রা) রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাচা আববাস (রা) কে নিয়ে বের হয়েছিলেন এবং বৃষ্টির জন্য তাঁর ওসিলায় দুআ করেছিলেন। ছলফে ছালেহীনগণ কবরের পাশে দুআ করতে নিষেধ করেছেন।
আলী ইবনে হোসাইন (রা) জনৈক ব্যক্তিকে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কবরের পাশে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করতে দেখে; তাকে ডেকে বললেন, আমি কি আপনাকে আমার নানার একটি হাদীস শুনাব না? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেনঃ
لَاتَجْعَلُوْا قَبْرِيْ عِيْداً وَلَا تَجْعَلُوْا بُيُوْتَكُمْ قبُوُرْاً. وَصَلُّوْا عَلَيَّ وَ سَلِّمُوْا حَيْثُمَا كُنْتُمْ فَسَيُبَلِّغُنِيْ سَلَامَكُمْ وَصَلَاتَكُمْ. (فضل الصلاة على النبي صلى الله عليه وسلم )
অর্থঃ তোমরা আমার কবরকে ঈদ বা আনন্দ উৎসবের জায়গা বানিও না, তোমাদের ঘরকে কবর বানিও না। তোমরা আমার উপর সালাত ও সালাম পাঠ কর। তোমরা যেখানেই তা পাঠ কর না কেন তোমাদের সালাম ও সালাত আমার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।[2]
যেখানে ভূখন্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ কবর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কবর, সেখানেই ঈদ বা ওরস করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাহলে দুনিয়ার অন্যান্য কবরের কথা বলার অপেক্ষাই রাখে না।
আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
لَا تَجْعَلُوْا بُيُوْتَكُمْ قَبُوْراً وَلَا تَجْعَلُوْا قَبْرِيَ عِيْدًا وَصَلُّوْا عَليََّ فَأِنَّ صَلَاتَكُمْ تَبْلُغُنِيْ حَيْثُ& كُنْتُمْ. (أبو داود)
অর্থঃ তোমরা নিজেদের ঘরকে কবর বানিও না, আমার কবরকে ঈদ বা উৎসবস্থল বানিও না। আমার উপর দরুদ পাঠ কর, তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তোমাদের দরূদ ও সালাম আমার কাছে পৌঁছে দেয়া হয়।[3]
[2] ফজুলস সালাত আলান নবী (সঃ):৩৪ পৃ
[3] আবু দাউদ : ২০৪২
প্রথমঃ মিলাদ মাহফিল
মিলাদ মাহফিল করা বিদআত। হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে উবায়দীরা এ বিদআতের প্রবর্তন করে। বর্তমান ও পুর্বেকার সকল উলামায়ে কেরাম একে বাতিল বলে আখ্যায়িত করেছেন। যারা এ ধরণের বিদআতের প্রবর্তন করেছে ও আমল করেছে, উলামায়ে কেরাম তাদের প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাই মিলাদ মাহফিল করা বৈধ নয়। কারণ :
১ম কারণঃ যে সকল কুসংস্কারের ব্যাপারে শরীয়তে কোন প্রমাণ নেই; তার অন্যতম হল মিলাদ মাহফিল। কেননা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে এ প্রসঙ্গে কোন বক্তব্য, আমল বা সমর্থন পাওয়া যায় না।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَمَآ ءأتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا.(الحشر: 7)
অর্থঃ রাসূল যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাক।[1]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَن كَانَ يَرجُواللهَ وَالْيَومَ اْلاخِرَ وَ ذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا.(الأحزاب: 21)
অর্থঃ অবশ্যই আল্লাহর রাসূলের জীবনের মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ ঐ ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও কিয়ামত দিবসে (মুক্তির) আশা করে। আর অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করে।[2]
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ.(بخاري و مسلم)
অর্থঃ যে আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু প্রবর্তন করে যা এর অন্তর্ভূক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।[3]
২য় কারণঃ খোলাফায়ে রাশেদীন এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অন্যান্য সাহাবীগণ মিলাদ মাহফিল করেননি। এমন কি তার দাওয়াতও দেননি, অথচ তারাই হচ্ছেন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পর সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত।
খুলাফায়ে রাশেদীনের মর্যাদা সম্পর্কে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ .(أبو داود)&
অর্থঃ তোমাদের জন্য আবশ্যক আমার ও আমার পরবর্তী হেদায়াত প্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরা যেভাবে দাঁত দিয়ে কোন জিনিস দৃঢ়ভাবে কামড়ে ধরা হয়। আর শরীয়তে নিত্য নতুন জিনিস আবিস্কার করা হতে বেঁচে থাক। কেননা সকল নবসৃষ্ট বস্ত্তই বিদআত। আর প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী।[4]
৩য় কারণঃ মীলাদ মাহফিল করা বক্রতা সৃষ্টিকারী পথভ্রষ্টদের প্রথা। এ প্রথাকে সর্ব প্রথম ফাতেমী ও উবাইদী গোত্রের লোকেরা হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে প্রবর্তন করে। তারা নিজেদেরকে ফাতেমা (রা) এর সাথে সম্পৃক্ত করে, যা অন্যায়, অযেŠক্তিক ও অপবাদ ব্যতীত আর কিছুই নয়। মূলতঃ তারা ইহুদী। কেউ বলেন, তারা অগ্নিপুজক, আবার কেউ বলেন, তারা মুলহিদীন বা নাস্তিক। তাদের প্রথম ব্যক্তি হল, মুইজুদ্দীন ওবায়দী। সে পাশ্চাত্যের অধিবাসী। সেখান থেকে সে ৩৬১ হিজরীর শাওয়াল মাসে মিশরে আগমন করে এবং ৩৬২ হিজরী রমজান মাস পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে।[5]
এখন কোন বুদ্ধিমানের জন্য এটা কি উচিত হবে যে, সে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নাত ছেড়ে একজন ইহুদীর অনুসরণ করবে? (আদৌ নয়)।
৪র্থ কারণঃ আল্লাহ্ তা‘আলা এ দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكَمْ نعْمَتِيْ وَ رَضِيْتُ لَكُم الإِسْلامَ دِيْنًا.(المائدة: 3)
অর্থঃ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম ও আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।[6]
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পরিপূর্ণভাবে দ্বীনের প্রচার করেছেন। জান্নাতে পৌঁছার সকল পথ ও জাহান্নাম হতে বাঁচার সকল উপায় উম্মতের সামনে বর্ণনা করে দিয়েছেন।
একথা সকলের জানা যে, আমাদের রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকল নবীগণের সর্দার এবং তিনি সর্বশেষ নবী, পরিপূর্ণভাবে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছিয়েছেন এবং আল্লাহর বান্দাদের কল্যাণ কামনা করেছেন। সুতরাং যদি মীলাদ মাহফিল দ্বীনের অংশ হতো আর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের কারণ হতো, তাহলে অবশ্যই তিনি তা উম্মতের জন্য বর্ণনা করতেন বা তাঁর জীবনে একবার হলেও আমল করে দেখাতেন।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
مَا بَعَثَ اللهُ مِنْ نَّبِيِّ إِلَّا كَانَ حَقًا عَلَيْهِ أَنْ يَّدُلَّ أُمَّتَهُ عَلَى خَيْرِ مَايَعْلَمُهُ لَهُمْ، وَيُنْذِرَهُمْ شَرَّ مَا يَعْلَمُهُ لَهُمْ. (مسلم)
অর্থঃ আল্লাহ যত নবী প্রেরণ করেছেন তাদের সকলের উপর দায়িত্ব ছিল উম্মতকে ভাল কাজের দিক নির্দেশনা দেয়া ও অন্যায় কাজ হতে ভীতি প্রদর্শন করা।[7]
৫ম কারণঃ মিলাদ মাহফিলের মত বিদআত আমলের আবিস্কারের মাধ্যমে এ কথা প্রতীয়মাণ হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা দ্বীনকে এ উম্মতের জন্য পরিপূর্ণ করেননি, তাই দ্বীনের পরিপূরক কিছু আবিস্কারের প্রয়োজন হয়েছে। তেমনি একথাও বুঝা যায় যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতের জন্য কল্যাণকর সকল বিষয়ের তাবলীগ বা প্রচার করেননি। যে কারণে পরবর্তীতে আল্লাহর অনুমোদন ব্যতিরেকে শরীয়তে নতুন কিছু আবিস্কারের প্রয়োজন দেখা দেয়। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চায়। এটা চুড়ান্ত পর্যায়ের অন্যায় ও ভুল। এটা আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর অভিযোগ। অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দ্বীনকে পরিপূর্ণ ও বান্দাদের জন্য সকল নিয়ামত সস্পূর্ণ করে দিয়েছেন।
৬ষ্ঠ কারণঃ এ উম্মতের বড় বড় আলেমগণ কুরআন ও হাদীসের ভিত্তিতে মীলাদ মাহফিলের প্রতি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তারা বিদআত পরিহার করতে ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অনুসরণ করতে বলেন এবং কথা, কাজ ও আমলে তাঁর বিরোধিতা করা হতে সতর্ক করেন।
৭ম কারণঃ মীলাদ মাহফিলের দ্বারা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ভালবাসা অর্জিত হয় না বরং তাঁর অনুসরণ ও সুন্নাত অনুযায়ী আমলের দ্বারা তা অর্জিত হয়।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
قُلْ إِن كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَ يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللهُ غَفُورُ رَّحِيْمٌ. (آل عمران: 31)
অর্থঃ )হে নবী( আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহর ভালবাসার দাবি কর, তাহলে আমার অনুসরণ কর। ফলে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন এবং তোমাদের সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।[8]
৮ম কারণ : মীলাদ মাহফিল, জসনে জুলুস ও ঈদে মিলাদুন্নবী ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের উৎসবের সাদৃশ। আর ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের সাদৃশ্য অবলম্বন করতে ও তাদের অনুসরণ করতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিষেধ করেছেন।[9]
৯ম কারণঃ সারাদেশে মিলাদ মাহফিলে অধিক হারে লোক সমাগম দ্বারা জ্ঞানী লোকেরা কখনও প্রভাবিত হয় না। কেননা সঠিক ও সত্য হওয়াটা মানুষের আধিক্যতা দ্বারা বুঝা যায় না বরং শরীয়তের দলিলের মাধ্যমে বুঝা যায়।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَإِن تُطِعْ أكْثَرَ مَن فِى اْلأَرْضِ يُضِّلُوكَ عَن سَبِيلِ اللهِ. (الأنعام: 116)
অর্থঃ যদি আপনি দুনিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের অনুকরণ করেন, তাহলে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করে দেবে।[10]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَمَآأكْثَرُ النَّاسِ وَلَوْ حَرَصْتَ بمؤمنين. (يوسف: 103)
অর্থঃ যদিও আপনি মনে প্রাণে চান তবুও অধিকাংশ লোক ঈমানদার নয়।[11]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ قَلِيلٌ مِّنْ عِباَدِيَ الشَّكُور.(السبا: 13)
অর্থঃ আমার বান্দাদের কম সংখ্যকই কৃতজ্ঞ।[12]
১০ম কারণঃ শরয়ী নীতিমালার যে সকল ব্যাপারে মানুষ বাক-বিতন্ডা ও ঝগড়া করে, সে সকল বিষয়ে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুসরণ করা উচিৎ।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
يَا أَيُّها الّذِينَ ءَامَنُوا اَطِيعُوا اللهَ وَاَطِيعُوا الرَّسُولَ وأًولِى الأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِى شَىْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَي اللهِ وَ الرَّسٌولِ إِن كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الأَخِر ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأوِيلاً.(النساء: 59)
অর্থঃ হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের অনুগত হও এবং তোমাদের নেতৃবৃন্দের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে মত বিরোধ দেখা দেয় তবে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তিত হও যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই কল্যাণকর ও শ্রেষ্ঠতর।[13]
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِن شَيءِ فَحُكْمُهُ إِلَى اللهِ.(الشورى: 10)
অর্থঃ তোমরা যে বিষয়েই মতভেদ কর না কেন ওর মীমাংসাতো আল্লাহরই নিকট।[14]
নিঃসন্দেহে যে ব্যক্তি মীলাদ মাহফিলের ব্যাপারে আল্লাহ্ ও রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিক নির্দেশনার প্রতি ধাবিত হবে, সে জানতে পারবে, আল্লাহ তাআলা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ
وَمَآ ءأتَاكمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَـكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا. (الحشر: 7)
অর্থঃ রাসূল তোমাদের কাছে যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ কর এবং যা হতে নিষেধ করেছেন তা হতে বিরত থাক।[15]
আল্লাহ তাআলা দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মীলাদ মাহফিলের জন্য কাউকে নির্দেশ দেননি, তিনি এবং তাঁর সাহাবীগণও তা কখনও করেননি। সুতরাং মীলাদ মাহফিল দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং তা নব্যসৃষ্ট বিদআত।
১১তম কারণঃ সোমবার সিয়াম পালন শরীয়ত সিদ্ধ। কেননা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে সোমবারের সিয়াম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেন, ذلِكَ يَوْمٍ وُلِدْتُ فِيْهِ، وَيَوْمَ بُعِثْتُ أَوْ أُنْزِلَ عَلي فِيْه. (مسلم) অর্থঃ এটা এমন দিন যে দিন আমি জন্ম গ্রহণ করেছি, আমি নবুওয়াত প্রাপ্ত হয়েছি অথবা আমার প্রতি সেদিন কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।[16]
সুতরাং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আদর্শ হল সোমবার সিয়াম পালন করা, তবে এ উপলক্ষে মীলাদ মাহফিল করা বৈধ নয়।
১২তম কারণঃ ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করা গর্হিত ও নিষিদ্ধ বিষয়াবলীর অন্যতম। আর তা বুঝা যায় এ ধরণের মাহফিলে উপস্থিত হওয়া দ্বারা। এ ধরণের গর্হিত কাজের কিছু উদাহরণ নিম্নে উল্লেখ করা হল।
১। মীলাদে অংশগ্রহণকারীদের রচিত অধিকাংশ কবিতা ও স্তুতিমূলক বাক্যগুলোতে শিরকী ও বাড়াবাড়িমূলক কথা পাওয়া যায়। অথচ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর প্রশংসা করার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করে বলেন,
لَا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُه. (بخاري)
অর্থঃ তোমরা আমার প্রশংসার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করো না, যেমন খ্রীষ্টানরা ইবনে মারইয়ামের প্রশংসার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছিল। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তোমরা বল আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।[17]
২। মীলাদ মাহফিলে অনেক ক্ষেত্রে হারাম কাজ হয়ে থাকে। যেমন নারী-পুরুষ মিলেমিশে বসা, গান-বাদ্য করা, মদ-গাজা সেবন ইত্যাদি। আর কখনও কখনও এতে শিরকে আকবরও সংঘটিত হয়। যেমন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে বা অন্য কোন অলীর কাছে সাহায্য চাওয়া, আল্লাহর কিতাবের অসম্মান করা, কুরআনের মজলিসে ধূমপান করা ইত্যাদি। মীলাদের দিনগুলোতে উচ্চস্বরে মসজিদে জিকির করা ও সুর করে শরীয়ত পরিপন্থী কবিতা আবৃত্তি করা। যা হক্কানী আলেমগণের ঐকমত্যে শরীয়ত সম্মত নয়।
৩। মীলাদ মাহফিলে আরো কিছু গর্হিত কাজ সংঘটিত হয়। যেমন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্মের ঘটনা আলোচনা কালে তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়ান এই বিশ্বাস নিয়ে যে, তিনি এ মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হয়েছেন। তাই তাঁর অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে যায়। আর এ সবই চরম ভ্রান্তি ও মূর্খতা, যা নিন্দিত। কেননা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিয়ামতের পূর্বে কবর থেকে বের হবেন না। কোন লোকের সাথে সাক্ষাত করবেন না, কোন সম্মেলনে উপস্থিত হবেন না। বরং তিনি কিয়ামত পর্যন্ত নিজ কবরে অবস্থান করবেন। আর তাঁর রুহ ইল্লিয়্যিনের সর্বোচ্চ স্তরে তাঁর প্রভুর কাছে সম্মানিত স্থানে রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ
ثُمَّ إِنَّكم بَعْدَ ذَلِكَ لَمَيِّتُون، ثُمَّ إِنَّكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ تُبْعَثُونَ.(المؤمنون:15-16)
অর্থঃ এরপর তোমরা অবশ্যই মৃত্যুবরণ করবে। অতঃপর কিয়ামতের দিন তোমাদের পুনরুত্থিত করা হবে।[18]
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
أَنَا سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَأَوَّلُ مَنْ يَنْشَقُّ عَنْهُ الْقَبْرُ وَأَوَّلُ شَافِعٍ وَأَوَّلُ مُشَفَّعٍ.
(مسلم)
অর্থঃ আমি কিয়ামতের দিন আদম সন্তানের নেতা, সর্ব প্রথম কবর থেকে উত্থিত ব্যক্তি, সর্বপ্রথম সুপারিশকারী এবং সর্বপ্রথম আমার সুপারিশ গৃহিত হবে।[19]
উক্ত আয়াত, হাদীস এবং এ জাতীয় আয়াত ও হাদীসসমূহ থেকে বুঝে আসে যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যান্য মৃতদের ন্যায় মৃত। তিনি কিয়ামতের দিন কবর থেকে উত্থিত হবেন।
আব্দুল আযীয ইবনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে বায বলেন, এ বিষয়ে সমস্ত আলেমের ঐকমত্য রয়েছে, এতে কারো মতবিরোধ নেই।[20]
[2] আহযাবঃ ২১
[3] বুখারী : ২৬৯৭ ও মুসলিম : ১৭১৮
[4] আবু দাউদ:৪৬০৭
[5] বিদায়া ওয়ান নিহায়া-ইবনে কাসীর:১১/২৭২-৭৩
[6] মায়েদা: ৩
[7] মুসলিম:১৮৪৪
[8] আলে-ইমরান: ৩১
[9] যাদুল মায়াদ-ইবনে কাইয়্যিম (র): ১/৫৯
[10] আনআম: ১১৬
[11] ইউসুফ: ১০৩
[12] সাবা: ১৩
[13] নিসা: ৫৯
[14] আশ-শুরা: ১০
[15] হাশরঃ ৭
[16] মুসলিম :
[17] বুখারী : ৩৪৪৫
[18] মুমিনুন : ১৫-১৬
[19] মুসলিম : ২২৭৮
[20] আত-তাহযীর মিনাল বিদআঃ ১৪
রজব মাসের প্রথম জুমার রাতে মাহফিল করা বিদআত ও গর্হিত কাজ। ইমাম আবু বকর তরতুশী উল্লেখ করেন, আবু মুহাম্মাদ আল মাকদেসী রহ. তাকে অবহিত করেছেন যে, রজব মাসে এ মীলাদ মাহফিল বায়তুল মুকাদ্দাসে ৪৮০ হিঃ সনে শুরু হয়। ইতিপূর্বে এ মাহফিল সম্পর্কে কিছু শুনিনি,দেখিওনি।[1]
ইমাম আবু শামা রহ. বলেন, সালাতে রাগায়েব যা মানুষের মাঝে এখনও প্রসিদ্ধ হয়ে গেছে, তা রজব মাসের প্রথম জুমার রাতে মাগরিব ও ইশার সালাতের মধ্যবর্তী সময়ে পড়া হয়।[2]
ইবনে রজব রহ. বলেন, রজব মাসের সাথে নির্দিষ্ট করে কোন সালাত আদায় করা সঠিক নয়। রজব মাসের প্রথম জুমার রাতে সালাতে রাগায়েব সংক্রান্ত বর্ণিত সকল হাদীস মিথ্যা ও অশুদ্ধ। আর জমহুর আলেমের মতে এ সালাত বিদআত।[3]
হাফেয ইবনে হাজার রহ. বলেন, রজব মাসের ফযীলত, তাতে সিয়াম পালন এবং এর বিশেষ কোন রাতে সালাত আদায় সম্পর্কে কোন বিশুদ্ধ হাদীস নেই।[4]
অতঃপর তিনি বলেন, যে সকল হাদীসে রজব মাসের ফযীলত বা তাতে সিয়াম পালনের ফযীলত সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে, তা দু‘ প্রকার। ১. যয়ীফ ও ২. মওজু।[5]
অতঃপর তিনি সালাতে রগায়েবের হাদীস উল্লেখ করেন। তাতে রয়েছে রজবের প্রথম বৃহস্পতিবার সিয়াম পালন, এরপর মাগরিব ও ইশার মাঝখানে বার রাকাত সালাত আদায়, প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতেহা ১বার, সূরা ক্বদর ৩ বার, ১২বার সূরা ইখলাছ পড়া এবং প্রত্যেক দু‘রাকাত পর পর সালাম ফিরানো। এরপর তিনি তাছবীহ, ইস্তেগফার, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রতি দরূদ পাঠ। অতঃপর তিনি উল্লেখ করেন, এ হাদীসটি মওজু এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর মিথ্যারোপ মাত্র। তিনি বলেন, লোকজনের নিকট এ ইবাদতকে বড় ফজিলতপূর্ণ করে দেখানো হয়, অথচ এ সালাতে সাধারণতঃ তারাই আগ্রহী হয়, যারা নিয়মিত সালাতের জামাতে উপস্থিত হয় না।[6]
ইমাম ইবনে সালাহ রহ. সালাতে রাগায়েব সম্পর্কে বলেন, এ হাদীসটি মওজু। এটা হিজরী ১৪শ বছর পর নতুন করে আবিষ্কার করা হয়েছে।[7]
ইমাম আল-ইজ্জ বিন আবদুস সালাম রহ. ৬৩৭ হিজরী সনে এক ফতোয়ায় লিখেন, সালাতে রাগায়েব বিদআত ও মুনকার এবং এ সংক্রান্ত হাদীস রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর মিথ্যারোপ ছাড়া কিছুই নয়।[8] পরিশেষে তিনি ইমাম আবু শামার রহ. কথা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরে সালাতে রাগায়েব বাতিল আখ্যায়িত করেন। তিনি উক্ত ইবাদতকে নেক আমল বিনষ্টকারী হিসেবে উল্লেখ করে নিম্মোক্ত বর্ণনা পেশ করেন।
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, এ সালাত বিদআত। সর্বাধিক জ্ঞানী আলেম সমাজ এবং আইম্মাতুল মুসলিমীন যথাঃ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন ও অন্যান্য আলেমগণ যারা দ্বীনের অনেক কিতাব লিপিবদ্ধ করেছেন এবং অতি উৎসাহের সাথে মানুষদের দ্বীনের বিধি-বিধান, ফরজ ও সুন্নাত শিক্ষা দিয়েছেন, তাদের কারো থেকে এ ধরনের কোন বর্ণনা পাওয়া যায়নি। এ সালাত সম্পর্কে কোন বর্ণনা তাদের কিতাবে লিপিবদ্ধ হয়নি এবং তারা কোন মজলিশে এধরনের বক্তব্য দেননি। এটা যদি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাত হত, তাহলে ওলামায়ে কেরামের নিকট তা অজ্ঞাত থাকত না।
এ সালাত তিনটি কারণে শরীয়ত পরিপন্থী।
প্রথম কারণঃ এ সালাত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসের পরিপন্থী। হাদীসটি হচ্ছেঃ
لَا تَخْتَصُّوا لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ بِقِيَامٍ مِنْ بَيْنِ اللَّيَالِي وَلَا تَخُصُّوا يَوْمَ الْجُمُعَةِ بِصِيَامٍ مِنْ بَيْنِ الْأَيَّامِ إِلَّا أَنْ يَكُونَ فِي صَوْمٍ يَصُومُهُ أَحَدُكُمْ.(متفق عليه)
অর্থঃ তোমরা শুধু জুমার রাতকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করো না এবং শুধু জুমার দিনকে সিয়ামের জন্য নির্দিষ্ট করো না। তবে হ্যাঁ; যদি কেউ ধারাবাহিক ভাবে সিয়াম পালন করতে থাকে তা স্বতন্ত্র কথা।[9]
সুতরাং এ হাদীসের ভিত্তিতে অন্যান্য রাতকে বাদ দিয়ে শুধু জুমার রাতকে সালাতের জন্য নির্দিষ্ট করা জায়েয নেই।[10] এটা রজব মাসের প্রথম জুমার রাতের ব্যাপারেও প্রযোজ্য।
দ্বিতীয় কারণঃ রজব ও শাবান মাসে বিশেষ সালাত আদায় বিদআত। এ ব্যাপারে এমন সব কথা বলা হয়, যা হাদীসে নেই। তাই এর দ্বারা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর মিথ্যারোপ করা হয়। তেমনি এ রাতে আমলের প্রতিদান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বলার মাধ্যমে আল্লাহর উপরও মিথ্যারোপ করা হয়। অথচ এ ব্যাপারে তিনি কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। পক্ষান্তরে যে সকল ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপর মিথ্যারোপ করা হয়, তা মিথ্যাজ্ঞান করা, পরিহার করা, নিকৃষ্ট মনে করা এবং জনগণের মাঝে এ সম্পর্কে ঘৃণা ছড়ানো একান্ত জরুরী। কেননা এ সবের সাথে একাত্মতার কারণে অনেক বিশৃঃখলা সৃষ্টি হয়।
১ম বিশৃংখলাঃ এ সকল ইবাদতের ফযীলত এবং তা ছেড়ে দেয়ার ক্ষতি সম্পর্কে যা কিছু মানুষের কানে আসে তার উপর নির্ভর করা। ফলে অধিকাংশ মানুষ দু‘টি কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
১। ফরজসমূহের ব্যাপারে শিথিলতা।
২। পাপের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়া।
মানুষ এ রাতের অপেক্ষায় থাকে ও এতে সালাত আদায় করে মনে করে যে, বিগত দিনে যা ছেড়ে দিয়েছে এসব আমল তার পরিপূরক হয়ে যাবে এবং যে পাপে তারা লিপ্ত ছিল তা মাফ হয়ে যাবে। সালাতে রাগায়েবের ব্যাপারে হাদীস রচনাকারীরা ধারণা করেছিল যে,‘‘মানুষ অধিক হারে সৎকাজে অনুগামী হবে’’। কিন্তু বাস্তবে মানুষ অধিক হারে পাপ ও নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েছে।
২য় বিশৃংখলাঃ মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য-বিদআতপন্থীরা যে সকল বিদআত কাজের প্রচলন করে; যখন তারা দেখে তাতে মানুষ লিপ্ত হয়েছে ও সে বিদআতগুলো প্রচলিত হয়েছে, তখন তারা মানুষদেরকে এক বিদআত থেকে আরেক বিদআতের দিকে পথ দেখায়।
৩য় বিশৃংখলাঃ যখন কোন আলেম বিদআতী কাজ করে তখন সাধারণ মানুষ ধারণা করে, এটা সুন্নাত। এ ক্ষেত্রে ঐ আলেম স্বীয় কাজের মাধ্যমে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর মিথ্যারোপ করে। অধিকাংশ মানুষ এ কারণেই বিদআতে লিপ্ত হয়ে পড়ে।
তৃতীয় কারণঃ এ বিদআতী সালাত বিভিন্ন কারণে শরয়ী সালাতের বিপরীত হয়।
এক : এ সালাতে সিজদার সংখ্যা, তাসবীহর সংখ্যা, প্রত্যেক রাকাআতে নির্দিষ্ট সংখ্যায় সূরা ক্বদর ও সূরা ইখলাছ পড়ার মাধ্যমে সালাতের সুন্নাত পদ্ধতির বিরোধিতা করা হয় ।
দুই : সালাতে অন্তর বিগলিত হওয়া, একাগ্রতার সাথে সালাত আদায় করা, আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় সালাতের জন্য অবসর হওয়া ও কুরআনের অর্থের দিকে লক্ষ্য করে সালাত আদায় করা সুন্নাত। এখানে তা পাওয়া যায় না।
তিন : নফল সালাত মসজিদে আদায় করার চেয়ে ঘরে এবং একাকী আদায় করা উত্তম। তবে রমজান মাসে তারাবীহর সালাত জামাতের সাথে মসজিদে আদায় করা উত্তম।
চার : এ সালাত শেষ করার পর অতিরিক্ত দু‘টি সিজদা আদায় করা, যার প্রকৃত কোন কারণ নেই।
উল্লিখিত দলিল-প্রমাণ, আলেমগণের বক্তব্য এবং ভ্রান্ত হওয়ার কারণ ও বিশৃংখলার প্রকার এ সব থেকে স্পষ্ট বুঝে আসে যে, সালাতে রাগায়েব বিদআত।[11]
[2] কিতাবুল বায়েস আলা ইনকারিল বিদয়ে ওয়াল হাওয়াদেস : ২৩৮
[3] লাতায়েফুল মাআরিফ ফিমা লি মাওয়াসিমিল আম মিনাল ওযায়েফ :২২৮
[4] তিবইয়ানুল উযব বিমা ওয়ারাদা ফী শাহ্রি রজব : ২৩
[5] প্রাগুক্তঃ ২৩
[6] তিবইয়ানুল উযব বিমা ওয়ারাদা ফি শাহরে রজব : ৫৪পৃ:
[7] কিতাবুল বায়েস আলা ইনকারিল বিদয়ে ওয়াল হাওয়াদেস : ১৪৫পৃ:
[8] কিতাবুল বায়েস আলা ইনকারিল বিদয়ে ওয়াল হাওয়াদেস : ১৪৯পৃ:
[9] বুখারী : ১৯৮৫ ও মুসলিম : ১১৪৪
[10] কিতাবুল বায়েস আলা ইনকারিল বিদয়ে ওয়াল হাওয়াদেস- ইমাম আবু শামা : ১৫৬পৃ:
[11] কিতাবুল বায়েস আলা ইনকারিল বিদয়ে ওয়াল হাওয়াদেস- ইমাম আবু শামা : ১৫৩-১৯৬পৃ:
ইসরা ও মিরাজ আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনাবলীর অন্যতম। যা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সত্যতা, আল্লাহর কাছে তাঁর উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন হওয়া, আল্লাহর কুদরত এবং তার আরশে অবস্থানের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بَعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ المَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الاَقَصَا الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ ءَايَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ الَّسّمِيعُ الْبِصِيْرُ.(الإسراء: 1)
অর্থঃ পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি স্বীয় বান্দা (রাসূলুল্লাহ) কে রাতে মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করিয়েছিলেন তাকে নির্দশনাবলী দেখাবার জন্য। যার চারপাশ আমি বরকতময় করেছিলাম, তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।[1]
হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আসমানে ভ্রমণ করেছিলেন, তাঁর জন্য আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়েছিল। এ পর্যায়ে তিনি সাত আসমান ভ্রমণ করেন। প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছিলেন। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে বারবার যেতে থাকলে ও সহজ করার প্রার্থনা করতে থাকলে আল্লাহ তাআলা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেন। তবে পাঁচ ওয়াক্তের বিনিময়ে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সাওয়াব দিবেন। কেননা উম্মতে মুহাম্মাদীর প্রত্যেকটি নেক আমল দশ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। তাই আল্লাহ তাআলার অসংখ্য নিয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।[2]
মিরাজের রাতে কোন মীলাদ মাহফিল, শরীয়ত অসমর্থিত কোন প্রকার ইবাদত না করা কয়েকটি কারণে জরুরী।
এক : কোন রাতে মিরাজ সংঘটিত হয়েছে, তা নির্ধারণের ব্যাপারে কোন বিশুদ্ধ হাদীস নেই। কারো মতে নবুওয়াত প্রাপ্তির ১৫মাস পর, কারো মতে হিজরতের এক বছর পূর্বে রবিউস সানীর ২৭তম রাতে, কারো মতে নবুওয়াত প্রাপ্তির পাঁচ বছর পর, কারো মতে রবিউল আউয়ালের ২৭ তারিখ।[3]
ইমাম আবু শামা রহ. বলেন, কতিপয় ঐতিহাসিকের মতে, ইসরা রজব মাসে হয়েছিল, যা বিজ্ঞজনদের মতে সঠিক নয়।[4]
ইবনুল কাইয়্যিম রহ. বলেন, ইসরা কোন রাতে হয়েছিল তা সঠিক ভাবে জানা নেই।[5]
আল্লামা আব্দুল আযীয ইবনে বায রহ. বলেন, যে রাতে ইসরা ও মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল তা রজব মাসে, না কি অন্য কোন মাসে, এটা নির্ধারণের জন্য কোন বিশুদ্ধ হাদীস নেই, আর তারিখ নির্ধারণের জন্য বর্ণিত সকল হাদীস মুহাদ্দিসগণের মতে বিশুদ্ধ নয়। মিরাজের তারিখ ভুলিয়ে দেয়ার মধ্যে আল্লাহর অনেক হিকমত নিহিত আছে।[6]
আর যদি তার জন্য নির্ধারিত কোন রাত প্রমাণিত হয়, তথাপি প্রমাণ ছাড়া তাতে বিশেষ কোন ইবাদত করা বৈধ হবে না।
দুই : কোন মুমিন বা আলেম থেকে এ কথা প্রমাণিত নেই যে, তারা মিরাজের রাতের বিশেষ কোন ফযীলত নির্ধারণ করেছেন। কেননা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীগণ এ রাতে কোন ধরনের মাহফিল করতেন না, এ রাতকে ইবাদতের জন্য খাছ করতেন না এবং এ বিষয়ে কোন আলোচনা করতেন না। যদি মাহ্ফিল করা শরীয়তে জায়েয হত তাহলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অবশ্যই তা বর্ণনা করতেন অথবা আমল করে দেখাতেন। অবশ্যই তা প্রচার-প্রসার হত এবং তার সহীহ প্রমাণ পাওয়া যেত।[7]
তিন : আল্লাহ তাআলা এ উম্মতের জন্য দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন ও নি‘য়ামত পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ
اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكَمْ نعْمَتِيْ وَ رَضِيْتُ لَكُم الإِسْلامَ دِيْنًا.(المائدة: 3)
অর্থঃ আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম।[8]
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনঃ
اَمْ لَهُمْ شُرَكَؤُا شَرَعُوْا لَهُمْ مِنَ الدِّيْنِ مَالَمْ يَأْذَنْ بِهِ اللهِ وَلَوْ لا كَلِمَةُ الْفَصْلِ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ وَاِنَّ الظّالِمِيْنَ لَهُمْ عَذَابٌ اَلِيْمٌ.(الشورى: 21)
অর্থঃ তাদের কি কতগুলো দেবতা আছে যারা তাদের জন্য বিধান দিয়েছে? এমন দ্বীনের, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি। ফায়সালার ঘোষণা না থাকলে তাদের বিষয়ে তো সিদ্ধান্ত হয়েই যেতো। নিশ্চয়ই যালিমদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।[9]
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদআত সম্পর্কে সর্তক করে বলেছেন প্রত্যেক বিদআত ভ্রষ্টতা তা প্রত্যাখ্যাত হবে তার প্রবর্তক ও আমলকারীসহ।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ. (متفق عليه)
অর্থঃ যে ব্যক্তি আমাদের এ দ্বীনে এমন কিছু নতুন আবিস্কার করেছে যা দ্বীনের অর্ন্তভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।[10]
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ.(مسلم)
অর্থঃ যে এমন কোন আমল করে যাতে আমাদের কোন নির্দেশনা নেই তা প্রত্যাখ্যাত।[11]
ছলফে ছালেহীন বিদআত সম্পর্কে সর্তক করেছেন। কেননা তা দ্বীনের মধ্যে অতিরঞ্জন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুমতি ছাড়া কোন কিছু শরীয়তে অন্তর্ভুক্ত করা এবং ইহুদী-খ্রীষ্টানদের ন্যায় দ্বীনের মধ্যে অতিরঞ্জনের নামান্তর।[12]
[2] আত-তাহযীর মিনাল বিদআ : ১৬
[3] ইমাম নববীর শরহে মুসলিম : ২/২৬৭
[4] কিতাবুল হাওয়াদেস ওয়াল বিদআ : ২৩২পৃ:
[5] যাদুল মা আদ :১/৫৮
[6] আত তাহযীর মিনাল বিদআত : ১৭
[7] যাদুল মাআদ : ১/৫৮
[8] মায়েদা : ৩
[9] শুরা: ২১
[10] বুখারী: ২৬৯৭ ও মুসলিম: ১৭১৮
[11] মুসলিম :১৭১৮
[12] আত-তাহযীর মিনাল বিদআ-ইবনে বায (র) ১৯ পৃ