প্রশ্ন: মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য এমন কোন শাসককে নির্বাচিত করা কি জায়েয হবে যে আল্লাহর আইন অনুযায়ী শাসন করে না? উল্লেখ্য, তাকে যদি নির্বাচিত করা না হয় তাহলে সে নানাভাবে কোণঠাসা করে রাখবে; এমন কি গ্রেফতারও করতে পারে।সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
ঈমানদারেরা সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, আল্লাহর আইনের চেয়ে উত্তম কোন আইন নেই। আল্লাহর আইন বিরোধী সকল বিধান জাহেলী বিধান। আল্লাহ তাআলা বলেন: “তারা কি তবে জাহিলিয়্যাতের বিধান চায়? আর নিশ্চিত বিশ্বাসী কওমের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক উত্তম?”[সূরা মায়েদা, ০৫:৫০] আল্লাহর উপর ঈমান ও রাসূলদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে সেগুলোর প্রতি ঈমান আনার পর আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে অন্য কোন আইন গ্রহণ করার প্রবণতাকে আল্লাহ তাআলা ‘বিস্ময়কর’ ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: “আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা দাবী করে যে, যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে আমরা সে বিষয়ের উপর ঈমান এনেছি। তারা তাগূতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চায় অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাকে অস্বীকার করতে। আর শয়তান চায় তাদেরকে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত করতে।”[সূরা নিসা ০৪:৬০]
শানকিতি (রহঃ) বলেন: “আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন যে, যারা আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে অন্য আইনে শাসন করে আল্লাহ তাদের ঈমানের দাবীর প্রতি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। কারণ তাগুতের কাছে বিচার ফয়সালা চাওয়ার পরেও ঈমানের দাবী- মিথ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। এমন মিথ্যা সত্যিই বিস্ময়কর।” সমাপ্ত
আল্লাহ তাআলা তাঁর সত্তার শপথ করে বলছেন: কোন ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূলকে ফয়সালাকারী হিসেবে না মানা পর্যন্ত ঈমানদার হবে না। রাসূল যে ফয়সালা দিয়েছেন সেটাই হক্ব; প্রকাশ্যে ও গোপনে সেটাকে মেনে নিতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন: “অতএব তোমার রবের কসম, তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে সে ব্যাপারে নিজদের অন্তরে কোন দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেয়।”। [সূরা নিসা, ০৪:৬৫]
আল্লাহ তাআলা বিবদমান বিষয়ে ফয়সালার দায়িত্ব রাসূলের উপর ছেড়ে দেয়া অপরিহার্য করে দিয়েছেন এবং এটাকে ঈমানের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কোন আইনের শাসন গ্রহণ করা ঈমানের পরিপন্থী। আল্লাহ তাআলা বলেন: “অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ কর- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি কল্যাণকর এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।”[সূরা নিসা, ০৪:৫৯]।
ইবনে কাছির (রহঃ) বলেন: আয়াতে কারিমা “যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ” নির্দেশ করছে যে, যে ব্যক্তি বিবদমান বিষয়ের ফয়সালা কুরআন ও সুন্নাহ হতে গ্রহণ করে না এবং এ দুটির কাছে ফিরে আসে না সে আল্লাহর প্রতি ও শেষ দিনের প্রতি ঈমানদার নয়।
পূর্বোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করে না তাকে নির্বাচিত করা হারাম। কারণ এই নির্বাচনের মাধ্যমে এই হারামের প্রতি সন্তুষ্টি ও এই হারাম কাজে সহযোগিতা করা হলো।
কোন মুসলমানকে যদি ভোট দিতে যেতে বাধ্য করা হয় তাহলে সে যেতে পারেন গিয়ে এই প্রার্থীর বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন অথবা সম্ভব হলে তার ভোট নষ্ট করে দিতে পারেন। যদি এর কোনটাই তার পক্ষে করা সম্ভবপর না হয় এবং এই প্রার্থীর পক্ষে ভোট না দিলে সে নির্যাতিত হওয়ার আশংকা করে তাহলে আমরা আশা করছি এমতাবস্থায় তার কোন গুনাহ হবে না। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলেছেন: “যার উপর জবরদস্তি করা হয় এবং তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে সে ব্যতীত” [সূরা নাহল ১৬:১০৬] এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আমার উম্মতকে ভুল, বিস্মৃতি ও জবরদস্তির গুনাহ হতে নিষ্কৃতি দেয়া হয়েছে।”[সুনানে ইবনে মাজাহ (২০৪৫), আলবানী সহীহ ইবনে মাজাহ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন]
আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।
আলহামদুলিল্লাহ।
এক: ডেমোক্রেসি (গণতন্ত্র) আরবী শব্দ নয়। এটি গ্রিক ভাষার শব্দ। দুটি শব্দের সমন্বয়ে শব্দটি গঠিত: Demos অর্থ- সাধারণ মানুষ বা জনগণ। আর দ্বিতীয় শব্দটি হচ্ছে-KRATIA অর্থ- শাসন। অতএব, ডেমোক্রেসি শব্দের অর্থ হচ্ছে- সাধারণ মানুষের শাসন অথবা জনগণের শাসন।
দুই: গণতন্ত্র ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক একটি তন্ত্র। এই তন্ত্রে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জনগণের হাতে অথবা তাদের নিযুক্ত প্রতিনিধি (পার্লামেন্ট সদস্য) এর হাতে অর্পণ করা হয়। তাই এ তন্ত্রের মাধ্যমে গায়রুল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়; বরং জনগণ ও জনপ্রতিনিধির শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ তন্ত্রে জনপ্রতিনিধিদের সকলে একমত হওয়ার দরকার নেই। বরং অধিকাংশ সদস্য একমত হওয়ার মাধ্যমে এমন সব আইন জারী করা যায় জনগণ যেসব আইন মেনে চলতে বাধ্য; এমনকি সে আইন যদি মানব প্রকৃতি, ধর্ম, বিবেক ইত্যাদির সাথে সাংঘর্ষিক হয় তবুও। উদাহরণতঃ এই তন্ত্রের অধীনে গর্ভপাত করা, সমকামিতা, সুদি মুনাফার বিধান ইত্যাদি জারী করা হয়েছে। ইসলামি শাসনকে বাতিল করা হয়েছে। ব্যভিচার ও মদ্যপানকে বৈধ করা হয়েছে। বরং এই তন্ত্রের মাধ্যমে ইসলাম ও ইসলামপন্থীদেরকে প্রতিহত করা হয়। অথচ আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে জানিয়েছেন, হুকুম বা শাসনের মালিক একমাত্র তিনি এবং তিনিই হচ্ছেন- উত্তম হুকুমদাতা বা শাসক। পক্ষান্তরে অন্যকে তাঁর শাসনে অংশীদার করা থেকে নিষেধ করেছেন এবং জানিয়েছেন তাঁর চেয়ে উত্তম বিধানদাতা কেউ নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন (ভাবানুবাদ): “অতএব, হুকুম দেওয়ার অধিকার সুউচ্চ ও সুমহান আল্লাহর জন্য” [সূরা গাফের, আয়াত: ১২] আল্লাহ তাআলা আরও বলেন (ভাবানুবাদ): “আল্লাহ ছাড়া কারো বিধান দেওয়ার অধিকার নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করো না। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।”।[সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৪০] আল্লাহ তাআলা আরও বলেন: “আল্লাহ কি হুকুমদাতাদের শ্রেষ্ঠ নন?” [সূরা ত্বীন, আয়াত: ০৮] তিনি আরও বলেন (ভাবানুবাদ): “বলুন, তারা কতকাল অবস্থান করেছে- তা আল্লাহই ভাল জানেন। নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের গায়েব বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই কাছে রয়েছে। তিনি কত চমৎকার দেখেন ও শোনেন! তিনি ব্যতীত তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। তিনি নিজ হুকুমে কাউকে অংশীদার করান না।”[সূরা কাহাফ, আয়াত: ২৬] তিনি আরও বলেন (ভাবানুবাদ): “তারা কি জাহেলিয়াতের হুকুম চায়? বিশ্বাসীদের জন্যে আল্লাহর চেয়ে উত্তম হুকুমদাতা আর কে?”[সূরা মায়েদা, আয়াত: ৫০]
আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা। তিনি জানেন, কোন বিধান তাদের জন্য উপযুক্ত; কোন বিধান তাদের জন্য উপযুক্ত নয়। সব মানুষের বিবেক-বুদ্ধি, আচার-আচরণ ও অভ্যাস এক রকম নয়। নিজের জন্য কোনটা উপযোগী মানুষ সেটাই তো জানে না; থাকতো অন্যের জন্য কোনটা উপযুক্ত সেটা জানবে। এ কারণে যে দেশগুলোতে জনগণের প্রণীত আইনে শাসন চলছে সে দেশগুলোতে বিশৃঙ্খলা, চারিত্রিক অবক্ষয়, সামাজিক বিপর্যয় ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না।
তবে কিছু কিছু দেশে এ তন্ত্রটি নিছক একটি শ্লোগান ছাড়া আর কিছু নয়; যার কোনরূপ বাস্তবতা নেই। এ শ্লোগানের মাধ্যমে জনগণকে ধোঁকা দেয়া উদ্দেশ্য। প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রপ্রধান ও তার সহযোগীরাই হচ্ছে- আসল শাসক এবং জনগণ হচ্ছে তাদের করদ। এর চেয়ে বড় প্রমাণের আর কি প্রয়োজন আছে, শাসকবর্গ যা অপছন্দ করে ডেমোক্রেসিতে যদি এমন কিছু থাকে তখন তারা সেটাকে পায়ের নীচে পিষ্ট করে। নির্বাচনে কারচুপি, স্বাধীনতা হরণ, সত্য কথা বললে টুটি চেপে ধরা ইত্যাদি এমন কিছু বাস্তবতা যা সকলের জানা; এগুলো সাব্যস্ত করার জন্য কোন দলিলের প্রয়োজন নেই। দিনের অস্তিত্ব সাব্যস্ত করার জন্য যদি দলিল লাগে তাহলে বিবেকে আর কিছু ধরবে না।
‘মাউসুআতুল আদইয়ান ওয়াল মাযাহেব আল-মুআসেরা’ গ্রন্থ (২/১০৬৬) তে এসেছে-
পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি: এটি এমন একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যাতে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিবর্গের নির্বাচনে গঠিত পরিষদের মাধ্যমে জনগণ শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকে। এ ব্যবস্থায় জনগণ বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু প্রক্রিয়ায় শাসনকার্যে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে। সে প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে রয়েছে-
১. ভোট দেওয়ার অধিকার: জনগণের কতিপয় ব্যক্তিবর্গ কোন একটি আইনের বিস্তারিত বা সংক্ষিপ্ত বিল উত্থাপন করে। এরপর পার্লামেন্ট কমিটি সেটার উপর আলোচনা করে ও ভোট দেয়।
২. গণভোট দেওয়ার অধিকার: কোন একটি আইন পার্লামেন্টের অনুমোদনের পর জনগণের রায় প্রকাশ করার জন্য পেশ করা।
৩. না-ভোট দেওয়ার অধিকার: কোন একটি আইন প্রকাশ করার নির্দিষ্ট কিছু সময়ের মধ্যে সংবিধান কর্তৃক নির্ধারিত সংখ্যক লোকের পক্ষ থেকে এ আইনের বিরুদ্ধে আপত্তি জানানোর অধিকার। যাতে করে এ আপত্তির ফলে গণভোটের মাধ্যমে সমাধান করা যায়। যদি হ্যাঁ-এর পক্ষে বেশি ভোট পড়ে তাহলে আইনটি কার্যকর করা হয়। আর যদি না-এর পক্ষে বেশি ভোট পড়ে তাহলে সেটি বাতিল করা হয়। বর্তমানে প্রায় সকল সংবিধান এ নিয়মে চলছে। কোন সন্দেহ নেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আল্লাহর আনুগত্য ও আইনপ্রণয়ন অধিকারের ক্ষেত্রে একটি নব্য শিরকের স্বরূপমাত্র। যেহেতু এ প্রক্রিয়ায় স্রষ্টা হিসেবে আল্লাহর আইন প্রণয়ন করার একক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করা হয় এবং মাখলুককে এ অধিকার প্রদান করা হয়। অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে নিছক কিছু নামের ইবাদত কর, সেগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা সাব্যস্ত করে নিয়েছে। আল্লাহ এদের কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। আল্লাহ ছাড়া কারও বিধান দেওয়ার অধিকার নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত করো না। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না।”।[সূরা আল-আনআম, আয়াত: ৫৭] সমাপ্ত।
তিন:
অনেক মানুষ ধারণা করে, ডেমোক্রেসি মানে- স্বাধীনতা, মুক্ততা! এটি একটি ভুল ধারণা। যদিও ‘স্বাধীনতা’ ডেমোক্রেসির উদ্ভাবিত একটি পণ্য। আমরা এখানে স্বাধীনতা বলতে বুঝাতে চাই: বিশ্বাসের স্বাধীনতা, চারিত্রিক স্খলনের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। ইসলামী সমাজের উপর এগুলোর নেতিবাচক প্রভাব অনেক। এ প্রভাব মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে রাসূলগণ, তাদের রিসালাত, কুরআন, সাহাবায়ে কেরামের উপর দোষারোপ করার পর্যায়ে পর্যন্ত পৌঁছে যায়। স্বাধীনতার নামে বেপর্দা, বেহায়াপনা, খারাপ ছবি ও ফিল্ম অনুমোদন দেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এভাবে এর তালিকা লম্বা হতেই থাকে। এ সবগুলো উম্মতের দ্বীনদারি ও চরিত্র ধ্বংস করার অপচেষ্টা। পৃথিবীর নানা রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক শাসনের আড়ালে যে স্বাধীনতার দিকে আহ্বান জানায় সে স্বাধীনতা আবার সবক্ষেত্রে নয়। বরং স্বার্থ ও প্রবৃত্তির শিকলে এ স্বাধীনতা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে তারা মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরআনকে দোষারোপ করা অনুমোদন করে; কিন্তু ‘নাৎসিদের ইহুদি নিধন’ নিয়ে কথার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা নিষেধ। বরং যে ব্যক্তি এ হত্যাযজ্ঞকে অস্বীকার করে তাকে শাস্তি দেয়া হয়, জেলে পুরা হয়। অথচ এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা; এটাকে যে কেউ অস্বীকার করতেই পারে।
যদি আসলেই তারা স্বাধীনতার আহ্বায়ক হতো তাহলে তারা ইসলামী রাষ্ট্রের জনগণকে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদেরকে নেয়ার সুযোগ দিল না কেন?! কেন তারা মুসলমানদের দেশগুলোকে উপনিবেশ বানাল, তাদের ধর্ম ও বিশ্বাস পরিবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করল? ইতালিয়ানরা যখন লিবিয়ার জনগণকে হত্যা করছিল তখন এ স্বাধীনতা কোথায় ছিল? ফ্রান্স যখন আলজেরিয়াতে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল অথবা ইতালিয়ানরা মিশরে গণহত্যা চালাচ্ছিল বা আমেরিকানরা যখন আফগান ও ইরাকে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল তখন এ স্বাধীনতা কোথায় ছিল?
এসব স্বাধীনতার দাবীদারদের নিকটেও স্বাধীনতা কতগুলো নিয়ম-কানুন দ্বারা শৃঙ্খলিত; যেমন-
১- আইন: কোন মানুষের এ অধিকার নেই যে, সে রাস্তাতে সাধারণ চলাচলের বিপরীত দিকে চলবে বা গাড়ী চালাবে। অথবা লাইসেন্স ছাড়া কোন দোকান-পাট খুলবে। যদি সে বলে আমি স্বাধীন; কেউ তার দিকে ভ্রুক্ষেপও করবে না।
২- সামাজিক প্রথা: উদাহরণতঃ কোন নারী সাগর যাপনের পোশাক পরে কোন মৃতব্যক্তির শোকাহত বাড়ীতে যেতে পারে না! যদি বলে আমি স্বাধীন, মানুষ তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে, তাড়িয়ে দিবে। কারণ এটি প্রথার বিপরীত।
৩- সাধারণ রুচিবোধ: উদাহরণতঃ কোন ব্যক্তি মানুষের সামনে বায়ু ত্যাগ করতে পারে না! এমনকি ঢেকুর তুলতে পারে না। যদি সে বলে, আমি স্বাধীন, তাহলে মানুষ তাকে হেয় প্রতিপন্ন করে।
এখন আমরা বলতে চাই:
তাহলে আমাদের ধর্মের কেন এ অধিকার থাকবে না যে, আমাদের স্বাধীনতাকে শৃঙ্খলিত করবে। যেমন- তাদের স্বাধীনতা বেশ কিছু বিষয় দ্বারা শৃঙ্খলিত হয়েছে যে বিষয়গুলোকে তারা অস্বীকার করতে পারে না?! কোন সন্দেহ নেই ইসলাম ধর্ম যা নিয়ে এসেছে এর মধ্যেই রয়েছে কল্যাণ ও মানুষের জন্য উপকার। নারীকে বেপর্দা হতে নিষেধ করা, মদপানে বারণ করা, শুকুর খেতে নিষেধ করা ইত্যাদি সব মানুষের শারীরিক, মানসিক ও জৈবনিক কল্যাণেই। কিন্তু ধর্ম যদি তাদের স্বাধীনতাকে বিধিবদ্ধ করে তখনি তারা সেটা প্রত্যাখ্যান করে। আর যদি তাদের মত অন্য কোন মানুষ বা অন্য কোন আইনের পক্ষ থেকে আসে তখন তারা বলে “শুনলাম ও মানলাম”।
চার:
কিছু মানুষ ধারণা করে- ডেমোক্রেসি শব্দটা ইসলামে ‘শুরা’ শব্দের প্রতিশব্দ। এটি কয়েকটি কারণে ভুল। কারণগুলো নিম্নরূপ:
১. শুরা বা পরামর্শ করা হয় নতুন কোন বিষয় নিয়ে, এমন বিষয়ে যে বিষয়ে কুরআন-হাদিসের বক্তব্য সুস্পষ্ট নয়। পক্ষান্তরে ‘জনগণের শাসন’ এ ধর্মের অকাট্য বিষয়গুলো নিয়েও আলোচনা-পর্যালোচনা করা হয়। এরপর হারামকে হারাম ঘোষণা করা হয় না, হালাল অথবা ওয়াজিবকে হারাম ঘোষণা করা হয়। এসব আইনের বলে মদ বিক্রির বৈধতা দেয়া হয়েছে। ব্যভিচার ও সুদের বৈধতা দেয়া হয়েছে। এসব আইনের মাধ্যমে ইসলামি সংস্থাগুলো ও আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীদের তৎপরতাকে কোণঠাসা করা হয়েছে। এ ধরণের কোণঠাসাকরণ ইসলামি শরিয়ার সাথে সাংঘর্ষিক। শুরা পদ্ধতিতে এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার কোন সুযোগ আছে কি?!
২. শুরা কমিটি গঠিত হয় এমন ব্যক্তিবর্গদের সমন্বয়ে যাদের মধ্যে ফিকহ, ইলম, সচেতনতা ও চরিত্র ইত্যাদির একটা উন্নত মান বিদ্যমান থাকে। কারণ চরিত্রহীন ব্যক্তি বা বোকার সাথে পরামর্শ করা যায় না; আর কাফের বা নাস্তিকের সাথে পরামর্শ তো আরও দূরের কথা। পক্ষান্তরে ডেমোক্রেটিক পার্লামেন্টে: পূর্বোক্ত গুণগুলোর কোন বিবেচনা নেই। একজন কাফের, দুর্নীতিবাজ, নির্বোধ ব্যক্তিও পার্লামেন্ট সদস্য হতে পারবে। সুতরাং শুরার সাথে এ তন্ত্রের কি সম্পর্ক?!
৩. শাসক শুরার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য নন। হতে পারে শুরা কমিটির একজন সদস্য যে পরামর্শ দিয়েছেন তার দলিলের বলিষ্ঠতার কারণে তিনি সেটাই গ্রহণ করবেন। অন্য সদস্যদের মতামতের পরিবর্তে এই মতকে সঠিক মনে করবেন। পক্ষান্তরে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ‘অধিকাংশ সদস্যের’ মত চূড়ান্ত মত। জনগণকে এ মত মেনে চলতে হবে।
অতএব, মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে- তাদের ধর্মকে নিয়ে গৌরববোধ করা, তাদের রবের পক্ষ থেকে দেয়া বিধানের প্রতি আস্থা রাখা; এ বিধান তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণে যথেষ্ট এবং আল্লাহর শরিয়ত বিরোধী সকল তন্ত্র-মন্ত্র থেকে নিজের মুক্ততা ঘোষণা করা।
শাসক ও শাসিত সকল মুসলমানের কর্তব্য জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান মেনে চলা। ইসলাম ছাড়া অন্য কোন তন্ত্র বা জীবনপদ্ধতি গ্রহণ করা হারাম। আল্লাহকে রব হিসেবে, ইসলামকে ধর্ম হিসেবে ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবী হিসেবে গ্রহণ করার দাবী হচ্ছে- প্রকাশ্যে ও গোপনে ইসলামকে আঁকড়ে ধরা, আল্লাহর শরিয়তকে সম্মান করা, নবীর আদর্শের অনুসরণ করা।
আমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি তিনি যেন ইসলামের মাধ্যমে আমাদেরকে শক্তিশালী করেন এবং ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেন।
আল্লাহই ভাল জানেন।
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
বাইআত করতে হয় শুধুমাত্র মুসলিম শাসকের হাতে। আহলে হিল্ল ও আকদ তাঁর হাতে বাইআত করবেন। আহলে হিল্ল ও আকদ হচ্ছে- আলেম সমাজ, সম্মানিত ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। এ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বাইআত করার মাধ্যমে তাঁর কর্তৃত্ব সাব্যস্ত হবে। সাধারণ মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বাইআত করতে হবে না। বরং তারা তার আনুগত্য করবে যতক্ষণ না সেটা গুনাহর আওতায় না পড়ে।
আল-মাজেরি বলেন: “যারা আহলে হিল্ল ওয়াল আকদ শুধু তারা ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বাইআত করলে যথেষ্ট; সর্বসাধারণের বাইআত করা ওয়াজিব নয়। প্রত্যেক ব্যক্তিকে সশরীরে তার কাছে হাযির হয়ে হাতে হাত রাখতে হবে এটা জরুরী নয়। বরং প্রত্যেকে তার আনুগত্য করবে, তার কথা মেনে চলবে, তার বিরোধিতা করবে না, তার বিপক্ষে যাবে না।”[ফাতহুল বারী থেকে সংকলিত]
ইমাম নববী ‘শরহে সহিহ মুসলিম’ গ্রন্থে বলেন: বাইআতের ব্যাপারে সকল আলেম একমত যে, বাইআত শুদ্ধ হওয়ার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে বাইআত করতে হবে এমন কোন শর্ত নেই। আহলে হিল্ল ওয়াল আকদের প্রত্যেক ব্যক্তিকে বাইআত করতে হবে সেটাও শর্ত নয়। বরং শর্ত হচ্ছে- আলেমসমাজ, নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও প্রভাবশালী লোকদের মধ্যে যাদেরকে একত্রিত করা সম্ভব হয় তাদের বাইআত করা...। প্রত্যেক ব্যক্তিকে ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে এসে হাতে হাত রেখে বাইআত করতে হবে এমনটি ওয়াজিব নয়। বরং সকলের উপর ওয়াজিব হচ্ছে- রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশ মেনে চলা, তার বিরোধিতা না করা, বিদ্রোহী না হওয়া।” সমাপ্ত
যেসব হাদিসে বাইআতের কথা এসেছে সেখানে বাইআত দ্বারা রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বাইআত করা উদ্দেশ্য। যেমন- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল কিন্তু তার গর্দানে বাইআত নেই সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল।” [সহিহ মুসলিম (১৮৫১)]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তি কোন রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বাইআত করেছে, হাত দিয়ে ও অন্তর থেকে তার সাথে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছে সে যেন যথাসম্ভব সে রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্য করে। যদি কোন লোক এ রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে টানাটানি করতে আসে তখন তোমরা সে লোকের গর্দান ফেলে দাও।” [সহিহ মুসলিম (১৮৪৪)] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যদি দুইজন খলিফার হাতে বাইআত করা হয় তখন শেষের জনকে হত্যা কর” [সহিহ মুসলিম (১৮৫৩)] এ হাদিসগুলো প্রত্যেকটি রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বাইআত করা সংক্রান্ত; এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
বিভিন্ন দলের হাতে বাইআত করা সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে শাইখ সালেহ আল-ফাওযান বলেন: বাইআত শুধুমাত্র মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে করতে হবে। এ ছাড়া যত বাইআত আছে এগুলো বিদআত। এ বাইআতগুলো অনৈক্যের কারণ। একই দেশের একই রাজ্যের মুসলমানদের উপর আবশ্যকীয় হলো একজন রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বাইআত করা। একাধিক বাইআত করা নাজায়েয।[আল-মুনতাকা মিন ফাতাওয়াস শাইখ সালেহ আল-ফাওযান ১/৩৬৭]
রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে বাইআত করার পদ্ধতি: পুরুষের বাইআত করার পদ্ধতি হবে মৌখিকভাবে ও কর্মের মাধ্যমে অর্থাৎ মুসাফাহা করে। আর নারীদের ক্ষেত্রে শুধু মৌখিকভাবে। এ পদ্ধতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে সাহাবায়ে কেরামের বাইআতের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়েছে। এ বিষয়ে আয়েশা (রাঃ) এর উক্তি হচ্ছে- “না, আল্লাহর শপথ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাত কখনো কোন নারীর হাতকে স্পর্শ করেনি। তিনি তাদেরকে মৌখিকভাবে বাইআত করাতেন।”[সহিহ বুখারী (৫২৮৮) সহিহ মুসলিম (১৮৬৬)]
ইমমা নববী (রহঃ) হাদিসটির ব্যাখ্যায় বলেন: এ হাদিসে মহিলাদের হাত না ধরে মৌখিকভাবে বাইআত করানোর দলিল রয়েছে এবং পুরুষের হাত ধরে ও মৌখিকভাবে বাইআত করানোর দলিল রয়েছে।” সমাপ্ত
আল্লাহই ভাল জানেন।