সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
হাদিস বিশারদগণ হাদিসকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে থাকেন। কয়েকটি দিক বিবেচনায় এ বিভাজনটি করা হয়ে থাকে। তেমনি একটি দিক হচ্ছে- বক্তা অনুসারে উক্তি (হাদিস) কে বিভাজন করা। হাদিসবিদগণ বলেন: বক্তা বা উক্তিকারীর দিক বিবেচনা করে হাদিসকে চার ভাগে ভাগ করা যায়।
এক: হাদিসে কুদসি:
যে হাদিস আমাদের নিকট নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সূত্রে তাঁর রব্ব থেকে বর্ণিত হয়েছে। এ হাদিসের ক্ষেত্রে রাবি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রব্ব থেকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন অথবা এ ধরনের কোন কথা।
দুই: হাদিসে মারফু
যে কথা, কাজ, অনুমোদন অথবা গুণকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সম্বন্ধিত করা হয়।
তিন: হাদিসে মাওকুফ
যে কথা, কাজ, অনুমোদন অথবা গুণকে সাহাবীর সাথে সম্বন্ধিত করা হয়। অর্থাৎ যে কথা, কাজ সাহাবী হতে প্রকাশিত হয়েছে; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে নয়।
যেমন- আলী (রাঃ) এর উক্তি: “তুমি তোমার প্রিয় ব্যক্তিকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিল হও; হতে পারে সে একদিন তোমার দুশমন হয়ে যাবে। তুমি তোমার দুশমনকে ঘৃণা করার ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিল হও; হতে পারে সে একদিন তোমার প্রিয়ব্যক্তি হয়ে যাবে। [এই মাওকুফ হাদিসটি ইমাম বুখারী তাঁর ‘আদাবুল মুফরাদ’ গ্রন্থে সংকলন করেছেন (নং-৪৪৭)]
খতিব বাগদাদি বলেন: “বর্ণনাকারী যে হাদিসকে সাহাবীর সাথে সম্পৃক্ত করেন; সাহাবীকে অতিক্রম করে যায় না।”
ইমাম হাকেম সনদ (সূত্র) পরম্পরা কর্তন না হওয়ার শর্ত করেছেন। তিনি বলেছেন: হাদিসটি সাহাবী থেকে বর্ণনা করা হবে। এতে কোন ইরসাল (শেষের দিকে সূত্রচ্ছেদ) বা ইদাল (দুই বা ততোধিক ব্যক্তির সূত্রচ্ছেদ) থাকতে পারবে না। যখন সূত্র সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছবে তখন বলবে: তিনি এই এই বলেছেন অথবা তিনি এই এই করেছেন অথবা তিনি এই এই নির্দেশ দিতেন।
অনেক সময় সাহাবী ছাড়া অন্য কারো কোন উক্তির ক্ষেত্রেও মাওকুফ শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বলতে হবে যেমন: এই হাদিসটি অমুক রাবি ‘যুহরি’র মাওকুফ হিসেবে অথবা ‘আতা’র মাওকুফ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এ দুইজনের প্রত্যেকে তাবেঈ অথবা তাবে-তাবেঈ।
চার: হাদিসে মাকতু
যে কথা, কাজ, অনুমোদন অথবা গুণকে তাবেঈর সাথে সম্বন্ধিত করা হয়। এটাকে আছারও বলা হয়। যেমন- মাসরুক ইবনে আজদা থেকে বর্ণিত আছে: “কোন ব্যক্তির আল্লাহভীতি তাঁর ইলম সাব্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট। আর কোন ব্যক্তির আত্মম্ভরিতা তার অজ্ঞতা সাব্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট।”
ইবনে সালাহ (রহঃ) বলেন: সনদকর্তিত কোন হাদিসকে মুনকাতি না বলে মাকতু বলার উদাহরণ আমি শাফেয়ি (রহঃ), আবুল কাসেম তাবারানী (রহঃ) প্রমুখের বক্তব্যে পেয়েছি।[মুকাদ্দিমাতু ইবনে সালাহ ফি উলুমিল হাদিস, পৃষ্ঠা-২৮]
যে গ্রন্থগুলোতে মাওকুফ ও মাকতু হাদিস বেশি পাওয়া যায় সেগুলো হচ্ছে- মুসান্নাফে ইবনে আবু শায়বা, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক সানআনি, ইমাম তাবারির তাফসিরে তাবারি, ইবনে মুনযির এর গ্রন্থাবলী ইত্যাদি।
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে হাদিসের প্রকারভেদ আরো বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন: ইবনে হাজারের ‘নুখবাতুল ফিকার” (পৃষ্ঠা-২১), অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয় জানার জন্য পড়ুন সাখাবীর “ফাতহুল মুগিছ” (১/১০৮-১১২), ড. আব্দুল্লাহ আল-জাদি এর “তাহরিরু উলুমিল হাদিস” (১/২৫) এবং ড. মাহমুদ তাহ্হান এর “তাইসিরু মুসতালাহিল হাদিস” (পৃষ্ঠা-৬৭)।
আল্লাহই ভাল জানেন।
উত্তর :সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
এক:
রজব মাসের ফজিলতের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছ থেকে কোন বর্ণনা সহিহ সাব্যস্ত হয়নি। দেখুন 75394 ও 171509 নং প্রশ্নোত্তর।
শাইখ উছাইমীন (রহঃ) বলেন:
“রজব মাসের ফজিলতের ব্যাপারে কোন সহিহ হাদিস বর্ণিত হয়নি। ‘রজব’ মাসের আগের মাস ‘জুমাদাল আখেরা’ মাসের উপর রজব মাসের ভিন্ন কোন মর্যাদা নেই; শুধু এইটুকু রজব মাস হারাম মাসগুলোর একটি। রজব মাসে বিশেষ কোন রোজা নেই। বিশেষ কোন নামাজ নেই। বিশেষ কোন উমরা নেই। অন্য কোন ইবাদত নেই। রজব মাস অন্য যে কোন মাসের মতোই।” সংক্ষেপিত ও সমাপ্ত। [লিকাউল বাব আল-মাফতুহ’ (২৬/১৭৪)]
দুই:
আব্দুল্লাহ ইবনে ইমাম আহমাদ ‘যাওয়ায়িদুল মুসনাদ’ (২৩৪৬) এ, তাবারানি তাঁর ‘আল-আওসাত’ (৩৯৩৯) এ, বায়হাকি তাঁর ‘শুয়াবুল ঈমান’ (৩৫৩৪) এ, আবু নুআইম তাঁর ‘আল-হিলয়া’ গ্রন্থে যায়েদা বিন আবু রিকাদ এর সূত্রে তিনি বলেন: যিয়াদ আল-নুমাইরি, আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: যখন রজব মাস প্রবেশ করত তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন: “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজব ও শাবান ওয়া বাল্লিগ না রমজান” (অর্থ-হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাস আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন)। এ হাদিসটির সনদ বা সূত্র দুর্বল। সনদের বর্ণনাকারী যিয়াদ আল-নুমাইরি যয়ীফ (দুর্বল)। ইবনে মাঈন তাকে যয়ীফ আখ্যায়িত করেছেন। আবু হাতিম বলেছেন: তাকে দিয়ে দলিল পেশ করা যাবে না। ইবনে হিব্বান তাকে দুর্বলদের বই এ উল্লেখ করে বলেছেন: তাকে দিয়ে দলিল পেশ করা যাবে না।[মিযানুল ইতিদাল (২/৯১)]
বর্ণনাকারী যায়িদা বিন আবু রিকাদ আরও যয়ীফ (দুর্বল)। আবু হাতিম বলেন: তিনি যিয়াদ আল-নুমাইরি এর সূত্রে আনাস (রাঃ) থেকে বেশ কিছু মারফু হাদিস বর্ণনা করেছেন যেগুলো ‘মুনকার’। এমন হাদিস আমরা তার সূত্রে অথবা যিয়াদ এর সূত্রে জানি না। বুখারি বলেন: ‘মুনকার উল হাদিস’। নাসাঈ বলেন: ‘মুনকার উল হাদিস’। নাসাঈ ‘আল-কুনা’ গ্রন্থে বলেন: ‘তিনি ছিকাহ (নির্ভরযোগ্য) নন’। ইবনে হিব্বান বলেন: “বিখ্যাত রাবীদের থেকে মুনকার (অখ্যাত) হাদিস বর্ণনা করেন। তার হাদিস দিয়ে দলিল দেয়া যাবে না। তার হাদিস অন্য হাদিসের সহায়ক হাদিস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।” ইবনে আদি বলেন: “তিনি আল-মুকাদ্দামি ও অন্যদের থেকে ‘ইফরাদ’ হাদিস বর্ণনা করেন। তার কিছু হাদিস সমালোচিত।”[তাহযিবুত তাহযিব ৩/৩০৫-৩০৬]
ইমাম নববী তাঁর ‘আল-আযকার’ গ্রন্থ (পৃষ্ঠা-১৮৯) এ, ইবনে রজব তাঁর ‘লাতায়িফুল মাআরিফ’ (পৃষ্ঠা- ১২১) এ এবং আলবানি তাঁর ‘যয়িফুল জামে’ (পৃষ্ঠা-৪৩৯৫) এ হাদিসটিকে ‘যয়িফ’(দুর্বল) আখ্যায়িত করেছেন।
হাইছামি বলেন: বায্যার হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। হাদিসটির সনদে ‘যায়িদা বিন আবু রিকাদ’ রয়েছেন। বুখারি বলেন: হাদিস বর্ণনাকারী হিসেবে অখ্যাত এবং অনেক ইমাম তাকে ‘মাজহুল’ (অপরিচিত) বলেছেন।[মাজমাউল যাওয়েদ (২/১৬৫)]
হাদিসটি দুর্বল; তদুপরি এ হাদিসের মধ্যে এমন কোন দলিল নেই যা প্রমাণ করবে যে, রজব মাসের প্রথম রাত্রিতে এটি বলা হবে। বরং এটি বরকতের জন্য সাধারণ দু’আ। এ দু’আ রজব মাসে বা রজব মাসের আগেও বলা যাবে।
তিন:
পক্ষান্তরে কোন মুসলমানের রমজান মাস পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করতে কোন অসুবিধা নেই। হাফেয ইবনে রজব (রহঃ) বলেন: “মুয়াল্লা বিন ফজল বলেন তাঁরা ছয়মাস দু’আ করতেন রমজান মাস পাওয়ার জন্য এবং ছয়মাস দু’আ করতেন তাদের আমলগুলো কবুল হওয়ার জন্য।” ইয়াইয়া বিন কাছির বলেন: তাদের দু’আর মধ্যে ছিল ‘হে আল্লাহ! আমাকে রমজান পর্যন্ত নিরাপদ রাখুন। রমজানকে আমার জন্য নিরাপদ করুন এবং রমজানের আমলগুলো কবুল করে আমার কাছ থেকে রমজানকে বিদায় করবেন।”[লাতায়িফুল মাআরিফ (পৃষ্ঠ- ১৪৮) থেকে সমাপ্ত।
শাইখ আব্দুল করিম আল-খুদাইরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:
“আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজব ও শাবান ওয়া বাল্লিগ-না রমজান” হাদিসটির শুদ্ধতা কি?
তিনি জবাবে বলেন: এ হাদিসটি সাব্যস্ত নয়। কিন্তু কোন মুসলিম যদি রমজান পাওয়ার জন্য, রোজা পালন ও কিয়াম সাধনার তাওফিকের জন্য এবং লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য দু’আ করে অর্থাৎ সাধারণ দু’আ করে- ইনশাআল্লাহ এতে কোন অসুবিধা নেই।[শাইখের ওয়েব সাইট http://khudheir.com/text/298 থেকে সংকলিত।
আল্লাহই ভাল জানেন।
উত্তর : সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
এই হাদিসটি সহীহ নয়। এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে সাব্যস্ত হয়নি। ইমাম বাইহাকী তাঁর ‘শুআবুল ঈমান’ (৩/১৪৩৭) গ্রন্থে ‘আব্দুল্লাহ ইবনে আবু আওফা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
عن عبد الله بن أبي أوفى رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : (نوم الصائم عبادة ، وصمته تسبيح ، ودعاؤه مستجاب ، وعمله مضاعف )
“রোজাদারের ঘুম হল ইবাদত। তার নিরবতা অবলম্বন হল- তাসবীহ। আর তার দোয়া হল কবুলযোগ্য এবং তার আমলের সওয়াব বহুগুণ বেশি।”
ইমাম বাইহাকী এই হাদিসটির সনদকে “যয়ীফ” (দুর্বল) আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন: মারূফ ইবনে হাসসান (সনদের রাবীদের একজন): যয়ীফ (দুর্বল) এবং সুলাইমান ইবনে আমর আন-নাখাঈ তার চেয়েও যয়ীফ (দুর্বল)।
ইরাকী তাঁর ‘তাখরীজ ইহইয়া উলুমুদ দ্বীন’ (১/৩১০) নামক গ্রন্থে বলেন: সুলাইমান আন-নাখাঈ মিথ্যাবাদীদের একজন।
মুনাউয়ী তাঁর ‘ফাইজুল কাদির’ (৯২৯৩) নামক গ্রন্থে তাকে যয়ীফ (দুর্বল) আখ্যায়িত করেছেন। আলবানী ‘সিলসিলাতুল আহাদিস আদ যায়িফা’ (৪৬৯৬) গ্রন্থে তাকে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন: “সে যয়ীফ (দুর্বল)”।
তাই সাধারণ মুসলমানদের দায়িত্ব হলো খতিব ও ওয়াজের-বক্তাদের বক্তব্য তাদের নিকট থেকে নিশ্চিত হওয়া। এতে করে তারা কোন উক্তিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে সম্পৃক্ত করার আগে নিশ্চিতভাবে জেনে নিবেন। কারণ যে কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেননি তা তাঁর উপর আরোপ করা জায়েয নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
قال صلى الله عليه وسلم : (إِنَّ كَذِبًا عَلَيَّ لَيْسَ كَكَذِبٍ عَلَى أَحَدٍ ، مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنْ النَّارِ)
رواه البخاري (1391) ورواه مسلم في مقدمة صحيحه (4) .
“নিশ্চয় আমার নামে মিথ্যা বলা অন্য কারো নামে মিথ্যা বলার মত নয়। যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার নামে মিথ্যা বলে সে যেন তার স্থান জাহান্নামে নির্ধারণ করে নেয়।” [সহীহ বুখারী (১৩৯১) ও সহীহ মুসলিমের ভূমিকায় (৪)]
আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।