ইসলাম কিউ এ ফতোয়া সমগ্র ইসলামী আইন ও এর মূলনীতি শাইখ মুহাম্মাদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ ১ টি
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত হওয়া সত্ত্বেও কেন মুসলমানেরা ইতিকাফ করা ছেড়ে দিয়েছে? ইতিকাফের মূল উদ্দেশ্যই বা কি?

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য।

এক:

ইতিকাফ সুন্নতে মুয়াক্কাদা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সুন্নত নিয়মিত পালন করতেন।

ইতিকাফ শরয়ি বিধান হওয়ার পক্ষের দলীলগুলো দেখুন (48999) নং প্রশ্নের উত্তরে।

এই সুন্নতটি মুসলিম জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। আল্লাহর খাস রহমতপ্রাপ্ত গুটি কতক মানুষ ব্যতীত আর কেউ তা পালন করে না। যে সুন্নতগুলো মুসলমানেরা একেবারে ছেড়ে দিয়েছে বা ছেড়ে দেয়ার উপক্রম হয়েছে- ইতিকাফ তার একটি।

মুসলমানেরা ইতিকাফ ছেড়ে দেয়ার কারণগুলো নিম্নরূপ:

১. একটা বড় সংখ্যক মুসলমানের ‘ঈমানী দুর্বলতা।

২. দুনিয়ার জীবনের সুখস্বাচ্ছন্দ্য, ভোগ বিলাসের প্রতি অতি মাত্রায় ঝুঁকে পড়া। যার ফলে তারা অল্প সময়ের জন্য হলেও এসব ভোগবিলাস থেকে দূরে থাকতে সক্ষম নয়।

৩. অনেক মানুষের মনে জান্নাত লাভের প্রেরণা নেই। তারা অতিমাত্রায় আরাম-আয়েশের দিকে ঝুঁকে আছে। তাই তারা ইতিকাফের সামান্য কষ্টও সহ্য করতে চায় না। যদিও তা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য হোক না কেন।

কারণ যে ব্যক্তি জান্নাতের মহান মর্যাদা ও এর সুখণ্ডস্বাচ্ছন্দ্য সম্পর্কে জানে, সে তার জান, তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ কোরবান করে হলেও তা লাভের চেষ্টা করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহর সামগ্রী অতি মূল্যবান। জেনে রাখো, আল্লাহর সামগ্রী হচ্ছে- জান্নাত।”[জামে তিরমিযি; আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন (২৪৫০)]

৪. অনেক মানুষের মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালবাসা শুধু মুখে সীমাবদ্ধ। বাস্তব কাজে ভালবাসা নেই। বাস্তব ভালবাসা তো হচ্ছে- মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নানাবিধ সুন্নত পালন করা। এ রকম একটি সুন্নত হচ্ছে-ইতিকাফ। আল্লাহ বলেছেন: “নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মাঝে আছে উত্তম আদর্শ। তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।”[৩৩ আল-আহযাব : ২১]

ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন: (৩/৭৫৬)

“এই মহান আয়াতটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতিটি কথা, কাজ ও প্রতিটি মুহূর্ত অনুসরণের ব্যাপারে একটি মহান মূলনীতি।” সমাপ্ত

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়মিত ইতিকাফ করা সত্ত্বেও মানুষদের ইতিকাফ ছেড়ে দেয়া দেখে জনৈক সলফে সালেহীন বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। ইবনে শিহাব যুহ্‌রী বলেন: “এটি খুবই আশ্চর্যজনক যে মুসলমানেরা ইতিকাফ করছে না। অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনাতে আসার পর থেকে আল্লাহ তাঁকে মৃত্যু দান করা পর্যন্ত তিনি ইতিকাফ বাদ দেননি।”

দুই:

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের শেষ দিকে রমজান মাসের শেষ দশদিন নিয়মিত ইতিকাফ পালন করতেন। সত্যিকার অর্থে ইতিকাফের এই কয়টি দিন একটি শিক্ষামূলক ইনটেনসিভ কোর্স তুল্য। এর ইতিবাচক ফলাফল মানুষের জীবনে তাৎক্ষণিকভাবে, এমনকি ইতিকাফের দিনগুলোতে পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া পরবর্তী রমজান পর্যন্ত অনাগত দিনগুলোর উপরেও এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়।

তাই মুসলমানদের মাঝে এই সুন্নতকে পুর্নজীবিত করা কতই না জরুরী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ যে আমলের উপর অটল ছিলেন তা পুণঃ প্রতিষ্ঠা করা কতই না প্রয়োজন।

মানুষের এই গাফিলতি ও উম্মতের এই দুর্দশার সময় যারা সুন্নতকে আকঁড়ে ধরে আছে তাদের পুরষ্কার কতই না মহান হবে!

তিন:

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইতিকাফের মূল লক্ষ্য ছিল- লাইলাতুল কদর পাওয়া। ইমাম মুসলিম (১১৬৭) আবু সাঈদ খুদরী থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেছেন: “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের প্রথম দশ দিন ইতিকাফ করেছেন। এরপর তিনি মাঝের দশদিন তুর্কী ক্বুব্বাতে (এক ধরণের ছোট তাঁবুতে) ইতিকাফ করেছেন। যে তাবুর দরজার উপর একটি কার্পেট ঝুলানো ছিল। রাবী বলেন: তিনি তাঁর হাত দিয়ে কার্পেটটিকে ক্বুব্বার এক পাশে সরিয়ে দিলেন। এরপর তাঁর মাথা বের করে লোকদের সাথে কথা বললেন। লোকেরা তাঁর কাছে আসল। অতঃপর তিনি বললেন, “আমি প্রথম দশদিন ইতিকাফ করেছি- এই রাতের (লাইলাতুল ক্দরের) খোঁজে, এরপর মাঝের দশ দিন ইতিকাফ করেছি। এরপর আমাকে বলা হল: লাইলাতুল কদর শেষ দশকে। সুতরাং আপনাদের মধ্যে যার ইচ্ছা হয় তিনি ইতিকাফ করুন। তখন লোকেরা তাঁর সাথে ইতিকাফ চালিয়ে গেল।”

এই হাদিসের কিছু শিক্ষণীয় দিক নিম্নরূপ:

১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইতিকাফের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভাগ্য রজনী সন্ধান করা এবং সেই রাতে নামায আদায় ও ইবাদতের মাধ্যমে কাটানোর জন্য প্রস্তুত হওয়া। যেহেতু ভাগ্য রজনীর সুমহান ফজিলত রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “লাইলাতুল ক্দর (ভাগ্য রজনী) হাজার মাস থেকেও উত্তম।” [৯৭ সূরা আল-ক্বাদর, আয়াত ৩]

২. এই রাতের অবস্থান জানার আগে সেটাকে পাওয়ার জন্য তিনি তাঁর সবটুকু চেষ্টা উৎসর্গ করেছেন। তাই তো তিনি প্রথম দশদিন থেকে ইতিকাফ করা শুরু করেন, এরপর মাঝের দশ দিনেও ইতিকাফ করেন, এভাবে মাসের শেষ পর্যন্ত ইতিকাফ চালিয়ে যান। এক পর্যায়ে তাঁকে জানানো হয় যে, লাইলাতুল ক্দর শেষ দশকে রয়েছে। এটি ছিল লাইলাতুল ক্দরকে পাওয়ার জন্য তাঁর চূড়ান্ত প্রচেষ্টা।

৩. সাহাবীগণ কর্তৃক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিপূর্ণ অনুসরণ। তাই তো তাঁরাও তাঁর সাথে মাসের শেষ পর্যন্ত ইতিকাফ চালিয়ে যান। এর মাধ্যমে সাহাবীগণ কর্তৃক তাঁকে অনুসরণের পরাকাষ্ঠা ফুটে উঠে।

৪. সাহাবীগণের প্রতি তাঁর ভালবাসা ও দয়া। ইতিকাফ করতে কষ্ট আছে সেটা তাঁর জানা ছিল বিধায় তিনি সাহাবীদেরকে ইতিকাফ চালিয়ে যাওয়া অথবা ইতিকাফ থেকে বের হয়ে যাওয়ার দুটো এখতিয়ার দিয়েছিলেন। তাই তিনি বলেছেন: “সুতরাং আপনাদের মধ্যে যার ইচ্ছা হয় তিনি ইতিকাফ করুন।”

এছাড়াও ইতিকাফের আরো কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে, যেমন :

১. মানুষ থেকে যথাসম্ভব বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর ঘনিষ্ঠতায় থাকা।

২. সর্বাত্মকরণে আল্লাহ অভিমুখী হয়ে আত্মশুদ্ধি করা।

৩. অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু নিরেট ইবাদত যেমন নামায, দুআ, যিকির ও কুরআন তেলাওয়াতে মশগুল হওয়া।

৪. রোজার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এমন সবকিছু থেকে রোজাকে হেফাযত করা। যেমন আত্মার কু প্রবৃত্তি ও যৌন কামনা বাসনা।

৫. দুনিয়ার বৈধ বিষয়গুলো ভোগ করা কমিয়ে আনা এবং সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এগুলো ভোগের ক্ষেত্রে কৃচ্ছতা অবলম্বন করা।

দেখুন আব্দুল লত্বিফ বালতুব কর্তৃক রচিত ‘ইতিকাফ নাযরা তারবাবিয়া’ (ইতিকাফ: প্রশিক্ষণমূলক দৃষ্টিকোণ)।

http://islamqa.info/bn/49007