মানব সমাজে এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যা কখনো বড় শিরক আবার কখনো ছোট শির্কে পরিণত হয়। মানুষের অন্তরের অবস্থা ভেদে তা থেকে যেসব কথা ও কাজ প্রকাশিত হয়, সে অনুপাতেই এগুলো কখনো বড় শিরক আবার কখনো ছোট শির্কে পরিণত হয়। অনেক মানুষ এতে আক্রান্ত হচ্ছে। এগুলো কখনো আকীদার পরিপন্থী হয় আবার কখনো আকীদার পরিচ্ছন্নতাকে ঘোলাটে করে ফেলে। সাধারণ জনগণের মধ্যে এগুলোর চর্চা ব্যাপকভাবে হয়ে থাকে। মূর্খ লোকেরা মিথ্যুক, চালবাজ, ফাঁকিবাজ ও ভেলকিবাজদের খপ্পরে পড়ে এসবের শিকার হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এগুলো থেকে মুসলিমদেরকে সাবধান করেছেন।
এগুলো জাহেলী যুগের কাজ। এগুলো পরিধান করা ছোট শিরকের অন্তর্ভুক্ত। তবে এগুলো পরিধানকারীদের অন্তরের অবস্থা ও আকীদা অনুপাতে বড় শিরকের স্তরে পৌঁছতে পারে। সাহাবী ইমরান ইবনে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
أن النبي صلى الله صلى الله عليه وسلم رَأَى رَجُلاً فِى يَدِهِ حَلْقَةٌ مِنْ صُفْرٍ فَقَالَ مَا هَذِهِ الْحَلْقَةُ قَالَ هَذِهِ مِنَ الْوَاهِنَةِ قَالَ انْزِعْهَا فَإِنَّهَا لاَ تَزِيدُكَ إِلاَّ وَهْنًا
‘‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তির হাতে পিতলের একটি বালা দেখলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কি?’’ লোকটি বললো, এটা দুর্বলতা দূর করার জন্য পরিধান করা হয়েছে। তিনি বললেন, এটা খুলে ফেল। কারণ এটা তোমার দুর্বলতাকে আরো বৃদ্ধি করবে। আর এটা তোমার সাথে থাকা অবস্থায় যদি তোমার মৃত্যু হয়, তাহলে তুমি কখনো সফলকাম হতে পারবে না’’।[1]
ইমাম আহমাদ ইবনে হান্বাল রহিমাহুল্লাহ ত্রুটিমূক্ত সনদে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনে হিববান ও হাকেম সহীহ বলেছেন এবং ইমাম যাহাবী হাকেমের কথাতে সহমত পোষণ করেছেন।
[1]. মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ। ইমাম আলবানী (রহি.) এই হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন। দেখুন: সিলসিলা যঈফা, হাদীছ নং- ২১৯৫।
ছিদ্রবিশিষ্ট এক শ্রেণীর পুঁতি বা দানাকে التميمة বা তাবীজ বলা হয়। বদনযর থেকে বাঁচার জন্য প্রাচীন আরবরা শিশুদের গলায় তাবীজ ঝুলাতো এবং تميمة নামের মাধ্যমে তারা এভাবে বরকতের আশা করতো যে, আল্লাহ তা‘আলা যেন তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করেন। তাবীজ কখনো হাড্ডী দিয়ে, কখনো পুঁতি বা দানা দিয়ে, কখনো কাগজে লিখে এবং অন্যান্য জিনিস দিয়েও তৈরী হয়। কোনো অবস্থাতেই এগুলো পরিধান করা বৈধ নয়।
কখনো কুরআন দিয়ে তাবীজ তৈরী করেও ঝুলানো হয়ে থাকে। সুতরাং কুরআন দিয়ে তাবীজ লেখা হলে তা জায়েয হওয়া বা না হওয়ার ব্যাপারে আলেমদের কিছু মতভেদ রয়েছে। তবে শিরকের দরজা বন্ধ করার জন্য আলেমদের দুই মতের মধ্যে প্রাধান্যযোগ্য মতে কুরআন দিয়ে তাবীজ লিখে ঝুলানো বৈধ নয়। কেননা কুরআন দিয়ে ঝুলানো জায়েয বলা হলে লোকেরা কুরআন ছাড়া অন্যান্য জিনিস দিয়ে তাবীজ বানিয়ে ঝুলানোর সুযোগ পেয়ে যাবে। আর সকল প্রকার তাবীজ ঝুলানো থেকে নিষেধ করা হয়েছে। তাবীজ ঝুলানোর এই নিষেধাজ্ঞা থেকে কোনো কিছুকেই আলাদা বা খাস করা হয়নি। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, ‘‘আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,
إِنَّ الرُّقَى وَالتَّمَائِمَ وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ
‘‘ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবজ ঝুলানো শিরক’’।[1] ইমাম আহমাদ ইবনে হান্বাল ও আবু দাউদ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
উকবা ইবনে আমের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু হিসাবে বর্ণিত হয়েছে যে, من علق تميمة فقد أشرك ‘‘যে ব্যক্তি তাবীজ ঝুলালো সে শিরক করলো’’। তাবীজ লাগানো নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে এ দলীলগুলো ব্যাপক অর্থবোধক। তা থেকে কোনো কিছুকেই খাস করা হয়নি। অর্থাৎ এগুলো কুরআন দিয়ে তৈরী কিংবা কুরআন ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে তৈরী সকল প্রকার তাবীজকেই হারাম করেছে।
[1]. মুসনাদে আহমাদ ও সুনানে আবু দাউদ। ইমাম আলবানী (রহি.) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুন: সিলসিলা ছহীহা, হাদীছ নং- ৩৩১।
التبرك অর্থ হলো বরকত অন্বেষণ করা, বরকত কামনা করা এবং উপরোক্ত জিনিসগুলোতে বরক আছে বলে বিশ্বাস করা। উপরোক্ত জিনিসগুলো থেকে বরকত অন্বেষণ করা বড় শিরক। কেননা এর মাধ্যমে বরকত হাসিলের জন্য আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য জিনিসের উপর ভরসা করা হয়ে থাকে। মূর্তিপূজকরা উপরোক্ত জিনিসগুলো থেকে বরকত অন্বেষণ করতো। সৎ লোকদের কবর থেকে বরকত হাসিল করাও বড় শিরক। যেমন লাত নামক মূর্তি থেকে বরকত লাভ করা, গাছ ও পাথর থেকে বরকত হাসিল করা এবং উয্যা ও মানাত নামক মূর্তি থেকে বরকত লাভ করা সৎ লোকদের কবর থেকে বরকতের আশা করার মতোই।
আবু ওয়াকিদ আল-লাইছী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
خَرَجَنا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم إلى حنين ونحن حدثاء عهد بكفر لِلْمُشْرِكِينَ سدرة يعكفون عندها و يُعَلِّقُونَ عَلَيْهَا أَسْلِحَتَهُمْ يُقَالُ لَهَا ذَاتُ أَنْوَاطٍ فَمررنا بسدرة فقلنا يَا رَسُولَ اللَّهِ اجْعَلْ لَنَا ذَاتَ أَنْوَاطٍ كَمَا لَهُمْ ذَاتُ أَنْوَاطٍ. فَقَالَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم اللَّهُ أَكْبَرُ إنها السنن قلتم والذي نفسي بيده كما قالت بنوا إسرائيل لموسى ﴿اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ﴾ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَتَرْكَبُنَّ سُنَّةَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ
‘‘আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে হুনাইন যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বের হলাম। আমরা তখন সবেমাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছি। এক স্থানে মুশরিকদের একটি বড়ইগাছ ছিল। তারা সেটার পাশে অবস্থান করতো এবং তাদের সমরাস্ত্র তাতে ঝুলিয়ে রাখতো। গাছটিকে তারা ذات أنواط ‘যাতু আনওয়াত’ বা বরকত ওয়ালা গাছ বলতো। আমরা একদিন একটি বড়ই গাছের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! মুশরিকদের যেমন ‘যাতু আনওয়াত’ আছে আমাদের জন্যও অনুরূপ ‘যাতু আনওয়াত’ নির্ধারণ করে দিন। তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহু আকবার! এটি পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতি ছাড়া আর কিছু নয়। যার হাতে আমার জীবন তার শপথ! তোমরা এমন কথাই বলেছ, যা বনী ইসরাঈলের লোকেরা মূসা (আ.) কে বলেছিল। তারা বলেছিল, ‘‘হে মূসা! মুশরিকদের যেমন মাবুদ আছে আমাদের জন্য তেমনি একটি মাবুদ নির্ধারণ করে দাও। মূসা (আ.) তখন বললেন: তোমরা একটি মূর্খ জাতি। ঐ সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতিই অবলম্বন করছো।[2] ইমাম তিরমিযী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং সহীহ বলেছেন।
[1]. البركة বরকত শব্দটির অর্থ হচ্ছে কল্যাণকর বস্তুসমূহ এক স্থানে একত্রিত ও স্থায়ী হওয়া এবং বৃদ্ধি হওয়া। আর التبرك তাবাররুক অর্থ হলো প্রচুর কল্যাণ অনুসন্ধান করা এবং বরকত স্থায়ী হওয়ার প্রার্থনা করা। সে হিসাবে تبرك অর্থ হচ্ছে সে বরকত তালাশ করলো।
কুরআন ও সহীহ হাদীছের অনেক দলীল প্রমাণ করে যে, বরকত কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলাই বরকত প্রদান করেন। কোন মানুষ অন্য কোনো মানুষকে বরকত দান করার ক্ষমতা রাখে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا﴾
‘‘বরকতের অধিকারী তিনি যিনি তার বান্দার প্রতি হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যাতে সে বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হয়’’। (সূরা ফুরকান: ১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾
‘‘বরকতের মালিক তিনি, যার হাতে রাজত্ব। তিনি সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান’’। (সূরা মূলক: ১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَبَارَكْنَا عَلَيْهِ وَعَلَى إِسْحَاقَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِهِمَا مُحْسِنٌ وَظَالِمٌ لِنَفْسِهِ مُبِينٌ﴾
‘‘তাকে এবং ইসহাককে আমি বরকত দান করেছি। তাদের বংশধরদের মধ্যে কতক সৎকর্মী এবং কতক নিজেদের উপর স্পষ্ট যুলুমকারী’’। (সূরা আস্ সাফ্ফাত: ১১৩) আল্লাহ তা‘আলা ঈসা আলাইহিস সালাম এর উক্তি উল্লেখ করে আরো বলেন,
﴿قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آَتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيًّا وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيْنَ مَا كُنْتُ وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيًّا﴾
‘‘সে বললো, আমি তো আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন জীবিত থাকি, ততোদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে’’। (সূরা মারইয়াম: ৩০-৩১) সুতরাং বরকত দানকারী একমাত্র আল্লাহ। কোনো সৃষ্টির জন্য জায়েয নয় যে, সে বলবে, আমি এ জিনিসকে বরকতময় করেছি কিংবা তাতে বরকত দিয়েছি। বরকত অর্থ হচ্ছে কল্যাণ ছড়িয়ে পড়া ও তা স্থায়ী হওয়া।
কুরআন মজীদ ও পবিত্র সুন্নাত প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা বেশ কিছু বস্তুকে বরকতময় করেছেন। সেগুলো ব্যতীত বিনা দলীলে অন্য কোনো বস্তুকে বরকতময় মনে করা অন্যায় এবং তা থেকে বরকত তালাশ করা অবৈধ। নিম্নে কতিপয় বরকতময় বিষয়ের বিবরণ পেশ করা হলো।
(১) বরকতময় স্থানসমূহ: বরকতময় স্থানসমূহের অন্যতম হলো, মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী, মসজিদুল আকসা, মক্কা মুকাররামাহ, মদীনা মুনাওয়ারা, সিরিয়া, ইয়ামান এবং হজ্জের পবিত্র স্থান সমূহ যেমন আরাফাহ্, মুযদালিফাহ্, মিনা ইত্যাদী। তা ছাড়া পৃথিবীর সকল মসজিদই বরকতময়। এ সমস্ত স্থান থেকে শরীয়াত সম্মত পদ্ধতিতে বরকত হাসিলের চেষ্টা করতে হবে। খালেস নিয়তে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণের মাধ্যমেই এ সকল পবিত্র ও বরকতময় স্থান থেকে বরকত লাভের আশা করতে হবে। বরকতপূর্ণ স্থান দ্বারা শরীয়াত সম্মত নিয়মের পরিপন্থি পদ্ধতিতে বরকত হাসিলের চেষ্টা করা সম্পূর্ণ নিষেধ। সুতরাং বরকতের আশায় মসজিদ সমূহের দরজা গুলোকে চুম্বন করা, সেটার মাটি দ্বারা রোগ মুক্তির আশা করা, কাবা শরীফের দেয়াল অথবা মাকামে ইবরাহীম ইত্যাদিকে স্পর্শ করা নিষেধ।
(২) কতিপয় বরকতময় সময়: আল্লাহ তা‘আলা যে সমস্ত স্থানকে বরকতময় করেছেন তার মধ্যে লাইলাতুল কদরসহ রামাযানের শেষ দিনগুলো, দশই যুল হজ জুমআর দিন, প্রত্যেক রাতের শেষ তৃতীয়াংশ। এ সকল ক্ষেত্রে বরকতের অনুসন্ধান হতে হবে শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশিত পন্থার অনুসরণ করে এবং তাতে এবাদত-বন্দেগী করার মাধ্যমে। এ সমস্ত সময়ে ইবাদত করে যে পরিমাণ ছাওয়াব পাওয়া যাবে, অন্যান্য সময়ে ইবাদত করে তা পাওয়া যাবে না।
(৩) বনী আদমের বরকতময় সন্তানসমূহ: আল্লাহ তা‘আলা আদমের সন্তানদের থেকে মুমিনদেরকে বরকত দান করেছেন। এ ক্ষেত্রে মুমিনদের সরদার নবী-রাসূলগণ সকলের উর্দ্ধে। তাদের শরীর বরকতময়। আল্লাহ তা‘আলা আদমের শরীরকে বরকতময় করেছেন এবং ইবরাহীম (আ.)এর শরীরে বরকত দান করেছেন। এমনিভাবে নূহ, ঈসা, মূসা এবং অন্যান্য সকল নবী-রাসূলের দেহকে বরকতময় করেছেন। সুতরাং নবী-রাসূলদের সম্প্রদায়ের কোনো লোক কিংবা তাদের কোন অনুসারী যদি তাদের শরীর থেকে বরকত হাসিল করে তাহলে তা জায়েয হবে। তাদের শরীর স্পর্শ করা, শরীরের ঘাম সংগ্রহ করা, তাদের চুল অথবা তাদের ব্যবহৃত অন্য যে কোনো জিনিস দিয়ে বরকত গ্রহণ করা জায়েয। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাদের শরীরকে বরকতময় করেছেন। আমাদের নবী মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর পবিত্র শরীরও বরকতময়। সহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, সাহাবীগণ তার শরীরের ঘাম ও তার মাথার চুল দিয়ে বরকত গ্রহণ করতেন। তিনি যখন অযু করতেন, তখন অযুর অতিরিক্ত পানি নিয়ে তারা কাড়াকাড়ি শুরু করতেন। এমনটি আরো অনেক কথাই সহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। তার কারণ এই যে, আল্লাহ তা‘আলা নবীদের শরীরে এমন বরকত দান করেছেন, যার প্রভাব অন্যদের প্রতিও স্থানান্তরিত হয়। আর এটি নবী-রাসূলদের সাথেই নির্দিষ্ট। নবী-রাসূলদের ব্যক্তিসত্তাই বরকতময়।
নবী-রাসূলগণ ব্যতীত অন্য কারো ব্যক্তিসত্তা বরকতময় নয়। নবী-রাসূলদের কোন সাথীর ব্যক্তিগত বরকত ছিল বলে কোন দলীল পাওয়া যায় না। এই উম্মতের সর্বোত্তম ব্যক্তি আবু বকর ও উমারের বেলায়ও এমনটি বর্ণিত হয়নি। তাদের ব্যক্তিসত্তাও বরকতময় ছিল বলে কোন দলীল পাওয়া যায় না। এ বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, সাহাবী ও তাবেঈগণ আবু বকর, উমার, উছমান আলী (রা.) কিংবা অন্য কোন সাহাবী থেকে বরকত গ্রহণ করতেন না। অথচ তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চুল, অযুর পানি, থুথু, ঘাম, ব্যবহৃত পোষাক এবং অন্যান্য বস্তু দিয়ে বরকত গ্রহণ করতেন। এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে, সাহাবীদের বরকত ছিল আমলের বরকত। তাদের ব্যক্তিসত্তার সাথে সম্পৃক্ত কোনো বরকত ছিল না, যা অন্যের প্রতি স্থানান্তরিত হতে পারে। যেমন ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বরকত। সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«إِنَّ مِنَ الشَّجَرِ لَمَا بَرَكَتُهُ كَبَرَكَةِ الْمُسْلِمِ»
‘‘একটি বৃক্ষ এমন রয়েছে, যার বরকত মুসলিমের বরকতের মতই’’। এই হাদীছ থেকে জানা যাচ্ছে যে, প্রত্যেক মুসলিমের মধ্যেই বরকত রয়েছে। বুখারীতে বর্ণিত উসাইদ ইবনে হুযায়ের (রাঃ)এর কথাও তাই প্রমাণ করে। তায়াম্মুমের আয়াত নাযিল হওয়ার পর তিনি উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রাঃ)কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন,
«مَا هِىَ بِأَوَّلِ بَرَكَتِكُمْ يَا آلَ أَبِى بَكْرٍ»
‘‘হে আবু বকরের বংশধর! এটি তোমাদের প্রথম বরকত নয়’’। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এই যে, আয়েশা (রা.) বলেন: আমি কোন এক সফরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বের হলাম। আমরা যখন ‘বায়দা’ অথবা ‘যাতুল জায়শ নামক স্থানে পৌঁছলাম তখন আমার গলার হার ছিড়ে গেল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেটা তালাশ করার জন্য তথায় অপেক্ষা করলেন। লোকেরাও অপেক্ষা করল। সেখানে পানির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। লোকেরা আবু বকর (রা.) এর নিকট এসে বলতে লাগলো, আপনি কি দেখছেন না আয়েশা কী করেছেন? আল্লাহর রাসূল এবং সমস্ত লোককে এমন স্থানে আটকিয়ে দিয়েছেন যেখানে পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। এমনকি তাঁদের সাথেও পানি নেই। আয়েশা (রা.) বলেন: আবু বকর (রা.) আমার নিকট আগমন করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন আমার রানের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলেন। আবু বকর (রা.) বলেন: আল্লাহর রাসূল এবং সমস্ত লোককে এমন স্থানে আটকিয়ে দিয়েছ যেখানে পানির কোন ব্যবস্থা নেই। এমনকি তাঁদের সাথেও কোন পানি নেই। আয়েশা (রা.) বলেন: আবু বকর আমাকে দোষারোপ করলেন এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি এ ধরণের আরো অনেক কথা বললেন। অতঃপর তিনি আমার কোমরে আঘাত করতে লাগলেন। আঘাত করা সত্ত্বেও আমি নড়াচড়া করতে পারলাম না। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার রানের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলেন। প্রাতঃকালে যখন তিনি ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন তখন সেখানে কোনো পানি ছিল না। এখানেই আল্লাহ তা‘আলা তায়াম্মুমের আয়াত নাযিল করেন। উসায়েদ ইবনে হুযায়ের (রা.) বলেন, হে আবু বকরের বংশধর! এটি তোমাদের প্রথম বরকত নয়। আয়েশা (রা.) বলেন, আমি যে উটে আরোহন করেছিলাম সেটি যখন উঠালাম তখন দেখতে পেলাম হারটি তার নিচে পড়ে আছে।
সুতরাং এটি হচ্ছে, সেই বরকত যা প্রত্যেক মুমিনকেই দেয়া হয়েছে। আবু বকরের পরিবারকেও তা দেয়া হয়েছে। এটি হচ্ছে আমলের বরকত। তারা যেই সৎ আমল করেছেন, তার কারণেই এটি তারা পেয়েছেন। নবী-রাসূলদের বরকতের ন্যায় এটি তাদের সত্তাগত নয়। ঈমান-ইল্ম অর্জন, তার প্রচার এবং তদোনুযায়ী আমল করার কারণেই তারা বরকতপ্রাপ্ত হয়েছেন। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমের মধ্যেই কম বা বেশি বরকত রয়েছে। আর এই বরকত তার ব্যক্তিগত ও নিজস্ব বরকত নয়। এটি হচ্ছে সৎ আমলের বরকত। তার মধ্যে যে পরিমাণ ঈমান ও ইসলাম রয়েছে এবং তার অন্তরে যে পরিমাণ ইয়াকীন, আল্লাহর ভালবাসা, সম্মান এবং তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্য রয়েছে, তার মধ্যে সে পরিমাণ বরকতই রয়েছে। সুতরাং বান্দার ইলম, ঈমান ও সৎ আমলের মধ্যে যেই বরকত রয়েছে, তা একজন থেকে অন্যজনের কাছে স্থানান্তর হয় না।
সুতরাং আলেম ও সৎ লোকদের থেকে বরকত নেওয়ার অর্থ হচ্ছে, তাদের ইল্ম থেকে উপকৃত হওয়া, তাদের থেকে দীনি জ্ঞান অর্জন করা এবং তাদের পথ অনুসরণ করা। কিন্তু তাদের দ্বারা বরকত গ্রহণ করা ঠিক নয়। অর্থাৎ তাদের শরীর স্পর্শ করে, তাদের থুথু কিংবা অযুর পানি বা তাদের উচ্ছিষ্ট অন্যান্য বস্তু দ্বারা বরকত গ্রহণ করা হারাম। এ ব্যাপারে সর্বাধিক শক্তিশালী দলীল হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর এ উম্মতের আবু বকর উমার, উছমান ও আলী সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও অন্যান্য সাহাবী ও তাবেঈগণ তাদের দ্বারা বরকত গ্রহণ করার চেষ্টা করেন নি।
সুতরাং বর্তমান যুগের যে সমস্ত লোক দাবি করে যে, সৎ লোকদের আছার তথা ব্যবহৃত ও উচ্ছিষ্ট বস্তু দ্বারা বরকত হাসিল করা জায়েয, একাধিক কারণে তা সঠিক নয়।
(১) ইসলামের প্রথম যুগের সৎকাজে অগ্রগামী সাহাবী ও তাবেঈগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো আছার দ্বারা বরকত গ্রহণ করেননি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জীবদ্দশাতেও না, তাঁর মৃত্যুর পরেও না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো দ্বারা বরকত গ্রহণ করা জায়েয হলে এবং তা কল্যাণের কাজ হলে অবশ্যই তারা তা করতেন। সাহাবীদের মধ্যে সর্বোত্তম ছিলেন আবু বকর, উমার, উছমান ও আলী (রা.)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। কোনো সাহাবী অথবা কোনো তাবেঈ এই সমস্ত নেতৃস্থানীয় সাহাবী থেকে বরকত গ্রহণ করার চেষ্টা করেননি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কাউকে তুলনা করা বৈধ নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবিত থাকা কালে তাঁর অনেক বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার সাথে সাথে সেগুলোর ধারাও চিরবিদায় নিয়েছে। আর যা তাঁর জীবদ্দশায় যা ছিল তাতে অন্য কারো শরীক হওয়া অশোভনীয়।
(২) শির্কের দরজা বন্ধ করার জন্য সৎ লোকের উচ্ছিষ্ট বস্তু দ্বারা বরকত হাসিল করা নিষিদ্ধ হওয়া বাঞ্চণীয়।
[2]. সহীহ: তিরমিযী ২১৮০, ইমাম তিরমিযী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং সহীহ বলেছেন।
যাদু ঐ জিনিসকে বলা হয়, যার উপাদান খুব গোপন ও সুক্ষ্ম। যাদুকে সিহর হিসাবে নামকরণ করার কারণ হলো, এমন গোপন জিনিস দ্বারা সেটার চর্চা করা হয়, যা চোখ দ্বারা দেখা যায়না। গিরা-বন্ধন, ঝাড়-ফুঁক ও বিশেষ এক ধরণের কথা এবং ধূম্রময় বিশেষ এক ধরণের বস্তুকে যাদু নামে আখ্যায়িত করা হয়। যাদুর ক্রিয়া-কর্মের মধ্যে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা মানুষের অন্তর ও শরীরে প্রভাব ফেলে। তা কখনো মানুষের মন ও শরীরকে অসুস্থ করে ফেলে। কখনো এটি মানুষকে হত্যাও করে ফেলে এবং কখনো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায়। তবে বিশ্বাস রাখতে হবে যাদুর ক্রিয়া ও প্রভাব আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিগত ইচ্ছা ও অনুমতির বাইরে নয়। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা না হলে এটি কারো ক্ষতি করতে পারে না।
যাদু শয়তানের কাজ। অনেক যাদু এমন রয়েছে যা শিরকের আশ্রয় নেয়া এবং পাপাত্মার নৈকট্য অর্জন করা ব্যতীত কার্যকর হয় না। শয়তান ও পাপাত্মা যা পছন্দ করে সেটা থেকে কিছু উৎসর্গ করার মাধ্যমে, ফন্দি ও চাতুরির আশ্রয় নিয়ে পাপাত্মাগুলো ব্যবহার করে যাদু করা হয়। এ জন্যই শরী‘আতে যাদুকে শিরকের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দুই দিক থেকে যাদু শিরকের মধ্যে পড়ে।
(১) যাদুর মধ্যে শয়তানদেরকে ব্যবহার করা হয় এবং তাদের উপর নির্ভর করা হয়। কখনো কখনো শয়তানেরা যা পছন্দ করে যাদুর মধ্যে সেটা তাদের জন্য উৎসর্গ করা হয়। এতে করে শয়তানেরা যাদুকরের খেদমত করে।
(২) যাদুতে ইলমুল গায়েবের দাবি করা হয় এবং তাতে আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করা হয়। আর এটি হচ্ছে কুফুরী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَقَدْ عَلِمُوا لَمَنِ اشْتَرَاهُ مَا لَهُ فِي الْآَخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ﴾
‘‘তারা অবশ্যই অবগত আছে, যে ব্যক্তি তা ক্রয় করে নিয়েছে, পরকালে তার কোনো অংশ নেই’’। (সূরা বাকারা: ১০২)
আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
قَالَ اجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوبِقَاتِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا هُنَّ قَالَ الشِّرْكُ بِاللَّهِ وَالسِّحْرُ وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ وَأَكْلُ الرِّبَا وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيمِ وَالتَّوَلِّي يَوْمَ الزَّحْفِ وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلَاتِ
‘‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক জিনিস থেকে দূরে থাক। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, সেগুলো কী কী? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, (১) আল্লাহর সাথে শিরক করা (২) যাদু করা (৩) অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, যা আল্লাহ তা‘আলা হারাম করেছেন (৪) সুদ খাওয়া (৫) ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করা (৬) যুদ্ধের ময়দান হতে পলায়ন করা এবং (৭) সতী-সাধ্বী মুমিন মহিলার প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া’’।[1]
[1]. বুখারী, অধ্যায়: সতী নারীকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়া।
এতেও ইলমুল গায়েবের দাবি করা হয়। যেমন আকাশের কথা চুরি করে শ্রবণকারীর উপর নির্ভর করে যমীনে ভবিষ্যতে যা ঘটবে সে সম্পর্কে খবর দেয়া। জিনেরা চুপেচাপে আসমানের ফেরেশতাদের কথা থেকে মাঝে মাঝে দু’একটি কথা শুনে ফেলে। তারা এ কথাটি গণকের কানে ঢেলে দেয়। গণক তার সাথে একশটি মিথ্যা কথা মিশায়। আর মূর্খ লোকেরা আসমানের ফেরেশতাদের থেকে চুপিসারে জিনদের শ্রুত একটি কথা সত্য হওয়ার কারণে বাকিসব মিথ্যা কথা বিশ্বাস করে।
আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র গায়েবের খবর জানেন। সুতরাং যে ব্যক্তি ভবিষ্যৎ বাণী করা কিংবা অন্য কোনোভাবে ইলমুল গায়েবের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার অংশীদার হওয়ার দাবি করলো অথবা ইলমুল গায়েবের দাবিদারকে সত্যায়ন করলো, সে আল্লাহ তা‘আলার খাস বিশেষণের মধ্যে অন্যকে শরীক নির্ধারণ করলো। সেই সঙ্গে সে আল্লাহ তা‘আলা এবং তার রসূলের প্রতি মিথ্যারোপও করলো।
গণক ও ভাগ্য গণনাকারীদের অনেক শয়তানী কাজ-কর্মই শিরক থেকে মুক্ত নয়। ইলমুল গায়েবের দাবি করার জন্য যেসব মাধ্যম যেমন জিন-শয়তান, পাপাত্মা ইত্যাদির সাহায্য নেয়া হয়, তারা ঐসব মাধ্যমের ইবাদতও করে থাকে। সুতরাং ইলমুল গায়েবের দাবি করা, ভাগ্য গণনা করা এবং ভবিষ্যৎ বাণী করা শিরক। কেননা এতে আল্লাহ তা‘আলার খাস ইলমের মধ্যে অংশীদারিত্বের দাবি করা হয়। এদিক থেকে এটি বড় শিরক। সেই সঙ্গে এতে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নৈকিট্য লাভের চেষ্টা করা হয় এবং অন্যের ইবাদতও করা হয়।
সহীহ মুসলিম শরীফে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কতিপয় স্ত্রী থেকে বর্ণিত আছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنْ أَتَى عَرَّافاً فسأله عن شيئ فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ لَمْ تُقْبَلْ لَهُ صَلاَةٌ أَرْبَعِينَ يَوْماً
‘‘যে ব্যক্তি কোনো গণকের কাছে গেল, অতঃপর তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করল এবং গণকের কথাকে সত্য বলে বিশ্বাস করল, চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার নামাজ কবুল হবে না’’।[1]
আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنْ أَتَى كَاهِناً فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ
‘‘যে ব্যক্তি গণকের কাছে আসল, অতঃপর গণক যা বলল তা সত্য বলে বিশ্বাস করল সে মূলত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর যা নাযিল করা হয়েছে তা অস্বীকার করল। ইমাম আবু দাউদ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন’’।[2]
মুসলিমদেরকে যেসব বিষয় থেকে সতর্ক করা আবশ্যক, তার মধ্যে যাদুকর, গণক এবং ভেলকিবাজ, ফাঁকিবাজ ও ধোঁকাবাজদের বিষয়টি অন্যতম। সংশোধন করার বদলে তারা পৃথিবীতে বিপর্যয় ও ফাসাদ সৃষ্টি করে। তাদের কেউ কেউ নিজেকে মানুষের সামনে রোগ-ব্যাধির ডাক্তার হিসাবে প্রকাশ করে। মূলতঃ সে মানুষের ঈমান-আকীদা বরবাদ করে দেয়। কেননা সে রোগীকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য হাস-মুরগী-কবুতর, গরু-খাসী ইত্যাদি যবেহ করার আদেশ করে অথবা তার জন্য শিরকী যাদুমন্ত্র, তেলেসমাতি, শয়তানের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা সম্বলিত তাবীয লিখে দেয়।
যাদুকর ও গণকদের আরেকটি শ্রেণী ভবিষ্যৎ বক্তার পোষাকে মানব সমাজে আত্মপ্রকাশ করে। ভাগ্য গণনা করা, গায়েবী বিষয়ের খবর এবং হারানো বস্তুর স্থানের সন্ধান দেয়ার জন্য মূর্খরা তাদের কাছে এসে হারানো বস্তুর স্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। গণকরা তাদেরকে সেটার স্থান সম্পর্কে খবর দেয় অথবা শয়তানের সাহায্যে তাদের হারানো বস্তু এনে দেয়।
তাদের কেউ আবার অলীর আকৃতিতে মানুষের সামনে উপস্থিত হয় এবং অলৌকিক জিনিস এবং কারামত দেখায়। যেমন তারা আগুনে ঝাপ দেয়, অস্ত্র দিয়ে নিজের শরীরে আঘাত করে, সাপ ধরে ইত্যাদি। প্রকৃত পক্ষে এরা মিথ্যুক, ভেলকিবাজ এবং শয়তানের দোসর। এদের প্রত্যেকেই ফন্দিবাজি, ধোঁকাবাজি ও ফাঁকিবাজির মাধ্যমে মানুষের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করতে চায়। সেই সঙ্গে তারা মানুষের ঈমান- আকীদাও নষ্ট করে।
সুতরাং এদের ধোঁকাবাজি, ফাঁকিবাজি ও ভেলকিবাজি থেকে মুসলিমদের সাবধান থাকা আবশ্যক। তাদের খপ্পরে পড়া থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা জরুরী। মুসলিম শাসকদের উচিত তাদেরকে ধরে তাওবা করানো। তাওবা করলে তো ভালো অন্যথায় এদেরকে হত্যা করা আবশ্যক। এতেই মুসলিমগণ তাদের ক্ষতি, ফিতনা ও ফাসাদ থেকে নিরাপদ থাকবে। সেই সঙ্গে তাদের ব্যাপারে আল্লাহর হুকুমু বাস্তবায়ন হবে।
সহীহ বুখারীতে বাজালা ইবনে আবাদাহ থেকে বর্ণিত আছে, উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু মুসলিম গভর্ণরদের কাছে পাঠানো নির্দেশনামায় লিখেছেন,
أَنِ اقْتُلُوا كُلَّ سَاحِرٍ وَسَاحِرَةٍ قَالَ: فَقَتَلْنَا ثَلاَثَ سَوَاحِرَ
‘‘তোমরা প্রত্যেক যাদুকর পুরুষ এবং যাদুকর নারীকে হত্যা করো। বাজালা বলেন, এ নির্দেশের পর আমরা তিনজন যাদুকর মহিলাকে হত্যা করেছি’’।[3]
জুনদুব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ‘মারফু’ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
حَدُّ السَّاحِرِ ضَرْبَةٌ بِالسَّيْفِ
‘‘যাদুকরের শাস্তি হচ্ছে তলোয়ারের এক আঘাতে গর্দান উড়িয়ে দেয়া’’।[4] ইমাম তিরমিযী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
[1]. সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: গণকের কাজ নিষিদ্ধ এবং গণকের কাছে যাওয়াও নিষিদ্ধ।
[2]. ইমাম আলবানীও হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুন: সিলসিলা ছহীহা, হাদীছ নং- ৩৩৮৭।
[3]. সুনানে বায়হাকী, অধ্যায়: যাদুকরকে কাফের বলা এবং তাকে হত্যা করা।
[4]. তিরমযী, অধ্যায়: যাদুকরের শাস্তি। ইমাম আলবানী (রহি.) এই হাদীছকে সহীহ বলেছেনঃ দেখুন: সিলসিলা যঈফা, হাদীছ নং- ১৪৪৬।
বিভিন্ন পাখি, বিভিন্ন নাম, ভিন্ন শব্দ, বিভিন্ন স্থান, বিভিন্ন লোক এবং অন্যান্য সৃষ্টিকে কুলক্ষণ মনে করাকে التطير বলা হয়। কোনো মানুষ যখন দীন বা দুনিয়ার কোনো কাজের সুদৃঢ় ইচ্ছা করার পর অপছন্দনীয় কিছু দেখে বা শুনে, তাহলে সেটা তার মধ্যে নিম্নোক্ত দু’টি বিষয়ের যে কোনো একটির প্রভাব পড়তে পারে।
(১) সে যা শুনে বা দেখে তাকে কুলক্ষণ মনে করে সেটা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্বীয় ইচ্ছা পুরণ করা থেকে ফিরে আসলে উপরোক্ত অপ্রিয় জিনিস থেকে তার অন্তরে ঢুকে যেতে পারে। কুলক্ষণের এ ধারণা তার ঈমানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তার তাওহীদের মধ্যে ঘাটতি আসে এবং আল্লাহর উপর ভরসাও কমে যায়।
(২) অথবা সে যদি তার উদ্দেশ্য পুরণ করার জন্য অগ্রসর হওয়া থেকে ফিরে নাও আসে, কিন্তু তার অন্তরে কুলক্ষণের ধারণার কুপ্রভাব থেকেই যায়। সে দুঃশ্চিন্তা, ব্যথা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, শয়তানের কুমন্ত্রণা এবং মানসিক দুর্বলতা নিয়েই কাজের প্রতি অগ্রসর হয়।
সুতরাং কেউ যখন তার অন্তরে কোনো কিছু থেকে অকল্যাণ-অশুভ হওয়ার ধারণা অনুভব করে, তখন সেটা প্রতিরোধ করার পচেষ্টা চালাবে, সেটা ঠেকাতে আল্লাহর নিকট সাহায্য চাইবে, তার উপর ভরসা করবে এবং দৃঢ়তার সাথে স্বীয় উদ্দেশ্য পূরণে অগ্রসর হবে। মোটকথা কেউ যদি অপছন্দনীয় কিছু প্রত্যক্ষ করে তখন যেন বলে,
اللَّهُمَّ لاَ يَأْتِى بِالْحَسَنَاتِ إِلاَّ أَنْتَ وَلاَ يَدْفَعُ السَّيِّئَاتِ إِلاَّ أَنْتَ وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِكَ
‘‘হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া অন্য কেউ কল্যাণ দিতে পারে না। তুমি ছাড়া কেউ অকল্যাণ প্রতিহত করতে সক্ষম নয়। তোমার সাহায্য ব্যতীত কেউ অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে পারে না এবং তোমার তাওফীক ও শক্তি ব্যতীত সৎ আমল করাও সম্ভব নয়।[1]
সৃষ্টি থেকে অশুভ-অকল্যাণ হওয়ার আশঙ্কা করা অতি প্রাচীন একটি ব্যাধি। পূর্বেকার অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ও এমনটি করতো বলে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয়; আল্লাহ তা‘আলার সর্বোত্তম সৃষ্টি নবী-রসূল ও তাদের মুমিন অনুসারীদের থেকেও তারা অশুভ-অকল্যাণের ধারণা করতো। আল্লাহ তা‘আলা ফেরাআউন ও তার সম্প্রদায় সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন যে, তারা যখন মুছীবতে পড়তো, তখন তারা মূসা এবং তার সঙ্গীদের অশুভ কারণ মনে করতো’’। (সূরা আরাফ: ১৩১)
আল্লাহ তা‘আলা সালেহ আলাইহিস সালামের গোত্র সম্পর্কে বলেন,
﴿قَالُوا اطَّيَّرْنَا بِكَ وَبِمَن مَّعَكَ قَالَ طَائِرُكُمْ عِندَ اللَّهِ بَلْ أَنتُمْ قَوْمٌ تُفْتَنُونَ﴾
‘‘তারা বললো, তোমাকে এবং তোমার সাথীদেরকে আমরা অমঙ্গলের কারণ মনে করি। সালেহ জবাব দিলেন, তোমাদের কল্যাণ-অকল্যাণ আল্লাহর নিকটেই। বস্তুত তোমরা এমন এক সম্প্রদায় যাদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে’’। (সূরা নামল: ৪৭)
এমনি জনপদবাসীদের ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন যে, তারা আল্লাহর নবী-রসূলদেরকে বলেছিল,
﴿إِنَّا تَطَيَّرْنَا بِكُمْ لَئِن لَّمْ تَنتَهُوا لَنَرْجُمَنَّكُمْ وَلَيَمَسَّنَّكُم مِّنَّا عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾
‘‘ওরা বললো, আমরা তোমাদেরকে অমঙ্গলের কারণ মনে করি। যদি তোমরা বিরত না হও তাহলে অবশ্যই তোমাদেরকে প্রস্তারাঘাতে নিহত করবো এবং আমাদের পক্ষ হতে তোমাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি স্পর্শ করবে’’। (সূরা ইয়াসীন: ১৮)
আল্লাহ তা‘আলা মক্কার মুশরিকদের সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন যে, তারা বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অমঙ্গলের কারণ মনে করতো। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَإِن تُصِبْهُمْ حَسَنَةٌ يَقُولُوا هَٰذِهِ مِنْ عِندِ اللَّهِ وَإِن تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَقُولُوا هَٰذِهِ مِنْ عِندِكَ قُلْ كُلٌّ مِّنْ عِندِ اللَّهِ فَمَالِ هَٰؤُلَاءِ الْقَوْمِ لَا يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ حَدِيثًا﴾
‘‘যদি তাদের কোনো কল্যাণ হয় তাহলে তারা বলে, এতো আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়েছে। আর কোনো ক্ষতি হলে বলে, এটা হয়েছে তোমার পক্ষ হতে। বলে দাও, সবকিছুই হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে। লোকদের কী হয়েছে, কোনো কথাই তারা বুঝতে চেষ্টা করে না’’। (সূরা নিসা: ৭৮)
এমনি সকল যুগেই মুশরিকদের দীন একই রকম। তাদের অন্তর ও মন উল্টে গেছে। ফলে যারা কল্যাণের উৎস, তাদেরকেই খারাপ মনে করছে। নবী-রসূলগণ কল্যাণের পথনির্দেশক হওয়া সত্ত্বেও তরা তাদেরকে অকল্যাণের কারণ মনে করেছে। তাদের ভিতরে গোমরাহী চেপে বসা তাদের সৃষ্টিগত স্বভাব নষ্ট হয়ে যওয়ার কারণেই এমনটি হয়েছে। অন্যথায় কল্যাণ-অকল্যাণ উভয়টিই আল্লাহর ফায়ছালা ও নির্ধারণ অনুযায়ী হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলার হিকমত ও ইলম অনুযায়ী উভয়টি হয়ে থাকে। অকল্যাণ হয়ে থাকে তার হিকমতের দাবি অনুসারে এবং কল্যাণ হয়ে থাকে তার অনুগ্রহে। তার অপার অনুগ্রহ এবং আনুগত্যের বিনিময় স্বরূপ তিনি কল্যাণ দান করেন। তার আদল-ইনসাফের কারণেই তার থেকে অকল্যাণ ও পাপাচারের বিনিময় স্বরূপ শাস্তি এসে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَّا أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللَّهِ وَمَا أَصَابَكَ مِن سَيِّئَةٍ فَمِن نَّفْسِكَ﴾
‘‘হে মুহাম্মাদ! যে কল্যাণই তুমি লাভ করে থাকো না কেন, তা আল্লাহর দান এবং যে বিপদ তোমার উপর আপতিত হয় তা তোমার নিকট থেকেই’’।[2] (সূরা আন নিসা: ৭৯)
التطير শিরক হওয়ার আরেকটি কারণ হলো এতে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের প্রতি কল্যাণ-অকল্যাণের সম্বন্ধ করা হয় এবং এমন সৃষ্টি থেকে ক্ষতি হওয়ার আকীদা পোষণ করা হয়, যে নিজেই নিজের কল্যাণ কিংবা ক্ষতি করার মালিক নয়। এটি শিরক হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, শয়তানই মানুষের অন্তরে এ ধরণের আকীদা, আশঙ্কা ও কুমন্ত্রণা ঢেলে দেয়। আর শুভাশুভ ও কল্যাণ-অকল্যাণের ধারণা যেহেতু অন্তরের ভয়-ভীতির কারণেই হয়ে থাকে, তাই এটি আল্লাহর উপর ভরসা করার পরিপন্থি।
প্রিয় মুসলিম ভাইগণ! রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম التطير বা কুলক্ষণের ধারণা করা থেকে সতর্ক করতে গিয়ে যা বলেছেন, তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন! ইমাম বুখারী আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لا عَدْوَى وَلا طِيَرَةَ وَلا هَامَةَ وَلا صَفَر
‘‘রোগের কোনো সংক্রমণ শক্তি নেই, পাখি উঁড়িয়ে কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ধারণ করারও কোনো ভিত্তি নেই। ‘হামাহ’ তথা হুতুম পেচাঁর ডাক শুনে অশুভ নির্ধারণ করা ভিত্তিহীন। সফর মাসের বিশেষ কোনো প্রভাব নেই’’।[3]
বুখারী ও মুসলিমে আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণিত আছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لاَ عَدْوَى وَلاَ طِيَرَةَ وَيُعْجِبُنِى الْفَأْلُ قَالُوا ومَاالفَالُ؟ قال الْكَلِمَةُ الْطَّيِّبَةُ
‘‘সংক্রামক ব্যাধি আর কুলক্ষণ বলতে কিছুই নেই। তবে আমি ‘ফাল’ পছন্দ করি। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ফাল’ কী? তিনি বললেন, ‘উত্তম কথা’।[4]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ‘মারফু’ হাদীছে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:্রالطِّيَرَةُ شِرْكٌ
‘‘তিয়ারাহ’ বা পাখি উঁড়িয়ে ভাগ্য গণনা করা শিরক’’।[5]
সহীহ মুসলিমে মুআবীয়া ইবনুল হাকাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন,
ومنا أناس يتطيرون؟ فقال: ذلك شيء يجده أحدكم في نفسه فلا يصدنه
‘‘আমাদের মধ্যে কি এমন লোক আছে, যারা কোনো সৃষ্টিকে কুলক্ষণ মনে করে? অতঃপর তিনি বললেন, তোমাদের কেউ যখন তার মনে এ ধরণের কিছু অনুভব করে, তখন এমন ধারণা যেন তাকে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অগ্রসর হতে বাধাগ্রস্থ না করে’’।[6]
এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন, তিয়ারার মাধ্যমে যে লোক কষ্ট পায় এবং যাকে সে কুলক্ষণ মনে করে, এটি তার মন ও আকীদার মধ্যকার ধারণা মাত্র; যে জিনিসকে সে কুলক্ষণ মনে করছে, আসলে তাতে কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই। সুতরাং তার ধারণা, ভয়-ভীতি এবং শিরকই কেবল তার মধ্যে কুলক্ষণের ধারণা ঢুকিয়ে দেয় ও তাকে প্রয়োজন পূরণে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত রাখে। ফলে সে অপছন্দনীয় যা দেখে কিংবা শুনে তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রয়োজন পুরণে অগ্রসর হওয়া থেকে ফিরে আসে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মতের জন্য দীনের সমস্ত বিষয় সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। তিয়ারা বা কোনো কিছু থেকে অকল্যাণ হওয়ার ধারণা সম্পুর্ণ বাতিল হওয়ার কথাও বর্ণনা করেছেন। যাতে তারা জানতে পারে যে, আল্লাহ তা‘আলা কোনো জিনিষের মধ্যেই তাদের জন্য অশুভ রাখেন নি কিংবা তাদের জন্য সেটাতে অকল্যাণের কোনো নির্দেশনা দেন নি অথবা তারা যাকে ভয় করছে করছে তাকে আল্লাহ তা‘আলা ভয়ের কারণ হিসাবেও নির্ধারণ করেন নি।
তিনি সৃষ্টি থেকে অশুভ ও অকল্যাণ হওয়ার ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে নাকোচ করেছেন, যাতে করে আল্লাহ তা‘আলা যে তাওহীদ দিয়ে নবী-রসূলদের পাঠিয়েছেন, যে তাওহীদসহ আসমানী কিতাবসমূহ নাযিল করেছন এবং যার জন্য আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছেন, তা বাস্তবায়ন করে মানুষের অন্তর শান্ত হয় এবং তাদের হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে। সুতরাং তিনি তাদের অন্তর থেকে শিরকের মূলোৎপাটন করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তাওহীদের মজবুত হাতলকে আঁকড়ে ধরবে, সেটার শক্ত রশি ধারণ করবে এবং আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসা করবে, তার অন্তরে তিয়ারার ধারণা বদ্ধমূল হওয়ার আগেই সেটা কেটে ফেলতে পারবে এবং সেটা পূর্ণতায় পৌঁছার আগেই মন থেকে তার জল্পনা-কল্পনা উচ্ছেদ করতে পারবে। ইকরিমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
كُنَّا جلوسا عِنْدَ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا فَمَرَّ طائر يَصِيحُ فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ: خَيْرٌ خَيْرٌ! فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: لَا خَيْرَ وَلَا شَرَّ المجالسة وجواهر العلم
‘‘একদা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার নিকট বসা ছিলাম। এ সময় একটি পাখি ডাকাডাকি করতে করতে অতিক্রম করছিল। তখন এক লোক বললো, ভাল হোক! ভালো হোক! আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা তখন বললেন, ভালো বা খারাপ কোনটাই না হোক।
ইবনে আব্বাস তাদের কথার দ্রুত প্রতিবাদ করলেন। যাতে করে কল্যাণ ও অকল্যাণের ব্যাপারে ঐ পাখির কোনো প্রভাব আছে বলে বিশ্বাস না করা হয়। সমস্ত মাখলুকের ক্ষেত্রে কথা একই। কোনো মাখলুকই মানুষের জন্য কল্যাণ আনয়ন করতে পারে না কিংবা অকল্যাণ প্রতিরোধ করতে পারে না।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, وَيُعْجِبُنِى الْفَأْلُ ‘‘তবে আমি ‘ফাল’ পছন্দ করি’’ (সহীহ বুখারী ৫৭৫৬)। অতঃপর ফালের ব্যাখ্যায় বললেন যে, সেটা হলো উত্তম কথা। ফালকে পছন্দ করার কারণ হলো, তাতে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করা হয়। আর বান্দাকে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। আর তিয়ারার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করা হয় এবং বালা-মুছীবতের কারণ মনে করা হয়। এ জন্যই উভয়ের হুকুমের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কেননা মানুষ যখন আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকে কল্যাণের আশা করবে, তখন অন্তর দিয়ে তার সাথে সম্পর্ক কায়েম করবে এবং তার উপরই ভরসা করবে। আর যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার উপর আশা-ভরসা ছেড়ে দিবে, তখন ইহাই তাদেরকে শিরক এবং আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের উপর ভরসা করার দিকে নিয়ে যাবে।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, ফাল পছন্দ করা ও সেটাকে ভালোবাসার মধ্যে শিরকের কিছু নেই; বরং এটি মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাবের দাবির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সেই সঙ্গে এটি মানুষের ফিতরাতেরও দাবি, যা সবসময় তার অনুকূল ও উপযোগী জিনিষের দিকে ধাবিত হয়। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদেরকে সংবাদ দিয়েছেন যে, দুনিয়ার ভোগ-সামগ্রী থেকে তার কাছে নারী ও সুঘ্রাণ সর্বাধিক পছন্দনীয় করে দেয়া হয়েছে। তিনি মিষ্টি ও মধুও পছন্দ করতেন। তিনি সুন্দর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত এবং মধুর সুরে আযান দেয়া পছন্দ করতেন। তিনি উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী এবং সুমহান বৈশিষ্ট্যগুলো পছন্দ করতেন।
মোটকথা, তিনি পূর্ণতার গুণাবলী পছন্দ করতেন। এমনি যেসব বৈশিষ্ট মানুষকে কল্যাণের দিকে নিয়ে যায় তিনি তাও পছন্দ করতেন। আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সৃষ্টিগত বৈশিষ্টের মধ্যে ভালো নাম শুনে খুশি হওয়া, ভালো নাম পছন্দ করা এবং ভালো নামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার স্বভাব স্থাপন করেছেন।
মানুষ الفلاح ‘ফালাহ’ (সফলতা), السلام ‘সালাম’ (শান্তি-নিরাপত্তা), النجاح ‘নাজাহ’ (কৃতকার্যতা) التهنئة ‘তাহনিআহ’ (মুবারকবাদ), البشرى ‘বুশরাহ’ (সুখবর), الفوز ফাউয, (বিজয়), الظفر যাফ্র (ধন্য হওয়া) ইত্যাদি নাম শুনে খুশী হয় এবং আন্তরিক প্রশান্তি লাভ করে। এ শব্দগুলো উচ্চারণের আওয়াজ মানুষের কানে পৌঁছার সাথে সাথেই তার অন্তর খুশি হয়, বক্ষ প্রশস্ত হয় এবং হৃদয় শক্তিশালী হয়। আর যখন এগুলোর বিপরীত শুনে, তখন তার অন্তরে বিপরীত অবস্থা সৃষ্টি হয় এবং সেটাকে চিন্তিত করে তুলে এবং তাতে ভয়-ভীতি, অশুভ ধারণা, সংকোচন, বিষন্নতা ইত্যাদির সৃষ্টি করে। ফলে সে তার প্রয়োজন পুরণের ইচ্ছা পরিহার করে এবং ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তার ঈমানে ঘাটতি আসে এবং কখনো শিরকের লিপ্ত হয়। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের কথা এখানেই শেষ।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন যে,
مَنْ رَدَّتْهُ الطِّيَرَةُ مِنْ حَاجَةٍ فَقَدْ أَشْرَكَ
‘‘কুলক্ষণের ধারণা যাকে প্রয়োজন পুরণে বাধা দিল সে শিরক করল। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, এর কাফ্ফারা কী? উত্তরে তিনি বললেন, তোমরা এ দু‘আ পড়বে,
اللَّهُمَّ لَا خَيْرَ إِلَّا خَيْرُك وَلَا طَيْرَ إِلَّا طَيْرُك وَلَا إِلَهَ غَيْرُك
‘‘হে আল্লাহ! তোমার কল্যাণ ব্যতীত অন্য কোনো কল্যাণ নেই। তোমার অমঙ্গল ছাড়া কোনো অমঙ্গল নেই।[7] আর তুমি ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই’’।[8]
সুতরাং এ হাদীছ শরীফ থেকে জানা যাচ্ছে যে, যে তিয়ারাকে অপছন্দ করে এবং আপন কাজে দৃঢ়তার সাথে অগ্রসর হয় সেটা তার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু যে এখলাসের সাথে আল্লাহর উপর ভরসা করে না; বরং শয়তানের পথে চলে, সে অপছন্দনীয় কাজের শিকার হয়। কেননা সে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমানের দাবি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
তিয়ারা সম্পর্কে উপরোক্ত আলোচনাটি ভালোভাবে বুঝা উচিত। আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে তার প্রতি পূর্ণ ঈমান ও তার উপর পরিপূর্ণ ভরসা দান করেন এবং অকল্যাণের সকল পথ ও শিরক থেকে আমাদেরকে উদ্ধার করেন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা এবং সাড়াদানকারী।
[1]. আবু দাউদ, অধ্যায়: তিয়ারাহ। ইমাম আলবানী (রহি.) এই হাদীছকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: সিলসিলা ছহীহা, হাদীছ নং- ১৬১৯।
[2]. কল্যাণ-অকল্যাণ উভয়ই আল্লাহর পক্ষ হতে। কিন্তু এরা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধির স্বল্পতা, মূর্খতা এবং যুলুম-অত্যাচারের আধিক্যের কারণে তা বুঝে না। আর এখানে অকল্যাণকে বান্দার প্রতি সম্বন্ধ করার কারণ হলো বান্দার ভুলের কারণেই শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ সেটা তার উপর নির্ধারণ করেন।
[3]. সহীহ বুখারী ৫৭০৭, অধ্যায়: কুষ্ঠরোগ, ইবনে মাজাহ ৩৫৩৯।
[4]. সহীহ মুসলিম ২২২৪।
[5]. সহীহ: ইবনে মাজাহ ৩৫৩৮, আবূ দাউদ ৩৯১০।
[6]. সহীহ মুসলিম ৫৩৭।
[7]. প্রাচীন আরবদের মধ্যে একটি বদ অভ্যাস ছিল যে, তারা যখন সফরে বের হত অথবা কোন প্রয়োজন পুরণের জন্য ঘর থেকে বের হত, তখন পাখি উড়িয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করতো এবং যাত্রা শুভ হবে কি না তা যাচাই করত। পাখিটি যদি ডান দিকে উড়ে যেত, তাহলে তারা শুভ লক্ষণ মনে করত এবং যাত্রা অব্যাহত রাখত। আর যদি পাখি বাম দিকে উড়ে যেত, তাহলে কুলক্ষণ মনে করত এবং সফরে অমঙ্গল হবে মনে করে বাড়ীতে ফিরে আসত। এই কাজকে তিয়ারা বলা হয়। ‘তিয়ারাহ’ শব্দটি طير থেকে। طير অর্থ পাখি। পাখি উড়িয়ে যেহেতু তারা ভাগ্য পরীক্ষা করতো, তাই তাদের এই কাজকে তিয়ারাহ বলা হয়েছে। পরবর্তীতে যে কোনো বস্তুর মাধ্যমে শুভ-অশুভ নির্ধারণ করার প্রচেষ্টাকেই তিয়ারা হিসাবে নাম করণ করা হয়েছে। ইসলাম এই ধারণার মূলোৎপাটন করেছে। ইসলাম সুস্পষ্ট ঘোষণা করেছে যে, পাখির ডান দিকে অথবা বাম দিকে চলাচলের মধ্যে কোনো কল্যাণ বা অকল্যাণ নেই। কল্যাণ এবং অকল্যাণের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
[8]. মুসনাদে আহমাদ। ইমাম আলবানী (রহি.) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: হাদীছ নং- ১০৬৫।
কোনো কোনো গবেষক বলেছেন, মহাশুণ্যের বিভিন্ন অবস্থার মাধ্যমে যমীনের ঘটনাসমূহের উপর দলীল গ্রহণ করাকে التنجيم বা জ্যোতির্বিদ্যা বলা হয়। যেমন জ্যোতিষীরা দাবি করে যে, তারা বাতাস প্রবাহিত হওয়ার সময়, ঝড় ও অন্যান্য দূর্যোগ শুরু হওয়ার সময়, বৃষ্টি হওয়ার সময়[1], গরম বা ঠান্ডা শুরু হওয়ার সময়, দ্রব্যমূল্য পরিবর্তন হওয়ার সময়, রোগ-ব্যাধি, মহামারি ও মৃত্যুর সময় এবং শুভ সময় কিংবা অশুভ সময় ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত রয়েছে। ইহাকে علم التأثير বা প্রভাব-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত বিদ্যাও বলা হয়। এটি দুই প্রকার।
(১) জ্যোতিষীরা দাবি করে যে, আসমানের তারকাগুলো নিজস্ব ইচ্ছাতেই ক্রিয়াশীল। এগুলোর প্রভাবের ফলেই পৃথিবীর কার্যাবলী পরিচালিত হয়। মুসলিমদের ঐক্যমতে এটি কুফুরী। কেননা এতে বিশ্বাস করা হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আরো স্রষ্টা রয়েছে এবং আল্লাহ তা‘আলার সাম্রাজ্যের মধ্যে তার ইচ্ছা ব্যতিরেকেই অন্যরা কর্তৃত্ব করে থাকে।
(২) তারা বলে থাকে, তারকার চলাচল, এগুলো একত্রিত হওয়া এবং বিচ্ছিন্ন হওয়া যমীনের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের প্রমাণ করে। এ রকম বিশ্বাস পোষণ করা হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা এতে ইলমুল গায়েবের দাবি করা হয়। অন্যদিক থেকে এটি যাদুও বটে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مَنِ اقْتَبَسَ عِلْمًا مِنَ النُّجُومِ اقْتَبَسَ شُعْبَةً مِنَ السِّحْرِ زَادَ مَا زَادَ
‘‘যে ব্যক্তি জ্যোতির্বিদ্যার কিছু অংশ শিখল, সে যাদু বিদ্যারই একটি শাখা শিখলো। জ্যোতির্বিদ্যা যে যত বেশি শিখলো, সে যাদুও তত বেশি শিখলো’’।[2] হাদীছের সনদ সহীহ। ইমাম নববী ও যাহাবী সহীহ বলেছেন। ইমাম ইবনে মাজাহ, আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং অন্যরাও হাদিছটি বর্ণনা করেছেন।
কুরআন, হাদীছ এবং মুসলিমদের ঐক্যমতে যাদু করা, যাদু শিক্ষা করা এবং সেটা শিক্ষা দেয়া হারাম। তারকার চলাচলকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে ভবিষ্যৎ ঘটনাবলী সম্পর্কে খবর দেয়ার মধ্যে গায়েবের এমন খবর জানার দাবি করা হয়, যা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা সম্পূর্ণরূপে নিজেকে বিশেষিত করেছেন। এখানে আল্লাহ তা‘আলার খাস ইলমের মধ্যে অংশীদারিত্বের দাবি করা হয় অথবা যারা এটি দাবি করে তাদেরকে সত্যায়ন করা হয়। এটি তাওহীদের পরিপন্থি। কারণ এতে রয়েছে একটি অন্যায় দাবি।
ইমাম খাত্তাবী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, সৃষ্টির মধ্যে ভবিষ্যতে যেসব ঘটনা ঘটবে বলে জ্যোতিষীরা দাবি করে, আলেমদের নিকট সেটা নিষিদ্ধ ইলমুত তানজীম হিসাবে প্রসিদ্ধ। যেমন তারা বাতাস প্রবাহিত হওয়ার সময় জানার দাবি করে, বৃষ্টি বর্ষণের সময় ও স্থানসমূহ জানার দাবি করে, দ্রব্যমূল্য পরিবর্তন হওয়ার দাবি করে এবং তারা এমনি আরো অনেক বিষয়ের দাবি করে। তারা দাবি করে যে, কক্ষপথে গ্রহ-নক্ষত্র ও তারকার চলাচল, সেটা একসাথে মিলিত হওয়া, বিচ্ছিন্ন হওয়া ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারলে উপরোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়। তারা দাবি করে যে, পৃথিবীর ঘটনাপ্রবাহে আসমানের গ্রহ-নক্ষত্র ও তারকারাজির প্রভাব রয়েছে। এটি তাদের গায়েবের খবর দাবি এবং এমন ইলমের দাবি করার শামিল, যা কেবল আল্লাহ তা‘আলার জন্যই খাস। আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কেউ গায়েবের খবর জানে না।
ইমাম বুখারী (রহিমাহুল্লাহ) তার সহীহ গ্রন্থে বলেন, কাতাদাহ বলেছেন,
خَلَقَ الله هَذِهِ النُّجُومَ لِثَلاَثٍ جَعَلَهَا زِينَةً لِلسَّمَاءِ وَرُجُومًا لِلشَّيَاطِينِ وَعَلاَمَاتٍ يُهْتَدَى بِهَا فَمَنْ تَأَوَّلَ فِيهَا بِغَيْرِ ذَلِكَ أَخْطَأَ وَأَضَاعَ نَصِيبَهُ وَتَكَلَّفَ مَا لاَ عِلْمَ لَهُ بِهِ
‘‘আল্লাহ তা‘আলা এসব নক্ষত্র তিনটি উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, আকাশের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য, শয়তানকে বিতাড়িত করার জন্য এবং পথিকদের দিশা পাওয়ার জন্য। যে ব্যক্তি এসব উদ্দেশ্য ছাড়া ভিন্ন ব্যাখ্যা করলো সে ভুল করলো, তার ভাগ্য নষ্ট করলো এবং যে বিষয়ে তার কোনো জ্ঞান নেই, তা জানার চেষ্টা করলো।
খতীব বাগদাদী রাহিমাহুল্লাহ কাতাদাহ থেকে আরো বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তা‘আলার শরী‘আত সম্পর্কে বেশ কিছু অজ্ঞ লোক আসমানের তারকাগুলো থেকে জ্যোতির্বিদ্যা তৈরী করেছে। তারা বলে অমুক অমুক তারকা উদিত হওয়ার পর বাসর করলে এমন এমন হবে এবং অমুক অমুক তারকা উদিত হওয়ার পর ভ্রমণ করলে এমন এমন হবে।
আমার জীবনের শপথ![3] তারা আরো বলে যে, এমন কোনো তারকা নেই, যার কারণে কোনো না কোনো লাল, কালো, লম্বা, খাটো, সুদর্শন কিংবা কুৎসিত মানুষ জন্ম গ্রহণ করে না। অথচ এ তারকাগুলো, কিংবা এ প্রাণীগুলো অথবা এ পাখিগুলো গায়েবের কোনো খবর জানেনা। কেউ যদি গায়েবের খবর জানতো, তাহলে আদম আলাইহিস সালাম জানতেন। আল্লাহ তাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন, ফেরেশতাদেরকে তার উদ্দেশ্যে সেজদা করিয়েছেন এবং তাকে প্রত্যেক জিনিষের নাম শিখিয়েছেন।
শাইখ বলেন, আমি বলছি, এমনি আরো অনেক কুসংস্কার রয়েছে, যা মিথ্যুকরা পত্র-পত্রিকায় প্রচার করে থাকে। যেমন রাশিচক্র ও নক্ষত্রের হিসাব করে তারা সুখ-দুঃখ, দুর্ভাগ্য, সৌভাগ্য ইত্যাদি সম্পর্কে খবর দিয়ে থাকে। কতিপয় সহজ-সরল মানুষ তাদের কথা বিশ্বাস করে থাকে।
শাইখ আব্দুর রাহমান ইবনে হাসান রহিমাহুল্লাহ ফাতহুল মাজীদে বলেন, যদি বলা হয় যে, জ্যোতিষীদের কথা তো মাঝে মাঝে সত্য হয়। এর জবাব হলো তাদের কথা সত্য হওয়া গণকের কথা সত্য হওয়ার মতোই। তার একটি কথা সত্য হলেও ১০০টি মিথ্যা হয়। একটি কথা সত্য হওয়া ইলমুল গায়েব জানার কারণে নয়; বরং আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারণ অনুপাতেই হয়ে থাকে; তার সাথে গণকের কথা মিলে যায় মাত্র।[4] এতে করে যে ব্যক্তি তার কথায় বিশ্বাস করে তার জন্য এটি ফিতনার কারণ হয়।
শাইখ আরো বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত একাধিক হাদীছ ইলমুত তানজীম তথা জ্যোতির্বিদ্যাকে বাতিল করে দিয়েছে। যেমন তিনি বলেছেন,
مَنِ اقْتَبَسَ عِلْمًا مِنَ النُّجُومِ اقْتَبَسَ شُعْبَةً مِنَ السِّحْرِ زَادَ مَا زَادَ
‘‘যে ব্যক্তি জ্যোতির্বিদ্যার কিছু অংশ শিখল, সে যাদু বিদ্যারই একটি শাখা শিখলো। জ্যোতির্বিদ্যা যে যত বেশি শিখলো, সে যাদুও বেশি শিখলো’’।[5] ইমাম ইবনে মাজাহ, আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং অন্যরা হাদিছটি বর্ণনা করেছেন।
রাজা ইবনে হাইওয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মতের উপর যেসব বিষয়ের আশঙ্কা করি, তা হলো যমীনের ঘটনাসমূহে আকাশের তারকার প্রভাব আছে বলে বিশ্বাস, তাক্বদীর অস্বীকার এবং শাসকদের যুলুম-নির্যাতন। ইবনে হুমায়েদ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তবে জলে ও স্থলে ভ্রমণ করার সময় দিক নির্দেশনার জন্য তারকার সাহায্য নেয়া জায়েয আছে। এটি আল্লাহ তা‘আলার নিয়ামতের মধ্যে গণ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَهُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ النُّجُومَ لِتَهْتَدُوا بِهَا فِي ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ﴾
‘‘তিনি তোমাদের জন্য তারকারাজি সৃজন করেছেন- যাতে তোমরা স্থল ও জলের অন্ধকারে পথপ্রাপ্ত হও। (সূরা আন আনআম: ৯৭) অর্থাৎ সেগুলো দ্বারা তোমরা যেন ভ্রমণের দিক নির্ণয় করতে পারো। উদ্দেশ্য এ নয় যে, এগুলো দ্বারা ইলমুল গায়েব অনুসন্ধান করবো। যেমন ধারণা করে থাকে জ্যোতিষীরা।
ইমাম খাত্তাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, কিবলার দিক নির্ধারণ করার জন্য তারকা দ্বারা নির্দেশনা গ্রহণ করা বৈধ। কেননা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আলেমগণ গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে এ তারকাগুলোকে কিবলার দিক নির্ধারণের জন্য ঠিক করেছেন।
তারকা সম্পর্কিত বিদ্যার মাধ্যমে কিবলার দিক নির্ধারণ করা হয়, সেটি হচ্ছে ঐ সমস্ত অভিজ্ঞ ইমামদের কাজ, যাদের দীনী খেদমতে আমরা কোনো প্রকার সন্দেহ করি না এবং তারকার চলাচল ও গতি সম্পর্কে তারা যে সংবাদ দেন তার সত্যতা অস্বীকার করি না। তারা কিবলার দিক কাবার কাছে থাকা অবস্থায় যেভাবে দেখেন, দূরে থাকা অবস্থায় ঠিক সেভাবেই দেখেন। সুতরাং দূর থেকে কিবলা সম্পর্কে তাদের জ্ঞান অর্জন করা কাবাকে দেখার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের মতোই। আর তাদের খবরকে গ্রহণ করার মাধ্যমে আমরাও কিবলার দিক জানতে পারি। কেননা দীনের বিষয়াদিতে আমাদের কাছে তাদের খেদমত প্রশ্নবিদ্ধ নয় এবং তারা আকাশের তারকা ও নক্ষত্ররাজি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার ক্ষেত্রেও কোনো প্রকার ত্রুটি করেননি।
ইমাম ইবনে রজব বলেন, তারকাসমূহের চলাচল সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু যে ইলমের মধ্যে দাবি করা হয় যে, পৃথিবীর ঘটনাবলীতে তারকার প্রভাব রয়েছে, তা শিক্ষা করার অনুমতি নেই। যেমন বর্তমানের জ্যোতিষীরা দাবী করে থাকে। এ ধরণের ইলম অর্জন করা নিষেধ। তা কম হোক বা বেশি হোক। কিন্তু অন্ধকার রাতে পথ চলার জন্য, কিবলা নির্ধারণ করার জন্য এবং রাস্তা চেনার জন্য প্রয়োজন অনুপাতে ইলমুত্ তাস্য়ীর তথা তারকা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা অধিকাংশ আলেমের নিকট জায়েয।
ঠিক তেমনি কিবলা, নামাযের সময়সূচি, বিভিন্ন ঋতু, পশ্চিমাকাশে সূর্য ঢলার সময় সম্পর্কে জানার জন্য চন্দ্র-সূর্যের মঞ্জিল সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা জায়েয আছে। ইমাম খাত্তাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, চোখ দিয়ে দেখে ইলমুন নুজুম সম্পর্কে যে বিদ্যা অর্জন করা হয়, যার মাধ্যমে পশ্চিমাকাশে সূর্য ঢলে যাওয়া সম্পর্কে অবগত হওয়া যায় এবং কিবলার দিক জানা যায়, তা নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত নয়। ছায়া পর্যবেক্ষণ করে যা জানা যায়, তা হলো সকাল বেলা কোনো কিছুর ছায়া ধীরে ধীরে ছোট হওয়ার অর্থ হলো পূর্ব দিগন্ত হতে সূর্য আসমানের মধ্যভাগে উঠছে। এক পর্যায়ে ছায়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর যখন পুনরায় বৃদ্ধি হওয়া শুরু করে, তখন সূর্য মধ্য আকাশ থেকে পশ্চিম দিগমেত্মর দিকে নামতে শুরু করে। এ প্রকার ইলম তো চোখে দেখেও অর্জন করা যায়। তবে লোকেরা এ ইলমটি এখন যন্ত্রপাতির সাহায্যে অর্জন করছে। এতে দৃষ্টি দেয়ার মাধ্যমেই এখন সূর্যের অবস্থান, নামাযের সময়সূচী ও ছায়ার লম্বা-খাটো, সূর্য ঠিক মাথার উপরে, না কি পূর্বাকাশে না কি পশ্চিমাকাশে তা বুঝা যায়।
ইমাম ইবনুল মুনযির মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি চন্দ্রের মঞ্জিল সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করাকে দোষণীয় মনে করতেন না।
পরিশেষে বলতে চাই যে, মুসলিমদের আকীদা হলো তাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। এর মাধ্যমেই তাদের নাজাত ও সৌভাগ্যের ফায়ছালা হবে। সুতরাং যেসব বিষয় আকীদাকে নষ্ট করে দেয় কিংবা তাতে শিরক, কুসংস্কার ও বিদআত ঢুকিয়ে দেয়, তা থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। এতে করে তার আকীদা পরিস্কার ও উজ্জ্বল থাকবে। আল্লাহর কিতাব, রসূলের সুন্নাত এবং সালাফদের মানহাজ আঁকড়ে ধরার মাধ্যমেই আকীদা সংরক্ষণ করা সম্ভব। সঠিক আকীদা শিক্ষা করা এবং সেটার পরিপন্থী ভ্রান্ত আকীদাগুলো জানা ব্যতীত কেউ সহীহ আকীদার উপর থাকতে পারবে না। বিশেষ করে বর্তমানে মুসলিমদের কাতারে এমন অনেক লোক ঢুকে পড়েছে, যারা প্রয়োজন পূরণের আবেদন নিয়ে এবং বিপদাপদ দূর করার জন্য মিথ্যুক, ভেলকিবাজ ও ফাঁকিবাজদের কাছে যায়। তারা কবর ও সমাধিস্থলের উপরও ভরসা করে। পূর্বযুগের মুশরিকরা যেমন শিরকের উপর ছিল, সাম্প্রতিক কালের নামধারী মুসলিমগণ অনুরূপ শিরকের চর্চায় লিপ্ত। এমনকি তাদের চেয়ে এক শ্রেণীর মুসলিমদের শিরক অধিক ভয়াবহ। সেই সঙ্গে তারা নেতা, আলেম এবং সুফী তরীকার পীরদেরকে আল্লাহর বদলে রব হিসাবে গ্রহণ করেছে। এরা তাদের অনুসারীদের জন্য এমন দীন তৈরী করে, যার অনুমতি আল্লাহ তা‘আলা দেননি।
[1]. তবে আবহাওয়া অফিস ঝড়-বৃষ্টি হওয়া বা শৈত প্রবাহের যেই পূর্বাভাস দেয়, তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কেননা আকাশে মেঘের লক্ষণ দেখে অথবা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বৃষ্টি বা ঝড়ো হাওয়ার আলামত পেয়েই আবহাওয়া অফিস পূর্বাবাস দেয়। তাই এটি গায়েবের অন্তর্ভুক্ত নয়।
[2]. আবু দাউদ, অধ্যায়: জ্যোতির্বিদ্যা। ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেন, দেখুন: সহীহুত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব, হাদীছ নং- ৩০৫১।
[3]. এই বাক্যটি আরবদের জবানে উচ্চারিত হলেও এর দ্বারা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে কসম উদ্দেশ্য নয়। এটি ভাষাগত রীতি মাত্র। সাধারণত তাদের ভাষায় এ জাতিয় কথার প্রচলন রয়েছে। এতে আল্লাহ ছাড়া অন্যের কসমের সন্দেহ থাকায় অনেক আলেমই এই রীতিকে অপছন্দ করেছেন।
[4]. কথায় বলে, ঝড়ে বক মরে ফকীরের কারামতি বাড়ে।
[5]. আবু দাউদ, অধ্যায়: জ্যোতির্বিদ্যা। ইমাম আলবানী রহিমাহুল্লাহ সহীহ বলেছেন, দেখুন: সহীহুত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব, হাদীছ নং- ৩০৫১।
তারকা উদিত হওয়া কিংবা অস্ত যাওয়ার দিকে বৃষ্টি বর্ষণের সম্বন্ধ করাকে, الاستسقاء بالأنواء বলা হয়। অন্ধকার যুগের মুশরিকরা বিশ্বাস করতো যে, তারকা উদিত হওয়া কিংবা অদৃশ্য হওয়ার কারণে বৃষ্টি হয়। তারা বলতো, ‘অমুক অমুক নক্ষত্রের কারণে আমরা বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছি। نوء শব্দের মাধ্যমে তারা তারকা উদ্দেশ্য করতো। তারকাকে তারা نوء দ্বারা ব্যাখ্যা করতো। মূলত এর অর্থ হলো তারকা উদিত হওয়া। যেমন বলা হয় ناء ينوء উদিত হলো। এ কথা ঠিক ঐ সময় বলা হয়, যখন উঠে দাঁড়ায় এবং ছুটে যায়। তারা বলতো, যখন অমুক তারকা উদিত হবে, তখন বৃষ্টি হবে।
আরবরা أنواء দ্বারা চন্দ্রের ২৮টি মঞ্জিল উদ্দেশ্য করতো। প্রত্যেক তের রাতে ফজরের সময় একটি করে মঞ্জিল লোপ পায় এবং তার বদলে আরেকটি উদিত হয়। চন্দ্র বছরের শেষে সবগুলো নিঃশেষ হয়ে যায়। জাহেলী যুগে আরবরা ধারণা করতো ফজরের সময় যখন একটি উদিত হয় এবং অন্য একটি অস্ত যায়, তখনই বৃষ্টি হয়। একেই তারা বলতো, তারকার মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করা। এর অর্থ হলো তারা বৃষ্টিকে এসব উদীয়মান তারকার প্রতি সম্বন্ধ করতো। এটি ছিল জাহেলী যুগের আরবদের বিশ্বাস। ইসলাম এসে এ বিশ্বাসকে বাতিল করে দিয়েছে এবং তা থেকে নিষেধ করেছে। কেননা বৃষ্টি অবতীর্ণ হওয়া কিংবা না হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা, নির্ধারণ ও হিকমতের উপর নির্ভরশীল। এতে তারকা উদয়ের কোনো প্রভাব নেই।
আল্লাহ তা‘আলা আয়াতগুলো নাযিল করেন,
﴿فَلَا أُقْسِمُ بِمَوَاقِعِ النُّجُومِ (৭৫) وَإِنَّهُ لَقَسَمٌ لَوْ تَعْلَمُونَ عَظِيمٌ إِنَّهُ لَقُرْآَنٌ كَرِيمٌ (৭৭) فِي كِتَابٍ مَكْنُونٍ (৭৮) لَا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ (৭৯) تَنْزِيلٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ (৮০) أَفَبِهَذَا الْحَدِيثِ أَنْتُمْ مُدْهِنُونَ (৮১) وَتَجْعَلُونَ رِزْقَكُمْ أَنَّكُمْ تُكَذِّبُونَ﴾
‘‘অতএব, আমি তারকারাজির ভ্রমণ পথের শপথ করছি, নিশ্চয় এটি বড় শপথ যদি তোমরা জানতে পারো। নিশ্চয় এটা সম্মানিত কুরআন, যা সুরক্ষিত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। পবিত্রগণ ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করতে পারে না। এটি বিশ্ব পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। তবুও কি তোমরা এ বাণীর প্রতি শৈথিল্য প্রদর্শন করছো? এ নিয়ামতে তোমরা নিজেদের অংশ এই রেখেছো যে, তোমরা তা অস্বীকার করছো। (সূরা ওয়াকিয়া: ৭৫-৮২)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী, ‘‘এ নেয়ামতে তোমরা নিজেদের অংশ এ রেখেছো যে, তোমরা তা অস্বীকার করছো’’ -এর অর্থ হলো আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে অবতীর্ণ বৃষ্টির সম্বন্ধ তারকার দিকে এভাবে করা যে, مطرنا بنوء كذا وكذا আমরা অমুক অমুক তারকার কারণে বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছি। এটি সর্ববৃহৎ মিথ্যা ও অপবাদের অন্তর্ভুক্ত।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল, তিরমিযী হাসান সূত্রে, ইবনে জারীর, আবু হাতিম এবং ইমাম যিয়াউদ্দীন মাকদেসী স্বীয় কিতাব মুখতারায় আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর বাণী,تجعلون رزقكم তোমাদের নিয়ামতের অংশকে অর্থাৎ আল্লাহর শুকরিয়াকে তোমরা এই করেছ যে, তোমরা মিথ্যা প্রতিপন্ন করছো। তোমরা বলে থাক যে, অমুক অমুক তারকার কারণে আমরা বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছি।
শাইখ আব্দুর রাহমান ইবনে হাসান রহিমাহুল্লাহ বলেন, উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় যা বলা হয়েছে, তাই সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। আলী, ইবনে আব্বাস, কাতাদাহ, যাহ্হাক, আতা আল-খোরাসানী এবং অন্যান্য আলেম থেকে উপরোক্ত ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। এটিই অধিকাংশ মুফাস্সিরের মতো। শাইখ আব্দুর রাহমান ইবনে হাসানের কথা এখানেই শেষ।
আবু মালেক আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
أَرْبَعٌ فِى أُمَّتِى مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ لاَ يَتْرُكُونَهُنَّ الْفَخْرُ فِى الأَحْسَابِ وَالطَّعْنُ فِى الأَنْسَابِ وَالاِسْتِسْقَاءُ بِالنُّجُومِ وَالنِّيَاحَةُ وَقَالَ النَّائِحَةُ إِذَا لَمْ تَتُبْ قَبْلَ مَوْتِهَا تُقَامُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَعَلَيْهَا سِرْبَالٌ مِنْ قَطِرَانٍ وَدِرْعٌ مِنْ جَرَبٍ
‘‘জাহেলী যুগের চারটি কু-স্বভাব আমার উম্মতের মধ্যে বিদ্যমান থাকবে, যা তারা পুরোপুরি পরিত্যাগ করতে পারবে না। (এক) আভিজাত্যের অহংকার করা। (দুই) বংশের বদনাম করা। (তিন) নক্ষত্ররাজির মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা করা এবং (চার) মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা। তিনি আরও বলেন, ‘মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপকারিনী মৃত্যুর পূর্বে যদি তাওবা না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তাকে এমন অবস্থায় উঠানো হবে যে, তার পরনে থাকবে আলকাতরার প্রলেপযুক্ত লম্বা পায়জামা এবং খোস-পাঁচড়াযুক্ত কোর্তা।[1]
জাহেলী যুগ বলতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বের যুগ উদ্দেশ্য। তার আনীত দীনের পরিপন্থী প্রত্যেক বিষয়ই জাহেলীয়াতের অন্তর্ভুক্ত।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ এ হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, মানুষ জাহেলীয়াতের কতক স্বভাব ছাড়তে পারবে না। যারা তা ছাড়তে পারবে না, তাদের নিন্দাবাদ বর্ণনা করতে গিয়েই তিনি এ কথা বলেছেন। হাদীছের দাবি হলো, জাহেলীয়াতের প্রত্যেক কথা ও কাজই দীন ইসলামের মধ্যে নিন্দিত। তা না হলে এগুলোকে জাহেলীয়াতের দিকে সম্বন্ধ করে নিন্দা করা হতোনা। সুতরাং জানা গেলো, নিন্দা করণার্থেই উপরোক্ত কাজগুলোর সম্বন্ধ জাহেলীয়াতের দিকে করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَى﴾
‘‘তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবে। মূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না’’। (সূরা আল আহযাব: ৩৩)
এখানে জাহেলী যামানার নারীদের সৌন্দর্য্য প্রদর্শন করে বের হওয়ার নিন্দা করা হয়েছে এবং জাহেলী যুগের লোকদেরও নিন্দা করা হয়েছে। এ নিন্দার দাবী হচ্ছে জাহেলী যুগের লোকদের সাদৃশ্য করা নিষিদ্ধ। শাইখুল ইসলামের বক্তব্য এখানেই শেষ।
الاستسقاء بالأنواء তারকাজির মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা করা: এর অর্থ হলো তারকার দিকে বৃষ্টির সম্বন্ধ করা। نوء অর্থ হলো তারকা অস্তমিত হওয়া। যেমন কোনো মানুষ বললো, আমরা অমুক অমুক তারকা অস্তমিত হওয়ার মাধ্যমে বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছি।
الاستسقاء بالأنواء তারকাজির মাধ্যমে বৃষ্টি কামনা করার হুকুম: যদি বিশ্বাস করা হয় যে, বৃষ্টি বর্ষণে নক্ষত্রের প্রভাব রয়েছে তাহলে এমন বিশ্বাস কুফুরী ও বড় শিরক। জাহেলী যামানার মুশরিকরা এ বিশ্বাসই করতো। আর যদি বিশ্বাস করা হয় যে, বৃষ্টি বর্ষণে তারকার নিজস্ব কোনো প্রভাব নেই; বরং আল্লাহই একমাত্র বৃষ্টি বর্ষণকারী, তবে আল্লাহ তা‘আলা একটি নিয়ম করেছেন যে, অমুক তারকা অস্তমিত হবার সময় বৃষ্টি হবেই তাহলে এ বিশ্বাস বড় শিরক পর্যন্ত পৌঁছবে না। কিন্তু ছোট শিরকের পর্যায়ে পড়বে। কেননা তারকার দিকে বৃষ্টি বর্ষণের সম্বন্ধ করা হারাম। শিরকের দরজা বন্ধ করণার্থে রূপকার্থেও এটি নিষিদ্ধ।
ইমাম বুখারী ও মুসলিম যায়েদ ইবনে খালেদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন,
صَلَّى لَنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم صَلاَةَ الصُّبْحِ بِالْحُدَيْبِيَةِ عَلَى إِثْرِ سَمَاءٍ كَانَتْ مِنَ اللَّيْلَةِ فَلَمَّا انْصَرَفَ أَقْبَلَ عَلَى النَّاسِ فَقَال্َর هَلْ تَدْرُونَ مَاذَا قَالَ رَبُّكُمْ قَالُوا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَال্َর أَصْبَحَ مِنْ عِبَادِى مُؤْمِنٌ بِى وَكَافِرٌ فَأَمَّا مَنْ قَالَ مُطِرْنَا بِفَضْلِ اللَّهِ وَرَحْمَتِهِ فَذَلِكَ مُؤْمِنٌ بِى وَكَافِرٌ بِالْكَوْكَبِ وَأَمَّا مَنْ قَالَ بِنَوْءِ كَذَا وَكَذَا فَذَلِكَ كَافِرٌ بِى وَمُؤْمِنٌ بِالْكَوْكَبِ
‘‘রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুদাইবিয়াতে আমাদেরকে নিয়ে ফজরের নামাজ পড়লেন। সে রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। সালাত শেষে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের দিকে ফিরে বললেন, তোমরা কি জানো তোমাদের প্রভু আজ রাতে কী বলেছেন? লোকেরা বললো আল্লাহ ও তার রসূলই অধিক জানেন। তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন, আজ সকালে আমার বান্দাদের মধ্যে কেউ আমার প্রতি ঈমানদার হয়েছে আবার কেউ কাফের হয়েছে। যে ব্যক্তি বলেছে, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতে বৃষ্টি হয়েছে, সে আমার প্রতি ঈমান এনেছে আর বৃষ্টি বর্ষণে নক্ষত্রের প্রভাবকে অস্বীকার করেছে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি বলেছে, ‘অমুক অমুক নক্ষত্রের কারণে বৃষ্টিপাত হয়েছে, সে আমাকে অস্বীকার করেছে আর নক্ষত্রের প্রতি ঈমান এনেছে’’।[2]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তি, আল্লাহ বলেছেন, আজ সকালে আমার বান্দাদের মধ্যে কেউ আমার প্রতি ঈমানদার হয়েছে আবার কেউ কাফের হয়েছে। এখানে মুমিনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি বৃষ্টি বর্ষণকে আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতের দিকে সম্বন্ধ করে, সে মুমিন। আর যে বৃষ্টিকে তারকার দিকে সম্বন্ধ করে তাকে কাফের হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এতে দলীল পাওয়া যাচ্ছে যে, আল্লাহর কাজকে অন্যের দিকে সম্বন্ধ করা জায়েয নয়। এটি নিঃসন্দেহে কুফুরী। মানুষ যদি বিশ্বাস করে, বৃষ্টি বর্ষণে তারকার প্রভাব রয়েছে, তাহলে এটি বড় কুফুরী। কেননা এতে আল্লাহর রুবুবীয়াতে শিরক করা হয়। মুশরিকও কাফেরের অন্তর্ভুক্ত।
আর যদি বিশ্বাস করা হয় যে, বৃষ্টি বর্ষণে তারকার কোনো প্রভাব ও ক্ষমতা নেই, বৃষ্টিকে তারকার দিকে কেবল রূপকার্থে সম্বন্ধ করা হয়েছে, তাহলে এটিও হারাম হবে এবং ছোট শিরকের অন্তর্ভুক্ত হবে। কেননা সে আল্লাহর দেয়া নিয়ামতের সম্বন্ধ অন্যের দিকে করেছে।
ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, পূর্বাকাশে যখন একটি তারকা উদিত হতো এবং পশ্চিমাকাশে অন্য একটি তারকা অস্তমিত হতো, তখন বৃষ্টিপাত হলে কিংবা বাতাস প্রবাহিত হলে প্রাচীন আরবদের কেউ কেউ উদিত তারকার দিকে আবার কেউ কেউ অস্তমিত তারকার দিকে বৃষ্টিপাতের সম্বন্ধ করতো। এভাবে সম্বন্ধ করতো যে, এগুলোই বৃষ্টি তৈরী, উদ্ভাবন ও বর্ষণ করে। তারা হাদীছে উল্লেখিত কথাটি ব্যবহার করে থাকে। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপরোক্ত বাক্য প্রয়োগ করতে নিষেধ করেছেন। যাতে করে কেউ জাহেলী যুগের লোকদের অনুরূপ আকীদা পোষণ না করে এবং কথা-বার্তায় তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ না করে। ইমাম কুরতুবীর বক্তব্য এখানেই শেষ।
ইমাম মুসলিম আল্লাহ তা‘আলার বাণী উল্লেখ করে বলেন:
﴿فَلَا أُقْسِمُ بِمَوَاقِعِ النُّجُومِ (৭৫) وَإِنَّهُ لَقَسَمٌ لَوْ تَعْلَمُونَ عَظِيمٌ إِنَّهُ لَقُرْآَنٌ كَرِيمٌ (৭৭) فِي كِتَابٍ مَكْنُونٍ (৭৮) لَا يَمَسُّهُ إِلَّا الْمُطَهَّرُونَ (৭৯) تَنْزِيلٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ (৮০) أَفَبِهَذَا الْحَدِيثِ أَنْتُمْ مُدْهِنُونَ (৮১) وَتَجْعَلُونَ رِزْقَكُمْ أَنَّكُمْ تُكَذِّبُونَ﴾
‘‘অতএব, আমি তারকারাজির ভ্রমণ পথের শপথ করছি, নিশ্চয় এটি বড় শপথ যদি তোমরা জানতে পারো। নিশ্চয়ই এটা সম্মানিত কুরআন, যা সুরক্ষিত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। পবিত্রগণ ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করতে পারে না। এটি বিশ্ব পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। তবুও কি তোমরা এই বাণীর প্রতি শৈথিল্য প্রদর্শন করছো? এ নেয়ামতে তোমরা নিজেদের অংশ এ রেখেছো যে, তোমরা তা অস্বীকার করছো। (সূরা ওয়াকিয়া: ৭৫-৮২)
এ আয়াতগুলোর শানে নুযুল সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাসের বরাত দিয়ে বলেন, কেউ কেউ বলেছেন, অমুক অমুক তারকার প্রভাব সত্য হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা উপরোক্ত আয়াতগুলো নাযিল করেন।
সুতরাং বৃষ্টি বর্ষণ করা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কাজ, তার শক্তি ও ক্ষমতাধীন। এতে কোনো সৃষ্টির প্রভাব নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَفَرَأَيْتُمُ الْمَاءَ الَّذِي تَشْرَبُونَ أَأَنتُمْ أَنزَلْتُمُوهُ مِنَ الْمُزْنِ أَمْ نَحْنُ الْمُنزِلُونَ﴾
‘‘তোমরা যে পানি পান কর, সে সম্পর্কে তোমরা চিন্তা করেছো কি? তোমরা কি তা মেঘ হতে বর্ষণ কর, না আমি বর্ষণ করি?’’ (সূরা ওয়াকিয়া: ৬৮-৬৯)
সুতরাং যে ব্যক্তি তারকাসমূহ কিংবা প্রাকৃতিক কারণ যেমন পৃথিবীর পরিবেশগত কারণ ও বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে মেঘ সৃষ্টি হয় বলে ধারণা করে তারা মিথ্যা বলে এবং অপবাদ রটায়। এসব ধারণা বড় শিরক। আর যদি বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তা‘আলাই বৃষ্টি বর্ষণকারী, কিন্তু রূপকার্থে বৃষ্টির সম্বন্ধ এগুলোর প্রতি করে, তাহলে এটিও হারাম এবং ছোট কুফুরী। কেননা এতেও আল্লাহ ছাড়া অন্যের দিকে নিয়ামতের সম্বন্ধ করা হয়। যেমন কেউ কেউ বলে থাকে অমুক অমুক তারকার মাধ্যমে আমরা বৃষ্টিপ্রাপ্ত হয়েছি।
এ বিষয়ে কতক সাংবাদিক এবং মিডিয়া কর্মীদের যথেষ্ট শৈথিল্য প্রদর্শন করতে দেখা যায়। মুসলিমদের এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত। আল্লাহ তা‘আলাই তাওফীক দানকারী।
[1]. সহীহ মুসলিম ৯৩৪, অধ্যায়: বিলাপ করার ভয়াবহতা।
[2]. সহীহ বুখারী ৮৪৬, অধ্যায়: হুদায়বিয়ার যুদ্ধ।
ইতিপূর্বে তারকার প্রতি বৃষ্টির সম্বন্ধ করা এবং সেটার মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করার হুকুম আলোচিত হয়েছে। এখন অন্যান্য নিয়ামত আল্লাহ ব্যতীত অন্যের দিকে সম্বন্ধ করার হুকুম সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। জেনে রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহর অনুগ্রহ ও নিয়ামতের স্বীকৃতি প্রদান করা এবং সেটার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আকীদার গভীরতম বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা নিয়ামত প্রদানকারী। তাকে বাদ দিয়ে যে ব্যক্তি অন্য কারো দিকে নিয়ামতের সম্বন্ধ করলো, সে কুফুরী করলো অথবা নিয়ামতকে গাইরুল্লাহর দিকে সম্বন্ধ করার কারণে আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করলো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَعْرِفُونَ نِعْمَةَ اللَّهِ ثُمَّ يُنْكِرُونَهَا وَأَكْثَرُهُمُ الْكَافِرُونَ﴾
‘‘তারা আল্লাহর নিয়ামত চিনে, অতঃপর তা অস্বীকার করে তাদের অধিকাংশই অকৃতজ্ঞ’’। (সূরা নাহল: ৮৩)
কতিপয় মুফাস্সির এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, তারা জানে যে, সমস্ত নিয়ামত আল্লাহর পক্ষ হতে। আল্লাহ তা‘আলাই তা দিয়ে তাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন। তারপরও তারা এটি অস্বীকার করে। তারা ধারণা করে যে, তারা তাদের বাপ-দাদাদের কাছ থেকেই উত্তরাধিকার সূত্রে এসব পেয়েছে। তাদের কেউ কেউ বলে, অমুক না থাকলে এমন হতো না। কেউ কেউ বলে, এটি আমরা আমাদের মাবুদসমূহের সুপারিশের কারণে পেয়েছি। এভাবে যে যাকে সম্মান করে, সে তার দিকেই নিয়ামতের সম্বন্ধ করে। কেউ করে বাপ-দাদার দিকে, কেউ করে তাদের বাতিল মাবুদগুলোর দিকে এবং কেউ করে থাকে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিদের দিকে। তারা ভুলে যায় নিয়ামতের প্রকৃত উৎস এবং সেটার প্রকৃত দাতা আল্লাহ তা‘আলার কথা।
কিছু মানুষ আছে, যারা সাগর পথে ভ্রমণকালে নানা ঝুকি ও বিপদাপদ মুক্ত নিরাপদ ভ্রমণের নিয়ামতকে অনুকূল বাতাস এবং মাঝি-মাল্লার দক্ষতার দিকে সম্বন্ধ করে। তারা বলে বাতাস ছিল খুব ভালো এবং মাঝি-মাল্লারা ছিল খুব সুদক্ষ-অভিজ্ঞ। বর্তমানেও অনেক লোকের মুখে শুনা যায় যে, রাষ্ট্রীয় শান্তি-শৃঙ্খলা, সুখ-শান্তি ও জান-মালের নিরাপত্তাজনিত নিয়ামত বজায় থাকা এবং দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন-দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি দূরিভুত হওয়াকে তারা সরকারের প্রচেষ্টা ও ব্যক্তি বিশেষের অবদান অথবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতি-উন্নতি ইত্যাদির প্রতি সম্বন্ধ করে। যেমন তারা বলে থাকে, মেডিকেল সাইন্স অনেক উন্নতি লাভ করার কারণেই রোগ-ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে কিংবা তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছে। সরকারের অমুক অমুক উন্নয়নমূলক কর্মসূচী দারিদ্র ও মূর্খতা দূর করেছে। অনুরূপ অন্যান্য বাক্য উচ্চারণ করা থেকে মুসলিমদের দূরে থাকা আবশ্যক এবং তা থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা চাই। সমস্ত নিয়ামতকে একমাত্র আল্লাহর দিকেই সম্বন্ধ করা উচিত এবং তার প্রশংসা করা চাই। কিছু কিছু সৃষ্টি যেমন ব্যক্তি বিশেষ, সংগঠন বা সরকারের প্রচেষ্টায় যেসব নিয়ামত আসে, তা ঐসব উপায়-উপকরণের অন্তর্ভুক্ত যা কখনো ফল দান করে আবার কখনো নিষ্ফল ও ব্যর্থ হয়। তাদের প্রচেষ্টা মাধ্যমে ভালো কিছু অর্জিত হলে তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যাবে। কিন্তু তাদের প্রচেষ্টার কারণে যে ফলাফল অর্জিত হয়, তার সম্বন্ধ আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো দিকে করা যাবে না।
আল্লাহ তা‘আলা তার সম্মানিত কিতাবে এমন অনেক গোত্রের কথা উল্লেখ করেছেন, যারা তাদের উপর আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করেছিল এবং তারা ধন-সম্পদ এবং অন্যান্য যেসব নিয়ামত লাভ করেছিল, তা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের প্রতি সম্বন্ধ করেছিল। তারা বলেছিল যে, তারা এগুলোর হকদার ছিল বলেই পেয়েছে অথবা তারা তাদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও যোগ্যতার বদৌলতেই অর্জন করেছে। আল্লাহ তা‘আলার বলেন,
﴿وَلَئِنْ أَذَقْنَاهُ رَحْمَةً مِنَّا مِنْ بَعْدِ ضَرَّاءَ مَسَّتْهُ لَيَقُولَنَّ هَذَا لِي وَمَا أَظُنُّ السَّاعَةَ قَائِمَةً وَلَئِنْ رُجِعْتُ إِلَى رَبِّي إِنَّ لِي عِنْدَهُ لَلْحُسْنَى فَلَنُنَبِّئَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِمَا عَمِلُوا وَلَنُذِيقَنَّهُمْ مِنْ عَذَابٍ غَلِيظٍ (৫০) وَإِذَا أَنْعَمْنَا عَلَى الْإِنْسَانِ أَعْرَضَ وَنَأَى بِجَانِبِهِ وَإِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ فَذُو دُعَاءٍ عَرِيضٍ﴾
‘‘কিন্তু কঠিন সময় কেটে যাওয়ার পর যেই মাত্র আমি তাকে আমার রহমতের স্বাদ আস্বাদন করাই, সে বলতে থাকে, এটা তো আমার যোগ্য প্রাপ্য; আমি মনে করি না যে, কিয়ামত সংঘটিত হবে। তবে সত্যিই যদি আমাকে আমার পালনকর্তার কাছে হাজির করা হয়, তবে অবশ্যই তার কাছে আমার জন্য কল্যাণ রয়েছে। অতএব আমি কাফেরদেরকে তাদের কর্ম সম্পর্কে অবশ্যই অবহিত করবো এবং তাদেরকে অবশ্যই আস্বাদন করাবো কঠিন শাস্তি’’। (সূরা ফুস্সিলাত: ৫০)
এটা তো আমার যোগ্য প্রাপ্য; এর অর্থ হলো আমি এটি আমার জ্ঞান দ্বারা অর্জন করেছি এবং আমি এর ন্যায্য হকদার। আসল কথা হলো, এটি আল্লাহর অনুগ্রহ থেকেই, এ নেয়ামত মানুষের প্রচেষ্টার ফলাফল নয় এবং তা মানুষ স্বীয় ক্ষমতা বলেও কামাই করেনি।
যে কারুনকে আল্লাহ তা‘আলা বিরাট ধনভা-ার দিয়েছিলেন, সে তার গোত্রীয় লোকদের উপর সীমাহীন যুলুম করেছিল। উপদেশ দানকারীগণ তাকে উপদেশ দিয়েছিলেন এবং আল্লাহর নেয়মাতের স্বীকৃতি প্রদান করার এবং সেটার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার আদেশ করেছিলেন। কিন্তু সে অহংকার করেছিল। আল্লাহ তা‘আলার তার সম্পর্কে কুরআনে বলেন যে, সে তখন বলেছিল, إِنَّمَا أُوتِيتُهُ عَلَى عِلْمٍ عِنْدِي ‘‘নিশ্চয় এ নেয়ামত জ্ঞানের জন্য আমাকে দেয়া হয়েছে’’। (কাসাস: ৭৮)
অর্থাৎ আমার পারদর্শিতা ও উপার্জনের বিভিন্ন পন্থা সম্পর্কিত জ্ঞান থাকার কারণেই আমি এ ধন-ভা-ার প্রাপ্ত হয়েছি। এটি নয় যে আল্লাহর অনুগ্রহে আমি ইহা প্রাপ্ত হয়েছি। এ জন্যই সে ভয়াবহ ও নিকৃষ্ট পরিণতির সম্মুখীন হয়েছিল। তার শাস্তি হয়েছিল খুব কঠোর। আল্লাহ তা‘আলা তাকে তার বাড়ি-ঘরসহ যমীনে দাবিয়ে দিয়েছেন। কেননা সে আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করেছিল এবং সেটাকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের দিকে সম্বন্ধ করে বলেছিল যে, সে নিজস্ব কলাকৌশল ও শক্তির বলে সেটা অর্জন করেছিল।
বর্তমান কালের অনেক লোক নতুন নতুন বস্তু আবিস্কার করতে পেরে অহমিকা প্রদর্শন করছে এবং আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য যেসব বিষয়ের ক্ষমতা দিয়েছেন, তা পেয়ে আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে নিজেদের বড়ত্ব প্রকাশ করছে, তাদের কলাকৌশল ও শক্তি-সামর্থ নিয়ে গর্ব করছে। সেই সঙ্গে তারা আল্লাহর যমীনে অন্যায়ভাবে সীমালংঘন করছে এবং আল্লাহর বান্দাদের উপর যুলুম করছে। কারুনের মতোই এরা শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত। এদের পূর্বে আদ জাতিও নিজেদের শক্তির বড়াই করে ধোঁকায় পড়েছিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَأَمَّا عَادٌ فَاسْتَكْبَرُوا فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَقَالُوا مَنْ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةً أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّ اللَّهَ الَّذِي خَلَقَهُمْ هُوَ أَشَدُّ مِنْهُمْ قُوَّةً وَكَانُوا بِآيَاتِنَا يَجْحَدُونَ (১৫) فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا صَرْصَرًا فِي أَيَّامٍ نَحِسَاتٍ لِنُذِيقَهُمْ عَذَابَ الْخِزْيِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلَعَذَابُ الْآخِرَةِ أَخْزَى وَهُمْ لَا يُنْصَرُونَ﴾
‘‘তাদের অবস্থা ছিল এই যে, পৃথিবীতে তারা অন্যায়ভাবে নিজেদেরকে বড় মনে করেছিলো এবং বলতে শুরু করেছিল, আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী আর কে আছে? তারা কি বুঝলো না, যে আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। তারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছিল। অবশেষে আমি কতিপয় অমঙ্গলকর দিনে তাদের উপর প্রবল ঝড়ো হাওয়া পাঠালাম যেন পার্থিব জীবনেই তাদেরকে অপমান ও লাঞ্ছনাকর আযাবের মজা আস্বাদন করাতে পারি। আখিরাতের আযাব তো এর চেয়েও অধিক অপমানকর। সেখানে কেউ তাদের সাহায্যকারী থাকবে না’’। (সূরা ফুস&&সলাত: ১৫-১৬)
প্রিয় পাঠক বৃন্দ! রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পূর্বকালের একদল লোকের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ঘটনাটি শুনুন। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে নিয়ামত প্রদান করে পরীক্ষা করেছেন। তাদের কেউ আল্লাহর নিয়ামতকে অস্বীকার করেছে এবং প্রাপ্ত নিয়ামতকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে বলে উল্লেখ করেছে। এতে আল্লাহ তা‘আলা তার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন। আর তাদের কেউ কেউ আল্লাহ তা‘আলার নিয়ামত ও অনুগ্রহের স্বীকৃতি প্রদান করেছে এবং আল্লাহর নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। এতে আল্লাহ তা‘আলা তার উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। এবার মূল ঘটনাটি শুনুন।
‘‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বনী ইসরাঈলের মধ্যে তিনজন লোক ছিল। যাদের একজন ছিল কুষ্ঠরোগী, আরেক জনের ছিল মাথায় টাক, অপরজন ছিল অন্ধ। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে পরীক্ষা করতে চাইলেন। তাদের কাছে তিনি একজন ফেরেশতা পাঠালেন।
সর্বপ্রথম কুষ্ঠরোগীর কাছে ফেরেশতা এসে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কী? সে বললো সুন্দর রং এবং ভালো চামড়া। আর যে রোগের কারণে মানুষ আমাকে ঘৃণা করে তা থেকে মুক্তি আমার কাম্য। তখন ফেরেস্তা তার শরীরে হাত বুলিয়ে দিলেন। এতে তার রোগ দূর হয়ে গেলো তাকে সুন্দর রং আর ভালো চামড়া দেয়া হলো। তারপর ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার প্রিয় সম্পদ কী? সে বললো, উট অথবা গরু। হাদীছ বর্ণনাকারী ইসহাক উট কিংবা গরু এ দু'য়ের মধ্যে সন্দেহ করেছেন। তখন তাকে একটি গর্ভবতী উট দেয়া হলো। ফেরেশতা তার জন্য এই বলে দু‘আ করলেন, আল্লাহ তোমাকে এ সম্পদে বরকত দান করুন।
অতঃপর ফেরেশতা টাক ওয়ালা লোকটির কাছে গিয়ে বললেন, তোমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কী? লোকটি বলল, আমার প্রিয় জিনিস হচ্ছে সুন্দর চুল। লোকজন আমাকে যে কারণে ঘৃণা করে তা থেকে মুক্ত হতে চাই। ফেরেশতা তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। এতে করে তার মাথার টাক দূর হয়ে গেল। তাকে সুন্দর চুল দেয়া হলো। অতঃপর ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনো সম্পদ তোমার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়? সে বললো উট অথবা গরু। তখন তাকে গর্ভবতী একটি গাভী দেয়া হলো। ফেরেশতা তার জন্য এই বলে দু‘আ করলেন আল্লাহ এ সম্পদে তোমাকে বরকত দান করুন।
তারপর ফেরেশতা অন্ধ লোকটির কাছে গিয়ে বললেন, তোমার কাছে সবচেয় প্রিয় সম্পদ কী? লোকটি বলল, আল্লাহ যেন আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। যার ফলে আমি লোকজনকে দেখতে পাবো। ফেরেশতা তখন তার চোখে হাত বুলিয়ে দিলেন। এতে আল্লাহ তা‘আলা লোকটির দৃষ্টিশক্তি ফিরেয়ে দিলেন। এবার ফেরেশতা তাকে বললেন, কী সম্পদ তোমার কাছে সব চেয়ে বেশি প্রিয়? সে বলল, ছাগল আমার বেশি প্রিয়। তখন তাকে একটি গর্ভবতী ছাগল দেয়া হলো। আল্লাহর অনুগ্রহে উট ও গরু বংশ বৃদ্ধি করতে লাগলো এবং ছাগলও বংশ বৃদ্ধি করতে লাগলো। অবশেষে অবস্থা এ দাঁড়ালো যে, একজনের উটে মাঠ ভরে গেলো, আরেকজনের গরুতে মাঠ পূর্ণ হয়ে গেলো এবং আরেক জনের ছাগলে মাঠ ভর্তি হয়ে গেলো।
অতঃপর নির্দিষ্ট একটি সময় পার হওয়ার পর একদিন ফেরেশতা তার পূর্ব আকৃতিতেই কুষ্ঠ রোগীর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, আমি একজন মিসকীন। আমার পথের সম্বল শেষ হয়ে গেছে। আমার গন্তব্যস্থলে পেঁŠছার জন্য আল্লাহর সাহায্য অতঃপর আপনার সাহায্য দরকার। যে আল্লাহ আপনাকে এত সুন্দর রং এবং ভালো চামড়া দান করেছেন, তার নামে আমি আপনার কাছে একটা উট সাহায্য চাই, যাতে আমি নিজ দেশে পেঁŠছাতে পারি। তখন লোকটি বললো, দেখুন: আমার অনেক দায়-দায়িত্ব আছে, হকদার আছে। ফেরেশতা বললেন, আমার মনে হয়, আপনাকে চিনি। আপনি কি কুষ্ঠ রোগী ছিলেন না? মানুষ কি আপনাকে ঘৃণা করতো না? আপনি খুব গরীব ছিলেন না? অতঃপর আল্লাহ আপনাকে এ সম্পদ দান করেছেন? তখন লোকটি বললো এ সম্পদ আমার পূর্ব পুরুষ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। ফেরেশতা তখন বললো, তুমি যদি মিথ্যাবাদী হয়ে থাকো তাহলে আল্লাহ যেন তোমাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেন।
অতঃপর ফেরেশতা মাথায় টাক ওয়ালা লোকটির কাছে গেলেন এবং ইতিপূর্বে কুষ্ঠরোগীর সাথে যে ধরনের কথা বলেছিল টাক ওয়ালা লোকটির সাথেও অনুরূপ কথা বললেন। উত্তরে কুষ্ঠরোগী যে জবাব দিয়েছিল, এ লোকটিও একই জবাব দিলো। ফেরেশতাও আগের মতই বললো যদি তুমি মিথ্যাবাদী হও তাহলে আল্লাহ তা‘আলা যেন তোমাকে তোমার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেন।
অতঃপর ফেরেশতা একই আকৃতিতে অন্ধ লোকটির কাছে গিয়ে বললেন, আমি এক গরীব মুসাফির। আমার পথের সম্বল নিঃশেষ হয়ে গেছে। আমি আল্লাহর সাহায্য অতঃপর আপনার সাহায্য কামনা করছি। যিনি আপনার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন, তার নামে একটি ছাগল আপনার কাছে সাহায্য চাই, যাতে আমার সফরে নিজ গন্তব্যস্থানে পেঁŠছাতে পারি। লোকটি তখন বললো আমি অন্ধ ছিলাম। আল্লাহ তা‘আলা আমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপনার যা খুশি নিয়ে যান। আর যা খুশি রেখে যান। আল্লাহর কসম, আল্লাহর নামে আপনি আজ যা নিয়ে যাবেন, তাতে আমি মোটেই বাধা দেবোনা। তখন ফেরেশতা বললেন, আপনার মাল আপনি রাখুন। আপনাদেরকে শুধুমাত্র পরীক্ষা করা হলো। আপনার আচরণে আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন। আপনার সঙ্গীদ্বয়ের আচরণে অসন্তুষ্ট হয়েছেন’’।[1]
এটি একটি বিরাট হাদীছ। তাতে রয়েছে বিরাট শিক্ষা। এ ঘটনাতে উল্লেখিত প্রথম দু’জন লোক আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার করেছিল। নিয়ামতের সম্বন্ধ তারা আল্লাহর দিকে করেনি এবং তাদের সম্পদের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার যে হক ছিল তাও আদায় করেনি। ফলে তাদের উপর আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ নেমে আসলো এবং তাদের থেকে নিয়ামত ছিনিয়ে নেয়া হলো।
সর্বশেষ ব্যক্তি আল্লাহর নিয়ামতের স্বীকৃতি প্রদান করলো, নিয়ামতের সম্বন্ধ তার দিকেই করলো এবং তাতে আল্লাহ তা‘আলার যে হক রয়েছে তাও প্রদান করলো। এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে নিলো। নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার কারণে আল্লাহ তা‘আলা তার সম্পদ আরো বাড়িয়ে দিলেন।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, الشكر শব্দের মূল অর্থ হচ্ছে বিনয়, নম্রতা ও ভালোবাসার সাথে নিয়ামত প্রদানকারীর নিয়ামতের স্বীকৃতি প্রদান করা। সুতরাং যে ব্যক্তি নিয়ামতের কদর জানে না; বরং সেটা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ সে নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতেও জানে না। আর যে ব্যক্তি নিয়ামতের কদর জানে, কিন্তু নেয়ামত প্রদানকারীকে চিনতে পারে না, সেও নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে জানে না। আর যে ব্যক্তি নিয়ামতের কদর জানতে পারলো এবং নিয়ামত প্রদানকারীকেও চিনতে পারলো, কিন্তু নিয়ামত এবং নিয়ামত প্রদানকারীর প্রতি অবিশ্বাসীর মতোই নেয়ামতকে অস্বীকার করলো সে মূলত নিয়ামতের প্রতি কুফুরী করলো।
আর যে ব্যক্তি নিয়ামত এবং নিয়ামত প্রদানকারীকে চিনতে পারলো, নিয়ামতের স্বীকৃতি প্রদান করলো, অস্বীকৃতি প্রদান করলোনা, কিন্তু নিয়ামত প্রদানকারীর জন্য বিনীত হলো না, তাকে ভালোবাসলো না, তার প্রতি সন্তুষ্ট হলো না সেও নিয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো না।
আর যে ব্যক্তি নিয়ামতকে চিনতে পারলো, নিয়ামত প্রদানকারীকেও চিনতে পারলো, নিয়ামতের স্বীকৃতি প্রদান করলো, নিয়ামত প্রদানকারীর জন্য বিনীত হলো, তাকে ভালোবাসলো, তার প্রতি সন্তুষ্ট হলো, নিয়ামতকে আল্লাহর প্রিয় ও তার আনুগত্যের কাজে ব্যবহার করলো, সেই নিয়ামতের প্রকৃত শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো। সুতরাং নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার জন্য বান্দার অন্তরে নিয়ামত সম্পর্কে ইলম থাকা জরুরী এবং সেই ইলম অনুযায়ী অন্তরের আমলও থাকা আবশ্যক। অন্তরের আমল হলো নিয়ামত প্রদানকারীর প্রতি ঝুকে পড়া, তাকে ভালোবাসা এবং তার জন্য বিনীত হওয়া। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের বক্তব্য এখানেই শেষ।
[1]. বুখারী, অধ্যায়: বনী ইসরাঈলের খবর থেকে যা বর্ণিত হয়েছে।