প্রশ্ন-৭৯ : উচ্চ উলামা পরিষদকে হেয় প্রতিপন্ন করা তাদেরকে তোষামোদকারী ও চাকর বলা কি ঐক্যের অন্তর্ভুক্ত?

উত্তর : মুসলিম উম্মাহর আলিমদেরকে সম্মান করা ওয়াজিব। কেননা তারা নাবীদের ওয়ারিছ বা উত্তরাধিকারী। তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করা প্রকারান্তরে তাদের অবস্থান, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উত্তরাধিকারিত্ব এবং তাদের বহনকৃত ইলমকেই হেয়প্রতিপন্ন করা।

যে ব্যক্তি আলিমগণকেই হেয় প্রতিপন্ন করে সে সাধারণ মুসলিমদেরকে আরো বেশি অবজ্ঞা করে। আলিমগণের ইলম, মর্যাদাগত অবস্থান, ইসলাম ও মুসলিমদের কল্যাণার্থে পালনকৃত দায়িত্বের কারণে তাদেরকে সম্মান করা ওয়াজিব। যদি আলিমগণকেই আঁকড়ে না ধরা হয় তাহলে কাকে আঁকড়ে ধরা হবে? আলিমদের থেকে সাধারণ মুসলিমদের আস্থা বিনষ্ট হয়ে গেলে তারা বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও শারঈ হুকুম-আহকামের বর্ণনা গ্রহণ করার জন্য কার দ্বারস্থ হবে? এমনটা হলে তো বিশৃঙখলা ছড়িয়ে পড়বে এবং উম্মাহর ধ্বংস অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে।

কোন আলিম যদি ইজতিহাদ বা গবেষণার ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারে তাহলে তিনি দ্বিগুণ ছাওয়াব পাবেন। পক্ষান্তরে তিনি যদি ভুল সিদ্ধান্তেও উপনিত হন তাহলেও একটা ছাওয়াব পাবেন এবং তার উক্ত ভুল মাফ বলে গণ্য হবে।

যে ব্যক্তিই আলিমগণকে অবজ্ঞা করে সে শাস্তির হকদার হয়ে যায়।[1]

অতীত ও বর্তমান কালের ইতিহাস এ ব্যাপারে খুব ভালো। বিশেষতঃ তা যদি হয়ে থাকে ঐ সকল আলিমগণের ক্ষেত্রে যাদের উপর মুসলিমদের বিচার-আচার বা শাসনকার্য ন্যস্ত যেমন বিচারকগণ ও উচ্চ উলামা পরিষদ।[2]


[1]. ইবনু আসাকির (রহ.) বলেন,আলিমগণের গোস্ত বিষাক্ত। আল্লাহ তা‘আলা তাদের হেয়প্রতিপন্ন কারীদেরকে অপমানিত করেন, এটা সর্বজন জ্ঞাত বিষয়। যারা তাদের উপর অপবাদ আরোপ করে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দেন।

তিনি বলেন, আলিমগণের গোস্ত বিষাক্ত। যারা আলিমগণের মর্যাদাহানি করে তাদের শাস্তির ব্যাপারে আল্লাহর আদত বা চিরন্তন রীতি সকলের জানা। তাদের প্রতি অপবাদ আরোপ করা বড়ই মারত্মক। তাদের প্রতি জোর-জবরদস্তি, জুলম-অত্যাচার করা নিকৃষ্ট কাজ। আলিম ও সালাফে সালেহীনের অনুসরণ করা ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়ার নিকটবর্তী ও উত্তম গুণ। আল্লাহ তা‘আলা আলিমগণের সচ্চরিত্রের প্রশংসায় বলেন,

وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالأِيمَانِ وَلا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلاً لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَؤُوفٌ رَحِيمٌ

যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে: ‘হে আমাদের রব! আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন; এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু। (সূরা আল-হাশর আয়াত নং ১০)

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত ব্যক্তিদের গিবত করা ও তাদের গালমন্দ করাকে মারাত্মক পাপ বলেছেন।  আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

অতএব যারা তাঁর নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা যেন তাদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসা অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাব পৌঁছার ভয় করে। (সূরা আন-নূর আয়াত নং ৬৩)

 ‘তাবয়িনু কিযবিল মুফতারা পৃ. ২৭-২৯

[2]. বর্তমানে মুসলিমগন একদল দাঈদের দ্বারা পরীক্ষিত হচ্ছেন। তারা (দা‘ঙ্গ’রা) সূক্ষ্ম ভাষায় উচ্চ উলামা পরিষদকে অপবাদ দেয়। তবে তারা সূক্ষ্মভাষায় অপবাদ আরোপ করলেও জ্ঞানী লোকেরা তাদের ষড়যন্ত্র বুঝতে পারে।

তাদের মুখোশ উম্মোচনের লক্ষ্যে এখানে তাদের বই এবং লেকচার থেকে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করা হলো। ‘হাকীক্বাতুত তাতররুফ’ নামক ক্যাসেটের বক্তা বলেন, ‘আলিম এবং দা‘ঙ্গগণকে একথা বলা ওয়াজিব যে, আপনারা আপনাদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হন। আপনার অন্যের অনুমতি বা নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা না করে নিজেদের ভূমিকা পালন করুন, উম্মাহকে দিকনির্দেশনা পেশ করুন।’’

তিনি কাউকে বাদ না দিয়েই আম ভাবে একথা বলেছেন। তিনি সাউদী আরবের মত একটা শান্তিপূর্ণ ইসলামী দেশে এমন কথা বলেছেন। আপনি ভেবে দেখুন; তার কথার উদ্দেশ্য কী? আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে তাওফিক দান করুন। আমীন।

অতঃপর তিনি এমন কথা বলেছেন যা দ্বারা তার মূল উদ্দেশ্য আপনার নিকট উদ্ভাসিত হয়ে যায়। ‘‘বর্তমানে রাষ্ট্রের দ্বীনী পদসমূহ কিছু দল বা গোষ্ঠীর হাতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে; যারা তোষামোদি ও ধোঁকাবাজীতে পারঙ্গম। তারা নামে ইসলাম ও মুসলিমদের পরামর্শদাতা রাজকীয় অফিসার। পক্ষান্তরে বাস্তবতা হলো মাত্র দু’টি মাসআলা ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে তাদের কোন ভূমিকা নাই।

ক) কখন রামাদ্বান মাস শুরু হলো এবং কখন শেষ হলো তার প্রচারণা করা।

খ) যাদেরকে তারা চরমপন্থী বলে তাদের উপর আক্রমণ করা।’’

তিনি ‘‘আশ শারীত্ব আল-ইসলামী মা লাহু ওয়ামা আলাইহি’’ শিরোনামের কা্যাসেটে বলেন, ‘‘আলিমগণ যদি রাজনৈতিক সমস্যাবলির সমাধানে বক্তব্য পেশ না করেন তাহলে তাদের কিইবা মূল্য থাকে? জনগণ রাজনৈতিক সমস্যাবলি সমাধানের প্রতিই বেশি মুখাপেক্ষী।’’ তিনি এ কথার দ্বারা বুঝাতে চাচ্ছেন আলিমগণের করণীয় হলো তারা যেন জণগনকে রাজনৈতিক কার্যাবলি ও অনর্থক কথা বার্তায় লিপ্ত করেন। অথচ সেই কাজ মুসলিম উম্মাহর কোনই কল্যাণ বা উপকারে আসে না।

সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মানুষকে তাওহীদ বা একত্বের প্রতি দা’ওয়াত দেয়া। তাদেরকে ইবাদত সংক্রান্ত বিষয়াবলি শেখানো। মানুষের এগুলোই বেশি প্রয়োজন। অন্তসারশূন্য, বিশৃঙ্খলপূর্ণ রাজনীতির কোনই প্রয়োজন নাই। তাদের রাজনীতি তো দ্বীনী (ধর্ম সংক্রান্ত) বিষয়াবলির ব্যাপারে অজ্ঞ থাকতে শেখায়। যদি অধিকাংশ মানুষ তাওহীদ এবং ইবাদত সংক্রান্ত বিষয়াবলি সম্পর্কেই অজ্ঞ থাকে তাহলে এমন নাম সর্বস্ব রাজনীতির কিইবা উপকার রয়েছে?

উক্ত ক্যাসেটের বক্তা আরো বলেন, ‘‘আপনি কি চান যে, আলিম উলামারা শুধু যবাই করা, শিকার করা কুরবানী করা, হায়েয নিফাস, ওযু-গোসল এবং মোযার উপর মাসাহ সংক্রান্ত বিষয় নিয়েই সীমাবদ্ধ থাক?’’

তিনি উল্লেখিত ইবাদতসমূহ এবং এগুলোর হকুম আহকাম সম্পর্কে জানাকে ঠাট্টা বিদ্রূপ করছেন। অথবা এগুলোর শারঈ হকুম সম্পর্কে সঠিক ভাবে না জানলে ইবাদত কীভাবে করবে? এই ব্যক্তি ও এর সমমনাদেরকে আমি বলব ‘‘এর দায়ভার শুধু তোমাদেরই নয়। তোমাদের পূর্বপসূরীরাও তোমাদের মতই ছিল। যেমন: আমর ইবনে উবাইদ আল-মু’তাযিলী যিনি কিনা ইমাম হাসান বাছারী (রহ.) কে নিয়ে বিদ্রূপ করতেন। তিনি বলতেন ‘‘ঋতুবর্তী স্ত্রীলোকের পট্টি পড়ার নিয়ম ছাড়া হাসান তোমাদেরকে আর কিইবা শিখিয়েছে?’’

সম্মানিত পাঠক, আপনার জ্ঞাতার্থে আরো উপমা পেশ করছি,

‘‘ফাফিররু ইলাল্লাহ’’ বা আল্লাহর দিকে প্রত্যেবর্তন করো নামক ক্যাসেটে বক্তা বলেন ‘‘ আলিমগণের প্রতি আমাদের বক্তব্য হলো....আমরা একই বিষয়ে বার বার তিরস্কার করব না। বিশেষত যিনি নির্দিষ্ট যুদ্ধ ক্ষেত্রে বসবাস করছেন, এমন কিছু বিশেষ অবস্থানে রয়েছেন যেখানে মোসাহেবী-তোষামোদি করা আবশ্যক। অথবা এরকম অন্য কোন কঠিন অবস্থানে রয়েছেন। ভাইসব, আমাদের আলিমগণের প্রতি এতটুকু মর্যাদাবোধই যথেষ্ট যে, আমরা তাদের সব কাজকে সৎকাজ মনে করব না। আমরা বলব না যে তারা মা’ছুম বা নিষ্পাপ। তাদের জন্য তো, এটাই যথেষ্ট যে, তারা ইলম অর্জনে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করেছেন আমাদেরকে ইবাদত, ‘আকীদা এবং লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়ে ফাতওয়া প্রদান করছেন। কিন্তু আমরা বলব হ্যাঁ বাস্তবতা বুঝার ক্ষেত্রে তাদের কিছু ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাদের যে অসম্পূর্ণতা রয়েছে আমরা তা সম্পূর্ণ করব। তাদের উপর আমাদের কোন মর্যাদা বা প্রাধান্য নেই। কিন্তু আমরা এমন কিছু ঘটনার মধ্যে বেড়ে উঠেছি যা তাদের ক্ষেত্রে ঘটেনি। আমরা এমন কিছু বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছি যা তারা হয়নি। আল্লাহ তা’আলা আলিমগণকে উত্তম প্রতিদান দান করুন। আমরা তাদের অপূর্ণ কাজকে সম্পূর্ণ করব। তাদের নিকট বাস্তবতা বর্ণনা করব। আমরা যেহেতু প্রথম শ্রেণির ছাত্র সুতরাং আমাদের উপরই মূল দায়িত্ব ন্যাস্ত। আলিমগণের মধ্যে থেকেও কেউ কেউ দায়িত্ব অর্পণ করতে শরু করেছেন। সুতরাং আপনারা চিন্তা ফিকির করে দেখুন কে তাদের উত্তরসূরী হবে? চিন্তা করুন কে হবে?’’

এটা হলো তাদের ফিকহুল ওয়াকি’ বা বাস্তব ফিকহ। তাদের কেউ কেউ তো এ বিষয়ে ফিকহুল ওয়াকি’ নামক কিতাব ও রচনা  করে ফেলেছেন। আল্লামা নাছীরুদ্দীন আলবানী (রহ.) দু’টি ক্যাসেটের দীর্ঘ আলোচনা দ্বারা উক্ত বইয়ের সমালোচনা করেছেন। উক্ত ফিকহুল ওয়াকি’’ কিতাবের লেখক আগামী সস্করণ থেকে শায়খ আলবানী (রহ.) নির্দেশিত ভুল-ত্রুটিগুলো সংশোধনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু এখনো তা করেননি।

লোকজন উক্ত বই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অথচ তা পত্রিকা, ম্যাগাজিন, লন্ডন রেডিও ইত্যাদির ফিকহ। (বিস্তারিত জানতে ৩ নং প্রশ্নের টীকায় দেখুন)

সম্মানিত পাঠক ভেবে দেখুন তারা সবাই একই ভঙ্গিমায় একই ভাষায় কথা বলছে যদিও একজন সাউদী আরবের পশ্চিম প্রান্তে এবং অপর জন উত্তর প্রান্তে অবস্থান করুক না কেন।

এই শ্রেণির লোক অনেক রয়েছে। লা হাওলা ওয়ালা ক্বুওওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ

এই ব্যক্তি ও এর সমমনা বিশৃঙ্খলাকারী ও ফিতনা ফাসাদ সৃষ্টিকারীরা আমাদের উচ্চ উলামা পরিষদ যেমন ইবনে বায, উছায়ামিন, আল ফাওয়ান, আল লাহিদান, আল গিদাইয়ান (রহ.) প্রমুখের বিরোধিতা করতে চায়। ফিকহল ওয়াকি বা বাস্তব ফিকহের প্রবক্তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন হলো ‘‘বাস্তব ফিকহ সম্পর্কে কে বেশি অবগত? বাস্তবতা উপলব্ধির ব্যাপারে, কারা বেশি উপযুক্ত? তোমরা নাকি উচ্চ উলামা পরিষদ? জালিমদের জুলমের মুকাবিলা করার জন্য আমেরিকার সাহায্য গ্রহণ করা জায়েয বলার ব্যাপারে তোমরা সঠিক ছিলে নাকি উচ্চ উলামা পরিষদ? তোমরা যে তোমাদের বিভিন্ন সভা সমাবেশে উচ্চ উলামা পরিষদের স্বীকৃতির বিরোধিতা করেছিলে তা কী ভোলার ভান করেছ? তোমরা কি ভেবেছে তোমাদের ধূর্তামি কেউ বুঝে না?