উত্তর : এটা সর্বজন বিদিত যে, তাদের এ কাজটি বাতিল। তারা হয়তো বা এর দ্বারা অনিষ্ট সাধনের ইচ্ছে পোষণ করে অথবা তারা বিভ্রান্তিকর, ভ্রষ্ট দাওয়াত প্রদানকারীদের দ্বারা প্রভাবিত; তারা চায় আমরা যে নিয়ামতে বসবাস করছি তা বিদূরিত হয়ে যাক।
আমরা ওয়া লিল্লাহিল হামদ, আমাদের শাসক-নেতাদের ব্যাপারে এবং আমরা যে কর্মপদ্ধতির উপর চলছি সে কর্মপদ্ধতির ব্যাপারে অটল অবস্থানে রয়েছি। তবে হ্যাঁ এর অর্থ এই নয় যে, তা পূর্ণতা লাভ করেছে, আমাদের কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই। বরং আমাদের ত্রুটি আছে; তবে আমরা শারঈ পন্থায় সে সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি সমাধান ও সংশোধনের চেষ্টা করছি। ইনশা আল্লাহ।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগেও পাওয়া যেত, কেউ চুরি করেছে, কেউ যিনা করেছে এবং কেউ মদ পান করেছে; নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের উপর শাস্তি কায়িম করতেন।
ওয়া লিল্লাহিল হামদ। আমাদের মাঝেও যদি কারো উপর শাস্তি ওয়াজিবকারী কোন বিষয় প্রমাণিত হয় তাহলে সেক্ষেত্রে শাস্তি কায়িম করা হয়। হত্যার ক্ষেত্রে কিছছ বাস্তবায়ন করা হয়। ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও এতে অনেক কল্যাণ রয়েছে।[1] আর মানুষের স্বভাবে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকাটাই স্বাভাবিক।
আমরা আশা করি, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের অবস্থা সংশোধন করে দিবেন। আমাদেরকে সাহায্য করবেন। আমাদের চলার পথ সহজ করে দিবেন। আমাদের ঘাটতি তার ক্ষমা দ্বারা পূরণ করে দিবেন।
আমরা হোচট খাওয়া বা একটু পদস্খলন ঘটলেই তা নিয়ে শাসকদেরকে খাটো করতে/কটাক্ষ করতে শুরু করি। তাদেরকে নিয়ে সমালোচনা করি। জনগণকে তাদের উপর ক্ষেপীয়ে তুলি। এগুলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের সালাফদের পন্থা নয়।[2]
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত মুসলিমদের আনুগত্য করতে, তাদেরকে ভালোবাসতে ও ঐক্য বজায় রাখতে উদ্বুদ্ধ করে। এটাই কাম্য।
মুসলিম শাসকদের সমালোচনা করা গিবাত ও পরনিন্দার অন্তর্ভুক্ত। শিরকের পর গিবাত ও পরনিন্দা সবচেয়ে মারাত্মক গুনাহ। বিশেষত গিবাত যদি হয়ে থাকে ‘উলামা অথবা শাসকদের ক্ষেত্রে তাহলে তা আরো বেশি মারাত্মক। এর পেছনে ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো অকল্যাণ অবধারিত হয়; ঐক্য বিনষ্ট হয়, শাসকদের ব্যাপারে খারাপ ধারণা তৈরি হয়, জনগণের অন্তরে হতাশা-নিরাশার সৃষ্টি হয়।[3]
[1]. এটা আমাদের দেশের আদালত সমূহে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা যাকে অন্ধ করে দিয়েছে একমাত্র সে ব্যতীত, অথবা অন্তরের রোগগ্রস্থ ও প্রবৃত্তিবাদী ছাড়া অন্য কেউ এটাকে অস্বীকার করতে পারে না।
[2]. সম্মানিত শায়খ ‘আব্দুল ‘আযীয ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে বায (রহ.) তায়িফ শহরে ২৯ শে সফর ১৪১৩ হিজরীতে ‘আফাতুল লিসান’ শিরোনামে বক্তৃতা করেছিলেন। সেখানে তাকে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। এই উত্তরটি ‘হুকুকুর র‘ঈ ওয়ার রয়িইয়্যাহ’ নামক পুস্তিকার শেষে প্রকাশিত হয়েছে। এ বইয়ে মুহাম্মাদ ইবনে সলিহ আল উছায়মিন (রহ.) এর কিছু বক্তৃতা স্থান পেয়েছে। ‘আব্দুল ‘আযিয ইবনে বায (রহ.) এর বাণী নিয়ে ‘‘আল-মা‘লুম মিন ওয়াজিবিল ‘আলাকহ বাইনাল হাকিমি ওয়াল মাহকুম’’ নামক স্বতন্ত্র গ্রন্থ রয়েছে।
প্রশ্নকারী শায়খ ইবনে বায (রহ.) কে জিজ্ঞাসা করে মিম্বারের উপর (মঞ্চে) শাসকদের সমালোচনা করা কী সালাফদের মানহাজ (কর্মপন্থা)? শাসকদেরকে উপদেশ প্রদানের নিয়ম কী?
শায়খ (রহ.) উত্তরে বলেন: জনগণের মাঝে শাসকদের ভুল-ত্রুটির ব্যাপারে শুহরাত দেওয়া, এব্যপারে মঞ্চে সমালোচনা-পর্যালোচনা করা সালাফদের মানহাজ নয়। কেননা এর দ্বারা অনুমানের ভিত্তিতে অনেক কথা বলা হয়ে থাকে যার দ্বারা শুধু ক্ষতিই হয়, মোটেও কোন লাভ হয় না। বরং এক্ষেত্রে সালাফদের অনুসরণীয় রীতি হলো তাদের ও শাসকদের মাঝের বিষয়াবলিতে শাসককে উপদেশ দেওয়া, শাসকদের নিকট পত্র লেখা, যে আলিমগণ শাসকদের সাথে যোগাযোগ রাখে তাদের সাথে যোগাযোগ করা যাতে তারা শাসকদের দৃষ্টিকে কল্যাণের দিকে ফিরিয়ে দেন।
দেখুন হুকুকুর র‘ঈ ওয়ার রয়িয়্যাহ পৃ.২৭, আল-মা‘লূম মিন ওয়াজিবিল ‘আলাকহ বাইনাল হাকিমি ওয়াল মাহকুম পৃ. ২২
সম্মানিত শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে সলিহ আল উছায়মিন (রহ.) হুকুকুর র‘ঈ ওয়ার রয়িয়্যাহ নামক কিতাবের ১১ নং পৃষ্ঠায় বলেন, (প্রজার উপর শাসকের অধিকার সমূহ: তারা শাসকদেরকে নছীহত প্রদান করবে, তাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করবে, তারা কোন ভুল-ত্রুটি করে বসলে তাদের ভুল-ত্রুটিকে সমালোচনা করার ও তাদের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করার সিঁড়ি হিসেবে নিবে না, কেননা এর দ্বারা জনগণের মনে শাসকদের প্রতি ঘৃণা ও অপছন্দের উদ্রেক হয়। তাদের ভালো কাজগুলোও জনগণের নিকট অপছন্দনীয় হয়ে যায়। মানুষ তাদের কথা শ্রবণ করা ও তাদের আনুগত্য করা বর্জন করে।
প্রত্যেক উপদেশ দাতার জন্য, বিশেষত শাসকদেরকে উপদেশ প্রদানকারীর জন্য আবশ্যক হলো নছীহত প্রদানের ক্ষেত্রে হিকমাত অবলম্বন করা, আল্লাহর পথে হিকমাহ এবং উত্তম উপদেশের দ্বারা আহবান করবেন।
এই সম্মানিত আলিমগণ তাদের কথাকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পথপ্রদর্শন রীতি এবং সালাফে সালেহীনের অনুধাবন অনুযায়ী সমৃদ্ধ করেন।
এবিষয়ে অনেকগুলো সহীহ হাদীছে এসেছে, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল, তার সংকলিত মুসনাদের ০৩/৪০৪, ইবনু আবি ‘আছিম তার ‘আস-সুন্নাহ’ নামক গ্রন্থের ১০৯৬, ইমাম হাকিম তার সংকলনকৃত মুসতাদরাকের ০৩/২৯০, হায়ছামী আল ‘মাজমা‘ নামক গ্রন্থের ০৫/২২৯ -২৩০ ‘‘যে উপদেশ দিতে চায়’’ শিরোনামে ‘ঈয়ায ইবনে গনাম রযিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ‘ঈয়ায ইবনে গনাম রযিয়াল্লাহ আনহু বলেন,
قال رسول الله - صلى الله عليه وسلم - : من كانت عنده نصيحة لذي سلطان فلا يكلمه بها علانية، وليأخذ بيده وليخل به؛ فإن قبلها قبلها، وإلا كان قد أدى الذي عليه والذي له
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যদি কারো নিকট শাসককে প্রদান করার মত কোন উপদেশ থাকে তাহলে সে যেন তা প্রকাশ্যভাবে প্রদান না করে, বরং সে যেন শাসকের হাত ধরে কোন নির্জন স্থানে গিয়ে সংগোপনে তা প্রদান করে। শাসক যদি তার উপদেশ কবুল করে করলো, না করলেও উপদেশদাতা তার দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পাবে (হাদীছ হাসান, হাকিমের শব্দ বিন্যাস)।
ইমাম বুখারী (রহ.) আবু ওয়ায়িল শাক্বীক থেকে বর্ণিত সহীহ বুখারীর ৩০৯৪ ও ৬৬৭৫ নম্বর হাদীছে, ইমাম মুসলিম ২৯৮৯ নং হাদীছে বর্ণনা করেন (উসামাকে বলা হয়েছিল, যদি তুমি অমুকের নিকট আগমন করতে। ইমাম মুসলিমের বর্ণনায় যদি তুমি উছমানের নিকট গমন করে তার সাথে কথা বলতে। আমি তোমাদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে তার সাথে আলোচনা করি না। বরং আমি তার সাথে নির্জনে আলোচনা করি। মুসলিমের বর্ণনায়, সমালোচনার দরজা উন্মুক্ত করার আগেই আমি তার সাথে আমার ও তার মাঝে কথা বলেছি।
হাফিয ইবনু হাজার (রহ.) বলেন, মুহাল্লাব বলেছেন: তারা উসামা (রা.) থেকে চেয়েছিল যেন তিনি উছমান (রা.) এর সাথে আলোচনা করেন; তিনি তার বিশেষ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। যারা ওয়ালিদ ইবনে ‘উকবাহর বিষয়ে তার সাথে মতানৈক্য করেছিল। তার শরীরে মদের গন্ধ পাওয়া গিয়েছিল। এখবরটি ছড়িয়ে পড়ল। সে ছিল উছমান (রা.) এর বৈপিত্রীয় ভাই। তিনি তাকে আমিল নিয়োগ দিয়েছিলেন। উসামা বলল, আমি বিশৃঙ্খলার দরজা খোলা ছাড়াই তার সাথে কথা বলেছি অর্থাৎ প্রকাশ্য ভাবে শাসকদের বিরুদ্ধে সমালোচনা করার দরজা উন্মুক্ত করা ছাড়াই; যাতে মুসলিমদের ঐক্য বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়।
ইয়ায (রহ.) বলেন, উসামার উদ্দেশ্য হলো যে, তিনি শাসকের মন্দ দিক নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করার পরিণামের কথা ভেবে প্রকাশ্যে সমালোচনার দরজা উন্মুক্ত করেননি। বরং তিনি এ ব্যাপারে কোমল হয়ে গোপনে নছীহত প্রদান করেছেন। আর গোপনে প্রদেয় নছীহতই কবুল/গ্রহণ করার বেশি উপযোগী। ফাতহুল বারী খ.১৩ পৃ. ৫২
আমি বলব, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল (রহ.) এর প্রতি লক্ষ্য করুন, খলক্বে কুরআনের মাসআলায় (আল-কুরআনুল কারীম কি আল্লাহর বাণী নাকি মাখলুক এ সংক্রান্ত মাসআলা) তাকে চাবুক দিয়ে প্রহার করা হলো, টানা হেঁচড়া করা হলো এবং কারারুদ্ধ করা হলো এতদসত্ত্বেও তিনি ফাসিক যালিম শাসকের আনুগত্য থেকে বের হয়ে গেছেন বলে আমরা দুর্বল সূত্রেও কোন আছার (বর্ণনা) পাইনি। বরং তার ধৈর্য ও আনুগত্যে অটল থাকা এবং জামাআহ আঁকড়ে ধরা বিষয়ে অনেক আছার পাওয়া যায়।
তিনি বলতেন হে আমীরুল মুমিনীন, সে কি তোষামোদ করে তা বলত নাকি কাপুরুষতা বশতঃ বলত?
আমাদের জন্য সালাফে সালেহীনের মাঝে কি উত্তম আদর্শ নাই? নাকি আমরা তাদের থেকে বেশি জানি? আমরা তাদের থেকে বেশি সাহসী?
ইমাম ইবনু রজব আল হামবালী (রহ.) ‘জামি‘উল উলুম ওয়াল হিকাম’ নামক গ্রন্থে বলেন, মুসলিম নেতাদের জন্য উপদেশ প্রদানের পদ্ধতি হলো তাদেরকে হক (সঠিক) বিষয়ে সাহায্য করা ও তাদের আনুগত্য করা, তাদের সে হক কাজের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা প্রদান করা, দয়া ও কোমলতার সাথে তাদেরকে সতর্ক করা, তাদের তাওফিক্বের জন্য দুআ করা, এবং অন্যদেরকে তাদের কল্যাণ কামনার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা। পৃ. ১১৩
ইমাম শাওকানী (রহ.) ‘রফ‘উল আসাত্বিন ফি হুকমিল ইত্তিছাল’ নামক গ্রন্থে বলেন, শাসকদের জন্য আনুগত্য করার বিষয়টি কুরআনুল কারীম দ্বারা সাব্যস্ত। আল্লাহ তা‘আলা তার ও তার রসূলে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য করার পর শাসকদের আনুগত্য করাকে ফরয করেছেন। এবিষয়ে অনেক মুতাওয়াতির হাদীছ রয়েছে যে তাদের আনুগত্য করা ও তাদের যুলুম-নির্যাতনের ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করা ওয়াজিব। কিছু হাদীছে তাদের আনুগত্য করার বিষয়ে নির্দেশ রয়েছে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
وإن ضر ظهرك، وأخذ مالك
যদিও তারা তোমার পিঠে প্রহার করে এবং তোমার ধন-সম্পদ কেড়ে নেয়।
তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
أعطوهم الذي لهم، واسألوا الله الذي لكم
তোমরা তাদেরকে তাদের হক (অধিকার) প্রদান করো এবং আল্লাহর নিকট তোমাদের অধিকার চাও। পৃ.৮১-৮২
[3]. আমাদের উলামা ও শাসকদের ব্যাপারে কিছু বুদ্ধিজীবী ও কথিত দাঈদের মনে সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। কিছু সরলমনা যুবকেরা তাদের দ্বারা ধোঁকাগ্রস্থ হয়ে পথচ্যুত হয়েছে। তারা আমাদের রববানী উলামাদের যেমন আমাদের দেশের কিবারুল ‘উলামা নিকট থেকে দূরে সরে গেছে। তাদের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে যদি আপনি বলেন অমুক শায়খ এ কথা বলেছেন অথবা এই ফাতওয়া দিয়েছেন। তাহলে সে আপনার কথাকে প্রত্যাখ্যান করে বলবে উনারা রাষ্ট্রীয় আলিম, উনারা তোষামোদকারী!! অথবা বলবে উনাদের উপর রাষ্ট্রীয় অনেক চাপ রয়েছে!! আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি কতইনা সুন্দর অভিভাবক! শেষ যামানায় নিরেট আহমক লোকও উম্মাহর বিষয়ে কথা বলবে।