প্রশ্ন-২৯ : মুহাম্মাদ সুরুর তার ‘‘মানহাজুল আম্বিয়া ফিদ্ দাওয়াতি ইলাল্লাহ’’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, ‘ক্বওমে লূত যদি তাদের পাপে অব্যাহত থাকত, তবে লা ইলাহা ইলাল্লাহ বললেও তা তাদের কোন উপকারে আসত না’। এই মত খণ্ডনে আপনার অভিমত কী?

উত্তর : তার ক্বওল/মত: ‘‘ক্বউমে লূত যতদিন সমকামিতায় লিপ্ত ছিল তাদের তাওহীদের স্বীকৃতি কোনো উপকারে আসেনি’’।[1]

এটা একটা বাতিল কথা। নিঃসন্দেহে সমকামিতা একটা কাবীরা গুনাহ বা বড় পাপ। কিন্তু তা কুফুরির পর্যায়ে পৌঁছে না। কোনো ব্যক্তি শিরক থেকে তাওবা করে আর যদি শিরকে পতিত না হয়। কিন্তু তার দ্বারা লিওয়াত্ব বা সমকামিতা ঘটে থাকে তাহলে তার এই পাপকে কাবীরা গুনাহ বলে বিবেচিত হবে। এর কারণে তাকে কাফির বলা যাবে না।

ক্বওমে লূত (লূত আলাইহিস সালামে্র সম্প্রদায়) যদি তাওহীদ গ্রহণ করে এক আল্লাহর ইবাদত করত তার সাথে কাউকে শরীক বা অংশী স্থাপন না করত তাহলে সমকামিতার পাপে লিপ্ত/অবিরত থাকলেও ফাসিক বা কাবিরাহ গুনাহ সম্পাদনকারী সাব্যস্ত হতো। আল্লাহ তা’আলা দুনিয়া বা আখিরাতে তাদেরকে শাস্তি প্রদান করতেন অথবা ক্ষমা করে দিতেন। এ পাপের কারণে তাদেরকে কাফির বলা হতো না। আল্লাহ তা’আলা বলেন,

إِنَّ اللَّهَ لا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ

নিশ্চয় আল্লাহ তার সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। তিনি ক্ষমা করেন এ ছাড়া অন্যান্য পাপ যার জন্য তিনি চান (সূরা আন নিসা ৪/৪৮, ১১৬)।

সহীহ হাদিছে বর্ণিত হয়েছে আল্লাহ তা’আলা কিয়ামাতের দিন যে সকল বান্দার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান আছে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করার নির্দেশ প্রদান করবেন।[2] এগুলোর দ্বারা তাওহীদপন্থীদেরকে বুঝানো হয়।

যাদের পাপ রয়েছে তারা পাপের কারণে জাহান্নামে যাবে। আযাব প্রাপ্ত হওয়ার পর তাদের তাওহীদ ও আক্বীদার কারণে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। তাওহীদপন্থী ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করলেও স্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে না। আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করে দিলে সে জাহান্নামে প্রবেশই করবে না।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ

এ ছাড়া অন্যান্য পাপ তিনি যার জন্য চান ক্ষমা করেন। (সূরা আন নিসা ৪:৪৮)

তাদের কথা মূর্খের কথা। মূর্খতা একটা মারাত্মক কষ্টদায়ক রোগ। আল্লাহর আশ্রয় চাই। বর্তমানের অনেক দাঈর এই সমস্যা রয়েছে; যারা মূর্খতার ভিত্তিতে আল্লাহর পথে আহবান করে। তারা মূর্খতার কারণে ফিতনায় পতিত হয় ও মানুষকে বিনা কারণে কাফির বলে। তাওহীদ সংক্রান্ত বিষয়াবলিতে নমনীয় থাকে।[3] এই মূর্খের কা- দেখুন সে ‘আক্বীদার বিষয়কে তুচ্ছভাবে অথচ লিওয়াত্ব (সমকামিতা) কে মারাত্মক মনে করে। কোনটি বেশি মারাত্মক? শিরক নাকি লিওয়াত্ব? আমরা আল্লাহর নিকট মুক্তি কামনা করি।


[1]. সম্ভবত অনেক যুবকই একথার অর্থ বোঝে না। এর অর্থ হলো: কোন ব্যক্তি যদি অবিরত কাবীরা গুনাহ করতে থাকে এবং তা থেকে তাওবা না করে তাহলে ঈমান আনলেও তার ঈমান কোন উপকারে আসে না। ব্যক্তি যদি কাফির অবস্থায়ই যিনা, সমকামিতা ইত্যাদি গুনাহে অভ্যস্ত হয় এবং এ অবস্থাতেই ঈমান আনয়ন করে তাহলে যতদিন পর্যন্ত ঐ গুনাহ ত্যাগ না করে, ততদিন পর্যন্ত ঐ ব্যক্তির ঈমান কোন কাজে আসবে না। অর্থাৎ কাবীরা গুনাহ ঈমানের প্রতিবন্ধক বা কাবিরা গুনাহ সম্পাদনকারী মুমিন নয়। এটা কাদের বিশ্বাস (আকীদা)? খারিজিদের আকীদা।

লন্ডনে অবস্থানরত এই দাঈ বলেছে যে, সে এবং তার বন্ধুরা দাঈ। তারা কিসের দাঈ (কোন পথের দাঈ?) খারেজী আকীদার দিকে আহবানকারী। তারা খারেজী আকীদার ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

এই বিশ্বাস করা যে ‘‘কাবীরা গুনাহগার যদি তাওবা করার পূর্বেই মারা যায় তাহলে সে কাফির। ঈমান তার কোন উপকারে আসবে না।’’ এটা খারিজীদের আকীদা। যারা ‘আলী ইবনে আবি তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর আনুগত্য থেকে বের হয়ে তাকে কাফির বলেছিল।’’

(মুহাম্মাদ ইবনে সুরুরের মতামত খণ্ডনে প্রদত্ত মুহাম্মাদ আমান আল-জামী (রহ.) এর ক্যাসেট থেকে)।

[2]. ইমাম বুখারী (রহ.) ও অন্যান্য মুহাদ্দিছ আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

حديث أبي سعيد الخدري - رضي الله عنه - عن النبي - صلى الله عليه وسلم - ، قال : ( يدخل أهل الجنة الجنة وأهل النار النار، ثم يقول الله تعالى : (( أخرجوا من كان في قلبه مثقال حبة من خردل من إيمان )) ، فيُخرجون قد إسودّوا، فيُلقون في نهر الحيا أو الحياة - شك مالك - فينبُتون كما تنبت الحبة في جانب السيل، ألم ترى أنها تخرج صفراء ملتوية ) . رقم ( 22 )

তিনি বলেন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জান্নাত বাসীরা জান্নাতে এবং জাহান্নাম বাসীরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা বলবেন, যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান আছে তাকে তাকে বের করো।

তখন তাদেরকে এমতাবস্থায় বের করা হবে যে, তারা কালো বর্ণে পরিণত হয়েছে। এরপর হায়াতের নদী/জীবন নদীতে নিক্ষেপ করা হবে।  অতঃপর তারা যেভাবে নালার কিনারায় বীজ অঙ্কুরিত হয় সেভাবে নতুন জীবন লাভ করবে। তুমি কি দেখনি যে তা হলুদ বর্ণে প্যাঁচযুক্ত গজায়। সহীহ বুখারী হা/২২।

[3]. তাদের একজন বলেছে যে, সে তাওহীদ শিক্ষা গ্রহণ করাকে তুচ্ছ মনে করে। অথচ প্রত্যেক নাবী, রসূল আলাইহিমুস সালাম যুগ যুগ ধরে তাদের জাতিকে তাওহীদের দিকেই আহবান করেছেন।

তিনি ‘হাকাযা ইলমুল ‘আম্বিয়া’ নামক গ্রন্থের  ৪৩-৪৪ নং পৃষ্ঠায় বলেন: নিশ্চয়ই তাওহীদ বা ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে এক সাব্যস্ত করা এটা মহান ও ভিত্তিমূলক বিষয়। সকল নাবী, রসূল আলাইহিমুস সালাম এই এক পথের প্রতিই আহবা্ন করেছেন এবং তা জটিলতা ও দূর্বোধ্যতা মুক্ত সুস্পষ্ট বিষয় যা সবাই বুঝতে পারে। দশ মিনিট ব্যাখ্যা করলেই যেকোন ব্যক্তিই সহজে হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়।

আমি বলব এ বিষয়টি যদি তাই হতো তাহলে সাইয়্যিদ কুতুব, হাসানুল বান্না এবং তাদের দলের লোকেরা আকীদার ক্ষেত্রে যাদের পদস্খলন ঘটেছে তারা দশ মিনিট দূরে থাক দশ বছরেও বুঝতে সক্ষম হয়নি কেন?

যদি বিষয়টি তাই হয়, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা ধারাবাহিকভাবে রসূল প্রেরণ করেছিলেন্ কেন?

নূহ আলাইহিস সালাম তার কওমকে কেন নয়শত পঞ্চাশ বছর যাবত দাওয়াত দিয়েছিলেন? আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَا آمَنَ مَعَهُ إِلاَّ قَلِيلٌ তাদের সাথে খুব অল্প সংখ্যক লোকই ঈমান এনেছে। (সূরা হুদ আয়াত ৪০)

কেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় তের বছর যাবত অবস্থান করে তাওহীদের দিকে আহবান করলেন? কেনইবা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক জুমু‘আর খুত্ববাহ ও প্রত্যেক মাশওয়ারার সময় বারবার বলতেন,  شر الأمور محدثاتها وكل بدعة  ضلالة ‘‘সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো নব আবিষ্কৃত বিষয় আর প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী/ভ্রষ্টতা। (মুসলিম হা/৮৬৭)

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম মৃত্যু শয্যায় শায়িত আবস্থায়ও বলেছেন,  ( لعن الله  اليهود والنصارى اتخذوا قبور أنبيائهم مساجد আল্লাহ তা‘আলা খ্রিষ্টানদের উপর লা‘নাত বর্ষণ করুন। তারা তাদের নাবীদের কবরকে মাসজিদ (সাজদার স্থল) বানিয়েছে। (বুখারী  হা/১৩২৪, ১২৬৫)

এতদসত্ত্বেও আমরা একটা দলকে পাই যারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হুনাইনের যুদ্ধে যাওয়ার পথে বলেছিল اجعل لنا ,ذات أنواط كما لهم ذات أنواط তাদের যেমন  যাতে -আনওয়াত্ব রয়েছে আপনি আমাদের জন্যও তেমনি যাতে আনওয়াত্ব নির্ধারণ করে দিন (ইবনু হিববান হা/৬৭০২)

ঐ সকল আরব যারা মক্কা বিজয়ের পর হুনায়ন আভিযানের পূর্বে দশ মিনিট বাদ দিলাম দশ দিন বা বিশদিন সময় পেয়েছিল তারাও কেন বুঝতে সক্ষম হলো না ?

সুতরাং দাঈ ও অন্যান্যদেরকে এ ব্যাপারে সর্তক থাকা উচিত যে, তাওহীদ শিক্ষা লাভ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইতিহাস ও বাস্তবতা সাক্ষ্য দেয় যে তাওহীদ শেখাও। বারবার তাওহীদের আলোচনা করা প্রয়োজন।

মহা সত্যবাদী নাবী মুহাম্মাদ্দ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ও বান্দার উপর আল্লাহর অধিকার তাওহীদ নিয়ে বারবার আলোচনা করার গুরুত্ব বুঝায়। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,  يبعث الله على رأس كل سنة من يجدد لهذه الأمة دينها ‘‘আল্লাহ প্রতি একশত বছর পর পর একজন মুজাদ্দিদ প্রেরণ করেন যিনি এই উম্মাহর দীনকে সংস্কার করেন’’ (আবু দাউদ হা/৪২৯১, ফাতহুল বারী ১৩/২৯৫) মানুষ কে তাওহীদ শেখানো এতই সহজ হতো তাহলে আল্লাহ তা‘আলা মুজাদ্দিদ প্রেরণ করতেন না। দীন থেকে সবচেয়ে বেশি যে জিনিস নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তা হলো তাওহীদ ।