পবিত্রতার বিপরীত হলো নাপাকি। নাপাক হলে নামায কবুল হয় না, কুরআন ছোঁয়া যায় না, এমনকি কাবাঘরও তাওয়াফ করা জায়েয নেই ।
প্রধানত: দুভাবে মানুষ নাপাক হয়। এর মধ্যে প্রথমটি হলো, কলব বা অন্তর নাপাক হয়ে যাওয়া । আর দ্বিতীয়টি হলো, দেহ নাপাক হওয়া।
মানুষের কলব নাপাক হয় তার ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসের কারণে। আর এটা হলো, সবচেয়ে মারাত্মক নাপাকি। যেসব ভুল আকীদার কারণে কলব নাপাক হয় তা হলো:
১. শির্ক করা: মহান আল্লাহর উলুহিয়্যাত, রুবুবিয়্যাত ও নাম-গুণাবলির সাথে শির্ক করা।
২. সন্দেহ পোষণ: আল্লাহর অস্তিত্ব ও পরকাল আছে কি না এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করা বা তা অবিশ্বাস করা । যেমন- কাফিরেরা পরকালে বিশ্বাস করে না। আবার কিছু মুসলিমের মনে পরকাল নিয়ে সন্দেহ-সংশয় রয়েছে।
৩. মুনাফিকী চরিত্র: অন্তরের বিশ্বাসের সাথে বাস্তব কাজের গরমিল। অর্থাৎ বাইরে যা সে আমল করে প্রকৃতপক্ষে অন্তরে তা বিশ্বাস করে না।
৪. শির্ক মিশ্রিত আকীদা: এমন আকীদা বিশ্বাস পোষণ ও আমল করা যার সাথে শির্কী চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা মিশ্রিত রয়েছে ।
৫. রিয়া বা লোকদেখানো ইবাদাত: মানুষকে দেখানো বা সমাজে সুনাম-সুখ্যাতি অর্জনের জন্য ভালো কাজ করা।
৬. গোঁড়ামি বশতঃ সত্য বর্জন করা: সত্যকে সত্য বলে জানা সত্ত্বেও গোঁড়ামি বশতঃ তা গ্রহণ না করা।
৭. হিংসা করা: অন্যের ভালো দেখতে না পারা, এতে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়া এবং তা নষ্ট হয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা করা।
৮. তাকাব্বরী বা অহংকার করা: কথায় ও কাজে-কর্মে নিজেকে বড় ও অন্যকে ছোট মনে করা।
৯. বিদআতী ও কুফরী আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করা: এ কাজগুলোর সবকটাই কলবের সাথে জড়িত। এতেই কলব নাপাক হয় । আর কলব নাপাক হওয়া বান্দা যদি ওযু-গোসল করার মাধ্যমে পবিত্র হয় না। এ থেকে পবিত্র হতে হলে তাকে অবশ্যই তাওবা করতে হবে, এগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং খালেস দিলে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে ।
যেসব কাজ করলে শির্ক হয় এর তালিকা অনেক বড় । নিম্নে এর কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
পূজা করা, কোন পীর-বুজুর্গ ও কবরে-মাযারে সিজদা করা, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করা, নবী (স) বা কোন পীর মুর্শেদ গায়েবের খবর রাখেন বলে বিশ্বাস করা, গণক ও জাদুকরের কথায় বিশ্বাস করা, মাযারে গিয়ে কোন কিছু চাওয়া, কবরে দাঁড়িয়ে মৃত ব্যক্তির কাছে বিপদ থেকে মুক্তি চাওয়া, মাযারে মান্নত করা, আল্লাহ তাআলাকে যে পরিমাণ ভালোবাসা দরকার সে পরিমাণে কোন পীরকে মহব্বত করা, তাবীজ-কবজ ব্যবহার করা ইত্যাদি সবই বড় শির্ক ।
কথায়, কাজে ও বিশ্বাসে মানুষ এমনভাবে শির্কের মধ্যে সয়লাব হয়ে আছে এবং তাদের সংখ্যা। এত বেশি বেড়ে গেছে যে, কুরআন কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেন,
“ঈমানদার সম্প্রদায়ের মধ্যে শির্ককারীদের সংখ্যা অর্ধেকের বেশি। (সূরা ১২: ইউসুফ ১০৬)
অর্থাৎ ঈমানের দাবি করলেও অধিকাংশ মানুষই মুশরিক। আর যে কেউ শির্ক করলে তার দেহ-মন আদ্যোপান্ত নাপাক হয়ে যায়, যা ওযু-গোসল দিয়ে পাক হয় না । আল্লাহ তাআলা বলেন,
“যারা শির্ক করে তারা নাপাক।” (সূরা ৯; তাওবা ২৮)।
আর এ শির্কের মাধ্যমে বান্দার যে করুণ পরিণতি হয় তা হলো:
১. ঈমান ভঙ্গ হয়ে যায়,
২. তার পূর্বের সকল নেক আমল বাতিল হয়ে যায়। (সূরা ৩৯; যুমার ৬৫)
৩. তার ভালো কাজ ও ইবাদতগুলোকে ধুলায় ধুসরিত করে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হয় । (সূরা ২৫; ফুরকান ২৩; সূরা ২২; হাজ্জ ৩১)
৪. শির্ক করার পর ঐ লোক যেসব ইবাদত করে সেগুলোও কবুল হয় না। (সূরা ১৮; কাহফ ১০৫)। কারণ সে তখন ঈমান থেকে খারিজ হয়ে যায় । আর ইবাদত কবুলের প্রধান শর্ত হলো ঈমান থাকা। (সূরা ১৮; কাহফ ১০৭)
৫. তার বিবেক বিভ্রান্ত হয়ে যায় (সূরা ৪; নিসা ১১৬)। ফলে সে হককে বাতিল হিসেবে দেখে এবং বাতিলকে সে হক বলে তা আমল করে। এভাবেই সে ধ্বংস হয়ে যায় ।
৬. জান্নাত চিরতরে তার জন্য হারাম হয়ে যায় (সূরা ৫; মায়িদা ৭২)। যদিও সে মুসলিম পিতার সন্তান এবং নিজেকে সে মুসলিম বলে দাবি করে।
৭. জাহান্নাম হবে তার জন্য চিরস্থায়ী ঠিকানা (সূরা ৯৮; বাইয়্যিনা ৬) (নাউযুবিল্লাহ)
যারা এক বা একাধিক শির্ক জেনে বা না জেনে করে ফেলেছে ভয়াবহ এ পরিণতি থেকে তাদের বাঁচার পথ হলো খালেছ দিলে তাওবা করা । আবার ঈমান ও তাওহীদের প্রতি প্রত্যাবর্তন করা এবং সত্যিকারভাবে অনুতপ্ত হওয়া । সর্বপ্রকার শির্কী আকীদা বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করা এবং এ ধরনের অপরাধ পুনরাবৃত্তি না করার দৃঢ় প্রত্যয়। ব্যক্ত করা। আর এ তাওবা অবশ্যই জীবদ্দশায় হতে হবে; মৃত্যুর পরে নয়। এভাবে হলে আল্লাহ তাআলা তার শির্কী গোনাহও ক্ষমা করে দেবেন ইনশাআল্লাহ। আর তাওবা ছাড়া মৃত্যু হলে জাহান্নাম হবে চিরস্থায়ী।
এগুলো প্রকার ও ধরনের যেমন: এমন বিশ্বাস রাখা যে
১. আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান (আস্তাগফিরুল্লাহ), এটি একটি বহুল প্রচলিত ভুল আকীদা । অথচ শুদ্ধ হলো আল্লাহ নিজেই কুরআনে বলেছেন যে, তিনি উপরে আরশে আযীমে আছেন। (সূরা ২০; ত্বা-হা ৫) আর এ জন্যই আমরা দু'হাত উপরে উঠিয়ে দু'আ করি ।
২. মুহাম্মাদ (স) নূরের তৈরি। এটি এক মারাত্মক ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস । অথচ শুদ্ধ হলো তিনি মানুষ । আর যেহেতু সকল মানুষ মাটির তৈরি, সেহেতু তিনিও মাটি থেকেই সৃষ্টি । (সূরা ২০; ত্বা-হা ৫৫)। এছাড়াও আরো অনেক ভ্রান্ত আকীদা ও আমল সমাজে ছড়িয়ে আছে যেগুলোতে ঈমান চলে যায়। তাওবা করে এগুলো থেকে বের হয়ে আসলে নাপাক কলব আবার পবিত্র হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
নাপাকিকে আরবীতে - (নাজাসাত) বলা হয়। আর নাজাছা' হলো অপবিত্রতা অর্থাৎ পবিত্রতার বিপরীত। নাপাকি হলো এমন ধরনের ময়লা অপরিচ্ছন্নতা যা থেকে দূরে থাকার জন্য আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ নাপাকি প্রধানত, দুই প্রকার
(১) হুকমি ও (২) হাকীকী। এ দুই প্রকারে প্রত্যেকটি আবার দুই ভাগে বিভক্ত। নিচের ছকের মধ্যে এর প্রকারভেদ দেখানো হলো:
(নাপাকি)
- হুকমি
- হাকীকী
(হুকমি)
- ছোট নাপাকি
- বড় নাপাকি
(হাকীকী)
- গালীযা (তীব্র)
- খাফীফা (হালকা)
১. নাজাসাতে হুকমী: ওযূ করার পর একজন লোক পেশাব করল। ফলে সে নাপাক হয়ে গেল। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নদোষ হলো । এতেও সে নাপাক হয়ে গেল । ব্যক্তিটি কিন্তু নাপাক নয়। এ লোকটি নাপাক হয়েছে পেশাব বা স্বপ্নদোষের কারণে । কোন একটা কারণে নাপাক হওয়ার দরুন এটাকে বলা হয় হুকুমগত নাপাকি অর্থাৎ নাজাছাতে হুকমিয়্যাহ
এ জাতীয় নাপাকি আবার দু' প্রকার:
ক. ছোট নাপাকি: কেউ পেশাব করল বা পায়খানা করল বা বায়ু বের হলো, ফলে লোকটি এখন নাপাক। এ ব্যক্তি কেবল ওযূ করলেই আবার পবিত্র হয়ে যাবে ।
খ. বড় নাপাকি: কারোর স্বপ্নদোষ হলো বা কেউ স্ত্রী সহবাস করল । এ ব্যক্তিটি এখন যে ধরনের নাপাকী হলো সেটা হলো বড় নাপাক। এমন নাপাকী থেকে পবিত্র হতে হলে ওযূ নয়, গোসল করতে হবে । আর এ গোসলটি হলো ফরয গোসল । সারসংক্ষেপ হলো- ছোট নাপাক হলে শুধু ওযু এবং বড় নাপাক হলে গোসল করে পবিত্র হতে হয়।
২. নাজাসাতে হাকীকী হলো মূল বস্তুটিই নাপাক । যেমন- পেশাব, পায়খানা, শূকর, কুকুর, মদ ইত্যাদি। ধৌত করে এগুলোকে পবিত্র করা সম্ভব নয়। কারণ এগুলো প্রকৃত নাপাক বস্তু। এসবকে আবার ‘নাজাছাতে আইনিয়্যাহও বলা হয়। অর্থাৎ এগুলো নিজেরাই নাপাক। এ নাপাকি আবার দু প্রকার:
ক. গালীযা অর্থাৎ তীব্র নাপাক
খ. খাফীফা অর্থাৎ হালকা নাপাক
(ক) নাজাছাতে গালীযা হলো তীব্র নাপাকী। যেসব নাপাকি অতিমাত্রায় তীব্র সেগুলো হলো নাজাছাতে গালীযা । সংক্ষেপে এগুলো হলো:
ক. প্রাণীকূল
১. কুকুর, ২. শূকর, ৩. ইঁদুর, ৪. এমন মৃত জানোয়ার যা শরয়ী পদ্ধতিতে জবাই করা হয়নি । তবে মাছ ব্যতীত । ৫. যেসব প্রাণী পায়খানা খায় ।
খ. জড় পদার্থ
১. মদ ও মাদক দ্রব্য, ২. কুকুরের মুখ দেওয়া পাত্র। (মুসলিম: ২৭৯)
গ. দেহ থেকে নির্গত বস্তু
১. মানুষের পেশাব, পায়খানা ।
২. হায়েযের রক্ত, মেয়েদের প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে নির্গত যেকোন তরল পদার্থ ।
৩. মৃত প্রাণীর দেহ থেকে নির্গত তরল পদার্থ।
৪. মণি অর্থাৎ সাদা গাঢ় বীর্য (বুখারী: ২৩০, আধুনিক)।
অপর একদল ফকীহর মতে, মণি নাপাক নয় । (শরহুল মুসলিম-লিন্নববী- ৩/১৯৭)
৫. মযী অর্থাৎ এমন এক প্রকার সাদা তরল পদার্থ, যা স্ত্রী সহবাসের পূর্বে বা এ জাতীয় অনুভূতির সময় শরীর থেকে নির্গত হয়।
৬. অদী, রোগের কারণে কারো কারো প্রস্রাবের পর এক প্রকার গাঢ় সাদা পানি বের হয়। এটা হলো অদী ।
৭. হালাল প্রাণীর প্রবহমান রক্ত। অবশ্য মাংসের সাথে লেগে থাকা রক্ত নয়। হালাল প্রাণী হলো যেসব প্রাণীর মাংস খাওয়া হালাল।
৮. হারাম প্রাণীর গোবর ও পেশাব । যেসব প্রাণীর মাংস খাওয়া হারাম সেগুলোকেই হারাম প্রাণী বলা হয়।
(খ) আর নাজাসাতে খাফীফা হলো হালকা নাপাকী। যেমন:
১. মানুষের বমি, রক্ত ও পূজ,
২. হারাম পাখির মলমূত্র,
৩. হালাল পশুর গোবর ও পেশাব,
৪. ঘোড়ার পেশাব।
কুকুর ও শূকরের ঝুটা ও লালা নাপাক । তাছাড়া বন্য হিংস্র প্রাণীর ঝুটাও নাপাক যদিও তা অল্প পানিতে পতিত হয়। তবে মানুষের ঝুটা নাপাক নয়, এমনকি বিধর্মী হলেও। ঋতুবতী মহিলার ঝুটাও পাক । অতএব, যেকোন ধর্মের মানুষ এবং যেসব প্রাণীর মাংস খাওয়া জায়েয এসব হালাল প্রাণী এমনকি গাধা ও বিড়ালের মুখ দেওয়া পানিতেও ওযূ গোসল করা জায়েয।
হাড়ি-পাতিল ও বাসনপত্রে কুকুর মুখ দিলে পাত্রটি ৭ বার ভালো করে ধৌত করতে হবে । এর মধ্যে ৭ম বার অর্থাৎ শেষ বার মাটি দিয়ে বা সাবান দিয়ে ঘষেমেজে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। এতে পাত্রটি পবিত্র হয়ে যাবে। আর বিড়ালে মুখ দিলে তা নাপাক হয় না। তখন তা সাধারণভাবে শুধু পানি দিয়ে ধুয়ে নিলেই চলবে ।