এর অর্থ হলো, ইবাদাত সংশ্লিষ্ট ফিকহ । আর ‘ফিকহ’ শব্দের অর্থ হলো, সূক্ষ ও গভীর জ্ঞান । “ফিকহুল ইবাদাত' হলো এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্র যেখানে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ | ভিত্তিগুলোর মধ্যকার নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত এবং নামায শুদ্ধ হওয়ার পূর্ব শর্ত পবিত্রতা। অর্জন- ইত্যকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শরী'আতের মাসআলা-মাসায়েল বর্ণনার সমাহার। যেখানে রয়েছে সুক্ষাতি সুক্ষ গভীর জ্ঞানের আলোচনা-পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ যা একজন মুসলমানের প্রতিদিনের একান্ত আবশ্যকীয় দিক-নির্দেশনা । কিভাবে মানুষ শুদ্ধরূপে পবিত্রতা অর্জন করবে, সালাত আদায় করবে, সাওম পালন করবে, হজ্জ পালন ও যাকাত দিবে তার দলীলভিত্তিক আলোচনা ।
প্র: ইবাদাত কবুলের শর্ত কয়টি ও কী কী?
উ: ইবাদাত কবুলের শর্ত ৪টি, যথা:
১. ঈমান থাকা: অর্থাৎ কাফির ও মুশরিক থাকা অবস্থায় কোন ইবাদাত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি ঈমানের প্রতি সন্দেহ পোষণ করলে বা ঈমান ছুটে গেলে ইবাদাত কবুল হবে না।
২. ইখলাস: অর্থাৎ মুমিন ব্যক্তির প্রতিটি ভালো কাজ শুধুমাত্র আল্লাহ তা'আলাকে খুশি করার জন্য হতে হবে। অন্য কোন স্বার্থে তা করলে ইবাদাতের কাজটিও ইবাদাত হবে না। এমনকি আল্লাহও খুশি হবেন, সাথে দুনিয়াবী একটি স্বার্থ হাসিল হবে এ দুই নিয়ত একত্র। করলে এটিও ইবাদাত হিসেবে কবুল হবে না। সকল প্রকার ইবাদাত ও ভালো কাজ একমাত্র আল্লাহ তা'আলাকে খুশি করার নিয়তে করতে হবে । একেই বলা হয় ইখলাস।
৩. সুন্নাত তরীকা: জীবনের সকল কর্মকাণ্ড শুধুমাত্র আমাদের নবী মুহাম্মাদ (স)-এর সুন্নত তরীকায় আদায় করতে হবে। তবেই এটি ইবাদাত বলে গণ্য হবে, নতুবা নয়। বিশুদ্ধ দলীল ছাড়া বা মনগড়া কিছুই করা যাবে না। পূর্ব থেকে চলে আসছে, রেওয়াজ আছে অথচ এর পক্ষে সহীহ শুদ্ধ দলীল নেই এমন কিছুই করা যাবে না। করলে তা ইবাদাত হিসেবে গণ্য হবে না। সাওয়াব তো হবেই না। টয়লেট ব্যবহার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পরিচালনা পর্যন্ত আপনি যে কাজটিই নবীজির (স) সুন্নত তরীকায় করবেন সেটিই ইবাদাত হয়ে যাবে এবং পরকালে এর সাওয়াব পাবেন ।
৪. শির্কমুক্ত থাকা: সর্বাবস্থায় আপনাকে শির্কমুক্ত থাকতে হবে। কারণ শির্ক করলে ইবাদাত বাতিল হয়ে যায় (সূরা ৩৯; যুমার ৬৫)। যে মুসলমান শির্ক করবে বেহেশত চিরকালের তরে তার জন্য হারাম হয়ে যায় । (সূরা ৫, মায়িদা ৭২; সূরা ২২, হজ্জ ৩১; সূরা ৪, নিসা ৪৮; সূরা ১২, ইউসুফ ১০৬)।
যেসব কাজ করলে বড় শির্ক হয় এর কিছু দৃষ্টান্ত নিচে দেওয়া হলো:
কবরে মৃত ব্যক্তির কাছে সাহায্য চাওয়া, কোন পীর মুর্শিদ বা কবরস্থ ব্যক্তির কাছে বিপদ। মুক্তি কামনা বা সন্তান চাওয়া, মাজারে বা কোন মানুষকে সিজদা করা, আল্লাহর নির্দেশের বিপরীতে মানুষের নির্দেশ মান্য করা, পীরের উপর ভরসা করা, গণকের কথায় বিশ্বাস করা, আলিমুল গায়েব হলেন একমাত্র আল্লাহ অথচ কোন পীরকে গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করা, জাদু করা, তাবিজ ব্যবহার করা ইত্যাদি। এগুলো ছাড়া আরো অনেক বড় শির্ক আছে । আর ছোট শির্ক তো আছেই। এগুলো সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে । আগে কোন শির্ক করে থাকলে তাওবাহ করে পাকসাফ হতে হবে । উপরে বর্ণিত ৪টি শর্তের একটি শর্তও যদি বাদ পড়ে যায় তাহলে বান্দার ইবাদাত বাতিল হয়ে যাবে। কোন ইবাদতই কবুল হবে না, কোন ভালো কাজেরই সাওয়াব পাওয়া যাবে না। এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জানিয়ে দেয়া, মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব।
ওযু যেমন ছুটে যায়, সালাত যেমন নষ্ট হয়, রোযাও যেমন ভঙ্গ হয়ে যায় তেমনি ইসলামও ছুটে যায়, ঈমানও ভঙ্গ হয় গুরুতর কিছু পাপের কারণে, ফলে ঐ পাপী ব্যক্তি মুসলমানের মিল্লাত থেকে বহিস্কৃত হয় এবং সেটা কী কারণে হয় তা আমরা অনেকেই জানি না। আর এটাই সবচেয়ে বড় বিপজ্জনক বিষয় । যেসব পাপের কারণে ইসলাম থেকে মানুষ বহিস্কৃত হয়ে যায়, পরিণতিতে তার সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যায় এবং তাওবাহ না করলে কাফিরদের মতোই চিরস্থায়ী জাহান্নামী হতে হবে সে বিষয়গুলোর সার সংক্ষেপ মক্কা শরীফের দারুল হাদীসের শিক্ষক ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা আল্লামা মুহাম্মদ বিন জামিল যাইনুর রচনাবলি থেকে নিচে এ জাতীয় পাপ কাজের একটি তালিকা তুলে ধরা হলো:
১. শির্ক করা
যেমন নবী বা মৃত আওলিয়াদের নিকট কিছু চাওয়া অথবা কোন ওলী আওলিয়ার অনুপস্থিতিতে দূর থেকে তার কাছে সাহায্য চাওয়া অথবা ঐ পীর বুজুর্গের উপস্থিতিতে তার কাছে এমন কিছু চাওয়া যা দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই । আল্লাহ তাআলা বলেন,
(হে নবী!) “শির্ক যদি তুমিও করো তাহলে তোমার সকল ইবাদত বাতিল হয়ে যাবে । অতঃপর তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে।” (সূরা ৩৯; যুমার ৬৫)
প্রিয় ভাই! ভেবে দেখুন, প্রিয়নবী যদি শির্ক করেন তাহলে তাঁর ইবাদতগুলোও বরবাদ করে দেওয়া হবে । আর আমরা সাধারণ মানুষ যদি শির্ক করি তাহলে আমাদের অবস্থা কি হবে! এ সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
“আর আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন কাউকে ডেকো না, যে না করতে পারে তোমার কোন উপকার, আর না করতে পারে তোমার ক্ষতি । আর যদি তা করেই ফেল, তবে অবশ্যই তুমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।” (অর্থাৎ তুমি মুশরিক হয়ে যাবে ।) (সূরা ১০; ইউনুস ১০৬)
এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“যে ব্যক্তি এ অবস্থায় মারা যায় যে, সে আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে তার সমকক্ষ দাঁড় করিয়ে তার কাছে সাহায্য চায়, তাহলে সে জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে।” (বুখারী)
২. বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাসে তুষ্ট না থাকা
তাওহীদের কথা শুনে যাদের মনে বিতৃষ্ণা আসে এবং বিপদে-আপদে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া থেকে দূরে থাকে। আর অন্তরে মুহাব্বতের সাথে ডাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বা মৃত ওলী আওলিয়া ও জীবিত (অনুপস্থিত) পীর মাশায়েখদেরকে এবং সাহায্য চায় তাদেরই কাছে । আল্লাহ তাআলা বলেন,
“আখিরাতের প্রতি প্রকৃত ঈমান যারা আনেনি তাদের কাছে যখন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন তাদের অন্তরে বিতৃষ্ণা লাগে। আর যখন আল্লাহ ছাড়া অন্য উপাস্য (পীর বুজুর্গের) নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন তাদের মনে আনন্দ লাগে।” (সূরা ৩৯; যুমার ৪৫)।
৩. আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে পশু জবাই করা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অথবা কোন ওলীর নাম নিয়ে পশু যবাই করা। এটা নিষেধ করে আল্লাহ তাআলা বলেন,
“সুতরাং, তুমি শুধু তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো এবং তাঁরই জন্য (তাঁরই নামে) যবেহ করো।” (সূরা ১০৮; কাওসার ২)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে যবাই কার্য করে আল্লাহ তাআলা তার প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করেন।” (মুসলিম: ১৯৭৮) উল্লেখ্য যে, যবাইয়ের সময় কেউ যদি বলে, ‘খাজা বাবা-জিন্দাবাদ' তাহলে এটা তার ঈমান ভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
৪. কোন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মান্নত করা
যেমন কবরে মাযারে মান্নত করা (শিরনী দেওয়া) অত্যন্ত গর্হিত কাজ ও ঈমান বিনষ্টকারী পাপ এবং শির্ক ও কবীরা গুনাহ। কারণ, মান্নত একমাত্র আল্লাহর জন্যই হতে হবে। আল্লাহ। তাআলা বলেন,
“হে পালনকর্তা! আমার গর্ভে যে সন্তান রয়েছে আমি তাকে তোমার উদ্দেশ্যে মান্নত করলাম।” (সূরা ৩; আলে ইমরান ৩৫)
অতএব, সাবধান! মান্নতের জন্য ছাগল, গরু বা অন্যকিছু নিয়ে কক্ষণোই কোন কবরের পাশে যাবে না, গেলে ঈমান ছুটে যাবে।
৫. আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর উপর ভরসা করা
আল্লাহ তাআলা বলেন,
“একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা কর যদি তোমরা মুসলিম হয়ে থাক।” (সূরা ১০; ইউনুস ৮৪)
৬. গায়রুল্লাহকে সিজদা করা
জেনে-বুঝে কোন রাজা, বাদশা, পীর, বুজুর্গ, জীবিত বা মৃত ব্যক্তিকে ইবাদতের নিয়তে রুকূ বা সিজদা করা। কেননা, রুকূ বা সিজদা একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত ইবাদত । এ ধরনের কোন কাজ বান্দার জন্য করলে ঈমানদার ব্যক্তি বেঈমান হয়ে যাবে ।
৭. ইসলামের কোন একটি রুকন অস্বীকার করা
যেমন- ঈমান, সালাত, সওম, যাকাত যাকাত ও হজ্জ । অথবা ঈমানের কোন একটি রুকন অস্বীকার করা। যেমন আল্লাহ, তাঁর রাসূল, তাঁর ফেরেশতা, আসমানি কিতাব, তাকদীরের ভালোমন্দ এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থান এগুলোর উপর ঈমান আনতেই হবে । এর কোন একটিকে অস্বীকার করলে ঈমান বিনষ্ট হয়ে যায় ।
৮. ইসলামী আইনকে ঘৃণা করা
ইসলামী আইন হলো আল্লাহর বিধান । এর কোন বিধান পুরাতন বা অকেজো হয়ে গেছে মনে করা । এ উপদেশাবলিকে ঘৃণার চোখে দেখা । এতে ঈমান চলে যায় । আল্লাহ তাআলা বলেন,
“আর যারা কুফুরী করেছে তাদের জন্য রয়েছে নিশ্চিত ধ্বংস । আর তাদের কর্মফল বরবাদ করে দেওয়া হবে । ঐ কারণে যে, আল্লাহর নাযিল করা (কুরআন বা তার অংশ বিশেষকে) তারা অপছন্দের দৃষ্টিতে দেখে। ফলে আল্লাহ তাদের সকল নেক আমল বরবাদ করে দিবেন।” (সূরা ৪৭; মুহাম্মাদ ৯)।
৯. কুরআন-হাদীসের কোন বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা কিংবা ইসলামের কোননা হুকুম-আহকাম নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করা
এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,
“বল, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াতসমূহ ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেছিলে? (কাজেই আজ আমার সামনে) তোমরা কোন ওজর-আপত্তি পেশ করো না। ঈমান আনার পর (বিদ্রুপের করে) পুনরায় তোমরা কুফুরী করেছ।” (সূরা ৯; তাওবা ৬৫-৬৬)
অতএব, কুরআন-হাদীস নিয়ে ঠাট্টা করা হলো কুফরী কাজ, যার ফলে ঈমান চলে যায় ।
১০. কুরআন-হাদীসের কোন কথা অস্বীকার করা
জেনে-শুনে ইচ্ছাকৃতভাবে কুরআন কারীমের কিংবা বিশুদ্ধ হাদীসের কোন অংশ বা কথা অস্বীকার করলে ইসলাম থেকে বহিস্কার হয়ে যায়। যদিও তা কোন ক্ষুদ্র বিষয়ে হোক না কেন ।
(সূরা ৯; তাওবা ৬৫-৬৬)।
১১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে গালি দেওয়া
মহান রবকে গালি দেওয়া, দীন ইসলামকে অভিশাপ দেওয়া, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালি দেওয়া বা তার কোন অবস্থা নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করা, তার প্রদর্শিত জীবনবিধানের সমালোচনা করা । এ জাতীয় কর্মকাণ্ডের কোন একটি কাজ করলেও কাফির হয়ে যাবে, ঈমান চলে যাবে।।
১২. আল্লাহর কোন গুণাবলি অস্বীকার ও অপব্যাখ্যা করা
আল্লাহর অনেক সুন্দর সুন্দর নাম ও গুণাবলি রয়েছে। এগুলোর কোন একটিকে অস্বীকার করা অথবা তার কোন কার্যাবলি অস্বীকার করা বা এগুলোর অপব্যাখ্যা করা । আল্লাহ তাআলা বলেন,
“যারা আল্লাহ তাআলার নামের মধ্যে বিকৃতি ঘটায় তাদেরকে তোমরা বর্জন করো। এ কর্মকাণ্ডের জন্য তাদেরকে প্রতিফল দেওয়া হবে।” (সূরা ৭; আ'রাফ ১৮০)
অতএব, আল্লাহর কোন সিফাত বা নাম যেমন অস্বীকার করা যায়েয নেই, তেমনি তার। কোন গুণবাচক নামের অপব্যাখ্যা করলেও ঈমানহারা হয়ে যাবে ।
১৩. কোন একজন নবীকেও অবিশ্বাস বা তুচ্ছ মনে করা
রাসূলগণকে বিশ্বাস করলেও কোন একজন নবীকে অবিশ্বাস করা অথবা নবী রাসূলদের কোন একজনকে তুচ্ছ মনে করা বা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা । আল্লাহ তাআলা বলেন,
“আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কারো ব্যাপারে তারতম্য করি না।” (২; বাকারা ২৮৫)
অর্থাৎ ইয়াহুদীরা মূসা (আঃ)-কে এবং খ্রিস্টানেরা শুধু ঈসা (আঃ)-কে মান্য করে । আবার উভয় সম্প্রদায়ই মুহাম্মদ (স)-কে অমান্য করে, তারা উনাকে মানে না। কিন্তু আমরা যেমন রাসূলুল্লাহ (স)-কে মান্য করি তেমনি পূর্বেকার যামানার নবীদেরকেও মান্য করি, বিশ্বাস করি । এক্ষেত্রে আমরা কোন পার্থক্য করি না। অপর এক আয়াতে আছে আল্লাহ তাআলা বলেন,
“নূহ (আঃ)-এর কাউমের লোকেরা রাসূলদের অস্বীকার করেছিল।” (সূরা ২৬; শুআরা ১০৫)
অর্থাৎ নূহের প্রতি বিশ্বাস না রাখায় তারা ঈমান বহির্ভূতদের দলে শামিল হয়ে গেল।
১৪. আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে মানবরচিত আইন দিয়ে বিচার করা
আর এ ধারণা করা যে, এ যুগে ইসলামের আইন-কানুন আর চলবে না। কারণ এ আইন অনেক পুরাতন হয়ে গেছে । অথবা আল্লাহ প্রদত্ত আইনের বিপরীতে মানবরচিত আইনকে জায়েয মনে করা এবং আল্লাহর আইনের উপর মানুষের তৈরি আইনকে প্রাধান্য দেওয়া, কার্যকরী করা, বাস্তবায়ন করা। ঈমান ভঙ্গের এটি একটি বড় কারণ । আল্লাহ তাআলা বলেন,
“আর যারা আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করে না, তারা কাফিরদের মধ্যে গণ্য হয়ে যায়।” (সূরা ৫; মায়িদা ৪৪)
১৫. ইসলামী বিচারে সন্তুষ্ট না হওয়া
ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী বিচার হলে সেই বিচারে অন্তরে সংকোচ বোধ করা ও কষ্ট পাওয়া । বরং ইসলাম বহির্ভূত আইনের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে স্বস্তি বোধ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“কিন্তু না, (হে মুহাম্মাদ!) তোমার রবের শপথ। তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের মীমাংসার ভার তোমার উপর ন্যস্ত না করে, অতঃপর তোমার ফায়সালার ব্যাপারে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে, আর তারা সর্বান্ত করণে তার সামনে নিজেদেরকে পূর্ণরূপে সমর্পণ করে।” (সূরা ৪; নিসা ৬৫)
১৬. আল্লাহর আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এমন ধরনের আইন তৈরি করা
এ জন্য কোন মানুষকে ক্ষমতা প্রদান করা বা তা সমর্থন করা অথবা ইসলামী আইনের সাথে সাংঘর্ষিক এমন ধরনের কোন আইনকে সঠিক বলে মেনে নেওয়া । আল্লাহ তাআলা বলেন,
“তাদের কি এমন অংশীদার আছে যারা তাদের জন্য এমন কোন আইন-কানুন তৈরি করে নিয়েছে যার অনুমতি আল্লাহ তাদেরকে দেননি।” (সূরা ৪২; শূরা ২১)
১৭. হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল করে ফেলা
যেমন সুদকে বৈধ ঘোষণা দেওয়া বা হালাল মনে করা ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“আর আল্লাহ ব্যবসাকে বৈধ করেছেন, আর সুদকে করেছেন হারাম” (সূরা ২; বাকারা ২৭৫)।
আবার হালালকে হারাম করে নেওয়া। আমাদের দেশে কোন পীর এমনও আছে যারা তাদের মুরীদদের জন্য গরুর হালাল মাংস নিষিদ্ধ করে দেয়। এ নিষেধাজ্ঞাটা যদি হারামের মতো করে নেয় তাহলে হালালকে হারাম। করার কারণে ঈমান ছুটে যাবে।
১৮. আকীদা ধ্বংসাত্মক মতবাদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা
যেমন- নাস্তিক্যবাদ, মার্কসবাদ, সমাজতন্ত্র বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“আর যে কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কিছুকে দীন হিসেবে (অর্থাৎ জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করতে চাইবে, তা কক্ষণো কবুল করা হবে না। বরং সে ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে।” (সূরা ৩; আলে ইমরান ৮৫)।
১৯. ইসলামের কোন বিধান রদবদল করা বা মুরতাদ হওয়া
দীনের বিধিবিধান পরিবর্তন করা বা ইসলাম ছেড়ে অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করা অর্থাৎ মুরতাদ হয়ে যাওয়া । আল্লাহ তাআলা বলেন,
“আর তোমাদের যে কেউ নিজের দীন (ইসলাম) থেকে (অন্য ধর্মে) ফিরে যায়, অতঃপর সে ব্যক্তি কাফির অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তবে ঐ ধরনের লোকের (সমস্ত নেক) আমল, ইহকাল ও পরকাল উভয় জাহানেই বাতিল হয়ে যাবে। ফলে তারা হয়ে যাবে আগুনের বাসিন্দা। সেখানে (জাহান্নামে) তারা স্থায়ী হবে চিরকাল।” (সূরা ২; বাকারা ২১৭)
২০. মুসলিমদের বিরুদ্ধে অমুসলিমদেরকে সাহায্য করা
যেকোন কারণেই হোক মুসলমানদের বিপক্ষে গিয়ে অমুসলিমদের পক্ষাবলম্বন করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“মুমিনগণ যেন মুমিন ছাড়া কাফিরদের সাথে বন্ধুত্ব না করে । যদি কেউ এমন কাজ করে তবে আল্লাহর সাথে তার আর কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে তাদের যুলম হতে আত্মরক্ষার জন্য হলে ভিন্ন কথা।” (সূরা ৩; আলে ইমরান ২৮)
২১. অমুসলিমদেরকে অমুসলিম না বলা
কেননা যারা ঈমান আনেনি আল্লাহ তাআলা কুরআনে তাদেরকে কাফির বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাদের ব্যাপারে বলেছেন,
“নিশ্চয়ই কিতাবীদের মধ্যে যারা কুফুরী করেছে, আর যারা মুশরিক তারা জাহান্নামের আগুনে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে । তারাই হলো সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম।” (সূরা ৯৮; বাইয়্যেনা ৬) অর্থাৎ যারা অন্য ধর্মাবলম্বী তারাও সঠিক পথে আছে বলে মনে করা । তাদের ধর্মও ঠিক মনে করা । বরং কুরআন তাদেরকে কাফের হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
২২. আল্লাহকে সর্বত্র বিরাজমান মনে করা
এ আকীদা পোষণ করা যে, সবকিছুর মধ্যেই আল্লাহ রয়েছে এবং আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান, সব জায়গায় তিনি আছেন- এ আকীদাকে অহদাতুল উজুদ বলা হয়। এটা শির্কী আকীদা ।
এতে ঈমান ভঙ্গ হয়ে যায়। আল্লাহ কোথায় এ বিষয়ে কুরআনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে । আল্লাহ তাআলা নিজেই তার সম্পর্কে বলেছেন,
“আল্লাহ তাআলা আছেন আরশের উপরে।” (সূরা ২০; ত্বা-হা ৫)
“এক লোক বলে আমার রব কি আসমানে বা যমীনে তা আমি জানি না। তার সম্পর্কে ইমাম আবু হানিফাকে জিজ্ঞেস করা হলে উত্তরে তিনি বলেন, লোকটি কুফুরী করল। কেননা, আল্লাহ বলেন যে, তিনি আরশের উপরে আছেন। আর আরশ হলো (সাত) আসমানের উপরে।' (ঐ বিভ্রান্ত) লোকটি আরো বলল। আমি স্বীকার করি যে, তিনি আরশের উপর আছেন। কিন্তু। আরশ কি আকাশে না যমীনে তা আমি জানি না । [এমন আকীদা পোষণকারী সম্পর্কে ইমাম। আবু হানীফা (র) বলেন, আল্লাহ আসমানের উপরে- এটা যদি কেউ অস্বীকার করে তাহলে সে কাফির হয়ে গেল । (ফিকহুল আকবার পৃ. ১৩৫, শরহে আকীদা তহাওয়ীয়্যাহ পৃ. ৩০১), কিন্তু আল্লাহ সর্বত্র সবকিছু দেখেন ও শুনেন। কিন্তু কেউ যদি মনে করে যে আল্লাহ সবজায়গায় আছেন তাহলে তার ঈমান চলে যাবে।
২৩. ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে এবং রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা রাখা
আর একথা বলা যে, ইসলামে রাজনীতি নেই এরূপ ধারণা ও মন্তব্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে । আল্লাহ তাআলা বলেন,
“(হে মুহাম্মদ!) তুমি কি ঐসব লোকদেরকে দেখনি যারা দাবি করে যে, তারা তোমার ও তোমার পূর্ববর্তী নবীদের উপর নাযিলকৃত কিতাবের প্রতি ঈমান এনেছে, একই সাথে শাসনকার্য (ও বিচার ফয়সালার জন্য তারা আবার তাগূতের কাছে যায়। অথচ আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন তাগূতের কাফের হতে।” (সূরা ৪; নিসা ৬০)
তাগূত হলো- শয়তান, আল্লাহর বিধান পরিবর্তনকারী শাসক, আল্লাহর আইনের বিপরীতে তৈরি করা আইন দিয়ে বিচার-ফয়সালা করা, কেউ গায়েব জানে বলে দাবি করা এবং মানুষের পূজা ও সিজদা গ্রহণকারী ব্যক্তি ইত্যাদি। অতএব, ধর্ম ও রাষ্ট্র একটিকে অপরটি থেকে আলাদা করা ঈমান ভঙ্গকারী পাপ।
২৪. ইবাদতের নিয়তে কোন কবরের চারপাশে তাওয়াফ করা
আল্লাহ তাআলা বলেন,
“অতঃপর তারা যেন তাদের দৈহিক নাপাকি দূর করে, তাদের মান্নত পূর্ণ করে, আর তারা যেন বেশি বেশি এ প্রাচীনতম (কাবা) ঘরের তাওয়াফ করে।” (সূরা ২২; হাজ্জ ২৯) তাওয়াফ করবে শুধু আল্লাহর ঘর কাবাকে । এর বিপরীতে কেউ যদি কবরকে তাওয়াফ করে তাহলে তার ঈমান চলে যাবে।
২৫. একদল কুতুব পৃথিবী পরিচালনা করে বলে বিশ্বাস করা
কিছু কিছু বিভ্রান্ত সুফীরা বলে যে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া পরিচালনার দায়িত্ব কুতুব নামধারী কয়েকজন আওলিয়ার হাতে অর্পণ করেছেন। তাদের এ ধারণা আল্লাহর কাজে সাথে শির্ক হয়ে যায়। এ আকীদা আল্লাহর কালামের বিপক্ষে চলে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“আসমান ও জমিনের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার চাবি শুধুমাত্র আল্লাহরই হাতে।” (সূরা ৩৯; যুমার ৬৩)
যে আল্লাহর হাতে নিখিল সৃষ্টির কর্তৃত্ব, সেই কর্তৃত্ব কোন কুতুব আবদালের কাছে বলে দাবি করলে বা বিশ্বাস করলে তার ঈমান ছুটে যাবে। উপরে বর্ণিত বিষয়গুলো ওযু ভঙ্গের কারণের মতোই ঈমান ভঙ্গকারী কাজ।
ঈমান ভঙ্গ হয়ে গেলে সে লোকটি ইসলাম থেকে বহিষ্কার হয়ে যায়। ফলে তার সালাত, সাওম ইবাদত কবুলতো হবেই না। বরং সে অমুসলমান হয়ে আখিরাতে কাফিরদের সাথে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হয়ে যাবে । (নাউযুবিল্লাহ)।
তাকে আবার নতুন করে ইসলাম গ্রহণ করতে হবে । তাওবা করতে হবে খালেছ দিলে, অনুশোচনা করা ও অনুতপ্ত হতে হবে । ভবিষ্যতে এমন পাপের ধারে কাছেও আর যাবে না, এরূপ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। তার এ তাওবা হতে হবে মৃত্যুর পূর্বে, এতে ইনশাআল্লাহ তাআলা তাওবা কবুল হবে এবং আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন। আল্লাহর নামতো তাওয়াব এবং তিনি গাফুরুর রাহীম এবং তিনি অতিশয় দয়ালু ।
উল্লেখ্য যে, সিয়ামসহ যাবতীয় ইবাদত কবুল হওয়ার প্রথম ও অপরিহার্য শর্ত হলো ঈমান থাকা এবং তা ভঙ্গ হয়ে যায় এমন সর্বনাশা পাপ থেকে দূরে থাকা ।