আমরা যত কিছুই জানি না কেন আমাদের সকলের জ্ঞানের সমষ্টি আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞানের তুলনায় মহা সমুদ্রের একবিন্দু পানিরও সমতুল্য নয় কারণ; মহান আল্লাহর জ্ঞান হচ্ছে তাঁর সত্তাগত ব্যাপার, আর আমাদের জ্ঞান হচ্ছে অর্জনগত ব্যাপার। তিনি আমাদেরকে অনুগ্রহ করে পঞ্চেন্দ্রিয়[1], ইলমে জরুরী[2] ও ইস্তেদলালী[3] এর সাথে জ্ঞান ও বুদ্ধিকে ব্যবহার করে কিছু জ্ঞানার্জনের তৌফিক দিয়েছেন বলেই আমরা কিছু জানতে পারি। আমাদের অসাক্ষাতে ও পিঠের পিছনে যা কিছু ঘটে, সে সম্পর্কে কেউ সংবাদ না দিলে আমরা কিছুতেই তা জানতে পারি না বলে এ সব আমাদের সম্পূর্ণ অজানা ও অদৃশ্য থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে নবী, রাসূল, অলি ও সাধারণ মানুষ সকলেই সমান। মানুষের জন্য যা অজানা ও গায়েব তা দু‘ভাগে বিভক্ত :
এক. রেসালত ও এর সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি
দুই. সাধারণ বিষয়াদি
নবী ও রাসূলগণ রেসালত ও এর সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ক্ষেত্রে সংবাদ পেতেন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রত্যাদেশ বা ইলহাম অথবা সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে। আর পার্থিব বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত ব্যপারে সংবাদ পেতেন একইভাবে প্রত্যাদেশ বা ইলহাম অথবা সত্য স্বপ্ন বা স্বচক্ষে দেখা কোনো মানুষের সংবাদ প্রদানের মাধ্যমে। নবী ব্যতীত অন্যান্য সকল মানুষগণ অজানা বিষয়ের সংবাদ আল্লাহর ইচ্ছা হলে কখনও বা ইলহাম কখনও বা সত্য স্বপ্ন, কখনও বা স্বচক্ষে দেখেছে এমন কোনো মানুষের মাধ্যমে পেতে পারেন।
মোটকথা : যা কিছু আমাদের অসাক্ষাতে সংঘটিত হয় তা-ই অদৃশ্য বা গায়েবের অন্তর্গত বিষয়। এ সম্পর্কে অবহিত হওয়া কোনো মানুষেরই স্বভাব, প্রকৃতি ও তাদের গুণাবলীর মধ্যকার বিষয় নয়; বরং তা আল্লাহর একচ্ছত্র অধিকারভুক্ত বিষয়। তিনি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তা তাঁর নিজের জন্যেই রেখে দিয়েছেন। এটি তাঁর সত্তাগত গুণের অন্তর্গত বিষয়। মহান আল্লাহ এ জাতীয় গুণের একচ্ছত্র অধিকারী হয়েছেন বলেই তিনি আমাদের রব বা প্রতিপালক। তাঁর এ সব গুণ রয়েছে বলেই আমরা প্রকাশ্য ও গোপনে যা কিছুই করি না কেন তিনি তা সম্যকভাবে অবহিত রয়েছেন। তাঁর সৃষ্টির কেউ এ গুণের কম-বেশী অধিকারী হতে পারলে সে তো তাঁর এ বিশেষগুণের সাথে শরীক হয়ে যাবে। সে জন্যে তিনি কস্মিনকালেও তাঁর কোন সৃষ্টিকে এ গুণের নূন্যতম অধিকারীও করেন না।
গায়েবের যাবতীয় চাবিকাঠির একচ্ছত্র মালিক হলেন তিনিই। সে জন্য তিনি কুরআনুল কারীমে বলেন :
﴿ ۞وَعِندَهُۥ مَفَاتِحُ ٱلۡغَيۡبِ لَا يَعۡلَمُهَآ إِلَّا هُوَۚ وَيَعۡلَمُ مَا فِي ٱلۡبَرِّ وَٱلۡبَحۡرِۚ وَمَا تَسۡقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلَّا يَعۡلَمُهَا وَلَا حَبَّةٖ فِي ظُلُمَٰتِ ٱلۡأَرۡضِ وَلَا رَطۡبٖ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَٰبٖ مُّبِينٖ ٥٩ ﴾ [الانعام: ٥٩]
‘‘আর আল্লাহর নিকটেই রয়েছে গায়েবের সকল চাবিকাঠি, তিনি ব্যতীত তা কেউ জানে না, স্থলে ও জলে যা কিছু রয়েছে তিনি তা অবগত রয়েছেন, গাছের একটি পাতা পড়লেও তিনি তা জানেন, পৃথিবীর অন্ধকার অংশে কোন শষ্যকণা বা কোন আদ্র বা শুষ্ক বস্তু পতিত হলে তাও প্রকাশ্য গ্রন্থে লিপিবদ্ধ রয়েছে।’’[4] আল্লাহ তা‘আলা তাঁর গায়েব সম্পর্কে জানার ব্যাপারে উক্ত আয়াতে উদাহরণস্বরূপ যা কিছুর বর্ণনা দিয়েছেন, কোনো মানুষের পক্ষে- তিনি যত বড় মর্যাদারই অধিকারী হোন না কেন- আল্লাহ বা অপর কোনো মানুষ তা স্বচক্ষে দেখে তাকে তা জানিয়ে না দিলে তার পক্ষে তা নিজ থেকে কোনোভাবেই জানা সম্ভবপর নয়। গায়েবের জ্ঞান বলতে কেবল আখেরাতের সাথে সম্পর্কিত বিষয়কেই বুঝায় না; বরং গায়েব বলতে সে সকল বিষয়ও বুঝায়, যা আমাদের অসাক্ষাতে বা পিঠের পিছনে সংঘটিত হয়, যদিও অপর কারো সামনে তা সংঘটিত হওয়ার কারণে সে ব্যক্তির নিকট তা গায়েব নয়। কিন্তু আল্লাহর ব্যাপার হলো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, তিনি হলেন :
﴿عَٰلِمُ ٱلۡغَيۡبِ وَٱلشَّهَٰدَةِۖ ﴾ [الحشر: ٢٢]
‘‘সকল গায়েব ও উপস্থিতের জ্ঞানী।’’[5] কোন বস্তুর হাযির বা গায়েব হওয়া মূলত আমাদের বিবেচনায়, আল্লাহর বিবেচনায় গায়েব ও হাজির বলতে কিছুই নেই, কেননা; সব কিছুই তাঁর কাছে উপস্থিত বা হাজির। এমন কোনো বস্তু নেই যা তাঁর জ্ঞান ও দৃষ্টির বাইরে থাকতে পারে।
>[2]. .العلم الضروري : কোন বিষয়ে কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়াই যে জ্ঞান অর্জিত হয়, সে জ্ঞানকে ‘আল-ইলমুদ দরূরী’ বলা হয়। তর্কশাস্ত্রবিদগণ এ জ্ঞানকে التصديق البديهي বলে থাকেন। যা সাত প্রকার : ১. بديهيات : প্রথম দৃষ্টিতেই যে জ্ঞান অর্জিত হয়, তাকে ‘বদেহিয়্যাত’ বলা হয়। ২. حسيات যে শক্তির সাহায্যে বুদ্ধি অতি দ্রুত কোন বস্তুকে অনুধাবন করতে পারে, তাকে ‘হিসসিয়্যাত’বলা হয়। ৩.وجدانيات : হিসসিয়্যাত এর নিকটবর্তী একটি শক্তিকে ‘বিজদানিয়্যাত’ বলা হয়। ৪. فطريات : যে সকল ব্যপারে দৃঢ় বিশ্বাস অর্জনের জন্যে অন্যান্য মাধ্যমের প্রয়োজন হয়, সে-গুলোকে ‘ফিতরিয়্যাত’ বলা হয়। ৫.حدسيات : যে শক্তির সাহায্যে মানুষ কোন বস্তুকে পরিচয় করতে পারে, তাকে ‘হাদাসিয়্যাত’ বলা হয়। এ শক্তিকে ‘ফারাসত’ও বলা হয়ে থাকে। মুল্লা ‘আলী ক্বারী আল-হানাফীর মতে ‘ফারাসত’ এর মূল হচ্ছে: তা অন্তরে হঠাৎ করে উদিত হয়ে এমনভাবে জেঁকে বসে যেমন সিংহ শিকারের উপর জেঁকে বসে। মুল্লা ‘আলী আল-ক্বারী আল-হানাফী, শরহু কিতাবিল ফিকহিল আকবার; প্রাগুক্ত; পৃ. ১১৫। ৬. مجربات : যা অভিজ্ঞতার আলোকে জানা যায়, তাকে ‘ মুজাররাবাত’ বলা হয়। ৭. متواترات : বিভিন্ন স্থানের অসংখ্য মানুষের ঐকমত্যের ভিত্তিতে যা জানা যায়, তাকে ‘মুতাওয়াতিরাত’ বলা হয়। এ শর্তে যে, তাদের মিথ্যার উপর একমত হওয়া বুদ্ধির কাছে অসম্ভব বলে মনে হয়।
[3].العلم الاستدلالي : এটি এমন এক জ্ঞানকে বলা হয় যার মাধ্যমে অপর বস্তু পরিচয়ের ব্যপারে দলীল পেশ করা হয়। যেমন- জ্যোতির্বিজ্ঞান, বালুকণার বিভিন্নতার জ্ঞান, ঔষধের নীতিমালা, গণিতবিদ্যা, টেলিযোগাযোগ ও ডাক্তারী পরীক্ষা নিরীক্ষার যন্ত্রপাতির সংকেতসমূহ জানার জ্ঞান।
[4]. আল-কুরআন, সূরা আল-আন‘আম : ৫৯।
[5]. আল-কুরআন, সূরা আল-হাশর : ২২।